বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৩, ২০২৩

সর্বরোগের মহৌষধ ‘নতুন কারিকুলাম’!

পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রম যেসব নতুন রোগ সৃষ্টি করছে সেগুলো সারানোর ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন না এ শিক্ষাক্রমের প্রশংসায় মুখর লেখকদের কেউ। ফলাফলভিত্তিক শিক্ষাক্রম সারাবিশ্বে চলছে প্রায় ছয় দশক ধরে; এখনো শিখনফল লেখার জন্য নতুন নতুন সক্রিয় ক্রিয়াপদ তৈরি করা হচ্ছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রমের চারটি আবর্তন শেষ হয়েছে; ২০১৯ সালে শুরু হলো পঞ্চম আবর্তনের কাজ। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রমকে তত্ত্বগতভাবে ‘তৈরি করা’ বলা যেতে পারে। এর পরেরগুলো ‘পরিমার্জন’ হিসাবে পরিচিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় তিন বছর ঢিমেতালে চলা পরিমার্জন প্রক্রিয়াধীন শিক্ষাক্রমকে অনেকেই ‘নতুন’ নামের তকমা পরাচ্ছেন। দেশের সব আবর্তনের শিক্ষাক্রমেই শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলি বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এবারের শিক্ষাক্রমে কিছু উদ্দেশ্যকে নতুনভাবে সংযোজনের দাবি করে বেশকিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে এবং টিভি আলোচনায় ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে অবিরাম ঢোলক বাজানো হচ্ছে। একজন শিক্ষা গবেষক হিসাবে আমি এ নিবন্ধে পরিভাষার ব্যবহার এবং যতটা গর্জন শুনছি তার সাপেক্ষে কতটা বর্ষণ হচ্ছে ও হবে বলে আশা করা যায়, সে আলোচনার চেষ্টা করছি।

পরিভাষার ব্যবহার: ‘নতুন কারিকুলাম’

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আবর্তনের (১৯৭৬-৭৮) শিক্ষাক্রমকে তত্ত্বগতভাবে ‘নতুন’ শিক্ষাক্রম বলা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা-ও সত্য নয়; কারণ, সেটিও ‘তৈরি করা’ হয়েছিল পাকিস্তান আমলের প্রধানত ১৯৬০ সালের শিক্ষাক্রমের ওপর ভিত্তি করে, পরিমার্জনের মাধ্যমে (ওই শিক্ষাক্রম ছিল Content-based বা বিষয়ভিত্তিক)। দ্বিতীয় আবর্তনের (১৯৯১-৯৬) শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয়েছিল সবচেয়ে ভালো করে, প্রথমবারের মতো শিক্ষার উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে (অর্থাৎ ওই শিক্ষাক্রম ছিল Objective-based); কিন্তু সেটাও ছিল প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন। তৃতীয় (২০০২-২০০৫) অসম্পূর্ণ (শুধু প্রাথমিক ও মধ্যমাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন করা হয়েছিল) এবং চতুর্থ সম্পূর্ণ আবর্তনের (২০১১-১২) শিক্ষাক্রমের কোনোটাকেই কেউ ‘নতুন শিক্ষাক্রম’ বলে দাবি করেননি। অথচ এবার ২০১৯ সালে কাজ শুরু করে প্রায় তিন বছরে শুধু ‘রূপরেখা’ নামে প্রকৃতপক্ষে ‘শিক্ষাক্রমের ভূমিকা’ সম্পূর্ণ লিখে, এখনো উচ্চমাধ্যমিক উপস্তর পুরোপুরি বাদ রেখে কয়েক শ্রেণির পূর্ণ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে, বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখায় নতুন বলে অভিহিত করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য কি আগের সবার অবদানকে খাটো করা, এমনকি অস্বীকার করা?

ইংরেজি শব্দ ‘কারিকুলাম’-এর বেশ জুতসই বাংলা হিসাবে ‘শিক্ষাক্রম’ শব্দটি গত শতাব্দীর সত্তরের দশকেই চালু হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা-দলিল: বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন (বিধিবদ্ধ নাম: বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন) রিপোর্টেই ‘শিক্ষাক্রম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় শিক্ষা-দলিল ১৯৭৬-৭৮ সালে মোট সাত খণ্ডে প্রকাশিত প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রমের শিরোনাম: ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি রিপোর্ট’। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত National Curriculum Development Center (NCDC) বাংলাদেশ টেক্সটবুক বোর্ডের সঙ্গে একীভূত করে একক প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্দেশ্যে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেক্সটবুক বোর্ড একটি বিধিমালা তৈরি করে। এই আইন অনুসারে ১৯৮৪ সালে একীভূত জাতীয় প্রতিষ্ঠান: ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ‘টেক্সটবুক’ শব্দটির পরিবর্তে বাংলা শব্দ ‘পাঠ্যপুস্তক’ ব্যবহারে প্রতিষ্ঠানটির নাম বর্তমানের ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’-এ রূপলাভ করে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম করে আত্মাহুতি দেওয়া জাতির গর্বিত সদস্য হয়ে দেশ হিসাবে স্বাধীন অস্তিত্বের শুরু থেকে প্রচলিত এবং ৩৮ বছর ধরে শিক্ষার এপেক্স প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে যুক্ত প্রমাণ (Standard) বাংলা পরিভাষা ‘শিক্ষাক্রম’ বাদ দিয়ে বাংলা বিবৃতি, এমনকি লেখায় ইংরেজি শব্দ Curriculum-এর বাংলা উচ্চারণ ‘কারিকুলাম’ বলা ও লেখা কীসের আলামত? এসব বক্তা ও লেখকদের কি জাতির ভাষাসৈনিকদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই?

শিক্ষাক্রমে ‘নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য’ আরোপ

দাবি করা হচ্ছে এবারের শিক্ষাক্রমের মূলভিত্তি ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন’ (Experiential learning) এবং এ শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো, মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে অনুসন্ধিৎসু ও সৃজনশীল করা, ভবিষ্যৎ জীবনের সমস্যাবলির সমাধানে যোগ্য করে গড়ে তোলা হবে এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও ঝোঁক অনুসারে গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আগের একটি নিবন্ধ ‘শিক্ষাক্রমের রূপরেখার ত্রুটিগুলো’সহ বিভিন্ন নিবন্ধে আমি উল্লেখ করেছি : ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন‘ কোনো নতুন ধারণা নয়। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের পূর্ববর্তী সব আবর্তনে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের জন্য কিছু অংশ ব্যাবহারিক কাজ, অনুসন্ধান, নির্ধারিত কাজ (Assignment) ইত্যাদি হিসাবে শিক্ষার্থীদের করানো হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ডেভিড কোব (১৯৮৪) এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং মডেল তৈরি করেছিলেন বয়স্কশিক্ষা তথা প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য, শিশু-কিশোরদের শিক্ষার জন্য নয়। তাছাড়া, কোবের চার স্তরবিশিষ্ট শক্ত বাঁধনের মডেলে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরা বেশ কিছু ত্রুটি পেয়েছেন। যেমন: বার্গস্টেইনার (২০১০) দেখিয়েছেন কোবের শিখন-চক্রে ব্যবহৃত স্থির পয়েন্টগুলোর পরিবর্তে চলমান রেখা ব্যবহার করা জরুরি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-র লোগো ও প্রতীকী চিত্র
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-র লোগো ও প্রতীকী চিত্র

বাংলাদেশের প্রথম থেকে চতুর্থ আবর্তনের শিক্ষাক্রমের সবগুলোয় বেঞ্জামিন ব্লুমের উদ্দেশ্যাবলির শ্রেণিবিন্যাস অনুসরণে শিক্ষার চিন্তন, আবেগীয় ও মনোপেশিজ সব ক্ষেত্রের উদ্দেশ্যই বিধৃত আছে। অসম্পূর্ণ তৃতীয় আবর্তনের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষাক্রমে (২০০৫) মাধ্যমিক শিক্ষা খাত মানোন্নয়ন প্রকল্পের (সেসিপ) দেশি-বিদেশি ডজনখানেক শিক্ষা পরামর্শকের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের অর্জিতব্য দক্ষতায় নতুন ধারা যুক্ত করা হয়। এ শিক্ষাক্রম-দলিলের শিরোনাম: ‘শিক্ষাক্রম ও ম্যানুয়াল’। উক্ত দলিলের ৫-৬ নম্বর পৃষ্ঠায় নতুন ধারার দক্ষতা-তালিকায় চিন্তন, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক, যোগাযোগমূলক, নান্দনিক, সামাজিক ও সহযোগিতামূলক, ব্যক্তিক এবং শারীরিক দক্ষতার উল্লেখ রয়েছে। চিন্তন দক্ষতার আওতায় ‘জ্ঞানের প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ, যৌক্তিক ক্রমবিন্যাস (Logical sequence) ও সমস্যা সমাধানের (Problem solving) মাধ্যমে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের সামর্থ্য বৃদ্ধি করা’ স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। চিন্তন দক্ষতার এসব স্তরের ভিত্তিতেই শিক্ষামূল্যায়নের জন্য কাঠামোবদ্ধ (Structured) প্রশ্ন তৈরি করা হয়। ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত না হলেও কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন ‘সৃজনশীল’ নামে পরে ২০০৯-১০ সাল থেকে চালু করা হয়।

চতুর্থ আবর্তনের শিক্ষাক্রমে (২০১২) ‘শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের মাধ্যমে মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক গুণসম্পন্ন, জ্ঞানী, দক্ষ, যুক্তিবাদী ও সৃজনশীল দেশপ্রেমিক জনসম্পদ সৃষ্টি’কে শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়। উক্ত শিক্ষাক্রমে বিএস ব্লুম (১৯৫৬) আবিষ্কৃত শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলির ধ্রুপদী শ্রেণিবিন্যাস এবং সেসিপের ব্যবহৃত নতুন ধারার শ্রেণিবিন্যাসের সমন্বয়ে মাধ্যমিক শিক্ষার মোট ১৮টি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় (জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২, পৃষ্ঠা ৭-৮)। এসব উদ্দেশ্যের মধ্যে হাওয়ার্ড গার্ডনারের (Frames of mind: The theory of multiple intelligences, 1983) ৭ থেকে ৯ প্রকার বুদ্ধির কোনোটিই বাদ পড়েনি।

পঞ্চম আবর্তনের বর্তমানে পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রমে একই ধারার দক্ষতা শুধু শব্দের ব্যবহার এদিক-সেদিক করে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই চতুর্থ আবর্তনে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের পরামর্শক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-আইইআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, ‘বলা হচ্ছে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হবে। অথচ ২০১২ সালের কারিকুলামে এসবের ৯৫ শতাংশ বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল’ (‘শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে কারিকুলাম বাস্তবায়ন অসম্ভব’ শীর্ষক সাক্ষাৎকার, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪.১০.২০২২)। সুতরাং বিভিন্ন লেখক এ শিক্ষাক্রমকে আগের সব শিক্ষাক্রমের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা দূর করার মহৌষধ বলে যে দাবি করছেন, তা অতিরঞ্জন ছাড়া কিছুই নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক ড. তারিক আহসান পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রম ‘প্যারাডাইম শিফট’ ঘটাবে বলে দাবি করেছেন (‘শিক্ষাক্ষেত্রে প্যারাডাইম শিফট ঘটাবে নতুন শিক্ষাক্রম’ শীর্ষক সাক্ষাৎকার, সমকাল, ০৬.০৬.২০২২)। উল্লেখ্য, ড. আহসান বিশেষ শিক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং আরও আগে প্রকাশিত তার এক লেখার (‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা কি পারবে সব শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে?’ প্রথম আলো, ১৬.১০.২০২১) অর্ধেকের বেশি জুড়ে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজনবিশিষ্ট শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়। শিক্ষাক্রমে সব শিক্ষার্থীর অন্তর্ভুক্তি জরুরি; কিন্তু জাতীয় শিক্ষাক্রমে প্রধান ধারার শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্বার্থ বেশি গুরুত্ব পেতে হবে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ‘প্যারাডাইম শিফট’ ঘটাতে গিয়ে আমরা প্রধান ধারার শিক্ষাকে তো দুর্বল করতে পারি না।

নতুন শিক্ষাক্রমে যেসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না

পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রম যেসব নতুন রোগ সৃষ্টি করছে সেগুলো সারানোর ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন না এ শিক্ষাক্রমের প্রশংসায় মুখর লেখকদের কেউ। ফলাফলভিত্তিক শিক্ষাক্রম সারাবিশ্বে চলছে প্রায় ছয় দশক ধরে; এখনো শিখনফল লেখার জন্য নতুন নতুন সক্রিয় ক্রিয়াপদ তৈরি করা হচ্ছে। অথচ এ শিক্ষাক্রমের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ‘যোগ্যতার নির্যাস নষ্ট’ হওয়ার ভয়ে গো ধরে বসে আছেন, ‘শিখনফল’ তারা লিখবেনই না। শিক্ষাক্রমকে শিখনফলের সূক্ষ্ম স্তরে না পৌঁছানোতে লেখকরা বই লিখতে হিমশিম খাচ্ছেন, শিক্ষকরা শিক্ষণ-পরিকল্পনা করতে বিপদে না হলেও আপদে পড়বেন, মূল্যায়নকারীরা তো মূল্যায়ন করতেই পারবেন না। এসবের সমাধান তারা কীভাবে করবেন?

নবম-দশম শ্রেণিতে ১৯৬১ সাল থেকে শাখাভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি এবং ’৬২ সাল থেকে ম্যাট্রিকুলেশনের পরিবর্তে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চলে এসেছে। এতে এ উপস্তরের শিক্ষা ব্রিটেন ও আমেরিকার ‘ও লেভেলের’ সমতুল হয়। ফলে ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার মধ্যে ব্যবধান কমে আসে। ৬০ বছর পর এখন এ শিক্ষাকে একমুখী করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সব শিক্ষার্থী এক চিমটি করে প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান পড়ে উচ্চমাধ্যমিক উপস্তরে গিয়ে এসব বিষয়ের প্রায় ছয়গুণ কলেবরের কোর্স কীভাবে আয়ত্ত করবে?

শিক্ষাক্রম রূপরেখার মূল্যায়ন বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে

শিক্ষক/অভিভাবক/বন্ধুদের দিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ, চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৬০ শতাংশ, নবম-দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩০ শতাংশ। শিক্ষকদের হাতে এত বেশি নম্বর কোন খাতে ব্যবহৃত হবে? কোচিং, প্রাইভেটের হিড়িক কীভাবে ঠেকাবেন? নিরীহ শিক্ষার্থীদের কীভাবে নিজ শিক্ষকের অবিচার থেকে রক্ষা করবেন? ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির সদস্যদের সঙ্গে এবার ছাত্রনেতাদের অত্যাচার যুক্ত হলে শিক্ষকদের কীভাবে বাঁচাবেন?

পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রমে কি ভালো কিছুই নেই?

ভালো কিছু উপাদান তো অবশ্যই আছে! প্রাথমিক স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক আদলে সাজানো হয়েছে। প্রথমবারের মতো শিক্ষাক্রম ‘মাঠে’ বাস্তবায়নের আগে পাইলটিংয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে; কিন্তু নমুনা বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রাথমিক পরিকল্পনার ২০০ থেকে কমিয়ে মাত্র ৬২-তে নামানো হয়েছে। প্রতিনিধিত্বশীল হলে পরিসংখ্যানগতভাবে এতে অসুবিধা নেই; কিন্তু একটি মাত্র কারিগরি বিদ্যালয় নমুনা হিসাবে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করে তাদের ব্যক্তিক চাহিদা পূরণ করে তা বিকাশে সহযোগিতার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এ কল্যাণমুখী শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে ক্লাসে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত কমাতে বেশিসংখ্যক ও মানে উন্নত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সৃজনশীলতা বাড়ানো এবং সূক্ষ্মচিন্তন ও সমস্যা সমাধান দক্ষতা শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসাবে সবসময় লেখা থাকলেও বাস্তবায়ন তেমন হয়নি। বলা হচ্ছে, পাইলটিংয়ে এটি ভালো চলছে। সারা দেশে বাস্তবায়ন করতে হলে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও যথাযথ মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে।

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা
শিক্ষাক্রম গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)। ইমেইল: asmolla@ymail.com

বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে 'বিশ্লেষণ'-এর জন্য স্পনসরশিপ খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইমেইল: contact.bishleshon@gmail.com

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ

বৈশ্বিক পানি সংকট : জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব ও বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির অভাব

বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাবের শিকার একটি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। বাংলাদেশের ১৯ টি উপকূলীয়  জেলার সমগ্র অঞ্চল ও অধিবাসীগণ সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত...

বিভক্ত বিশ্বে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধে ঐতিহাসিক’ চুক্তি ও বহুপাক্ষিকতার বিজয়

বিভাজিত বিশ্বে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়েছে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ও পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক...

অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার যুগে বাংলাদেশ

যেহেতু অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা একটি নতুন ধারণা, তাই বাস্তবায়নের জন্য এমন একটি কমিটি থাকা উচিত যারা ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করবে পাঠ্যক্রমটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম রেকর্ড করার জন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবে তাও স্পষ্ট করতে হবে। কারণ মূল্যায়নের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য অভিজ্ঞতার রেকর্ড সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে প্রয়োজন দক্ষ জনসম্পদ

জনশক্তি রপ্তানিতে রেকর্ড হলেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহের হার কমেছে বিদায়ী বছরে। সদ্য শেষ...

অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার যুগে বাংলাদেশ

যেহেতু অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা একটি নতুন ধারণা, তাই বাস্তবায়নের জন্য এমন একটি কমিটি থাকা উচিত যারা ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করবে পাঠ্যক্রমটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম রেকর্ড করার জন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবে তাও স্পষ্ট করতে হবে। কারণ মূল্যায়নের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য অভিজ্ঞতার রেকর্ড সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে।

যুগে যুগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ

ইউরোপে মুসলিম বিদ্বেষিতা নতুন কিছু নয়। মধ্যযুগ থেকে এর সূত্রপাত। মধ্যযুগে খ্রিষ্টানদের কাছে জেরুজালেম শহরটি ছিল তাদের ধর্মীয় প্রেরণার প্রধান কেন্দ্র। তাদের...

হোয়াইট কলার বা ভদ্রবেশী  অপরাধ কী এবং বাংলাদেশে ভদ্রবেশী অপরাধের সংঘটন

হোয়াইট কলার অপরাধ। এর কোনো আইনগত সংজ্ঞা নেই। বাংলা শব্দে এটা ‘ভদ্রবেশী অপরাধ।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর উৎপত্তি হলেও ক্রমে তা বিভিন্ন রাষ্ট্রে...
আরও পড়তে পারেন

শিরক কী, মানুষ কীভাবে শিরকে লিপ্ত হয়

ইসলাম একমাত্র ধর্ম যেখানে স্রষ্টা তার কোনো ক্ষমতাতেই কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করেননি। অর্থাৎ আল্লাহই একমাত্র একক ইলাহ যিনি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। সৃষ্টির...

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বা হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বলতে কী বোঝায়

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বা হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (Human Resource management) হলো একই সঙ্গে একটি অধ্যয়নের বিষয় ও ব্যবস্থাপনা কৌশল যা একটি প্রতিষ্ঠানের...

টপ্পা গান কী, টপ্পা গানের উৎপত্তি, বাংলায় টপ্পা গান ও এর বিশেষত্ব

টপ্পা গান এক ধরনের লোকিক গান বা লোকগীতি যা ভারত ও বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। এই টপ্পা গান বলতে...

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে কী বোঝায় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনীতি বা রাষ্ট্রচিন্তা

রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political Science) সমাজবিজ্ঞানের একটি শাখাবিশেষ যেখানে পরিচালন প্রক্রিয়া, রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনীতি সম্পর্কীয় বিষয়াবলী নিয়ে আলোকপাত করা হয়।  এরিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাষ্ট্র...

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী বা গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়

গণতন্ত্র বলতে কোনো জাতিরাষ্ট্রের অথবা কোনো সংগঠনের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বা পরিচালনাব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here