শুক্রবার, জুন ৯, ২০২৩

ঝুমুর গান: ঝুমুর গানের সংজ্ঞা, তত্ত্ব, ইতিহাস, নামকরণ, বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ

বাঙালিদের মধ্যে ঝুমুর গান ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের শুরুর আগে থেকেই। তবে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য যে অঞ্চল জুড়ে বিকশিত হয়েছিল, ঝুমুর অঞ্চল তার বাইরে ছিল।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যা রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত লোকগীতি বিশেষ। এ নিবন্ধে ঘুমুর গানের তত্ত্ব, ইতিহাস ও প্রকারভেদ সম্পর্কে তুলে ধরা হলো।

ঝুমুর গান কী?

ঝুমুর গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যা রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত লোকগীতি বিশেষ। বঙ্গ বা বাংলা অর্থাৎ আধুনিক বাংলাদেশ ও আধুনিক ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে প্রাচীনকাল হতে প্রচলিত লোকগীতির ধরনসমূহের মধ্যে ঝুমুর গান একটি।  ঝুমুর গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা; ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগণা, সিংভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, গিরিডি, ধানবাদ ও বোকারো জেলা এবং উড়িষ্যা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ, সুন্দরগড়, কেঁওনঝাড় ও সম্বলপুর জেলা ইত্যাদি এক বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচলিত।

বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ রাঢ়, ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের একটি প্রকরণ হলো। মূলত ঝুমুর হলো গান, নাচ, তাল ও গায়নশৈলী নিয়ে একটি সাধারণ লোকসঙ্গীতের ধারা।

ঝুমুর গানের ইতিহাস

পূর্বে ঝুমুর গানগুলি মুখে মুখে রচিত হত, দাঁড় নাচের গান হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং কোন ভণিতা বা পদকর্তার উল্লেখ থাকতো না। কিন্তু চৈতন্য পরবর্তী যুগে ভণিতাযুক্ত ঝুমুরের সূচনা হয় এবং ধীরে ধীরে নৃত্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হলে পুরুষদের মহিলা সেজে দাঁড় নাচে অংশগ্রহণের প্রচলন শুরু হয়। এই সময় ঝুমুর গানের ওপর ভিত্তি করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও কীর্তনের সুরে নাচনী নাচ ও দরবারী ঝুমুরের প্রচলন হয়। এই সময়ের ঝুমুরে পুরাণকাহিনি, সহজিয়া বাউলতত্ত্ব এবং রাধা কৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক বৈষ্ণব ভক্তিতত্ত্ব স্থান পায়। ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী ঝুমুর গান বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার ওপর রচিত হওয়া শুরু হয়।

ঝুমুরের নামকরণ

ঝুমুর নামটি নিয়ে মতভেদ আছে। সুকুমার সেনের মতে-

‘…নাট্য গীতের একটি ধারা ঝুমুর নামে পরিচিত ছিল। এই নাট্য গীত পালায় কোন গদ্য সংলাপ থাকত না। পুরো পালাটাই ছিল গানের। সংস্কৃতে ঝুমুরকে বলা হত জম্ভলিকা। জম্ভলিকা নাচ হইতে আসিয়াছে রাজস্থানী ঝামাল গান। বাংলায় ইহা একদিকে ধামানীতে ও অপরদিকে ঝুমুর-এ পরিণত।’

সুকুমার সেনের মত গ্রহণ করলে, বলা যায় যে, হয়তো সাঁওতালি বা বাংলা ঝুমুর নাচ ও গানকে সংস্কৃতভাষীরা জম্ভলিকা বলতো। কেউ কেউ বলেন ঝুমুর (নূপুর) শব্দের সাথে ঝুমুর গানের সম্পর্ক আছে। আবার অনেক বলে থাকেন ঝুমরি রাগের বা সুরে পরিবেশিত গানগুলোই ঝুমুর গান নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।

বাঙালিদের মধ্যে ঝুমুর গান ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের শুরুর আগে থেকেই। তবে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য যে অঞ্চল জুড়ে বিকশিত হয়েছিল, ঝুমুর অঞ্চল তার বাইরে ছিল। সে কারণে, ঝুমুর পূর্ববঙ্গ, দক্ষিণ-মধ্য বঙ্গ, উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ অংশেই মধ্যযুগীয় সাহিত্যের প্রথমদিকে ততটা প্রভাব ফেলে নি। সম্ভবত সে কারণে বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ ঝুমুর বা ঝুমরি নামে কোনো গান বা রাগের উল্লেখ নেই। প্রখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাসের মাতামহ দামোদর সেনের ‘সঙ্গীত দামোদর’ গ্রন্থে প্রথম ‘ঝুমুর’ শব্দ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত সঙ্গীত দামোদরে উল্লেখ আছে: প্রায়ঃ শৃঙ্গারবহুলা মধ্বীক মধুরামৃদু। / একৈব ঝুমুরীলৌকে বর্ণদিনিয়মোজ্‌ঝিতা [প্রায়সই শৃঙ্গারবহুল মধুর মৃদু সুরার (মাধ্বীক) মতো। ঝুমুরে বর্ণাদি (বর্ণালঙ্কার ও ছন্দ) নিবদ্ধ নয়।]

ঝুমুর সম্পর্কে সঙ্গীত দামোদর-এর এই উক্তি অনুসারে জানা যায়, ঝুমুর গান শৃঙ্গার রসের এবং তাতে মধুর ব্যঞ্জনা আছে। অশ্লীল বলে এই গান দোষণীয় নয়। এই গানের কোনো বাঁধা-ধরা ছন্দও ছিল না।

মধ্যযুগের পদকল্পতরু নামক গ্রন্থের একটি পদে লেখা রয়েছে, ‘যুবতী যুথ শত গায়ত ঝুমরী’। মধ্যযুগের আদি কবি, বিদ্যাপতি তাঁর পদাবলীতে লিখেছেন, ‘গওই সহি লোরি ঝুমরি সঅন – আরাধনে যাঞা’। তাঁর পরবর্তী সময়ে রচিত গোবিন্দদাসের পদে পাওয়া যায়- ‘মদনমোহন হরি মাতল মনসিজ যুবতী যুথ গাওত ঝুমরী’। এ সকল নমুনা থেকে মনে হয়, বাংলা সাহিত্যের বা সঙ্গীতের মধ্যযুগের পূর্বে ঝুমুরের উপস্থিতি ছিল।

ভাদু গান সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

ঝুমুর গানের প্রচলিত প্রাচীনত্ব

ঝুমুর গানের প্রাচীনতত্ব সম্বন্ধে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায় না, তবে সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে এই গান প্রায় হাজার বছর ধরে চলে আসছে। তার মতে ঝুমুরের সঙ্গে কীর্তন মিশে পরবর্তীকালে যাত্রার উদ্ভব ঘটেছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার পশ্চিম সীমান্তবঙ্গের লোকগীতি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে মধ্যযুগে ঝুমুর শব্দের প্রচলন ছিল। মধ্যযুগের পদকল্পতরু গ্রন্থের একটি পদে লেখা রয়েছে, ‘যুবতী যুথ শত গায়ত ঝুমরী’।

মিথিলার কবি বিদ্যাপতি তার পদাবলীতে লিখেছেন, ‘গওই সহি লোরি ঝুমরি সঅন – আরাধনে যাঞা’।

গোবিন্দদাসের পদেও পাওয়া যায়, ‘মদনমোহন হরি মাতল মনসিজ যুবতী যুথ গাওত ঝুমরী।’

ঝুমুর গানে অধ্যাত্মভাবনা,  সামাজিক রীতিনীতি, জীবনযাপন চিত্র, অভাব, লড়াইয়ের আহবান, পুরাণ, রাজনীতি, ইতিহাস, প্রেম ইত্যাদি ফুটে উঠেছে। ঝুমুর গানের বিষয়গুলোর মধ্যে সম্ভবত ‘প্রেম’ সবথেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে; এই প্রেম লৌকিক এবং তাতে দেহেরই প্রাধান্য রয়েছে।

ষােড়শ শতকে প্রাচীন সংগীতবিষয়ক গ্রন্থ ‘সংগীত দামােদর’-এ ঝুমুর এবং সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে শৃঙ্গার রসের আধিক্যের কথাই বলা হয়েছে। একটি ঝুমুর গানের অংশ—

“চোখে চোখে ইশারাতে আর মনের কথা বলি তােমাকে,/রসিক যে জন বুঝবে সে জন আমার মনের বেদনা।/ও আমার যৌবন জ্বালা বড় জ্বালা বঁধু বিধেছে মদনা।”

উল্লেখযােগ্য ঝুমুর পদকর্তা জগৎ কবিরাজ, গদাধর চৌধুরী, ভবপ্রীতানন্দ ওঝা, রামকৃয় গাঙ্গুলি, সৈকত রক্ষিত প্রমুখ।

ঝুমুর গানের বৈশিষ্ট্য

  • নৃত্য, গীত ও বাদ্য সহযোগে ঝুমুর গাওয়া হলেও এতে গীতের প্রাধান্য থাকে।
  • ঝুমুর গানের সুর উচ্চগ্রাম থেক নিম্নগ্রামে অবরোহণ করা হয়, যা ঝুমুরের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
  • ঝুমুর গানে তালকে অগ্রাহ্য করে মাত্রা অনুসরণ করে সুর দেওয়া হয়। সম থেকে শুরু না করে ফাঁক থেকে গান শুরু করা হয়। 
  • সাধারণত সমঝদারের আসর ও নাচের আসর এই দুই জায়গায় ঝুমুর গাওয়া হয়। সমঝদারের আসরে বৈঠকী, ছুট ও পালাবদ্ধ ঝুমুর গাওয়া হয়।
  • বৈঠকী ঝুমুরে গায়ক একজন; কোন নাচ থাকে না এবং বাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় হারমোনিয়াম ও পাখোয়াজ।
  • ছুট ঝুমুর নাচ, গান, বাজনা সহযোগে একটি পূর্ণাঙ্গ ঝুমুর।
  • পালা ঝুমুর একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গাওয়া হয়।
  • নাচের আসরে নাচ, গান, বাজনা সহযোগে একটি পূর্ণাঙ্গ ঝুমুর গাওয়া হয়। এই আসরে রসক্যা বা রসিক সহযোগে নাচনী নাচ হয়ে থাকে।

ঝুমুরকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু সুর ও তালের প্রচলন হয়েছিল, যার মধ্যে অধিকাংশের অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। তবে ডহরওয়া, পতরতুলা, বেঁগাড়ি, পাটিয়ামেধা, রিঁঝামাঠা, ঝুমরা, ঝুমটা, একডাঁড়িয়া, গোলোয়ারি, নাগপুরিয়া, তামাড়িয়া, শিখারিয়া, পাঁচপরগণিয়া, মুদিআরি প্রভৃতি সুরের অস্তিত্ব বর্তমানে রয়েছে।

ঝুমুর গানের প্রকারভেদ

বিষয়বস্তু ও রচনার বৈশিষ্ট্য অনুসারে ঝুমুর গানকে নানা ভাগে বিভক্ত করা হয়।

মার্জিত ভাষায় রচিত

বিষয়বস্তু: দেহতত্ত্ব, কৃষ্ণলীলা, পুরাণ ইত্যাদি; পয়ার বা ত্রিপদী ছন্দে রচিত; চারটি কলি; ধুঁয়া, রঙ ও ভণিতাযুক্ত

উদাহরণ: দরবারী বা বৈঠকী ঝুমুর

লৌকিক   

কলির সংখ্যা তিন বা তিনের কম; সুরবৈচিত্র্য নেই; আকস্মিক আবেগে রচিত

উদাহরণ: টাঁড়, উধোয়া, ডমকচ, ডহরিয়া, দাঁড় প্রভৃতি

সুর, তাল, নৃত্য অনুসরণ করে ঝুমুর

উদাহরণ: বাউলছোঁয়া, ঢুয়া, কীর্তনছোঁয়া, দাঁড়শালিয়া, খেমটি, আড়হাইয়া প্রভৃতি

ঋতু অনুসারে

উদাহরণ: ভাদরিয়া, চৈতারি, আষাঢ়ি, বারমেসা প্রভৃতি

অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যানুসারে

উদাহরণ: বরাবাজারিয়া, বাগমুড়্যা, ঝালদোয়া, সিলিয়াড়ি, গোলায়ারি, তামাড়িয়া প্রভৃতি

জাতি অনুসারে

উদাহরণ: কুড়মালি, মুণ্ডারি প্রভৃতি

তথ্যসূত্র

  • ঝুমুর. অনুশীলন.
  • ঝুমুর কথা, ঝুমুর গীতি সংগ্রহ, ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টার, সাহায্যেঃ গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রক, ভারত সরকার; পঞ্চায়েত ও গ্রাম উন্নয়ন বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার; তথ্য ও সাংস্কৃতিক বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
  •  হরিধন মাহাতো, আদিরসকলা ঝুমুর পদাবলী
  •  তরুণদেব ভট্টাচার্য, পুরুলিয়া,ফার্মা কে এল প্রাইভেট লিমিটেড, ২৫৭-বি, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, কলকাতা-১২, ২০০৯

For all latest articles, follow on Google News

বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে 'বিশ্লেষণ'-এর জন্য স্পনসরশিপ খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইমেইল: contact.bishleshon@gmail.com

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here