কেমন হওয়া চাই করোনাভাইরাস অতিমারীকালীন শিক্ষা বাজেট
- প্রকাশ: ১০:২৬:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ মে ২০২১
- / ৫২৮ বার পড়া হয়েছে
করোনাভাইরাস অতিমারীতে যে সকল খাতের চরম ক্ষতি হয়েছে সেগুলো দৃশ্যমান কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি দৃশ্যমান নয়। আর তাই এটি বেশি ভয়াবহ কারণ দৃশ্যমান নয় বলে এর প্রতিকারের পদক্ষেপ কি হবে সেটি নির্ধারন করা যাচেছনা। রোগের উপসর্গ ধরা না পড়লে কীভাবে ঔষধ প্রয়োগ করা হবে, সেটিই বিরাট ভয়।
শিক্ষার এই ক্ষতি কাটাতে কেউ কেউ নিজেরা পড়ার চেষ্ট করছে, কেউ রেডিও টিভির ক্লাস করছে, কেউবা অনলাইনে চেষ্টা করছে, কিছু কিছু অভিভাবক নিজ উদ্যোগে শিশুদের প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বিদ্যালযে ছয়-সাত ঘন্টা থাকা এবং এর সামাজিকতা, অংশগ্রহন, পারস্পরিক ভাব বিনিময়সহ বহু ঘাটতি শিক্ষার্থীদের হচ্ছে পনেরো মাস যাবত। গতানুগতিক শিক্ষা বাজেটে এর প্রতিকার আসবে কি না সেটিই আমাদের প্রথম বুঝতে হবে। করোনা থেকে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বাাঁচানোর উপায় হিসেবে দফার দফায় বন্ধ বাড়ানো হচ্ছে এর শেষ কোথায় তা কেউ বলতে পারছে না। তবে, এটি ঠিক শিক্ষার অবস্থা আগের মতো আর হচ্ছেনা অন্তত সর্বত্র। এই বাজেটের পূর্বেই প্রয়োজন ছিল কোন কোন বিদ্যালয়ে সরাসরি পাঠদান সম্ভব হবে যেমন যেসব এলাকা কম আক্রান্ত হয়েছে সেসব এলকায় ফেস টু ফেস পাঠদান সম্ভব এবং সীমিত আকারে অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থা করা আর যেসব এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সেসব এলাকায় অনলাইন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেখানে সরকার কতটুকু দিবে, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কতটুকু এবং অভিভাবকগন কিভাবে অংশগ্রহন করবেন এই ম্যাপিং প্রয়োজন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (বিঅইজিডি) যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছেন যেখানে শহরের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে, মেয়েদের ২৬ ও ছেলে শিক্ষার্থীদের ৩০ শতাংশ এই ঝুঁকিতে রয়েছে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের মাঝে যারা অতিদরিদ্র, সেসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থীর করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলাফলে আরও দেখা গেছে দূরবর্তী শিক্ষণের জন্য যেসব সুবিধা থাকা দরকার তা আছে বা ব্যবহার করছে মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ফলে সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমের লেখাপড়া শেখার হার খুব কম।অভিভাবকের উপার্জনের নিরাপত্তা না থাকলে তার প্রভাব শিক্ষার ওপর পড়বেই কারণ ক্ষুধার্ত শিশুর কাছে শিক্ষা দেওয়ার বিষয় কী কাজ করে? পুষ্টিহীনতা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটোর ওপরই প্রভাব ফেলে। বেসরকারিভাবে পরিচালিত স্কুল-কলেজের শিক্ষক কর্মচারীরা, বিশেষ করে নন-এমপিও, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকরা আয় নিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে। এই ঝুঁকি থেকে তাদেরকে তুলে আনার আপাত কোন ব্যবস্থা দৃশ্যমান হচ্ছেনা।
কেমন হওয়া উচিত এবারকার শিক্ষা বাজেট?
৩ জুন ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে। প্রতি বছরের মতো এবারো কি সেই চিরাচরিত বাজেটই পেশ করা হবে নাকি নতুন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে সেটি একটি প্রশ্ন। কারণ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ১৫ মাস যাবত বন্ধ, শিক্ষার্থীর একটি অংশ ইতিমধ্যে ঝরে পড়েছে, একটি অংশ আর বিদ্যালয়েই আসবে না। বাকিরা সাধারন উপায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছেনা। এই বাস্তবতায় কেমন হওয়া উচিত এবারকার শিক্ষা বাজেট?
করোনাকাল দীর্ঘায়িত হলে বিকল্প পাঠদানের কথা ভাবতেই হবে। সেটি ভার্চুয়াল ক্লাস, অনলাইন এবং ডিজিটাল ল্যাব তথা ক্লাসরুমের চিন্তা করতে হবে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটি করতে হলে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনানুযায়ী কোথাও বিনামূল্যে কোথাও স্বল্পসুদে ল্যাপটপ প্রদান, মোবাইল ডাটা, অ্যান্ড্রয়েড ফোন ক্রয়ের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। অনলাইনে লেকচার/ক্লাস আপলোড, অনলাইনে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, নম্বর প্রদানের সফটওয়্যার ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। শিকক্ষকদের অনলাইনে পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এগুলো সবই অর্থের সাথে যুক্ত আর বাজেটও সেভাবে প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
বাজেটে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি খরচের দিকনির্দেশনাও থাকতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে কোন খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমা-খরচের হিসাব রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়ে এরপর প্রয়োজন উত্তোলন করে খরচ করতে হবে। এতে ব্যাংকে জমা-উত্তোলনের হিসেব থাকবে। দুর্নীতির সুযোগ কমবে। ২৬ফেব্রুযারি ২০২১ তারিখে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে পূর্ন উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। ২০৩০ সালে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার অর্জন, ২০৪১ সালে উন্নত দেশ সোনার বাংলা, ২০৭১ সালে স্বাধীনতার ১০০ বছর পূতির্তে সমৃদ্ধির সর্বোচচ শিখরে ২১০০ সালে ডেল্টা প্ল্যান অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে দুর্নীতি রুখতে হবে যে কোন মূল্যে তা না হলে সরকারের সব উন্নয়ন উদ্যোগ বিফলে যাবে। দেশের বাইরে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে সেগুলো যদি দেশে থাকতো তাহলে শিক্ষাসহ সব ধরনের জরুরীখাতগুলোতে এখন সে অর্থ ব্যয় করা যেত।
চরম ক্ষতির শিকার প্রাথমিক স্তর থেকে উচচশিক্ষা পর্যায়ের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী ও ৫০লাখ শিক্ষক। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। গণসাক্ষরতা অভিযানে সমীক্ষা অনুযায়ী ৩১শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ও দূরশিক্ষণ বা বেতার, টেলিভিশন, অনলাইনের বিভিন্ন প্লাটফর্ম এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেওয়া পাঠদানের আওতায় এসেছে। যাদও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবী ৯২শতাংশ আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের দাবি ৬৫শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের পাঠদানের আওতায় এসেছে। পিপিআরসি ও বিআইজিডি-র গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের চিত্র আরও ভয়াবহ। করোনার অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার কিন্ডারগার্টেনে স্কুলগুলো। ভাড়া বাড়িতে অল্প পুঁজিতে চলা এসব স্কুলের একটি অংশ বন্ধ হয়ে গেছে। শিশু শিক্ষার্থীরা অবাক বিস্ময়ে দেখছে, যে স্কুলে তারা লেখাপড়া করতো, সেটি রাতারাতি উধাও হযে গেছে। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, সারাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল। এর অন্তত অর্ধেক করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলোর শিক্ষক ও স্টাফরা না খেয়ে, একবেলা খেয়ে কোন রকম বেঁচে আছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম বর্ষে কোন শিক্ষার্থী নেই। কারণ, ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে কোন শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারেনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়। এটি কিভাবে জোরা লাগানো যাবে কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা হবে তার নির্দেশনাও বাজেটে থাকা বাঞ্জনীয়। গত বছর অটোপাসের মাধ্যমে যারা এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেসব শিক্ষার্থীরাই প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়ার কথা। কিন্তু করোনার কারণে এখনও ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সঠিক সময়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হলে গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর থেকে এসব শিক্ষার্থীর ক্লাস শুরু হয়ে যেত।
শিক্ষাখাতে বাজেটের প্রভাব
প্রতিবছর বাজেটে যা হয় ফলাও করে বলা হয় যে, শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বাজেট। আকারের দিক থেকে হয়তো এটি সত্য কিন্তু শিক্ষার পরিবর্তনে এর কোন দৃশ্যমান প্রভাব পড়ে কিনা সেটি দেখতে হবে। বাজেটের আকারের চেয়ে অর্থ ব্যয়ের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা এবং সর্বোপরি দক্ষতার বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। আর এগুলোর সাথে জড়িত সঠিক পরিকল্পনা, নির্দেশান ও সততা। শুধু এইখাতে এতটাকা ব্যয় হবে, এই টাকার এত শতাংশ আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে, বাকিটা দাতাগোষ্ঠী থেকে ইত্যাদি ইত্যাদ ঠিক আছে। কিন্তু সাথে একটি কৌশলপত্রও থাকতে হবে কিভাবে, কোন সময়ের মধ্যে অর্থ ব্যয় হবে। সাথে থাকতে হবে দুর্নীতিরোধের রক্ষাকবচও। এটি কিভাবে তৈরি করা সম্ভব?
সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয় নিজ নিজ বিষয়, উন্নয়ন, সংশোধন, ব্যয়সীমা, ব্যয়ের প্রকৃতি, পদ্ধতি ও দুর্নীতিরোধের উপায়সহ অর্থমন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবেন এবং এর প্রতিটি বিষয় জনগনের কাছে উন্মুক্ত থাকতে হবে। জনগনের কাছ থেকে যতই বিষয়গুলো গোপন করা হবে, জনগন ততই ঠকতে থাকবে। অন্ধকে হাইকোর্ট দেখানো সহজ হয়। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উন্মুক্ত তথ্য অধিকার। যেমন আপনি সরকারি কোন দপ্তরে একটি দরখাস্ত করেছেন, অপনাকে জানতে হবে, কার কাছে সেটি করতে হবে এবং কতদিনের মধ্যে সেটির সুরাহা হবে। তা না জানলে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী (যারা মূলত জনগনের সেবক) জনগনকে অন্ধকারে রাখবেন, হাইকোর্ট দেখাবেন সেবাদান হবে সুদূর পরাহত। রাষ্ট্রকে জানাতে হবে তার জনগন রাষ্ট্রের কাছে কি কি পাবেন, কোন সময়ে পাবেন এবং কিভাবে পাবেন। এসব বিষয় জানালে রাষ্ট্র ও জনগনের মাঝে কোন গ্যাপ তৈরি হবেনা, সেবা নিশ্চিত হবে। আর সেবা নিশ্চিত হলে বাজেটের বৃহত্তর অংশ সঠিক পথে, কাঙ্খিত পথে ব্যয় হবে। দুর্নীতি হ্রাস পাবে। এটি একটি চেইন। একটির সাথে আর একটি জড়িত।