০৫:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নে শিল্প খাতের গুরুত্ব

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
  • প্রকাশ: ১০:৪৭:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / ৬১৬ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্প

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি খাত ও শিল্প খাতের উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ এবং বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষি খাত এবং শিল্প খাত নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব অনুধাবন করা কিছুটা হলেও সম্ভব। ১৯৯০ সালে শিল্পখাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৬৬৩.৬ কোটি ডলার এবং সেবা খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ১৪৮৫.২ কোটি ডলার। জিডিপিতে কৃষি শিল্প এবং সেবাখাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ, ২১ শতাংশ এবং ৪৭ শতাংশ। ২০০০ সালে জিডিপিতে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ২৪ শতাংশ, ২৩ শতাংশ এবং ৫৩ শতাংশ । ২০১০ সালে জিডিপিতে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ১৮ শতাংশ, ২৬ শতাংশ এবং ৫৬ শতাংশ ।  ২০২০ সালে দেশে জিডিপিতে এর পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৪২০ কোটি ডলার এবং কৃষি খাত, শিল্প খাত এবং সেবা খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪.১৮৮.৬৬ কোটি ডলার, প্রায় ৯.৫৭৬.৮৭ কোটি ডলার এবং প্রায় ১৭.৩১২.২৮ কোটি  ডলার। ২০২০ সালে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২২৭০ ডলার। ২০২১ সালে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২,৫০৩ ডলার। জিডিপিতে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের অবদান ছিল প্রায় ১২.৯২ শতাংশ, ২৯.৫৭ শতাংশ এবং ৫৩.৪ শতাংশ।

বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্প
বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্প

উপরি উক্ত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের জিডিপি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলে মাথাপিছু আয়ও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও কৃষি খাতের উত্পাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে  এবং জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ক্রমান্বয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯০ সালে শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৬৩,৬ কোটি ডলার এবং ২০২০ সালে শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯,৫৭৬.৮৭ কোটি ডলার। সেবা খাতে মোট উত্পাদন এবং জিডিপিতে এর অবদান বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ২০২০ সালে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে তবুও বাংলাদেশের মোট উত্পাদনের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে সেবা খাত। উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ফলে দেশের শিল্প খাত ও সেবাখাতের উত্পাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলে মাথাপিছু আয় আগের তুলনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যদিও কৃষি খাত দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং কৃষি খাতে উত্পাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই তথাপি দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান কৃষির তুলনায় অনেকাংশে বেশি। গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি, প্রবাসীগণের প্রেরিত অর্থের ফলে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে। তাছাড়াও পাওয়ার ও এনার্জি খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল  প্রায় ২৫৬ কোটি ডলার।

এবার থাইল্যান্ড প্রসঙ্গে আসা যাক। থাইল্যান্ডের জিডিপিতে ৬ শতাংশ অবদান রয়েছে কৃষি খাতের। একসময় থাইল্যান্ড কৃষিনির্ভর দেশ ছিল। কৃষির সঙ্গে থাইল্যান্ড প্রায় ৩২ শতাংশ জনগণ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। মোট জমির ৪০ শতাংশ থাইল্যান্ডে কৃষিতে ব্যবহূত হচ্ছে। থাইল্যান্ডে প্রচুর ধান উত্পন্ন হয়। এছাড়াও রাবার, হিমায়িত চিংড়ি, আনারস, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ থাইল্যান্ড থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে। থাইল্যান্ডের রপ্তানির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ । জাপানে, সিঙ্গাপুর, হংকং, নেদারল্যান্ড, আমেরিকা, থাইল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং প্রভৃতি দেশ মূলত থাইল্যান্ডের ‘ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স’ শিল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ফলে দ্রুত গতিতে বেড়েছে থাইল্যান্ডের জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়। থাইল্যান্ডের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে কম্পিউটার, ইলেট্রিক্যাল মেশিন, রাবার, প্লাস্টিক, যানবাহন প্রভৃতি পণ্য অন্যতম।

১৯৬১ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত মোট জিডিপি এবং প্রায় ৩১.১ শতাংশ ছিল কৃষি খাতের অবদান। ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ১০.৬ শতাংশ, ২০২০ সালে জিডিপি ৮.৬৩ শতাংশ। অপরপক্ষে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছিল ২২.৮ শতাংশ, ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ছিল ৩২.৮ এবং ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ছিল ৪৩.৭ শতাংশ। থাইল্যান্ডে প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের বিকাশের ফলে মথাপিছু আয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৬৮৩ ডলার, ২০০০ সালে এটি ছিল ২০০৮ ডলার এবং ২০২০ সালে থাইল্যান্ডের মাথাপিছু আয় ছিল ৭,১৮৯ ডলার। থাইল্যান্ডের মোট উত্পাদন বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে মূলত শিল্প খাতের বিরাট ভূমিকা ছিল। ২০১০ সালে থাইল্যান্ডের জিডিপি ছিল ৩৪১১০ কোটি ডলার এবং কৃষি খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩,৫৮৮ কোটি ডলার, ২০২০ সালে জিডিপির পরিমাণ ছিল ৫০,১৮০ কোটি ডলার এবং কৃষি খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪,৩৩০ কোটি ডলার। ২০১০ সালে শিল্প খাতের  মাধ্যমে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ১৩,৬১৭ কোটি ডলার এবং  ২০২০ সালে শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬,৬০৯ কোটি ডলার। ওপরের তথ্য ও উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, যদিও কৃষি খাতের উত্পাদন থাইল্যান্ডে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু  থাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে শিল্প খাতে ভূমিকা ছিল ব্যাপক।

এবার আসা যাক, মালয়েশিয়া প্রসঙ্গে। ১৯৬০ সালে দেশটির প্রায় ৩৭ শতাংশ জনগণ কৃষির সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে জড়িত। রাবার, পাম তেল, কোকোয়া মালোয়েশিয়ায় প্রচুর পরিমাণে উত্পন্ন হয়। ১৯৮০ সালে মালোয়েশিয়ার জিডিপি ছিল ২,৪৪৯ কোটি ডলার, এবং মাথাপিছু আয় ছিল ১৭৭৫ ডলার। জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ২২.৮৯ শতাংশ অর্থাত্ কৃষি খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৬১ কোটি ডলার। জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ১৯.৬৪ শতাংশ অর্থাত্ শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি ডলার।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প

২০০০ সালে মালোয়েশিয়ার জিডিপির পরিমাণ ছিল ৮.৮৬ শতাংশ অর্থাত্ কৃষি খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৮৩৩ কোটি ডলার। ২০০০ সালে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ৩২ শতাংশ অর্থাত্ শিল্প খাতেউত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০০৭ কোটি ডলার। ২০০০ সালে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ৪০৪৪ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে মালোয়েশিয়ার জিডিপি ছিল ৩৬,৪৮৬ কোটি ডলার এবং মাথাপিছু আয় ছিল ১১,৮০২ ডলার। জিডিপিতে কৃষির খাতের অবদান ছিল ৭.৪ শতাংশ অর্থাত্ কৃষি খাতের মাধ্যমে উত্পাদন হয়েছে ২৬৯৯ কোটি ডলার। শিল্প খাতের অবদান ছিল ২২৩ শতাংশ অর্থাত্ শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮১৩২ কোটি ডলার।

ওপরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মালোয়েশিয়ার কৃষি খাতে ও শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ বেড়েছে। শিল্প খাতে উত্পাদন বেড়েছে ব্যাপকভাবে। মালোয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মাথাপিছু আয়ের উন্নয়নে শিল্প খাতের অবদান ছিল বেশি। মালোয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে ছিল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৃহত্ আকারের বিনিয়োগ। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় মালয়েশিয়ার ইলেকট্রনিক্স শিল্পে মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশের বেশি ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগ।

তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালোয়েশিয়া তিনটি দেশেরই কৃষি খাতে উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কৃষি খাতে যে হারে উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে শিল্প খাতের উত্পাদন, যা দেশ তিনটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। শিল্প খাতে উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি অপরিহার্য। দেশীয় উদ্যোক্তাগণের বিনিয়োগ, প্রবাসী বিনিয়োগ অথবা বৈদিশিক বিনিয়োগ যে কোনো ধরনের বিনিয়োগই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্যাবসায়িক কানেকটিভিটি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সব বাস্তবায়ন ইত্যাদি জরুরি। বিনিয়োগ আগ্রহী বৈদেশিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সুবিধা আদায় এবং প্রাপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মালয়েশিয়ায় গাড়ি উৎপাদনকারী বৈদেশিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গুলোতে ৭ হাজার মালোয়েশিয়া শিক্ষিত যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে শিল্প খাতের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের শিল্প খাতে বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিল্প খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ। সহায়ক প্রতিষ্ঠানসমূহের, যেমন— বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ সিকউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রভৃতি কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে। বিদেশি বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করার জন্য দেশের পজিটিভ ইমপ্রেশন তৈরি করা দরকার। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের পদক্ষেপ পর্যালোচনা করে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আমাদের উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিনিয়োগ ও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীগণকে শনাক্ত করে বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বিনিয়োগে উত্সাহ প্রদান করা অপরিহার্য। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের কৃষি খাত এ শিল্প খাত আরো বিকশিত হোক ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যতা নিরসনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হোক সে প্রত্যাশা রইল।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নে শিল্প খাতের গুরুত্ব

প্রকাশ: ১০:৪৭:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি খাত ও শিল্প খাতের উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ এবং বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষি খাত এবং শিল্প খাত নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব অনুধাবন করা কিছুটা হলেও সম্ভব। ১৯৯০ সালে শিল্পখাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৬৬৩.৬ কোটি ডলার এবং সেবা খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ১৪৮৫.২ কোটি ডলার। জিডিপিতে কৃষি শিল্প এবং সেবাখাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ, ২১ শতাংশ এবং ৪৭ শতাংশ। ২০০০ সালে জিডিপিতে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ২৪ শতাংশ, ২৩ শতাংশ এবং ৫৩ শতাংশ । ২০১০ সালে জিডিপিতে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ১৮ শতাংশ, ২৬ শতাংশ এবং ৫৬ শতাংশ ।  ২০২০ সালে দেশে জিডিপিতে এর পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৪২০ কোটি ডলার এবং কৃষি খাত, শিল্প খাত এবং সেবা খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪.১৮৮.৬৬ কোটি ডলার, প্রায় ৯.৫৭৬.৮৭ কোটি ডলার এবং প্রায় ১৭.৩১২.২৮ কোটি  ডলার। ২০২০ সালে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২২৭০ ডলার। ২০২১ সালে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২,৫০৩ ডলার। জিডিপিতে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের অবদান ছিল প্রায় ১২.৯২ শতাংশ, ২৯.৫৭ শতাংশ এবং ৫৩.৪ শতাংশ।

বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্প
বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্প

উপরি উক্ত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের জিডিপি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলে মাথাপিছু আয়ও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও কৃষি খাতের উত্পাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে  এবং জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ক্রমান্বয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯০ সালে শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৬৩,৬ কোটি ডলার এবং ২০২০ সালে শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯,৫৭৬.৮৭ কোটি ডলার। সেবা খাতে মোট উত্পাদন এবং জিডিপিতে এর অবদান বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ২০২০ সালে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে তবুও বাংলাদেশের মোট উত্পাদনের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে সেবা খাত। উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ফলে দেশের শিল্প খাত ও সেবাখাতের উত্পাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলে মাথাপিছু আয় আগের তুলনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যদিও কৃষি খাত দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং কৃষি খাতে উত্পাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই তথাপি দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান কৃষির তুলনায় অনেকাংশে বেশি। গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি, প্রবাসীগণের প্রেরিত অর্থের ফলে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে। তাছাড়াও পাওয়ার ও এনার্জি খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল  প্রায় ২৫৬ কোটি ডলার।

এবার থাইল্যান্ড প্রসঙ্গে আসা যাক। থাইল্যান্ডের জিডিপিতে ৬ শতাংশ অবদান রয়েছে কৃষি খাতের। একসময় থাইল্যান্ড কৃষিনির্ভর দেশ ছিল। কৃষির সঙ্গে থাইল্যান্ড প্রায় ৩২ শতাংশ জনগণ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। মোট জমির ৪০ শতাংশ থাইল্যান্ডে কৃষিতে ব্যবহূত হচ্ছে। থাইল্যান্ডে প্রচুর ধান উত্পন্ন হয়। এছাড়াও রাবার, হিমায়িত চিংড়ি, আনারস, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ থাইল্যান্ড থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে। থাইল্যান্ডের রপ্তানির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ । জাপানে, সিঙ্গাপুর, হংকং, নেদারল্যান্ড, আমেরিকা, থাইল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং প্রভৃতি দেশ মূলত থাইল্যান্ডের ‘ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স’ শিল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ফলে দ্রুত গতিতে বেড়েছে থাইল্যান্ডের জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়। থাইল্যান্ডের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে কম্পিউটার, ইলেট্রিক্যাল মেশিন, রাবার, প্লাস্টিক, যানবাহন প্রভৃতি পণ্য অন্যতম।

১৯৬১ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত মোট জিডিপি এবং প্রায় ৩১.১ শতাংশ ছিল কৃষি খাতের অবদান। ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ১০.৬ শতাংশ, ২০২০ সালে জিডিপি ৮.৬৩ শতাংশ। অপরপক্ষে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছিল ২২.৮ শতাংশ, ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ছিল ৩২.৮ এবং ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ছিল ৪৩.৭ শতাংশ। থাইল্যান্ডে প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের বিকাশের ফলে মথাপিছু আয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৬৮৩ ডলার, ২০০০ সালে এটি ছিল ২০০৮ ডলার এবং ২০২০ সালে থাইল্যান্ডের মাথাপিছু আয় ছিল ৭,১৮৯ ডলার। থাইল্যান্ডের মোট উত্পাদন বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে মূলত শিল্প খাতের বিরাট ভূমিকা ছিল। ২০১০ সালে থাইল্যান্ডের জিডিপি ছিল ৩৪১১০ কোটি ডলার এবং কৃষি খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩,৫৮৮ কোটি ডলার, ২০২০ সালে জিডিপির পরিমাণ ছিল ৫০,১৮০ কোটি ডলার এবং কৃষি খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪,৩৩০ কোটি ডলার। ২০১০ সালে শিল্প খাতের  মাধ্যমে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ১৩,৬১৭ কোটি ডলার এবং  ২০২০ সালে শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬,৬০৯ কোটি ডলার। ওপরের তথ্য ও উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, যদিও কৃষি খাতের উত্পাদন থাইল্যান্ডে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু  থাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে শিল্প খাতে ভূমিকা ছিল ব্যাপক।

এবার আসা যাক, মালয়েশিয়া প্রসঙ্গে। ১৯৬০ সালে দেশটির প্রায় ৩৭ শতাংশ জনগণ কৃষির সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে জড়িত। রাবার, পাম তেল, কোকোয়া মালোয়েশিয়ায় প্রচুর পরিমাণে উত্পন্ন হয়। ১৯৮০ সালে মালোয়েশিয়ার জিডিপি ছিল ২,৪৪৯ কোটি ডলার, এবং মাথাপিছু আয় ছিল ১৭৭৫ ডলার। জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ২২.৮৯ শতাংশ অর্থাত্ কৃষি খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৬১ কোটি ডলার। জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ১৯.৬৪ শতাংশ অর্থাত্ শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি ডলার।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প

২০০০ সালে মালোয়েশিয়ার জিডিপির পরিমাণ ছিল ৮.৮৬ শতাংশ অর্থাত্ কৃষি খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৮৩৩ কোটি ডলার। ২০০০ সালে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ৩২ শতাংশ অর্থাত্ শিল্প খাতেউত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০০৭ কোটি ডলার। ২০০০ সালে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ৪০৪৪ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে মালোয়েশিয়ার জিডিপি ছিল ৩৬,৪৮৬ কোটি ডলার এবং মাথাপিছু আয় ছিল ১১,৮০২ ডলার। জিডিপিতে কৃষির খাতের অবদান ছিল ৭.৪ শতাংশ অর্থাত্ কৃষি খাতের মাধ্যমে উত্পাদন হয়েছে ২৬৯৯ কোটি ডলার। শিল্প খাতের অবদান ছিল ২২৩ শতাংশ অর্থাত্ শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮১৩২ কোটি ডলার।

ওপরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মালোয়েশিয়ার কৃষি খাতে ও শিল্প খাতে উত্পাদনের পরিমাণ বেড়েছে। শিল্প খাতে উত্পাদন বেড়েছে ব্যাপকভাবে। মালোয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মাথাপিছু আয়ের উন্নয়নে শিল্প খাতের অবদান ছিল বেশি। মালোয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে ছিল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৃহত্ আকারের বিনিয়োগ। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় মালয়েশিয়ার ইলেকট্রনিক্স শিল্পে মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশের বেশি ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগ।

তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালোয়েশিয়া তিনটি দেশেরই কৃষি খাতে উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কৃষি খাতে যে হারে উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে শিল্প খাতের উত্পাদন, যা দেশ তিনটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। শিল্প খাতে উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি অপরিহার্য। দেশীয় উদ্যোক্তাগণের বিনিয়োগ, প্রবাসী বিনিয়োগ অথবা বৈদিশিক বিনিয়োগ যে কোনো ধরনের বিনিয়োগই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্যাবসায়িক কানেকটিভিটি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সব বাস্তবায়ন ইত্যাদি জরুরি। বিনিয়োগ আগ্রহী বৈদেশিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সুবিধা আদায় এবং প্রাপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মালয়েশিয়ায় গাড়ি উৎপাদনকারী বৈদেশিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গুলোতে ৭ হাজার মালোয়েশিয়া শিক্ষিত যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে শিল্প খাতের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের শিল্প খাতে বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিল্প খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ। সহায়ক প্রতিষ্ঠানসমূহের, যেমন— বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ সিকউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রভৃতি কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে। বিদেশি বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করার জন্য দেশের পজিটিভ ইমপ্রেশন তৈরি করা দরকার। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের পদক্ষেপ পর্যালোচনা করে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আমাদের উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিনিয়োগ ও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীগণকে শনাক্ত করে বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বিনিয়োগে উত্সাহ প্রদান করা অপরিহার্য। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের কৃষি খাত এ শিল্প খাত আরো বিকশিত হোক ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যতা নিরসনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হোক সে প্রত্যাশা রইল।