০৬:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
                       

পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতির সংজ্ঞা ও এদের মধ্যে পার্থক্য কী? বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কী ছিল?

মো. আসাদুল আমীন
  • প্রকাশ: ১২:১৬:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৮ অগাস্ট ২০২২
  • / ৬৯৫৪ বার পড়া হয়েছে

পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি দুটো কাছাকাছি বিষয় এবং একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত। পররাষ্ট্রনীতি থেকে আসে কূটনীতি বিষয়টি, আর কূটনীতি কে বলা হয় পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার।

পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি কাছাকাছি বিষয় অনেকটা, তবে এক নয়। আমরা অনেকে কখনো কখনো পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি কে একত্র করে ফেলি, আসলে বিষয়টি তেমন নয়। একটি দেশের জন্য পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি এই দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর বিকল্প নেই। সব দেশই তার নিজস্ব স্বার্থরক্ষা বা দেশের বা দেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করে থাকে। আর এক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি কোনো একটি দেশকে বর্হিবিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তা ধরে রেখে পথ চলতে হয়, বিভিন্ন বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট এর বিষয় থাকে, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষায় সম্পর্ক বজায় রেখে চলা এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। আর এসবের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি খুবই দরকারি দুটি টার্ম। 

এবার আলাদা আলাদা ভাবে বিষয় দুটি বুঝতে চেষ্টা করা যাক—

পররাষ্ট্রনীতি আসলে কী?

এককথায় বলতে গেলে, কোনো দেশের নিজস্ব স্বার্থরক্ষার জন্য অন্যান্য দেশের সাথে যে নীতি বা সম্পর্ক স্থাপন করা হয়ে থাকে তা পররাষ্ট্রনীতি।

কোনো দেশের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য অভ্যন্তরীন বিভিন্ন নীতির পাশাপাশি যে নীতিগুলো বহিঃরাষ্ট্র সম্পর্কিত গ্রহন করা হয়ে থাকে তাকে পররাষ্ট্রনীতি বলে।

অর্থাৎ আমার দেশের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে আমি যে ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখবো সে বিষয়ে গ্রহন করা নীতি। একেকটা দেশের পররাষ্ট্রনীতি একেকরকম হয়ে থাকে আর এক্ষেত্রে ঐ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন, অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র এবং দরিদ্র দেশের পররাষ্ট্রনীতি কখনো আমেরিকার মতো হতে পারে না। কারণ আমাদের এখনো বৈদেশিক বিভিন্ন সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়, আমাদের অর্থনীতি ততটা শক্তিশালী নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি হলো— ‘সবার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, কারও সাথে শত্রুতা নয়’।

আমাদের সব দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এটাই স্বাভাবিক। আবার আমাদের উপর যদি বহিঃশত্রুর আক্রমণ আসে সেক্ষেত্রে আমরা অনেকটা দুর্বল দেশ, অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকেও ততটা অগ্রগামী নয। এজন্য এসব বিষয় বিবেচনা করে আমাদের নীতি সবার সাথে সম্পর্ক রেখে কিভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করা যায়, কিভাবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়। আর অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমনঃ জিএসপি। অর্থাৎ, এককথায় কিভাবে আমরা অন্য দেশ থেকে সহযোগিতা পেয়ে এগিয়ে যেতে পারি। দেশের অভ্যন্তরীন কোনো বিষয়ের উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে আমাদের সে বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা বা নীতি গ্রহন করতে হয় যাকে অভ্যন্তরীন নীতি বলা যায়। যেমনঃ কৃষির উন্নয়ন করতে চাই, আর এক্ষেত্রে কৃষির আধুনিকায়ন, কৃষি খাতে ভর্তুকি, কৃষি উৎপাদনের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী সহজলভ্য বা উৎপাদন খরচ কম হয় এদিকে নজর দিতে হবে। আর কোনো বিষয়ে যখন আন্তর্জাতিক ভাবে কিছু ব্যবস্থা বা নীতি গ্রহন করতে হয় তা পররাষ্ট্রনীতি যা অপর একটি রাষ্ট্রের সাথে হয়ে থাকে।

কূটনীতি বলতে কী বোঝায়?

কূটনীতি বিষয়টি আসে পররাষ্ট্রনীতি থেকেই। কোনো একটা দেশের সাথে কোনো বিষয়ে সম্পর্ক স্থাপন করা হলো। আর এ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে বা ধরে রাখতে যে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয় তা হলো কূটনীতি। কূটনীতি হচ্ছে কোনো রাষ্ট্র পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত সরকারি (কিছু বিষয়ে বেসরকারিভাবে সম্পন্ন) কার্যক্রম। অর্থাৎ কূটনীতি হচ্ছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোনো রাষ্ট্রের প্রতিনিধি দ্বারা অন্য কোনো রাষ্ট্রে পরিচালিত কার্যক্রম। কূটনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Diplomacy’ যার উদ্ভব ঘটেছে প্রাচীনকালে। প্রাচীন গ্রীসে যখন একটি রাষ্ট্র হতে অন্য কোনো রাষ্ট্রে কোনো প্রতিনিধি যেত তখন তিনি তার পরিচয় খোদাই করা একটা কাঠের টুকরো গ্রাহক রাষ্ট্রের প্রধানের কাছে হস্তান্তর করতেন। কাঠের খন্ডটিকে বলা হতো ”Diplom’ আর এখান থেকে ‘Diplomacy’ শব্দটি এসেছে। 

কূটনীতির ক্ষেত্রে নিয়োগ করা হয় বিভিন্ন কূটনীতিক। আর এই কূটনীতিকরা কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে থাকেন, কোনো দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে যেন আক্রমণ না হয় এমনটি নিশ্চিত করেন। অর্থাৎ সম্পর্ক এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যে আক্রমণ হবে না। অনেক সময় আমরা শুনে থাকি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে কোনো দেশ আর তখন বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয় দুই দেশের মধ্যে। কূটনৈতিক মহল সবসময় চেষ্টা করে সম্পর্ক বজায় থাকুক, আক্রমণ না হোক। কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি হতে পারে – বন্ধুত্বপূর্ণ বা আক্রমানাত্মক বা ডিফেন্সিভ। আর সম্পর্ক যেমনটি হোক তা বাস্তবায়নের জন্য ই কূটনীতি। অর্থাৎ, কূটনীতি কে বলা যায় পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার। আর পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য ই বিভিন্ন দেশ অন্যান্য দেশে রাষ্ট্রদূত বা এম্বাসেডর হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়োগ করে থাকেন যারা কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য বা কোনো একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কাজ করে থাকে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কী

‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়’।

বাংলাদেশ একটি দরিদ্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভিন্ন দেশের তুলনায় দুর্বল বা আকার ছোট। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। যার কারণে বাংলাদেশকে বিভিন্ন মতাদর্শী দ্বারা প্রভাবিত হতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “আমাদের একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, আমরা চাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব”।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে রয়েছে। এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি ৪ টি।

  1. সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়। 
  2. অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।
  3. অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা।
  4. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্রনীতি

  • মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়। 
  • মুক্তিযুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য লাভ করা। এজন্য বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী কে বৈদেশিক মুখপাত্র নিয়োগ করা হয়েছিল।

ফলাফল: চীন ও আমেরিকা ব্যতিত অন্য তিন সুপার পাওয়ার রাষ্ট্র সমর্থন দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত মুক্তিযুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য করে। 

শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীত

  • বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি অর্জন করা। 
  • যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুর্নগঠনে অর্থনৈতিক সাহায্য লাভ করা। 

ফলাফল: চীন ব্যতিত অন্য সব সুপার পাওয়ার স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় সদস্যপদ লাভ করে— জাতিসংঘ, ওআইসি, ন্যাম ইত্যাদি। 

জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি

  • বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
  • ১৯৭৯ সালে NPT (Non-proliferation of Nuclear Weapons Treaty) তে স্বাক্ষর। অর্থাৎ পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ পরমাণু শক্তি বাড়াতে পারবে না।
  • বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
  • সার্ক (SAARC) গঠনের জন্য ৭ টি দেশকে চিঠি দেয়া হয়। যার ফলে সার্ক গঠন করা হয়।

এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি

  • ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সভাপতি নির্বাচিত।
  • ১৯৮৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি শুরু করতে পারে।
  • ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী তে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বা যোগদান। 

খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি

  • ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিক কূটনীতির সূত্রপাত ঘটে। তিনটি বিষয় জড়িত অর্থনৈতিক কূটনীতি তে – বৈদেশিক বিনিয়োগে আর্কষণ করা, আন্তর্জাতিক বাজার সংস্কার করা, এবং জনশক্তি রপ্তানি।
  • ১৯৯২ সালে তিনবিঘা করিডর ভারতকে হস্তান্তর।
  • SAPTA (South Asian Free Trade Area) গঠন।

শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি

  • ১৯৯৬ সালে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষর।
  • ভারতের সাথে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময়।
  • ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি।
  • ভারত-চীন-রাশিয়া-জাপানসহ বিভিন্ন দেশের সহায়তায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন।
  • মিয়ানমার ও ভারতের থেকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা উদ্ধার।
  • যুক্তরাষ্ট্রের সাথে TICFA (Trade and Investment Cooperation Forum Agreement) চুক্তি স্বাক্ষর। 

উপসংহার

পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি দুটো কাছাকাছি বিষয় এবং একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত। পররাষ্ট্রনীতি থেকে আসে কূটনীতি বিষয়টি, আর কূটনীতি কে বলা হয় পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারের আমলে প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন ধরনের পররাষ্ট্রনীতি গ্রহন করা হয়েছে। তবে পররাষ্ট্রনীতির কিছু মূলনীতি রয়েছে যা সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে রয়েছে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মো. আসাদুল আমীন

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতির সংজ্ঞা ও এদের মধ্যে পার্থক্য কী? বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কী ছিল?

প্রকাশ: ১২:১৬:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৮ অগাস্ট ২০২২

পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি কাছাকাছি বিষয় অনেকটা, তবে এক নয়। আমরা অনেকে কখনো কখনো পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি কে একত্র করে ফেলি, আসলে বিষয়টি তেমন নয়। একটি দেশের জন্য পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি এই দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর বিকল্প নেই। সব দেশই তার নিজস্ব স্বার্থরক্ষা বা দেশের বা দেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করে থাকে। আর এক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি কোনো একটি দেশকে বর্হিবিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তা ধরে রেখে পথ চলতে হয়, বিভিন্ন বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট এর বিষয় থাকে, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষায় সম্পর্ক বজায় রেখে চলা এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। আর এসবের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি খুবই দরকারি দুটি টার্ম। 

এবার আলাদা আলাদা ভাবে বিষয় দুটি বুঝতে চেষ্টা করা যাক—

পররাষ্ট্রনীতি আসলে কী?

এককথায় বলতে গেলে, কোনো দেশের নিজস্ব স্বার্থরক্ষার জন্য অন্যান্য দেশের সাথে যে নীতি বা সম্পর্ক স্থাপন করা হয়ে থাকে তা পররাষ্ট্রনীতি।

কোনো দেশের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য অভ্যন্তরীন বিভিন্ন নীতির পাশাপাশি যে নীতিগুলো বহিঃরাষ্ট্র সম্পর্কিত গ্রহন করা হয়ে থাকে তাকে পররাষ্ট্রনীতি বলে।

অর্থাৎ আমার দেশের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে আমি যে ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখবো সে বিষয়ে গ্রহন করা নীতি। একেকটা দেশের পররাষ্ট্রনীতি একেকরকম হয়ে থাকে আর এক্ষেত্রে ঐ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন, অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র এবং দরিদ্র দেশের পররাষ্ট্রনীতি কখনো আমেরিকার মতো হতে পারে না। কারণ আমাদের এখনো বৈদেশিক বিভিন্ন সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়, আমাদের অর্থনীতি ততটা শক্তিশালী নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি হলো— ‘সবার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, কারও সাথে শত্রুতা নয়’।

আমাদের সব দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এটাই স্বাভাবিক। আবার আমাদের উপর যদি বহিঃশত্রুর আক্রমণ আসে সেক্ষেত্রে আমরা অনেকটা দুর্বল দেশ, অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকেও ততটা অগ্রগামী নয। এজন্য এসব বিষয় বিবেচনা করে আমাদের নীতি সবার সাথে সম্পর্ক রেখে কিভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করা যায়, কিভাবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়। আর অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমনঃ জিএসপি। অর্থাৎ, এককথায় কিভাবে আমরা অন্য দেশ থেকে সহযোগিতা পেয়ে এগিয়ে যেতে পারি। দেশের অভ্যন্তরীন কোনো বিষয়ের উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে আমাদের সে বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা বা নীতি গ্রহন করতে হয় যাকে অভ্যন্তরীন নীতি বলা যায়। যেমনঃ কৃষির উন্নয়ন করতে চাই, আর এক্ষেত্রে কৃষির আধুনিকায়ন, কৃষি খাতে ভর্তুকি, কৃষি উৎপাদনের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী সহজলভ্য বা উৎপাদন খরচ কম হয় এদিকে নজর দিতে হবে। আর কোনো বিষয়ে যখন আন্তর্জাতিক ভাবে কিছু ব্যবস্থা বা নীতি গ্রহন করতে হয় তা পররাষ্ট্রনীতি যা অপর একটি রাষ্ট্রের সাথে হয়ে থাকে।

কূটনীতি বলতে কী বোঝায়?

কূটনীতি বিষয়টি আসে পররাষ্ট্রনীতি থেকেই। কোনো একটা দেশের সাথে কোনো বিষয়ে সম্পর্ক স্থাপন করা হলো। আর এ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে বা ধরে রাখতে যে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয় তা হলো কূটনীতি। কূটনীতি হচ্ছে কোনো রাষ্ট্র পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত সরকারি (কিছু বিষয়ে বেসরকারিভাবে সম্পন্ন) কার্যক্রম। অর্থাৎ কূটনীতি হচ্ছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোনো রাষ্ট্রের প্রতিনিধি দ্বারা অন্য কোনো রাষ্ট্রে পরিচালিত কার্যক্রম। কূটনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Diplomacy’ যার উদ্ভব ঘটেছে প্রাচীনকালে। প্রাচীন গ্রীসে যখন একটি রাষ্ট্র হতে অন্য কোনো রাষ্ট্রে কোনো প্রতিনিধি যেত তখন তিনি তার পরিচয় খোদাই করা একটা কাঠের টুকরো গ্রাহক রাষ্ট্রের প্রধানের কাছে হস্তান্তর করতেন। কাঠের খন্ডটিকে বলা হতো ”Diplom’ আর এখান থেকে ‘Diplomacy’ শব্দটি এসেছে। 

কূটনীতির ক্ষেত্রে নিয়োগ করা হয় বিভিন্ন কূটনীতিক। আর এই কূটনীতিকরা কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে থাকেন, কোনো দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে যেন আক্রমণ না হয় এমনটি নিশ্চিত করেন। অর্থাৎ সম্পর্ক এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যে আক্রমণ হবে না। অনেক সময় আমরা শুনে থাকি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে কোনো দেশ আর তখন বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয় দুই দেশের মধ্যে। কূটনৈতিক মহল সবসময় চেষ্টা করে সম্পর্ক বজায় থাকুক, আক্রমণ না হোক। কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি হতে পারে – বন্ধুত্বপূর্ণ বা আক্রমানাত্মক বা ডিফেন্সিভ। আর সম্পর্ক যেমনটি হোক তা বাস্তবায়নের জন্য ই কূটনীতি। অর্থাৎ, কূটনীতি কে বলা যায় পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার। আর পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য ই বিভিন্ন দেশ অন্যান্য দেশে রাষ্ট্রদূত বা এম্বাসেডর হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়োগ করে থাকেন যারা কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য বা কোনো একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কাজ করে থাকে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কী

‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়’।

বাংলাদেশ একটি দরিদ্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভিন্ন দেশের তুলনায় দুর্বল বা আকার ছোট। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। যার কারণে বাংলাদেশকে বিভিন্ন মতাদর্শী দ্বারা প্রভাবিত হতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “আমাদের একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, আমরা চাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব”।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে রয়েছে। এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি ৪ টি।

  1. সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়। 
  2. অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।
  3. অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা।
  4. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্রনীতি

  • মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়। 
  • মুক্তিযুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য লাভ করা। এজন্য বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী কে বৈদেশিক মুখপাত্র নিয়োগ করা হয়েছিল।

ফলাফল: চীন ও আমেরিকা ব্যতিত অন্য তিন সুপার পাওয়ার রাষ্ট্র সমর্থন দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত মুক্তিযুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য করে। 

শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীত

  • বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি অর্জন করা। 
  • যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুর্নগঠনে অর্থনৈতিক সাহায্য লাভ করা। 

ফলাফল: চীন ব্যতিত অন্য সব সুপার পাওয়ার স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় সদস্যপদ লাভ করে— জাতিসংঘ, ওআইসি, ন্যাম ইত্যাদি। 

জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি

  • বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
  • ১৯৭৯ সালে NPT (Non-proliferation of Nuclear Weapons Treaty) তে স্বাক্ষর। অর্থাৎ পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ পরমাণু শক্তি বাড়াতে পারবে না।
  • বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
  • সার্ক (SAARC) গঠনের জন্য ৭ টি দেশকে চিঠি দেয়া হয়। যার ফলে সার্ক গঠন করা হয়।

এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি

  • ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সভাপতি নির্বাচিত।
  • ১৯৮৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি শুরু করতে পারে।
  • ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী তে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বা যোগদান। 

খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি

  • ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিক কূটনীতির সূত্রপাত ঘটে। তিনটি বিষয় জড়িত অর্থনৈতিক কূটনীতি তে – বৈদেশিক বিনিয়োগে আর্কষণ করা, আন্তর্জাতিক বাজার সংস্কার করা, এবং জনশক্তি রপ্তানি।
  • ১৯৯২ সালে তিনবিঘা করিডর ভারতকে হস্তান্তর।
  • SAPTA (South Asian Free Trade Area) গঠন।

শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি

  • ১৯৯৬ সালে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষর।
  • ভারতের সাথে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময়।
  • ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি।
  • ভারত-চীন-রাশিয়া-জাপানসহ বিভিন্ন দেশের সহায়তায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন।
  • মিয়ানমার ও ভারতের থেকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা উদ্ধার।
  • যুক্তরাষ্ট্রের সাথে TICFA (Trade and Investment Cooperation Forum Agreement) চুক্তি স্বাক্ষর। 

উপসংহার

পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি দুটো কাছাকাছি বিষয় এবং একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত। পররাষ্ট্রনীতি থেকে আসে কূটনীতি বিষয়টি, আর কূটনীতি কে বলা হয় পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারের আমলে প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন ধরনের পররাষ্ট্রনীতি গ্রহন করা হয়েছে। তবে পররাষ্ট্রনীতির কিছু মূলনীতি রয়েছে যা সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে রয়েছে।