০৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

বেহাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাল ধরবে কে?

দেলোয়ার জাহিদ
  • প্রকাশ: ০৯:৫২:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৭৪৩ বার পড়া হয়েছে

বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এখন সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ও দুর্নীতির কবলে পতিত হয়েছে। | ছবি: ডেইলি স্টার


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

‘মাত্র দুটি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক মোশতাক আহমেদ। প্রতিবেদনের সারাংশতে বলা হয়, “১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করেছে। তবে অনেকগুলো পরিণত হয়েছে সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে।…  সব মিলিয়ে অন্তত ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ বছরের বিভিন্ন সময়ে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সব কটিই বিভিন্ন মাত্রায় অনিয়ম পাওয়া গেছে। যার বিপরীতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।…আরও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে জানিয়ে ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ওমর ফারুখ প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত করা হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। আবার নিজস্ব এখতিয়ার অনুযায়ী কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ইউজিসি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইউজিসির অবস্থান হলো, এখন অনিয়ম করলে কেউ আর ছাড় পাবে না।”

প্রতিবেদনটিতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে যে বিষয়গুলো নিয়ে অব্যাহতভাবে লেখালেখি হলেও এর প্রতিকারে প্রশাসন নীরব ও নির্বিকার। দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে মানসম্মত শিক্ষা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হাজারো শিক্ষার্থী। দৈনিক যুগান্তরে গত ৫ অগাস্ট ২০২২ একটি নিবন্ধ এ লিখেছিলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: একাডেমিক উৎকর্ষতা ও দক্ষ প্রশাসনিক নেতৃত্ব নিয়ে-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে এর একাডেমিক ও প্রশাসনিক উৎকর্ষতা এবং উভয় ক্ষেত্রেই যোগ্য একাডেমিক কর্মী প্রশাসক; যা ছাত্রছাত্রীদের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ করে।…গত ১ জুলাই দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে এ বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র উঠে এসেছে- ‘মানবসম্পদ উন্নয়নের সর্বপ্রথম ধাপ শিক্ষা। মানবসম্পদের দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশের থেকে বাংলাদেশ অনেক বেশি এগিয়ে। কাজেই মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার গুরুত্বটাও এখানে বেশি দেওয়া প্রয়োজন।…শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড—এটি আমরা সবাই জানি, কিন্তু আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার দায়িত্ব যারা কাঁধে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই সেই দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন তো করছেনই না; বরং শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।’

…একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে রাষ্ট্রপতির (চ্যান্সেলর) ভূমিকা এবং ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার নিয়োগ তাদের নির্বাচন পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা বিবেচনা করে যে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতিনিধিত্ব, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণের নামে প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সমালোচনামূলক সংকেত প্রদান করে; ইস্যুটি নিয়ে আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার কারণ এ মূল্যবোধগুলি সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মৌলিক ভিত্তি গঠন করে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন পদ্ধতিগুলি অন্বেষণ করলে আমাদের বর্তমান ব্যবস্থার বিচ্যুতিগুলো সহজে ধরা পড়ে।…শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়া ও শিক্ষকতার মতো একটা পবিত্র ও মহান পেশা নিম্নস্তরে কোথায় নেমে যাচ্ছে এবং কেন নেমে যাচ্ছে তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার ও কাজ করার সময় এসে গেছে, বিলম্বে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।”

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এর কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে ২০০১ সালের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকার কথা । দৃশ্যতঃ রাজনৈতিক বিবেচনায়  এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে যেগুলো নূন্যতম নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে সনদ বিক্রির একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলো সূত্রে  আরো প্রকাশ ইউজিসি চলতি বছরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্ত করেছে এবং করছে তার মধ্যে রয়েছে ঢাকার মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি, ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটি, চুয়াডাঙ্গার ফাস্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মানিকগঞ্জের এনপিআই বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

কুমিল্লায় সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে যে বিষয়ে প্রথম আলো লিখছে, “নামে বিশ্ববিদ্যালয়, ভর্তি বন্ধ” কুমিল্লায় ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। গত এপ্রিলে এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদনে ইউজিসি বলেছিল, সেখানে শিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি অনুপস্থিত। ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে চলছে একাধিক মামলা এবং সদস্যদের বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতির অভিযোগ। এ ছাড়া শিক্ষকসংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে, গবেষণা নেই। …তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, গত এপ্রিলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় ইউজিসি। এখনো তা বন্ধ রয়েছে। …নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন কর্মকর্তা সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই।” (ডিসেম্বর ৭, ২০২২) সংবাদসূত্রের বরাতে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি ফ্যাকাল্টির অধীন ১৬টি প্রোগ্রাম চালু রয়েছে যদিও নতুন ভর্তি ইউজিসির নির্দেশে বন্ধ রয়েছে।

এমন সংকটপূর্ণ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের  একমাত্র বৈধ কর্মকর্তা রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (দায়িত্বে) কে পাওনা বেতনভাতা বঞ্চিত করে দাপ্তরিক দায়িত্বপালন থেকে অবৈধভাবে বিরত রাখা হয়েছে।  এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের  রেজিস্ট্রার কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় গত অগাস্ট ১১, ২০২২  তারিখে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন যার তদন্ত কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক  ও পুলিশ সুপারকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। চার মাস সময়ের মধ্যে তদন্ত কর্ম্মকর্তা ও সাংবাদিক মাত্র একবার ঘটনাস্থলে গিয়েছেন, রেজিস্ট্রার অফিস  তালাবদ্ধ পেয়েছেন কারণ ও জানতে পেরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা হন্নে হয়ে তাদের সার্টিফিকেট ও মার্কশিট এর জন্য বৈধ কতৃপক্ষকে খোঁজছে।  বেসামাল পরিস্থিতিতে সম্পুর্ন্ন বেআইনিভাবে একজন ‘নবম গ্রেড’-এর কর্মকর্তা সার্টিফিকেট ও মার্কশিট ইস্যু করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বন্ধ সহ উদ্ভুত পরিস্তিতিতে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়ভাবে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে কিন্তু ইউজিসি  ও স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ন্ন নীরব। এ নিষ্ক্রিয়তার মূল্য দিতে হবে বিদ্যার্থীদের, মূল্য দিতে হবে পরিবারকে, মূল্য দিতে হবে দেশকে।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে সঙ্গত ভাবেই বলেছেন যে , “বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বেশ কিছু নিয়মকানুন আছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তা মানে, বেশির ভাগই তা মানে না। ইউজিসি এসব নিয়মকানুন মানাতে পারছে কি না, সেটাও একটি প্রশ্ন।”

তদন্তাধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ম নীতি অনুযায়ী একাডেমিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ব্যৰ্থ।  এ বিষয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার পরিণতি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনে অচলাবস্থা, নিয়োগ নৈরাজ্য, দুর্নীতি ও আইন অমান্যতার প্রতিকারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া  প্রয়োজন।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

দেলোয়ার জাহিদ

সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা, কানাডা) নিবাসী

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বেহাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাল ধরবে কে?

প্রকাশ: ০৯:৫২:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২২

‘মাত্র দুটি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক মোশতাক আহমেদ। প্রতিবেদনের সারাংশতে বলা হয়, “১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করেছে। তবে অনেকগুলো পরিণত হয়েছে সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে।…  সব মিলিয়ে অন্তত ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ বছরের বিভিন্ন সময়ে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সব কটিই বিভিন্ন মাত্রায় অনিয়ম পাওয়া গেছে। যার বিপরীতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।…আরও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে জানিয়ে ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ওমর ফারুখ প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত করা হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। আবার নিজস্ব এখতিয়ার অনুযায়ী কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ইউজিসি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইউজিসির অবস্থান হলো, এখন অনিয়ম করলে কেউ আর ছাড় পাবে না।”

প্রতিবেদনটিতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে যে বিষয়গুলো নিয়ে অব্যাহতভাবে লেখালেখি হলেও এর প্রতিকারে প্রশাসন নীরব ও নির্বিকার। দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে মানসম্মত শিক্ষা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হাজারো শিক্ষার্থী। দৈনিক যুগান্তরে গত ৫ অগাস্ট ২০২২ একটি নিবন্ধ এ লিখেছিলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: একাডেমিক উৎকর্ষতা ও দক্ষ প্রশাসনিক নেতৃত্ব নিয়ে-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে এর একাডেমিক ও প্রশাসনিক উৎকর্ষতা এবং উভয় ক্ষেত্রেই যোগ্য একাডেমিক কর্মী প্রশাসক; যা ছাত্রছাত্রীদের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ করে।…গত ১ জুলাই দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে এ বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র উঠে এসেছে- ‘মানবসম্পদ উন্নয়নের সর্বপ্রথম ধাপ শিক্ষা। মানবসম্পদের দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশের থেকে বাংলাদেশ অনেক বেশি এগিয়ে। কাজেই মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার গুরুত্বটাও এখানে বেশি দেওয়া প্রয়োজন।…শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড—এটি আমরা সবাই জানি, কিন্তু আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার দায়িত্ব যারা কাঁধে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই সেই দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন তো করছেনই না; বরং শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।’

…একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে রাষ্ট্রপতির (চ্যান্সেলর) ভূমিকা এবং ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার নিয়োগ তাদের নির্বাচন পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা বিবেচনা করে যে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতিনিধিত্ব, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণের নামে প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সমালোচনামূলক সংকেত প্রদান করে; ইস্যুটি নিয়ে আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার কারণ এ মূল্যবোধগুলি সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মৌলিক ভিত্তি গঠন করে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন পদ্ধতিগুলি অন্বেষণ করলে আমাদের বর্তমান ব্যবস্থার বিচ্যুতিগুলো সহজে ধরা পড়ে।…শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়া ও শিক্ষকতার মতো একটা পবিত্র ও মহান পেশা নিম্নস্তরে কোথায় নেমে যাচ্ছে এবং কেন নেমে যাচ্ছে তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার ও কাজ করার সময় এসে গেছে, বিলম্বে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।”

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এর কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে ২০০১ সালের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকার কথা । দৃশ্যতঃ রাজনৈতিক বিবেচনায়  এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে যেগুলো নূন্যতম নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে সনদ বিক্রির একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলো সূত্রে  আরো প্রকাশ ইউজিসি চলতি বছরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্ত করেছে এবং করছে তার মধ্যে রয়েছে ঢাকার মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি, ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটি, চুয়াডাঙ্গার ফাস্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মানিকগঞ্জের এনপিআই বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

কুমিল্লায় সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে যে বিষয়ে প্রথম আলো লিখছে, “নামে বিশ্ববিদ্যালয়, ভর্তি বন্ধ” কুমিল্লায় ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। গত এপ্রিলে এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদনে ইউজিসি বলেছিল, সেখানে শিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি অনুপস্থিত। ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে চলছে একাধিক মামলা এবং সদস্যদের বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতির অভিযোগ। এ ছাড়া শিক্ষকসংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে, গবেষণা নেই। …তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, গত এপ্রিলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় ইউজিসি। এখনো তা বন্ধ রয়েছে। …নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন কর্মকর্তা সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই।” (ডিসেম্বর ৭, ২০২২) সংবাদসূত্রের বরাতে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি ফ্যাকাল্টির অধীন ১৬টি প্রোগ্রাম চালু রয়েছে যদিও নতুন ভর্তি ইউজিসির নির্দেশে বন্ধ রয়েছে।

এমন সংকটপূর্ণ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের  একমাত্র বৈধ কর্মকর্তা রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (দায়িত্বে) কে পাওনা বেতনভাতা বঞ্চিত করে দাপ্তরিক দায়িত্বপালন থেকে অবৈধভাবে বিরত রাখা হয়েছে।  এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের  রেজিস্ট্রার কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় গত অগাস্ট ১১, ২০২২  তারিখে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন যার তদন্ত কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক  ও পুলিশ সুপারকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। চার মাস সময়ের মধ্যে তদন্ত কর্ম্মকর্তা ও সাংবাদিক মাত্র একবার ঘটনাস্থলে গিয়েছেন, রেজিস্ট্রার অফিস  তালাবদ্ধ পেয়েছেন কারণ ও জানতে পেরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা হন্নে হয়ে তাদের সার্টিফিকেট ও মার্কশিট এর জন্য বৈধ কতৃপক্ষকে খোঁজছে।  বেসামাল পরিস্থিতিতে সম্পুর্ন্ন বেআইনিভাবে একজন ‘নবম গ্রেড’-এর কর্মকর্তা সার্টিফিকেট ও মার্কশিট ইস্যু করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বন্ধ সহ উদ্ভুত পরিস্তিতিতে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়ভাবে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে কিন্তু ইউজিসি  ও স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ন্ন নীরব। এ নিষ্ক্রিয়তার মূল্য দিতে হবে বিদ্যার্থীদের, মূল্য দিতে হবে পরিবারকে, মূল্য দিতে হবে দেশকে।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে সঙ্গত ভাবেই বলেছেন যে , “বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বেশ কিছু নিয়মকানুন আছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তা মানে, বেশির ভাগই তা মানে না। ইউজিসি এসব নিয়মকানুন মানাতে পারছে কি না, সেটাও একটি প্রশ্ন।”

তদন্তাধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ম নীতি অনুযায়ী একাডেমিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ব্যৰ্থ।  এ বিষয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার পরিণতি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনে অচলাবস্থা, নিয়োগ নৈরাজ্য, দুর্নীতি ও আইন অমান্যতার প্রতিকারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া  প্রয়োজন।