০৪:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশের অর্থনীতির অপার সম্ভবনা

মো. আসাদুল আমীন
  • প্রকাশ: ১১:৪৯:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ জুলাই ২০২২
  • / ৯৪৮৪ বার পড়া হয়েছে

পদ্মা সেতু | ছবি: দ্য ডেইলি স্টার/ইয়াসিন কবির জয়


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

জুন ২৫, ২০২২ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু (Padma Bridge) উদ্‌বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয় পরের দিন অর্থাৎ জুন ২৬, ২০২২ তারিখ থেকে। এই পদ্মা সেতু কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এই নিবন্ধেও সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশের অর্থনীতির এর গুরুত্ব ও সম্ভবনা সম্পর্কে।

পদ্মা সেতু সম্পর্কিত তথ্য: ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন থেকে উদ্বোধন

পদ্মা সেতু নামটির সাথে অনেক আবেগ, উৎকন্ঠা, উৎসাহ, উদ্দীপনা জড়িত। পদ্মা সেতু কে বলা হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু এবং আসলেই এটা দক্ষিণবঙ্গ তথা সমগ্র বাংলার যে স্বপ্ন ছিল এটা বাস্তব সত্য। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে যেন দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের স্বপ্নের দুয়ার খুললো।

রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান এ স্বপ্নের, বাস্তবায়িত এ সেতুর। এটির উত্তর প্রান্তে মাওয়া, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরিয়তপুর, শিবচর এবং মাদারিপুর অবস্থিত। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’ আর মূল সেতুর ঠিকাদার ছিল প্রতিষ্ঠান ‘চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি লিমিটেড’ এবং নকশার দায়িত্বে ছিলেন আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের (AECOM) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল। ১৯৯৮-৯৯ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বপ্রথম সেতু নির্মানের প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই এবং ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন ও বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭২ ফুট প্রস্থের এ সেতুর রয়েছে ৩.১৮ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট যার পিলার সংখ্যা ৮১ টি। আর সেতু তে মোট লোকবল দরকার হয়েছে প্রায় ৪ হাজারের মতো।

পদ্মা সেতুর মোট ৪২ টি পিলারে স্প্যান সংখ্যা ৪১ টি এবং সর্বশেষ সেতুর ১২ ও ১৩ নং পিলারে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর স্প্যান বসানোর মধ্যে দিয়ে পুরো সেতু দৃশ্যমান হয়। আর ২৫ জুন তারিখে উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে যান চলাচলের মধ্যে দিয়ে কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হলো এবং বাংলাদেশ এগিয়ে গেল আরও একধাপ। বাংলাদেশের পরিচয় এখন বিশ্বের কাছে সম্মানের, গৌরবের, সফলতার এবং সক্ষমতার। পদ্মা সেতু যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করবে ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

পদ্মা সেতু| ছবি: বাসস

কেন পদ্মা সেতু অন্যসব সেতুর মতো নয়?

পদ্মা সেতুর নদী শাসন ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কেননা বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী হলো পদ্মা যার অবস্থান আমাজনের পরেই। নদী শাসন করতে হয়েছে ১৪ কিলোমিটার যে কাজটি করেছে চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড।

পদ্মা সেতু কতগুলো জেলা এবং উপজেলার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে?

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলা এবং ১৩৩ টি উপজেলা কে সরাসরি রাজধানী ঢাকার সাথে সংযুক্ত করেছে স্বপ্নের এই সেতু যার সুফল লাভ করবে সংযুক্ত জেলা এবং উপজেলা সহ সমগ্র দেশ। সেতু যেমন সময়ের সাশ্রয় করবে ঠিক তেমনি ফেরির জন্য অপেক্ষা, ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিয়েছে। ফেরি দুর্ঘটনা থেকে প্রাণহানি, সময়মতো ফেরি না পাওয়ায় অনেক রোগীর মৃত্যু আর তা থেকে স্বজন হারানোর বেদনা আর ব্যথিত করবে না।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভবনা

পদ্মা সেতু অর্থনীতির নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। পর্যটন, শিল্পায়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষির আধুনিকায়ন, কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া, বেকারত্ব হ্রাস, দরিদ্র বিমোচন সমস্যা সমাধানে অনেক বড়ো ভূমিকা পালন করবে। দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে এক দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে এ সেতু। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু তে রেলসংযোগ, গ্যাসলাইন, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন যা দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে এগিয়ে নিবে দক্ষিণবঙ্গকে। আর এ এগিয়ে নেওয়া দেশের এগিয়ে যাওয়া, দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার অগ্রগতি। পদ্মা সেতুর ফলে পর্যটনের অপার সম্ভবনা তৈরি হবে পদ্মার ওপারে শরিয়তপুর সহ আশপাশের জেলাগুলো তে। সুন্দরবন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়বে, আসবে অনেক বিদেশি পর্যটক। সরকারের পদ্মার ওপারে জাজিরা প্রান্তে এয়ারপোর্ট নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে আর এক্ষেত্রে অনেক বিদেশি পর্যটক পদ্মা সেতু দেখার পাশাপাশি সুন্দরবন ও সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে যেতে পারবে। তাদের ল্যান্ডি হবে এয়ারপোর্টে এবং সেখান থেকে ঘুরতে সক্ষম হবে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলো যা পর্যটন খাত থেকে আয় বাড়াবে এবং জিডিপি সম্প্রসারিত হবে। রাজধানী ঢাকা থেকে শিল্প কারখানার চাপ কমবে এবং অনেক নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে যা দেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে। 

যোগাযোগ ব্যবস্থায় পদ্মা সেতুর গুরুত্ব

পদ্মা সেতু তে রেলসংযোগ, গ্যাসলাইন, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন যা দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে এগিয়ে নিবে দক্ষিণবঙ্গকে। বেনাপোল স্থল বন্দর, মংলা বন্দর, পায়রা বন্দর, ভোলা নদী বন্দর এসব জায়গা থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানি সহজ হবে এবং খুব কম সময়ে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। অর্থাৎ বন্দরগুলোর গুরুত্ব এবং ব্যস্ততা আরও বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য দক্ষিণ অঞ্চলের জেলা শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ দ্রুত পরিবহন সম্ভব হবে যা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য ত্বরান্বিত করবে এবং ক্রেতারা আগের তুলনায় কম সময়ের মধ্যে তাদের ক্রয়কৃত দ্রব্য-সামগী পেয়ে থাকবেন।

পদ্মা সেতু | ছবি: ডেইলি স্টার/ইয়াসিন কবির জয়

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব

চিংড়ি চাষে শীর্ষ জেলা সাতক্ষীরা থেকে চাষিরা চিংড়ি খুব দ্রুত ঢাকায় পাঠাতে পারবেন এবং আগের থেকে ভালো দাম পাবেন। বাগেরহাটের গলদা, বাগদা চিংড়ির বড় বাজার হবে রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলা যেখানে আগে নদী পথের কারণে তাজা চিংড়ি পৌঁছানো সম্ভব ছিল না এবং ন্যায্য দাম না পাওয়ায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। দেশের দক্ষিণের জেলা পিরোজপুর যেখানে রয়েছে ভাসমান পেয়ারা বাগান যা ভিমরুলি তে অবস্থিত এবং এখানকার স্বরূপকাঠির আটঘর কুরিয়ানা তে প্রচুর পেয়ারা উৎপাদিত হয়। আটঘর কুরিয়ানা পেয়ারা বাগান এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাগান। পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার আমড়া যা বরিশালের আমড়া বলে পরিচিত এবং সারাদেশে প্রায় এ আমড়া পাওয়া যায় যা আগে পরিবহনে অনেক সময় লাগতো এবং গুণগত মান ঠিক থাকতো না। কিন্তু এখন তা অল্পসময়ের মধ্যে পরিবহন সম্ভব হবে এবং চাহিদা বৃদ্ধি চাষিদের লাভবান হতে সহযোগিতা করবে। ভোলা জেলা কে বলা হয় –  “কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ” যেখানে প্রচুর সুপারি উৎপাদিত হয় এবং বরগুনা জেলায় নারিকেলের ভালো ফলন হয় যার বাজারও সমাদৃত হবে। ফরিদপুরে প্রচুর ধান, ইক্ষু, গম, পাট এবং গোপালগঞ্জে বাদাম, পাট, তরমুজ উৎপাদিত হয় যা জাতীয় অর্থনীতি তে অবদান রেখে চলছে। কৃষিতে আধুনিকায়নের ছোঁয়া পেলে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে যার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিবহন সহজ হবে যা সহায়ক করবে পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভবনা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভবনা কাজে লাগাতে অবশ্য পরিকল্পনার দরকার রয়েছে এবং সরকার ও বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে দশ বছর মেয়াদী ১.৪ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচী গ্রহন করেছে যার মেয়াদকাল ২০২০-৩০। পদ্মা সেতুর ফলে বিনিয়োগ বাড়বে আর কোনো বিনিয়োগ থেকে যদি ১২ শতাংশ রিটার্ন আসে তাকে আদর্শ বিনিয়োগ বলা হয়ে থাকে যেখানে পদ্মা সেতুর ফলে যেসব বিনিয়োগ হবে সেখান থেকে বছরে ১৯ শতাংশ রিটার্নের সম্ভবনা ধরা হয়েছে।

পদ্মা সেতু যেভাবে অর্থনীতি তে ভূমিকা রাখবে

কোনো দেশের অর্থনীতির অবস্থা জানার জন্য সে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন, মোট জাতীয় আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার জানা দরকার এবং এগুলো বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনীতি যে ডানে অগ্রসর হচ্ছে তা বোঝা যাবে তবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থেকে জাতীয় আয় বৃদ্ধি, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেলে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে তা বেকারত্ব সমস্যা হ্রাস এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতুর ফলে এগুলো সবই বৃদ্ধি পাবে বলা যায় যা দেশের মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়ার সাথে সাথে পাল্টে দিবে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। 

পদ্মা সেতু হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ বাস্তব জীবনে উপলব্ধি করতে পারবে। সময়ের সাশ্রয় থেকে উপলব্ধিবোধ জাগ্রত হবে সর্বপ্রথমে এবং আমি নিজেও দক্ষিণবঙ্গের পিরোজপুর জেলার মানুষ হিসেবে সেতুর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। আমার এখনো মনে আছে একবার আমার জেলা পিরোজপুর থেকে ঢাকা পৌঁছাতে দীর্ঘ ১৭ ঘন্টা সময় লেগেছিল কোনো এক ইদ মৌসুমে। দেশের মানুষের জীবন ও জীবীকার পরিবর্তন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কল্যাণে পদ্মা সেতু হোক অন্যতম দৃষ্টান্ত। এগিয়ে যাক দেশের মানুষের ভাগ্যের চাকা, এগিয়ে যাক আমার দেশ।

শেয়ার করুন

One thought on “পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশের অর্থনীতির অপার সম্ভবনা

  1. ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটা তথ্যমুলক পোস্ট লিখার জন্য যা অনেকের কাজে লাগবে। এমন নতুন নতুন আরো পোস্ট চাই।

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মো. আসাদুল আমীন

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশের অর্থনীতির অপার সম্ভবনা

প্রকাশ: ১১:৪৯:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ জুলাই ২০২২

জুন ২৫, ২০২২ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু (Padma Bridge) উদ্‌বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয় পরের দিন অর্থাৎ জুন ২৬, ২০২২ তারিখ থেকে। এই পদ্মা সেতু কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এই নিবন্ধেও সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশের অর্থনীতির এর গুরুত্ব ও সম্ভবনা সম্পর্কে।

পদ্মা সেতু সম্পর্কিত তথ্য: ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন থেকে উদ্বোধন

পদ্মা সেতু নামটির সাথে অনেক আবেগ, উৎকন্ঠা, উৎসাহ, উদ্দীপনা জড়িত। পদ্মা সেতু কে বলা হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু এবং আসলেই এটা দক্ষিণবঙ্গ তথা সমগ্র বাংলার যে স্বপ্ন ছিল এটা বাস্তব সত্য। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে যেন দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের স্বপ্নের দুয়ার খুললো।

রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান এ স্বপ্নের, বাস্তবায়িত এ সেতুর। এটির উত্তর প্রান্তে মাওয়া, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরিয়তপুর, শিবচর এবং মাদারিপুর অবস্থিত। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’ আর মূল সেতুর ঠিকাদার ছিল প্রতিষ্ঠান ‘চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি লিমিটেড’ এবং নকশার দায়িত্বে ছিলেন আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের (AECOM) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল। ১৯৯৮-৯৯ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বপ্রথম সেতু নির্মানের প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই এবং ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন ও বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭২ ফুট প্রস্থের এ সেতুর রয়েছে ৩.১৮ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট যার পিলার সংখ্যা ৮১ টি। আর সেতু তে মোট লোকবল দরকার হয়েছে প্রায় ৪ হাজারের মতো।

পদ্মা সেতুর মোট ৪২ টি পিলারে স্প্যান সংখ্যা ৪১ টি এবং সর্বশেষ সেতুর ১২ ও ১৩ নং পিলারে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর স্প্যান বসানোর মধ্যে দিয়ে পুরো সেতু দৃশ্যমান হয়। আর ২৫ জুন তারিখে উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে যান চলাচলের মধ্যে দিয়ে কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হলো এবং বাংলাদেশ এগিয়ে গেল আরও একধাপ। বাংলাদেশের পরিচয় এখন বিশ্বের কাছে সম্মানের, গৌরবের, সফলতার এবং সক্ষমতার। পদ্মা সেতু যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করবে ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

পদ্মা সেতু| ছবি: বাসস

কেন পদ্মা সেতু অন্যসব সেতুর মতো নয়?

পদ্মা সেতুর নদী শাসন ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কেননা বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী হলো পদ্মা যার অবস্থান আমাজনের পরেই। নদী শাসন করতে হয়েছে ১৪ কিলোমিটার যে কাজটি করেছে চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড।

পদ্মা সেতু কতগুলো জেলা এবং উপজেলার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে?

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলা এবং ১৩৩ টি উপজেলা কে সরাসরি রাজধানী ঢাকার সাথে সংযুক্ত করেছে স্বপ্নের এই সেতু যার সুফল লাভ করবে সংযুক্ত জেলা এবং উপজেলা সহ সমগ্র দেশ। সেতু যেমন সময়ের সাশ্রয় করবে ঠিক তেমনি ফেরির জন্য অপেক্ষা, ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিয়েছে। ফেরি দুর্ঘটনা থেকে প্রাণহানি, সময়মতো ফেরি না পাওয়ায় অনেক রোগীর মৃত্যু আর তা থেকে স্বজন হারানোর বেদনা আর ব্যথিত করবে না।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভবনা

পদ্মা সেতু অর্থনীতির নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। পর্যটন, শিল্পায়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষির আধুনিকায়ন, কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া, বেকারত্ব হ্রাস, দরিদ্র বিমোচন সমস্যা সমাধানে অনেক বড়ো ভূমিকা পালন করবে। দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে এক দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে এ সেতু। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু তে রেলসংযোগ, গ্যাসলাইন, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন যা দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে এগিয়ে নিবে দক্ষিণবঙ্গকে। আর এ এগিয়ে নেওয়া দেশের এগিয়ে যাওয়া, দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার অগ্রগতি। পদ্মা সেতুর ফলে পর্যটনের অপার সম্ভবনা তৈরি হবে পদ্মার ওপারে শরিয়তপুর সহ আশপাশের জেলাগুলো তে। সুন্দরবন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়বে, আসবে অনেক বিদেশি পর্যটক। সরকারের পদ্মার ওপারে জাজিরা প্রান্তে এয়ারপোর্ট নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে আর এক্ষেত্রে অনেক বিদেশি পর্যটক পদ্মা সেতু দেখার পাশাপাশি সুন্দরবন ও সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে যেতে পারবে। তাদের ল্যান্ডি হবে এয়ারপোর্টে এবং সেখান থেকে ঘুরতে সক্ষম হবে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলো যা পর্যটন খাত থেকে আয় বাড়াবে এবং জিডিপি সম্প্রসারিত হবে। রাজধানী ঢাকা থেকে শিল্প কারখানার চাপ কমবে এবং অনেক নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে যা দেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে। 

যোগাযোগ ব্যবস্থায় পদ্মা সেতুর গুরুত্ব

পদ্মা সেতু তে রেলসংযোগ, গ্যাসলাইন, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন যা দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে এগিয়ে নিবে দক্ষিণবঙ্গকে। বেনাপোল স্থল বন্দর, মংলা বন্দর, পায়রা বন্দর, ভোলা নদী বন্দর এসব জায়গা থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানি সহজ হবে এবং খুব কম সময়ে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। অর্থাৎ বন্দরগুলোর গুরুত্ব এবং ব্যস্ততা আরও বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য দক্ষিণ অঞ্চলের জেলা শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ দ্রুত পরিবহন সম্ভব হবে যা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য ত্বরান্বিত করবে এবং ক্রেতারা আগের তুলনায় কম সময়ের মধ্যে তাদের ক্রয়কৃত দ্রব্য-সামগী পেয়ে থাকবেন।

পদ্মা সেতু | ছবি: ডেইলি স্টার/ইয়াসিন কবির জয়

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব

চিংড়ি চাষে শীর্ষ জেলা সাতক্ষীরা থেকে চাষিরা চিংড়ি খুব দ্রুত ঢাকায় পাঠাতে পারবেন এবং আগের থেকে ভালো দাম পাবেন। বাগেরহাটের গলদা, বাগদা চিংড়ির বড় বাজার হবে রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলা যেখানে আগে নদী পথের কারণে তাজা চিংড়ি পৌঁছানো সম্ভব ছিল না এবং ন্যায্য দাম না পাওয়ায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। দেশের দক্ষিণের জেলা পিরোজপুর যেখানে রয়েছে ভাসমান পেয়ারা বাগান যা ভিমরুলি তে অবস্থিত এবং এখানকার স্বরূপকাঠির আটঘর কুরিয়ানা তে প্রচুর পেয়ারা উৎপাদিত হয়। আটঘর কুরিয়ানা পেয়ারা বাগান এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাগান। পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার আমড়া যা বরিশালের আমড়া বলে পরিচিত এবং সারাদেশে প্রায় এ আমড়া পাওয়া যায় যা আগে পরিবহনে অনেক সময় লাগতো এবং গুণগত মান ঠিক থাকতো না। কিন্তু এখন তা অল্পসময়ের মধ্যে পরিবহন সম্ভব হবে এবং চাহিদা বৃদ্ধি চাষিদের লাভবান হতে সহযোগিতা করবে। ভোলা জেলা কে বলা হয় –  “কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ” যেখানে প্রচুর সুপারি উৎপাদিত হয় এবং বরগুনা জেলায় নারিকেলের ভালো ফলন হয় যার বাজারও সমাদৃত হবে। ফরিদপুরে প্রচুর ধান, ইক্ষু, গম, পাট এবং গোপালগঞ্জে বাদাম, পাট, তরমুজ উৎপাদিত হয় যা জাতীয় অর্থনীতি তে অবদান রেখে চলছে। কৃষিতে আধুনিকায়নের ছোঁয়া পেলে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে যার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিবহন সহজ হবে যা সহায়ক করবে পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভবনা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভবনা কাজে লাগাতে অবশ্য পরিকল্পনার দরকার রয়েছে এবং সরকার ও বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে দশ বছর মেয়াদী ১.৪ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচী গ্রহন করেছে যার মেয়াদকাল ২০২০-৩০। পদ্মা সেতুর ফলে বিনিয়োগ বাড়বে আর কোনো বিনিয়োগ থেকে যদি ১২ শতাংশ রিটার্ন আসে তাকে আদর্শ বিনিয়োগ বলা হয়ে থাকে যেখানে পদ্মা সেতুর ফলে যেসব বিনিয়োগ হবে সেখান থেকে বছরে ১৯ শতাংশ রিটার্নের সম্ভবনা ধরা হয়েছে।

পদ্মা সেতু যেভাবে অর্থনীতি তে ভূমিকা রাখবে

কোনো দেশের অর্থনীতির অবস্থা জানার জন্য সে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন, মোট জাতীয় আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার জানা দরকার এবং এগুলো বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনীতি যে ডানে অগ্রসর হচ্ছে তা বোঝা যাবে তবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থেকে জাতীয় আয় বৃদ্ধি, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেলে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে তা বেকারত্ব সমস্যা হ্রাস এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতুর ফলে এগুলো সবই বৃদ্ধি পাবে বলা যায় যা দেশের মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়ার সাথে সাথে পাল্টে দিবে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। 

পদ্মা সেতু হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ বাস্তব জীবনে উপলব্ধি করতে পারবে। সময়ের সাশ্রয় থেকে উপলব্ধিবোধ জাগ্রত হবে সর্বপ্রথমে এবং আমি নিজেও দক্ষিণবঙ্গের পিরোজপুর জেলার মানুষ হিসেবে সেতুর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। আমার এখনো মনে আছে একবার আমার জেলা পিরোজপুর থেকে ঢাকা পৌঁছাতে দীর্ঘ ১৭ ঘন্টা সময় লেগেছিল কোনো এক ইদ মৌসুমে। দেশের মানুষের জীবন ও জীবীকার পরিবর্তন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কল্যাণে পদ্মা সেতু হোক অন্যতম দৃষ্টান্ত। এগিয়ে যাক দেশের মানুষের ভাগ্যের চাকা, এগিয়ে যাক আমার দেশ।