সোমবার, জুন ৫, ২০২৩

মনোবিজ্ঞান কাকে বলে— এর উৎপত্তি ও সংজ্ঞা

জীবিত জীবের আচরণ, ব্যক্তিবিশেষের কার্যকলাপ সম্পর্কিত বিজ্ঞান হলো মনোবিজ্ঞান।

‘সাইকি’ (Psyche) এবং ‘লোগোস’ (Logos) এই দুটি শব্দের সমম্বয়ে গঠিত শব্দ ‘সাইকোলজি’ (Psychology)। শব্দ দুটি গ্রিক ভাষা থেকে এসেছে। ‘সাইকি’ অর্থ আত্মা এবং ‘লোগোস’ অর্থ বিজ্ঞান। ‘আত্মা’ এবং ‘মন’কে প্রাচীন দার্শনিকেরা একই অর্থে ব্যবহার করতেন। তাই মনোবিজ্ঞানের উৎস দর্শনশাস্ত্র। মনোবিজ্ঞানের জনক অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের শারীরবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড।

অ্যারিস্টটল, প্লেটো এবং সক্রেটিস তাঁদের লেখায় আত্ম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সর্বপ্রথম অ্যারিস্টটল তাঁর De Anima (On the Soul) নামক গ্রন্থে ‘সাইকোলজি’ সম্পর্কে বিশদভাবে লিখেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে মনোবিজ্ঞান দর্শনশাস্ত্র থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় লক পরীক্ষা শুরু হয় ১৮৭৯ সালে। আর এ কাজটি শুরু করেন জার্মানির লিপজিগের মনোবিজ্ঞানী উন্ড (Wundt)। আর তখন থেকেই মনোবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানরূপে বিবেচিত হয়। প্রথমে মনোবিজ্ঞানকে আত্মার বিজ্ঞান, পরে মন ও চেতনার বিজ্ঞান এবং আধুনিক কালে আচরণের বিজ্ঞান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী বিভিন্ন সময়ে মনোবিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। এখন আমরা সেগুলি পর্যালোচনা করে দেখব। 

মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

“আত্মাসম্পর্কীয় বিজ্ঞানই হলো মনোবিজ্ঞান”—এই সংজ্ঞাকে সমর্থন দিয়েছেন প্লেটো, এরিস্টটল ও মাহের প্রমুখ। কিন্তু এ সংজ্ঞাকে আধুনিক মনোবিজ্ঞানীগণ সমর্থন করেন না। কারণ মনোবিজ্ঞান বিজ্ঞান পর্যায়ভুক্ত বলেই এর বিষয়বস্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের আওতায় আসা প্রয়োজন কিন্তু আত্মকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের বিষয় হিসেবে নিয়ে আসা সম্ভব নয়, এ কারণেই আত্মা মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। 

এ সম্পর্কীয় বিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞান এ সংজ্ঞাটি দিয়েছেন হফডিং। কিন্তু এ সংজ্ঞাটিও সত্নোষজনক নয়। কারণ আত্মার মতই মনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না। ধরাছোঁয়া এবং বিশেষ কোনো অবয়বে একে দেখা যায়না। এ ছাড়া মনোবিজ্ঞান কোন ধরনের বিজ্ঞান তা এখানে উল্লেখ নেই। মানবীয় আচরণ ও দৈহিক প্রক্রিয়া সম্পর্কেও এতে কোনো কিছু বলা হয়নি।

মনোবিজ্ঞান চেতনার বিজ্ঞান

ডেকার্টে, এঞ্জেল প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীগণ মানোবিজ্ঞানকে চেতনার বিজ্ঞান বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ সংজ্ঞাটিও গৃহীত হয়নি। কারণ এই সংজ্ঞায় ‘চেতনা’ ও ‘মন’ কে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘মনের’ চেতন স্তর ছাড়াও ‘অবচেতন’ এবং ‘অচেতন’ স্তর রয়েছে। চেতন স্তর মনের একটি অংশ মাত্র। খন্ডিত অংশ দিয়ে একটি সমগ্র বিষয়কে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই এ সংজ্ঞাটিও পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। ‘আত্মা’ এবং ‘মন’ যেমন অস্পষ্ট তেমনি চেতনাও অস্পষ্ট। আবার এই সংজ্ঞা গ্রহণ করা হলে প্রাণী, শিশু এবং অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানকে মনোবিজ্ঞানের শাখারূপে গণ্য করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া মনোবিজ্ঞান বস্তুনিষ্ঠ না ব্যক্তিনিষ্ঠ বিজ্ঞান তা এখানে বলা হয়নি। আচরণ ও দৈহিক প্রক্রিয়া সম্পর্কেও কোনো উল্লেখ নেই এখানে। 

মানসিক অবস্থা এবং প্রক্রিয়ার বিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞান 

মনোবিজ্ঞানী স্টাউটের মতে, মানসিক অবস্থা এবং প্রক্রিয়ার বিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞান। এখানে আত্মা, মন এবং চেতনার কোনো উল্লেখ নেই। তা সত্ত্বেও এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মনোবিজ্ঞান কোন ধরনের বিজ্ঞান এখানে তা উল্লেখ করা হয়নি। 

মনোবিজ্ঞান মানবীয় আচরণের বিজ্ঞান 

জে. বি. ওয়াটসন বলেছেন, যে বিজ্ঞান মানুষের আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করে তা মনোবিজ্ঞান। আচরণ বলতে আমরা উদ্দীপকের উপস্থিতিতে মানুষের প্রতিক্রিয়াকে বুঝে থাকি। 

প্রাত্যাহিক জীবনে আমরা হাসি, কাঁদি, ভয় পাই আর এর সবই হচ্ছে আচরণের উদাহরণ। এগুলি কোন উদ্দীপকের কারণেই ঘটে থাকে। 

মানুষের আচরণ তার মন, চেতনা ও মানসিক প্রক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ। এ সংজ্ঞাটি বিজ্ঞানসম্মত এবং গ্রহণযোগ্য। কারণ আচরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায়। তবে মনোবিজ্ঞানের আওতায় যাবতীয় প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয় বলে এখানে শুধু মানুষের আচরণ সম্পর্কে উল্লেখ করায় সংজ্ঞাটি সীমিত হয়ে পড়েছে।

জীবের আচরণ সম্পর্কীয় বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞান

ম্যাকডুগাল বলেছেন, জীবিত জীবের আচরণ সম্পর্কীয় বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞান ম্যাকডুগালের এ সংজ্ঞাটি অন্যান্য সংজ্ঞার তুলনায় আলাদা। এ সংজ্ঞায় শুধু মানুষ নয়, যাবতীয় জীবিত প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে ব্যাখ্যার দাবি করছে। এছাড়া মনোবিজ্ঞান কোন ধরনের বিজ্ঞান এখানে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। জীবের কার্যকলাপ যেভাবে ঘটে সেভাবে ব্যাখ্যা করাই বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানের কাজ। মনোবিজ্ঞানের কাজও তাই। এ জন্য বলা যায় সংজ্ঞাটি তুলনামূলক ভাবে গ্রহণযোগ্য।

পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবিশেষের কার্যকলাপ সংক্রান্ত বিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞান

মনোবিজ্ঞানী উডওয়ার্থ এই সংজ্ঞাটি দিয়েছেন। সংজ্ঞাটি তাহলে ব্যাখ্যা করা যাক। প্রথমত আমরা যে আচরণই করি না কেন তার সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক আছে। যেমন সাপকে দেখলেআমরা ভয় পাই। এর ফলে আমরা হয় দৌড়াই, না হয় কাউকে ডেকে পাঠাই অথবা অন্য কিছু করি। দ্বিতীয়ত জীবের ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটে তা ব্যাখ্যা করাই মনোবিজ্ঞানের কাজ- তাই এটি বস্তুনিষ্ঠ। তৃতীয়ত কার্যকলাপ বলতে উডওয়ার্থ জীবের যাবতীয় আচরণ বা কার্যকলাপকে  বুঝিয়েছেন। চতুর্থত ব্যক্তিবিশেষ বলতে তিনি ব্যক্তির দেহ ও মনের সমন্বিত রূপকেই বুঝিয়েছেন।দর্শনশাস্ত্র থেকে মনোবিজ্ঞানের উৎপত্তি। প্রথমে আত্ম তারপর মন, চেতনা, মানসিক অবস্থা ও প্রক্রিয়া এবং পরিশেষে মানুষের আচরণ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। 

জীবিত জীবের আচরণ, ব্যক্তিবিশেষের কার্যকলাপ সম্পর্কিত বিজ্ঞান হলো মনোবিজ্ঞান।

For all latest articles, follow on Google News

বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে 'বিশ্লেষণ'-এর জন্য স্পনসরশিপ খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইমেইল: contact.bishleshon@gmail.com

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here