০৭:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আমার শিক্ষক রঞ্জিত পোদ্দার

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০৩:০৫:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুন ২০২১
  • / ১১৩৬ বার পড়া হয়েছে

নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. রঞ্জিত পোদ্দার


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

আমরা প্রায়ই বিশেষ কোনো বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে বা বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে বলার সময় নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে নানান রকম উপমা ব্যবহার করে থাকি। সেসব উপমা যেমন একেকটি বাক্যকে সজ্জিত করে এর শ্রোতা বা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়, তেমনি ওই বিষয় বা ব্যক্তি সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণারও জন্ম দিয়ে থাকে অডিয়েন্সদের মনে। তবে আমি ঠিক বলতে পারছি না যে, আমাদের রঞ্জিত পোদ্দার স্যারকে নিয়ে দুটো কথা বলতে গেলে কি এমন উপমা ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো কিছুর সাথে তুলনা করে আমাদের এই সম্মানিত শিক্ষককে নিয়ে কোনো কিছু বলা হলে সেটা কতটুকু পর্যাপ্ত হবে তা আমার জানা নেই।

প্রচার বিমুখ আমাদের বা আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব রঞ্জিত পোদ্দারকে পরিচিত করিয়ে দিতে চাই আরেকজন শিক্ষককে উপমা হিসেবে ধরে। আমার না দেখা যে মহান শিক্ষককের আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে আছেন তাঁর এই ছাত্র রঞ্জিত পোদ্দার। স্যারের মুখে শুনেছি প্রয়াত এ মানুষটির মহত্বের কথা। সে মানুষটির নাম ভগিরথ চন্দ্র সেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভগিরথ চন্দ্র স্যার পড়িয়েছেন রঞ্জিত পোদ্দার স্যারকে। শুধু পড়িয়েছেন বললে কম হবে; তিনি তাকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছেন এবং আমি বলতে পারি ভগিরথ স্যার এখানে সফল।

আমি রঞ্জিত স্যারের মুখে যত মানুষের প্রশংসা শুনেছি, যত মানুষ নিয়ে ভালো ভালো কথা বলতে শুনেছি, যত জনকে নিয়ে গর্ব করতে দেখেছি, যত জনকে নিয়ে ভাবছেন বলে টের পেয়েছি তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই রয়েছেন তাঁর শিক্ষার্থীরা। তাঁর চরিত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন টান কেন লক্ষ্য করা যায় তা আমার জানা নেই। তবে এটা জানি যে, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকার এই টিচার এডুকেটর রঞ্জিত স্যারের শিক্ষক ভগিরথ চন্দ্র সেনও এমন ছিলেন, যে রকমটা স্যারের মুখ থেকেই শুনেছি। তিনি গর্বের সাথে বলে থাকেন, ‘আমি ভগিরথ স্যারের ছাত্র’। সেই শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছেন বলে আমার এই শিক্ষক নিজেকে ভাগ্যবান বলে দাবি করেন। আমারও বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয় না যে, জনাব পোদ্দার মনের দিক থেকে আরেকজন ভগিরথ সেন যিনি তাঁর ওই শিক্ষকের মতোই নিজের শিক্ষার্থীদের নানা দিক নিয়ে ভেবে থাকেন যা শুধু ক্লাস আর সিলেবাস পর্যন্তই নয়; আরও অনেক কিছুতেই।

রঞ্জিত স্যার একজন শিক্ষাগবেষক, ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত প্রাবন্ধিক এবং ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকপ্রেমী মানুষ যার টেবিলে আপনি বিভিন্ন প্রকারের কাগজপত্র, বই, জার্নাল, খাতা-কলম বা অন্যান্য স্টেশনারির পাশাপাশি আরও এক প্রকারের জিনিস পাবেন- সেটি হলো বাঁশি, সংগীতের অন্যতম একটি যন্ত্র। কাজের ফাঁকে সেই বাঁশিতে মাঝেমধ্যেই সুর তোলেন।

তিনি যেমন গবেষণা, লেখালেখি ও সংগীত পছন্দ করেন, তেমনই তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদেরও এসবের দিকে আগ্রহী করার চেষ্টা করেন। স্যার নিজের উদ্যোগে ডেকে নিয়ে তাঁর অনেক শিক্ষার্থীকে গবেষণার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বা একেকজন গবেষক বানিয়েছেন; বাংলা ও ইংরেজিতে কীভাবে মানসম্পন্ন প্রবন্ধ লিখতে হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকায় তাঁর উদ্যোগে একটি মিউজিক ক্লাবও গঠন করা হয়েছে।

জনাব পোদ্দারের প্রশিক্ষণ পেয়ে এখন অনেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ও মানের বিভিন্ন পত্রিকা ও জার্নালে লিখছেন। স্যারের কাছে গবেষণা শিখে এখন বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন, এমনও আছে। এসব আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। আমার কয়েকজন সিনিয়র ভাই ব্যাচেলর ও মাস্টার প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী থাকাকালীনই তিন/চারটি করে আর্টিকেল বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ হয় যা আমাদের বাংলাদেশে বিরল। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষকই যেখানে গবেষণায় আসতে অনাগ্রহী থাকেন সেখানে শিক্ষার্থীদের দ্বারা এমন সাফল্য অর্জন নিশ্চয়ই রঞ্জিত স্যারকে আরেকটু উঁচু পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।

আমি গবেষণার যা শিখেছি তা তাঁর কাছ থেকেই, এমন কি স্যারের সাথেই কো-অথর হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের শেখান কীভাবে বাস্তব ও যুক্তিনির্ভর একটা ভালো মানের নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখতে হয় বা কীভাবে যুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সমালোচনা করতে হয়, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রকম দক্ষতায় আরও কীভাবে নিজেদের এগিয়ে নিতে পারে সে ব্যাপারে সহযোগিতা করেন, তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তাঁর শিক্ষার্থীদের আর বিশেষ কোনো পন্থায় সহযোগিতা করা যায় কি না। শিক্ষার্থীদের সামান্য সাফল্যেও তাকে পুলকিত হতে দেখেছি।

এ নিয়ে অনেক কিছুই লেখা যায় কিন্তু লেখার সাহস পাচ্ছি না কারণ স্যার চান না এ সব প্রকাশ্যে আসুক; তবে কথা দিতে পারি একদিন লিখব আল্লাহ সুস্থ রাখলে। তবে একটু জানিয়ে রাখি- তিনি যে প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা করেছেন সেখানেই শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন। তিনি যখন পদোন্নতি পেয়ে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ফরিদপুর থেকে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকায় যোগদান করেন তখন সেখানের কয়েকজন শিক্ষার্থী জনাব রঞ্জিত পোদ্দার ও একজন ভালো শিক্ষকের অভাব যে তাঁদের ছিল তা নিয়ে ‘ডোন্ট উই ডিজারভ আ গুড টিচার ইন আওয়ার কলেজ?’ শিরোনামে লিখেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ডেইলি সান’এ।

সম্প্রতি পোদ্দার স্যার পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে। কিন্তু আমরা অনেকেই মনে করি স্যারের পিএইচডির দরকার ছিল না কারণ তিনি এমন একজন মানুষ যাকে নিয়েই পিএইচডি করা যায়। এ মন্তব্যটিকে অতিরঞ্জিত বলে আখ্যা দেওয়ার বা ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ নেই। আমরা যারা স্যারকে খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁরা এটা জানি নিশ্চয়ই। শিক্ষার্থীদের উন্নতিতে তিনি সব সময়ই মেন্টরিং করার সাথে নিজেকে যুক্ত রাখেন। আর চাইতেই আমার মতো শিক্ষার্থীরা নিজেদের অজান্তেই পেয়ে যায় একজন মেন্টর। জনাব পোদ্দার এমনই একজন শিক্ষক যিনি প্রভাব বিস্তার করে আছেন সব ধরণের শিক্ষার্থীদের মাঝে। মেধাবী বা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী শিক্ষার্থী কিংবা ক্যাম্পাসে দুষ্টু ছেলেদের মধ্যেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পেরেছেন।

স্যার একদিন মজা করে বললেন, ‘পিএইচডিটা শুধু নিজেকে সন্তষ্ট করার জন্যই করা, এ বয়সে আর কিবা দেওয়ার আছে।’ তবে স্যার যা দিয়ে চলেছেন জাতিকে তা খুব কম সংখ্যক শিক্ষকই বা দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে অনেক শিক্ষকই তাঁর মতো এতটা নিবেদিত নন। নিউজিল্যান্ডের ক্যানটারবারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মালয়েশিয়ার নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে তিনি দেশে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও সান্তকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিএলটিতে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্যান্টারবারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পিএইচডির সুযোগ পেয়েও বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং পরিবর্তিতে কর্মকালীন পিইচডি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এনরোলড হন।

অভিনন্দন জানাচ্ছি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডক্টর রঞ্জিত পোদ্দারকে। তিনি রক্ত-মাংসেই গড়া একজন সাধারণ মানুষ, নেতিবাচক দিক তাঁরও থাকতে পারে। তবে তাঁর মতো একজন শিক্ষক, শিক্ষক প্রশিক্ষক, মেন্টর, শিক্ষাগবেষক, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিকের খুবই প্রয়োজন আমাদের বাংলাদেশে। তাঁর মতো যত বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব ও পরিশ্রমী শিক্ষক তৈরি করা যাবে এ দেশের শিক্ষাখাত ততটাই এগিয়ে যাবে, আমাদের বিশ্বাস। স্যারের দীর্ঘায়ু এবং সেই সাথে সুস্থতা কামনা করছি।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

আমার শিক্ষক রঞ্জিত পোদ্দার

প্রকাশ: ০৩:০৫:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুন ২০২১

আমরা প্রায়ই বিশেষ কোনো বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে বা বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে বলার সময় নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে নানান রকম উপমা ব্যবহার করে থাকি। সেসব উপমা যেমন একেকটি বাক্যকে সজ্জিত করে এর শ্রোতা বা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়, তেমনি ওই বিষয় বা ব্যক্তি সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণারও জন্ম দিয়ে থাকে অডিয়েন্সদের মনে। তবে আমি ঠিক বলতে পারছি না যে, আমাদের রঞ্জিত পোদ্দার স্যারকে নিয়ে দুটো কথা বলতে গেলে কি এমন উপমা ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো কিছুর সাথে তুলনা করে আমাদের এই সম্মানিত শিক্ষককে নিয়ে কোনো কিছু বলা হলে সেটা কতটুকু পর্যাপ্ত হবে তা আমার জানা নেই।

প্রচার বিমুখ আমাদের বা আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব রঞ্জিত পোদ্দারকে পরিচিত করিয়ে দিতে চাই আরেকজন শিক্ষককে উপমা হিসেবে ধরে। আমার না দেখা যে মহান শিক্ষককের আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে আছেন তাঁর এই ছাত্র রঞ্জিত পোদ্দার। স্যারের মুখে শুনেছি প্রয়াত এ মানুষটির মহত্বের কথা। সে মানুষটির নাম ভগিরথ চন্দ্র সেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভগিরথ চন্দ্র স্যার পড়িয়েছেন রঞ্জিত পোদ্দার স্যারকে। শুধু পড়িয়েছেন বললে কম হবে; তিনি তাকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছেন এবং আমি বলতে পারি ভগিরথ স্যার এখানে সফল।

আমি রঞ্জিত স্যারের মুখে যত মানুষের প্রশংসা শুনেছি, যত মানুষ নিয়ে ভালো ভালো কথা বলতে শুনেছি, যত জনকে নিয়ে গর্ব করতে দেখেছি, যত জনকে নিয়ে ভাবছেন বলে টের পেয়েছি তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই রয়েছেন তাঁর শিক্ষার্থীরা। তাঁর চরিত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন টান কেন লক্ষ্য করা যায় তা আমার জানা নেই। তবে এটা জানি যে, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকার এই টিচার এডুকেটর রঞ্জিত স্যারের শিক্ষক ভগিরথ চন্দ্র সেনও এমন ছিলেন, যে রকমটা স্যারের মুখ থেকেই শুনেছি। তিনি গর্বের সাথে বলে থাকেন, ‘আমি ভগিরথ স্যারের ছাত্র’। সেই শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছেন বলে আমার এই শিক্ষক নিজেকে ভাগ্যবান বলে দাবি করেন। আমারও বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয় না যে, জনাব পোদ্দার মনের দিক থেকে আরেকজন ভগিরথ সেন যিনি তাঁর ওই শিক্ষকের মতোই নিজের শিক্ষার্থীদের নানা দিক নিয়ে ভেবে থাকেন যা শুধু ক্লাস আর সিলেবাস পর্যন্তই নয়; আরও অনেক কিছুতেই।

রঞ্জিত স্যার একজন শিক্ষাগবেষক, ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত প্রাবন্ধিক এবং ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকপ্রেমী মানুষ যার টেবিলে আপনি বিভিন্ন প্রকারের কাগজপত্র, বই, জার্নাল, খাতা-কলম বা অন্যান্য স্টেশনারির পাশাপাশি আরও এক প্রকারের জিনিস পাবেন- সেটি হলো বাঁশি, সংগীতের অন্যতম একটি যন্ত্র। কাজের ফাঁকে সেই বাঁশিতে মাঝেমধ্যেই সুর তোলেন।

তিনি যেমন গবেষণা, লেখালেখি ও সংগীত পছন্দ করেন, তেমনই তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদেরও এসবের দিকে আগ্রহী করার চেষ্টা করেন। স্যার নিজের উদ্যোগে ডেকে নিয়ে তাঁর অনেক শিক্ষার্থীকে গবেষণার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বা একেকজন গবেষক বানিয়েছেন; বাংলা ও ইংরেজিতে কীভাবে মানসম্পন্ন প্রবন্ধ লিখতে হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকায় তাঁর উদ্যোগে একটি মিউজিক ক্লাবও গঠন করা হয়েছে।

জনাব পোদ্দারের প্রশিক্ষণ পেয়ে এখন অনেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ও মানের বিভিন্ন পত্রিকা ও জার্নালে লিখছেন। স্যারের কাছে গবেষণা শিখে এখন বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন, এমনও আছে। এসব আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। আমার কয়েকজন সিনিয়র ভাই ব্যাচেলর ও মাস্টার প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী থাকাকালীনই তিন/চারটি করে আর্টিকেল বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ হয় যা আমাদের বাংলাদেশে বিরল। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষকই যেখানে গবেষণায় আসতে অনাগ্রহী থাকেন সেখানে শিক্ষার্থীদের দ্বারা এমন সাফল্য অর্জন নিশ্চয়ই রঞ্জিত স্যারকে আরেকটু উঁচু পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।

আমি গবেষণার যা শিখেছি তা তাঁর কাছ থেকেই, এমন কি স্যারের সাথেই কো-অথর হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের শেখান কীভাবে বাস্তব ও যুক্তিনির্ভর একটা ভালো মানের নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখতে হয় বা কীভাবে যুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সমালোচনা করতে হয়, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রকম দক্ষতায় আরও কীভাবে নিজেদের এগিয়ে নিতে পারে সে ব্যাপারে সহযোগিতা করেন, তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তাঁর শিক্ষার্থীদের আর বিশেষ কোনো পন্থায় সহযোগিতা করা যায় কি না। শিক্ষার্থীদের সামান্য সাফল্যেও তাকে পুলকিত হতে দেখেছি।

এ নিয়ে অনেক কিছুই লেখা যায় কিন্তু লেখার সাহস পাচ্ছি না কারণ স্যার চান না এ সব প্রকাশ্যে আসুক; তবে কথা দিতে পারি একদিন লিখব আল্লাহ সুস্থ রাখলে। তবে একটু জানিয়ে রাখি- তিনি যে প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা করেছেন সেখানেই শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন। তিনি যখন পদোন্নতি পেয়ে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ফরিদপুর থেকে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকায় যোগদান করেন তখন সেখানের কয়েকজন শিক্ষার্থী জনাব রঞ্জিত পোদ্দার ও একজন ভালো শিক্ষকের অভাব যে তাঁদের ছিল তা নিয়ে ‘ডোন্ট উই ডিজারভ আ গুড টিচার ইন আওয়ার কলেজ?’ শিরোনামে লিখেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ডেইলি সান’এ।

সম্প্রতি পোদ্দার স্যার পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে। কিন্তু আমরা অনেকেই মনে করি স্যারের পিএইচডির দরকার ছিল না কারণ তিনি এমন একজন মানুষ যাকে নিয়েই পিএইচডি করা যায়। এ মন্তব্যটিকে অতিরঞ্জিত বলে আখ্যা দেওয়ার বা ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ নেই। আমরা যারা স্যারকে খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁরা এটা জানি নিশ্চয়ই। শিক্ষার্থীদের উন্নতিতে তিনি সব সময়ই মেন্টরিং করার সাথে নিজেকে যুক্ত রাখেন। আর চাইতেই আমার মতো শিক্ষার্থীরা নিজেদের অজান্তেই পেয়ে যায় একজন মেন্টর। জনাব পোদ্দার এমনই একজন শিক্ষক যিনি প্রভাব বিস্তার করে আছেন সব ধরণের শিক্ষার্থীদের মাঝে। মেধাবী বা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী শিক্ষার্থী কিংবা ক্যাম্পাসে দুষ্টু ছেলেদের মধ্যেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পেরেছেন।

স্যার একদিন মজা করে বললেন, ‘পিএইচডিটা শুধু নিজেকে সন্তষ্ট করার জন্যই করা, এ বয়সে আর কিবা দেওয়ার আছে।’ তবে স্যার যা দিয়ে চলেছেন জাতিকে তা খুব কম সংখ্যক শিক্ষকই বা দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে অনেক শিক্ষকই তাঁর মতো এতটা নিবেদিত নন। নিউজিল্যান্ডের ক্যানটারবারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মালয়েশিয়ার নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে তিনি দেশে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও সান্তকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিএলটিতে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্যান্টারবারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পিএইচডির সুযোগ পেয়েও বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং পরিবর্তিতে কর্মকালীন পিইচডি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এনরোলড হন।

অভিনন্দন জানাচ্ছি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডক্টর রঞ্জিত পোদ্দারকে। তিনি রক্ত-মাংসেই গড়া একজন সাধারণ মানুষ, নেতিবাচক দিক তাঁরও থাকতে পারে। তবে তাঁর মতো একজন শিক্ষক, শিক্ষক প্রশিক্ষক, মেন্টর, শিক্ষাগবেষক, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিকের খুবই প্রয়োজন আমাদের বাংলাদেশে। তাঁর মতো যত বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব ও পরিশ্রমী শিক্ষক তৈরি করা যাবে এ দেশের শিক্ষাখাত ততটাই এগিয়ে যাবে, আমাদের বিশ্বাস। স্যারের দীর্ঘায়ু এবং সেই সাথে সুস্থতা কামনা করছি।