০৪:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের এসডিজি অর্জনের অগ্রগতি কতটা?

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
  • প্রকাশ: ১১:২৮:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ নভেম্বর ২০২২
  • / ৮১৫ বার পড়া হয়েছে

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা | জাতিসংঘ

একেএম শাহনাওয়াজ 

এটি খুব দুর্ভাগ্য যে, এদেশে যারা সরকার গঠনে বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় আসীন থাকেন, তাদের অধিকাংশের প্রকৃত দেশোন্নয়নের চেয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের দিকে দৃষ্টি থাকে বেশি। তাই তারা উন্নয়ন কার্যক্রম চালালেও তা টেকসই উন্নয়নের চেয়ে স্বল্পকালীন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতেই পছন্দ করেন বেশি।

এ কারণে সম্ভবত শিক্ষাঙ্গনকে বিকশিত করার দিকে নজর খুব কম দেওয়া হয়। যেখানে জাতিসংঘ এসডিজি-৪ (Sustainable Development Goal-4) অর্জনের জন্য ১৭টি টেকসই লক্ষ্য পূরণের অন্যতম লক্ষ্য হিসাবে মানসম্মত শিক্ষার কথা বলেছে, সেখানে শিক্ষা উন্নয়নের সংজ্ঞাটিই যেন আমাদের কাছে এখনো পরিষ্কার হলো না।

তাই যেখানে জিডিপির কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষা বাজেট থাকা উচিত, সেখানে চলমান শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ১.৪৮ শতাংশ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাযাত্রায় এসজিডি-৪০-এর লক্ষ্য ভেদ করা আমাদের জন্য দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হয়।

শিক্ষা তথা জ্ঞাননির্ভরতা ছাড়া কোনো উন্নয়নই যে টেকসই হতে পারে না, তা কোনোকালেই আমাদের সরকারগুলো মনে করেনি। তাই শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কখনো প্রতিশ্র“তিশীল শিক্ষাবিদের ওপর অর্পিত হলো না। এ কারণে সবকিছুই ঘটতে থাকে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’। এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটতে পারে না।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একই সময়ে কেউ একজন কলেজে প্রভাষক হিসাবে এবং প্রাইমারি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেলে তিনি কখনো কখনো প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব বেছে নেন আনন্দের সঙ্গে। কারণ আকর্ষণীয় বেতন উভয় পর্যায়েই রয়েছে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়াও পিএইচডি ডিগ্রিধারী অনেককেই প্রাইমারি স্কুলে পাওয়া যাবে শিক্ষক হিসাবে।

শিক্ষা প্রণোদনাও অনেক বেশি প্রতিবেশী দেশে। শিক্ষা যে একটি বড় বিনিয়োগ, তা কখনো আমাদের দেশের সরকারগুলো ভাবতে পারেনি। তাই শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি এখানে বেশ নড়বড়ে। উপরের যাত্রাপথে একে আর কতটা শক্ত করা যাবে!

অতিসম্প্রতি Times Higher Education World University: 2023 প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না, সেখানে একটু আশার আলো দেখা গেছে। এবার বিশ্বের ৬০১ থেকে ৮০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় উঠে এসেছে। এর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আর অন্যটি বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তী ১২০০ থেকে ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে বুয়েট, কুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর পরের ধাপ আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হয় না। তারপরও আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে দেখা যাবে, দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তবু একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ওপরের দিকে।

পাশাপাশি লক্ষ করি, তালিকার প্রথম ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে চীনের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়। ৫০০ থেকে ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের প্রায় ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রথমবারের মতো উচ্চ র‌্যাংকিংয়ে চলে এসেছে জাম্বিয়া, নামিবিয়া, মোজাম্বিক ও জিম্বাবুয়ের মতো দেশ।

সাধারণত ১৩টি বিষয়ের ভিত্তিতে র‌্যাংকিং হয়; এর মধ্যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে; এগুলো হচ্ছে— ১. শিক্ষকতা, ২. গবেষণা, ৩. জ্ঞানবিস্তরণ ও ৪. আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। এবার উলি­খিত র‌্যাংকিং তৈরি করতে বিশ্বের ১০৪টি দেশের ১ হাজার ৭৯৯ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, দেশে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে পুরোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে তলানিতে চলে গেছে। কিছুটা এগিয়ে চলছে বিশেষায়িত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও কুয়েটের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি বিষয় লক্ষণীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দিলে দীর্ঘদিনের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাংকিংয়ের তলানিতে চলে এলেও মাত্র ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণার জায়গায় নিজেকে ক্রমে যোগ্য করে তুলছে। এর ফলও মিলেছে অল্পদিনেই। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হিসাবে নিজের নাম যুক্ত করার গৌরব অর্জন করতে পেরেছে।

এসব পর্যবেক্ষণ করলে এই অধোগতির কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। মোটা দাগে বললে বলতে হয়-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকরণ, শিক্ষা ও গবেষণা খাতে সীমিত বাজেট এবং শিক্ষকদের একাংশের অনৈতিকতা।

উন্নত দেশগুলোয় আমাদের দেশের মতো ক্যাম্পাস রাজনীতি নেই বললেই চলে। সেখানে রাজনীতির কারণে শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। একাডেমিক যোগ্যতাই সেখানে শিক্ষক নিয়োগের মাপকাঠি। শিক্ষা-গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে-এমন ক্যাম্পাস রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে চীন। ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস রাজনীতি থাকলেও তা সুনিয়ন্ত্রিত। শিক্ষা-গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো ঘটনা সেখানে কমই ঘটে।

আমি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত গবেষণার কাজে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। ক্যাম্পাসে কখনো উগ্র ছাত্ররাজনীতির দাপট দেখিনি। শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন লক্ষ করেছি, তবে তা শিক্ষক নিয়োগে প্রভাব রাখে বলে শুনিনি। একদিনের কথা আমি স্মরণ করি মঝেমধ্যে। সেদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে একটু থমকে গিয়েছিলাম। অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি নীরব ক্যাম্পাস। ভাবলাম, বিশ্ববিদ্যালয় বুঝি বন্ধ। তাও নয়। শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীদেরও হাঁটাচলা রয়েছে। একটু পরে বিষয়টি পরিষ্কার হলো। কিছু দূর পরপর খোলা আকাশের নিচে চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বসে আছে। সহায়তা করছে অন্য শিক্ষার্থীদের। সবার কাপড়ে ব্যাচ লাগানো। পেছনে প্ল্যাকার্ড। সেখানে প্রার্থীদের পরিচিতি রয়েছে। আসলে সেদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন চলছিল। কর্মীরা ভোটারদের সহযোগিতা করছিল।

আমি কল্পনা করলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এমন করে জাকসু নির্বাচন হতো! আগে থেকেই সরগরম থাকত ক্যাম্পাস। পোস্টারে ছেয়ে যেত দেওয়াল। স্লোগানে ক্লাস নেওয়া দায় হতো। আর নির্বাচনের দিনে পুলিশি ব্যবস্থা তো থাকতই। সরকারি দলের কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে মনিটর করা হতো। ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করা যাবে না। তাছাড়া এখন তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ প্রায় ওপেন সিক্রেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ওপরও থাকে সরকার ও সরকারি দলের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ।

এসব কারণে শিক্ষকদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষকের নৈতিকতার জায়গাটিতেও স্খলন লক্ষ করা যায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের সম্মানিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি তার উদারতা দিয়ে ধরে নিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হবেন। তাদের ওপর খবরদারি করে ছোট করা যাবে না। তাই ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু সেই আস্থা কোনো কোনো শিক্ষক রাখতে পারছেন না। দিনের পর দিন ক্লাস না নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। এভাবে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ের একটি শর্তে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। এবার বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে ২য় অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় উপরে উঠেছে বিশেষ করে এর শিক্ষা প্রদানের জায়গাটিতে অনেক উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বরে পৌঁছার পেছনে বড় কারণ ছিল এ প্রতিষ্ঠানের উচ্চমানের গবেষণা।

আমরা কোন ধারা বলে এগিয়ে যাব? আমি বিশ্বাস করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো মেধাবী শিক্ষক-গবেষক রয়েছেন। তাদের মেধা বিকাশের প্রয়োজনে উচ্চমানের গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেই মানের ল্যাব কোথায়? কোথায় গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট? প্রতিবছর যে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ থাকে, তা দিয়ে সিলেবাসসংশ্লিষ্ট ছাত্র প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়াই কঠিন। শিক্ষক-গবেষকের ব্যক্তিগত গবেষণা পরিচালনা করা সহজ নয়।

এ বিষয়গুলো সরকার যদি যোগ্যতার সঙ্গে বিবেচনা করতে পারত, তাহলে হয়তো ভিন্ন ধারা দেখতে পেতাম। এসব ভাবার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হয়। মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের আগে বিষয়ের গভীরতা বুঝতে হবে। সেখানেই তো আমরা বারবার হতাশ হই।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা | জাতিসংঘ
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা | জাতিসংঘ

বিশ্ব র‌্যাংকিং তো দূরের কথা-এসডিজি-৪-এর লক্ষ্য পূরণের জন্য সর্বস্তরে শিক্ষার মানোন্নয়নে যে গতি তৈরি করা দরকার, সেখানেই তো হোঁচট খেতে হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূরদর্শিতা দিয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি সাফল্যও দেখাতে পেরেছেন। কিন্তু এ বিবেচনাটি পাশাপাশি রাখা হচ্ছে কিনা যে, জাতিকে যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত করে তোলা না যায়, তাহলে এই উন্নয়ন ধরে রাখা ও এগিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। এ সত্য সবাই জানবেন, রাজনীতি দিয়ে সবকিছুর ফয়সালা করা যায় না।

শেয়ার করুন

One thought on “শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের এসডিজি অর্জনের অগ্রগতি কতটা?

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ

অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইমেইল: [email protected]
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের এসডিজি অর্জনের অগ্রগতি কতটা?

প্রকাশ: ১১:২৮:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ নভেম্বর ২০২২

একেএম শাহনাওয়াজ 

এটি খুব দুর্ভাগ্য যে, এদেশে যারা সরকার গঠনে বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় আসীন থাকেন, তাদের অধিকাংশের প্রকৃত দেশোন্নয়নের চেয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের দিকে দৃষ্টি থাকে বেশি। তাই তারা উন্নয়ন কার্যক্রম চালালেও তা টেকসই উন্নয়নের চেয়ে স্বল্পকালীন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতেই পছন্দ করেন বেশি।

এ কারণে সম্ভবত শিক্ষাঙ্গনকে বিকশিত করার দিকে নজর খুব কম দেওয়া হয়। যেখানে জাতিসংঘ এসডিজি-৪ (Sustainable Development Goal-4) অর্জনের জন্য ১৭টি টেকসই লক্ষ্য পূরণের অন্যতম লক্ষ্য হিসাবে মানসম্মত শিক্ষার কথা বলেছে, সেখানে শিক্ষা উন্নয়নের সংজ্ঞাটিই যেন আমাদের কাছে এখনো পরিষ্কার হলো না।

তাই যেখানে জিডিপির কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষা বাজেট থাকা উচিত, সেখানে চলমান শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ১.৪৮ শতাংশ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাযাত্রায় এসজিডি-৪০-এর লক্ষ্য ভেদ করা আমাদের জন্য দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হয়।

শিক্ষা তথা জ্ঞাননির্ভরতা ছাড়া কোনো উন্নয়নই যে টেকসই হতে পারে না, তা কোনোকালেই আমাদের সরকারগুলো মনে করেনি। তাই শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কখনো প্রতিশ্র“তিশীল শিক্ষাবিদের ওপর অর্পিত হলো না। এ কারণে সবকিছুই ঘটতে থাকে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’। এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটতে পারে না।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একই সময়ে কেউ একজন কলেজে প্রভাষক হিসাবে এবং প্রাইমারি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেলে তিনি কখনো কখনো প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব বেছে নেন আনন্দের সঙ্গে। কারণ আকর্ষণীয় বেতন উভয় পর্যায়েই রয়েছে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়াও পিএইচডি ডিগ্রিধারী অনেককেই প্রাইমারি স্কুলে পাওয়া যাবে শিক্ষক হিসাবে।

শিক্ষা প্রণোদনাও অনেক বেশি প্রতিবেশী দেশে। শিক্ষা যে একটি বড় বিনিয়োগ, তা কখনো আমাদের দেশের সরকারগুলো ভাবতে পারেনি। তাই শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি এখানে বেশ নড়বড়ে। উপরের যাত্রাপথে একে আর কতটা শক্ত করা যাবে!

অতিসম্প্রতি Times Higher Education World University: 2023 প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না, সেখানে একটু আশার আলো দেখা গেছে। এবার বিশ্বের ৬০১ থেকে ৮০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় উঠে এসেছে। এর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আর অন্যটি বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তী ১২০০ থেকে ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে বুয়েট, কুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর পরের ধাপ আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হয় না। তারপরও আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে দেখা যাবে, দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তবু একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ওপরের দিকে।

পাশাপাশি লক্ষ করি, তালিকার প্রথম ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে চীনের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়। ৫০০ থেকে ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের প্রায় ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রথমবারের মতো উচ্চ র‌্যাংকিংয়ে চলে এসেছে জাম্বিয়া, নামিবিয়া, মোজাম্বিক ও জিম্বাবুয়ের মতো দেশ।

সাধারণত ১৩টি বিষয়ের ভিত্তিতে র‌্যাংকিং হয়; এর মধ্যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে; এগুলো হচ্ছে— ১. শিক্ষকতা, ২. গবেষণা, ৩. জ্ঞানবিস্তরণ ও ৪. আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। এবার উলি­খিত র‌্যাংকিং তৈরি করতে বিশ্বের ১০৪টি দেশের ১ হাজার ৭৯৯ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, দেশে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে পুরোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে তলানিতে চলে গেছে। কিছুটা এগিয়ে চলছে বিশেষায়িত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও কুয়েটের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি বিষয় লক্ষণীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দিলে দীর্ঘদিনের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাংকিংয়ের তলানিতে চলে এলেও মাত্র ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণার জায়গায় নিজেকে ক্রমে যোগ্য করে তুলছে। এর ফলও মিলেছে অল্পদিনেই। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হিসাবে নিজের নাম যুক্ত করার গৌরব অর্জন করতে পেরেছে।

এসব পর্যবেক্ষণ করলে এই অধোগতির কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। মোটা দাগে বললে বলতে হয়-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকরণ, শিক্ষা ও গবেষণা খাতে সীমিত বাজেট এবং শিক্ষকদের একাংশের অনৈতিকতা।

উন্নত দেশগুলোয় আমাদের দেশের মতো ক্যাম্পাস রাজনীতি নেই বললেই চলে। সেখানে রাজনীতির কারণে শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। একাডেমিক যোগ্যতাই সেখানে শিক্ষক নিয়োগের মাপকাঠি। শিক্ষা-গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে-এমন ক্যাম্পাস রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে চীন। ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস রাজনীতি থাকলেও তা সুনিয়ন্ত্রিত। শিক্ষা-গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো ঘটনা সেখানে কমই ঘটে।

আমি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত গবেষণার কাজে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। ক্যাম্পাসে কখনো উগ্র ছাত্ররাজনীতির দাপট দেখিনি। শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন লক্ষ করেছি, তবে তা শিক্ষক নিয়োগে প্রভাব রাখে বলে শুনিনি। একদিনের কথা আমি স্মরণ করি মঝেমধ্যে। সেদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে একটু থমকে গিয়েছিলাম। অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি নীরব ক্যাম্পাস। ভাবলাম, বিশ্ববিদ্যালয় বুঝি বন্ধ। তাও নয়। শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীদেরও হাঁটাচলা রয়েছে। একটু পরে বিষয়টি পরিষ্কার হলো। কিছু দূর পরপর খোলা আকাশের নিচে চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বসে আছে। সহায়তা করছে অন্য শিক্ষার্থীদের। সবার কাপড়ে ব্যাচ লাগানো। পেছনে প্ল্যাকার্ড। সেখানে প্রার্থীদের পরিচিতি রয়েছে। আসলে সেদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন চলছিল। কর্মীরা ভোটারদের সহযোগিতা করছিল।

আমি কল্পনা করলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এমন করে জাকসু নির্বাচন হতো! আগে থেকেই সরগরম থাকত ক্যাম্পাস। পোস্টারে ছেয়ে যেত দেওয়াল। স্লোগানে ক্লাস নেওয়া দায় হতো। আর নির্বাচনের দিনে পুলিশি ব্যবস্থা তো থাকতই। সরকারি দলের কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে মনিটর করা হতো। ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করা যাবে না। তাছাড়া এখন তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ প্রায় ওপেন সিক্রেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ওপরও থাকে সরকার ও সরকারি দলের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ।

এসব কারণে শিক্ষকদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষকের নৈতিকতার জায়গাটিতেও স্খলন লক্ষ করা যায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের সম্মানিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি তার উদারতা দিয়ে ধরে নিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হবেন। তাদের ওপর খবরদারি করে ছোট করা যাবে না। তাই ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু সেই আস্থা কোনো কোনো শিক্ষক রাখতে পারছেন না। দিনের পর দিন ক্লাস না নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। এভাবে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ের একটি শর্তে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। এবার বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে ২য় অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় উপরে উঠেছে বিশেষ করে এর শিক্ষা প্রদানের জায়গাটিতে অনেক উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বরে পৌঁছার পেছনে বড় কারণ ছিল এ প্রতিষ্ঠানের উচ্চমানের গবেষণা।

আমরা কোন ধারা বলে এগিয়ে যাব? আমি বিশ্বাস করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো মেধাবী শিক্ষক-গবেষক রয়েছেন। তাদের মেধা বিকাশের প্রয়োজনে উচ্চমানের গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেই মানের ল্যাব কোথায়? কোথায় গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট? প্রতিবছর যে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ থাকে, তা দিয়ে সিলেবাসসংশ্লিষ্ট ছাত্র প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়াই কঠিন। শিক্ষক-গবেষকের ব্যক্তিগত গবেষণা পরিচালনা করা সহজ নয়।

এ বিষয়গুলো সরকার যদি যোগ্যতার সঙ্গে বিবেচনা করতে পারত, তাহলে হয়তো ভিন্ন ধারা দেখতে পেতাম। এসব ভাবার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হয়। মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের আগে বিষয়ের গভীরতা বুঝতে হবে। সেখানেই তো আমরা বারবার হতাশ হই।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা | জাতিসংঘ
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা | জাতিসংঘ

বিশ্ব র‌্যাংকিং তো দূরের কথা-এসডিজি-৪-এর লক্ষ্য পূরণের জন্য সর্বস্তরে শিক্ষার মানোন্নয়নে যে গতি তৈরি করা দরকার, সেখানেই তো হোঁচট খেতে হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূরদর্শিতা দিয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি সাফল্যও দেখাতে পেরেছেন। কিন্তু এ বিবেচনাটি পাশাপাশি রাখা হচ্ছে কিনা যে, জাতিকে যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত করে তোলা না যায়, তাহলে এই উন্নয়ন ধরে রাখা ও এগিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। এ সত্য সবাই জানবেন, রাজনীতি দিয়ে সবকিছুর ফয়সালা করা যায় না।