১১:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

জীবনী: হাছন রাজা

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ১২:২২:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৯৮৫ বার পড়া হয়েছে

দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী (কল্পিত ছবি)

মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সংগীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্‌ মরমী সংগীতের প্রধান পথিকৃৎ; এর পাশাপাশি নাম করতে হয় ইবরাহীম তশ্না দুদ্দু শাহ্‌, পাঞ্জ শাহ্‌, পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্ত, আরকুম শাহ্‌, শিতালং শাহ, জালাল খাঁ এবং আরো অনেকে। তবে দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাছন রাজার। এখানে হাছন রাজার জীবনী সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।

মূল নিবন্ধে প্রবেশের আগে পড়ে নিন: হাছন রাজার নামের বানানে ‘স’ যোগে ‘হাসন’ এবং ‘ছ’ যোগে ‘হাছন’ উভয়ই প্রচলিত। তবে বেশিরভাগ বই, গবেষণাপত্র ও দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে ‘হাছন রাজা’ দেখা যায়; ‘হাসন রাজা’ লিখলেও ভুল হবে না।

হাছন রাজা কে?

দেওয়ান হাসন “হাছন” রাজা চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী। হাছন রাজার প্রকৃত নাম ছিল দেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী। সিলেটিরা রাজা শব্দটিকে রেজা বা রজা বলেন বা লিখেন তাই উনাদের নামে রেজা বা রজা লিখা ছিল তবে আসলে শব্দটি রাজা হবে। আসল শব্দ বা নামটি হলো অহিদুর রাজা কিন্তু তিনি হাছন রাজা নামেই সুপরিচিত ছিলেন।

নামদেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী 
ছদ্মনামদেওয়ান হাসন “হাছন” রাজা চৌধুরী
জন্ম২১শে ডিসেম্বর ১৮৫৪
জন্মস্থানরামপাশা, বিশ্বনাথ, সিলেট, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি
পেশাকবি এবং বাউল শিল্পী
মৃত্যু৬ই ডিসেম্বর ১৯২২ (বয়স ৬৭)

হাছন রাজার জন্ম ও বংশপরিচয়

হাছন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সেকালের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে। হাছন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর তৃতীয় পুত্র। আলী রাজা তাঁর মাসতুতো/খালাতো ভাই আমির বখ্‌শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাছন রাজার জন্ম। হাছনের পিতা দেওয়ান আলী রাজা তার অপূর্ব সুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শ মত তাঁরই নামের অনুকরণে বা আকারে তাঁর নামকরণ করেন অহিদুর রাজা।

হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাছন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার কোণাউরা গ্রামে তার পূর্ব পুরুষ বিজয় সিংহ বসতি শুরু করেন, পরে কোন একসময় বিজয় সিংহ কোণাউরা গ্রাম ত্যাগ করে একই এলাকায় নতুন আরেকটি গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তার বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নামের প্রথমাংশ “রাম” যোগ করে নামকরণ করেন রামপাশা।

হাছন রাজার বাল্যকাল

সিলেটে তখন আরবী-ফার্সির চর্চা খুব প্রবল ছিল। সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের নাজির আবদুল্লা বলে এক বিখ্যাত ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ মতে তার নামকরণ করা হয়- হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন- হাসান রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। মাজহারুদ্দীন ভূঁইয়া বলেন, “বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ে তেমনি সৌম্যদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফীকবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো।”(পৃ. ১৪, ঈদ সংখ্যা ‘হানাফী’, ১৩৪৪)”। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন।

হাছন রাজার যৌবনকাল

উত্তারিধাকার সূত্রে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী এবং শৌখিন। রমণী সম্ভোগে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন— “সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া”

প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন, নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। আশ্চর্যের বিষয় হল, এসব গানে জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে, ভোগ-বিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

হাছন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। তিনি ঘোড়া পুষতেন। তার প্রিয় দুটি ঘোড়ার নাম ছিল জং বাহাদুর এবং চান্দমুশকি।এই ভাবে হাছন রাজার মোট ৭৭টি ঘোড়ার নাম মিলে মোটকথা, শৌখিনতার পিছনেই তার সময় কাটতে লাগলো। আনন্দ বিহারে সময় কাটানোই হয়ে উঠলো তার জীবনের একমাত্র বাসনা। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠলেন।

জীবদ্দশায় ক্যামেরায় তোলা হাছন রাজার একমাত্র ছবিটি কলকাতার একটি স্টুডিওতে তোলা হয়েছিল।
জীবদ্দশায় ক্যামেরায় তোলা হাছন রাজার একমাত্র ছবিটি কলকাতার একটি স্টুডিওতে তোলা হয়েছিল।

হাছন রাজার বৈরাগ্যভাবের সূচনা

হাছন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালাতে লাগলেন। কিন্তু এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাছন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাছন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগলো। তার চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। ভুল ত্রুটিগুলো শুধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন। শুধু বহির্জগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। তার মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। এক ধরনের বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তার প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহ্‌র প্রেমে মগ্ন হলেন। তার সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো। সেই গানে তিনি সুরারোপ করতেন এভাবে—

“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।”

এভাবে প্রকাশ পেতে লাগলো তার বৈরাগ্যভাব। হাছন রাজা সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ডাকসাইটে রাজা এককালে ‘চন্ড হাছন’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি হলেন ‘নম্র হাসন’। তার এক গানে আক্ষেপের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে

“ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন
সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন”

পরিণত বয়সে তিনি বিষয় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ-জীবন যাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে হাসন এম. ই. হাই স্কুল, অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হয়।

হাছন রাজার সঙ্গীত সাধনা

হাছন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কত গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। হাছন উদাস গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাছন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্‌’সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায়, হাছন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তার গানের পাণ্ডুলিপি আছে। 

অনুমান করা চলে, তার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাছনের অপর গ্রন্থ শৌখিন বাহার-এর আলোচ্য বিষয়-‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার(লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী, ‘মরমী কবি হাসন রাজা’)। হাছন বাহার নামে তার আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাছন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।

মরমী গানের ছক-বাঁধা বিষয় ধারাকে অনুসরণ করেই হাছনের গান রচিত। ঈশ্বানুরক্তি, জগৎ জীবনের অনিত্যতা ও প্রমোদমত্ত মানুষের সাধন-ভজনে অক্ষমতার খেদোক্তিই তার গানে প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। কোথাও নিজেকে দীনহীন বিবেচনা করেছেন, আবার তিনি যে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে বাঁধা ঘুড়ি সে কথাও ব্যক্ত হয়েছে:

“গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতের ডুরি।
হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি।।
মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।
জযেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।।”

এই যে ‘মৌলা’ তিনিই আবার হাছন রাজার বন্ধু। স্পর্শের অনুভবের যোগ্য কেবল, তার সাক্ষাৎ মেলে শুধুমাত্র তৃতীয় নয়নে:

“আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে।
আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।।”

কিন্তু এই বন্ধুর সনে হাসন রাজার প্রেমের আশা বাঁধা পেত স্বজন ও সংসার। হাছনের খেদ:

“স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল।
কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল।।

এদিকে নশ্বর জীবনের সীমাবদ্ব আয়ু শেষ হয়ে আসে- তবু ‘মরণ কথা স্মরণ হইল না, হাছন রাজা তোর’। পার্থিব সম্পদ, আকাঙ্ক্ষা আর সম্ভোগের মোহ হাছন রাজাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আবার নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারেন:

যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়ি।
টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরিরে।।
সে সময় কোথায় রইব (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রী।
কোথায় রইব রামপাশা কোথায় লক্ষণছিরি রে।।
করবায় নিরে হাছন রাজা রামপাশায় জমিদারী।
করবায় নিরে কাপনা নদীর তীরে ঘুরাঘুরি রে।।
(আর) যাইবায় নিরে হাছন রাজা রাজাগঞ্জ দিয়া।?
করবায় নিরে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া রে।।
ছাড় ছাড় হাছন রাজা এ ভবের আশা।
প্রাণ বন্ধের চরণ তলে কর গিয়া বাসা রে।।

এই আত্নবিশ্লষণ ও আত্নোপলব্ধির ভেতর দিয়েই হাছন রাজা মরমী-সাধন-লোকের সন্ধান পেয়েছিলেন।

মরমীসাধনার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জাতধর্ম আর ভেদবুদ্ধির উপরে উঠা। সকল ধর্মের নির্যাস, সকল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যই আধ্যাত্ন-উপলব্ধির ভেতর দিয়ে সাধক আপন করে নেন। তার অনুভবে ধর্মের এক অভিন্ন রূপ ধরা পরে- সম্প্রদায় ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে অতক্রম করে সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করে। হাসন রাজার সঙ্গীত, সাধনা ও দর্শনে এই চেতনার প্রতিফলন আছে। হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের যুগল পরিচয় তার গানে পাওয়া যায়। অবশ্য মনে রাখা প্রয়োজন, কয়েক পুরুষ পূর্বে হিন্দু ঐতিহ্যের ধারা হাছন রাজার রক্তে প্রবহমান ছিল। হাছন রাজার মরমীলোকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঠাঁই ছিলোনা। তাই একদিকে ‘আল্লাজী’র ইশ্‌কে কাতর হাছন অনায়াসেই ‘শ্রীহরি’ বা ‘কানাই’-য়ের বন্দনা গাইতে পারেন। একদিকে হাসন বলেন:

“আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।”

আবার পাশাপাশি তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়:

“আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।।”

হাছনের হৃদয় কান্নায় আপ্লুত হয়,— ‘কী হইব মোর হাসরের দিন রে ভাই মমিন’,— আবার পাশাপাশি তার ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় এভাবে,- ‘আমি মরিয়া যদি পাই শ্যামের রাঙ্গা চরণ’ কিংবা ‘দয়াল কানাই, দয়াল কানাই রে, পার করিয়া দেও কাঙ্গালীরে’। আবার তিনি বলেন,’ হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা’। স্পষ্টই হাছনের সাধনা ও সঙ্গীতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পুরাণ ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন লালন ও অন্যান্য মরমী সাধকের সমানধর্মা।

হাছন রাজা কোন পন্থার সাধক ছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। তার পদাবলীতে কোন গুরুর নামোল্লেখ নেই। কেউ কেউ বলেন তিনি চিশ্‌তিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। সূফীতত্ত্বের প্রেরণা ও প্রভাব তার সঙ্গীতে ও দর্শনে থাকলেও, তিনি পুরোপুরি এই মতের সাধক হয়তো ছিলেন না। নিজেকে তিনি ‘বাউলা’ বা ‘বাউল’ বলে কখনো কখনো উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বাউলদের সমগোত্রীয় হলেও নিজে আনুষ্ঠানিক বাউল ছিলেন না। সূফীমতের সঙ্গে দেশীয় লোকায়ত মরমীধারা ও নিজস্ব চিন্তা-দর্শনের সমন্বয়ে তার সাধনার পথ নির্মিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। তার সঙ্গীতরচনার পশ্চাতে একটি সাধন-দর্শনের প্রভাব বলা যায়।

হাছনের গানে আঞ্চলিক শব্দ

হাছন রাজার গানে আঞ্চলিক বুলি, প্রবচন ও বাগ্‌ধারার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তার গানের ভাষাভঙ্গি ভাষাতাত্ত্বিকদের পর্যালোচনার আকর্ষনীয় উপকরণ হতে পারে। হাছন রাজার গানে ব্যবহৃত কিছু আঞ্চলিক শব্দ ও বাগ্‌ধারার তালিকা এখানে প্রণীত হলো

  • আক্কল
  • জিয়ন
  • ভালা
  • ঠেকাইলায়
  • মুঞ্জিয়া
  • গানা
  • বেসক
  • বাড়ৈ
  • খেইড়
  • বন্ধে
  • লাঙ্গ
  • নাতিন
  • বুচা
  • লেইনজ
  • আজল
  • হাড়ুয়া পোক
  • মাড়ইল
  • গুড্ডি
  • ডুরি
  • হাউস
  • রেকি
  • উন্দা কল
  • মুস্করিয়া
  • টাটি
  • ছঙ্গাসন
  • খেওয়ানী
  • টন্‌কাইলে
  • আঞ্জা
  • খুবী
  • খেশ
  • ঢেন্ডুরা
  • ঠমকাইয়া
  • নাছন
  • গছে
  • ফাল্‌
  • পুতলা
  • ভৈসাল
  • জুংরা
  • সামাইল
  • লাইন্তি
  • চিনিবায়
  • কহন
  • বিকে
  • চিড়াবারা
  • কারাকারা
  • তারাবারচ
  • আঙ্গে আর ডাঙ্গে
  • আন্ধাইর গুন্ধাইর

হাছন রাজার গান ও তার প্রকাশভঙ্গিতে গ্রামীণ সাবলীল ভাষা প্রকাশ পেয়েছে, যা শহুরে “ভদ্রলোক” সমাজের কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে। যেমন—

স্বামীর সেবা না করিলে, ধরাইব নি লাঙ্গে।।
লাঙ্গের সঙ্গে মন মজাইয়া হারাইলায় নিজ পতি।।
বুড়ি বড় হারামজাদা, ডাকে মোরে দাদা দাদা।।
হাসন রাজায় যায় তোদের মুখেতে হাগিয়া।।
মুতিয়া দে তোর বাপের মুখে, তার মুখে দে ছাই।।

হাছন রাজার কোনো কোনো গানে স্থান-কাল-পাত্রের পরিচয় চিহ্নিত আছে। লক্ষণছিরি ও রামপাশা-তার জন্মগ্রাম ও জমিদারী এলাকার উল্লেখ বারবার এসেছে। পাওয়া যায় সুরমা ও আঞ্চলিক নদী কাপনার নাম। কোন কোন গানে প্রসঙ্গ হিসেবে নিজেই উপস্থাপিত হয়েছেন। দিলারাম নামে তার এক পরিচারিকা, বেনামে সাধনসঙ্গিনী, মাঝে মাঝে তার গানে উপস্থাপিত হয়েছেন:

ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর।
হাসন রাজারে বান্ধিয়া রাখ দিলারাম তোর ঘর।।

কিংবা,

তোমরা শুন্‌ছনি গো সই।
হাছন রাজা দিলারামের মাথার কাঁকই।।”

হাছন রাজা মুখে মুখে গান রচনা করতেন, আর তার সহচরবৃন্দ কী নায়েব-গোমস্তা সে সব লিখে রাখতেন। তার স্বভাবকবিত্ব এসব গানে জন্ম নিত, পরিমার্জনের সুযোগ খুব একটা মিলতনা। তাই কখনো কখনো তার গানে অসংলগ্নতা, গ্রাম্যতা, ছন্দপতন ও শব্দপ্রয়োগে অসতর্কতা লক্ষ করা যায়। অবশ্য এই ত্রুটি সত্ত্বেও হাছন রাজার গানে অনেক উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তি, মনোহর উপমা-চিত্রকল্পের সাক্ষাৎ মেলে। তার কিছু গান, বিশেষ করে ‘লোকে বলে, বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপরে’, ‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল’, ‘মরণ কথা স্মরণ হইল না হাছন রাজা তোর’, ‘আমি যাইমুরে যাইমুরে আল্লার সঙ্গে’, ‘কানাই তুমি খেইর খেলাও কেনে’, ‘একদিন তোর হইব রে মরন রে হাসন রাজা’- সমাদৃত ও লোকপ্রিয় শুধু নয়, সঙ্গীত-সাহিত্যের মর্যাদাও লাভ করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে হাছন রাজা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯শে ডিসেম্বর ১৯২৫ Indian Philosophical Congress-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাছন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তার দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষণটি ‘Modern Review’ (January 1926 ) পত্রিকায় ‘The philosophy of Our People’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’ (মাঘ ১৩২২) পত্রিকায়। ভাষণে হাছন রাজা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত হলো :

“পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির [হাছন রাজা] গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—

“মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম
নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়।”

এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনইভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আধিত্যমন্ডলে অধিষ্ঠিত।

“রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে।
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে।।”

১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারে’ রবীন্দ্রনাথ ‘The Religion of Man’ নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাছন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেন।

হাছন রাজার মৃত্যু

হাছন রাজা ৭ই ডিসেম্বর ১৯২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকাধীণ গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে রয়েছে তার সমাধি।

সংস্কৃতিকে জনপ্রিয়তা

  • হাসন রাজার জীবনের উপর ভিত্তিকৃত প্রথম চলচ্চিত্র হাসন রাজা ২০০২ সালে মুক্তি পায়; এটির পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম এবং প্রযোজনা করেন এই চলচ্চিত্রের মূখ্য অভিনেতা হেলাল খান। এতে আরো অভিনয় করেছেন ববিতা, সিমলা, অমল বোস প্রমূখ।
  • হাসন রাজার জীবনের উপর ভিত্তিকৃত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র হাসন রাজা ২০১৭ সালে মুক্তি পায়। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রের পরিচালনা করেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক রুহুল আমিন। এতে অভিনয় করেন ভারতীয় অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী এবং অভিনেত্রী রাইমা সেন।

রচনাবলী

  • হাছন উদাস – দেওয়ান হাছনরাজা কর্তৃক সংকলিত
  • শৌখিন বাহার
  • হাছন বাহার

তথ্যসূত্র

  • হোসেন, মকফুল। “তাহলে এটা হাসন রাজার ছবি নয়?”। প্রথম আলো।
  • ইসলাম, তাসিকুল (২০১২)। “হাসন রাজা”। ইসলাম, সিরাজুল; জামাল, আহমেদ উ.। বাংলাপিডিয়া (দ্বিতীয় সংস্করণ)। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
  •  সিলেটের মরমী মানস সৈয়দ মোস্তফা কামাল, প্রকাশনায়- মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ, প্রকাশ কাল ২০০৯
  •  দেওয়ান হাসন রাজা; অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ
  •  বিশ্বনাথের ইতিহাস ও ঐতিহ্য; পৃঃ নং-২৪১।
  •  ‘হাছন রাজা সমগ্র’, পৃষ্ঠা – ৬৬৩, সম্পাদনায় – দেওয়ান তাছাওয়ার রাজা, প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০০০ খ্রি
  • Rabindranath Tagore, “The Religion of Man: The Man of My Heart, Being The Hibbert Lectures for 1930”, The MacMillan Company, New-York, 1931
  • Tasiqul Islam। “Hasan Raja”। Banglapedia (First edition)।
  • “সুনামগঞ্জ জেলা, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন”।
  •  হাসন রাজা চলচ্চিত্রের প্রিভিউ। “ওয়েটাইমস”। ওয়েটাইমস।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

জীবনী: হাছন রাজা

প্রকাশ: ১২:২২:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২

মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সংগীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্‌ মরমী সংগীতের প্রধান পথিকৃৎ; এর পাশাপাশি নাম করতে হয় ইবরাহীম তশ্না দুদ্দু শাহ্‌, পাঞ্জ শাহ্‌, পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্ত, আরকুম শাহ্‌, শিতালং শাহ, জালাল খাঁ এবং আরো অনেকে। তবে দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাছন রাজার। এখানে হাছন রাজার জীবনী সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।

মূল নিবন্ধে প্রবেশের আগে পড়ে নিন: হাছন রাজার নামের বানানে ‘স’ যোগে ‘হাসন’ এবং ‘ছ’ যোগে ‘হাছন’ উভয়ই প্রচলিত। তবে বেশিরভাগ বই, গবেষণাপত্র ও দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে ‘হাছন রাজা’ দেখা যায়; ‘হাসন রাজা’ লিখলেও ভুল হবে না।

হাছন রাজা কে?

দেওয়ান হাসন “হাছন” রাজা চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী। হাছন রাজার প্রকৃত নাম ছিল দেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী। সিলেটিরা রাজা শব্দটিকে রেজা বা রজা বলেন বা লিখেন তাই উনাদের নামে রেজা বা রজা লিখা ছিল তবে আসলে শব্দটি রাজা হবে। আসল শব্দ বা নামটি হলো অহিদুর রাজা কিন্তু তিনি হাছন রাজা নামেই সুপরিচিত ছিলেন।

নামদেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী 
ছদ্মনামদেওয়ান হাসন “হাছন” রাজা চৌধুরী
জন্ম২১শে ডিসেম্বর ১৮৫৪
জন্মস্থানরামপাশা, বিশ্বনাথ, সিলেট, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি
পেশাকবি এবং বাউল শিল্পী
মৃত্যু৬ই ডিসেম্বর ১৯২২ (বয়স ৬৭)

হাছন রাজার জন্ম ও বংশপরিচয়

হাছন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সেকালের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে। হাছন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর তৃতীয় পুত্র। আলী রাজা তাঁর মাসতুতো/খালাতো ভাই আমির বখ্‌শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাছন রাজার জন্ম। হাছনের পিতা দেওয়ান আলী রাজা তার অপূর্ব সুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শ মত তাঁরই নামের অনুকরণে বা আকারে তাঁর নামকরণ করেন অহিদুর রাজা।

হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাছন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার কোণাউরা গ্রামে তার পূর্ব পুরুষ বিজয় সিংহ বসতি শুরু করেন, পরে কোন একসময় বিজয় সিংহ কোণাউরা গ্রাম ত্যাগ করে একই এলাকায় নতুন আরেকটি গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তার বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নামের প্রথমাংশ “রাম” যোগ করে নামকরণ করেন রামপাশা।

হাছন রাজার বাল্যকাল

সিলেটে তখন আরবী-ফার্সির চর্চা খুব প্রবল ছিল। সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের নাজির আবদুল্লা বলে এক বিখ্যাত ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ মতে তার নামকরণ করা হয়- হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন- হাসান রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। মাজহারুদ্দীন ভূঁইয়া বলেন, “বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ে তেমনি সৌম্যদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফীকবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো।”(পৃ. ১৪, ঈদ সংখ্যা ‘হানাফী’, ১৩৪৪)”। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন।

হাছন রাজার যৌবনকাল

উত্তারিধাকার সূত্রে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী এবং শৌখিন। রমণী সম্ভোগে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন— “সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া”

প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন, নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। আশ্চর্যের বিষয় হল, এসব গানে জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে, ভোগ-বিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

হাছন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। তিনি ঘোড়া পুষতেন। তার প্রিয় দুটি ঘোড়ার নাম ছিল জং বাহাদুর এবং চান্দমুশকি।এই ভাবে হাছন রাজার মোট ৭৭টি ঘোড়ার নাম মিলে মোটকথা, শৌখিনতার পিছনেই তার সময় কাটতে লাগলো। আনন্দ বিহারে সময় কাটানোই হয়ে উঠলো তার জীবনের একমাত্র বাসনা। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠলেন।

জীবদ্দশায় ক্যামেরায় তোলা হাছন রাজার একমাত্র ছবিটি কলকাতার একটি স্টুডিওতে তোলা হয়েছিল।
জীবদ্দশায় ক্যামেরায় তোলা হাছন রাজার একমাত্র ছবিটি কলকাতার একটি স্টুডিওতে তোলা হয়েছিল।

হাছন রাজার বৈরাগ্যভাবের সূচনা

হাছন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালাতে লাগলেন। কিন্তু এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাছন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাছন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগলো। তার চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। ভুল ত্রুটিগুলো শুধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন। শুধু বহির্জগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। তার মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। এক ধরনের বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তার প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহ্‌র প্রেমে মগ্ন হলেন। তার সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো। সেই গানে তিনি সুরারোপ করতেন এভাবে—

“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।”

এভাবে প্রকাশ পেতে লাগলো তার বৈরাগ্যভাব। হাছন রাজা সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ডাকসাইটে রাজা এককালে ‘চন্ড হাছন’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি হলেন ‘নম্র হাসন’। তার এক গানে আক্ষেপের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে

“ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন
সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন”

পরিণত বয়সে তিনি বিষয় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ-জীবন যাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে হাসন এম. ই. হাই স্কুল, অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হয়।

হাছন রাজার সঙ্গীত সাধনা

হাছন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কত গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। হাছন উদাস গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাছন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্‌’সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায়, হাছন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তার গানের পাণ্ডুলিপি আছে। 

অনুমান করা চলে, তার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাছনের অপর গ্রন্থ শৌখিন বাহার-এর আলোচ্য বিষয়-‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার(লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী, ‘মরমী কবি হাসন রাজা’)। হাছন বাহার নামে তার আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাছন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।

মরমী গানের ছক-বাঁধা বিষয় ধারাকে অনুসরণ করেই হাছনের গান রচিত। ঈশ্বানুরক্তি, জগৎ জীবনের অনিত্যতা ও প্রমোদমত্ত মানুষের সাধন-ভজনে অক্ষমতার খেদোক্তিই তার গানে প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। কোথাও নিজেকে দীনহীন বিবেচনা করেছেন, আবার তিনি যে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে বাঁধা ঘুড়ি সে কথাও ব্যক্ত হয়েছে:

“গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতের ডুরি।
হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি।।
মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।
জযেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।।”

এই যে ‘মৌলা’ তিনিই আবার হাছন রাজার বন্ধু। স্পর্শের অনুভবের যোগ্য কেবল, তার সাক্ষাৎ মেলে শুধুমাত্র তৃতীয় নয়নে:

“আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে।
আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।।”

কিন্তু এই বন্ধুর সনে হাসন রাজার প্রেমের আশা বাঁধা পেত স্বজন ও সংসার। হাছনের খেদ:

“স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল।
কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল।।

এদিকে নশ্বর জীবনের সীমাবদ্ব আয়ু শেষ হয়ে আসে- তবু ‘মরণ কথা স্মরণ হইল না, হাছন রাজা তোর’। পার্থিব সম্পদ, আকাঙ্ক্ষা আর সম্ভোগের মোহ হাছন রাজাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আবার নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারেন:

যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়ি।
টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরিরে।।
সে সময় কোথায় রইব (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রী।
কোথায় রইব রামপাশা কোথায় লক্ষণছিরি রে।।
করবায় নিরে হাছন রাজা রামপাশায় জমিদারী।
করবায় নিরে কাপনা নদীর তীরে ঘুরাঘুরি রে।।
(আর) যাইবায় নিরে হাছন রাজা রাজাগঞ্জ দিয়া।?
করবায় নিরে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া রে।।
ছাড় ছাড় হাছন রাজা এ ভবের আশা।
প্রাণ বন্ধের চরণ তলে কর গিয়া বাসা রে।।

এই আত্নবিশ্লষণ ও আত্নোপলব্ধির ভেতর দিয়েই হাছন রাজা মরমী-সাধন-লোকের সন্ধান পেয়েছিলেন।

মরমীসাধনার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জাতধর্ম আর ভেদবুদ্ধির উপরে উঠা। সকল ধর্মের নির্যাস, সকল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যই আধ্যাত্ন-উপলব্ধির ভেতর দিয়ে সাধক আপন করে নেন। তার অনুভবে ধর্মের এক অভিন্ন রূপ ধরা পরে- সম্প্রদায় ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে অতক্রম করে সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করে। হাসন রাজার সঙ্গীত, সাধনা ও দর্শনে এই চেতনার প্রতিফলন আছে। হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের যুগল পরিচয় তার গানে পাওয়া যায়। অবশ্য মনে রাখা প্রয়োজন, কয়েক পুরুষ পূর্বে হিন্দু ঐতিহ্যের ধারা হাছন রাজার রক্তে প্রবহমান ছিল। হাছন রাজার মরমীলোকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঠাঁই ছিলোনা। তাই একদিকে ‘আল্লাজী’র ইশ্‌কে কাতর হাছন অনায়াসেই ‘শ্রীহরি’ বা ‘কানাই’-য়ের বন্দনা গাইতে পারেন। একদিকে হাসন বলেন:

“আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।”

আবার পাশাপাশি তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়:

“আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।।”

হাছনের হৃদয় কান্নায় আপ্লুত হয়,— ‘কী হইব মোর হাসরের দিন রে ভাই মমিন’,— আবার পাশাপাশি তার ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় এভাবে,- ‘আমি মরিয়া যদি পাই শ্যামের রাঙ্গা চরণ’ কিংবা ‘দয়াল কানাই, দয়াল কানাই রে, পার করিয়া দেও কাঙ্গালীরে’। আবার তিনি বলেন,’ হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা’। স্পষ্টই হাছনের সাধনা ও সঙ্গীতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পুরাণ ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন লালন ও অন্যান্য মরমী সাধকের সমানধর্মা।

হাছন রাজা কোন পন্থার সাধক ছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। তার পদাবলীতে কোন গুরুর নামোল্লেখ নেই। কেউ কেউ বলেন তিনি চিশ্‌তিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। সূফীতত্ত্বের প্রেরণা ও প্রভাব তার সঙ্গীতে ও দর্শনে থাকলেও, তিনি পুরোপুরি এই মতের সাধক হয়তো ছিলেন না। নিজেকে তিনি ‘বাউলা’ বা ‘বাউল’ বলে কখনো কখনো উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বাউলদের সমগোত্রীয় হলেও নিজে আনুষ্ঠানিক বাউল ছিলেন না। সূফীমতের সঙ্গে দেশীয় লোকায়ত মরমীধারা ও নিজস্ব চিন্তা-দর্শনের সমন্বয়ে তার সাধনার পথ নির্মিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। তার সঙ্গীতরচনার পশ্চাতে একটি সাধন-দর্শনের প্রভাব বলা যায়।

হাছনের গানে আঞ্চলিক শব্দ

হাছন রাজার গানে আঞ্চলিক বুলি, প্রবচন ও বাগ্‌ধারার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তার গানের ভাষাভঙ্গি ভাষাতাত্ত্বিকদের পর্যালোচনার আকর্ষনীয় উপকরণ হতে পারে। হাছন রাজার গানে ব্যবহৃত কিছু আঞ্চলিক শব্দ ও বাগ্‌ধারার তালিকা এখানে প্রণীত হলো

  • আক্কল
  • জিয়ন
  • ভালা
  • ঠেকাইলায়
  • মুঞ্জিয়া
  • গানা
  • বেসক
  • বাড়ৈ
  • খেইড়
  • বন্ধে
  • লাঙ্গ
  • নাতিন
  • বুচা
  • লেইনজ
  • আজল
  • হাড়ুয়া পোক
  • মাড়ইল
  • গুড্ডি
  • ডুরি
  • হাউস
  • রেকি
  • উন্দা কল
  • মুস্করিয়া
  • টাটি
  • ছঙ্গাসন
  • খেওয়ানী
  • টন্‌কাইলে
  • আঞ্জা
  • খুবী
  • খেশ
  • ঢেন্ডুরা
  • ঠমকাইয়া
  • নাছন
  • গছে
  • ফাল্‌
  • পুতলা
  • ভৈসাল
  • জুংরা
  • সামাইল
  • লাইন্তি
  • চিনিবায়
  • কহন
  • বিকে
  • চিড়াবারা
  • কারাকারা
  • তারাবারচ
  • আঙ্গে আর ডাঙ্গে
  • আন্ধাইর গুন্ধাইর

হাছন রাজার গান ও তার প্রকাশভঙ্গিতে গ্রামীণ সাবলীল ভাষা প্রকাশ পেয়েছে, যা শহুরে “ভদ্রলোক” সমাজের কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে। যেমন—

স্বামীর সেবা না করিলে, ধরাইব নি লাঙ্গে।।
লাঙ্গের সঙ্গে মন মজাইয়া হারাইলায় নিজ পতি।।
বুড়ি বড় হারামজাদা, ডাকে মোরে দাদা দাদা।।
হাসন রাজায় যায় তোদের মুখেতে হাগিয়া।।
মুতিয়া দে তোর বাপের মুখে, তার মুখে দে ছাই।।

হাছন রাজার কোনো কোনো গানে স্থান-কাল-পাত্রের পরিচয় চিহ্নিত আছে। লক্ষণছিরি ও রামপাশা-তার জন্মগ্রাম ও জমিদারী এলাকার উল্লেখ বারবার এসেছে। পাওয়া যায় সুরমা ও আঞ্চলিক নদী কাপনার নাম। কোন কোন গানে প্রসঙ্গ হিসেবে নিজেই উপস্থাপিত হয়েছেন। দিলারাম নামে তার এক পরিচারিকা, বেনামে সাধনসঙ্গিনী, মাঝে মাঝে তার গানে উপস্থাপিত হয়েছেন:

ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর।
হাসন রাজারে বান্ধিয়া রাখ দিলারাম তোর ঘর।।

কিংবা,

তোমরা শুন্‌ছনি গো সই।
হাছন রাজা দিলারামের মাথার কাঁকই।।”

হাছন রাজা মুখে মুখে গান রচনা করতেন, আর তার সহচরবৃন্দ কী নায়েব-গোমস্তা সে সব লিখে রাখতেন। তার স্বভাবকবিত্ব এসব গানে জন্ম নিত, পরিমার্জনের সুযোগ খুব একটা মিলতনা। তাই কখনো কখনো তার গানে অসংলগ্নতা, গ্রাম্যতা, ছন্দপতন ও শব্দপ্রয়োগে অসতর্কতা লক্ষ করা যায়। অবশ্য এই ত্রুটি সত্ত্বেও হাছন রাজার গানে অনেক উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তি, মনোহর উপমা-চিত্রকল্পের সাক্ষাৎ মেলে। তার কিছু গান, বিশেষ করে ‘লোকে বলে, বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপরে’, ‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল’, ‘মরণ কথা স্মরণ হইল না হাছন রাজা তোর’, ‘আমি যাইমুরে যাইমুরে আল্লার সঙ্গে’, ‘কানাই তুমি খেইর খেলাও কেনে’, ‘একদিন তোর হইব রে মরন রে হাসন রাজা’- সমাদৃত ও লোকপ্রিয় শুধু নয়, সঙ্গীত-সাহিত্যের মর্যাদাও লাভ করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে হাছন রাজা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯শে ডিসেম্বর ১৯২৫ Indian Philosophical Congress-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাছন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তার দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষণটি ‘Modern Review’ (January 1926 ) পত্রিকায় ‘The philosophy of Our People’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’ (মাঘ ১৩২২) পত্রিকায়। ভাষণে হাছন রাজা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত হলো :

“পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির [হাছন রাজা] গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—

“মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম
নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়।”

এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনইভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আধিত্যমন্ডলে অধিষ্ঠিত।

“রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে।
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে।।”

১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারে’ রবীন্দ্রনাথ ‘The Religion of Man’ নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাছন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেন।

হাছন রাজার মৃত্যু

হাছন রাজা ৭ই ডিসেম্বর ১৯২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকাধীণ গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে রয়েছে তার সমাধি।

সংস্কৃতিকে জনপ্রিয়তা

  • হাসন রাজার জীবনের উপর ভিত্তিকৃত প্রথম চলচ্চিত্র হাসন রাজা ২০০২ সালে মুক্তি পায়; এটির পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম এবং প্রযোজনা করেন এই চলচ্চিত্রের মূখ্য অভিনেতা হেলাল খান। এতে আরো অভিনয় করেছেন ববিতা, সিমলা, অমল বোস প্রমূখ।
  • হাসন রাজার জীবনের উপর ভিত্তিকৃত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র হাসন রাজা ২০১৭ সালে মুক্তি পায়। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রের পরিচালনা করেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক রুহুল আমিন। এতে অভিনয় করেন ভারতীয় অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী এবং অভিনেত্রী রাইমা সেন।

রচনাবলী

  • হাছন উদাস – দেওয়ান হাছনরাজা কর্তৃক সংকলিত
  • শৌখিন বাহার
  • হাছন বাহার

তথ্যসূত্র

  • হোসেন, মকফুল। “তাহলে এটা হাসন রাজার ছবি নয়?”। প্রথম আলো।
  • ইসলাম, তাসিকুল (২০১২)। “হাসন রাজা”। ইসলাম, সিরাজুল; জামাল, আহমেদ উ.। বাংলাপিডিয়া (দ্বিতীয় সংস্করণ)। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
  •  সিলেটের মরমী মানস সৈয়দ মোস্তফা কামাল, প্রকাশনায়- মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ, প্রকাশ কাল ২০০৯
  •  দেওয়ান হাসন রাজা; অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ
  •  বিশ্বনাথের ইতিহাস ও ঐতিহ্য; পৃঃ নং-২৪১।
  •  ‘হাছন রাজা সমগ্র’, পৃষ্ঠা – ৬৬৩, সম্পাদনায় – দেওয়ান তাছাওয়ার রাজা, প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০০০ খ্রি
  • Rabindranath Tagore, “The Religion of Man: The Man of My Heart, Being The Hibbert Lectures for 1930”, The MacMillan Company, New-York, 1931
  • Tasiqul Islam। “Hasan Raja”। Banglapedia (First edition)।
  • “সুনামগঞ্জ জেলা, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন”।
  •  হাসন রাজা চলচ্চিত্রের প্রিভিউ। “ওয়েটাইমস”। ওয়েটাইমস।