০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

জীবনানন্দ দাশের কবিতার বিশেষত্ব

কামরুল ইসলাম ফারুকী
  • প্রকাশ: ০৬:৫৩:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ নভেম্বর ২০২২
  • / ৪৯৭৩ বার পড়া হয়েছে

জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪) | ইলাসট্রেশন: প্রথম আলো

তিরিশের কবিতা আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে বুদ্ধদেব বসু পরিচিত  হলোও তিরিশের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ফসল জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দের  মতোকবি প্রতিভাকে আশ্রয় না করলে তিরিশ বাংলা কবিতার ইতিহাসে সত্যিই এত বেশি আলোচিত ও দিক নির্ণয়কারী হত কিনা সন্দেহ।

জীবনকালে জীবনানন্দ দাশ খ্যাতির মুখ দেখে যেতে পারেননি। বরং তার কবিতায় বাক্যের শ্লথ ভঙ্গির মাঝে মাটিগন্ধা বিচিত্র শব্দ প্রয়োগ, প্রমিত বন্ধনের মাঝে ক্রিয়াপদের সাধুভঙ্গির ব্যবহার, মৃত্যুচিন্তা ও গলিত স্থবির অন্ধকারময় চিত্রকল্পের অধিষ্ঠান— এসব কারণে সমকালে তাকে নানা বিরূপ মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে তিরিশের অন্যান্য কবিদের নিয়মিত আসা যাওয়া থাকলেও জীবনানন্দের সাথে তার কখনও দেখা হয়নি। তবে তাদের মাঝে কয়েকটি চিঠি বিনিময় হয়েছিল। প্রথম চিঠিতে জীবনানন্দের কবি প্রতিভার স্বীকৃতির পাশাপাশি ভাষায় শব্দের জবরদস্তিমূলক ব্যবহার বিষয়ে কিছু কটাক্ষ ছিল। তবে জীবনানন্দের দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৭ সালে লেখা চিঠিতে জীবনানন্দ দাশের উচ্ছ্বসিত প্রশংশা করেন; এই চিঠিতে ছিল মাত্র দুই লাইন। দুই লাইনের সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা লেখেন তা  হলো— “তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।” জীবিত অবস্থায় এভাবে জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বুদ্ধদেব বসুর উৎসাহ পেয়েছেন। তবে পাঠক সমাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছেন মৃত্যুর অনেক পরে সত্তর ও আশির দশকের দিকে। এমনকি এখনও তার জনপ্রিয়তার ধারা বয়ে চলেছে। এখনও তিনি নতুন নতুন পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন কবিতায় তার চীরকালীন গন্তব্যের জন্য। 

বাংলা কবিতায় তিরিশের কবিরা টেকনিকের দিক থেকে যে নতুনত্ব আনেন তার মাঝে ব্যতিক্রমী শক্তি জীবনানন্দ দাশ। একমাত্র তিনিই টেকনিকের পাশাপাশি বোধকে কবিতা থেকে হারিয়ে যেতে দেননি, বরং বিচিত্রগন্ধী চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবিতাকে ভিন্নমাত্রায় অনুভূতিজাত করে তোলেছেন। তাঁর কবিতায় ঘাস-লতাপাতা, জীবন-মৃত্যু এসব বিষয় ঘুরে-ফিরে বিমূর্ত ভাষায় চিত্রিত হয়েছে।

জীবনানন্দের কবিতা বাংলা কবিতায় এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের  মতো সুন্দর। প্রথম দিকে নজরুল ও সত্যেন্দ্রনাথের ছন্দ ও শব্দের প্রভাব ছাড়া তার কবিতাকে মনে হয় বাংলা কবিতার ঐতিহ্য থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র, পথ ধরে পেছনে হেঁটে গেলে তার কোন পূর্বপুরুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনানন্দ কবিতায় বিমূর্ত ভাব আনলেন কিন্তু শব্দ ও চিত্রকল্পে পড়ে রইলেন আমাদের একেবারে পরিচিত জীবনে। শুধু পরিচিত নয় সাহিত্যে স্থান পেতে পারে এমন প্রশ্নবিদ্ধ নগন্য, ক্লেদাক্ত ও স্পর্শ- গন্ধময় জগত নিয়ে। ফলে কিছুদিন বিমূর্ত বা দুর্বোধ্য আখ্যা পেলেও তার কবিতা অগ্রসর পাঠকের অনুভূতিতে গভীর জায়গা করে নিতে বেশিদিন সময় নিল না। 

জীবনানন্দ দাশ উপমা ও চিত্রকল্প নির্মাণে এক সিদ্ধহস্ত কবি। চিত্রকল্প নির্মাণে দৃশ্যপ্রধান চিত্রকল্পের বাইরে তিনিই প্রথম অনুভূতির এত গভীরতায় গিয়ে ঘ্রাণ প্রধান, শ্রবণ প্রধান, স্বাদ প্রধান এমনকি বিবমিষা প্রধান চিত্রকল্পের প্রয়োগ ঘটান। যখন তিনি বলেন “হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল” কিংবা “সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত পৃথিবীতে শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর” দেখেন; তখন একইসাথে বিবমিষা ও নাগরিক অপরিচ্ছন্নতার বোধ ভেসে উঠে আমাদের চেতনায়।

রূপসী বাংলা হিসেবে খ্যাত বাংলার ত্রস্ত নীলিমার কবিতাগুলোতে একদিকে প্রকৃতি বর্ণনায় তিনি যেমন প্রবাদতুল্য, শেষ জীবনে প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন নগর জীবনের যাপন অভিজ্ঞতাতেও জীবনানন্দ দাশ সরব ছিলেন। শহর যেন এক মৃত লাশের  মতো উপস্থিত হয়েছে তার কবিতায়, সেখানে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন তিনি থ্যাতানো ইদুরের মতো। জীবনানন্দের গ্রামীণ চিত্রকল্প নির্মাণে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, সেটা  হলো তিনি চিত্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছেন টপ ভিউ থেকে। অর্থাৎ একটি পাখি উড়ে যেতে যেতে যেভাবে নিচের দৃশ্যাবলী দেখে কিছুটা তেমন। এজন্যই পৃথিবীকে জীবনানন্দ দাশ মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ হিসেবে দেখতে পেরেছিলেন। আবার নগর জীবনের বর্ণনার ক্ষেত্রে তার চিত্রকল্পগুলো একদমই প্রত্যক্ষ। নগরের বিষাক্ত শ্বাস যেন সরাসরি পড়ছে তার গায়ে, রিক্ত করে তোলছে তার সমস্ত মানস অবয়ব। 

কবিতায় ভাবগত নতুনত্ব সন্ধানের পাশাপাশি জীবনানন্দ দাশ আঙ্গিকগত নতুনত্বকেও গ্রহণ করেছেন। বাংলা ভাষার এলায়িত ভঙ্গিকে অনুভব করে তিনিই প্রথম কবিতায় গদ্যভাষার এত সার্থক প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কবিতায় গতানুগতিক অন্ত্যমিলের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি অন্ত্যমিলেও নতুনত্বের পরিচয় দেন। সফেন শব্দের সাথে বনলতা সেন এর অন্ত্যমিল তার একটি উদাহরণ। তাছাড়া উপমা প্রকাশেও তিনি ভিন্নতা আনেন। চোখকে পাখির নীড়ের  মতোকল্পনা করা, চুলের কালো রূপ প্রকাশ করতে গিয়ে ইতিহাসের লুপ্ত নগরীর সাথে তাকে তুলনা করা— সাদৃশ্যের এত সূক্ষ্ম পথে গিয়ে তিনিই প্রথম এসব করতে পেরেছিলেন। তার কবিতায় চিত্রকল্পের নতুনত্বের কোন অভাব নেই। কবিতা পড়তে পড়তে উটের গ্রীবার  মতোনিঃস্তব্ধতা এসে যখন গ্রাস করে, তখন চেনা দৃশ্যকেও ভাবতে বাধ্য করায় নতন বোধিচিত্ত দিয়ে।

জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪)
জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪) | ইলাসট্রেশন: প্রথম আলো

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যতিচিহ্নের ব্যবহার নতুন মাত্রা পেয়েছে। তার আগে বাংলা কবিতায় ড্যাশের এত ব্যবহার কেউ করেননি। বলা যায় ড্যাশকে তিনি শব্দের মতোই অর্থময় করে প্রকাশ করেছেন কবিতায়। বাক্যের ভেতরে ও অন্ত্যে ড্যাশের ব্যবহারের মাধ্যমে সেই ফাঁকা অংশে তিনি যেন কবিতায় ব্যক্ত বোধকে পাঠকের মনে সঞ্চারিত ও ব্যাপ্ত হওয়ার অবকাশ দিয়েছেন। এই ব্যাপারটি সত্যিই অতুলনীয়।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ভারতীয় পুরাণ ও লোককাহিনীর নানা উপকরণের সার্থক ব্যবহার দেখা যায়। কবিতায় এই উপাদানগুলো হাজার বছরের স্মৃতিকে বহন করে যেন সজোরে আঘাত করে বর্তমানের স্থিরতাকে। জীবনানন্দ দাশের  মতোগাণিতিক সংখ্যার ব্যবহার তার আগে ও পরে বাংলা কবিতায় এত সার্থকভাবে কেউ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। হাঁস নামক কবিতায় নয়টি হাঁসকে রোজ জলপাই পল্লবের  মতোস্নিগ্ধ জলে ভাসার বর্ণনা দিয়ে যখন তিনি বলেন, “তিনবার তিন গুনে নয় হয় পৃথিবীর পথে;/এরা তবু নয়জন মায়াবীর মতো জাদুবলে”— তখন তিন গুনে নয় হওয়ার বিষয়টি গাণিতিক নিয়মে নির্দিষ্টতায় আবদ্ধ না করে পাঠককে সুযোগ করে দেয় অবারিত কল্পনার। 

জীবনানন্দের কবিতায় নক্ষত্র, প্যাঁচা, ইঁদুর, সন্ধ্যা, ঢের— এসব শব্দ খুব বেশি দেখা যায়। চিত্রকল্প নির্মাণেও একধরণের চিত্রকল্পের দিকে তার খুব বেশি অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। তবে কবিতা নির্মাণে তিনি এত পারদর্শী যে প্রত্যেকটি কবিতায় পুরনো বাহনের ভেতর দিয়েও তিনি আলাদা আলাদা বোধকে সঞ্চার করতে পারেন। সব শিল্পীরই কিছু প্রিয় রঙ থাকে। বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি সেসব রঙের কিছু না কিছু চিহ্ন রাখতে চান। না রাখলে তিনি স্বস্তি পান না। সব কবিরই তেমন প্রিয় কিছু শব্দ ও চিত্রকল্প থাকে। বিভিন্ন কবিতায় নানাভাবে তা ফিরে ফিরে আসে। এটাকে সীমাবদ্ধতা ভাবার কিছু নেই। কবির ব্যক্তিত্ব, কল্পনা ও যাপনের অভিজ্ঞতার উপর এসবের প্রয়োগ নির্ভর করে। একই প্রকারের ঢিল ভিন্ন ভিন্ন পুকুরে তরঙ্গ তোলতে পারলে তার সৌন্দর্য দেখায় আমাদের আপত্তি নেই। 

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সাময়িক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ অনুরণন বা দ্রোহ নেই বলে কেউ কেউ যে অভিযোগ করে থাকেন তা মূলত জীবনানন্দকে গভীরভাবে পাঠ না করারই ফল। জীবনানন্দের কবিতায় শ্লোগানধর্মী দ্রোহ না থাকলেও তার শেষের দিকের কবিতায় যে নাগরিক ক্লান্তি, স্থবির জীবনচিত্র ও ব্যাঙ্গাত্মক ত্রিকোণের প্রয়োগ দেখি তা তার সমকাল ও বিশ্বব্যাপী মহাযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অবক্ষয়েরই সূক্ষ্ম অথচ তীব্র প্রতিবাদ।

বাংলা কবিতায় ধ্যানী, ঋষি, বীরভাব ও করুণ রসের অনেক বড়ো বড়ো কবি জন্মেছেন। তাদের মাঝে জীবনানন্দের জগত সম্পূর্ণ আলাদা। তার কবিতা জাদুমন্ত্রের  মতোপাঠককে শব্দের মানস মূর্তিতে টেনে নিয়ে যায়। শব্দের স্তরে স্তরে ছড়ানো ইতিহাস, স্মৃতি ও চেতনার আফিম ঘোরগ্রস্ত করে ফেলে সমস্ত আমিত্বকে। তখন কবিতা পড়তে পড়তে গ্লাসের তলায় নিমগ্ন পাথরকুচির  মতোপাঠক হঠাৎ আবিষ্কার করে নিজের অবচেতনাকে। 

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

জীবনানন্দ দাশের কবিতার বিশেষত্ব

প্রকাশ: ০৬:৫৩:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ নভেম্বর ২০২২

তিরিশের কবিতা আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে বুদ্ধদেব বসু পরিচিত  হলোও তিরিশের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ফসল জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দের  মতোকবি প্রতিভাকে আশ্রয় না করলে তিরিশ বাংলা কবিতার ইতিহাসে সত্যিই এত বেশি আলোচিত ও দিক নির্ণয়কারী হত কিনা সন্দেহ।

জীবনকালে জীবনানন্দ দাশ খ্যাতির মুখ দেখে যেতে পারেননি। বরং তার কবিতায় বাক্যের শ্লথ ভঙ্গির মাঝে মাটিগন্ধা বিচিত্র শব্দ প্রয়োগ, প্রমিত বন্ধনের মাঝে ক্রিয়াপদের সাধুভঙ্গির ব্যবহার, মৃত্যুচিন্তা ও গলিত স্থবির অন্ধকারময় চিত্রকল্পের অধিষ্ঠান— এসব কারণে সমকালে তাকে নানা বিরূপ মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে তিরিশের অন্যান্য কবিদের নিয়মিত আসা যাওয়া থাকলেও জীবনানন্দের সাথে তার কখনও দেখা হয়নি। তবে তাদের মাঝে কয়েকটি চিঠি বিনিময় হয়েছিল। প্রথম চিঠিতে জীবনানন্দের কবি প্রতিভার স্বীকৃতির পাশাপাশি ভাষায় শব্দের জবরদস্তিমূলক ব্যবহার বিষয়ে কিছু কটাক্ষ ছিল। তবে জীবনানন্দের দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৭ সালে লেখা চিঠিতে জীবনানন্দ দাশের উচ্ছ্বসিত প্রশংশা করেন; এই চিঠিতে ছিল মাত্র দুই লাইন। দুই লাইনের সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা লেখেন তা  হলো— “তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।” জীবিত অবস্থায় এভাবে জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বুদ্ধদেব বসুর উৎসাহ পেয়েছেন। তবে পাঠক সমাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছেন মৃত্যুর অনেক পরে সত্তর ও আশির দশকের দিকে। এমনকি এখনও তার জনপ্রিয়তার ধারা বয়ে চলেছে। এখনও তিনি নতুন নতুন পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন কবিতায় তার চীরকালীন গন্তব্যের জন্য। 

বাংলা কবিতায় তিরিশের কবিরা টেকনিকের দিক থেকে যে নতুনত্ব আনেন তার মাঝে ব্যতিক্রমী শক্তি জীবনানন্দ দাশ। একমাত্র তিনিই টেকনিকের পাশাপাশি বোধকে কবিতা থেকে হারিয়ে যেতে দেননি, বরং বিচিত্রগন্ধী চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবিতাকে ভিন্নমাত্রায় অনুভূতিজাত করে তোলেছেন। তাঁর কবিতায় ঘাস-লতাপাতা, জীবন-মৃত্যু এসব বিষয় ঘুরে-ফিরে বিমূর্ত ভাষায় চিত্রিত হয়েছে।

জীবনানন্দের কবিতা বাংলা কবিতায় এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের  মতো সুন্দর। প্রথম দিকে নজরুল ও সত্যেন্দ্রনাথের ছন্দ ও শব্দের প্রভাব ছাড়া তার কবিতাকে মনে হয় বাংলা কবিতার ঐতিহ্য থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র, পথ ধরে পেছনে হেঁটে গেলে তার কোন পূর্বপুরুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনানন্দ কবিতায় বিমূর্ত ভাব আনলেন কিন্তু শব্দ ও চিত্রকল্পে পড়ে রইলেন আমাদের একেবারে পরিচিত জীবনে। শুধু পরিচিত নয় সাহিত্যে স্থান পেতে পারে এমন প্রশ্নবিদ্ধ নগন্য, ক্লেদাক্ত ও স্পর্শ- গন্ধময় জগত নিয়ে। ফলে কিছুদিন বিমূর্ত বা দুর্বোধ্য আখ্যা পেলেও তার কবিতা অগ্রসর পাঠকের অনুভূতিতে গভীর জায়গা করে নিতে বেশিদিন সময় নিল না। 

জীবনানন্দ দাশ উপমা ও চিত্রকল্প নির্মাণে এক সিদ্ধহস্ত কবি। চিত্রকল্প নির্মাণে দৃশ্যপ্রধান চিত্রকল্পের বাইরে তিনিই প্রথম অনুভূতির এত গভীরতায় গিয়ে ঘ্রাণ প্রধান, শ্রবণ প্রধান, স্বাদ প্রধান এমনকি বিবমিষা প্রধান চিত্রকল্পের প্রয়োগ ঘটান। যখন তিনি বলেন “হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল” কিংবা “সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত পৃথিবীতে শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর” দেখেন; তখন একইসাথে বিবমিষা ও নাগরিক অপরিচ্ছন্নতার বোধ ভেসে উঠে আমাদের চেতনায়।

রূপসী বাংলা হিসেবে খ্যাত বাংলার ত্রস্ত নীলিমার কবিতাগুলোতে একদিকে প্রকৃতি বর্ণনায় তিনি যেমন প্রবাদতুল্য, শেষ জীবনে প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন নগর জীবনের যাপন অভিজ্ঞতাতেও জীবনানন্দ দাশ সরব ছিলেন। শহর যেন এক মৃত লাশের  মতো উপস্থিত হয়েছে তার কবিতায়, সেখানে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন তিনি থ্যাতানো ইদুরের মতো। জীবনানন্দের গ্রামীণ চিত্রকল্প নির্মাণে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, সেটা  হলো তিনি চিত্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছেন টপ ভিউ থেকে। অর্থাৎ একটি পাখি উড়ে যেতে যেতে যেভাবে নিচের দৃশ্যাবলী দেখে কিছুটা তেমন। এজন্যই পৃথিবীকে জীবনানন্দ দাশ মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ হিসেবে দেখতে পেরেছিলেন। আবার নগর জীবনের বর্ণনার ক্ষেত্রে তার চিত্রকল্পগুলো একদমই প্রত্যক্ষ। নগরের বিষাক্ত শ্বাস যেন সরাসরি পড়ছে তার গায়ে, রিক্ত করে তোলছে তার সমস্ত মানস অবয়ব। 

কবিতায় ভাবগত নতুনত্ব সন্ধানের পাশাপাশি জীবনানন্দ দাশ আঙ্গিকগত নতুনত্বকেও গ্রহণ করেছেন। বাংলা ভাষার এলায়িত ভঙ্গিকে অনুভব করে তিনিই প্রথম কবিতায় গদ্যভাষার এত সার্থক প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কবিতায় গতানুগতিক অন্ত্যমিলের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি অন্ত্যমিলেও নতুনত্বের পরিচয় দেন। সফেন শব্দের সাথে বনলতা সেন এর অন্ত্যমিল তার একটি উদাহরণ। তাছাড়া উপমা প্রকাশেও তিনি ভিন্নতা আনেন। চোখকে পাখির নীড়ের  মতোকল্পনা করা, চুলের কালো রূপ প্রকাশ করতে গিয়ে ইতিহাসের লুপ্ত নগরীর সাথে তাকে তুলনা করা— সাদৃশ্যের এত সূক্ষ্ম পথে গিয়ে তিনিই প্রথম এসব করতে পেরেছিলেন। তার কবিতায় চিত্রকল্পের নতুনত্বের কোন অভাব নেই। কবিতা পড়তে পড়তে উটের গ্রীবার  মতোনিঃস্তব্ধতা এসে যখন গ্রাস করে, তখন চেনা দৃশ্যকেও ভাবতে বাধ্য করায় নতন বোধিচিত্ত দিয়ে।

জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪)
জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪) | ইলাসট্রেশন: প্রথম আলো

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যতিচিহ্নের ব্যবহার নতুন মাত্রা পেয়েছে। তার আগে বাংলা কবিতায় ড্যাশের এত ব্যবহার কেউ করেননি। বলা যায় ড্যাশকে তিনি শব্দের মতোই অর্থময় করে প্রকাশ করেছেন কবিতায়। বাক্যের ভেতরে ও অন্ত্যে ড্যাশের ব্যবহারের মাধ্যমে সেই ফাঁকা অংশে তিনি যেন কবিতায় ব্যক্ত বোধকে পাঠকের মনে সঞ্চারিত ও ব্যাপ্ত হওয়ার অবকাশ দিয়েছেন। এই ব্যাপারটি সত্যিই অতুলনীয়।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ভারতীয় পুরাণ ও লোককাহিনীর নানা উপকরণের সার্থক ব্যবহার দেখা যায়। কবিতায় এই উপাদানগুলো হাজার বছরের স্মৃতিকে বহন করে যেন সজোরে আঘাত করে বর্তমানের স্থিরতাকে। জীবনানন্দ দাশের  মতোগাণিতিক সংখ্যার ব্যবহার তার আগে ও পরে বাংলা কবিতায় এত সার্থকভাবে কেউ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। হাঁস নামক কবিতায় নয়টি হাঁসকে রোজ জলপাই পল্লবের  মতোস্নিগ্ধ জলে ভাসার বর্ণনা দিয়ে যখন তিনি বলেন, “তিনবার তিন গুনে নয় হয় পৃথিবীর পথে;/এরা তবু নয়জন মায়াবীর মতো জাদুবলে”— তখন তিন গুনে নয় হওয়ার বিষয়টি গাণিতিক নিয়মে নির্দিষ্টতায় আবদ্ধ না করে পাঠককে সুযোগ করে দেয় অবারিত কল্পনার। 

জীবনানন্দের কবিতায় নক্ষত্র, প্যাঁচা, ইঁদুর, সন্ধ্যা, ঢের— এসব শব্দ খুব বেশি দেখা যায়। চিত্রকল্প নির্মাণেও একধরণের চিত্রকল্পের দিকে তার খুব বেশি অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। তবে কবিতা নির্মাণে তিনি এত পারদর্শী যে প্রত্যেকটি কবিতায় পুরনো বাহনের ভেতর দিয়েও তিনি আলাদা আলাদা বোধকে সঞ্চার করতে পারেন। সব শিল্পীরই কিছু প্রিয় রঙ থাকে। বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি সেসব রঙের কিছু না কিছু চিহ্ন রাখতে চান। না রাখলে তিনি স্বস্তি পান না। সব কবিরই তেমন প্রিয় কিছু শব্দ ও চিত্রকল্প থাকে। বিভিন্ন কবিতায় নানাভাবে তা ফিরে ফিরে আসে। এটাকে সীমাবদ্ধতা ভাবার কিছু নেই। কবির ব্যক্তিত্ব, কল্পনা ও যাপনের অভিজ্ঞতার উপর এসবের প্রয়োগ নির্ভর করে। একই প্রকারের ঢিল ভিন্ন ভিন্ন পুকুরে তরঙ্গ তোলতে পারলে তার সৌন্দর্য দেখায় আমাদের আপত্তি নেই। 

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সাময়িক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ অনুরণন বা দ্রোহ নেই বলে কেউ কেউ যে অভিযোগ করে থাকেন তা মূলত জীবনানন্দকে গভীরভাবে পাঠ না করারই ফল। জীবনানন্দের কবিতায় শ্লোগানধর্মী দ্রোহ না থাকলেও তার শেষের দিকের কবিতায় যে নাগরিক ক্লান্তি, স্থবির জীবনচিত্র ও ব্যাঙ্গাত্মক ত্রিকোণের প্রয়োগ দেখি তা তার সমকাল ও বিশ্বব্যাপী মহাযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অবক্ষয়েরই সূক্ষ্ম অথচ তীব্র প্রতিবাদ।

বাংলা কবিতায় ধ্যানী, ঋষি, বীরভাব ও করুণ রসের অনেক বড়ো বড়ো কবি জন্মেছেন। তাদের মাঝে জীবনানন্দের জগত সম্পূর্ণ আলাদা। তার কবিতা জাদুমন্ত্রের  মতোপাঠককে শব্দের মানস মূর্তিতে টেনে নিয়ে যায়। শব্দের স্তরে স্তরে ছড়ানো ইতিহাস, স্মৃতি ও চেতনার আফিম ঘোরগ্রস্ত করে ফেলে সমস্ত আমিত্বকে। তখন কবিতা পড়তে পড়তে গ্লাসের তলায় নিমগ্ন পাথরকুচির  মতোপাঠক হঠাৎ আবিষ্কার করে নিজের অবচেতনাকে।