শুক্রবার, জুন ৯, ২০২৩

বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান এবং আকরাম খান প্রসঙ্গে কিছু কথা

সাকিব আল হাসানদের যেভাবে দমিয়ে রাখতে চায় আকরাম খান বা নাইমুর রহমান দুর্জয়রা সেটা দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো কোনো বার্তা দিচ্ছে না।

সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার ও বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে নেমেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। আর মাঠে নেমেই তিনি সাফল্য পেয়েছেন এবং তাঁর হাত ধরে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। এরপরে টেস্ট খেলতে গিয়ে পড়েছেন ইনজুরিতে। পরবর্তিতে যখন সেড়ে উঠলেন তখন নিলেন ছুটি। নিউজিল্যন্ড সিরিজ রেখে তিনি চলে গেলেন সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে যুক্তরাষ্ট্রে। এই ছুটির বিষয়টি অনুমতই ছিল। এর মধ্যেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) নিলামে সাকিব আল হাসানকে ভালো একটি মূল্যে আদলে নেয় কোলকাতা নাইট রাইডার্স (কেকেআর)। কেকেআর যখন সাকিব আল হাসানকে পুনরায় দলে নিলো তখন অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, সাকিব আল হাসান সেখানে আদৌ খেলতে পারবেন কি না। যেহেতু আইপিএল যখন অনুষ্ঠিত হবে তখন বাংলাদেশের সাথে একটি দ্বিপক্ষীয় টেস্ট সিরিজ খেলবে শ্রীলঙ্কা, শ্রীলঙ্কার মাটিতে এই টেস্ট সিরিজটি অনেক আগেই হবার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস মহামারীতে তা আটকে যায়। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কা বনাম বাংলাদেশের এই টেস্ট সিরিজটি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্ত। তবে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান এবং আকরাম খান প্রসঙ্গে কিছু কথা বলাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো?- এ প্রবন্ধে তা অল্পতেই তুলে ধরা হয়েছে।

সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কে চিঠি দিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলঙ্কা সফরে না খেলে আইপিএল খেলার অনুমতি প্রসঙ্গে। বিসিবি তাকে অনুমতি দিলো। কিন্তু এটি ভালো চোখে দেখেননি দেশের অসংখ্য ক্রিকেটভক্ত। তাঁরা নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন এসব বলে যে, সাকব আল হাসান নিজের দেশকে ভালোবাসেন না, সাকিব আল হাসানের প্রচুর টাকার লোভ, সাকিব আল হাসান নীতিহীন ইত্যাদি। কিন্তু পেশাদারিত্বের জায়গা বিবেচনায় অনেকেই এটাকে খুব একটা গুরত্ব দেননি, যেহেতু এটা একজন পেশাদার ক্রিকেট প্লেয়ারের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের আওতায় পড়ে।

ক্রিকেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান।
ক্রিকেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ছবিটি আইসিসির টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া।

বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান টেস্ট খেলতে চান না। এই গুজবটি ছড়িয়েছেন বিসিবির একজন বড়ো কর্মকর্তা আকরাম খান। আকরাম খান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সাকিব আল হাসান টেস্ট খেলতে রাজী নন তাই এবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে না খেলে আইপিএল খেলার জন্য ছুটি চেয়েছেন। আকরাম খান আরও বলেছেন, সে (সাকিব) টেস্ট খেলতেই চায় না যে কারণে তাকে জোর করে খেলাতেও চায় না বোর্ড যেহেতু এখানে ইচ্ছাকৃত ভালো না খেলার বা এই ফরম্যাট থেকে অবসর নেওয়ার একটা অবস্থা তৈরি হয়ে যেতে পারে। এই কারণে বোর্ড তাকে আইপিএল খেলার অনাপত্তিপত্র দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সফর থাকা স্বত্বেও। এটা আবার সাধারণ মানুষের মনের জ্বালা আরও বাড়িয়ে দেয়, তাঁরা সমাজমাধ্যমে নানাভাবে সাকিব আল হাসানকে আঘাত করে লিখতে থাকেন।

সাধারণ মানুষ বা সাধারণ ক্রিকেটভক্তদের কথা সাকিব আল হাসান কর্ণপাত করেননি। তবে সম্প্রতি ক্রিকফ্রেঞ্জি নামক একটি ক্রিকেট বিষয়ক ওয়েবসাইটে এসে বিসিবির একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। সাকিব আল হাসান দাবি করেছেন, তিনি যে চিঠিটি বিসিবিকে দিয়েছেন সেটার কোথাও টেস্ট না খেলার ব্যাপারে বলেননি। তিনি এখানে ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাট, অর্থাৎ টেস্ট ম্যাচ, একদিনের ম্যাচ এবং টোয়েন্টি টোয়েন্টি ম্যাচের পরিসংখ্যান মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, টেস্টেই তাঁর রেকর্ড সবথেকে ভালো। সাকিব আল হাসান জানালেন, তিনি টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চান। সাকিব আল হাসানের অভিযোগ তুলেছেন, আকরাম খানের বিরুদ্ধে। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, আকরাম খান সম্ভবত তাঁর দেওয়া চিঠিটি ভালো করে পড়েননি যে কারণে তিনি বলে বেড়াচ্ছেন, সাকিব টেস্ট খেলতে চায় না। বাকিটা তো বোঝাই গেল যখন চিঠির একটি কপি সাংবাদিক জনাব উৎপল শুভ্র সামনে নিয়ে এসেছেন।

সাকিব আল হাসান যখন এরকম অভিযোগ আনলেন বিসিবির বড়ো পদ দখল করে থাকা আকরাম খানের বিরুদ্ধে, তখনই আকরাম খান রাগে ফেটে পড়লেন এবং সাংবাদিকদের জানালেন সাকিবের আইপিএল খেলার অনাপত্তিপত্র পুনরায় বিবেচনা করবে বোর্ড। আকরাম খান জানালেন, তিনি এবার তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন।

এখানে আমরা বুঝতে পারি আকরাম খান সব সময়ই নিজের মতামতকে এবং পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যেহেতু বিসিবির একটা ভালো পদে রয়েছেন, সেহেতু বিসিবির কোনো কর্মকর্তা বা কোনো খেলোয়াড় সম্পর্কে তাঁর মনগড়া কথা না বলা বা মনগড়া বক্তব্য না করাই উচিৎ। সাকিব আল হাসান চিঠিতে যা লিখেছেন তাকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করাটা কি অন্যায় নয়? তিনি এই বিষয়ে যখন কথা বলেন, তখন এক ধরণের ক্ষোভ ঝেড়েই কথা বলেন সাকিব সম্পর্কে। কিন্তু তাঁর এতটুকু বোঝার ক্ষমতা নেই যে, তিনি যে দাপ্তরিক পদে আছেন সেখানে বসে মনগড়া কোনো কথা বলাটা অপরাধ। আকরাম খানের সাথে সাকিব আল হাসানের কোনো ব্যক্তিগত ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে কি না সেটি আমাদের জানার কথা নয়, তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে বোঝা যায় তিনি সাকিবকে পছন্দ করেন না। আর সাকিব আল হাসানকে ধরা যায় একজন প্রকৃত পেশাদার হিসেবেই।

সাকিব আল হাসান যখনই অভিযোগ আনলেন, আকরাম খান সেই চিঠি ভালো ভাবে পড়েননি বলেই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন ঠিক তখনি আকরাম খানের তেজ দেখা গেল এবং মিটিঙে বসে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কথা জানালেন। বিষয়টা কোন ধরণের পেশাদারিত্ব থেকে দেখছেন আকরাম খান সেটা তিনিই ভালো জানেন। কিন্তু ভাবেভঙ্গিতে বোঝা চলে, আকরাম খানের মতো লোকদের প্রেস্টিজের মূল্য প্রচুর এবং তাঁরা ভুল বা শুদ্ধ যেটাই করুন না কেন সেটাই মেনে নিতে হবে সকলের।

আর ছোট্ট করে বলে নেই, নাইমুর রহমান দুর্জয় সম্পর্কে হাই পারফরম্যান্স ইউনিট নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন সাকিব আল হাসান সেটি ভালো ভাবে নেননি নাইমুর রহমান দুর্জয়। দুর্জয় মন্তব্য করেছেন, সাকিব এভাবে বলতে পারে না এবং সাকিব সম্ভবত তাকে পছন্দ করেন না। আসলেই কি তাই? মূলে কি আছে সেদিকে না তাকিয়ে সোজা কথায় বলি, যদি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের অবস্থা ভালোই থাকে এবং ২১টির মতো ছেলে জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতাসম্পন্ন থাকে তাহলে জাতীয় দল এরকম ঝিমিয়ে পড়া দল কেন? সাকিব আল হাসান একদমই মন্দ বলেননি।

যারা বলে থাকেন সাকিব আল হাসানকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তৈরি করেছে, তাহলে পারলে তাঁরা আরেকটা সাকিব আল হাসান বানিয়ে দেখাচ্ছে না কেন? বাংলাদেশ দলে প্রায় প্রতি সিরিজেই নতুন মুখ ঢুকছে কিন্তু স্থায়ী হতে পারছে কতজন? অথবা দলের মধ্যে যাদেরকে সবচেয়ে অভিজ্ঞ হিসেবে ধরা হয় কিংবা খাতা কলমেই অনেক অনেক ম্যাচ খেলেছেন তাঁরা দলের জন্য কী করতে পারছেন? একজন সাকিব আল হাসান ছাড়া যে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম অনেকাংশেই অচল তার প্রমাণ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে সিরিজেই বোঝা গিয়েছে। তিনটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ দল ভালো খেলেছে এবং জয় পেয়েছে কারণ সে দলে ছিলেন সাকিব আল হাসান। যদিও লোকে বলছে, এটা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সারির দল। হ্যাঁ, আমিও এটাই বলি। যদি বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সাকিবাল হাসানকে ছাড়া ভালো খেলার সামর্থ্য থাকত তাহলে ওই একই দলের সাথে টেস্ট সিরিজে নাস্তানাবুদ হলো কেন? এরপরে নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রসঙ্গ বাদই রাখলাম।

অন্যসব পেশাদারের মতো একজন ক্রিকেটারেরও অধিকার আছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কাছে ছুটি চাওয়ার আবার অন্যসব প্রতিষ্ঠানের মতোও ছুটি মঞ্জুর করা বা করারও অধিকার রাখে বিসিবি। কিন্তু ছুটি মঞ্জুর করার পর আকরাম খানের মতো একজন উঁচু পদের কর্মকর্তা গায়ে টেনে মন্তব্য করার অধিকার পেলেন কোথা থেকে?

শেষ কথা হলো- সাকিব আল হাসানদের যেভাবে দমিয়ে রাখতে চায় আকরাম খান বা নাইমুর রহমান দুর্জয়রা সেটা দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো কোনো বার্তা দিচ্ছে না। অন্যসব পেশার মতোই ক্রিকেটও একটা পেশাদারিত্বের জায়গা, এখানে নিজের ইচ্ছে বা অনিচ্ছে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড চাইলেই একটা ভালো চুক্তিতে যেতে পারে ক্রিকেটারদের সাথে যেটাতে কোনো ব্যক্তির প্রভাব থাকবে না বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের। যেমন আজ যদি সাকিব আল হাসানের সাথে বোর্ডের চুক্তি থাকত এবং সেখানে উল্লেখ করা থাকত, ‘বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলা চলাকালীন তিনি অন্য কোনো দলের হয়ে খেলতে পারবেন না’ তাহলে এই বিষয়টি এতদূর  আসত না। আর আকরাম খানকেও সাকিব ইস্যুতে এত নিজের ওজন বাড়ানোর চেষ্টা করতে দেখা যেত না।

মু. মিজানুর রহমান মিজান
মু. মিজানুর রহমান মিজানhttps://www.mizanurrmizan.info
মু. মিজানুর রহমান মিজান সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকায় মাস্টার অব এডুকেশন প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী এবং একজন স্বাধীন লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী।

For all latest articles, follow on Google News

বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে 'বিশ্লেষণ'-এর জন্য স্পনসরশিপ খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইমেইল: contact.bishleshon@gmail.com

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here