০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

র‌্যাডক্লিফ লাইন কী এবং র‍্যাডক্লিফ লাইন সংশ্লিষ্ট ইতিহাস

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ১২:৩২:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / ৬৭৪৪ বার পড়া হয়েছে

সাইরিল র‍্যাডক্লিফ ও র‍্যাডক্লিফ লাইন

র‍্যাডক্লিফ লাইন ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই র‍্যাডক্লিফ শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয় বরং বিশ্বের ইতিহাসেই একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এ নিবন্ধে এই র‍্যাডক্লিফ লাইন বা র‍্যাডক্লিফ রেখা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

এখানে যা আছে

র‍্যাডক্লিফ লাইন কী

র‍্যাডক্লিফ লাইন বা র‍্যাডক্লিফ রেখা হলো ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভাজন করে নবগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণকারী রেখা। র‍্যাডক্লিফ লাইনের পরিকল্পনাকারী স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফ (Cyril John Radcliffe)। এই রেখার নাম রাখা হয় পরিকল্পনাকারী স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফ-এর নামে। তিনি প্রায় ৮.৮ কোটি মানুষের বসতি ও সর্বমোট ১,৭৫,০০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃৃত বাংলা ও পাঞ্জাব উভয় প্রদেশের জনবিন্যাসগত সুষ্ঠু বিভাজন পরিকল্পনার যুগ্মসভাপতি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন।

ভারতবর্ষের বিভাজন (১৯৪৭)
ভারতবর্ষের বিভাজন (১৯৪৭)

১৭ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাজন সংক্রান্ত সীমানা নির্ধারণ রেখার অন্তিম পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে এই রেখাটির পশ্চিমভাগ ভারত–পাকিস্তান সীমান্ত ও পূর্বভাগ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নামে পরিচিত। অর্থাৎ, র‍্যাডক্লিফ রেখার মাধ্যমে বর্তমান ভারতের ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে বিভক্ত করা হয়েছে।

র‍্যাডক্লিফ লাইনের পটভূমি

র‍্যাডক্লিফ কমিশন গঠনের পুর্বের ঘটনাবলি

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাইতে যুক্তরাজ্যের আইনসভাতে (ব্রিটিশ পার্লামেন্ট) পাশ হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ১৯৪৭ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনকে নির্দেশ করে, যা একমাস পরে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট ফলস্রুতি পায়। শুধু তাই নয় আইনটির মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি অধিরাজ্যের মধ্যে ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি ও প্রদেশসমূহ বিভাজনের ইঙ্গিতও নিহিত ছিল।

ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় ও আইনানুসারে ভারতের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে দেশীয় রাজ্য এবং ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলগুলি একীভূত করে তাদের নেতৃৃৃবৃৃন্দের ওপর কে কোন অধিরাজ্য চয়ন করবে সেই অধিকার দেওয়া হয়।

পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল একটি মুসলিমপ্রধান ক্ষেত্র তৈরী করা, অপরদিকে ভারতীয় অধিরাজ্য চেয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে। ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলিই পরে পাকিস্তানের স্রষ্টা হয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে উত্তরপশ্চিমের বেলুচিস্তান প্রদেশ (বিভাজনের পূর্বে ৯১.৮% মুসলিম জনসংখ্যা) ও সিন্ধুপ্রদেশ (বিভাজনের পূর্বে ৭২.৭% মুসলিম জনসংখ্যা) পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উক্ত প্রদেশগুলিতে অন্যান্যধর্মের সংখ্যা নগণ্য হলেও (যদিও সিন্ধুপ্রদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল ছিল হিন্দুপ্রধান) উত্তর পশ্চিমের পাঞ্জাব ও পূর্বভারতের বঙ্গপ্রদেশ ছিল যথাক্রমে ৫৫.৭% ও ৫৪.৪% মুসলিমপ্রধান। পাঞ্জাব প্রদেশ (ব্রিটিশ ভারত)|পাঞ্জাবের পশ্চিমভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় আবার পূর্ব পাঞ্জাব ভারতের একটি রাজ্য হিসাবে ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে পূর্ব পাঞ্জাব পাঞ্জাব, হরিয়াণা ও হিমাচল প্রদেশ নামে তিনটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। বঙ্গপ্রদেশও পূর্ব বাংলা (পাকিস্তান) ও পশ্চিমবঙ্গতে (ভারত) বিভক্ত হয়ে যায়। স্বাধীনতার পূর্বে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (যা পূর্বে ডুরান্ড সীমার মাধ্যমে আফগানিস্তানের সাথে সীমানা নির্দেশিত ছিল) গণভোটের মাধ্যমে ঠিক হয় যে তা পাকিস্তানের যাথে যুক্ত হবে। এই বিতর্কিত গণভোটটি যদিও পরবর্তীকালে উক্ত প্রদেশে খুদাই খিদমতগার আন্দোলনের মাধ্যমে স্থানীয় পাঠানরা বয়কট করে। এটি বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ।

পাঞ্জাবের ধর্মীয় জনবিন্যাস এমনই ছিল যেন কোনো রেখার দ্বারাই হিন্দু, মুসলিম ও শিখপ্রধান অঞ্চল আলাদা করা সম্ভব ছিল না। একই কারণে কোনোভাবেই ব্রিটিশ প্রস্তাবিত কোনো সীমা নির্ধারণকারী রেখা মহম্মদ আলি জিন্নাহ পরিচালিত মুসলিম লীগ এবং জওহরলাল নেহেরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পরিচালিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উভয়কে খুশি করতে পারেনি। উপরন্তু ধর্মের ভিত্তিতে করা যেকোনো প্রকার বিভাজনের ফলস্বরূপ রেল ও সড়ক বিছিন্ন, সেচ পরিকল্পনা, বৈদ্যুতিন সংযোগ এমনকী ভূসম্পত্তির টানাপোড়ন হওয়া সম্ভাবনা নাকচ করা যেতো না। যাইহোক, একটি সুপরিকল্পিত রেখা দ্বারা চাষী ও চাষের জমিকে বা সাধারণ মানুষকে সর্বনিম্ন হয়রানির সম্মুখীন করা যেতো। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে উপমহাদেশে প্রায় ১.৪ কোটি জনসাধারণ বাস্তুহারা হয়। তারা যে যেমন ভাবে পারুক বাসে, ট্রেনে, আকাশপথে, এক্কাগাড়ি, লরিতে করে এবং অধিকাংশই পায়ে হেঁটে আপন জমিহারা হয়ে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হন। তাদের অনেকেই প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়, অনেকে দুর্ভিক্ষগ্রস্থ হয়ে বা অবসন্ন হয়ে মারা যান। এছাড়া ঊনপুষ্টি জনিত শরণার্থীদের অনেকেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কলেরা ও আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন। উক্ত সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীর অনুমোদিত গণনা অনুসারে প্রায় ২,০০,০০০ জন শরণার্থী বিভিন্ন কারণে মারা যায়, যদিও জণগণনার মাধ্যমে জানা যায় যে এর পরিমান প্রায় দশলক্ষের কাছাকাছি ছিল।

বিভাজন পূর্ববর্তী পরিকল্পনা

খ্রিস্টীয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই ব্রিটিশ ভারতে বাংলা এবং পাঞ্জাব প্রদেশের বিভাজনের পরিকল্পনা বিভিন্ন স্তরে চলতে থাকে। শুধু পরিকল্পনাই নয় ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বাংলা ও তৎলগ্ন আসাম, বিহার ও ওড়িশা বঙ্গভঙ্গের কবলিত হয়েছিল। প্রথমবার এই বঙ্গভঙ্গে প্রস্তাব দেন লর্ড কার্জন। ফলস্বরূপ নবগঠিত ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ প্রদেশটি একটি মুসলিমপ্রধান প্রদেশে পরিণত হয় ও ঢাকা শহরটিকে তার রাজধানী হিসাবে স্থাপিত করা হয়। অপরপক্ষে ‘পশ্চিম বাংলা’ প্রদেশটি ছিল একটি হিন্দু প্রধান প্রদেশ, যার রাজধানী ছিল শহর কলকাতা। নবগঠিত উভয় প্রদেশ থেকে প্রবল বিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রশমিত করার লক্ষে এই বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। কিন্তু পুরাতন বৃৃহত্তর বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে বিহার, আসাম ও উৎকল প্রদেশকে পৃথক করে দেওয়া হয়।

বঙ্গভঙ্গের অনুরূপ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পাঞ্জাব প্রদেশটি বিভাজনের প্রস্তাব আসা শুরু হয়। পাঞ্জাব ভাগের প্রবক্তারা হলেন হিন্দু নেতা পরমানন্দ মোহিয়াল, জাতীয় কংগ্রেসের নেতা লালা লাজপত রায়, শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাসহ অন্যান্য আরো অনেক শিখ নেতা। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের সময় মুসলিম লীগ আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী তোলে। ডাঃ বি. আর. আম্বেদকর “থট্স অন পাকিস্তান”(পাকিস্তানের পরিকল্পনা) নামক ৪০০ পাতার একটি গবেষণামূলক পুস্তিকা লেখেন। পুস্তিকাটি মূলত বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলিম ও অমুসলিম জনসীমানা ও তার বিশ্লেষণের ওপর নির্দেশিত। তার গণনা অনুযায়ী তিনি দেখান পাঞ্জাবের পশ্চিমাঞ্চলের ১৬ টি জেলা মুসলিম প্রধান ও পূর্বের বাকী ১৩ টি জেলা শিখ বা হিন্দু, তথা অমুসলিমদের দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আবার বাংলার ক্ষেত্রে ১৫ টি জেলা অমুসলিম তথা হিন্দুপ্রধান হিসাবে তিনি প্রকাশ করেন। তিনি ভেবেছিলেন মুসলিম জনগণ প্রাদেশিক সীমানা পুণর্নির্ধারণ নিয়ে কোনো প্রকার মতবিরোধ করবে না। তার মতে, যদি এরপরেও তাদের বিরোধ হয় তবে এটাই বুঝে নিতে হবে যে তারা তাদের নিজের মুল দাবীচ্যুত ও অন্যপ্রকার পরিকল্পনায় রত।

১৯৪১ এর জনবিন্যাস অনুসারে ব্রিটিশ পাঞ্জাব প্রদেশের সবুজকৃত মুসলিমপ্রধান ও গোলাপীকৃত অমুসলিমপ্রধান অঞ্চল
১৯৪১ এর জনবিন্যাস অনুসারে ব্রিটিশ পাঞ্জাব প্রদেশের সবুজকৃত মুসলিমপ্রধান ও গোলাপীকৃত অমুসলিমপ্রধান অঞ্চল

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের সিমলা সম্মেলন বিফল হওয়ার পর পাকিস্তান তৈরীর পরিকল্পনা গভীরভাবে শুরু হয়। ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত মুনশি স্যার ইভান জেনকিন্স, যিনি পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের রাজ্যপাল হিসাবে নিয়োজিত হন, “পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য পাঞ্জাব” (পাকিস্তান এবং পাঞ্জাব) নামক একটি স্মারকলিপি লেখেন। সেখানে তিনি পাকিস্তান বিভাজনকে ঘিরে তৎকাল ও পরবর্তী সময়ে কী কী সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এরপরেই বিকানেরের অমাত্য-প্রধান কে. এম. পণিক্কর ভাইসরয়কে একটি ফিরতি স্মারকলিপি পাঠান। তার পাঠানো “নেক্সট স্টেপ ইন ইন্ডিয়া”তে (ভারতে পরবর্তী পদক্ষেপ) তিনি ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দেন যে, তারা যেন মুসলিমপ্রধান অঞ্চল আলাদা করার মূলনীতি মাথায় রেখেই পাঞ্জাব এবং বাংলাতে বসবাসকারী সার্বিক সংখ্যালঘু হিন্দু এবং শিখদের দাবীগুলিও পুরণ করার চেষ্টা করে এবং সেই মতো স্থানিক সমন্বয় ঘটায়। এই আলোচনার ওপর ভিত্তি করে ভাইসরয় ভারতীয় রাজ্য মহাসচিবকে “পাকিস্তান থিওরি” (পাকিস্তান প্রকল্প) নামে একটি চিঠি লেখেন। ভাইসরয় রাজ্য মহাসচিবকে জানান যে, সম্পূর্ণ বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে কোনোরকম ন্যূনতম আপোস না করে তার পরিকল্পনা মতো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চান। যেখানে একটি বিরাট সংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি থাকার জন্য জাতীয় কংগ্রেস উভয় প্রদেশেরই প্রায় অর্ধেকাংশ ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিই সেসময়ে বিভাজনের একমাত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

রাজ্যসচিব তার প্রস্তাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লর্ড ওয়াভেলকে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলোর সঠিক নির্বাচন করে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত করার কথা বলেন। পুণর্গঠন কমিশনার ভি.পি.মেনোন এবং তার সহকর্মী স্যার বি.এন.রাও-এর ওপর এই কাজ অর্পিত হয়। তারা “ডিমার্কেশন অব পাকিস্তান এরিয়া” (পাকিস্তান অঞ্চলের সীমানানির্দেশ) নামে একটি চিঠি প্রস্তুত করে। তাদের চিঠি অনুসারে সিন্ধুপ্রদেশ, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ পাঞ্জাবর পশ্চিমভাগের তিনটি বিভাগ যথা, রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান ও লাহোর বিভাগকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাদের অনুমান করেছিল এর ফলে প্রায় ২২ লক্ষ শিখ ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানে ও ১৫ লক্ষ শিখ ভারতে অবস্থান করবে। পাকিস্তানের লাহোর বিভাগের অমৃতসর জেলা ও গুরুদাসপুর জেলাকে শিখপ্রধান অঞ্চল হিসাবে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়(অমৃৃতসর ছিল একটি অমুসলিম প্রধান জেলা ও গুরুদাসপুর ছিল প্রান্তীয় মুসলিম প্রধান জেলা)। সম্পূর্ণ গুরুদাসপুর জেলার ভারতভুক্তির ক্ষতিপূরণ হিসাবে সীমানা নির্ধারণ কমিশন বাংলার সামান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পূর্ণ দিনাজপুর জেলাকে পাকিস্তানের পূর্বপ্রান্তে যুক্ত করা হয়। ভারপ্রাপ্ত গৃহপরিকল্পনা কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য জন থর্নের কাছ থেকে তার মন্তব্য শোনার পর ভাইসরয় ওয়াভেল তা রাজ্যসচিবকে জানানোর ব্যবস্থা করেন। শিখদের ধর্মীয় পবিত্র শহর অমৃতসরকে পাকিস্তান থেকে বহির্ভুত করার এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে গুরুদাসপুর জেলাকেও ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়। রাজ্য মহাসচিব এই প্রস্তাবটি সমর্থন করে তা ভারত-ব্রহ্মদেশ সমিতিকে স্থানান্তর করেন ও জানান, “আই ডু নট থিঙ্ক দ্যাট এনি বেটার ডিভিশান দ্যান দ্য ওয়ান দ্য ভাইসরয় প্রোপোসেস ইস লাইক্লি টু বি ফাউন্ড”(আমার মনে হয় না ভাইসরয়ের দ্বারা প্রস্তাবিত বিভাজন রেখার থেকে উত্তম কোনো প্রস্তাব হতে পারে)।

শিখ উদ্বেগ

প্রাক্তন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর প্রস্তাব ও মুসলিম লীগের প্রস্তাবিত দাবীর মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ কমিশনের যেকোনো প্রকার পরিকল্পনাই শিখদের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মাস্টার তারা সিং ব্যাখ্যা করেন। তার মতে এই বিভাজনের ফলে শিখরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্টিত হয়ে যাবে। তিনি পাঞ্জাবের ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের বিপক্ষে ছিলেন, বরং তিনি চেয়েছিলন পাঞ্জাব যেন একটি সায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হয়। তার মতে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের কখনোই পাঞ্জাবে শাসন করতে দেওয়া ঠিক নয়। অন্যান্য শিখরাও স্বীকার করেছিলেন যে মুসলিমরা হিন্দু আধিপত্য ও শিখরা মুসলিম আধিপত্যযুক্ত স্থান এড়িয়ে চলতে চান। শিখরা ব্রিটিশ সরকারকে সতর্ক করে দেন যে, পাঞ্জাবের অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত বিভাজন বা সম্পূর্ণ পাঞ্জাবকে পাকিস্তানে যুক্ত করলে ব্রাটিশবাহিনীতে কর্মরত শিখ সেনাদলের মনোবল ক্ষুণ্ণ করবে। যেহেতু বাকী হিন্দুরা পাঞ্জাবকে বাদ দিয়ে বাকী ভারত নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিল তাই শিখনেতা মাস্টার তারা সিং হিন্দুদের সাথে সমন্বয় না ঘটিয়ে বরং ইংরেজদের সরাসরি আলোচনার কথা বলতে আগ্রহী হন। ভারত ভাগের উপরিফলস্বরূপ গিয়ানী কর্তার সিং একটি আলাদা শিখরাজ্য গঠন করার প্রস্তাব পরিকল্পনা করেন।

বিভাজন পরিকল্পনা ও সীমা নির্ধারণ চলাকালীন পাকিস্তানের পরিকল্পক মহম্মদ আলি জিন্নাহ শিখদের পূর্ণ অধিকারের সাথে সমস্ত সাংবিধানিক স্বাধীনতা-অধিকার দেওয়ার শর্তে পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন। শিখরা এই প্রস্তাবকে খারিজ করে দেয় ও পাকিস্তানের বিরোধীতা করতে থাকে। তারা একটি বৃৃহত্তর মুসলিম রাষ্ট্রে একটি প্রদেশের ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হয়ে থাকতে চাননি। শিখ সম্প্রদায়ের লোক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃৃষ্টি বা পাকিস্তানের পক্ষে যোগ দিতে চাওয়ার একাধিক কারণ থাকলেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, পাঞ্জাবের বিভাজনের ফলে শিখদের একাধিক পবিত্র ধর্মীয়স্থল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়ে, যা ঐসমস্ত ধর্মস্থলগুলিকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে।

যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একটি অখণ্ড ভারত গড়ার পরিকল্পনা করেন ও মুসলিম লীগ একটি পৃৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে ঐ ঐকই সময়ে শিখনেতা ডাঃ বীর সিং ভাট্টি ‘খালিস্তান’ নামে একটি পৃৃথক শিখরাজ্য গঠনের প্রস্তাব দেন। পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধে অনড় শিখনেতাদের মধ্যে সকলেই পৃথক শিখরাজ্যের দাবীকে সমর্থন করেন। মাস্টার তারা সিং স্বাধীন খালিস্তানের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে ভারত বা পাকিস্তান অধিরাজ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে যুক্ত হওয়ার কথা বলেন। তবে এটা মানতে হয় যে, শিখরা যেই অঞ্চলটিকে নিয়ে খালিস্তান তৈরি করতে চেয়েছিলেন সেখানে কোনো ধর্মেরই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ভারত থেকে পৃথক খালিস্তান রাজ্যের দাবী উঠতে থাকে। প্রাথমিকভাবে আলাপালোচনর মাধ্যমে ব্রিটিশ বাহিনী এই দাবীকে মেনে নিলেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতাদের চাপের বশে শিখরা পরে তাদের এই দাবী প্রত্যাহার করে নেয়। ক্যাবিনেট মিশনের সিদ্ধান্ত শিখদের মূলগতভাবে নাড়া দিয়েছিল, কারণ যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই ব্রিটিশ প্রস্তাবে সন্তুষ্ঠ হলে দেখা যায় তাতে শিখদের স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত রয়ে যায়। তাদের হয় একাধিক ধর্মস্থল বিসর্জন দিয়ে হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্রে যোগ দিতে হতো, নতুবা নতুন মুসলিম রাষ্ট্রে যোগ দিতে হত যেখানে তাদের প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা ছিল। মাস্টার তারা সিং ৫ই মে এই প্রস্তাবের বিরোধ করেন। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকের মধ্যে তাদের পূর্ববর্তী দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব সত্ত্বেও শিখনেতারা ব্রিটিশদের অন্তর্বর্তী প্রস্তাবে মান্যতা দেয়। শিখরা ধর্মীয় ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিতে ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

দেশভাগ প্রসঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

পাঞ্জাব প্রদেশের প্রাকবিভাজন চিত্র

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যেকার মতবিরোধ দূর করে একটি সঠিক সমাধানের লক্ষ্যে ভারতে একটি ক্যাবিনেট মিশন পাঠান। কংগ্রেস খাঁটি মুসলিম অঞ্চলগুলি নিয়ে পাকিস্তান তৈরির প্রস্তাবে মান্যতা দেয়। শিখনেতারা শিখদের স্বার্থে আম্বালা, জলন্ধর , লাহোর বিভাগ এবং মুলতান বিভাগের কিছু জেলা একত্রিত করে একটি শিখ স্বশাসিত অঞ্চলের প্রস্তাব দেন, যদিও তা ক্যাবিনেট সদস্যদের গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। জিন্নাহের সাথে আলোচনার পর ক্যাবিনেট মিশন সিদ্ধান্ত নেয়, হয় গুরুদাসপুর বাদে অন্যান্য মুসলিম প্রধান জেলাগুলি নিয়ে একটি ক্ষুদ্র পাকিস্তান তৈরী হবে নতুবা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত একটি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন বৃহত্তর পাকিস্তান তৈরী হবে। প্রাথমিক ভাবে ক্যাবিনেট মিশন সমস্ত প্রস্তাবসম্বলিত হয়ে একটি বৃৃহত্তর ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব দিলেও শেষে অকেন্দ্রীভূত ভারতের শাসন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে নেহেরু এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন।

পাঞ্জাব এবং বাংলা উভয় প্রদেশেরই হিন্দু এবং শিখরা প্রদেশদুটির বিভাজনকে ক্ষতিকর বলে মনে করেছিল কারণ যদি ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগও হয় তবুও এই দুটি প্রদেশে মুসলিমরা সামান্য প্রান্তীয় সংখ্যাগরিষ্ট ছিল কিন্তু ভারতভাগের সীমানা এই প্রদেশদুটির ওপর দিয়েই নির্ধারিত হয়। ব্রিটিশ সরকারও এই যুক্তির সাথে সহমত পোষন করে। বিদ্বান আকবর আহমেদ মনে করেন যে, ভারতের শাসনতন্ত্রের মৌলিক একক হলো প্রদেশ, এবং তাই প্রদেশভাগের জায়গায় জেলাভিত্তিক বিভাজন হাস্যকর, অযৌক্তিক এবং বিভাজনের মূল উদ্দেশ্যকে খন্ডিত করে। তিনি আরো বলেন যে, এই ধরনের সিদ্ধান্তে বিচ্ছিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলিও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবী তুলতে পারে।

শিয়ালকোটের পণ্ডিত ও লেখক মনে করেন, ভি.পি.মেনোন ও সর্দার প্যাটেল যুগ্ম প্রচেষ্টায় মুসলিমদের একটি “মথ ইটেন পাকিস্তান” (অপূর্ণ পাকিস্তান) দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। এরপর নেহেরু ভাইসরয় ওয়াভেলের সাথে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজন বিষয়ক আলোচনা শুরু করেন। নেহেরু মেনোনকে জানান যে, এই বিভাজনের ফলে পাঞ্জাব ও বাংলার যথাক্রমে কৃৃষি ও শিল্পে উন্নত অংশগুলি ভারতের অন্তর্ভক্ত হবে আর পাকিস্তান কন্ধ-কাটা হয়ে তার গুরুত্ব হারাবে। জওহরলাল নেহেরু মহাত্মা গান্ধীজিকে বলেছিলেন, “ইট ইস আনলাইক্লি দ্যাট জিন্নাহ অ্যান্ড মুসলিম লীগ উইল এগ্রি টু দিস ট্রাঙ্কেটেড পাকিস্তান হুইচ ক্যান নেভার সাক্সিড ইকোনমিকালি অর আদারওয়াইস” (এটা প্রায় অসম্ভব যে জিন্নাহ এবং মুসলীম লিগ এরকম একটি কন্ধ-কাটা পাকিস্তান তৈরীতে সম্মত হবে যা পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক বা অন্যান্য দিক দিয়ে অগ্রসর হতে অপারক) স্যার ক্রিপ্স বলেন, পাকিস্তান যা চেয়েছিল তার থেকে তারা যা পাচ্ছে তা কিছু অংশে পরিবর্তন যোগ্য এবং এটা হতেও পারে যে তারা এই পরিকল্পনাকে অস্বীকার করবে। ৮ই মার্চ তারিখে কংগ্রেস পাঞ্জাব বিভাজনের সম্ভাব্য সমাধান পেশ করে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্পষ্ট আদেশ নিয়ে পরবর্তী ভাইসরয় হিসাবে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন। শিয়ালকোটের প্রখ্যাত লেখকের মতে, মাউন্টব্যাটেন এবং তার সদস্যরা সেখানে আসার আগে থেকেই পাঞ্জাব বিভাজনের সমস্ত সুপারিশের মূল্যায়ন করে রেখেছিলেন। দশদিনের মধ্যে মাউন্টব্যাটেন এর কর্মীরা সুনিশ্চিতভাবে বলেন যে, কংগ্রেস পাঞ্জাবের পূর্বদিকের ১৩ টি জেলা (অমৃৃতসর ও গুরুদাসপুর জেলা সহ) বাদে বাকী অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে বিনাবাধায় প্রস্তুত।

জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব সহ্য করে নেয়। যদিও লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে পরপর হওয়া ছয়টি আলোচনাসভাতে তিনি প্রদেশগুলির পাকিস্তানে সম্পূর্ণ ভুক্তির কথা তুলতে থাকেন। তিনি তীব্রভাবে অভিযোগ করেন যে তার পরিকল্পিত সম্পূর্ণ পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং বাংলাকে ভেঙে ভাইসরয় একটি অসম্পূর্ণ ও কন্ধ-কাটা পাকিস্তান তৈরী করতে চান।

অমুসলিমদের জন্য গুরুদাসপুর জেলা একটি মুখ্য কলহপরায়ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পাঞ্জাব লোকসভায় তাদের সদস্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মুখ্যসদস্য লর্ড ইসমায়কে এবং জেলাশাসককে জানান যে, গুরুদাসপুর আসলে একটি অমুসলিম জেলা। তারা বিস্তারিতভাবে বোঝান যে গুরুদাসপুর জেলায় জনসংখ্যার দিক থেকে ৫১% মুসলিম হলেও সমগ্র জেলাটির জমির মাত্র ৩৫% মুসলিমদের মালিকানাধীন এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা এসেছে দ্রুত সংখ্যাবৃৃদ্ধির হারের কারণে।

এপ্রিল মাসে গভর্নর ইভান জেনকিন্স লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে একটি মুক্তপত্র লেখেন যে, পাঞ্জাব মুসলিম এবং অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্টতার ভাত্তিতে বিভাজন হবে কিন্তু সংলগ্ন তহশিল সংক্রান্ত বিষয়ে একমাত্র চুক্তির মাধ্যমেই সমন্বয় স্থাপন করা সম্ভব। তিনি পাঞ্জাব লোকসভাতে দুজন মুসলিম এবং দুজন অমুসলিম সদস্যদের নিয়ে একটি সর্বাধিক নিখুঁত সীমানা কমিশন তৈরী করে বিচার বিবেচনা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি আরো প্রস্তাব দেন যে, উচ্চ আদালতের একজন ব্রিটিশ বিচারক যেন এই কমিশনের সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন। জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ আলোচনা ও সভার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত দুটি প্রদেশের বিভাজনকে আটকানোর চেষ্টা করে যান আবার অপরদিকে উপেক্ষিত শিখরা পূর্বের মাত্র ১২টি জেলা ভারতে সংযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা করে তথা তারা মনে করেছিল যে শিখদের পবিত্র গুরুদাসপুর হয়তো এই বিভাজনের ফলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কা পূর্ণতা পায় যখন ৩রা জুন বিভাজনের পরিকল্পনার প্রকল্পে ১২ টি জেলা ভারতে ও ১৭ টি জেলা পাকিস্তানের যুক্ত করার কথা লেখা হয় এবং চূড়ান্ত সীমান্ত নির্ধারন স্থির হয়। পরে তা পুণর্মূল্যায়নের মাধ্যমে গুরুদাসপুরকে ভারতে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিয়ালকোটের লেখকের দৃষ্টিতে এটা ছিল শিখদের শান্ত করার প্রয়াস।

মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহকে ভয় দেখান যে যদি তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগকে সমর্থন না করেন তবে পরিকল্পনা করে তিনি শিখদের পক্ষ নেবেন ও মুসলিমদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে এরকম একটি সীমানারেখা তৈরী করবেন। পরবর্তীকালে সদস্য লর্ড ইসমায় বোঝান যে জিন্নাহকে ভয় না দেখিয়ে তার মানষিকতাকে আঘাত করলেও একইরকম ফল পাওয়া যেতে পারে। শেষমেশ তারা জিন্নাহর দাবী নাকচ করতে সক্ষম হন। ২রা জুন জিন্নাহ আবার মাউন্টব্যাটেনের কাছে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ না করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তাকে ভয় দেখিয়ে বলেন’ “ইউ উড লুজ পাকিস্তান প্রব্যাব্লি ফর গুড” (আপনি হয়তো এভাবে পাকিস্তানকে হারাতে চলেছেন)।

প্রক্রিয়া ও অবদানকারী ব্যক্তিত্ব

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন লর্ড ওয়াভেলকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের ভাইসরয় পদে নিযুক্তি হওয়ার আগেই তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের একটি অপরিকল্পিত সীমানা নির্ধারন করেছিলেন। কোন প্রদেশের কোন অঞ্চল কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে একটি অন্তর্বঙ্গ এবং আরেকটি অন্তর্পাঞ্জাব উভয় সীমানা অঞ্চলে স্যার শেরিল র‌্যাডক্লিফকে নিয়োগ করেন।

প্রত্যাসন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নির্ণয় করে সেই ভিত্তিতে পাঞ্জাবের ভারতীয় খণ্ড ও পাকিস্তানি খণ্ড ন্যূনতম প্রতিরোধের সাথে নির্ধারন করার জন্য ভারতে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াও এই কমিশন অন্যান্য বিষয়গুলিকেও বিবেচনার মধ্যে আনে। সামান্য কিছু বিচ্যুতি বাদ দিয়ে অন্যান্য ভিত্তিক বিষয়গুলি সুস্পষ্ট না হলেও র‌্যাডক্লিফ লাইনটি প্রাকৃতিক সীমানা, যোগাযোগ, জলসম্পদ ও সেচকার্যের ওপরেও নির্ভর ছিল। এছাড়া কিছুক্ষেত্রে আর্থসামাজিক বিবেচনার মাধ্যমেও সীমানা ঠিক হয়। প্রতি কমিশনে চারজন করে প্রতিনিধি ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও অপর দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। উভয়পক্ষের আগ্রহীদের অচলাবস্থায় বা তাদের হিংসাপূর্ণ আচরণের সময় মাননীয় র‌্যাডক্লিফই অন্তিম সিদ্ধান্ত নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ৮ই জুলাই মাসে একটি পক্ষপাতশূণ্য সীমানা নির্ধারণের জন্য র‌্যাডক্লিফ মাত্র ৫ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন। শীঘ্রই তিনি তার মহাবিদ্যালয়ের সহপাঠী মাউন্টব্যাটেনের সাথে কমিশনের সদস্যদের সাথে দেখা করার জন্য লাহোর এবং কলকাতাতে এসে উপস্থিত হন। কমিশন সদস্যের মধ্যে মুখ্য দুজন ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের মুখ্য জওহরলাল নেহেরু মহাশয় ও মুসলিম লীগের সভাপতি জনাব মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি এতো ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে এরকম বৃৃহত্তর সিদ্ধান্ত নিতে প্রথমে না চাইলেও সমস্ত দলীয় সদস্যরা তার কাছে ১৫ই আগস্টের পূর্বে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেন। মাউন্টব্যাটেন এইসময়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত ভাইসরয় পদে আসীন থাকতে রাজি ছিলেন পদ প্রত্যাহারের ঠিক দুদিন আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল কিন্তু রাজনৈতিক চাপানউতোর ও কুটনৈতিক কারণে স্বাধীনতার ঘোষণার দুদিন পর অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট তারিখে চূড়ান্ত সীমানা ঘোষণা হয়।

কমিশনের সদস্যপদ

প্রতি সীমানা নির্ধারণ কমিশনে চারজন করে প্রতিনিধি ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও অপর দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও পঞ্চম ব্যক্তি হিসাবে উভয় কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন স্বয়ং র‌্যাডক্লিফ

বাংলার সীমানা নির্ধারণ কমিশনে জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক সি.সি.বিশ্বাস এবং বিজন কুমার মুখার্জী এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক আবু সালেহ মুহাম্মদ আক্রম এবং শেখ আব্দুর রহমান।

পাঞ্জাবের সীমানা নির্ধারণ কমিশনে জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক তেজ সিং এবং মেহের চাঁদ মহাজন এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক দীন মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদ মুনীর।

এই প্রক্রিয়ার সমস্যাগুলি

সীমা রচন প্রক্রিয়া

র‌্যাডক্লিফ রেখার পাঞ্জাব অংশ
র‌্যাডক্লিফ রেখার পাঞ্জাব অংশ

বাইরে থেকে আনীত আইনজ্ঞ, র‌্যাডক্লিফ এবং কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের এই বিষয়ে সমস্ত তথ্য মজুত থাকা ও অভিজ্ঞতা থাকার দরুন অতিরিক্ত কোনো সময় নষ্ট বা প্রতিনিধিদলের প্রয়োজন পড়েনি। সীমানা তৈরীর মতো তাদের কাছে কোনো দক্ষ প্রযোজক ও তথ্যপ্রযৌক্তিক ছিল না। তাদের কোনো বিবেচক ও ছিল না আবার কাজটি একদম নিঁখুতভাবে করার জন্য আঞ্চলিক তথ্য বা জরিপ করার সময়ও ছিল না। দক্ষ অভিজ্ঞ মানুষ ও বিবেচকদের অভাব থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃৃত এই সিদ্ধান্ত যত দ্রুত সম্ভব নেওয়ার চেষ্টা করে। ব্রিটেনের নতুন নির্বাচিত শ্রমজীবী সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি, ঋণের বোঝা ও তার টালবাহান সাম্রাজ্যের চাপ নিতে প্রস্তুত ছিল না। বাইরের প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে ব্রিটিশরা তাদের বিস্তৃৃত সাম্রাজ্যের ইতি ঘটাতে চান যেমন, তারা অন্যান্য অধিকৃৃত দেশের সাথে করেছিল। একই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থেকে মুক্তি পায়, সেই পরিস্থিতির পুণরাবৃত্তি হয় ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও।

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব

নিশ্চুপ অবস্থা ত্যাগ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ উভয়ই সমান প্রতিনিধিত্ব করে গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষপাতিত্ব প্রশমিত করতে থাকে। তাদের সম্পর্ক এতটাই উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে যে, বিচারকমন্ডলীও তাদের সাথে পৃৃথকভাবে আলোচনা করতে নাকচ করে দেয় এবং বিষয়সুচি এতটাই বিষম হয়ে ওঠে যে কোনো ছোটো বিষয়ও বাদ যায়নি। বিষম পরিস্থিতি এতটাই বাজে হয়ে ওঠে যে স্বাধীনতার কিছু সপ্তাহ পুর্বে লাহোরে অবস্থানরত এক শিখ বিচারকের স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হয়।

কার্যত, বিপক্ষ দলের হিন্দু এবং মুসলিম সদস্য সংখ্যালোপ করার জন্য পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত পরিস্থিতি এমন হয় যে, পাঞ্জাবে সীমানা কমিশনকে একটি শিখপ্রধান অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে ভাগ করতে হয়। লর্ড ইসলায় ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজদের সহায়ক চমৎকার ভারতীয় সৈন্যদল”কে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কিন্তু তা ছিল ব্রিটিশদের অন্যতম ঐতিহাসিক ভুল। যাইহোক, শিখ সৈন্যদল কোনোভাবেই তাদের সম্প্রদায় একটি মুসলিমপ্রধান দেশের জন্য যুদ্ধ করুক তা চায়নি, ফলে তারা ভারতে থাকতে চায়। উপরন্তু ভারতে যুক্ত না হলেও তাদের অনেকে আলাদা রাষ্ট্রের দাবী করেছিল যা ব্রিটিশরা ও কমিশন কোনোভাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি।

পরিশেষে, অন্যান্য সম্প্রদায়গুলির ভাগ্য প্রতিনিধির অভাবে বাকী দলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলা সীমানা কমিশন প্রতিনিধিরা কলকাতা শহর কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে সেই প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আবার উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের তরফ থেকে কমিশনে কোনো সদস্য ছিল না। তারা ভারতভাগের দুদিন আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সমস্ত তথ্য থেকে রহিত ছিল ফলে তারা কোনো সদস্যপদের আবেদনও করার সুযোগ পায়নি।

এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেও সীমানা নির্ধারণ আশু প্রয়োজনীয় দেখে র‌্যাডক্লিফ নিজেই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবেন। শুরুতে সবকিছু পর্যালোচনা করা অসম্ভব ছিল কিন্তু র‌্যাডক্লিফ নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং আবার নতুন করে বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে ভেবে এরপর কোনোপ্রকার পরিবর্তন করার কথা খারিজ করে দেন।

স্থানীয় জ্ঞান

কার্যনিযুক্তির পুর্বে র‌্যাডক্লিফ কখনো ভারতে কার্যসুত্রে বা ভারত পরিদর্শনে আসেননি ফলে তিনি স্থানীয়দের কাছে যেমন অপরিচিত মুখ ছিলেন তেমনি তারও ভারত সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ছিল না। ব্রিটিশদের এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিতর্কের পরেও পক্ষপাতহীনত্বই এই প্রকল্পের মুল সম্পদ ছিল। ব্রিটেন ছাড়া অন্য যেকোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না এই শর্তেই তিনি নিযুক্ত হন। তার ব্যক্তিগত মুনশী ক্রিস্টোফার ব্যুমন্ট পাঞ্জাবের প্রশাসন ও জীবনশৈলীর সাথে পরিচিত ছিলেন। নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য র‌্যাডক্লিফ; ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথেও দূরত্ববজায় রাখতে থাকেন।

দ্বন্দ্ব এড়িয়ে থাকা যাবে এরকম সীমানা নির্ধারণ করার মতো বিচক্ষণতা বা পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিল না। পাঞ্জাব এবং বাংলায় আগেই হয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশদের ভারত বিদায়কে আরো অনিশ্চিত করে তুলেছিল। উপনিবেশ পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশিয়া কী ধরনের অসাম্প্রদায়িকতা ও হানাহানি হতে পারে তার আভাষ অর্ধশতাব্দী পুর্বেই উপ্ত হয়েছিল। উপমাহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও করদ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন ছিল ফলে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের হাতের শতাব্দীর দুঃখজনক এই বিভাজনের ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়ে।

ত্বরা এবং ঔদাসীন্য

র‌্যাডক্লিফ স্বতঃসিদ্ধ সত্যতার সাথে নৈমিত্তিক বিভাজন করাকে ন্যায্য বলে ভেবেছিলেন যদিও তাতে বহুলোককে সাম্প্রদায়িকভাবে ভুক্তভোগী হতে হতো। র‌্যাডক্লিফ ভারত ছাড়ার আগে তার সমস্ত নথিপত্র বিনষ্ট করে দেন তাই এই যুক্তির পেছনে র‌্যাডক্লিফের চিন্তাভাবনা জানা যায় না। সীমান্ত তৈরীর পরিকল্পনা সম্পন্ন করে তা লাগু হওয়ার আগেই তিনি নিজে থেকে ভারতের স্বাধীনতার দিন ভারত থেকে বিদায় নেন। র‌্যাডক্লিফের স্ব-উক্তিতে বলেন যে ভারতীয় জলবায়ু তার শরীর পক্ষে উপযুক্ত না। তার তাড়াতাড়ি ভারতত্যাগের এই কারণটিই তিনি জনসমক্ষে পেশ করেন।

সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়া যতটা দ্রুততার সাথে নেওয়া হয়েছিল তার বাস্তবায়ন ও করা হয় সেরকমই দ্রুততার সাথে কোনো বিবেচনা ছাড়া। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট র‌্যাডক্লিফের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগের দিন ১৬ই আগস্ট তারিখে বিকাল ৫টার সময় ঐ পরিকল্পনাটি ভারতীয় ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের পড়ার জন্য দুঘণ্টা সময় দেওয়া হয়।

গোপনীয়তা

মতবিরোধ এবং বিলম্ব এড়ানোর জন্য বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজন গোপনে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৯ই এবং ১২ই আগস্ট-এর মধ্য পরিকল্পনা মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গেলেও তা স্বাধীনতার দুদিন পর আনা হয়, তার আগে নয়।

রিড এবং ফিশারের মতে, কিছু পরিস্থিতিগত প্রমাণ এও পাওয়া যায় যে মাউন্টব্যাটেন বা র‍্যাডক্লিফের ভারতীয় সহকারী পারিষদের সদস্যরা ৯ বা ১০ই আগস্টে পাঞ্জাবের প্রদেশ বিভাজন ও তার রূপায়ণ সম্বন্ধ্যে সমস্ত গোপন তথ্য জওহরলাল নেহেরু ও প্যাটেলকে ফাঁস করে দেয়। এই গোপন সংবাদ কীভাবে প্রকাশ হলো সেই বিষয়ে চিন্তা না করে পরিবর্তনস্বরূপ শতদ্রু খালকে পাকিস্তানে না দিয়ে ভারতের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয় যা শতদ্রু নদীর পূর্বদিকের প্রাচীরের কাজ করবে বলে মনে করা হয়। এই অঞ্চলে পাঁচলক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার সাথে দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তহশিল রয়ে যায়। এই পরিকল্পনা পরিবর্তনের দুটি কারণকে তুলে ধরা যেতে পারে যে, এই অঞ্চলে একটি সেনাবলের অস্ত্রদপ্তর ছিল এবং এটি ছিল শতদ্রু খালের মুখ, যা সমগ্র বিকানের রাজ্যের জলপ্রাপ্তির অন্যতম উৎস। ভারতের মরু অঞ্চলগুলিতে এই সেচখালের মাধ্যমেই চাষাবাদ হতো।

রূপায়ণ

দেশ ভাগের পরে, ব্রিটিশ সরকার দেশত্যাগ করলে সীমানা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ভারত ও পাকিস্তান সরকারের ওপর পড়ে। আগস্ট মাসে লাহোর পরিদর্শনের পরে ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আসন্ন দাঙ্গা আটকানোর জন্য শীঘ্রভাবে পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্স (পাঞ্জাব সীমানারক্ষা বল) মোতায়েন করেন। কিন্তু ৫০,০০০ লোকবল যুক্ত এই সেনাদল ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড আটকানোর জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। ৭৭% হত্যাকাণ্ডই হয়েছিল পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলগুলিতে। প্রদেশটির আয়তনানুসারে লোকবল এতই কম ছিল যে প্রতিবর্গমাইলেও একজন করে সেনা গোনা যেত না। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা ও দুর্ঘটনার শিকার হয় প্রচুর মানুষ বাস্তুহারা হয়ে দেশান্তরী হন, এই বিপুর পরিমান বিশৃঙ্খলা আটকানোর ক্ষমতা ঐ সামান্য সেনাবাহিনীর ছিল না।

ভারত এবং পাকিস্তান কেউই চুক্তি ভাঙতে রাজি ছিল। তারা নির্ধারিত সীমানার উভয়দিকের গ্রামগুলিতে আসন্ন বিদ্রোহর কথা মাথায় রেখে তা প্রশমনে তৎপর হয়, নয়তো এই বিষয়টির ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে উভয় দেশকে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে ফলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ পড়তে পারে। সীমানা বিতর্ক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে তিনবার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ হয়েছিল এবং পরবর্তী কালে ১৯৯৯ তে কার্গিল যুদ্ধও ছিল বিতর্কিত সীমানা কলহেরই ফল।

র‍্যাডক্লিফ লাইন নিয়ে বিবাদ

র‍্যাডক্লিফ লাইন নিয়ে দুইটি মুখ্য বিবাদ ছিল, বাংলার পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা। এ ছাড়া বাংলার মালদা, খুলনা এবং মুর্শিদাবাদ জেলার অংশে ও আসামের করিমগঞ্জে সামান্য বিবাদ হয়েছিল।

পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার মুসলিম প্রধান তহশিলগুলির সাথে সাথে র‍্যাডক্লিফ অমৃৃতসর জেলার মুসলিমপ্রধান অজনালা তহশিল, ফিরোজপুর জেলার মুসলিমপ্রধান জিরা ও ফিরোজপুর তহশিল, জলন্ধর জেলার মুসলিমপ্রধান জলন্ধর ও নাকোদার তহশিলকে পাকিস্তানের বদলে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

পাঞ্জাব

লাহোর

লাহোর জেলা সামগ্রিকভাবে ৬৪.৫% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও লাহোর শহরটি মোটামুটিভাবে ৮০% হিন্দু এবং শিখদের বাসভূমি ছিল। র‍্যাডক্লিফ তার মুল পরিকল্পনাতে লাহোর শহরটিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছিলেন। সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের বক্তব্য অনুসারে, “আমি লাহোর শহরকে প্রায় ভারতের মধ্যে যুক্ত করতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু দেখলাম যে পাকিস্তানে কোনো বড় শহর থাকছে না। আমি আগে থেকেই কলকাতাকে ভারতের জন্য স্থির করে রেখেছিলাম।” যখন র‍্যাডক্লিফ মহাশয়কে বলা করা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের মুসলিম সমাজ তার ভারতের প্রতি পক্ষপাতিত্বের জন্য রুষ্ট হয়েছেন তখন তিনি বলেছিলেন যে, “তাদের উচিত আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা, কারণ নিয়ম মত লাহোর শহর ভারতে যুক্ত হওয়ার কথা, পাকিস্তানে নয়।” কিন্তু এটা শুধুই এই যুক্তি ছিল,কারণ ভারতে স্বাধীনতা অধিনিয়ম এবং ভারতভাগের ভিত্তি ছিল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, যেখানে লাহোরের ৮০% জমির মালিক অমুসলিমরা হলেও মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ভূসম্পত্তির পরিমাপ দেশভাগের মাপকাঠি ছিল না।

সাইরিল র‍্যাডক্লিফ, মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহেরু
সাইরিল র‍্যাডক্লিফ, মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহেরু

ফিরোজপুর জেলা

বর্তমানে ভারতীয় ইতিহাসবিদরা এটা স্বীকার করেন যে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ফিরোজপুর জেলাকে উপহার হিসাবে ভারতকে দিয়েছিল, এই জেলার একাধিক তহশিল ছিল মুসলিমপ্রধান।

গুরুদাসপুর জেলা

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পাঞ্জাব প্রদেশের সর্বোত্তরের জেলাটি ছিল গুরুদাসপুর জেলা। জেলাটি তখন চারটি তহশিলে বিভক্ত ছিল, সেগুলি হলো যথাক্রমে— উত্তরে শঙ্করগড় তহশিল, পাঠানকোট তহশিল এবং দক্ষিণে গুরুদাসপুর তহশিল ও বাতালা তহশিল। এই চারটি তহশিলের মধ্যে ইরাবতী নদী দিকে অন্য তহশিলের থেকে বিচ্ছিন্ন শঙ্করগড় তহশিলটি পাকিস্তানকে দেওয়া হয়। তহশিলটি পশ্চিম পাঞ্জাব প্রদেশের নারোওয়াল জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গুরুদাসপুর, বাতালা ও পাঠানকোট তহশিল ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব রাজ্যের অংশীভুত হয়। মুসলিম দের পাকিস্তানে গমন এবং হিন্দু ও শিখদের ভারতে আনয়নের মাধ্যমে এই জেলাটির জনবিন্যাস তহশিলগতভাবে পরিবর্তন করে জেলাটিকে দুটি অধিরাজ্যে ভাগ করা হয়েছিল।

ঐ সময়ে গুরুদাসপুর জেলা সামগ্রিকভাবে ৫০.২% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ভারতীয় স্বাধীনতা আইনৈর রিপোর্ট অনুসারে গুরুদাসপুর জেলাকে ৫১.১৪% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে দেখানোাহয়। ১৯০১ সালের জনগণনা অনুসারে গুরুদাসপুর জেলাতে ৪৯% মুসলিম, ৪০% হিন্দু এবং ১০% শিখ জনসংখ্যা ছিল বলে জানা যায়। পাঠানকোট তহশিলটি হিন্দু প্রধান হলেও বাকী তিনটি তহশিল মুসলিম প্রধান ছিল, যদিও একমাত্র শঙ্করগড় তহশিলটিই পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা হয়।

র‍্যাডক্লিফ ব্যাখ্যা দেন যে, গুরুদাসপুর ছিল শতদ্রু খালের মুখ যা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জলের উৎস, তাই এই অঞ্চলটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাছাড়া এই খালটি শিখদের পবিত্র অমৃৃতসর নগরের নিকাশি ব্যবস্থার মূল ছিল। লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে সিদ্ধান্ত নেন যে গুরুদাসপুর জেলাটিও অমৃতসর জেলার সাথে যেকোনো একটি অধিরাজ্যে যুক্ত হওয়া উচিত। পরে শিখদের ধর্মীয় স্থানের কথা চিন্তা করে তাকে ভারতে যুক্ত করার কথা ভাবেন। তিন আরো বলেন যে,অমৃতসর থেকে পাঠানকোট অবধি রেল সংযোগটি বাতালা ও গুরুদাসপুর তহশিলের ওপর দিয়েই বিস্তৃত।

পাকিস্তানিরা মনে করেন যে, গুরুদাসপুর জেলার তিনটি তহশিলকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে দিয়েছিলেন সহজপথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে জম্মুতে পৌঁছানোর জন্য। আবার শিরীণ ইলাহি দেখান যে ভারতে অন্যান্য জায়গা থেকে সহজে কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য পাঠানকোট তহশিলই ব্যবহার করা হতো, যা শুরু থেকেই একটি হিন্দু প্রধান তহশিল ছিল। গুরুদাসপুর এবং বাতালা তহশিলকে ভারতে যুক্ত করার সাথে কাশ্মীরের কোনো যোগাযোগ নেই।

গুরুদাসপুরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তান শুরু থেকেই ভেবে আসছিল যে গুরুদাসপুর জেলাকে ভারতে দেওয়াই হয়েছিল কাশ্মীরের সাথে যোগাযোগ সহজ করার জন্য। জাতীয় তথ্যানুসারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার জন্য গুরুদাসপুর জেলা পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার জন্য সাক্ষর করে। ১৪ থেকে ১৭ই আগস্টের মধ্যে মুস্তাক আহমেদ চীমা পাকিস্তানের হয়ে গুরুদাসপুরে ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হন কিন্তু পরে এর অধিকাংশ অঞ্চলই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি সেই পদ ত্যাগ করে পাকিস্তানে ফেরত চলে যান। ভারত বিভাজন ও ভারতের স্বাধীনতা অধিনিয়ম অনুসারে যেহেতু গুরুদাসপুর জেলা ছিল একটি মুসলিম প্রধান জেলা তাই তারা ভেবেছিল নির্দিধায় এই জেলা পাকিস্তানে যুক্ত হবে। কিন্তু কাশ্মীরে ভারতের হস্তক্ষেপ বাড়াতে গুরুদাসপুরকে ভারতের সাথে যুক্ত করা হয়। এটা ধীরে ধীরে পাকিস্তানের একটি চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। জিন্নাহ এবং পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃৃৃবৃন্দ এই বিভাজনকে সরাসরি অনৈতিক এবং ভুল সিদ্ধান্ত বলে দাবী করেন।

মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান সীমানা নির্ধারণ কমিশন পেশ হওয়ার পুর্বেই মুসলিম লীগকে সতর্ক করেছিলেন যে এই আনীত কমিশনটি প্রহসন ছাড়া কিছুই না। তার মতে মাউন্টব্যাটেন ও জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি আগে থেকেই হয়ে গিয়েছিল। সীমানা কমিশনের এক অমুসলিম সদস্য মেহের চাঁদ মহাজন তার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে ভারত ভাগের সমস্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পনা লর্ড মাউন্টব্যাটেন আগে থেকেই করেছিলেন এবং তিনি সহ অন্যান্য অমুসলিম সদস্যরা ছিলেন লোক দেখানোর জন্য একটি পুত্তলিকাস্বরূপ মাত্র। শুধুই ব্রিটিশদের চাপে পড়ে শেষ মুহূর্তে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ঐ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে রেডক্লিভকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং কাশ্মীর প্রসঙ্গে সরকারীভাবে রেডক্লিভ জাতিপুঞ্জের কাছে পাকিস্তানের দাবীকে কখনো তুলে ধরতে দেননি।

জাফরুল্লাহ খান মহাশয় আরো বলেন যে, শুধু গুরুদাসপুর নয় ফিরোজপুর জেলার ফিরোজপুর ও জিরো তহশিল, জলন্ধর জেলার জলন্ধর ও রহোন তহশিল হুশিয়ারপুর জেলার দাসুয়া তহশিলগুলি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও সেগুলি পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি। এই তহশিলগুলি পাকিস্তানকে দেওয়া হলে পাঞ্জাবের কাপুরথালা জেলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তহশিলগুলিও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা যেত। আবার অমৃৃতসরের অজনালা তহশিলও ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাকিস্তানকে গুরুদাসপুর জেলার গুরুদাসপুর ও বাতালা তহশিলটি দেওয়াও যুক্তিযুক্ত ছিল। যদি সত্যিই সঠিক নিয়মে বিভাজন করা হতো তবে নির্ধারিত ১৬ টি পশ্চিম পাকিস্তানের জেলা ও গুরুদাসপুর জেলা ছাড়াও উপর্যুক্ত তহশিলগুলি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতো, যার ফলে কাংড়া জেলাটি হতো ভারতের দিকে ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত। এই সমস্ত অঞ্চলের একটি বৃৃহত্তর অঞ্চল পাকিস্তানে দিলে পাকিস্তান লাভবান হতে পারতো এবং এক্ষত্রে তহশিলগুলি দেশভাগের গুরুত্বপূর্ণ একক হিসাবে কাজ করতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত শঙ্করগড় তহশিল বাদে কোনো মুসলিমপ্রধান তহশিলই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না করে ভারতে দিয়ে দেওয়া হয় উপরন্তু পাকিস্তান এর বদলে পাঞ্জাবের কোনো অমুসলিম প্রধান তহশিল পায় না। তার মতে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাঞ্জাবকে জেলা, তহশিল,থানা এমনকি গ্রাম হিসাবে ভাগ করেও ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন, যা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে খুবই অনিষ্টকর।

জাফরুল্লাহ খানের মতে, গুরুদাসপুর জেলার সদর ও বাতালা তহশিল যে কাশ্মীরকে সুগম্য করার ফন্দি নয় তা মেনে নেওয়াটা খুবই কষ্টসাধ্য। যদি গুরুদাসপুর ও বাতালা তহশিল পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হতো তবে পাঠানকোট তহশিলটি পাঞ্জাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো এবং পাকিস্তান বেষ্টিত হয়ে যেতো। যদিও হুশিয়ারপুরের মাধ্যমে পাঠানকোটে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হতো কিন্তু রেল, সতু ও সড়ক নির্মানে সময় লাগতো অনেক কারণ সৈন্যবলের জন্য এই স্থানটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

র‍্যাডক্লিফ লাইন এবং কাশ্মীর বিতর্ক

স্ট্যানলি ওয়লপার্ট তার একটি বইতে লিখেছিলেন য প্রাথমিক ভাবে র‍্যাডক্লিফ গুরুদাসপুর জেলার তিনটি তহশিল ভারতকে উপহার হিসাবে তুলে দেন কিন্তু নেহেরু এবং তার শ্রদ্ধাভাজন লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিশ্চিত করেন যেন এই জেলাটিকে কোনোভাবেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না করে দেওয়া হয় কারণ এটা ছিল পাঞ্জাব থেকে কাশ্মীরের যাবার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ। ইসলামিক বিভিন্ন মতবাদের ওপর ভিত্তি করে ইউনেস্কোর একটি সদস্যদল অতিসম্প্রতিকালে ব্রিটিশ শাসনকিলের জটিলতা, ভারত বিভাজনের আইন এবং কাশ্মীরকে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে নিতে ভারত এবং ভারতের উচ্চদলগুলির অবদান সম্পর্কে একটি নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ উন্মোচন করেন। তাদের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন জাতীয় কংগ্রেসের জওহরলাল নেহেরুর সাথে হাত মিলিয়ে রেডক্লিভকে বাধ্য করেন যেন তিন ভারতকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গুরুদাসপুর জেলা ও অন্যান্য তহশিলগুলি উপহার দেন। এর ফলে কাশ্মীরের দখল নিতেও ভারতকে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। ঐতিহাসিক অ্যান্ড্রিউ রবার্টস বিশ্বাস করেন যে, মাউন্টব্যাটেন ভারত পাকিস্তান সীমানাচুক্তি লঙ্ঘন করেছিলেন এবং ফিরোজপুর জেলার বহু নথিপত্র জাল করা হয়েছিল এবং গুরুদাসপুরের ক্ষেত্রে তিনিই যে কাশ্মীরকে ভারতে রাখার জন্য রেডক্লিভ বাধ্য করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

পেরি অ্যান্ডারসনের মতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন সরকারীভাবে কোনোরকম পরীক্ষা বা সমীক্ষা এবং কোনো ভবিষ্যত বিবেচনা করেননি এবং তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করে নেহেরুর পরিকল্পিত পথে চলেছিলেন এবং তার শ্রমলাঘব করার জন্য তিনি তাকে উপহারস্বরূপ উক্ত তহশিলগুলি দেন। তিনিই রেডক্লিভের ওপর গুরুদাসপুর জেলা বিষয়ে অনধিকার চর্চা করেন ফলে ভারত দিল্লি থেকে কাশ্মীর অবধি বিনা বাধায় সড়ক যোগাযোগের পথ পেয়ে যায়।

আবার কিছু কিছু ঐতিহাসিকদের মতে কাশ্মীর ছিল একটি করদ রাজতান্ত্রিক রাজ্য, কারো সম্পত্তি নয়, ফলে কাশ্মীরের সাথে দিল্লির যোগসাধনের জন্য গুরুদাসপুরের ভারতভুক্তির কথা মেনে নেওয়া যায় না। পাকিস্তানের নেতা তথা মুসলিম লীগই এই গুরুদাসপুর জেলার গুরুত্ব না বুঝতে পেরে শুরু শঙ্করগড় তহশিল নিয়েই খুশি ছিল। যতক্ষন না ভারতীয় সৈন্য কাশ্মীরে প্রবেশ করে ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তান এই জেলার গুরুত্ব বুঝতে অপারক ছিল। র‍্যাডক্লিফ এবং মাউন্টব্যাটেন উভয়ই এইধরনের দোষারোপকে অস্বীকার করন। মাউন্টব্যাটেনের খসড়াসম্বন্ধীয় বিষয়ে ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগার ও সংগ্রহালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কাশ্মীরের ভারতে যুক্ত হওয়াকে ঐ অঞ্চলের মুসলিমদের জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়।

র‍্যাডক্লিফ লাইন ও বাংলা

পার্বত্য চট্টগ্রাম

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি অতি অমুসলিমপ্রবণ অঞ্চল যার ৯৭% ই ছিল অমুসলিম এবং তাদের মধ্যে একটি সিংহভাগ মানুষই ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাসত্ত্বেও এটিকে পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট পিপলস’ এসোসিয়েশন বাংলায় সীমানা নির্ধারণকারী কমিশনের কাছে আবেদন করেন যে, যেহেতু এই অঞ্চলটি অতি অমুসলিমপ্রবণ তাই তারা ভারতেই থাকতে চায়। যেহেতু তাদের কোনো সরকারী প্রতিনিধিত্ব ছিল না তাই সরকারীভাবে এই বিষয় নিয়ে সেরকম কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি। এবং ভারতের অনেকে ভেবেছিলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ত ভারতকেই দেওয়া হবে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট তারিখ অবধি তারা জানতো না যে তারা কোন দেশের অংশ হবে। ১৭ই আগস্টের র‌্যাডক্লিফের সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ফল হিসাবে দেখা যায় এটিকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানকে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেওয়ার যুক্তি হিসাবে দেখানো হয় যে, তারা ভারতে অনধিগম্য এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও শহরাঞ্চলকে গ্রামাঞ্চলিক সাহায্য ও কর্ণফুলী নদীর নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জরুরি। ফলে প্রায় জোর করেই এই অঞ্চলকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়।

দুদিন পরে, তারা পাকিস্তানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ও ভারতের পতাকা উত্তোলন করে। পাকিস্তানি সৈন্যদল বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনায় বসে এবং অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তারা পাকিস্তানের অপসারণ দাবী করে।

মালদহ জেলা

র‌্যাডক্লিফের দ্বারা নেওয়া আরেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি ছিল বাংলার মালদহ জেলাকে ঘিরে। জেলাটি সার্বিকভাবে সামান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট ছিল কিন্তু জেলাটি বিভাজন কালে অধিকাংশ অঞ্চলই ভারতকে দেওয়া হয়। তার মধ্যে ছিল মুসলিমপ্রধান চাঁচল মহকুমা এবং সদরশহর মালদা। ১৫ই আগস্টের পরাপ্রায় তিন-চার দিন অবধি এখানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল কিন্তু পরে পরিকল্পনা জনসমক্ষে এলে স্থানীয়রাই মালদায় পাকিস্তানের বদলে ভারতীয় পতাকার স্থান দেন।

খুলনা ও মুর্শিদাবাদ জেলা

পূর্বতন অবিভক্ত খুলনা জেলা ছিল সামান্য হিন্দু প্রধান জেলা (৫২%), যার খুলনা মহকুমা বাদে বাকী মহকুমাদুটি মুসলিমপ্রধান ছিল। তাসত্ত্বেও জেলাটিকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবং এর ফলস্বরূপ ৭০% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট মুর্শিদাবাদ জেলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৭ই আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা ভারতের পতাকা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার আগে অবধি মুর্শিদাবাদে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দরুন পাকিস্তানের পতাকাই উত্তোলিত হয়েছিল। মুর্শিদাবাদকে ভারতে যুক্ত করে হিন্দুপ্রধান খুলনাকে পাকিস্তানে দেওয়া ছিল একটি শর্তমাত্র। কারণ কলকাতা বন্দর যে হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত তা এই মুর্শিদাবাদেই গঙ্গা থেকে পৃথক হয়েছে, ফলে মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে থাকলে রাজধানী শহর কলকাতা ও কলকাতা বন্দর সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তো।

আসামের করিমগঞ্জ জেলা

সিলেট গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা আসাম থেকে পাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু সিলেটেরই করিমগঞ্জ মহকুমাটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি জেলার মর্যাদা পায়। মনে করা হয় ত্রিপুরার সাথে ভারতের মুল ভুখণ্ডের যোগাযোগ বৃৃদ্ধি ও সহজ পথে আসাম থেকে ত্রিপুরাতে আসা-যাওয়ার সিলেট থেকে করিমগঞ্জ মহকুমাটি সাড়ে তিনটি থানসহ পৃথক করা হয়েছিল। ২০০১ সালে জনগণনা অনুসারে করিমগঞ্জ জেলার ৫২.৩% জনগণ ধর্মে মুসলিম।

অন্যান্য জেলা

  • কোচবিহার জেলার থেকে দেবীগঞ্জ অঞ্চল এবং জলপাইগুড়ি জেলা থেকে পঞ্চগড় অঞ্চল পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ তথা রায়গঞ্জ মহকুমা, বালুরঘাট মহকুমা ও গঙ্গারামপুর মহকুমা পশ্চিম দিনাজপুর জেলা নামে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • অবিভক্ত নদিয়া জেলার পূর্ব দিকের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহরপুর মহকুমা পূর্ব পাকিস্তানে এবং বাকী কৃষ্ণনগর সদর মহকুমা ও রানাঘাট মহকুমা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • যশোর জেলা থেকে বনগাঁ অঞ্চল ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

উত্তরাধিকার

উত্তরাধিকার ও ইতিহাস রচনা

ভারতের বিভাজন হলো ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মুল কেন্দ্রীয় ঘটনাগুলির একটি এবং একটি যুক্ত ইতিহাসর স্মৃৃতি। এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হাওয়ার্ড ব্রেন্টন ড্রয়িং দ্য লাইন নাটকটি রচনা করেছিলেন। তিনি রেডক্লিভের ভারত ভ্রমণকালে সীমা নির্ধারণ রেখা তৈরী এবং বাঁচার তাগিদে দেশান্তরী হওয়া ও শতকষ্টে থাকা এই মানুষদের জীবনকাহিনী নিয়ে কিঞ্চিত উৎসাহিত হয়েছিলেন, যা তার নাটকে ফুটে উঠেছে।

শৈল্পিক চিত্রাঙ্কন

দেশভাগের চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসাবে রেডক্লিভ লাইনের প্রস্তাব, তার বাস্তবায়ন এবং তার দীর্ঘমেয়াদী ফলস্রুতি বিভিন্ন লেখকদের অনুপ্রাণিত করে। অনেকে এবিষয়ে কখনো বই বা কখনো নাটক উপস্থাপন করেন, অনেকে এই ঘটনার শৈল্পিক চিত্রায়ন করে দর্শকদের সামনে তুলে ধরছিলেন। এই বিষয়ে স্মৃৃতি রক্ষা করে গল্প বা নাটকের পুণর্মূল্যায়ন করে উপস্থাপন করা ব্যক্তিত্বে সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা।

ড্রয়িং দ্য লাইন নাটকটিতে লেখক রেডক্লিভকে একটিাগূরুত্বপূর্ণ আসনে বসিয়েছিলেন। একটি জনসভাতে তিনি বলেছিলেন যে, রেডক্লিভকে ঐসময়ে খুব সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, “তিনি আয়হীনভাবে মানচিত্র এবং সমস্ত নথিপত্র তার ইংল্যিন্ডের বাড়িতে নষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি তার সাথে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই পরিবারের সদস্যদের জানাতে চান নি। আমি এই তথ্যগুলি ঘাটার সময়ে এগুলিই আমাকে এই নাটক লেখার জন্য ধাবিয়ে তোলে”।

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা রাম মাধবানী একটি নয় মিনিটের ছোটো চলচ্চিত্র তৈরী করেন যেখানে তিনি রেডক্লিভের তার সীমা নির্ণয়কিলীন একটি বিশ্বাসযোগ্য চিত্রপট তুলে ধরেন। চলচ্চিত্রটি দেশবিভাগ সম্বন্ধীয় ডব্লিউ. এইচ. অড্যান এর একটি কবিতার ওপর ভিত্তি করে তৈরী।

আরও পড়ুন

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

র‌্যাডক্লিফ লাইন কী এবং র‍্যাডক্লিফ লাইন সংশ্লিষ্ট ইতিহাস

প্রকাশ: ১২:৩২:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

র‍্যাডক্লিফ লাইন ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই র‍্যাডক্লিফ শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয় বরং বিশ্বের ইতিহাসেই একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এ নিবন্ধে এই র‍্যাডক্লিফ লাইন বা র‍্যাডক্লিফ রেখা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

এখানে যা আছে

র‍্যাডক্লিফ লাইন কী

র‍্যাডক্লিফ লাইন বা র‍্যাডক্লিফ রেখা হলো ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভাজন করে নবগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণকারী রেখা। র‍্যাডক্লিফ লাইনের পরিকল্পনাকারী স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফ (Cyril John Radcliffe)। এই রেখার নাম রাখা হয় পরিকল্পনাকারী স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফ-এর নামে। তিনি প্রায় ৮.৮ কোটি মানুষের বসতি ও সর্বমোট ১,৭৫,০০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃৃত বাংলা ও পাঞ্জাব উভয় প্রদেশের জনবিন্যাসগত সুষ্ঠু বিভাজন পরিকল্পনার যুগ্মসভাপতি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন।

ভারতবর্ষের বিভাজন (১৯৪৭)
ভারতবর্ষের বিভাজন (১৯৪৭)

১৭ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাজন সংক্রান্ত সীমানা নির্ধারণ রেখার অন্তিম পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে এই রেখাটির পশ্চিমভাগ ভারত–পাকিস্তান সীমান্ত ও পূর্বভাগ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নামে পরিচিত। অর্থাৎ, র‍্যাডক্লিফ রেখার মাধ্যমে বর্তমান ভারতের ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে বিভক্ত করা হয়েছে।

র‍্যাডক্লিফ লাইনের পটভূমি

র‍্যাডক্লিফ কমিশন গঠনের পুর্বের ঘটনাবলি

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাইতে যুক্তরাজ্যের আইনসভাতে (ব্রিটিশ পার্লামেন্ট) পাশ হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ১৯৪৭ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনকে নির্দেশ করে, যা একমাস পরে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট ফলস্রুতি পায়। শুধু তাই নয় আইনটির মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি অধিরাজ্যের মধ্যে ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি ও প্রদেশসমূহ বিভাজনের ইঙ্গিতও নিহিত ছিল।

ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় ও আইনানুসারে ভারতের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে দেশীয় রাজ্য এবং ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলগুলি একীভূত করে তাদের নেতৃৃৃবৃৃন্দের ওপর কে কোন অধিরাজ্য চয়ন করবে সেই অধিকার দেওয়া হয়।

পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল একটি মুসলিমপ্রধান ক্ষেত্র তৈরী করা, অপরদিকে ভারতীয় অধিরাজ্য চেয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে। ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলিই পরে পাকিস্তানের স্রষ্টা হয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে উত্তরপশ্চিমের বেলুচিস্তান প্রদেশ (বিভাজনের পূর্বে ৯১.৮% মুসলিম জনসংখ্যা) ও সিন্ধুপ্রদেশ (বিভাজনের পূর্বে ৭২.৭% মুসলিম জনসংখ্যা) পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উক্ত প্রদেশগুলিতে অন্যান্যধর্মের সংখ্যা নগণ্য হলেও (যদিও সিন্ধুপ্রদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল ছিল হিন্দুপ্রধান) উত্তর পশ্চিমের পাঞ্জাব ও পূর্বভারতের বঙ্গপ্রদেশ ছিল যথাক্রমে ৫৫.৭% ও ৫৪.৪% মুসলিমপ্রধান। পাঞ্জাব প্রদেশ (ব্রিটিশ ভারত)|পাঞ্জাবের পশ্চিমভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় আবার পূর্ব পাঞ্জাব ভারতের একটি রাজ্য হিসাবে ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে পূর্ব পাঞ্জাব পাঞ্জাব, হরিয়াণা ও হিমাচল প্রদেশ নামে তিনটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। বঙ্গপ্রদেশও পূর্ব বাংলা (পাকিস্তান) ও পশ্চিমবঙ্গতে (ভারত) বিভক্ত হয়ে যায়। স্বাধীনতার পূর্বে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (যা পূর্বে ডুরান্ড সীমার মাধ্যমে আফগানিস্তানের সাথে সীমানা নির্দেশিত ছিল) গণভোটের মাধ্যমে ঠিক হয় যে তা পাকিস্তানের যাথে যুক্ত হবে। এই বিতর্কিত গণভোটটি যদিও পরবর্তীকালে উক্ত প্রদেশে খুদাই খিদমতগার আন্দোলনের মাধ্যমে স্থানীয় পাঠানরা বয়কট করে। এটি বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ।

পাঞ্জাবের ধর্মীয় জনবিন্যাস এমনই ছিল যেন কোনো রেখার দ্বারাই হিন্দু, মুসলিম ও শিখপ্রধান অঞ্চল আলাদা করা সম্ভব ছিল না। একই কারণে কোনোভাবেই ব্রিটিশ প্রস্তাবিত কোনো সীমা নির্ধারণকারী রেখা মহম্মদ আলি জিন্নাহ পরিচালিত মুসলিম লীগ এবং জওহরলাল নেহেরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পরিচালিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উভয়কে খুশি করতে পারেনি। উপরন্তু ধর্মের ভিত্তিতে করা যেকোনো প্রকার বিভাজনের ফলস্বরূপ রেল ও সড়ক বিছিন্ন, সেচ পরিকল্পনা, বৈদ্যুতিন সংযোগ এমনকী ভূসম্পত্তির টানাপোড়ন হওয়া সম্ভাবনা নাকচ করা যেতো না। যাইহোক, একটি সুপরিকল্পিত রেখা দ্বারা চাষী ও চাষের জমিকে বা সাধারণ মানুষকে সর্বনিম্ন হয়রানির সম্মুখীন করা যেতো। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে উপমহাদেশে প্রায় ১.৪ কোটি জনসাধারণ বাস্তুহারা হয়। তারা যে যেমন ভাবে পারুক বাসে, ট্রেনে, আকাশপথে, এক্কাগাড়ি, লরিতে করে এবং অধিকাংশই পায়ে হেঁটে আপন জমিহারা হয়ে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হন। তাদের অনেকেই প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়, অনেকে দুর্ভিক্ষগ্রস্থ হয়ে বা অবসন্ন হয়ে মারা যান। এছাড়া ঊনপুষ্টি জনিত শরণার্থীদের অনেকেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কলেরা ও আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন। উক্ত সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীর অনুমোদিত গণনা অনুসারে প্রায় ২,০০,০০০ জন শরণার্থী বিভিন্ন কারণে মারা যায়, যদিও জণগণনার মাধ্যমে জানা যায় যে এর পরিমান প্রায় দশলক্ষের কাছাকাছি ছিল।

বিভাজন পূর্ববর্তী পরিকল্পনা

খ্রিস্টীয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই ব্রিটিশ ভারতে বাংলা এবং পাঞ্জাব প্রদেশের বিভাজনের পরিকল্পনা বিভিন্ন স্তরে চলতে থাকে। শুধু পরিকল্পনাই নয় ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বাংলা ও তৎলগ্ন আসাম, বিহার ও ওড়িশা বঙ্গভঙ্গের কবলিত হয়েছিল। প্রথমবার এই বঙ্গভঙ্গে প্রস্তাব দেন লর্ড কার্জন। ফলস্বরূপ নবগঠিত ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ প্রদেশটি একটি মুসলিমপ্রধান প্রদেশে পরিণত হয় ও ঢাকা শহরটিকে তার রাজধানী হিসাবে স্থাপিত করা হয়। অপরপক্ষে ‘পশ্চিম বাংলা’ প্রদেশটি ছিল একটি হিন্দু প্রধান প্রদেশ, যার রাজধানী ছিল শহর কলকাতা। নবগঠিত উভয় প্রদেশ থেকে প্রবল বিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রশমিত করার লক্ষে এই বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। কিন্তু পুরাতন বৃৃহত্তর বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে বিহার, আসাম ও উৎকল প্রদেশকে পৃথক করে দেওয়া হয়।

বঙ্গভঙ্গের অনুরূপ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পাঞ্জাব প্রদেশটি বিভাজনের প্রস্তাব আসা শুরু হয়। পাঞ্জাব ভাগের প্রবক্তারা হলেন হিন্দু নেতা পরমানন্দ মোহিয়াল, জাতীয় কংগ্রেসের নেতা লালা লাজপত রায়, শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাসহ অন্যান্য আরো অনেক শিখ নেতা। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের সময় মুসলিম লীগ আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী তোলে। ডাঃ বি. আর. আম্বেদকর “থট্স অন পাকিস্তান”(পাকিস্তানের পরিকল্পনা) নামক ৪০০ পাতার একটি গবেষণামূলক পুস্তিকা লেখেন। পুস্তিকাটি মূলত বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলিম ও অমুসলিম জনসীমানা ও তার বিশ্লেষণের ওপর নির্দেশিত। তার গণনা অনুযায়ী তিনি দেখান পাঞ্জাবের পশ্চিমাঞ্চলের ১৬ টি জেলা মুসলিম প্রধান ও পূর্বের বাকী ১৩ টি জেলা শিখ বা হিন্দু, তথা অমুসলিমদের দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আবার বাংলার ক্ষেত্রে ১৫ টি জেলা অমুসলিম তথা হিন্দুপ্রধান হিসাবে তিনি প্রকাশ করেন। তিনি ভেবেছিলেন মুসলিম জনগণ প্রাদেশিক সীমানা পুণর্নির্ধারণ নিয়ে কোনো প্রকার মতবিরোধ করবে না। তার মতে, যদি এরপরেও তাদের বিরোধ হয় তবে এটাই বুঝে নিতে হবে যে তারা তাদের নিজের মুল দাবীচ্যুত ও অন্যপ্রকার পরিকল্পনায় রত।

১৯৪১ এর জনবিন্যাস অনুসারে ব্রিটিশ পাঞ্জাব প্রদেশের সবুজকৃত মুসলিমপ্রধান ও গোলাপীকৃত অমুসলিমপ্রধান অঞ্চল
১৯৪১ এর জনবিন্যাস অনুসারে ব্রিটিশ পাঞ্জাব প্রদেশের সবুজকৃত মুসলিমপ্রধান ও গোলাপীকৃত অমুসলিমপ্রধান অঞ্চল

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের সিমলা সম্মেলন বিফল হওয়ার পর পাকিস্তান তৈরীর পরিকল্পনা গভীরভাবে শুরু হয়। ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত মুনশি স্যার ইভান জেনকিন্স, যিনি পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের রাজ্যপাল হিসাবে নিয়োজিত হন, “পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য পাঞ্জাব” (পাকিস্তান এবং পাঞ্জাব) নামক একটি স্মারকলিপি লেখেন। সেখানে তিনি পাকিস্তান বিভাজনকে ঘিরে তৎকাল ও পরবর্তী সময়ে কী কী সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এরপরেই বিকানেরের অমাত্য-প্রধান কে. এম. পণিক্কর ভাইসরয়কে একটি ফিরতি স্মারকলিপি পাঠান। তার পাঠানো “নেক্সট স্টেপ ইন ইন্ডিয়া”তে (ভারতে পরবর্তী পদক্ষেপ) তিনি ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দেন যে, তারা যেন মুসলিমপ্রধান অঞ্চল আলাদা করার মূলনীতি মাথায় রেখেই পাঞ্জাব এবং বাংলাতে বসবাসকারী সার্বিক সংখ্যালঘু হিন্দু এবং শিখদের দাবীগুলিও পুরণ করার চেষ্টা করে এবং সেই মতো স্থানিক সমন্বয় ঘটায়। এই আলোচনার ওপর ভিত্তি করে ভাইসরয় ভারতীয় রাজ্য মহাসচিবকে “পাকিস্তান থিওরি” (পাকিস্তান প্রকল্প) নামে একটি চিঠি লেখেন। ভাইসরয় রাজ্য মহাসচিবকে জানান যে, সম্পূর্ণ বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে কোনোরকম ন্যূনতম আপোস না করে তার পরিকল্পনা মতো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চান। যেখানে একটি বিরাট সংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি থাকার জন্য জাতীয় কংগ্রেস উভয় প্রদেশেরই প্রায় অর্ধেকাংশ ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিই সেসময়ে বিভাজনের একমাত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

রাজ্যসচিব তার প্রস্তাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লর্ড ওয়াভেলকে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলোর সঠিক নির্বাচন করে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত করার কথা বলেন। পুণর্গঠন কমিশনার ভি.পি.মেনোন এবং তার সহকর্মী স্যার বি.এন.রাও-এর ওপর এই কাজ অর্পিত হয়। তারা “ডিমার্কেশন অব পাকিস্তান এরিয়া” (পাকিস্তান অঞ্চলের সীমানানির্দেশ) নামে একটি চিঠি প্রস্তুত করে। তাদের চিঠি অনুসারে সিন্ধুপ্রদেশ, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ পাঞ্জাবর পশ্চিমভাগের তিনটি বিভাগ যথা, রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান ও লাহোর বিভাগকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাদের অনুমান করেছিল এর ফলে প্রায় ২২ লক্ষ শিখ ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানে ও ১৫ লক্ষ শিখ ভারতে অবস্থান করবে। পাকিস্তানের লাহোর বিভাগের অমৃতসর জেলা ও গুরুদাসপুর জেলাকে শিখপ্রধান অঞ্চল হিসাবে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়(অমৃৃতসর ছিল একটি অমুসলিম প্রধান জেলা ও গুরুদাসপুর ছিল প্রান্তীয় মুসলিম প্রধান জেলা)। সম্পূর্ণ গুরুদাসপুর জেলার ভারতভুক্তির ক্ষতিপূরণ হিসাবে সীমানা নির্ধারণ কমিশন বাংলার সামান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পূর্ণ দিনাজপুর জেলাকে পাকিস্তানের পূর্বপ্রান্তে যুক্ত করা হয়। ভারপ্রাপ্ত গৃহপরিকল্পনা কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য জন থর্নের কাছ থেকে তার মন্তব্য শোনার পর ভাইসরয় ওয়াভেল তা রাজ্যসচিবকে জানানোর ব্যবস্থা করেন। শিখদের ধর্মীয় পবিত্র শহর অমৃতসরকে পাকিস্তান থেকে বহির্ভুত করার এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে গুরুদাসপুর জেলাকেও ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়। রাজ্য মহাসচিব এই প্রস্তাবটি সমর্থন করে তা ভারত-ব্রহ্মদেশ সমিতিকে স্থানান্তর করেন ও জানান, “আই ডু নট থিঙ্ক দ্যাট এনি বেটার ডিভিশান দ্যান দ্য ওয়ান দ্য ভাইসরয় প্রোপোসেস ইস লাইক্লি টু বি ফাউন্ড”(আমার মনে হয় না ভাইসরয়ের দ্বারা প্রস্তাবিত বিভাজন রেখার থেকে উত্তম কোনো প্রস্তাব হতে পারে)।

শিখ উদ্বেগ

প্রাক্তন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর প্রস্তাব ও মুসলিম লীগের প্রস্তাবিত দাবীর মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ কমিশনের যেকোনো প্রকার পরিকল্পনাই শিখদের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মাস্টার তারা সিং ব্যাখ্যা করেন। তার মতে এই বিভাজনের ফলে শিখরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্টিত হয়ে যাবে। তিনি পাঞ্জাবের ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের বিপক্ষে ছিলেন, বরং তিনি চেয়েছিলন পাঞ্জাব যেন একটি সায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হয়। তার মতে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের কখনোই পাঞ্জাবে শাসন করতে দেওয়া ঠিক নয়। অন্যান্য শিখরাও স্বীকার করেছিলেন যে মুসলিমরা হিন্দু আধিপত্য ও শিখরা মুসলিম আধিপত্যযুক্ত স্থান এড়িয়ে চলতে চান। শিখরা ব্রিটিশ সরকারকে সতর্ক করে দেন যে, পাঞ্জাবের অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত বিভাজন বা সম্পূর্ণ পাঞ্জাবকে পাকিস্তানে যুক্ত করলে ব্রাটিশবাহিনীতে কর্মরত শিখ সেনাদলের মনোবল ক্ষুণ্ণ করবে। যেহেতু বাকী হিন্দুরা পাঞ্জাবকে বাদ দিয়ে বাকী ভারত নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিল তাই শিখনেতা মাস্টার তারা সিং হিন্দুদের সাথে সমন্বয় না ঘটিয়ে বরং ইংরেজদের সরাসরি আলোচনার কথা বলতে আগ্রহী হন। ভারত ভাগের উপরিফলস্বরূপ গিয়ানী কর্তার সিং একটি আলাদা শিখরাজ্য গঠন করার প্রস্তাব পরিকল্পনা করেন।

বিভাজন পরিকল্পনা ও সীমা নির্ধারণ চলাকালীন পাকিস্তানের পরিকল্পক মহম্মদ আলি জিন্নাহ শিখদের পূর্ণ অধিকারের সাথে সমস্ত সাংবিধানিক স্বাধীনতা-অধিকার দেওয়ার শর্তে পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন। শিখরা এই প্রস্তাবকে খারিজ করে দেয় ও পাকিস্তানের বিরোধীতা করতে থাকে। তারা একটি বৃৃহত্তর মুসলিম রাষ্ট্রে একটি প্রদেশের ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হয়ে থাকতে চাননি। শিখ সম্প্রদায়ের লোক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃৃষ্টি বা পাকিস্তানের পক্ষে যোগ দিতে চাওয়ার একাধিক কারণ থাকলেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, পাঞ্জাবের বিভাজনের ফলে শিখদের একাধিক পবিত্র ধর্মীয়স্থল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়ে, যা ঐসমস্ত ধর্মস্থলগুলিকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে।

যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একটি অখণ্ড ভারত গড়ার পরিকল্পনা করেন ও মুসলিম লীগ একটি পৃৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে ঐ ঐকই সময়ে শিখনেতা ডাঃ বীর সিং ভাট্টি ‘খালিস্তান’ নামে একটি পৃৃথক শিখরাজ্য গঠনের প্রস্তাব দেন। পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধে অনড় শিখনেতাদের মধ্যে সকলেই পৃথক শিখরাজ্যের দাবীকে সমর্থন করেন। মাস্টার তারা সিং স্বাধীন খালিস্তানের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে ভারত বা পাকিস্তান অধিরাজ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে যুক্ত হওয়ার কথা বলেন। তবে এটা মানতে হয় যে, শিখরা যেই অঞ্চলটিকে নিয়ে খালিস্তান তৈরি করতে চেয়েছিলেন সেখানে কোনো ধর্মেরই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ভারত থেকে পৃথক খালিস্তান রাজ্যের দাবী উঠতে থাকে। প্রাথমিকভাবে আলাপালোচনর মাধ্যমে ব্রিটিশ বাহিনী এই দাবীকে মেনে নিলেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতাদের চাপের বশে শিখরা পরে তাদের এই দাবী প্রত্যাহার করে নেয়। ক্যাবিনেট মিশনের সিদ্ধান্ত শিখদের মূলগতভাবে নাড়া দিয়েছিল, কারণ যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই ব্রিটিশ প্রস্তাবে সন্তুষ্ঠ হলে দেখা যায় তাতে শিখদের স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত রয়ে যায়। তাদের হয় একাধিক ধর্মস্থল বিসর্জন দিয়ে হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্রে যোগ দিতে হতো, নতুবা নতুন মুসলিম রাষ্ট্রে যোগ দিতে হত যেখানে তাদের প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা ছিল। মাস্টার তারা সিং ৫ই মে এই প্রস্তাবের বিরোধ করেন। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকের মধ্যে তাদের পূর্ববর্তী দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব সত্ত্বেও শিখনেতারা ব্রিটিশদের অন্তর্বর্তী প্রস্তাবে মান্যতা দেয়। শিখরা ধর্মীয় ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিতে ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

দেশভাগ প্রসঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

পাঞ্জাব প্রদেশের প্রাকবিভাজন চিত্র

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যেকার মতবিরোধ দূর করে একটি সঠিক সমাধানের লক্ষ্যে ভারতে একটি ক্যাবিনেট মিশন পাঠান। কংগ্রেস খাঁটি মুসলিম অঞ্চলগুলি নিয়ে পাকিস্তান তৈরির প্রস্তাবে মান্যতা দেয়। শিখনেতারা শিখদের স্বার্থে আম্বালা, জলন্ধর , লাহোর বিভাগ এবং মুলতান বিভাগের কিছু জেলা একত্রিত করে একটি শিখ স্বশাসিত অঞ্চলের প্রস্তাব দেন, যদিও তা ক্যাবিনেট সদস্যদের গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। জিন্নাহের সাথে আলোচনার পর ক্যাবিনেট মিশন সিদ্ধান্ত নেয়, হয় গুরুদাসপুর বাদে অন্যান্য মুসলিম প্রধান জেলাগুলি নিয়ে একটি ক্ষুদ্র পাকিস্তান তৈরী হবে নতুবা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত একটি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন বৃহত্তর পাকিস্তান তৈরী হবে। প্রাথমিক ভাবে ক্যাবিনেট মিশন সমস্ত প্রস্তাবসম্বলিত হয়ে একটি বৃৃহত্তর ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব দিলেও শেষে অকেন্দ্রীভূত ভারতের শাসন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে নেহেরু এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন।

পাঞ্জাব এবং বাংলা উভয় প্রদেশেরই হিন্দু এবং শিখরা প্রদেশদুটির বিভাজনকে ক্ষতিকর বলে মনে করেছিল কারণ যদি ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগও হয় তবুও এই দুটি প্রদেশে মুসলিমরা সামান্য প্রান্তীয় সংখ্যাগরিষ্ট ছিল কিন্তু ভারতভাগের সীমানা এই প্রদেশদুটির ওপর দিয়েই নির্ধারিত হয়। ব্রিটিশ সরকারও এই যুক্তির সাথে সহমত পোষন করে। বিদ্বান আকবর আহমেদ মনে করেন যে, ভারতের শাসনতন্ত্রের মৌলিক একক হলো প্রদেশ, এবং তাই প্রদেশভাগের জায়গায় জেলাভিত্তিক বিভাজন হাস্যকর, অযৌক্তিক এবং বিভাজনের মূল উদ্দেশ্যকে খন্ডিত করে। তিনি আরো বলেন যে, এই ধরনের সিদ্ধান্তে বিচ্ছিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলিও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবী তুলতে পারে।

শিয়ালকোটের পণ্ডিত ও লেখক মনে করেন, ভি.পি.মেনোন ও সর্দার প্যাটেল যুগ্ম প্রচেষ্টায় মুসলিমদের একটি “মথ ইটেন পাকিস্তান” (অপূর্ণ পাকিস্তান) দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। এরপর নেহেরু ভাইসরয় ওয়াভেলের সাথে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজন বিষয়ক আলোচনা শুরু করেন। নেহেরু মেনোনকে জানান যে, এই বিভাজনের ফলে পাঞ্জাব ও বাংলার যথাক্রমে কৃৃষি ও শিল্পে উন্নত অংশগুলি ভারতের অন্তর্ভক্ত হবে আর পাকিস্তান কন্ধ-কাটা হয়ে তার গুরুত্ব হারাবে। জওহরলাল নেহেরু মহাত্মা গান্ধীজিকে বলেছিলেন, “ইট ইস আনলাইক্লি দ্যাট জিন্নাহ অ্যান্ড মুসলিম লীগ উইল এগ্রি টু দিস ট্রাঙ্কেটেড পাকিস্তান হুইচ ক্যান নেভার সাক্সিড ইকোনমিকালি অর আদারওয়াইস” (এটা প্রায় অসম্ভব যে জিন্নাহ এবং মুসলীম লিগ এরকম একটি কন্ধ-কাটা পাকিস্তান তৈরীতে সম্মত হবে যা পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক বা অন্যান্য দিক দিয়ে অগ্রসর হতে অপারক) স্যার ক্রিপ্স বলেন, পাকিস্তান যা চেয়েছিল তার থেকে তারা যা পাচ্ছে তা কিছু অংশে পরিবর্তন যোগ্য এবং এটা হতেও পারে যে তারা এই পরিকল্পনাকে অস্বীকার করবে। ৮ই মার্চ তারিখে কংগ্রেস পাঞ্জাব বিভাজনের সম্ভাব্য সমাধান পেশ করে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্পষ্ট আদেশ নিয়ে পরবর্তী ভাইসরয় হিসাবে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন। শিয়ালকোটের প্রখ্যাত লেখকের মতে, মাউন্টব্যাটেন এবং তার সদস্যরা সেখানে আসার আগে থেকেই পাঞ্জাব বিভাজনের সমস্ত সুপারিশের মূল্যায়ন করে রেখেছিলেন। দশদিনের মধ্যে মাউন্টব্যাটেন এর কর্মীরা সুনিশ্চিতভাবে বলেন যে, কংগ্রেস পাঞ্জাবের পূর্বদিকের ১৩ টি জেলা (অমৃৃতসর ও গুরুদাসপুর জেলা সহ) বাদে বাকী অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে বিনাবাধায় প্রস্তুত।

জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব সহ্য করে নেয়। যদিও লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে পরপর হওয়া ছয়টি আলোচনাসভাতে তিনি প্রদেশগুলির পাকিস্তানে সম্পূর্ণ ভুক্তির কথা তুলতে থাকেন। তিনি তীব্রভাবে অভিযোগ করেন যে তার পরিকল্পিত সম্পূর্ণ পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং বাংলাকে ভেঙে ভাইসরয় একটি অসম্পূর্ণ ও কন্ধ-কাটা পাকিস্তান তৈরী করতে চান।

অমুসলিমদের জন্য গুরুদাসপুর জেলা একটি মুখ্য কলহপরায়ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পাঞ্জাব লোকসভায় তাদের সদস্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মুখ্যসদস্য লর্ড ইসমায়কে এবং জেলাশাসককে জানান যে, গুরুদাসপুর আসলে একটি অমুসলিম জেলা। তারা বিস্তারিতভাবে বোঝান যে গুরুদাসপুর জেলায় জনসংখ্যার দিক থেকে ৫১% মুসলিম হলেও সমগ্র জেলাটির জমির মাত্র ৩৫% মুসলিমদের মালিকানাধীন এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা এসেছে দ্রুত সংখ্যাবৃৃদ্ধির হারের কারণে।

এপ্রিল মাসে গভর্নর ইভান জেনকিন্স লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে একটি মুক্তপত্র লেখেন যে, পাঞ্জাব মুসলিম এবং অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্টতার ভাত্তিতে বিভাজন হবে কিন্তু সংলগ্ন তহশিল সংক্রান্ত বিষয়ে একমাত্র চুক্তির মাধ্যমেই সমন্বয় স্থাপন করা সম্ভব। তিনি পাঞ্জাব লোকসভাতে দুজন মুসলিম এবং দুজন অমুসলিম সদস্যদের নিয়ে একটি সর্বাধিক নিখুঁত সীমানা কমিশন তৈরী করে বিচার বিবেচনা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি আরো প্রস্তাব দেন যে, উচ্চ আদালতের একজন ব্রিটিশ বিচারক যেন এই কমিশনের সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন। জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ আলোচনা ও সভার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত দুটি প্রদেশের বিভাজনকে আটকানোর চেষ্টা করে যান আবার অপরদিকে উপেক্ষিত শিখরা পূর্বের মাত্র ১২টি জেলা ভারতে সংযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা করে তথা তারা মনে করেছিল যে শিখদের পবিত্র গুরুদাসপুর হয়তো এই বিভাজনের ফলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কা পূর্ণতা পায় যখন ৩রা জুন বিভাজনের পরিকল্পনার প্রকল্পে ১২ টি জেলা ভারতে ও ১৭ টি জেলা পাকিস্তানের যুক্ত করার কথা লেখা হয় এবং চূড়ান্ত সীমান্ত নির্ধারন স্থির হয়। পরে তা পুণর্মূল্যায়নের মাধ্যমে গুরুদাসপুরকে ভারতে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিয়ালকোটের লেখকের দৃষ্টিতে এটা ছিল শিখদের শান্ত করার প্রয়াস।

মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহকে ভয় দেখান যে যদি তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগকে সমর্থন না করেন তবে পরিকল্পনা করে তিনি শিখদের পক্ষ নেবেন ও মুসলিমদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে এরকম একটি সীমানারেখা তৈরী করবেন। পরবর্তীকালে সদস্য লর্ড ইসমায় বোঝান যে জিন্নাহকে ভয় না দেখিয়ে তার মানষিকতাকে আঘাত করলেও একইরকম ফল পাওয়া যেতে পারে। শেষমেশ তারা জিন্নাহর দাবী নাকচ করতে সক্ষম হন। ২রা জুন জিন্নাহ আবার মাউন্টব্যাটেনের কাছে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ না করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তাকে ভয় দেখিয়ে বলেন’ “ইউ উড লুজ পাকিস্তান প্রব্যাব্লি ফর গুড” (আপনি হয়তো এভাবে পাকিস্তানকে হারাতে চলেছেন)।

প্রক্রিয়া ও অবদানকারী ব্যক্তিত্ব

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন লর্ড ওয়াভেলকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের ভাইসরয় পদে নিযুক্তি হওয়ার আগেই তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের একটি অপরিকল্পিত সীমানা নির্ধারন করেছিলেন। কোন প্রদেশের কোন অঞ্চল কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে একটি অন্তর্বঙ্গ এবং আরেকটি অন্তর্পাঞ্জাব উভয় সীমানা অঞ্চলে স্যার শেরিল র‌্যাডক্লিফকে নিয়োগ করেন।

প্রত্যাসন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নির্ণয় করে সেই ভিত্তিতে পাঞ্জাবের ভারতীয় খণ্ড ও পাকিস্তানি খণ্ড ন্যূনতম প্রতিরোধের সাথে নির্ধারন করার জন্য ভারতে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াও এই কমিশন অন্যান্য বিষয়গুলিকেও বিবেচনার মধ্যে আনে। সামান্য কিছু বিচ্যুতি বাদ দিয়ে অন্যান্য ভিত্তিক বিষয়গুলি সুস্পষ্ট না হলেও র‌্যাডক্লিফ লাইনটি প্রাকৃতিক সীমানা, যোগাযোগ, জলসম্পদ ও সেচকার্যের ওপরেও নির্ভর ছিল। এছাড়া কিছুক্ষেত্রে আর্থসামাজিক বিবেচনার মাধ্যমেও সীমানা ঠিক হয়। প্রতি কমিশনে চারজন করে প্রতিনিধি ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও অপর দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। উভয়পক্ষের আগ্রহীদের অচলাবস্থায় বা তাদের হিংসাপূর্ণ আচরণের সময় মাননীয় র‌্যাডক্লিফই অন্তিম সিদ্ধান্ত নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ৮ই জুলাই মাসে একটি পক্ষপাতশূণ্য সীমানা নির্ধারণের জন্য র‌্যাডক্লিফ মাত্র ৫ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন। শীঘ্রই তিনি তার মহাবিদ্যালয়ের সহপাঠী মাউন্টব্যাটেনের সাথে কমিশনের সদস্যদের সাথে দেখা করার জন্য লাহোর এবং কলকাতাতে এসে উপস্থিত হন। কমিশন সদস্যের মধ্যে মুখ্য দুজন ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের মুখ্য জওহরলাল নেহেরু মহাশয় ও মুসলিম লীগের সভাপতি জনাব মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি এতো ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে এরকম বৃৃহত্তর সিদ্ধান্ত নিতে প্রথমে না চাইলেও সমস্ত দলীয় সদস্যরা তার কাছে ১৫ই আগস্টের পূর্বে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেন। মাউন্টব্যাটেন এইসময়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত ভাইসরয় পদে আসীন থাকতে রাজি ছিলেন পদ প্রত্যাহারের ঠিক দুদিন আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল কিন্তু রাজনৈতিক চাপানউতোর ও কুটনৈতিক কারণে স্বাধীনতার ঘোষণার দুদিন পর অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট তারিখে চূড়ান্ত সীমানা ঘোষণা হয়।

কমিশনের সদস্যপদ

প্রতি সীমানা নির্ধারণ কমিশনে চারজন করে প্রতিনিধি ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও অপর দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও পঞ্চম ব্যক্তি হিসাবে উভয় কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন স্বয়ং র‌্যাডক্লিফ

বাংলার সীমানা নির্ধারণ কমিশনে জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক সি.সি.বিশ্বাস এবং বিজন কুমার মুখার্জী এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক আবু সালেহ মুহাম্মদ আক্রম এবং শেখ আব্দুর রহমান।

পাঞ্জাবের সীমানা নির্ধারণ কমিশনে জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক তেজ সিং এবং মেহের চাঁদ মহাজন এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক দীন মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদ মুনীর।

এই প্রক্রিয়ার সমস্যাগুলি

সীমা রচন প্রক্রিয়া

র‌্যাডক্লিফ রেখার পাঞ্জাব অংশ
র‌্যাডক্লিফ রেখার পাঞ্জাব অংশ

বাইরে থেকে আনীত আইনজ্ঞ, র‌্যাডক্লিফ এবং কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের এই বিষয়ে সমস্ত তথ্য মজুত থাকা ও অভিজ্ঞতা থাকার দরুন অতিরিক্ত কোনো সময় নষ্ট বা প্রতিনিধিদলের প্রয়োজন পড়েনি। সীমানা তৈরীর মতো তাদের কাছে কোনো দক্ষ প্রযোজক ও তথ্যপ্রযৌক্তিক ছিল না। তাদের কোনো বিবেচক ও ছিল না আবার কাজটি একদম নিঁখুতভাবে করার জন্য আঞ্চলিক তথ্য বা জরিপ করার সময়ও ছিল না। দক্ষ অভিজ্ঞ মানুষ ও বিবেচকদের অভাব থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃৃত এই সিদ্ধান্ত যত দ্রুত সম্ভব নেওয়ার চেষ্টা করে। ব্রিটেনের নতুন নির্বাচিত শ্রমজীবী সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি, ঋণের বোঝা ও তার টালবাহান সাম্রাজ্যের চাপ নিতে প্রস্তুত ছিল না। বাইরের প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে ব্রিটিশরা তাদের বিস্তৃৃত সাম্রাজ্যের ইতি ঘটাতে চান যেমন, তারা অন্যান্য অধিকৃৃত দেশের সাথে করেছিল। একই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থেকে মুক্তি পায়, সেই পরিস্থিতির পুণরাবৃত্তি হয় ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও।

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব

নিশ্চুপ অবস্থা ত্যাগ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ উভয়ই সমান প্রতিনিধিত্ব করে গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষপাতিত্ব প্রশমিত করতে থাকে। তাদের সম্পর্ক এতটাই উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে যে, বিচারকমন্ডলীও তাদের সাথে পৃৃথকভাবে আলোচনা করতে নাকচ করে দেয় এবং বিষয়সুচি এতটাই বিষম হয়ে ওঠে যে কোনো ছোটো বিষয়ও বাদ যায়নি। বিষম পরিস্থিতি এতটাই বাজে হয়ে ওঠে যে স্বাধীনতার কিছু সপ্তাহ পুর্বে লাহোরে অবস্থানরত এক শিখ বিচারকের স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হয়।

কার্যত, বিপক্ষ দলের হিন্দু এবং মুসলিম সদস্য সংখ্যালোপ করার জন্য পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত পরিস্থিতি এমন হয় যে, পাঞ্জাবে সীমানা কমিশনকে একটি শিখপ্রধান অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে ভাগ করতে হয়। লর্ড ইসলায় ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজদের সহায়ক চমৎকার ভারতীয় সৈন্যদল”কে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কিন্তু তা ছিল ব্রিটিশদের অন্যতম ঐতিহাসিক ভুল। যাইহোক, শিখ সৈন্যদল কোনোভাবেই তাদের সম্প্রদায় একটি মুসলিমপ্রধান দেশের জন্য যুদ্ধ করুক তা চায়নি, ফলে তারা ভারতে থাকতে চায়। উপরন্তু ভারতে যুক্ত না হলেও তাদের অনেকে আলাদা রাষ্ট্রের দাবী করেছিল যা ব্রিটিশরা ও কমিশন কোনোভাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি।

পরিশেষে, অন্যান্য সম্প্রদায়গুলির ভাগ্য প্রতিনিধির অভাবে বাকী দলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলা সীমানা কমিশন প্রতিনিধিরা কলকাতা শহর কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে সেই প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আবার উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের তরফ থেকে কমিশনে কোনো সদস্য ছিল না। তারা ভারতভাগের দুদিন আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সমস্ত তথ্য থেকে রহিত ছিল ফলে তারা কোনো সদস্যপদের আবেদনও করার সুযোগ পায়নি।

এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেও সীমানা নির্ধারণ আশু প্রয়োজনীয় দেখে র‌্যাডক্লিফ নিজেই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবেন। শুরুতে সবকিছু পর্যালোচনা করা অসম্ভব ছিল কিন্তু র‌্যাডক্লিফ নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং আবার নতুন করে বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে ভেবে এরপর কোনোপ্রকার পরিবর্তন করার কথা খারিজ করে দেন।

স্থানীয় জ্ঞান

কার্যনিযুক্তির পুর্বে র‌্যাডক্লিফ কখনো ভারতে কার্যসুত্রে বা ভারত পরিদর্শনে আসেননি ফলে তিনি স্থানীয়দের কাছে যেমন অপরিচিত মুখ ছিলেন তেমনি তারও ভারত সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ছিল না। ব্রিটিশদের এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিতর্কের পরেও পক্ষপাতহীনত্বই এই প্রকল্পের মুল সম্পদ ছিল। ব্রিটেন ছাড়া অন্য যেকোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না এই শর্তেই তিনি নিযুক্ত হন। তার ব্যক্তিগত মুনশী ক্রিস্টোফার ব্যুমন্ট পাঞ্জাবের প্রশাসন ও জীবনশৈলীর সাথে পরিচিত ছিলেন। নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য র‌্যাডক্লিফ; ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথেও দূরত্ববজায় রাখতে থাকেন।

দ্বন্দ্ব এড়িয়ে থাকা যাবে এরকম সীমানা নির্ধারণ করার মতো বিচক্ষণতা বা পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিল না। পাঞ্জাব এবং বাংলায় আগেই হয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশদের ভারত বিদায়কে আরো অনিশ্চিত করে তুলেছিল। উপনিবেশ পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশিয়া কী ধরনের অসাম্প্রদায়িকতা ও হানাহানি হতে পারে তার আভাষ অর্ধশতাব্দী পুর্বেই উপ্ত হয়েছিল। উপমাহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও করদ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন ছিল ফলে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের হাতের শতাব্দীর দুঃখজনক এই বিভাজনের ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়ে।

ত্বরা এবং ঔদাসীন্য

র‌্যাডক্লিফ স্বতঃসিদ্ধ সত্যতার সাথে নৈমিত্তিক বিভাজন করাকে ন্যায্য বলে ভেবেছিলেন যদিও তাতে বহুলোককে সাম্প্রদায়িকভাবে ভুক্তভোগী হতে হতো। র‌্যাডক্লিফ ভারত ছাড়ার আগে তার সমস্ত নথিপত্র বিনষ্ট করে দেন তাই এই যুক্তির পেছনে র‌্যাডক্লিফের চিন্তাভাবনা জানা যায় না। সীমান্ত তৈরীর পরিকল্পনা সম্পন্ন করে তা লাগু হওয়ার আগেই তিনি নিজে থেকে ভারতের স্বাধীনতার দিন ভারত থেকে বিদায় নেন। র‌্যাডক্লিফের স্ব-উক্তিতে বলেন যে ভারতীয় জলবায়ু তার শরীর পক্ষে উপযুক্ত না। তার তাড়াতাড়ি ভারতত্যাগের এই কারণটিই তিনি জনসমক্ষে পেশ করেন।

সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়া যতটা দ্রুততার সাথে নেওয়া হয়েছিল তার বাস্তবায়ন ও করা হয় সেরকমই দ্রুততার সাথে কোনো বিবেচনা ছাড়া। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট র‌্যাডক্লিফের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগের দিন ১৬ই আগস্ট তারিখে বিকাল ৫টার সময় ঐ পরিকল্পনাটি ভারতীয় ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের পড়ার জন্য দুঘণ্টা সময় দেওয়া হয়।

গোপনীয়তা

মতবিরোধ এবং বিলম্ব এড়ানোর জন্য বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজন গোপনে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৯ই এবং ১২ই আগস্ট-এর মধ্য পরিকল্পনা মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গেলেও তা স্বাধীনতার দুদিন পর আনা হয়, তার আগে নয়।

রিড এবং ফিশারের মতে, কিছু পরিস্থিতিগত প্রমাণ এও পাওয়া যায় যে মাউন্টব্যাটেন বা র‍্যাডক্লিফের ভারতীয় সহকারী পারিষদের সদস্যরা ৯ বা ১০ই আগস্টে পাঞ্জাবের প্রদেশ বিভাজন ও তার রূপায়ণ সম্বন্ধ্যে সমস্ত গোপন তথ্য জওহরলাল নেহেরু ও প্যাটেলকে ফাঁস করে দেয়। এই গোপন সংবাদ কীভাবে প্রকাশ হলো সেই বিষয়ে চিন্তা না করে পরিবর্তনস্বরূপ শতদ্রু খালকে পাকিস্তানে না দিয়ে ভারতের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয় যা শতদ্রু নদীর পূর্বদিকের প্রাচীরের কাজ করবে বলে মনে করা হয়। এই অঞ্চলে পাঁচলক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার সাথে দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তহশিল রয়ে যায়। এই পরিকল্পনা পরিবর্তনের দুটি কারণকে তুলে ধরা যেতে পারে যে, এই অঞ্চলে একটি সেনাবলের অস্ত্রদপ্তর ছিল এবং এটি ছিল শতদ্রু খালের মুখ, যা সমগ্র বিকানের রাজ্যের জলপ্রাপ্তির অন্যতম উৎস। ভারতের মরু অঞ্চলগুলিতে এই সেচখালের মাধ্যমেই চাষাবাদ হতো।

রূপায়ণ

দেশ ভাগের পরে, ব্রিটিশ সরকার দেশত্যাগ করলে সীমানা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ভারত ও পাকিস্তান সরকারের ওপর পড়ে। আগস্ট মাসে লাহোর পরিদর্শনের পরে ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আসন্ন দাঙ্গা আটকানোর জন্য শীঘ্রভাবে পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্স (পাঞ্জাব সীমানারক্ষা বল) মোতায়েন করেন। কিন্তু ৫০,০০০ লোকবল যুক্ত এই সেনাদল ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড আটকানোর জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। ৭৭% হত্যাকাণ্ডই হয়েছিল পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলগুলিতে। প্রদেশটির আয়তনানুসারে লোকবল এতই কম ছিল যে প্রতিবর্গমাইলেও একজন করে সেনা গোনা যেত না। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা ও দুর্ঘটনার শিকার হয় প্রচুর মানুষ বাস্তুহারা হয়ে দেশান্তরী হন, এই বিপুর পরিমান বিশৃঙ্খলা আটকানোর ক্ষমতা ঐ সামান্য সেনাবাহিনীর ছিল না।

ভারত এবং পাকিস্তান কেউই চুক্তি ভাঙতে রাজি ছিল। তারা নির্ধারিত সীমানার উভয়দিকের গ্রামগুলিতে আসন্ন বিদ্রোহর কথা মাথায় রেখে তা প্রশমনে তৎপর হয়, নয়তো এই বিষয়টির ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে উভয় দেশকে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে ফলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ পড়তে পারে। সীমানা বিতর্ক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে তিনবার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ হয়েছিল এবং পরবর্তী কালে ১৯৯৯ তে কার্গিল যুদ্ধও ছিল বিতর্কিত সীমানা কলহেরই ফল।

র‍্যাডক্লিফ লাইন নিয়ে বিবাদ

র‍্যাডক্লিফ লাইন নিয়ে দুইটি মুখ্য বিবাদ ছিল, বাংলার পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা। এ ছাড়া বাংলার মালদা, খুলনা এবং মুর্শিদাবাদ জেলার অংশে ও আসামের করিমগঞ্জে সামান্য বিবাদ হয়েছিল।

পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার মুসলিম প্রধান তহশিলগুলির সাথে সাথে র‍্যাডক্লিফ অমৃৃতসর জেলার মুসলিমপ্রধান অজনালা তহশিল, ফিরোজপুর জেলার মুসলিমপ্রধান জিরা ও ফিরোজপুর তহশিল, জলন্ধর জেলার মুসলিমপ্রধান জলন্ধর ও নাকোদার তহশিলকে পাকিস্তানের বদলে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

পাঞ্জাব

লাহোর

লাহোর জেলা সামগ্রিকভাবে ৬৪.৫% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও লাহোর শহরটি মোটামুটিভাবে ৮০% হিন্দু এবং শিখদের বাসভূমি ছিল। র‍্যাডক্লিফ তার মুল পরিকল্পনাতে লাহোর শহরটিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছিলেন। সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের বক্তব্য অনুসারে, “আমি লাহোর শহরকে প্রায় ভারতের মধ্যে যুক্ত করতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু দেখলাম যে পাকিস্তানে কোনো বড় শহর থাকছে না। আমি আগে থেকেই কলকাতাকে ভারতের জন্য স্থির করে রেখেছিলাম।” যখন র‍্যাডক্লিফ মহাশয়কে বলা করা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের মুসলিম সমাজ তার ভারতের প্রতি পক্ষপাতিত্বের জন্য রুষ্ট হয়েছেন তখন তিনি বলেছিলেন যে, “তাদের উচিত আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা, কারণ নিয়ম মত লাহোর শহর ভারতে যুক্ত হওয়ার কথা, পাকিস্তানে নয়।” কিন্তু এটা শুধুই এই যুক্তি ছিল,কারণ ভারতে স্বাধীনতা অধিনিয়ম এবং ভারতভাগের ভিত্তি ছিল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, যেখানে লাহোরের ৮০% জমির মালিক অমুসলিমরা হলেও মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ভূসম্পত্তির পরিমাপ দেশভাগের মাপকাঠি ছিল না।

সাইরিল র‍্যাডক্লিফ, মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহেরু
সাইরিল র‍্যাডক্লিফ, মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহেরু

ফিরোজপুর জেলা

বর্তমানে ভারতীয় ইতিহাসবিদরা এটা স্বীকার করেন যে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ফিরোজপুর জেলাকে উপহার হিসাবে ভারতকে দিয়েছিল, এই জেলার একাধিক তহশিল ছিল মুসলিমপ্রধান।

গুরুদাসপুর জেলা

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পাঞ্জাব প্রদেশের সর্বোত্তরের জেলাটি ছিল গুরুদাসপুর জেলা। জেলাটি তখন চারটি তহশিলে বিভক্ত ছিল, সেগুলি হলো যথাক্রমে— উত্তরে শঙ্করগড় তহশিল, পাঠানকোট তহশিল এবং দক্ষিণে গুরুদাসপুর তহশিল ও বাতালা তহশিল। এই চারটি তহশিলের মধ্যে ইরাবতী নদী দিকে অন্য তহশিলের থেকে বিচ্ছিন্ন শঙ্করগড় তহশিলটি পাকিস্তানকে দেওয়া হয়। তহশিলটি পশ্চিম পাঞ্জাব প্রদেশের নারোওয়াল জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গুরুদাসপুর, বাতালা ও পাঠানকোট তহশিল ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব রাজ্যের অংশীভুত হয়। মুসলিম দের পাকিস্তানে গমন এবং হিন্দু ও শিখদের ভারতে আনয়নের মাধ্যমে এই জেলাটির জনবিন্যাস তহশিলগতভাবে পরিবর্তন করে জেলাটিকে দুটি অধিরাজ্যে ভাগ করা হয়েছিল।

ঐ সময়ে গুরুদাসপুর জেলা সামগ্রিকভাবে ৫০.২% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ভারতীয় স্বাধীনতা আইনৈর রিপোর্ট অনুসারে গুরুদাসপুর জেলাকে ৫১.১৪% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে দেখানোাহয়। ১৯০১ সালের জনগণনা অনুসারে গুরুদাসপুর জেলাতে ৪৯% মুসলিম, ৪০% হিন্দু এবং ১০% শিখ জনসংখ্যা ছিল বলে জানা যায়। পাঠানকোট তহশিলটি হিন্দু প্রধান হলেও বাকী তিনটি তহশিল মুসলিম প্রধান ছিল, যদিও একমাত্র শঙ্করগড় তহশিলটিই পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা হয়।

র‍্যাডক্লিফ ব্যাখ্যা দেন যে, গুরুদাসপুর ছিল শতদ্রু খালের মুখ যা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জলের উৎস, তাই এই অঞ্চলটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাছাড়া এই খালটি শিখদের পবিত্র অমৃৃতসর নগরের নিকাশি ব্যবস্থার মূল ছিল। লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে সিদ্ধান্ত নেন যে গুরুদাসপুর জেলাটিও অমৃতসর জেলার সাথে যেকোনো একটি অধিরাজ্যে যুক্ত হওয়া উচিত। পরে শিখদের ধর্মীয় স্থানের কথা চিন্তা করে তাকে ভারতে যুক্ত করার কথা ভাবেন। তিন আরো বলেন যে,অমৃতসর থেকে পাঠানকোট অবধি রেল সংযোগটি বাতালা ও গুরুদাসপুর তহশিলের ওপর দিয়েই বিস্তৃত।

পাকিস্তানিরা মনে করেন যে, গুরুদাসপুর জেলার তিনটি তহশিলকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে দিয়েছিলেন সহজপথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে জম্মুতে পৌঁছানোর জন্য। আবার শিরীণ ইলাহি দেখান যে ভারতে অন্যান্য জায়গা থেকে সহজে কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য পাঠানকোট তহশিলই ব্যবহার করা হতো, যা শুরু থেকেই একটি হিন্দু প্রধান তহশিল ছিল। গুরুদাসপুর এবং বাতালা তহশিলকে ভারতে যুক্ত করার সাথে কাশ্মীরের কোনো যোগাযোগ নেই।

গুরুদাসপুরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তান শুরু থেকেই ভেবে আসছিল যে গুরুদাসপুর জেলাকে ভারতে দেওয়াই হয়েছিল কাশ্মীরের সাথে যোগাযোগ সহজ করার জন্য। জাতীয় তথ্যানুসারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার জন্য গুরুদাসপুর জেলা পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার জন্য সাক্ষর করে। ১৪ থেকে ১৭ই আগস্টের মধ্যে মুস্তাক আহমেদ চীমা পাকিস্তানের হয়ে গুরুদাসপুরে ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হন কিন্তু পরে এর অধিকাংশ অঞ্চলই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি সেই পদ ত্যাগ করে পাকিস্তানে ফেরত চলে যান। ভারত বিভাজন ও ভারতের স্বাধীনতা অধিনিয়ম অনুসারে যেহেতু গুরুদাসপুর জেলা ছিল একটি মুসলিম প্রধান জেলা তাই তারা ভেবেছিল নির্দিধায় এই জেলা পাকিস্তানে যুক্ত হবে। কিন্তু কাশ্মীরে ভারতের হস্তক্ষেপ বাড়াতে গুরুদাসপুরকে ভারতের সাথে যুক্ত করা হয়। এটা ধীরে ধীরে পাকিস্তানের একটি চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। জিন্নাহ এবং পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃৃৃবৃন্দ এই বিভাজনকে সরাসরি অনৈতিক এবং ভুল সিদ্ধান্ত বলে দাবী করেন।

মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান সীমানা নির্ধারণ কমিশন পেশ হওয়ার পুর্বেই মুসলিম লীগকে সতর্ক করেছিলেন যে এই আনীত কমিশনটি প্রহসন ছাড়া কিছুই না। তার মতে মাউন্টব্যাটেন ও জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি আগে থেকেই হয়ে গিয়েছিল। সীমানা কমিশনের এক অমুসলিম সদস্য মেহের চাঁদ মহাজন তার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে ভারত ভাগের সমস্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পনা লর্ড মাউন্টব্যাটেন আগে থেকেই করেছিলেন এবং তিনি সহ অন্যান্য অমুসলিম সদস্যরা ছিলেন লোক দেখানোর জন্য একটি পুত্তলিকাস্বরূপ মাত্র। শুধুই ব্রিটিশদের চাপে পড়ে শেষ মুহূর্তে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ঐ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে রেডক্লিভকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং কাশ্মীর প্রসঙ্গে সরকারীভাবে রেডক্লিভ জাতিপুঞ্জের কাছে পাকিস্তানের দাবীকে কখনো তুলে ধরতে দেননি।

জাফরুল্লাহ খান মহাশয় আরো বলেন যে, শুধু গুরুদাসপুর নয় ফিরোজপুর জেলার ফিরোজপুর ও জিরো তহশিল, জলন্ধর জেলার জলন্ধর ও রহোন তহশিল হুশিয়ারপুর জেলার দাসুয়া তহশিলগুলি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও সেগুলি পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি। এই তহশিলগুলি পাকিস্তানকে দেওয়া হলে পাঞ্জাবের কাপুরথালা জেলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তহশিলগুলিও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা যেত। আবার অমৃৃতসরের অজনালা তহশিলও ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাকিস্তানকে গুরুদাসপুর জেলার গুরুদাসপুর ও বাতালা তহশিলটি দেওয়াও যুক্তিযুক্ত ছিল। যদি সত্যিই সঠিক নিয়মে বিভাজন করা হতো তবে নির্ধারিত ১৬ টি পশ্চিম পাকিস্তানের জেলা ও গুরুদাসপুর জেলা ছাড়াও উপর্যুক্ত তহশিলগুলি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতো, যার ফলে কাংড়া জেলাটি হতো ভারতের দিকে ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত। এই সমস্ত অঞ্চলের একটি বৃৃহত্তর অঞ্চল পাকিস্তানে দিলে পাকিস্তান লাভবান হতে পারতো এবং এক্ষত্রে তহশিলগুলি দেশভাগের গুরুত্বপূর্ণ একক হিসাবে কাজ করতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত শঙ্করগড় তহশিল বাদে কোনো মুসলিমপ্রধান তহশিলই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না করে ভারতে দিয়ে দেওয়া হয় উপরন্তু পাকিস্তান এর বদলে পাঞ্জাবের কোনো অমুসলিম প্রধান তহশিল পায় না। তার মতে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাঞ্জাবকে জেলা, তহশিল,থানা এমনকি গ্রাম হিসাবে ভাগ করেও ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন, যা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে খুবই অনিষ্টকর।

জাফরুল্লাহ খানের মতে, গুরুদাসপুর জেলার সদর ও বাতালা তহশিল যে কাশ্মীরকে সুগম্য করার ফন্দি নয় তা মেনে নেওয়াটা খুবই কষ্টসাধ্য। যদি গুরুদাসপুর ও বাতালা তহশিল পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হতো তবে পাঠানকোট তহশিলটি পাঞ্জাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো এবং পাকিস্তান বেষ্টিত হয়ে যেতো। যদিও হুশিয়ারপুরের মাধ্যমে পাঠানকোটে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হতো কিন্তু রেল, সতু ও সড়ক নির্মানে সময় লাগতো অনেক কারণ সৈন্যবলের জন্য এই স্থানটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

র‍্যাডক্লিফ লাইন এবং কাশ্মীর বিতর্ক

স্ট্যানলি ওয়লপার্ট তার একটি বইতে লিখেছিলেন য প্রাথমিক ভাবে র‍্যাডক্লিফ গুরুদাসপুর জেলার তিনটি তহশিল ভারতকে উপহার হিসাবে তুলে দেন কিন্তু নেহেরু এবং তার শ্রদ্ধাভাজন লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিশ্চিত করেন যেন এই জেলাটিকে কোনোভাবেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না করে দেওয়া হয় কারণ এটা ছিল পাঞ্জাব থেকে কাশ্মীরের যাবার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ। ইসলামিক বিভিন্ন মতবাদের ওপর ভিত্তি করে ইউনেস্কোর একটি সদস্যদল অতিসম্প্রতিকালে ব্রিটিশ শাসনকিলের জটিলতা, ভারত বিভাজনের আইন এবং কাশ্মীরকে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে নিতে ভারত এবং ভারতের উচ্চদলগুলির অবদান সম্পর্কে একটি নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ উন্মোচন করেন। তাদের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন জাতীয় কংগ্রেসের জওহরলাল নেহেরুর সাথে হাত মিলিয়ে রেডক্লিভকে বাধ্য করেন যেন তিন ভারতকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গুরুদাসপুর জেলা ও অন্যান্য তহশিলগুলি উপহার দেন। এর ফলে কাশ্মীরের দখল নিতেও ভারতকে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। ঐতিহাসিক অ্যান্ড্রিউ রবার্টস বিশ্বাস করেন যে, মাউন্টব্যাটেন ভারত পাকিস্তান সীমানাচুক্তি লঙ্ঘন করেছিলেন এবং ফিরোজপুর জেলার বহু নথিপত্র জাল করা হয়েছিল এবং গুরুদাসপুরের ক্ষেত্রে তিনিই যে কাশ্মীরকে ভারতে রাখার জন্য রেডক্লিভ বাধ্য করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

পেরি অ্যান্ডারসনের মতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন সরকারীভাবে কোনোরকম পরীক্ষা বা সমীক্ষা এবং কোনো ভবিষ্যত বিবেচনা করেননি এবং তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করে নেহেরুর পরিকল্পিত পথে চলেছিলেন এবং তার শ্রমলাঘব করার জন্য তিনি তাকে উপহারস্বরূপ উক্ত তহশিলগুলি দেন। তিনিই রেডক্লিভের ওপর গুরুদাসপুর জেলা বিষয়ে অনধিকার চর্চা করেন ফলে ভারত দিল্লি থেকে কাশ্মীর অবধি বিনা বাধায় সড়ক যোগাযোগের পথ পেয়ে যায়।

আবার কিছু কিছু ঐতিহাসিকদের মতে কাশ্মীর ছিল একটি করদ রাজতান্ত্রিক রাজ্য, কারো সম্পত্তি নয়, ফলে কাশ্মীরের সাথে দিল্লির যোগসাধনের জন্য গুরুদাসপুরের ভারতভুক্তির কথা মেনে নেওয়া যায় না। পাকিস্তানের নেতা তথা মুসলিম লীগই এই গুরুদাসপুর জেলার গুরুত্ব না বুঝতে পেরে শুরু শঙ্করগড় তহশিল নিয়েই খুশি ছিল। যতক্ষন না ভারতীয় সৈন্য কাশ্মীরে প্রবেশ করে ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তান এই জেলার গুরুত্ব বুঝতে অপারক ছিল। র‍্যাডক্লিফ এবং মাউন্টব্যাটেন উভয়ই এইধরনের দোষারোপকে অস্বীকার করন। মাউন্টব্যাটেনের খসড়াসম্বন্ধীয় বিষয়ে ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগার ও সংগ্রহালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কাশ্মীরের ভারতে যুক্ত হওয়াকে ঐ অঞ্চলের মুসলিমদের জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়।

র‍্যাডক্লিফ লাইন ও বাংলা

পার্বত্য চট্টগ্রাম

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি অতি অমুসলিমপ্রবণ অঞ্চল যার ৯৭% ই ছিল অমুসলিম এবং তাদের মধ্যে একটি সিংহভাগ মানুষই ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাসত্ত্বেও এটিকে পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট পিপলস’ এসোসিয়েশন বাংলায় সীমানা নির্ধারণকারী কমিশনের কাছে আবেদন করেন যে, যেহেতু এই অঞ্চলটি অতি অমুসলিমপ্রবণ তাই তারা ভারতেই থাকতে চায়। যেহেতু তাদের কোনো সরকারী প্রতিনিধিত্ব ছিল না তাই সরকারীভাবে এই বিষয় নিয়ে সেরকম কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি। এবং ভারতের অনেকে ভেবেছিলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ত ভারতকেই দেওয়া হবে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট তারিখ অবধি তারা জানতো না যে তারা কোন দেশের অংশ হবে। ১৭ই আগস্টের র‌্যাডক্লিফের সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ফল হিসাবে দেখা যায় এটিকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানকে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেওয়ার যুক্তি হিসাবে দেখানো হয় যে, তারা ভারতে অনধিগম্য এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও শহরাঞ্চলকে গ্রামাঞ্চলিক সাহায্য ও কর্ণফুলী নদীর নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জরুরি। ফলে প্রায় জোর করেই এই অঞ্চলকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়।

দুদিন পরে, তারা পাকিস্তানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ও ভারতের পতাকা উত্তোলন করে। পাকিস্তানি সৈন্যদল বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনায় বসে এবং অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তারা পাকিস্তানের অপসারণ দাবী করে।

মালদহ জেলা

র‌্যাডক্লিফের দ্বারা নেওয়া আরেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি ছিল বাংলার মালদহ জেলাকে ঘিরে। জেলাটি সার্বিকভাবে সামান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট ছিল কিন্তু জেলাটি বিভাজন কালে অধিকাংশ অঞ্চলই ভারতকে দেওয়া হয়। তার মধ্যে ছিল মুসলিমপ্রধান চাঁচল মহকুমা এবং সদরশহর মালদা। ১৫ই আগস্টের পরাপ্রায় তিন-চার দিন অবধি এখানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল কিন্তু পরে পরিকল্পনা জনসমক্ষে এলে স্থানীয়রাই মালদায় পাকিস্তানের বদলে ভারতীয় পতাকার স্থান দেন।

খুলনা ও মুর্শিদাবাদ জেলা

পূর্বতন অবিভক্ত খুলনা জেলা ছিল সামান্য হিন্দু প্রধান জেলা (৫২%), যার খুলনা মহকুমা বাদে বাকী মহকুমাদুটি মুসলিমপ্রধান ছিল। তাসত্ত্বেও জেলাটিকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবং এর ফলস্বরূপ ৭০% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট মুর্শিদাবাদ জেলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৭ই আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা ভারতের পতাকা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার আগে অবধি মুর্শিদাবাদে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দরুন পাকিস্তানের পতাকাই উত্তোলিত হয়েছিল। মুর্শিদাবাদকে ভারতে যুক্ত করে হিন্দুপ্রধান খুলনাকে পাকিস্তানে দেওয়া ছিল একটি শর্তমাত্র। কারণ কলকাতা বন্দর যে হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত তা এই মুর্শিদাবাদেই গঙ্গা থেকে পৃথক হয়েছে, ফলে মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে থাকলে রাজধানী শহর কলকাতা ও কলকাতা বন্দর সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তো।

আসামের করিমগঞ্জ জেলা

সিলেট গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা আসাম থেকে পাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু সিলেটেরই করিমগঞ্জ মহকুমাটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি জেলার মর্যাদা পায়। মনে করা হয় ত্রিপুরার সাথে ভারতের মুল ভুখণ্ডের যোগাযোগ বৃৃদ্ধি ও সহজ পথে আসাম থেকে ত্রিপুরাতে আসা-যাওয়ার সিলেট থেকে করিমগঞ্জ মহকুমাটি সাড়ে তিনটি থানসহ পৃথক করা হয়েছিল। ২০০১ সালে জনগণনা অনুসারে করিমগঞ্জ জেলার ৫২.৩% জনগণ ধর্মে মুসলিম।

অন্যান্য জেলা

  • কোচবিহার জেলার থেকে দেবীগঞ্জ অঞ্চল এবং জলপাইগুড়ি জেলা থেকে পঞ্চগড় অঞ্চল পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ তথা রায়গঞ্জ মহকুমা, বালুরঘাট মহকুমা ও গঙ্গারামপুর মহকুমা পশ্চিম দিনাজপুর জেলা নামে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • অবিভক্ত নদিয়া জেলার পূর্ব দিকের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহরপুর মহকুমা পূর্ব পাকিস্তানে এবং বাকী কৃষ্ণনগর সদর মহকুমা ও রানাঘাট মহকুমা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • যশোর জেলা থেকে বনগাঁ অঞ্চল ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

উত্তরাধিকার

উত্তরাধিকার ও ইতিহাস রচনা

ভারতের বিভাজন হলো ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মুল কেন্দ্রীয় ঘটনাগুলির একটি এবং একটি যুক্ত ইতিহাসর স্মৃৃতি। এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হাওয়ার্ড ব্রেন্টন ড্রয়িং দ্য লাইন নাটকটি রচনা করেছিলেন। তিনি রেডক্লিভের ভারত ভ্রমণকালে সীমা নির্ধারণ রেখা তৈরী এবং বাঁচার তাগিদে দেশান্তরী হওয়া ও শতকষ্টে থাকা এই মানুষদের জীবনকাহিনী নিয়ে কিঞ্চিত উৎসাহিত হয়েছিলেন, যা তার নাটকে ফুটে উঠেছে।

শৈল্পিক চিত্রাঙ্কন

দেশভাগের চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসাবে রেডক্লিভ লাইনের প্রস্তাব, তার বাস্তবায়ন এবং তার দীর্ঘমেয়াদী ফলস্রুতি বিভিন্ন লেখকদের অনুপ্রাণিত করে। অনেকে এবিষয়ে কখনো বই বা কখনো নাটক উপস্থাপন করেন, অনেকে এই ঘটনার শৈল্পিক চিত্রায়ন করে দর্শকদের সামনে তুলে ধরছিলেন। এই বিষয়ে স্মৃৃতি রক্ষা করে গল্প বা নাটকের পুণর্মূল্যায়ন করে উপস্থাপন করা ব্যক্তিত্বে সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা।

ড্রয়িং দ্য লাইন নাটকটিতে লেখক রেডক্লিভকে একটিাগূরুত্বপূর্ণ আসনে বসিয়েছিলেন। একটি জনসভাতে তিনি বলেছিলেন যে, রেডক্লিভকে ঐসময়ে খুব সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, “তিনি আয়হীনভাবে মানচিত্র এবং সমস্ত নথিপত্র তার ইংল্যিন্ডের বাড়িতে নষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি তার সাথে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই পরিবারের সদস্যদের জানাতে চান নি। আমি এই তথ্যগুলি ঘাটার সময়ে এগুলিই আমাকে এই নাটক লেখার জন্য ধাবিয়ে তোলে”।

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা রাম মাধবানী একটি নয় মিনিটের ছোটো চলচ্চিত্র তৈরী করেন যেখানে তিনি রেডক্লিভের তার সীমা নির্ণয়কিলীন একটি বিশ্বাসযোগ্য চিত্রপট তুলে ধরেন। চলচ্চিত্রটি দেশবিভাগ সম্বন্ধীয় ডব্লিউ. এইচ. অড্যান এর একটি কবিতার ওপর ভিত্তি করে তৈরী।

আরও পড়ুন