১২:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
                       

মিয়ানমার সীমান্তে যুদ্ধাবস্থার কারণ ও প্রতিক্রিয়া

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ১২:৩৮:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / ৪৪০ বার পড়া হয়েছে

 সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী নানারকম আচরণ করছে মিয়ানমার। নিজ সীমান্তের ভেতরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া মর্টার শেল, এমনকি বিমানের বোমা পড়েছে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার গানশিপ বাংলাদেশের আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছে কয়েক দফা। প্রথমে গোলা বিস্ফোরিত না হলেও পরে বাংলাদেশের ভেতরে গোলা বিস্ফোরণ হয়েছে এবং এতে একজনের মৃত্যুসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। অর্থাৎ সীমান্তে যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে মিয়ানমার আসলেই আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ চাচ্ছে কি না, এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে আলোচনা করা যাক এ যুদ্ধপরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে।

এ দফার রোহিঙ্গা ঢল আসার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আগস্টের শেষে। দিবসটি সামনে রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা চলছিল। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ সফরে আসা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফরকালে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছিলেন। ঢাকায় তিনি তার সফরের ব্যাপারে ব্রিফিংয়ের সময় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলেছেন। এমনকি কয়েকদিন আগেই মানবাধিকার পরিষদের ৫১তম অধিবেশনের সূচনায় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাদা আল নাশিফ বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যাচেলেটের পর্যবেক্ষণগুলো পুনরুল্লেখ করেন।

বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক পর্যায়ে একরকম হারিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা আবার কিছুটা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এ পরিস্থিতি মিয়ানমারের সামরিক সরকারের জন্য মোটেও ইতিবাচক নয়। সুতরাং বাংলাদেশ সীমান্তে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে সবার আলোচনা সেদিকেই কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা এবং তা রোহিঙ্গাসংক্রান্ত সব আলোচনাকে দূরে সরিয়ে দেবে। এছাড়াও আছে মিয়ানমার জান্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ২০২০ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। সেই নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছিল।

আমরা অনেকেই জানি, মিয়ানমারে এর আগের সরকারে সু চির দল ক্ষমতায় থাকলেও দেশটির ডি-ফ্যাক্টো শাসক ছিলেন সেনাবাহিনীপ্রধান। মিয়ানমারের সর্বশেষ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন এবং প্রশাসনের অঙ্গ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ সদস্য সংরক্ষিত আছে কর্মরত সেনা অফিসারদের জন্য।

অর্থাৎ কোনো বেসামরিক সরকার সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া বিদ্যমান সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না। শুধু তা-ই নয়-স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত রক্ষা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো সরাসরি সামরিক বাহিনীর অধীনে। এমন একটি সর্বশক্তিমান সেনাবাহিনী কার্যত মিয়ানমারের সরকারে থাকার পরও একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, যেটিতে সেনাবাহিনী সমর্থিতরা অত্যন্ত বাজে ফল করেছে। যাই হোক, কারচুপির অভিযোগে নির্বাচনের ফলাফল সেনাবাহিনী প্রত্যাখ্যান করে এবং অং সান সু চির দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তো তারা করেইনি, বরং সু চিসহ তার দলের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করেছে। সেনাবাহিনীপ্রধান সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন।

তবে এবার সেনাবাহিনী আর আগের মতো খুব ভালো অবস্থায় নেই। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো একত্র হয়েছে এবং তারা একটি সরকার গঠন করেছে। সেই সরকারের পক্ষে সমর্থন দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, যাতে সাড়া দিয়েছে পশ্চিমা অনেক দেশ। শুধু তা-ই নয়, তারা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে।

বর্তমানে মিয়ানমারে প্রায় পূর্ণমাত্রার একটা গৃহযুদ্ধ চলছে। এ গৃহযুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনই আছে বেসামরিক মানুষকে হত্যা, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ। এ গৃহযুদ্ধের কারণেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন আন্তর্জাতিক মহলের কাছে, বিশেষত পশ্চিমাদের দিক থেকে চাপের মুখে আছে। বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করার ঘটনা মিয়ানমার জান্তার ওপর থেকে এ চাপ সরিয়ে মনোযোগ ভিন্নদিকে নিতে সাহায্য করবে।

এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢল আসার সময়ও মিয়ানমার আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘনসহ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। অর্থাৎ আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে-কোনোভাবেই যেন মিয়ানমার বারবার একই কাজ করে ফায়দা নিতে না পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের এখন করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, মিয়ানমার আমাদের একটা যুদ্ধের প্ররোচনা দিচ্ছে, যেটায় আমরা কোনোভাবেই পা দেব না। সীমান্তের এ সংঘাত বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায় বলার পর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাতে যদি কাজ না হয় তাহলে তারা জাতিসংঘে যাবেন।

মিয়ানমার জান্তা রোহিঙ্গা সংকটসহ কোনো ইস্যুতে যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছে জাতিসংঘে, তখনই ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে তাকে রক্ষা করেছে রাশিয়া ও চীন। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০ সেপ্টেম্বর এ সংকট নিয়ে বাংলাদেশে কর্মরত প্রতিটি বিদেশি মিশনের প্রতিনিধিদের সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে যখন ব্রিফ করে সাহায্য চেয়েছে, তখন এ বৈঠকে রাশিয়ার প্রতিনিধি থাকলেও ছিল না চীনের প্রতিনিধি। এই একটি তথ্য আমাদের এই সংকটের মূল বুঝতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়।

আর, ‘আমরা কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ করব না’-আমি ব্যক্তিগতভাবে এ কথাটাকে ভুল বলে মনে করি। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করার আগে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয় একটু জেনে নেওয়া যাক। পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়া অন্যান্য অস্ত্রের (কনভেনশনাল) শক্তির ভিত্তিতে পৃথিবীর দেশগুলোর সামরিক সক্ষমতার একটা র‌্যাংকিং আছে। এর নাম ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স’।

এ তালিকার প্রথম নামটি অনুমিতভাবেই আমেরিকা। এরপর আছে যথাক্রমে রাশিয়া, চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এই সূচকে বাংলাদেশ (৪৬তম) মিয়ানমারের (৩৯তম) চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে। যদিও দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেলে সামরিক শক্তিই জয়-পরাজয়ের একমাত্র নির্ধারক নয়, তবুও এটুকু আমরা মাথায় রাখতে পারি যে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সামরিক শক্তি কাছাকাছি।

আগেই আলোচনা করেছি, মিয়ানমার এ মুহূর্তে অভ্যন্তরীণভাবেই সামরিক ক্ষেত্রে চরম সংকটে আছে। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে একটা পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া তার উদ্দেশ্য হওয়ার কথা নয়, যা খুব সহজ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়। তবে তারা সীমান্তে একটা উত্তেজনা বজায় রাখতে চাইবে এবং মাঝেমধ্যে সেটাকে বাড়াতে চাইবে তাদের সেই ভয়াবহ সমস্যাগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

মিয়ানমারের এমন চিন্তা যদি সঠিক বলে বিশ্বাস করি, তাহলে আমরা কোনোভাবেই দেশটির সঙ্গে যুদ্ধে জড়াব না-এমন কথা বলে একটা ভুল বার্তা দিচ্ছি। বাংলাদেশের একটা পূর্ণাঙ্গ নিয়মিত সামরিক বাহিনী আছে, যেটি কাগজে-কলমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমপর্যায়ের। তাহলে কেন আমরা তাদের প্ররোচনার জবাব আরেকটু শক্তভাবে দেব না? এমনকি সামরিক দিক থেকে আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী দেশও যদি আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি তৈরি করে, সেক্ষেত্রেও আমাদের সেনাবাহিনীকে জবাব দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সেটা তাদের কাছে প্রকাশও করতে হবে।

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে একটা সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা সংকট আরও বাড়িয়ে তুলবে, সন্দেহ নেই। তবে মিয়ানমারকে এই বার্তাটি খুব শক্তভাবে দেওয়া উচিত যে, তারা ক্রমাগত আক্রমণাত্মক আচরণ করতে থাকলে বাংলাদেশ তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেবে। যখন মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান কিংবা হেলিকপ্টার গানশিপ প্রথমবার বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করেছিল, এর পরপরই আমাদের উচিত ছিল সেগুলোকে ভূপাতিত করে না ফেললেও সেগুলোর উদ্দেশে সতর্কতামূলক গুলি চালানো-কিছুদিন আগে যেমন নিজ আকাশসীমায় ঢুকে যাওয়া চীনের যুদ্ধবিমানকে সতর্কতামূলক গুলি করেছিল তাইওয়ান। একই সঙ্গে আমাদের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশও করতে পারতাম আমরা। আমাদের জরুরি ছিল স্পষ্টভাবে বলা-আমরা যুদ্ধ চাই না; কিন্তু মিয়ানমার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে থাকলে সেটার জবাব সামরিকভাবে দিতেও প্রস্তুত আছি আমরা।

আমরা অনেকেই খেয়াল করছি না, রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা খুব বড় সার্বভৌমত্বের সংকটে আমরা পড়ে গেছি। দুই বছর আগে জাতিসংঘে মিয়ানমারের এক মন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন, রাখাইন প্রদেশের দুটি সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরাকান আর্মির ঘাঁটি আছে বাংলাদেশে। তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করা এবং এরপর তাদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে সংগঠন দুটি।

বাংলাদেশের ভেতরে সরাসরি আক্রমণ করার একটা প্লট তৈরি করে রাখা হয়েছে দুই বছর আগে থেকেই। এখন যে কোনো প্রয়োজনে এই কাণ্ড ঘটাতে পারে মিয়ানমার, নিজের ইচ্ছায় কিংবা পরের ইচ্ছায়। মিয়ানমারের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা চীনের হাতের পুতুল। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে চলতে থাকা ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় মিয়ানমারের জান্তা সরকার ব্যবহৃত হতে পারে এক মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে। আবারও বলে শেষ করছি-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি দূতাবাসগুলোর প্রতিনিধিদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের ব্রিফিংয়ে অনুপস্থিত ছিল বাংলাদেশ সরকারের ‘অতি কাছের বন্ধু’ চীন।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

মিয়ানমার সীমান্তে যুদ্ধাবস্থার কারণ ও প্রতিক্রিয়া

প্রকাশ: ১২:৩৮:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২

 সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী নানারকম আচরণ করছে মিয়ানমার। নিজ সীমান্তের ভেতরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া মর্টার শেল, এমনকি বিমানের বোমা পড়েছে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার গানশিপ বাংলাদেশের আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছে কয়েক দফা। প্রথমে গোলা বিস্ফোরিত না হলেও পরে বাংলাদেশের ভেতরে গোলা বিস্ফোরণ হয়েছে এবং এতে একজনের মৃত্যুসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। অর্থাৎ সীমান্তে যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে মিয়ানমার আসলেই আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ চাচ্ছে কি না, এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে আলোচনা করা যাক এ যুদ্ধপরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে।

এ দফার রোহিঙ্গা ঢল আসার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আগস্টের শেষে। দিবসটি সামনে রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা চলছিল। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ সফরে আসা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফরকালে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছিলেন। ঢাকায় তিনি তার সফরের ব্যাপারে ব্রিফিংয়ের সময় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলেছেন। এমনকি কয়েকদিন আগেই মানবাধিকার পরিষদের ৫১তম অধিবেশনের সূচনায় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাদা আল নাশিফ বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যাচেলেটের পর্যবেক্ষণগুলো পুনরুল্লেখ করেন।

বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক পর্যায়ে একরকম হারিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা আবার কিছুটা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এ পরিস্থিতি মিয়ানমারের সামরিক সরকারের জন্য মোটেও ইতিবাচক নয়। সুতরাং বাংলাদেশ সীমান্তে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে সবার আলোচনা সেদিকেই কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা এবং তা রোহিঙ্গাসংক্রান্ত সব আলোচনাকে দূরে সরিয়ে দেবে। এছাড়াও আছে মিয়ানমার জান্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ২০২০ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। সেই নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছিল।

আমরা অনেকেই জানি, মিয়ানমারে এর আগের সরকারে সু চির দল ক্ষমতায় থাকলেও দেশটির ডি-ফ্যাক্টো শাসক ছিলেন সেনাবাহিনীপ্রধান। মিয়ানমারের সর্বশেষ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন এবং প্রশাসনের অঙ্গ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ সদস্য সংরক্ষিত আছে কর্মরত সেনা অফিসারদের জন্য।

অর্থাৎ কোনো বেসামরিক সরকার সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া বিদ্যমান সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না। শুধু তা-ই নয়-স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত রক্ষা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো সরাসরি সামরিক বাহিনীর অধীনে। এমন একটি সর্বশক্তিমান সেনাবাহিনী কার্যত মিয়ানমারের সরকারে থাকার পরও একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, যেটিতে সেনাবাহিনী সমর্থিতরা অত্যন্ত বাজে ফল করেছে। যাই হোক, কারচুপির অভিযোগে নির্বাচনের ফলাফল সেনাবাহিনী প্রত্যাখ্যান করে এবং অং সান সু চির দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তো তারা করেইনি, বরং সু চিসহ তার দলের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করেছে। সেনাবাহিনীপ্রধান সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন।

তবে এবার সেনাবাহিনী আর আগের মতো খুব ভালো অবস্থায় নেই। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো একত্র হয়েছে এবং তারা একটি সরকার গঠন করেছে। সেই সরকারের পক্ষে সমর্থন দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, যাতে সাড়া দিয়েছে পশ্চিমা অনেক দেশ। শুধু তা-ই নয়, তারা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে।

বর্তমানে মিয়ানমারে প্রায় পূর্ণমাত্রার একটা গৃহযুদ্ধ চলছে। এ গৃহযুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনই আছে বেসামরিক মানুষকে হত্যা, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ। এ গৃহযুদ্ধের কারণেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন আন্তর্জাতিক মহলের কাছে, বিশেষত পশ্চিমাদের দিক থেকে চাপের মুখে আছে। বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করার ঘটনা মিয়ানমার জান্তার ওপর থেকে এ চাপ সরিয়ে মনোযোগ ভিন্নদিকে নিতে সাহায্য করবে।

এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢল আসার সময়ও মিয়ানমার আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘনসহ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। অর্থাৎ আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে-কোনোভাবেই যেন মিয়ানমার বারবার একই কাজ করে ফায়দা নিতে না পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের এখন করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, মিয়ানমার আমাদের একটা যুদ্ধের প্ররোচনা দিচ্ছে, যেটায় আমরা কোনোভাবেই পা দেব না। সীমান্তের এ সংঘাত বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায় বলার পর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাতে যদি কাজ না হয় তাহলে তারা জাতিসংঘে যাবেন।

মিয়ানমার জান্তা রোহিঙ্গা সংকটসহ কোনো ইস্যুতে যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছে জাতিসংঘে, তখনই ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে তাকে রক্ষা করেছে রাশিয়া ও চীন। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০ সেপ্টেম্বর এ সংকট নিয়ে বাংলাদেশে কর্মরত প্রতিটি বিদেশি মিশনের প্রতিনিধিদের সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে যখন ব্রিফ করে সাহায্য চেয়েছে, তখন এ বৈঠকে রাশিয়ার প্রতিনিধি থাকলেও ছিল না চীনের প্রতিনিধি। এই একটি তথ্য আমাদের এই সংকটের মূল বুঝতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়।

আর, ‘আমরা কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ করব না’-আমি ব্যক্তিগতভাবে এ কথাটাকে ভুল বলে মনে করি। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করার আগে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয় একটু জেনে নেওয়া যাক। পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়া অন্যান্য অস্ত্রের (কনভেনশনাল) শক্তির ভিত্তিতে পৃথিবীর দেশগুলোর সামরিক সক্ষমতার একটা র‌্যাংকিং আছে। এর নাম ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স’।

এ তালিকার প্রথম নামটি অনুমিতভাবেই আমেরিকা। এরপর আছে যথাক্রমে রাশিয়া, চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এই সূচকে বাংলাদেশ (৪৬তম) মিয়ানমারের (৩৯তম) চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে। যদিও দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেলে সামরিক শক্তিই জয়-পরাজয়ের একমাত্র নির্ধারক নয়, তবুও এটুকু আমরা মাথায় রাখতে পারি যে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সামরিক শক্তি কাছাকাছি।

আগেই আলোচনা করেছি, মিয়ানমার এ মুহূর্তে অভ্যন্তরীণভাবেই সামরিক ক্ষেত্রে চরম সংকটে আছে। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে একটা পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া তার উদ্দেশ্য হওয়ার কথা নয়, যা খুব সহজ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়। তবে তারা সীমান্তে একটা উত্তেজনা বজায় রাখতে চাইবে এবং মাঝেমধ্যে সেটাকে বাড়াতে চাইবে তাদের সেই ভয়াবহ সমস্যাগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

মিয়ানমারের এমন চিন্তা যদি সঠিক বলে বিশ্বাস করি, তাহলে আমরা কোনোভাবেই দেশটির সঙ্গে যুদ্ধে জড়াব না-এমন কথা বলে একটা ভুল বার্তা দিচ্ছি। বাংলাদেশের একটা পূর্ণাঙ্গ নিয়মিত সামরিক বাহিনী আছে, যেটি কাগজে-কলমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমপর্যায়ের। তাহলে কেন আমরা তাদের প্ররোচনার জবাব আরেকটু শক্তভাবে দেব না? এমনকি সামরিক দিক থেকে আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী দেশও যদি আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি তৈরি করে, সেক্ষেত্রেও আমাদের সেনাবাহিনীকে জবাব দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সেটা তাদের কাছে প্রকাশও করতে হবে।

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে একটা সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা সংকট আরও বাড়িয়ে তুলবে, সন্দেহ নেই। তবে মিয়ানমারকে এই বার্তাটি খুব শক্তভাবে দেওয়া উচিত যে, তারা ক্রমাগত আক্রমণাত্মক আচরণ করতে থাকলে বাংলাদেশ তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেবে। যখন মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান কিংবা হেলিকপ্টার গানশিপ প্রথমবার বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করেছিল, এর পরপরই আমাদের উচিত ছিল সেগুলোকে ভূপাতিত করে না ফেললেও সেগুলোর উদ্দেশে সতর্কতামূলক গুলি চালানো-কিছুদিন আগে যেমন নিজ আকাশসীমায় ঢুকে যাওয়া চীনের যুদ্ধবিমানকে সতর্কতামূলক গুলি করেছিল তাইওয়ান। একই সঙ্গে আমাদের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশও করতে পারতাম আমরা। আমাদের জরুরি ছিল স্পষ্টভাবে বলা-আমরা যুদ্ধ চাই না; কিন্তু মিয়ানমার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে থাকলে সেটার জবাব সামরিকভাবে দিতেও প্রস্তুত আছি আমরা।

আমরা অনেকেই খেয়াল করছি না, রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা খুব বড় সার্বভৌমত্বের সংকটে আমরা পড়ে গেছি। দুই বছর আগে জাতিসংঘে মিয়ানমারের এক মন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন, রাখাইন প্রদেশের দুটি সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরাকান আর্মির ঘাঁটি আছে বাংলাদেশে। তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করা এবং এরপর তাদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে সংগঠন দুটি।

বাংলাদেশের ভেতরে সরাসরি আক্রমণ করার একটা প্লট তৈরি করে রাখা হয়েছে দুই বছর আগে থেকেই। এখন যে কোনো প্রয়োজনে এই কাণ্ড ঘটাতে পারে মিয়ানমার, নিজের ইচ্ছায় কিংবা পরের ইচ্ছায়। মিয়ানমারের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা চীনের হাতের পুতুল। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে চলতে থাকা ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় মিয়ানমারের জান্তা সরকার ব্যবহৃত হতে পারে এক মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে। আবারও বলে শেষ করছি-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি দূতাবাসগুলোর প্রতিনিধিদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের ব্রিফিংয়ে অনুপস্থিত ছিল বাংলাদেশ সরকারের ‘অতি কাছের বন্ধু’ চীন।