০৭:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখার ত্রুটিগুলো

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা
  • প্রকাশ: ০৬:৫০:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ মার্চ ২০২২
  • / ৮০৮ বার পড়া হয়েছে

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-র লোগো ও প্রতীকী চিত্র

শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় জাতীয়ভাবে যে শিক্ষা-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, এক কথায় তারই নাম শিক্ষাক্রম। স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারবার শিক্ষাক্রম তৈরি ও উন্নয়নের জন্য পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রথম আবর্তনের (১৯৭৬-৭৮) শিক্ষাক্রমকেই তৈরি করা (Making) বলা যায় কিনা সন্দেহ; কারণ, সেটিও করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলের প্রধানত ১৯৬০ সালের শিক্ষাক্রমের ওপর ভিত্তি করে, পরিমার্জনের মাধ্যমে। 

দ্বিতীয় আবর্তনের (১৯৯১-৯৫) শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয়েছিল সবচেয়ে ভালো করে, প্রথমবারের মতো শিক্ষার উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে (অর্থাৎ ওটা ছিল Objective-based); কিন্তু সেটাও ছিল প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন। তৃতীয় (২০০২-২০০৫) অসম্পূর্ণ (শুধু প্রাথমিক ও মধ্যমাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন করা হয়েছিল) এবং চতুর্থ সম্পূর্ণ আবর্তনের (২০১১-১২) শিক্ষাক্রমের কোনোটিকেই কেউ ‘নতুন শিক্ষাক্রম’ বলে দাবি করেননি। অথচ এবার ২০১৯ সালে কাজ শুরু করে দুবছরে আধখেঁচড়া করে এখনো যে শুধু ‘রূপরেখা’ নামে, প্রকৃতপক্ষে ‘শিক্ষাক্রমের ভূমিকা’ লেখা হয়েছে, তাকেই শিক্ষাক্রমের মৌলিক পরিবর্তন বলে দাবি করা হচ্ছে।

এদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রথম থেকে তৃতীয় আবর্তন পর্যন্ত ছিল ১ম থেকে ১২শ মোট ১২ শ্রেণির; চতুর্থ আবর্তনে প্রথমবারের মতো এক শ্রেণির প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করায় শিক্ষাক্রম হয় ১৩ শ্রেণির। এবার পঞ্চম আবর্তনে প্রাক-প্রাথমিক স্তর দুবছরের হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় শিক্ষাক্রম হবে ১৪ শ্রেণির। ২০১৯ সালে কাজ শুরু করে সেপ্টেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার পাঁচটি সংস্করণ তৈরি হয়েছে: ১ম সংস্করণ (মার্চ, ২০২০) ছিল মাত্র ৬৩ পৃষ্ঠার; এতে পৃষ্ঠাসংখ্যা ও রেফারেন্স ছিল অনুপস্থিত। ২য় সংস্করণ (সেপ্টেম্বর, ২০২০) ছিল ১০৭ পৃষ্ঠার; এতেও পৃষ্ঠাসংখ্যা বা রেফারেন্স কোনোটিই ছিল না। ৩য় সংস্করণ (নভেম্বর, ২০২০) ছিল ১১৪ পৃষ্ঠার; এতে প্রথমবারের মতো পৃষ্ঠাসংখ্যা ও রেফারেন্স যুক্ত করা হয়। ৪র্থ সংস্করণ (ফেব্রুয়ারি, ২০২১) ছিল ১২১ পৃষ্ঠার, পৃষ্ঠাসংখ্যা ও রেফারেন্সযুক্ত। ১ম থেকে ৪র্থ সংস্করণের প্রতিটিতে যোগ্যতার ছক (Competency Tables) ছিল। শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা লেখার বিধিবদ্ধ অধিকার ও দায়িত্ব বিষয় কমিটির; বিষয় কমিটি (Subject Committee) গঠন করার আগে কোর কমিটি ও ওয়ার্কিং কমিটি কোন অধিকার বলে শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করেছিল, তা এক গুরুতর প্রশ্ন বটে। শেষ পর্যন্ত এটি অনধিকার চর্চা বুঝে যোগ্যতার ছক বাদ দিয়ে ৫ম সংস্করণ (সেপ্টেম্বর, ২০২১) প্রকাশ করা হয়। আমি এ লেখায় এবারের শিক্ষাক্রমের কয়েকটি ত্রুটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

ধারণাগত ত্রুটি (Conceptual Errors) ও সীমাবদ্ধতাগুলো

শিক্ষাক্রম রূপরেখার প্রধান বিষয় কিছু ধারণা। ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১: প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি’ শীর্ষক দলিলটিতে ‘শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের’ পটভূমি, ভিত্তি ও পরিমার্জন প্রক্রিয়া এবং শিক্ষাক্রমের ধরন, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম, মূলনীতি, শিক্ষার উদ্দেশ্য, বিভিন্ন শ্রেণির বিষয়, শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া ও সামগ্রী, সময় বণ্টন, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও বাস্তবায়ন কৌশল-সবই আলোচিত হয়েছে।

১. রূপরেখা অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত

শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হয় নিচের শ্রেণি থেকে ক্রমান্বয়ে ওপরের দিকে; কিন্তু পূর্ণ শিক্ষাক্রম-পরিকল্পনা করতে হয় একসঙ্গে। শিক্ষাক্রম-পরিকল্পনা একসঙ্গে এবং সামগ্রিক না হলে শিক্ষাক্রমের সমকেন্দ্র (Concentric) বা সর্পিল (Spiral) পদ্ধতি (Method) অনুসরণে নিচের শ্রেণি থেকে ওপর দিকে ক্রমেই বিস্তৃত করা হয়েছে কিনা (Vertical Alignment) এবং একই শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাক্রমে পুনরাবৃত্তি বর্জন করা হয়েছে কিনা (Horizontal Alignment), তা বিবেচনা/পর্যালোচনা করে শিক্ষাক্রমের ভেটিং (Curriculum Vetting) সম্পন্ন করা যায় না। দুঃখের বিষয়, এ দলিলে প্রাক-প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উপস্তর সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি। দলিলে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ‘প্রাথমিক’ স্তর নাম দিয়ে রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছে; ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির কোনো স্তর বা উপস্তর কিছুই উল্লেখ না করে শ্রেণিভিত্তিক রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছে।

শুধু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে বলা হয়েছে ‘মাধ্যমিক’ স্তর (পৃষ্ঠা-১)। ওই স্তর সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘বিশেষায়িত বিষয়গুলো যেহেতু বেশি প্রাধান্য পাবে, সেহেতু এ বিষয়গুলোর বিন্যাস এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আবশ্যিক বিষয়গুলোর প্রকৃতি ও পরিসর নির্দিষ্ট করার পরে বিষয়ভিত্তিক শিখনযোগ্যতাগুলো নির্ধারণ করা হবে’ (পৃষ্ঠা-৬৩)। অর্থাৎ শিখনযোগ্যতা নির্ধারণ করা তো পরের কথা, আবশ্যিক ও নৈর্বাচনিক কোনো বিষয়ের নামই লেখা হয়নি! পরে যখন প্রাক-প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাক্রম পূর্ণ করা হবে, তখন প্রাক-প্রাথমিককে প্রথম শ্রেণি এবং উচ্চমাধ্যমিককে দশম শ্রেণির সঙ্গে যৌক্তিকভাবে মেলানো কষ্টসাধ্য, এমনকি অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও টেকসই উন্নয়নের ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনা

স্বাধীন দেশে আগে সর্বনিম্ন ১০ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৭ বছরের ব্যবধানে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের রেকর্ড ছিল। এবার শুরু করা হয়েছিল চতুর্থ আবর্তনের (২০১২) মাত্র সাত বছর পরে (২০১৯)। এ আগাম পরিমার্জন প্রচেষ্টার প্রধান দুটো যৌক্তিক উদ্দেশ্য ছিল:

  • ১. প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের মতো মাধ্যমিকের সব উপস্তরের (নিম্ন, মধ্য ও উচ্চমাধ্যমিক) শিক্ষাক্রমকে যোগ্যতাভিত্তিক (Competency-based) আদলে সাজানো;
  • ২. জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals-SDG) অর্জন করা।

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ধারণা ও বেশ সমৃদ্ধ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে দলিলের ১৫ থেকে ২৬ পৃষ্ঠাব্যাপী। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ দারুণভাবে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মূলত ১০টি শিখনক্ষেত্রকেই (Learning Areas) যোগ্যতা (Competency) বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে (পৃষ্ঠা ২৭-২৮)। প্রতি শিখনক্ষেত্র/বিষয়ের যোগ্যতা অতি সংক্ষিপ্তাকারে একবাক্যে লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাবটা এমন যে, যৌক্তিকভাবে ভেঙে স্পষ্ট করে কয়েকটি বাক্যে লিখলে যদি কেউ বুঝে ফেলে! টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বিষয়টি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

৩. শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের ভিত্তি বর্ণনায় অসংগতি ও সীমাবদ্ধতা

দলিলের পৃষ্ঠা ৪-এ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের পাঁচটি ভিত্তির তালিকা দেওয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয়, এ তালিকায় সামাজিক ভিত্তির (Sociological Foundation) উল্লেখই নেই; অথচ প্রমাণনির্ভর ভিত্তি (Evidence-based Foundation) নামে এক আজগুবি ভিত্তি আবিষ্কার করা হয়েছে। বাস্তবে সব ভিত্তিই প্রমাণনির্ভর; যা প্রমাণনির্ভর নয়, তা কোনো ভিত্তিই হতে পারে না। বৈশ্বিক ও জাতীয় অগ্রাধিকারকেও (Global and National Priorities) একটি ‘ভিত্তির’ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তা হয়তো দেওয়া যায়; কিন্তু এর আওতায় ‘বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের’ (পৃষ্ঠা ৬) কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘নির্বাচনি ইশতেহার’ ঘোষণা করে রাজনৈতিক দল, নির্বাচিত সরকার নয়। কোনো দলের ইশতেহার শিক্ষার ভিত্তি হতে পারে না; কারণ, দল নির্বাচনে হেরে গেলে ইশতেহার তার গুরুত্ব হারাবে। তাই নির্বাচিত সরকারের কর্মসূচি শিক্ষার ভিত্তি হতে পারে, দলের নির্বাচনি ইশতেহার নয়।

শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ঐতিহাসিক ভিত্তির (Historical Foundation) বর্ণনা শুরু করা হয়েছে ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন রিপোর্ট দিয়ে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমলের পূর্ব বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষার ইতিহাস মেকলের মিনিট (Macaulay’s Minutes, 1835) এবং উইলিয়াম অ্যাডামের রিপোর্ট (William Adam’s Report, 1838) ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে না। লর্ড মেকলে এ উপমহাদেশে কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন; পক্ষান্তরে উইলিয়াম অ্যাডাম তার রিপোর্টে এ অঞ্চলে প্রচলিত নিজস্ব ধারার মাদ্রাসা ও টোল শিক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

৪. অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের (Experiential Learning) ফুলঝুরি

দলিলটিতে ঝাঁকুনি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, দলিলের লেখকরা এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন নামে একটা নতুন ধারণার আওতায় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করছেন। তারা জানেন না যে, এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং-এর মূল বিষয় ‘করে শেখা’ (Learning by doing)-এর কথা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলে গেছেন। ডেভিড কোব ১৯৮৪ সালে একই ধারণাকে একটু বিস্তৃত করেছেন মাত্র। এমন অভিজ্ঞতাজাত শিখন আমাদের এলাকায় ‘গুরুগৃহে’ একসময় প্রচলিত ছিল। কিন্তু সে পদ্ধতি বিপুল আয়তনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক (প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়) স্তরের কয়েক কোটি শিক্ষার্থীর জন্য যথেষ্ট হলে তো আর জাতীয় শিক্ষাক্রম বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কোনোটিরই দরকার হতো না!

শিক্ষাক্রম জাতীয়ভাবে তৈরি করার শুরুর দিক থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষানির্ভর প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের জন্য শিক্ষাক্রম ও শিখনের কিছু অংশ ব্যবহারিক কাজ, অনুসন্ধান, নির্ধারিত কাজ (Assignment) ইত্যাদি হিসাবে শিক্ষার্থীদের করানো হয়ে আসছে। উচ্চশিক্ষায়, মাস্টার্স ও তদূর্ধ্ব কোর্সে গবেষণা করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, সংগীত ইত্যাদিতে এ ধারার শিখনের প্রাধান্য থাকে। কিন্তু বিশ্বের কোথাও সাধারণ শিক্ষার পুরো কোর্সের অর্ধেকও এমন অভিজ্ঞতাভিত্তিক করা হয় না; কারণ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আগের লোকদের সৃষ্ট, গ্রন্থে, জার্নালে লিপিবদ্ধ এবং ইদানীং ইন্টারনেটে প্রকাশিত বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের হালকা করে হলেও আস্বাদ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরি। সবার সবকিছু করে শেখার দরকারই পড়ে না। সবাইকে সবকিছু করে শেখানোর চেষ্টা করা ভাত ফুটেছে কিনা দেখার জন্য নমুনা হিসাবে কয়েকটি ভাত টিপে দেখার পরিবর্তে পাত্রের সব ভাত টিপে নষ্ট করার শামিল!

আমাদের দেশে ২০-২৫ শতাংশ নম্বর ‘ব্যবহারিক’ শিরোনামে বরাদ্দ হয়ে আসছে; কিন্তু ব্যবহারিক কাজ ও পরীক্ষাকে আমরা অল্প অভিজ্ঞতা, এমনকি অভিজ্ঞতা ছাড়াই নম্বর প্রদানের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের চতুর্থ আবর্তনে (২০১১-১২) প্রকৃতি বিজ্ঞানের গণ্ডি ছাড়িয়ে অধিকাংশ বিষয়ে অনুসন্ধানমূলক কাজের ব্যবস্থা রাখা আছে। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে থাকা এ ব্যবস্থাটি করোনাকালে নির্ধারিত কাজের (Assignment) মাধ্যমে শিখন চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায় প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকে পুরো কোর্স অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মাধ্যমে চালানোর চেষ্টা করার কোনোই প্রয়োজন নেই; এ ‘অপচেষ্টা’ শিক্ষার্থীদের বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে পরিচয় করায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে মাত্র।

৫. যোগ্যতার নির্যাস (Essence of Competency) নষ্ট হওয়ার ভয়ে শিখনফল হেলায় হারানো

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ঢেউ ধারণ করে বাংলাদেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক উভয় স্তরের শিক্ষাক্রমকে যোগ্যতাভিত্তিক করা এখন সময়ের দাবি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ১৯৯২ সাল থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক আদলে প্রস্তুত ‘আবশ্যকীয় শিখনক্রম’ শীর্ষক শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তরে বাস্তবায়ন করে আসছে। এখন মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমকেও প্রাথমিকের সঙ্গে মিলিয়ে ‘যোগ্যতাভিত্তিক আদলে’ সাজাতে হবে এবং হচ্ছেও তা-ই। কিন্তু এনসিটিবির মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং প্রচার করে বেড়াচ্ছে: ‘শিখনফল’ ব্যবহারে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের নির্যাস (Essence of Competency-based Curriculum) নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ তো এক বিদয়াত বা নতুন সমস্যা!

মনে রাখতে হবে, শিক্ষার জাতীয় উদ্দেশ্যাবলি, বিভিন্ন ধারা (সাধারণ, মাদ্রাসা, কারিগরি) ও স্তরের (প্রাথমিক, মাধ্যমিক) উদ্দেশ্যাবলির (Objectives) পর মাঝপথে বিভিন্ন শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা (Competency) নির্ধারণ করা হয়। যোগ্যতার সংজ্ঞায় ‘পরিমাপযোগ্য’ ও ‘মূল্যায়নযোগ্য’ বিশেষণগুলো ব্যবহার করা হলেও বাস্তবে শিখনফলের (Learning Outcome) মতো বিস্তৃত (Detailed), সূক্ষ্ম, জরুরি ধাপে না গেলে শিক্ষাক্রম ও শিখন ‘পরিমাপযোগ্য’ ও ‘মূল্যায়নযোগ্য’ হয়ে ওঠে না। এ কারণে বেঞ্জামিন ব্লুমের শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলির শ্রেণিবিন্যাস (Taxonomy of Educational Objectives, 1956)-এর আওতায় সারা বিশ্বে এখনো শিখনফল লেখার জন্য নতুন নতুন সক্রিয় ক্রিয়াপদ (Action Verbs) তৈরি করা হচ্ছে। শিখনফল কোনো ‘খেলনা বিষয়’ নয় যে, ‘খেলা শেষ’; এখন খেলনা ফেলে দিলেই চলবে! শিক্ষাক্রমকে শিখনফলের সূক্ষ্ম স্তরে না পৌঁছালে, লেখকরা বই লিখতে পারবেন না, শিক্ষকরা শিক্ষণ-পরিকল্পনা করতে পারবেন না, মূল্যায়নকারীরা মূল্যায়ন করতে পারবেন না; এক কথায় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নই করা যাবে না।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা

শিক্ষাক্রম গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)। ইমেইল: [email protected]

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখার ত্রুটিগুলো

প্রকাশ: ০৬:৫০:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ মার্চ ২০২২

শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় জাতীয়ভাবে যে শিক্ষা-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, এক কথায় তারই নাম শিক্ষাক্রম। স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারবার শিক্ষাক্রম তৈরি ও উন্নয়নের জন্য পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রথম আবর্তনের (১৯৭৬-৭৮) শিক্ষাক্রমকেই তৈরি করা (Making) বলা যায় কিনা সন্দেহ; কারণ, সেটিও করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলের প্রধানত ১৯৬০ সালের শিক্ষাক্রমের ওপর ভিত্তি করে, পরিমার্জনের মাধ্যমে। 

দ্বিতীয় আবর্তনের (১৯৯১-৯৫) শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয়েছিল সবচেয়ে ভালো করে, প্রথমবারের মতো শিক্ষার উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে (অর্থাৎ ওটা ছিল Objective-based); কিন্তু সেটাও ছিল প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন। তৃতীয় (২০০২-২০০৫) অসম্পূর্ণ (শুধু প্রাথমিক ও মধ্যমাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন করা হয়েছিল) এবং চতুর্থ সম্পূর্ণ আবর্তনের (২০১১-১২) শিক্ষাক্রমের কোনোটিকেই কেউ ‘নতুন শিক্ষাক্রম’ বলে দাবি করেননি। অথচ এবার ২০১৯ সালে কাজ শুরু করে দুবছরে আধখেঁচড়া করে এখনো যে শুধু ‘রূপরেখা’ নামে, প্রকৃতপক্ষে ‘শিক্ষাক্রমের ভূমিকা’ লেখা হয়েছে, তাকেই শিক্ষাক্রমের মৌলিক পরিবর্তন বলে দাবি করা হচ্ছে।

এদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রথম থেকে তৃতীয় আবর্তন পর্যন্ত ছিল ১ম থেকে ১২শ মোট ১২ শ্রেণির; চতুর্থ আবর্তনে প্রথমবারের মতো এক শ্রেণির প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করায় শিক্ষাক্রম হয় ১৩ শ্রেণির। এবার পঞ্চম আবর্তনে প্রাক-প্রাথমিক স্তর দুবছরের হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় শিক্ষাক্রম হবে ১৪ শ্রেণির। ২০১৯ সালে কাজ শুরু করে সেপ্টেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার পাঁচটি সংস্করণ তৈরি হয়েছে: ১ম সংস্করণ (মার্চ, ২০২০) ছিল মাত্র ৬৩ পৃষ্ঠার; এতে পৃষ্ঠাসংখ্যা ও রেফারেন্স ছিল অনুপস্থিত। ২য় সংস্করণ (সেপ্টেম্বর, ২০২০) ছিল ১০৭ পৃষ্ঠার; এতেও পৃষ্ঠাসংখ্যা বা রেফারেন্স কোনোটিই ছিল না। ৩য় সংস্করণ (নভেম্বর, ২০২০) ছিল ১১৪ পৃষ্ঠার; এতে প্রথমবারের মতো পৃষ্ঠাসংখ্যা ও রেফারেন্স যুক্ত করা হয়। ৪র্থ সংস্করণ (ফেব্রুয়ারি, ২০২১) ছিল ১২১ পৃষ্ঠার, পৃষ্ঠাসংখ্যা ও রেফারেন্সযুক্ত। ১ম থেকে ৪র্থ সংস্করণের প্রতিটিতে যোগ্যতার ছক (Competency Tables) ছিল। শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা লেখার বিধিবদ্ধ অধিকার ও দায়িত্ব বিষয় কমিটির; বিষয় কমিটি (Subject Committee) গঠন করার আগে কোর কমিটি ও ওয়ার্কিং কমিটি কোন অধিকার বলে শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করেছিল, তা এক গুরুতর প্রশ্ন বটে। শেষ পর্যন্ত এটি অনধিকার চর্চা বুঝে যোগ্যতার ছক বাদ দিয়ে ৫ম সংস্করণ (সেপ্টেম্বর, ২০২১) প্রকাশ করা হয়। আমি এ লেখায় এবারের শিক্ষাক্রমের কয়েকটি ত্রুটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

ধারণাগত ত্রুটি (Conceptual Errors) ও সীমাবদ্ধতাগুলো

শিক্ষাক্রম রূপরেখার প্রধান বিষয় কিছু ধারণা। ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১: প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি’ শীর্ষক দলিলটিতে ‘শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের’ পটভূমি, ভিত্তি ও পরিমার্জন প্রক্রিয়া এবং শিক্ষাক্রমের ধরন, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম, মূলনীতি, শিক্ষার উদ্দেশ্য, বিভিন্ন শ্রেণির বিষয়, শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া ও সামগ্রী, সময় বণ্টন, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও বাস্তবায়ন কৌশল-সবই আলোচিত হয়েছে।

১. রূপরেখা অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত

শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হয় নিচের শ্রেণি থেকে ক্রমান্বয়ে ওপরের দিকে; কিন্তু পূর্ণ শিক্ষাক্রম-পরিকল্পনা করতে হয় একসঙ্গে। শিক্ষাক্রম-পরিকল্পনা একসঙ্গে এবং সামগ্রিক না হলে শিক্ষাক্রমের সমকেন্দ্র (Concentric) বা সর্পিল (Spiral) পদ্ধতি (Method) অনুসরণে নিচের শ্রেণি থেকে ওপর দিকে ক্রমেই বিস্তৃত করা হয়েছে কিনা (Vertical Alignment) এবং একই শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাক্রমে পুনরাবৃত্তি বর্জন করা হয়েছে কিনা (Horizontal Alignment), তা বিবেচনা/পর্যালোচনা করে শিক্ষাক্রমের ভেটিং (Curriculum Vetting) সম্পন্ন করা যায় না। দুঃখের বিষয়, এ দলিলে প্রাক-প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উপস্তর সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি। দলিলে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ‘প্রাথমিক’ স্তর নাম দিয়ে রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছে; ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির কোনো স্তর বা উপস্তর কিছুই উল্লেখ না করে শ্রেণিভিত্তিক রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছে।

শুধু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে বলা হয়েছে ‘মাধ্যমিক’ স্তর (পৃষ্ঠা-১)। ওই স্তর সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘বিশেষায়িত বিষয়গুলো যেহেতু বেশি প্রাধান্য পাবে, সেহেতু এ বিষয়গুলোর বিন্যাস এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আবশ্যিক বিষয়গুলোর প্রকৃতি ও পরিসর নির্দিষ্ট করার পরে বিষয়ভিত্তিক শিখনযোগ্যতাগুলো নির্ধারণ করা হবে’ (পৃষ্ঠা-৬৩)। অর্থাৎ শিখনযোগ্যতা নির্ধারণ করা তো পরের কথা, আবশ্যিক ও নৈর্বাচনিক কোনো বিষয়ের নামই লেখা হয়নি! পরে যখন প্রাক-প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাক্রম পূর্ণ করা হবে, তখন প্রাক-প্রাথমিককে প্রথম শ্রেণি এবং উচ্চমাধ্যমিককে দশম শ্রেণির সঙ্গে যৌক্তিকভাবে মেলানো কষ্টসাধ্য, এমনকি অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও টেকসই উন্নয়নের ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনা

স্বাধীন দেশে আগে সর্বনিম্ন ১০ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৭ বছরের ব্যবধানে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের রেকর্ড ছিল। এবার শুরু করা হয়েছিল চতুর্থ আবর্তনের (২০১২) মাত্র সাত বছর পরে (২০১৯)। এ আগাম পরিমার্জন প্রচেষ্টার প্রধান দুটো যৌক্তিক উদ্দেশ্য ছিল:

  • ১. প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের মতো মাধ্যমিকের সব উপস্তরের (নিম্ন, মধ্য ও উচ্চমাধ্যমিক) শিক্ষাক্রমকে যোগ্যতাভিত্তিক (Competency-based) আদলে সাজানো;
  • ২. জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals-SDG) অর্জন করা।

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ধারণা ও বেশ সমৃদ্ধ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে দলিলের ১৫ থেকে ২৬ পৃষ্ঠাব্যাপী। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ দারুণভাবে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মূলত ১০টি শিখনক্ষেত্রকেই (Learning Areas) যোগ্যতা (Competency) বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে (পৃষ্ঠা ২৭-২৮)। প্রতি শিখনক্ষেত্র/বিষয়ের যোগ্যতা অতি সংক্ষিপ্তাকারে একবাক্যে লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাবটা এমন যে, যৌক্তিকভাবে ভেঙে স্পষ্ট করে কয়েকটি বাক্যে লিখলে যদি কেউ বুঝে ফেলে! টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বিষয়টি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

৩. শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের ভিত্তি বর্ণনায় অসংগতি ও সীমাবদ্ধতা

দলিলের পৃষ্ঠা ৪-এ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের পাঁচটি ভিত্তির তালিকা দেওয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয়, এ তালিকায় সামাজিক ভিত্তির (Sociological Foundation) উল্লেখই নেই; অথচ প্রমাণনির্ভর ভিত্তি (Evidence-based Foundation) নামে এক আজগুবি ভিত্তি আবিষ্কার করা হয়েছে। বাস্তবে সব ভিত্তিই প্রমাণনির্ভর; যা প্রমাণনির্ভর নয়, তা কোনো ভিত্তিই হতে পারে না। বৈশ্বিক ও জাতীয় অগ্রাধিকারকেও (Global and National Priorities) একটি ‘ভিত্তির’ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তা হয়তো দেওয়া যায়; কিন্তু এর আওতায় ‘বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের’ (পৃষ্ঠা ৬) কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘নির্বাচনি ইশতেহার’ ঘোষণা করে রাজনৈতিক দল, নির্বাচিত সরকার নয়। কোনো দলের ইশতেহার শিক্ষার ভিত্তি হতে পারে না; কারণ, দল নির্বাচনে হেরে গেলে ইশতেহার তার গুরুত্ব হারাবে। তাই নির্বাচিত সরকারের কর্মসূচি শিক্ষার ভিত্তি হতে পারে, দলের নির্বাচনি ইশতেহার নয়।

শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ঐতিহাসিক ভিত্তির (Historical Foundation) বর্ণনা শুরু করা হয়েছে ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন রিপোর্ট দিয়ে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমলের পূর্ব বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষার ইতিহাস মেকলের মিনিট (Macaulay’s Minutes, 1835) এবং উইলিয়াম অ্যাডামের রিপোর্ট (William Adam’s Report, 1838) ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে না। লর্ড মেকলে এ উপমহাদেশে কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন; পক্ষান্তরে উইলিয়াম অ্যাডাম তার রিপোর্টে এ অঞ্চলে প্রচলিত নিজস্ব ধারার মাদ্রাসা ও টোল শিক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

৪. অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের (Experiential Learning) ফুলঝুরি

দলিলটিতে ঝাঁকুনি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, দলিলের লেখকরা এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন নামে একটা নতুন ধারণার আওতায় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করছেন। তারা জানেন না যে, এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং-এর মূল বিষয় ‘করে শেখা’ (Learning by doing)-এর কথা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলে গেছেন। ডেভিড কোব ১৯৮৪ সালে একই ধারণাকে একটু বিস্তৃত করেছেন মাত্র। এমন অভিজ্ঞতাজাত শিখন আমাদের এলাকায় ‘গুরুগৃহে’ একসময় প্রচলিত ছিল। কিন্তু সে পদ্ধতি বিপুল আয়তনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক (প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়) স্তরের কয়েক কোটি শিক্ষার্থীর জন্য যথেষ্ট হলে তো আর জাতীয় শিক্ষাক্রম বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কোনোটিরই দরকার হতো না!

শিক্ষাক্রম জাতীয়ভাবে তৈরি করার শুরুর দিক থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষানির্ভর প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের জন্য শিক্ষাক্রম ও শিখনের কিছু অংশ ব্যবহারিক কাজ, অনুসন্ধান, নির্ধারিত কাজ (Assignment) ইত্যাদি হিসাবে শিক্ষার্থীদের করানো হয়ে আসছে। উচ্চশিক্ষায়, মাস্টার্স ও তদূর্ধ্ব কোর্সে গবেষণা করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, সংগীত ইত্যাদিতে এ ধারার শিখনের প্রাধান্য থাকে। কিন্তু বিশ্বের কোথাও সাধারণ শিক্ষার পুরো কোর্সের অর্ধেকও এমন অভিজ্ঞতাভিত্তিক করা হয় না; কারণ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আগের লোকদের সৃষ্ট, গ্রন্থে, জার্নালে লিপিবদ্ধ এবং ইদানীং ইন্টারনেটে প্রকাশিত বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের হালকা করে হলেও আস্বাদ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরি। সবার সবকিছু করে শেখার দরকারই পড়ে না। সবাইকে সবকিছু করে শেখানোর চেষ্টা করা ভাত ফুটেছে কিনা দেখার জন্য নমুনা হিসাবে কয়েকটি ভাত টিপে দেখার পরিবর্তে পাত্রের সব ভাত টিপে নষ্ট করার শামিল!

আমাদের দেশে ২০-২৫ শতাংশ নম্বর ‘ব্যবহারিক’ শিরোনামে বরাদ্দ হয়ে আসছে; কিন্তু ব্যবহারিক কাজ ও পরীক্ষাকে আমরা অল্প অভিজ্ঞতা, এমনকি অভিজ্ঞতা ছাড়াই নম্বর প্রদানের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের চতুর্থ আবর্তনে (২০১১-১২) প্রকৃতি বিজ্ঞানের গণ্ডি ছাড়িয়ে অধিকাংশ বিষয়ে অনুসন্ধানমূলক কাজের ব্যবস্থা রাখা আছে। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে থাকা এ ব্যবস্থাটি করোনাকালে নির্ধারিত কাজের (Assignment) মাধ্যমে শিখন চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায় প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকে পুরো কোর্স অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মাধ্যমে চালানোর চেষ্টা করার কোনোই প্রয়োজন নেই; এ ‘অপচেষ্টা’ শিক্ষার্থীদের বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে পরিচয় করায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে মাত্র।

৫. যোগ্যতার নির্যাস (Essence of Competency) নষ্ট হওয়ার ভয়ে শিখনফল হেলায় হারানো

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ঢেউ ধারণ করে বাংলাদেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক উভয় স্তরের শিক্ষাক্রমকে যোগ্যতাভিত্তিক করা এখন সময়ের দাবি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ১৯৯২ সাল থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক আদলে প্রস্তুত ‘আবশ্যকীয় শিখনক্রম’ শীর্ষক শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তরে বাস্তবায়ন করে আসছে। এখন মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমকেও প্রাথমিকের সঙ্গে মিলিয়ে ‘যোগ্যতাভিত্তিক আদলে’ সাজাতে হবে এবং হচ্ছেও তা-ই। কিন্তু এনসিটিবির মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং প্রচার করে বেড়াচ্ছে: ‘শিখনফল’ ব্যবহারে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের নির্যাস (Essence of Competency-based Curriculum) নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ তো এক বিদয়াত বা নতুন সমস্যা!

মনে রাখতে হবে, শিক্ষার জাতীয় উদ্দেশ্যাবলি, বিভিন্ন ধারা (সাধারণ, মাদ্রাসা, কারিগরি) ও স্তরের (প্রাথমিক, মাধ্যমিক) উদ্দেশ্যাবলির (Objectives) পর মাঝপথে বিভিন্ন শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা (Competency) নির্ধারণ করা হয়। যোগ্যতার সংজ্ঞায় ‘পরিমাপযোগ্য’ ও ‘মূল্যায়নযোগ্য’ বিশেষণগুলো ব্যবহার করা হলেও বাস্তবে শিখনফলের (Learning Outcome) মতো বিস্তৃত (Detailed), সূক্ষ্ম, জরুরি ধাপে না গেলে শিক্ষাক্রম ও শিখন ‘পরিমাপযোগ্য’ ও ‘মূল্যায়নযোগ্য’ হয়ে ওঠে না। এ কারণে বেঞ্জামিন ব্লুমের শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলির শ্রেণিবিন্যাস (Taxonomy of Educational Objectives, 1956)-এর আওতায় সারা বিশ্বে এখনো শিখনফল লেখার জন্য নতুন নতুন সক্রিয় ক্রিয়াপদ (Action Verbs) তৈরি করা হচ্ছে। শিখনফল কোনো ‘খেলনা বিষয়’ নয় যে, ‘খেলা শেষ’; এখন খেলনা ফেলে দিলেই চলবে! শিক্ষাক্রমকে শিখনফলের সূক্ষ্ম স্তরে না পৌঁছালে, লেখকরা বই লিখতে পারবেন না, শিক্ষকরা শিক্ষণ-পরিকল্পনা করতে পারবেন না, মূল্যায়নকারীরা মূল্যায়ন করতে পারবেন না; এক কথায় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নই করা যাবে না।