০৩:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আহারে কিংবা অনাহারে বিভিন্নভাবে গ্লুকোজ ফিরে আসে কোষীয় জ্বালানী হয়ে

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক
  • প্রকাশ: ০৮:২৯:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২
  • / ১১১৬ বার পড়া হয়েছে

দেহে গ্লুকোজের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে আলফা ও বিটা কোষ উভয়ই অংশীদার

পৃথিবীর সকল জীবের একটি প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে অ-ধাতব মৌল কার্বন বা অঙ্গার। এই কার্বন-ভিত্তিক জীবনের আরো প্রধান তিনটি এলিমেন্ট রয়েছে:  হাইড্রোজেন  (১০%), অক্সিজেন (৬৩%), নাইট্রোজেন (৪%), অর্থাৎ CHON। এছাড়াও, জীবদেহে রয়েছে ফসফোরাস ও সালফার। ভরের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ভূত্বকে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও অক্সিজেন এর পরের স্থানেই রয়েছে কার্বন। বায়ুমণ্ডলে, কার্বন থাকে সাধারণত: কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) বা আঙ্গারিক গ্যাস ও মিথেন (CH4) আকারে। পার্থিব এবং মহাসাগরীয় সালোকসংশ্লেষী জীব আঙ্গারিক গ্যাস  গ্রহণ করে। সমুদ্রে আঙ্গারিক গ্যাস দ্রবীভূত থাকে কার্বনিক অ্যাসিড বা অঙ্গারাম্ল গঠন করে। বায়ুমণ্ডলের তুলনায় মহাসাগর প্রায় ৫০ গুণ বেশি চক্রাকারে কার্বন সঞ্চয় করে, সে কারণে সমুদ্রকে বলা হয় কার্বনের বৃহত্তম সঞ্চয়ভাণ্ডার।  জীবননির্মাণে কার্বনকে বেছে নেয়ার পেছনে সম্ভবত: মূল কারণ ছিল যে একটি কার্বন পরমাণু একসাথে চারটি সমযোজী রাসায়নিক বন্ধন গঠন করতে সক্ষম। এই গুণটি কার্বনকে প্রোটিন, শর্করা, লিপিড এবং ডিএনএর মতো অণুগুলির দীর্ঘ শৃঙ্খল তৈরি করার জন্য উপযুক্ত করে তোলে যা জীবনের ভিত্তি হিসেবে  কাজ করে। কার্বন এখন পর্যন্ত বর্ণিত প্রায় এক কোটি যৌগ গঠন করতে সক্ষম। যেহেতু এটি হালকা ওজনের এবং আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট, তাই কার্বন অণুগুলির অনুঘটন করা এনজাইমের পক্ষে যথেষ্টই সহজ হয়ে যায়। কার্বননির্ভর অণুগুলি সৃষ্টির বড় একটি কারণ ছিল সেখান থেকে শক্তি উৎপাদন করা। কার্বন অণু ভেঙ্গে, শক্তি নির্গত হয় যা বিভিন্ন কোষীয় প্রক্রিয়া চালাতে অপরিহার্য। এটা অনস্বীকার্য, কার্বন-ভিত্তিক জীবনও বাঁচত না যদি জীবগুলি সরাসরি হাইড্রোকার্বন হিসেবে  শক্তি সঞ্চয় করত, কারণ অ্যালকেনগুলি নিজেরাই বেশ দাহ্য (পেট্রোল ও কেরোসিন), কিন্তু কার্বন-ভিত্তিক জীবগুলি যদি শর্করা, লিপিড, অ্যালকোহল এবং অন্যান্য হাইড্রোকার্বন হিসেবে  শক্তি সঞ্চয় করে তাহলে সেই জটিলতা অতিক্রম করা সহজ হয়ে যায়। প্রকৃতিতে সেটাই হয়েছে- সৌরশক্তি দ্বারা সালোকসংশ্লেষনের মাধ্যমে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া ও উদ্ভিদজগত আঙ্গারিক গ্যাস ও পানি থেকে শর্করা উৎপন্ন করে, মুক্ত করে অক্সিজেনকে। প্রাণীজগত এই ব্যাপারটিতে পিছিয়ে পড়লো। যেহেতু প্রাণিকোষে ক্লোরোপ্লাস্ট জাতীয় অঙ্গাণু থাকে না, তাই এই  হেটেরোট্রফদের (heterotroph: যারা নিজের খাদ্য তৈরি করতে পারে না) জৈব কার্বনের অন্যান্য উৎস থেকে পুষ্টি গ্রহণ করতে হয়, প্রধানত উদ্ভিদ পদার্থ। বিপরীতে, প্রাণিকুল দেয় তাদের নিঃশ্বসিত আঙ্গারিক গ্যাস।     

অন্ত্র থেকে রক্তপ্রবাহে গ্লুকোজের পরিবহন

গ্লুকোজ একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্বোহাইড্রেট, রাসায়নিক শ্রেণিবিভাগে একশর্করা বা মনোস্যাকারাইড গ্ৰুপে অন্তর্ভুক্ত। গ্লুকোজকে অ্যালডোহেক্সোজ-ও বলা হয়। অ্যালডোহেক্সোজ চিনির দুইটি স্টেরিও সমাণু গ্লুকোজ রয়েছে: L-গ্লুকোজ ও D-গ্লুকোজ। জীবকোষের বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র D-গ্লুকোজ জৈবিকভাবে সক্রিয়। দ্রবণে গ্লুকোজ অণু খোলা শিকল আকারেও থাকতে পারে বা বলয়াকারে। কঠিন অবস্থায় গ্লুকোজ বলয়াকার আকার ধারণ করে। কারণ, বলয়ের গঠনটি পাঁচটি কার্বন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু ধারণ করে। এই গঠনে প্রত্যেক কার্বন পরমাণু একটি করে হাইড্রক্সিল গ্ৰুপের সাথে যুক্ত থাকে। পঞ্চম পরমাণুটি ষষ্ঠ পরমাণুর সাথে যুক্ত থাকে এবং -CH2OH গ্ৰুপ গঠন করে। পানিতে গ্লুকোজের দ্রাব্যতা খুব বেশি। খাদ্যের অধিকাংশ জটিল কার্বহাইড্রেট লালারসে এবং ক্ষুদ্রান্তে অগ্ন্যাশয় ও অন্ত্র (এন্টেরোসাইট) থেকে নিঃসৃত গ্লাইকোসিডেজ (glycosidases) বা গ্লাইকোসাইড হাইড্রোলেজ (যেমন অ্যামাইলেজ, ম্যাল্টেজ, ল্যাকটেজ, সুক্রেজ) এনজাইমগুলির মাধ্যমে ভেঙে সরল গ্লুকোজ ও অন্যান্য একশর্করা (গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, গ্যালাকটোজ) অণুতে পরিণত হয়। তবে দেহের নিকট একশর্করা হিসেবে গ্লুকোজের কদর অনেক বেশি, সে কারণেই গ্লুকোজ শোষণ ও তাকে ভেঙে শক্তি উৎপাদন করা নিয়ে উদ্ভব হয়েছে কতসব প্রোটিন, এনজাইম ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া। সাথে ফ্রুকটোজ ও গ্যালাকটোজের শোষণ ও বিপাক নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা। অন্ত্রে একশর্করা গ্লুকোজ, সাথে ফ্রুকটোজ ও গ্যালাকটোজেরও, অণুগুলির পরবর্তী তিনটি কাজ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ- অন্ত্র থেকে তার রক্তপ্রবাহে আগমন (শোষণ), দেহের বিভিন্ন কোষে গ্লুকোজকে অভ্যন্তরীণ করার প্রক্রিয়া ও অবশেষে নিজেকে ভেঙে দেহের শক্তি উৎপাদন করাই হচ্ছে গ্লুকোজের অভীষ্ট লক্ষ্য। প্রতিটি স্তরেই রয়েছে শর্করা বিপাকীয়   বিবর্তনের স্পর্শ (এককোষী জীব থেকে মানুষ পর্যন্ত), ধাপে ধাপে উদ্ভব হয়েছে নানান গ্লুকোজ-পরিবাহী প্রোটিন, বিপাকীয় উৎসেচক ও শক্তি উৎপাদনের কৌশল। সাথে সৃষ্টি হয়েছে রক্ত প্রবাহে গ্লুকোজ ভারসাম্যতা রক্ষার্থে কিছু হরমোন, যার মধ্যে ইন্সুলিন (insulin) ও গ্লুকাগন (glucagon) অন্যতম। গ্লুকোজ অন্ত্রের এন্টারোসাইট (enterocyte) কোষের মাধ্যমে শোষিত হয় এবং সেখান থেকে রক্ত ​​প্রবাহে প্রবেশ করে। ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষ, প্রায় সব জীবে শক্তির একটি উৎস হিসেবে গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়, তাই গ্লুকোজ হচ্ছে কোষের অন্যতম জ্বালানী। প্রোটিন ও লিপিড উৎপাদনে গ্ল‌ুকোজ একটি জটিল বিক্রিয়ক। উদ্ভিদে ও অধিকাংশ প্রাণীদেহে ভিটামিন সি উৎপাদনেও গ্ল‌ুকোজ একটি বিক্রিয়ক। স্টার্চ, সেলুলোজ ও গ্লাইকোজেন হলো গ্ল‌ুকোজের পলিমার। দেহের প্রতিটি কোষেই রয়েছে গ্লুকোজের চাহিদা, তবে শুধুমাত্র মস্তিষ্কের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১২০ গ্রাম গ্লুকোজ প্রয়োজন যা সমস্ত গ্লুকোজের অর্ধেকেরও বেশি। 

গ্লুকোজ পরিবাহী প্রোটিন (Glucose transporter)

পানি-আকর্ষণীয় (হাইড্রোফিলিক) ধর্মের কারণে, একশর্করা অণুগুলি কোষের  লিপিড-মেমব্রেনভেদ্য নয়, ফলে তাদের বাহক-মধ্যস্থ পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্বিস্তর ঝিল্লিটি অতিক্রম করতে হয়। জীবজগতে সুগার ট্রান্সপোর্টার/বাহকগুলি ব্যাকটেরিয়া থেকে আর্কিয়া ও প্রকৃতকোষীয় সকল জীবের মধ্যে দেখা যায়। আদিকোষীয় জীবে প্রোটন (H+)-সহযোগিতায় সিমপোর্টার (symporter) নামক বাহকের মাধ্যমে ঝিল্লিজুড়ে গ্লুকোজ পরিবহনের ব্যবস্থা উচ্চতর প্রাণীদের কোনো কোনো অঙ্গে এখনও রয়ে গেছে। তবে, অন্তঃক্ষরা হরমোন (ইন্সুলিন)-মধ্যস্থিত ১২-ডোমেইন (domain)বিশিষ্ট এক বিশেষ ধরণের গ্লুকোজ বাহক প্রোটিন (GLUT)র আবির্ভাব ঘটেছে উচ্চতর প্রাণীজগতে, বিশেষকরে স্তন্যপায়ী জীবে। এছাড়া, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম গ্রেডিয়েন্টের সহযোগিতায় একটি সহযোগী পরিবাহী প্রোটিনের (SGLT: Na+/glucose cotransporter)র উপস্থিতি ক্ষুদ্রান্ত্রে ও হৃদপেশির টিস্যুতে (SGLT1) এবং বৃক্কে (SGLT2) এখনও রয়ে গেছে। অতীতে ধারণা করা হতো যে শুধুমাত্র গ্লুকোজ ঘনত্বের উপর ভিত্তি করে অ্যাকটিভ পরিবহন (কম ঘনত্বের অঞ্চল থেকে উচ্চ ঘনত্বের অঞ্চলে ‘ঘনত্ব গ্রেডিয়েন্টে’র বিপরীতে অণুর চলাচল) প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ অন্ত্র থেকে রক্তপ্রবাহে শোষিত হয়। বলা বাহুল্য, প্রোটন (H+)-সংযুক্ত সিমপোর্টারের অনেকটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায় GLUT1 প্রোটিনে, তজ্জন্যে GLUT পরিবারে GLUT1-কে অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়।

কোষের মেমব্রেন প্রোটিনের একটি বিস্তৃত গ্রুপ হলো গ্লুকোজ ট্রান্সপোর্টার (Glucose Transporter) বা GLUT প্রোটিন, যা প্লাজমা ঝিল্লিজুড়ে গ্লুকোজ পরিবহনের একটি সহায়ক প্রোটিন। পরিবহনের এই প্রক্রিয়াটিকে এক ধরণের প্রোটিন-মধ্যস্থ ডিফিউশন বা ব্যপনও বলা যেতে পারে। যেহেতু কার্বন-ভিত্তিক গ্লুকোজ জীবন পরিচালনার জন্য শক্তির একটি অত্যাবশ্যক উৎস, তাই এই পরিবহনকারী প্রোটিনগুলি সমস্ত জীবেই উপস্থিত। আদিকোষীয় জীবে (যেমন ব্যাকটেরিয়া) এক জাতীয় প্রাচীন (The phosphoenolpyruvate-phosphotransferase system) গ্লুকোজ পরিবহন পদ্ধতি দেখা যায়। ছত্রাক গ্রুপে দেখা যায় Hxt পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এক ধরণের ট্রান্সপোর্টার প্রোটিন। মানব দেহের বিভিন্ন টিসুতে গ্লুট পরিবারের ১৪টি ভিন্ন GLUT ট্রান্সপোর্টার রয়েছে, যা তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণীর গ্লুট প্রোটিন (GLUT1, GLUT2, GLUT3, GLUT4 ও GLUT14) ও দ্বিতীয় শ্রেণীর GLUT5-প্রোটিনদের অবস্থান ও কার্যকারিতা নিয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে, তম্মধ্যে যকৃত কোষের GLUT2 ও পেশি কোষের GLUT4 বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গ্লুকোজ ছাড়াও, GLUT ট্রান্সপোর্টার ফ্রুক্টোজ (GLUT5), গ্যালাকটোজ (GLUT2), মায়োইনোসিটল (GLUT4) এবং ইউরেট (urate, GLUT9) বহন করতে সক্ষম। বিভিন্ন গ্লুট ট্রান্সপোর্টার দেহের ভিন্ন ভিন্ন কোষ বা টিস্যুতে দেখা যায়, যেমন ভ্রূণ টিস্যু ও লোহিত রক্ত কণিকায় GLUT1, স্নায়ুকোষ ও প্লাসেন্টায় GLUT3 এবং মুষ্ককোষে GLUT14। প্রোটিন GLUT2 একটি দ্বিমুখী ট্রান্সপোর্টার, যার মাধ্যমে মুক্ত গ্লুকোজ অণুর কোষঝিল্লির এপার-ওপার উভয় দিকেই পরিবাহিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। GLUT2  দেখা যায় বৃক্কের টিউবুলার কোষ, যকৃত কোষ এবং অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলিতে। এছাড়া, এটি ক্ষুদ্রান্তের এপিথেলীয় বেসোল্যাটারাল (basolateral) মেমব্রেনেও উপস্থিত থাকে। গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টার এন্ডোথেলিয়াল, এপিথেলিয়াল এবং ট্রফোব্লাস্ট কোষ দ্বারা গ্লুকোজ গ্রহণ এবং পরিবহন প্রাথমিকভাবে GLUT1 ও GLUT3 দ্বারাই সম্পাদিত হয়। যদিও GLUT4 ট্রান্সপোর্টারের উপস্থিতি দেখা যায়, কিন্তু শেষোক্ত প্রোটিনটির অবস্থান স্থায়ী নয়। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখনো তর্ক শেষ হয়নি যে ভ্রূণের গ্লুকোজ গ্রহণ ও পরিবহনে ইন্সুলিনের কোনো ভূমিকা রয়েছে কি না। প্রসঙ্গতঃ GLUT পরিবারের সমস্ত প্রোটিন মানব ডিএনএ (DNA)-র SLC2 জিন দ্বারা সংকেত প্রাপ্ত।

কোষাভ্যন্তরে গ্লুকোজ প্রবেশে ইন্সুলিনের ভূমিকা

রক্ত প্রবাহ থেকে গ্লুকোজ প্রবেশ করে কোষাভ্যন্তরে ইন্সুলিনের সহায়তায় GLUT2 (যকৃত কোষে) ও GLUT4 (অ্যাডিপোজ টিস্যু ও পেশি কোষে) ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের মাধ্যমে। ইন্সুলিন গ্লুকোজকে সারা শরীরের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেয়- কোথাও (এডিপোজ টিস্যু) তা লাইপোজেনেসিস (lipogenesis) প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয় ট্রাইগ্লিসেরাইডে (triglyceride), আবার গ্লাইকোজেনেসিস (glycogenesis) প্রক্রিয়ায় কোথাও (পেশী কোষ, যকৃত) গ্লাইকোজেন-এ রূপান্তরিত হয়ে সঞ্চিত থাকে গ্লুকোজ, দেহের পরবর্তী চাহিদা মিটাতে। এটা জেনে রাখা ভালো যে, ইন্সুলিনের সঙ্গে গ্লুকোজের সরাসরি বন্ধন কোনো সময়ই ঘটে না। তবে, কোষপৃষ্ঠে অবস্থিত ইন্সুলিন রিসেপ্টর (Insulin receptor, Ins-R)র মাধ্যমে রক্তে প্রবাহিত গ্লুকোজ অণুগুলিকে কোষাভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য একটি আণবিক আবহ তৈরি করাটাই হচ্ছে ইন্সুলিনের মূল ভূমিকা। গ্লুকোজ হলো দেহে শক্তির উৎস। কোষের সাইটোপ্লাজমে গ্লুকোজের মূল কাজ হচ্ছে গ্লাইকোলাইসিস (glycolysis) প্রক্রিয়ায় এটিপি (ATP: adenosine triphosphate) রূপে শক্তি তৈরি করা এবং সে প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন পাইরুভেট অনু কোষের মাইটোকোন্দ্রিয়ায় প্রবেশ করে, যেখানে  কোষের অধিকাংশ শক্তি ATPরূপে উৎপন্ন হয়। তাই গ্লুকোজের কোষাভ্যন্তরীণকরণের এই প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব পড়েছে ইনসুলিনের ওপর। ফলে, ইনসুলিনের কাজ হচ্ছে গ্লুকোজকে কীভাবে সুচারুরূপে কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো যায় তা নিশ্চিৎ করা। ইন্সুলিন এই কাজটি করে তার স্বকীয় রিসেপ্টর (Ins-R) ও কোষের কতিপয়  উৎসেচক (enzyme)কে সক্রিয় করার মাধ্যমে, এবং সে কাজটি করতেও তার একটি নির্দিষ্ট সংকেতপ্রবাহের পথ অনুসরণ করতে হয় (ছবি দেখুন ও বিস্তারিত জানুন: ‘দেহে গ্লুকোজের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে আলফা ও বিটা কোষ উভয়ই অংশীদার’, https://www.bishleshon.com/6077/)। তাহলে এটা খুব স্পষ্ট যে, গ্লুকোজের সঙ্গে সরাসরি বন্ধন GLUT প্রোটিনের, ইনসুলিনের সঙ্গে নয়। তবে, এটাও অনস্বীকার্য যে, এই বন্ধনটি সম্ভব হয়েছে ইনসুলিনের সহযোগিতায়।

গ্লুকোজ হলো দেহে শক্তির উৎস

গ্লুকোজ থেকে শক্তি উৎপাদনের কৌশল হিসেবে অণুজীব থেকে উচ্চতরজীবসহ মানুষ পর্যন্ত তিনটি প্রধান প্রক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছে: গ্লাইকোলাইসিস, সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র বা ক্রেবস চক্র ও অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশন, যার এনজাইম-ভিত্তিক পর্যায়ক্রমিক বিস্তারিত রাসায়নিক বিক্রিয়া এই প্রবন্ধে ব্যাখ্যাত হয় নি (বিস্তারিত জানতে পড়ুন কোনো পাঠ্যপুস্তক), কারণ এটি কোষে গ্লুকোজের অবদান নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক লেখা। এই তিনটি প্রক্রিয়ার ফলাফলে একটি গ্লুকোজ অণু ভেঙে তৈরি হয় শক্তিরূপে ৩৬ থেকে ৩৮টি ATP। স্বাভাবিক অবস্থায় একটি ATP অণু উৎপন্ন করে প্রায় ৮ Kcal শক্তিl ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষ পর্যন্ত সকল জীবের জন্য গ্লুকোজ হলো সার্বজনীন জ্বালানী-শক্তির একটি প্রধান উৎস। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে কিছু টিস্যু তাদের বিপাকীয় শক্তির জন্য সম্পূর্ণরূপে গ্লুকোজের ওপর নির্ভরশীল, যেমন মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, লোহিত রক্ত কণিকা, বৃক্ক, ভ্রূণীয় টিস্যু ইত্যাদি। 

গ্লুকোজ অবক্ষয়ের মাধ্যমে, এমনকি অক্সিজেনের অনুপস্থিতেও, ATP-রূপে শক্তি তৈরির যে প্রক্রিয়া গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) তা উদ্ভব হয়েছিল আদিকোষীয় জীবে, অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ায়।  কোষের সাইটোপ্লাজমে সংঘটিত গ্লাইকোলাইসিসের মাধ্যমে গ্লুকোজ (C6H12O6) অণু দশটি এনজাইমের পর্যায়ক্রমিক অনুঘটনে অবশেষে রূপান্তরিত হয় পাইরুভিক অ্যাসিড (CH3COCO2H) বা পাইরুভেট অণুতে। এই প্রক্রিয়ায় মুক্ত হয় উচ্চ-শক্তি সম্পন্ন অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট (ATP) এবং বিজারিত নিকোটিনামাইড অ্যাডিনাইন ডাইনিউক্লিওটাইড (NADH)। যেহেতু গ্লাইকোলাইসিস একটি অতি প্রাচীন বিপাকীয় পদ্ধতি, যার উদ্ভব হয়েছিল ৪,০০০ থেকে ২,৫০০ মিলিয়ন বছর আগে, যখন আর্কিয়ান মহাসাগরে অক্সিজেনের উপস্থিতি ছিল না, তখন সে সময়ে এনজাইমের অনুপস্থিতিতে গ্লাইকোলাইসিস সম্পন্ন হতো কিছু ধাতুর অনুঘটন প্রক্রিয়ার দ্বারা। সে সময়ে আরও একটি সমান্তরাল বিপাকীয় পথের উদ্ভব হয়েছিল, যা পেন্টোজ ফসফেট (pentose phosphate pathway) পদ্ধতি  নামে অভিহিত, যার মাধ্যমে উৎপন্ন হয় NADH, পেন্টোজ (pentose) চিনি ও নিউক্লিওটাইডের পূর্বসূরি রাইবোজ ৫-ফসফেট (ribose 5-phosphate)। লোহিত রক্ত কণিকায় (এরিথ্রোসাইট) এই পদ্ধতি এখনও রয়ে গেছে এবং সেখানে এই পথটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে সে সময়ে আরো একটি জীবনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সম্প্রতি আবিষ্কৃত (২০১৯) সেই অণুজীবগুলি  এখনো রয়ে গেছে এবং অক্সিজেন নয়,  বরং সালফার পরমাণুই হচ্ছে তাদের জীবন। ভূপৃষ্ঠের ৮০০০ ফুট নীচে বাস করা কিছু অণুজীব, যেমন সালফিডোজেনিক (sulfidogenic) অণুজীব, আণবিক অক্সিজেন (O2) এর পরিবর্তে “শ্বাস নেয়” সালফেট (SO42-)। অবাত শ্বসনে  তারা প্রান্তিক ইলেক্ট্রন গ্রহণকারী হিসেবে  সালফেট ব্যবহার করে, সাথে তৈরি করে হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S)। 

গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়াকে প্রাথমিকভাবে দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: বিনিয়োগ ফেজ ও পে-অফ ফেজ। একটি ATP অণুর বিনিয়োগে গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয় ও হেক্সোকাইনেজ বা গ্লুকোকাইনেজ (যকৃত কোষে) এনজাইমের সাহায্যে তৈরি হয় একটি গ্লুকোজ ৬-ফসফেট অণু (গ্লুকোজ অণুর ৬নং কার্বনে যুক্ত হয় একটি ফসফেট)। গ্লুকোজের এই রূপান্তরটি একটি অভিনব কৌশল বলা যেতে পারে। কারণ, কোষের ভিতরে গ্লুকোজের প্রবেশ মাত্রই তাকে কোষাভ্যন্তরে আটকানো জরুরী, নইলে দ্বিমুখী GLUT ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে সে কোষের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে, GLUT ট্রান্সপোর্টার গ্লুকোজ ৬-ফসফেটকে বেরিয়ে যেতে অনুমতি দেয় না। বিনিয়োগ দশায় শক্তি যোগাতে দুইটি ATP খরচ করা হয়। গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় দেখা যায়  যে, কার্বন বন্ধনের নমনীয় বিশিষ্টতার কারণে ৬-কার্বন গ্লুকোজ তিন-কার্বনবিশিষ্ট দুটি ফসফেট-যুক্ত (ডাইহাইড্রোক্সি অ্যাসিটোন ও ফসফেট গ্লিসেরালডিহাইড ৩-ফসফেট)অণুতে বিভক্ত হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে পাইরুভেট কাইনেজ দ্বারা পরিণত হয় পাইরুভেটে-এক অণু গ্লুকোজ থেকে তৈরি হয় দুই অণু পাইরুভেট। গ্লাইকোলাইসিস বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় একটি গ্লুকোজ অণু ভেঙে দুইটি তিন-কার্বনবিশিষ্ট পাইরুভেট অণুতে রূপান্তর হতে খরচ হয় দুইটি ATP, কিন্তু খরচ বাদ দিয়ে নিট অর্জন হয় ২টি ATP, আর ২টি ইলেক্ট্রন দাতা, NADH।

গ্লাইকোলাইসিসের সামগ্রিক প্রক্রিয়া হল:  Glucose + 2 NAD+ + 2 ADP + 2 Pi → 2 pyruvate + 2 NADH + 2 H+ + 2 ATP।  গ্লাইকোলাইসিস সম্পন্ন করতে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না, তাই এই প্রক্রিয়াটি অ্যানারোবিক।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ অক্সিজেনের অপর্যাপ্ততায় ল্যাকটিক অ্যাসিড গাঁজন প্রক্রিয়ায় পাইরুভেট অণুকে ল্যাকটেট-এ রূপান্তর করা যেতে পারে:  পাইরুভেট + NADH + H+ → ল্যাকটেট + NAD+; নতুবা, অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পাইরুভেট মাইটোকন্ড্রিয়ায় প্রবেশ ক’রে পাইরুভেট ডিকারবক্সিলেশন (decarboxylation) নামক প্রক্রিয়ায় ২-কার্বনবিশিষ্ট অ্যাসিটিল-কোএ (Acetyl CoA)-তে রূপান্তরিত হয়ে ক্রেব’স/সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের সূচনা করতে পারে। পাইরুভেট জারিত হয় পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজ (pyruvate dehydrogenase) কমপ্লেক্স দ্বারা, উৎপন্ন করে অ্যাসিটিল-কোএ ও CO2।  

পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজ (pyruvate dehydrogenase) এবং কার্বক্সিলেজ (carboxylase) এনজাইমদুটি মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্সে অবস্থান করে। তাই পাইরুভেটকে সাইটোসল থেকে মাইটোকন্ড্রিয়ার বহিঃস্ত ও আভ্যন্তর উভয় ঝিল্লির মধ্য দিয়ে পরিবাহিত হতে হয় দুইটি বাহক প্রোটিন (VDAC- Voltage-dependent anion channel ও MPC- Mitochondrial pyruvate carrier)র মাধ্যমে। সংক্ষেপে, সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র (ক্রেব’স চক্র) হলো একটি ৮-পদক্ষেপ প্রক্রিয়া,  যেখানে ৮টি ভিন্ন এনজাইম ও অন্যান্য কো-এনজাইম জড়িত। প্রক্রিয়া চলাকালীন, অ্যাসিটিল-কোএ (২ কার্বন)+ অক্সালোঅ্যাসিটেট (৪ কার্বন) একীভূত বা  ঘনীভূত হয়ে উৎপাদন করে একটি সাইট্রেট অণু (৬ কার্বন), যা আরও প্রতিক্রিয়াশীল আকারে পুনর্বিন্যসিত হয় আইসোসাইট্রেট (৬ কার্বন)-এ। জারণ প্রক্রিয়ায় আইসোসাইট্রেট পরিবর্তিত হয়ে α-কিটোগ্লুটারেট (৫ কার্বন) ও সাকসিনিল-কোএ (৪-কার্বন) এবং সেখান থেকে সাক্সিনেট (৪-কার্বন), ফিউমারেট (৪-কার্বন), ম্যালেট (৪-কার্বন) এবং অবশেষে পূনরুদ্ধার হয়  অক্সালোঅ্যাসিটেট (৪-কার্বন)। একটি চক্র থেকে নিট অর্জন হয় ৩টি NADH, ১টি FADH2, প্রোটন প্লাস ইলেকট্রন বহনকারী যৌগ, এবং ১টি উচ্চ-শক্তি জিটিপি (GTP), যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয় এটিপি-তে, সাথে নির্গত হয় ২টি CO2।  যেহেতু প্রতিটি গ্লুকোজ অণু থেকে দুটি অ্যাসিটিল-কোএ অণু উত্পাদিত হয়, তাই প্রতি গ্লুকোজ অণুতে দুটি চক্রের প্রয়োজন হয়। এইভাবে, ১ গ্লুকোজ অণু (২ পাইরুভেট অণু তৈরি হবার ফলে)-র থেকে মোট ফলন হয় ৬টি NADH, ২টি FADH2, এবং ২টি ATP।

‘শ্বসন’ শব্দটি মানেই শুধু শ্বাস নেয়া নয়, কোষীয় শ্বসন (গ্লাইকোলাইসিস, সাইট্রিক অ্যাসিড বা ক্রেবস চক্র  এবং অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশন) আসলে একটি বিপাকীয় প্রক্রিয়া যা গ্লুকোজ ভেঙ্গে এটিপি নামক কোষীয় শক্তি উৎপন্ন করে। কোষীয় শ্বসন আদিকোষীয় (ব্যাকটেরিয়া) ও প্রকৃতকোষীয় (ইউক্যারিওট) উভয় জীবেই সম্পন্ন হয়। যেহেতু আদিকোষীয় জীবে মাইটোকন্ড্রিয়া নামক কোনো অঙ্গাণু থাকে না, তাই সেখানে ক্রেবস চক্রসহ কোষীয় শ্বসনের প্রতিটি প্রক্রিয়া ঘটে থাকে সাইটোপ্লাজমে ও প্লাজমা মেমব্রেনে। অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের মতে মাইটোকন্ড্রিয়া এক সময়ে ছিল স্বতন্ত্র ব্যাকটেরিয়া, যেমন ছিল উদ্ভিদ কোষের ক্লোরোপ্লাস্ট। জীব বিবর্তনের কোনো এক সময় এই আগন্তক এসে পড়ে প্রকৃতকোষে এবং সেই থেকে অন্তঃমিথোজীবী পরিচয় নিয়ে প্রকৃতকোষীয় জীবদের সাথেই রয়ে গেল চিরতরে। অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশনের দুটি অংশ রয়েছে: ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন (electron transfer chain, ETC) এবং কেমিওসমোসিস (chemiosmosis)। প্রকৃতকোষীয় জীবে, মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্রিষ্টিতে অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশন ঘটে। এই প্রক্রিয়াটি চার-প্রোটিন-কমপ্লেক্সবিশিষ্ট একটি ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন নিয়ে গঠিত যা ক্রেবস চক্র থেকে উৎপন্ন NADH ও FADH-কে জারণ করে, ব্যাকটেরিয়া ও মাইটোকন্ড্রিয়া উভয় ক্ষেত্রেই, আভ্যন্তরীণ ঝিল্লিজুড়ে একটি ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল প্রোটন গ্রেডিয়েন্ট স্থাপন করে এবং ইলেকট্রনের প্রবাহ অবশেষে গিয়ে পৌঁছয় গ্রহীতা আণবিক অক্সিজেনের কাছে। ফলশ্রুতিতে, অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশন প্রক্রিয়ায় এটিপি সিন্থেজ (ATP synthase) এনজাইমের মাধ্যমে শক্তির অণু হিসেবে ADP ফসফোরিলেশনের মাধমে এটিপি সংশ্লেষিত হয়। এটি সবাত শ্বসনেরই অঙ্গ,  যেখানে  ATP উৎপাদনের জন্য ইলেকট্রনগুলি আসে ইলেক্ট্রন দাতা NADH ও FADH থেকে। ৪টি H+/প্রোটনের পক্ষে এটিপি সিন্থেজ একটি এটিপি (ATP) অণু সংশ্লেষ করে। গ্লাইকোলাইসিস ও ক্রেবস চক্রের তুলনায়, যেখানে উৎপন্ন হয় মাত্র ২টি করে এটিপি, সেখানে ETC-অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে ৩২ থেকে ৩৪টি এটিপি অণু তৈরি হয়। অর্থাৎ, একটি ৬-কার্বনবিশিষ্ট গ্লুকোজ অণু ব্যবহার করে  উপরোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সর্বমোট ৩৬ থেকে ৩৮টি এটিপি অণু। একটি কোষের জন্য এটি এক বিশাল অর্জন।

অনাহারে-স্বল্পাহারে গ্লুকোজের প্রাপ্তি

দীর্ঘ সময় ধরে অনাহার, স্বল্প শর্করাজাতীয় খাবার গ্রহণ বা অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে রক্ত প্রবাহে দেখা দেয় গ্লুকোজের অনাটন. এবং সেক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হবার সম্ভাবনাও থাকে অনেক বেশি। ফলে দেহের শক্তি যোগাতে নির্ভরশীল হতে হয় সঞ্চিত গ্লুকোজ (গ্লাইকোজেন) বা বিভিন্ন গ্লুকোজেনিক পদার্থের ওপর, যারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাময়িকভাবে গ্লুকোজ অণু তৈরি করতে সক্ষম। গ্লুকোনিওজেনেসিস (gluconeogenesis) তেমনি একটি সর্বব্যাপী বিপাকীয় প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট অ-শর্করা (যেমন গ্লুকোজেনিক অ্যামিনো অ্যাসিড, ল্যাকটিক অ্যাসিড/ল্যাকটেট, পাইরুভেট ও গ্লিসেরল) অণু থেকে গ্লুকোজ তৈরি হয়। ট্রাইগ্লিসেরাইড ভেঙে রূপান্তরিত হয় গ্লিসেরল ও ফ্যাটি অ্যাসিডে। প্রোটিন পদার্থের বিপাকীয় বিশ্লেষণে কোষে  মুক্ত হয় অ্যামিনো অ্যাসিড (গ্লুকোজেনিক ও কিটোজেনিক)। ১৩টি গ্লুকোজেনিক অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে, তম্মধ্যে  অ্যালানিন (alanine) ও গ্লুটামিন (glutamine) হচ্ছে গ্লুকোজ তৈরির প্রধান উৎস। এছাড়াও, অনাহারের সময় ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে প্রাপ্ত কিটোন বডি ১১% পর্যন্ত গ্লুকোনিওজেনেসিসে অবদান রাখতে পারে। গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়া দেখা যায় প্রায় সমস্ত জীবেই- ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলে। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে গ্লুকোনিওজেনেসিস অধিকাংশক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে যকৃতে এবং কিছুটা হলেও ঘটে বৃক্কের কর্টেক্স, পেশি, অন্ত্র ও মস্তিষ্কের অ্যাস্ট্রোসাইটে (astrocyte)। গ্লুকোনিওজেনিক পূর্বসূরি হিসাবে, যকৃত ব্যবহার করে তিন-কার্বনবিশিষ্ট  ল্যাকটেট (C3H6O3), গ্লিসারল (C3H8O3) এবং অ্যামিনো অ্যাসিড, অ্যালানিন (C3H7NO2)। গ্লাইকোজেনোলাইসিস (গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজ তৈরি) ও গ্লুকোনিওজেনেসিস এই দুটি প্রক্রিয়া রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখতে ও হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়াতে প্রায় সমস্ত জীবেই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে, কিছু টিস্যু তাদের বিপাকীয় শক্তির জন্য সম্পূর্ণরূপে গ্লুকোজের ওপর নির্ভরশীল, যেমন মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, লোহিত রক্ত কণিকা, বৃক্ক, ভ্রূণীয় টিস্যু ইত্যাদি।

কোরি চক্র  (Cori cycle) থেকে উৎপন্ন ল্যাকটেট পাইরুভেটে রূপান্তরিত হয় ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজিনেজ (lactate dehydrogenase) এনজাইম দ্বারা। গ্লুকোনিওজেনেসিস এবং গ্লাইকোলাইসিস এই দুটি প্রক্রিয়া মূলতঃ একই এনজাইমের অনুঘটনে পরস্পর বিপরীত দিকে সংঘঠিত হয়। গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ার ১০টি এনজাইম বিক্রিয়ার মধ্যে ৭টি বিক্রিয়া পূর্বানুবৃত্তিমূলক (reversible), অর্থাৎ একটির থেকে আরেকটিতে ফিরে আসা যায়; কিন্তু তিনটি বিক্রিয়া অনিবর্তনীয় (irreversible), যেমন হেক্সোকাইনেজ/গ্লুকোকাইনেজ, ফসফোফ্রুকটোকাইনেজ এবং পাইরুভেট কাইনেজ-জনিত বিক্রিয়া (দেখুন ছবি)। গ্লাইকোলাইসিসের এই তিনটি এনজাইমকে গ্লুকোনিওজেনেসিসে প্রতিস্থাপিত করা হয় গ্লুকোজ-৬-ফসফাটেজ (Glucose-6-phosphatase, G6Pase), ফ্রুক্টোজ-1,6-বিসফসফেটেজ (Fructose bisphophatase, FBPase) এবং পেপ কার্বোক্সিকাইনেজ (Phosphoenol pyruvate carboxykinase, PEPCK) দ্বারা। গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণ করতে এই অনিবর্তনীয় তিনটি জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন তিনটি এনজাইম ব্যবহার করা হয় (ছবি দেখুন)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ গ্লুকোজ বিপাক সংক্রান্ত তিনটি প্রক্রিয়া (গ্লাইকোলাইসিস, গ্লাইকোজেনোলাইসিস ও গ্লুকোনিওজেনেসিস) সংঘটিত হয় সাইটোপ্লাজমে; তবে, গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে সহযোগিতা প্রয়োজন মাইটোকন্ড্রিয়া ও মসৃন এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের। গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় পাইরুভেট কার্বোক্সিলেজ (pyruvate carboxylase) দ্বারা পাইরুভেট থেকে তৈরী হয় অক্সালোএসিটেট, যা ঘটে  শুধুমাত্র মাইটোকন্ড্রিয়ায় ক্রেবস চক্রের মাধ্যমে।  অক্সালোএসিটেট (Oxaloacetate)কে সাইটসলে বের করার জন্য মাইটোকন্ড্রিয়ার ঝিল্লিতে কোনো ট্রান্সপোর্টার নেই। ফলে, ম্যালেট ডিহাইড্রোজিনেজ বিজারণের মাধ্যমে অক্সালোএসিটেট-কে প্রথমে ম্যালেটে (malic acid) রূপান্তরিত হওয়া আবশ্যক। নিজস্ব ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে ম্যালেট মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসে সাইটোসলে, যেখানে ম্যালেট ডিহাইড্রোজিনেজ দ্বারা ম্যালেট  জারিত হয়ে আবারো ফিরে যায় অক্সালোঅ্যাসিটেটে। অক্সালোঅ্যাসিটেটের মাধ্যমে গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটির হয় সূচনা এবং প্রক্রিয়াটির অন্তিমে গিয়ে তৈরি হয় গ্লুকোজ-৬-ফসফেট, যা এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে প্রবেশ করে G6Pase এনজাইম দ্বারা রূপান্তরিত হয় মুক্ত গ্লুকোজে। এছাড়া, গ্লাইকোলাইসিস বা গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় যে বাকি এনজাইমগুলি প্রয়োজন সেগুলি সবই পাওয়া যায় সাইটোসলে। মুক্ত গ্লুকোজ কোষ থেকে নির্গত হয় রক্ত প্রবাহে GLUT2 (যকৃত কোষে) ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের মাধ্যমে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক্সারগোনিক বিক্রিয়ায় পাইরুভেট থেকে গ্লুকোজ-৬-ফসফেট তৈরী হওয়ার (গ্লুকোনিওজেনেসিস) প্রক্রিয়াটি পরিচালনার জন্য ৪ অণু ATP এবং ২ অণু GTP প্রয়োজন পড়ে। এই ATP গুলি ফ্যাটি এসিডের অক্সিডেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।

বিভিন্ন প্রোটিন ফ্যাক্টর ও হরমোন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে। ইন্সুলিন ও গ্লুকাগন বিপরীতমুখী প্রভাব ফেলে। অনাহার অবস্থায় গ্লুকাগন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটিকে উদ্দীপিত করে; আর, রক্তে গ্লুকোজের আধিক্যে ইন্সুলিন তা রোধ করে। গ্লুকাগন (Glucagon) ও ইন্সুলিন (Insulin) মূলতঃ তাদের কাজটি করে ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের মাধ্যমে। গ্লুকাগন হরমোনের সক্রিয়তায় অনাহার অবস্থায় ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর CREB (cAMP response element binding protein), FoxO1 (forkhead transcription factor) ও FoxO6 প্রোটিন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত জিনদের (যেমন PEPCK, G6Pase, Fbpase, এবং pyruvate carboxylase) উদ্দীপিত করে ও তাদের প্রকাশকে বৃদ্ধি করে। অপরদিকে, রক্তে গ্লুকোজের প্রাচুর্য্যে ইনসুলিনের সক্রিয়তায় প্রোটিন কাইনেজ B (Akt) দ্বারা FoxO1 ও FoxO6কে ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে তার ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করে। ফলে, গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটি স্থগিত হয়ে যায়। ইনসুলিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাবার (insulin resistance) ফলে ইনসুলিন FoxO6-কে ব্লক করতে ব্যর্থ হয়, ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অধিক থাকা সত্ত্বেও গ্লুকোনিওজেনেসিস অব্যাহত থাকে, দেহে সৃষ্টি হয় হাইপারগ্লাইসেমিয়া (hyperglycemia)। এই অবস্থায় ওষুধ মেটফরমিন FoxO6কে বাধা দিতে সমর্থ হয়। এই কারণে গ্লুকোনিওজেনেসিস হলো টাইপ২ ডায়াবেটিস থেরাপির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এছাড়াও, গ্লুকোনিওজেনেসিস এপিনেফ্রিন, নর-এপিনেফ্রিন, কর্টিসল, থাইরয়েড হরমোন এবং গ্রোথ হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। 

গ্লুকোজের পর্যাপ্ত সরবরাহে কোষে তৈরি হয় গ্লুকোজভান্ডার

রক্ত প্রবাহে গ্লুকোজের পরিমাণ যখন অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন  দেহে মূলতঃ যকৃত ও পেশি কোষে গ্লুকোজ সঞ্চিত থাকে গ্লাইকোজেন হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ: যকৃতে ও পেশিতে গ্লাইকোজেন সঞ্চিত থাকে যথাক্রমে প্রায় ১৫০ গ্রাম ও ২৫০ গ্রাম। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় গ্লাইকোজেনেসিস (glycogenesis), যা জীব সৃষ্টির আদি থেকেই এই সঞ্চয়ের প্রবণতা দেখা যায় আর্কিয়া, ব্যাকটেরিয়া ও হেটেরোট্রপ জীবে এবং কতটা অল্প পরিসরে লক্ষ-লক্ষ গ্লুকোজ অণুগুলিকে থরে-বিথরে সাজানো যায় তার কৌশল দেখলে আধুনিক গ্রন্থাগারগুলিও হার মেনে যায় (ছবি দেখুন)। উদ্ভিদ কোষের একটি বিশেষ অঙ্গাণু অ্যামেলোপ্লাস্টে স্টার্চ থাকে অ্যামাইলোপেকটিন (amylopectin) হিসেবে। গ্লাইকোজেনেসিস প্রক্রিয়াটিতে গ্লুকোজ ছাড়াও প্রয়োজন ATP (adenosine triphosphate) ও UTP (uridine triphosphate), সাথে প্রয়োজন পাঁচটি অপরিহার্য এনজাইম। এ ছাড়াও গ্লাইকোজেন নির্মাণের জন্য প্রয়োজন একটি প্রোটিন-নির্ভর ভিত্তি বা পত্তন যার ওপর ভর করে তৈরি হয় গ্লাইকোজেনের একাধিক শাখা (ছবি দেখুন)। প্রাণিকূলে এই ভিত্তি স্থাপনকারী প্রোটিনটি হচ্ছে গ্লাইকোজেনিন (glycogenin)। কোষাভ্যন্তরে গ্লুকোজ-৬-ফসফেট এনজাইম ফসফোগ্লুকোমিউটেজ (phosphoglucomutase) দ্বারা রূপান্তরিত হয় গ্লুকোজ-১-ফসফেট অণুতে, যা এনজাইম ইউডিপি-গ্লুকোজ পাইরোফসফোরিলেজের (UDP-glucose pyrophosphorylase) অনুঘটনে পরিবর্তিত হয় ইউডিপি-গ্লুকোজ (UDP-glucose) অণুতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ পাইরোফসফাটেজ (pyrophosphatase) এনজাইমের মাধ্যমে গঠিত হয় পাইরোফসফেট যা UDP-গ্লুকোজ গঠনে সহায়ক। গ্লাইকোজেনিন প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করে গ্লাইকোজেন পলিমারের শৃঙ্খল তৈরি করতে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন সাতটি গ্লুকোজ মনোমারের একটি প্রাইমার (primer), যার সূত্র ধরে গ্লাইকোজেন সিনথেজ (glycogen synthase) এনজাইম UDP-গ্লুকোজ সংযুক্ত ক’রে ক্রমবর্ধমান গ্লাইকোজেন চেইনটি সৃষ্টি করে। পলিমার শৃঙ্খলে রৈখিকভাবে বেশিরভাগ গ্লুকোজ অণুগুলি একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে α-১,৪ (কার্বন ১ → কার্বন ৪) গ্লাইকোসিডিক (glycosidic) বন্ড দ্বারা এবং প্রতি দশ থেকে বিশটি গ্লুকোজ অণুসহ সৃষ্টি হয় একটি নতুন শাখা, যা পূর্ববর্তী শাখার সাথে যুক্ত থাকে একটি α-১,৬-গ্লাইকোসিডিক বন্ড দ্বারা। এইভাবে গ্লাইকোজেন পলিমারের অসংখ্য শাখা তৈরি করে এক চাঞ্চল্যকর ‘গ্লাইকোজেন ব্রাঞ্চিং এনজাইম’ (glycogen branching enzyme, GBE)। Escherichia coli জিনোমে, গ্লাইকোজেন বিপাকের জন্য পাঁচটি অপরিহার্য জিন একটি একক অপেরন (operon glgBXCAP) অঞ্চলে  সংগঠিত থাকে, যা একটি মাত্র জিন ‘প্রমোটর’ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। আর, মানব জিনোমে GBE1 জিনটি অবস্থান করে ৩নং ক্রোমোজোমে।

দীর্ঘকালীন অনাহারে দেহের রক্ত প্রবাহে শর্করাজাতীয় পদার্থের ঘাটতিতে অগ্নাশয়ের আলফা কোষ থেকে নিঃসৃত গ্লুকাগন হরমোন ছুটে যায় যকৃতে- মুক্ত করে গ্লুকোজ অণুগুলিকে গ্লুকোজভাণ্ডার (গ্লাইকোজেন) থেকে মোট চারটি এনজাইমের সাহায্যে। এই প্রক্রিয়াটি হলো গ্লাইকোজেনোলাইসিস (glycogenolysis)। ঠিক যেভাবে এক অভিনব কৌশলে গ্লুকোজগুলিকে সাজানো হয়েছিল পলিমারগু, ঠিক তার উল্টোপথে গ্লুকোজগুলিকে মুক্ত করা হয় গ্লাইকোজেন থেকে। গ্লাইকোজেনের একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খল থেকে ফসফোরোলাইসিস (phosphorolysis) প্রক্রিয়ায় গ্লাইকোজেন ফসফরিলেজ (glycogen phosphorylase) এনজাইমের মাধ্যমে (শেষের চারটি গ্লুকোজ অণু ছাড়া) গ্লুকোজ ১-ফসফেট অণুগুলি  পলিমার থেকে মুক্ত হয়। গ্লুকোজ-১-ফসফেট থেকে গ্লুকোজ-৬-ফসফেটে রূপান্তরিত হয় এনজাইম ফসফোগ্লুকোমিউটেজ (phosphoglucomutase) দ্বারা। গ্লুকোজ-৬-ফসফেট প্রবেশ করে যকৃতের এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম (endoplasmic reticulum, ER) অঙ্গাণুতে GLUT1 ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে, যেখানে অবস্থান করছে গ্লুকোজ-৬-ফসফাটেজ (glucose-6-phosphatase, G6Pase) এনজাইম, যা ৬ নং কার্বন থেকে ফসফেটকে অপসারণ করে মুক্ত করা হয় ব্যবহারযোগ্য গ্লুকোজ অণুতে।  তবে. অন্ত্র, পেশী, মস্তিষ্ক ও কিডনি কোষে G6Pase না থাকার কারণে মুক্ত গ্লুকোজ সৃষ্টিও হয় না এবং রক্তেও ফিরে আসে না। এছাড়া, গ্লুকোজ-৬-ফসফেট অণুর জন্য পেশি কোষে কোনো নির্ধারিত GLUT ট্রান্সপোর্টার-ও অবস্থান করে না। শুধুমাত্র, ফসফেট-মুক্ত গ্লুকোজ GLUT2 ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে ER থেকে ও অবশেষে যকৃত কোষ থেকে ফিরে আসে রক্ত প্রবাহে। উল্লেখিত গ্লাইকোজেন শৃঙ্খলের যে চারটি গ্লুকোজ অণু অবশিষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে তার তিনটি অণু গ্লাইকোজেনের নিকটস্থ পার্শ্ববর্তী শৃঙ্খলে স্থানান্তরিত হয় গ্লাইকোজেন ডিব্র্যাঞ্চিং (glycogen debranching enzyme) উৎসেচকের মাধ্যমে।  ডিব্র্যাঞ্চিং এনজাইম পরিবার দুইটি এনজাইম নিয়ে গঠিত- ট্রান্সফারেজ (transferase) ও আলফা-গ্লুকোসিডেজ (α-glucosidase)। পূর্ববর্তী শৃঙ্খলের অন্তিম গ্লুকোজটি যা পার্শ্ববর্তী শৃঙ্খলের সাথে গ্লাইকোসাইড (glycoside) বন্ধন (কার্বন ১→৬) দিয়ে যুক্ত তা আলফা-গ্লুকোসিডেজ এনজাইম দ্বারা ভেঙে ফেলে তাকেও মুক্ত করা হয়। এভাবেই, দেহে গ্লুকোজের অভাব মিটাতে, প্রয়োজনবোধে একের পর এক শৃঙ্খল থেকে সঞ্চিত গ্লুকোজ অণুগুলিকে মুক্ত করে বজায় রাখা হয় গ্লুকোজের ভারসাম্যতা। রক্তে শর্করার মাত্রার প্রতিক্রিয়া হিসেবে গ্লাইকোজেনোলাইসিস প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত হয় গ্লুকাগন, ইনসুলিন ও এপিনেফ্রিন হরমোন দ্বারা।

উপসংহার

সৃষ্টিকর্তা এই মর্তলোকে জীবজগতের সকল জীবন কার্বন উপাদানের ওপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি করেছেন, সিলিকন বা অন্য কোনো মৌলিক উপাদানের উপর ভিত্তি করে নয়। দেহে শুধু কার্বন-ই নয়, সাথে রয়েছে আরও পাঁচটি মূল উপাদান -অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম, ও ফসফরাস- যা গঠন করেছে আমাদের দেহের ৯৯ শতাংশ। কার্বন তার সমস্ত প্রতিবেশী উপাদানগুলির সাথে চারটি পারমাণবিক বন্ধন তৈরি করে ও বন্ধনগুলির শক্তি হয় একই রকম। পক্ষান্তরে, সিলিকন-ও চারটি পারমাণবিক বন্ধন তৈরি করার সক্ষমতা রাখে- কিন্তু, সিলিকনের অন্যান্য উপাদানগুলির সাথে বন্ধন অনেক বেশি দৃঢ় ও স্থিতিশীল, তাদের আলাদা করা খুব কঠিন। কার্বনবন্ধনগুলির ক্ষেত্রে তা নয়- জৈব অণুতে কার্বন-কার্বন, কার্বন-অক্সিজেন, কার্বন-হাইড্রোজেন এবং কার্বন-নাইট্রোজেন বন্ধন সবই প্রায় একই রকম। এর মানে হলো যে, শক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, পরমাণুগুলিকে অদলবদল করা বেশ সহজ। সেই সহজ রদবদল, যেমন আইসোমেরাইজেশন, ৬-কার্বন অণু থেকে ৫-,৪-, বা ৩-কার্বন অণুতে রূপান্তর (বা তার বিপরীত) ইত্যাদি, আমরা দেখেছি গ্লাইকোলাইসিস, ক্রেবস চক্র ও অন্যান্য প্রক্রিয়াগুলিতে। কোষের গ্লুকোজ অণুগুলি তাদের সমযোজী বন্ধনে প্রচুর সংগঠিত শক্তি ধারণ করে। তাই, ওইসব পুনর্বিন্যাসে তাদের কোভ্যালেন্ট বন্ডগুলিতে সঞ্চিত শক্তি (যেমন C – H ৯৮ kcal/mole, C – O ৭৮ kcal/mole, C – N ৬৫ kcal/mole ইত্যাদি) মুক্তি পেয়েও যায়। আমরা শ্বাসের সাথে অক্সিজেন নিই, ত্যাগ করি আঙ্গারিক গ্যাস (কার্বন ডাই অক্সাইড)। ভাবুন তো আমরা ত্যাগ করছি সিলিকন ডাই অক্সাইড – সে তো সিলিকন-ভিত্তিক নুড়ি, আর বালি। একশর্করা অণুগুলির মধ্যে শরীরের প্রতিটি কোষ গ্লুকোজ-কেই প্রাধান্য দিয়েছে জ্বালানী হিসেবে, ফ্রুক্টোজ বা গ্যালাকটোজ-কে নয়। তাই, অশিকাংশ ক্ষেত্রে, ফ্রুক্টোজ কোষে রূপান্তরিত হয় গ্লুকোজে। যকৃতই একমাত্র অঙ্গ, যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফ্রুক্টোজ বিপাক করতে পারে। তাছাড়া, অতিরিক্ত ফ্রুক্টোজ গ্রহণে ফ্যাটি লিভার এবং প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলির চারপাশে ভিসারাল ফ্যাট জমতে পারে। এছাড়া, গ্লুকোজের শক্তি উৎপাদনের হার ফ্রুক্টোজের চেয়ে তিনগুণ বেশি। তাই সবকিছু ভেবেই দেহ বেছে নিয়েছে কার্বন-ভিত্তিক গ্লুকোজ অনুকে তার শক্তি উৎপাদনের উৎস হিসেবে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক: সাবেক উপ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, এবং সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র, ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

আহারে কিংবা অনাহারে বিভিন্নভাবে গ্লুকোজ ফিরে আসে কোষীয় জ্বালানী হয়ে

প্রকাশ: ০৮:২৯:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২

পৃথিবীর সকল জীবের একটি প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে অ-ধাতব মৌল কার্বন বা অঙ্গার। এই কার্বন-ভিত্তিক জীবনের আরো প্রধান তিনটি এলিমেন্ট রয়েছে:  হাইড্রোজেন  (১০%), অক্সিজেন (৬৩%), নাইট্রোজেন (৪%), অর্থাৎ CHON। এছাড়াও, জীবদেহে রয়েছে ফসফোরাস ও সালফার। ভরের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ভূত্বকে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও অক্সিজেন এর পরের স্থানেই রয়েছে কার্বন। বায়ুমণ্ডলে, কার্বন থাকে সাধারণত: কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) বা আঙ্গারিক গ্যাস ও মিথেন (CH4) আকারে। পার্থিব এবং মহাসাগরীয় সালোকসংশ্লেষী জীব আঙ্গারিক গ্যাস  গ্রহণ করে। সমুদ্রে আঙ্গারিক গ্যাস দ্রবীভূত থাকে কার্বনিক অ্যাসিড বা অঙ্গারাম্ল গঠন করে। বায়ুমণ্ডলের তুলনায় মহাসাগর প্রায় ৫০ গুণ বেশি চক্রাকারে কার্বন সঞ্চয় করে, সে কারণে সমুদ্রকে বলা হয় কার্বনের বৃহত্তম সঞ্চয়ভাণ্ডার।  জীবননির্মাণে কার্বনকে বেছে নেয়ার পেছনে সম্ভবত: মূল কারণ ছিল যে একটি কার্বন পরমাণু একসাথে চারটি সমযোজী রাসায়নিক বন্ধন গঠন করতে সক্ষম। এই গুণটি কার্বনকে প্রোটিন, শর্করা, লিপিড এবং ডিএনএর মতো অণুগুলির দীর্ঘ শৃঙ্খল তৈরি করার জন্য উপযুক্ত করে তোলে যা জীবনের ভিত্তি হিসেবে  কাজ করে। কার্বন এখন পর্যন্ত বর্ণিত প্রায় এক কোটি যৌগ গঠন করতে সক্ষম। যেহেতু এটি হালকা ওজনের এবং আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট, তাই কার্বন অণুগুলির অনুঘটন করা এনজাইমের পক্ষে যথেষ্টই সহজ হয়ে যায়। কার্বননির্ভর অণুগুলি সৃষ্টির বড় একটি কারণ ছিল সেখান থেকে শক্তি উৎপাদন করা। কার্বন অণু ভেঙ্গে, শক্তি নির্গত হয় যা বিভিন্ন কোষীয় প্রক্রিয়া চালাতে অপরিহার্য। এটা অনস্বীকার্য, কার্বন-ভিত্তিক জীবনও বাঁচত না যদি জীবগুলি সরাসরি হাইড্রোকার্বন হিসেবে  শক্তি সঞ্চয় করত, কারণ অ্যালকেনগুলি নিজেরাই বেশ দাহ্য (পেট্রোল ও কেরোসিন), কিন্তু কার্বন-ভিত্তিক জীবগুলি যদি শর্করা, লিপিড, অ্যালকোহল এবং অন্যান্য হাইড্রোকার্বন হিসেবে  শক্তি সঞ্চয় করে তাহলে সেই জটিলতা অতিক্রম করা সহজ হয়ে যায়। প্রকৃতিতে সেটাই হয়েছে- সৌরশক্তি দ্বারা সালোকসংশ্লেষনের মাধ্যমে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া ও উদ্ভিদজগত আঙ্গারিক গ্যাস ও পানি থেকে শর্করা উৎপন্ন করে, মুক্ত করে অক্সিজেনকে। প্রাণীজগত এই ব্যাপারটিতে পিছিয়ে পড়লো। যেহেতু প্রাণিকোষে ক্লোরোপ্লাস্ট জাতীয় অঙ্গাণু থাকে না, তাই এই  হেটেরোট্রফদের (heterotroph: যারা নিজের খাদ্য তৈরি করতে পারে না) জৈব কার্বনের অন্যান্য উৎস থেকে পুষ্টি গ্রহণ করতে হয়, প্রধানত উদ্ভিদ পদার্থ। বিপরীতে, প্রাণিকুল দেয় তাদের নিঃশ্বসিত আঙ্গারিক গ্যাস।     

অন্ত্র থেকে রক্তপ্রবাহে গ্লুকোজের পরিবহন

গ্লুকোজ একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্বোহাইড্রেট, রাসায়নিক শ্রেণিবিভাগে একশর্করা বা মনোস্যাকারাইড গ্ৰুপে অন্তর্ভুক্ত। গ্লুকোজকে অ্যালডোহেক্সোজ-ও বলা হয়। অ্যালডোহেক্সোজ চিনির দুইটি স্টেরিও সমাণু গ্লুকোজ রয়েছে: L-গ্লুকোজ ও D-গ্লুকোজ। জীবকোষের বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র D-গ্লুকোজ জৈবিকভাবে সক্রিয়। দ্রবণে গ্লুকোজ অণু খোলা শিকল আকারেও থাকতে পারে বা বলয়াকারে। কঠিন অবস্থায় গ্লুকোজ বলয়াকার আকার ধারণ করে। কারণ, বলয়ের গঠনটি পাঁচটি কার্বন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু ধারণ করে। এই গঠনে প্রত্যেক কার্বন পরমাণু একটি করে হাইড্রক্সিল গ্ৰুপের সাথে যুক্ত থাকে। পঞ্চম পরমাণুটি ষষ্ঠ পরমাণুর সাথে যুক্ত থাকে এবং -CH2OH গ্ৰুপ গঠন করে। পানিতে গ্লুকোজের দ্রাব্যতা খুব বেশি। খাদ্যের অধিকাংশ জটিল কার্বহাইড্রেট লালারসে এবং ক্ষুদ্রান্তে অগ্ন্যাশয় ও অন্ত্র (এন্টেরোসাইট) থেকে নিঃসৃত গ্লাইকোসিডেজ (glycosidases) বা গ্লাইকোসাইড হাইড্রোলেজ (যেমন অ্যামাইলেজ, ম্যাল্টেজ, ল্যাকটেজ, সুক্রেজ) এনজাইমগুলির মাধ্যমে ভেঙে সরল গ্লুকোজ ও অন্যান্য একশর্করা (গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, গ্যালাকটোজ) অণুতে পরিণত হয়। তবে দেহের নিকট একশর্করা হিসেবে গ্লুকোজের কদর অনেক বেশি, সে কারণেই গ্লুকোজ শোষণ ও তাকে ভেঙে শক্তি উৎপাদন করা নিয়ে উদ্ভব হয়েছে কতসব প্রোটিন, এনজাইম ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া। সাথে ফ্রুকটোজ ও গ্যালাকটোজের শোষণ ও বিপাক নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা। অন্ত্রে একশর্করা গ্লুকোজ, সাথে ফ্রুকটোজ ও গ্যালাকটোজেরও, অণুগুলির পরবর্তী তিনটি কাজ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ- অন্ত্র থেকে তার রক্তপ্রবাহে আগমন (শোষণ), দেহের বিভিন্ন কোষে গ্লুকোজকে অভ্যন্তরীণ করার প্রক্রিয়া ও অবশেষে নিজেকে ভেঙে দেহের শক্তি উৎপাদন করাই হচ্ছে গ্লুকোজের অভীষ্ট লক্ষ্য। প্রতিটি স্তরেই রয়েছে শর্করা বিপাকীয়   বিবর্তনের স্পর্শ (এককোষী জীব থেকে মানুষ পর্যন্ত), ধাপে ধাপে উদ্ভব হয়েছে নানান গ্লুকোজ-পরিবাহী প্রোটিন, বিপাকীয় উৎসেচক ও শক্তি উৎপাদনের কৌশল। সাথে সৃষ্টি হয়েছে রক্ত প্রবাহে গ্লুকোজ ভারসাম্যতা রক্ষার্থে কিছু হরমোন, যার মধ্যে ইন্সুলিন (insulin) ও গ্লুকাগন (glucagon) অন্যতম। গ্লুকোজ অন্ত্রের এন্টারোসাইট (enterocyte) কোষের মাধ্যমে শোষিত হয় এবং সেখান থেকে রক্ত ​​প্রবাহে প্রবেশ করে। ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষ, প্রায় সব জীবে শক্তির একটি উৎস হিসেবে গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়, তাই গ্লুকোজ হচ্ছে কোষের অন্যতম জ্বালানী। প্রোটিন ও লিপিড উৎপাদনে গ্ল‌ুকোজ একটি জটিল বিক্রিয়ক। উদ্ভিদে ও অধিকাংশ প্রাণীদেহে ভিটামিন সি উৎপাদনেও গ্ল‌ুকোজ একটি বিক্রিয়ক। স্টার্চ, সেলুলোজ ও গ্লাইকোজেন হলো গ্ল‌ুকোজের পলিমার। দেহের প্রতিটি কোষেই রয়েছে গ্লুকোজের চাহিদা, তবে শুধুমাত্র মস্তিষ্কের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১২০ গ্রাম গ্লুকোজ প্রয়োজন যা সমস্ত গ্লুকোজের অর্ধেকেরও বেশি। 

গ্লুকোজ পরিবাহী প্রোটিন (Glucose transporter)

পানি-আকর্ষণীয় (হাইড্রোফিলিক) ধর্মের কারণে, একশর্করা অণুগুলি কোষের  লিপিড-মেমব্রেনভেদ্য নয়, ফলে তাদের বাহক-মধ্যস্থ পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্বিস্তর ঝিল্লিটি অতিক্রম করতে হয়। জীবজগতে সুগার ট্রান্সপোর্টার/বাহকগুলি ব্যাকটেরিয়া থেকে আর্কিয়া ও প্রকৃতকোষীয় সকল জীবের মধ্যে দেখা যায়। আদিকোষীয় জীবে প্রোটন (H+)-সহযোগিতায় সিমপোর্টার (symporter) নামক বাহকের মাধ্যমে ঝিল্লিজুড়ে গ্লুকোজ পরিবহনের ব্যবস্থা উচ্চতর প্রাণীদের কোনো কোনো অঙ্গে এখনও রয়ে গেছে। তবে, অন্তঃক্ষরা হরমোন (ইন্সুলিন)-মধ্যস্থিত ১২-ডোমেইন (domain)বিশিষ্ট এক বিশেষ ধরণের গ্লুকোজ বাহক প্রোটিন (GLUT)র আবির্ভাব ঘটেছে উচ্চতর প্রাণীজগতে, বিশেষকরে স্তন্যপায়ী জীবে। এছাড়া, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম গ্রেডিয়েন্টের সহযোগিতায় একটি সহযোগী পরিবাহী প্রোটিনের (SGLT: Na+/glucose cotransporter)র উপস্থিতি ক্ষুদ্রান্ত্রে ও হৃদপেশির টিস্যুতে (SGLT1) এবং বৃক্কে (SGLT2) এখনও রয়ে গেছে। অতীতে ধারণা করা হতো যে শুধুমাত্র গ্লুকোজ ঘনত্বের উপর ভিত্তি করে অ্যাকটিভ পরিবহন (কম ঘনত্বের অঞ্চল থেকে উচ্চ ঘনত্বের অঞ্চলে ‘ঘনত্ব গ্রেডিয়েন্টে’র বিপরীতে অণুর চলাচল) প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ অন্ত্র থেকে রক্তপ্রবাহে শোষিত হয়। বলা বাহুল্য, প্রোটন (H+)-সংযুক্ত সিমপোর্টারের অনেকটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায় GLUT1 প্রোটিনে, তজ্জন্যে GLUT পরিবারে GLUT1-কে অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়।

কোষের মেমব্রেন প্রোটিনের একটি বিস্তৃত গ্রুপ হলো গ্লুকোজ ট্রান্সপোর্টার (Glucose Transporter) বা GLUT প্রোটিন, যা প্লাজমা ঝিল্লিজুড়ে গ্লুকোজ পরিবহনের একটি সহায়ক প্রোটিন। পরিবহনের এই প্রক্রিয়াটিকে এক ধরণের প্রোটিন-মধ্যস্থ ডিফিউশন বা ব্যপনও বলা যেতে পারে। যেহেতু কার্বন-ভিত্তিক গ্লুকোজ জীবন পরিচালনার জন্য শক্তির একটি অত্যাবশ্যক উৎস, তাই এই পরিবহনকারী প্রোটিনগুলি সমস্ত জীবেই উপস্থিত। আদিকোষীয় জীবে (যেমন ব্যাকটেরিয়া) এক জাতীয় প্রাচীন (The phosphoenolpyruvate-phosphotransferase system) গ্লুকোজ পরিবহন পদ্ধতি দেখা যায়। ছত্রাক গ্রুপে দেখা যায় Hxt পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এক ধরণের ট্রান্সপোর্টার প্রোটিন। মানব দেহের বিভিন্ন টিসুতে গ্লুট পরিবারের ১৪টি ভিন্ন GLUT ট্রান্সপোর্টার রয়েছে, যা তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণীর গ্লুট প্রোটিন (GLUT1, GLUT2, GLUT3, GLUT4 ও GLUT14) ও দ্বিতীয় শ্রেণীর GLUT5-প্রোটিনদের অবস্থান ও কার্যকারিতা নিয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে, তম্মধ্যে যকৃত কোষের GLUT2 ও পেশি কোষের GLUT4 বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গ্লুকোজ ছাড়াও, GLUT ট্রান্সপোর্টার ফ্রুক্টোজ (GLUT5), গ্যালাকটোজ (GLUT2), মায়োইনোসিটল (GLUT4) এবং ইউরেট (urate, GLUT9) বহন করতে সক্ষম। বিভিন্ন গ্লুট ট্রান্সপোর্টার দেহের ভিন্ন ভিন্ন কোষ বা টিস্যুতে দেখা যায়, যেমন ভ্রূণ টিস্যু ও লোহিত রক্ত কণিকায় GLUT1, স্নায়ুকোষ ও প্লাসেন্টায় GLUT3 এবং মুষ্ককোষে GLUT14। প্রোটিন GLUT2 একটি দ্বিমুখী ট্রান্সপোর্টার, যার মাধ্যমে মুক্ত গ্লুকোজ অণুর কোষঝিল্লির এপার-ওপার উভয় দিকেই পরিবাহিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। GLUT2  দেখা যায় বৃক্কের টিউবুলার কোষ, যকৃত কোষ এবং অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলিতে। এছাড়া, এটি ক্ষুদ্রান্তের এপিথেলীয় বেসোল্যাটারাল (basolateral) মেমব্রেনেও উপস্থিত থাকে। গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টার এন্ডোথেলিয়াল, এপিথেলিয়াল এবং ট্রফোব্লাস্ট কোষ দ্বারা গ্লুকোজ গ্রহণ এবং পরিবহন প্রাথমিকভাবে GLUT1 ও GLUT3 দ্বারাই সম্পাদিত হয়। যদিও GLUT4 ট্রান্সপোর্টারের উপস্থিতি দেখা যায়, কিন্তু শেষোক্ত প্রোটিনটির অবস্থান স্থায়ী নয়। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখনো তর্ক শেষ হয়নি যে ভ্রূণের গ্লুকোজ গ্রহণ ও পরিবহনে ইন্সুলিনের কোনো ভূমিকা রয়েছে কি না। প্রসঙ্গতঃ GLUT পরিবারের সমস্ত প্রোটিন মানব ডিএনএ (DNA)-র SLC2 জিন দ্বারা সংকেত প্রাপ্ত।

কোষাভ্যন্তরে গ্লুকোজ প্রবেশে ইন্সুলিনের ভূমিকা

রক্ত প্রবাহ থেকে গ্লুকোজ প্রবেশ করে কোষাভ্যন্তরে ইন্সুলিনের সহায়তায় GLUT2 (যকৃত কোষে) ও GLUT4 (অ্যাডিপোজ টিস্যু ও পেশি কোষে) ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের মাধ্যমে। ইন্সুলিন গ্লুকোজকে সারা শরীরের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেয়- কোথাও (এডিপোজ টিস্যু) তা লাইপোজেনেসিস (lipogenesis) প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয় ট্রাইগ্লিসেরাইডে (triglyceride), আবার গ্লাইকোজেনেসিস (glycogenesis) প্রক্রিয়ায় কোথাও (পেশী কোষ, যকৃত) গ্লাইকোজেন-এ রূপান্তরিত হয়ে সঞ্চিত থাকে গ্লুকোজ, দেহের পরবর্তী চাহিদা মিটাতে। এটা জেনে রাখা ভালো যে, ইন্সুলিনের সঙ্গে গ্লুকোজের সরাসরি বন্ধন কোনো সময়ই ঘটে না। তবে, কোষপৃষ্ঠে অবস্থিত ইন্সুলিন রিসেপ্টর (Insulin receptor, Ins-R)র মাধ্যমে রক্তে প্রবাহিত গ্লুকোজ অণুগুলিকে কোষাভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য একটি আণবিক আবহ তৈরি করাটাই হচ্ছে ইন্সুলিনের মূল ভূমিকা। গ্লুকোজ হলো দেহে শক্তির উৎস। কোষের সাইটোপ্লাজমে গ্লুকোজের মূল কাজ হচ্ছে গ্লাইকোলাইসিস (glycolysis) প্রক্রিয়ায় এটিপি (ATP: adenosine triphosphate) রূপে শক্তি তৈরি করা এবং সে প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন পাইরুভেট অনু কোষের মাইটোকোন্দ্রিয়ায় প্রবেশ করে, যেখানে  কোষের অধিকাংশ শক্তি ATPরূপে উৎপন্ন হয়। তাই গ্লুকোজের কোষাভ্যন্তরীণকরণের এই প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব পড়েছে ইনসুলিনের ওপর। ফলে, ইনসুলিনের কাজ হচ্ছে গ্লুকোজকে কীভাবে সুচারুরূপে কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো যায় তা নিশ্চিৎ করা। ইন্সুলিন এই কাজটি করে তার স্বকীয় রিসেপ্টর (Ins-R) ও কোষের কতিপয়  উৎসেচক (enzyme)কে সক্রিয় করার মাধ্যমে, এবং সে কাজটি করতেও তার একটি নির্দিষ্ট সংকেতপ্রবাহের পথ অনুসরণ করতে হয় (ছবি দেখুন ও বিস্তারিত জানুন: ‘দেহে গ্লুকোজের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে আলফা ও বিটা কোষ উভয়ই অংশীদার’, https://www.bishleshon.com/6077/)। তাহলে এটা খুব স্পষ্ট যে, গ্লুকোজের সঙ্গে সরাসরি বন্ধন GLUT প্রোটিনের, ইনসুলিনের সঙ্গে নয়। তবে, এটাও অনস্বীকার্য যে, এই বন্ধনটি সম্ভব হয়েছে ইনসুলিনের সহযোগিতায়।

গ্লুকোজ হলো দেহে শক্তির উৎস

গ্লুকোজ থেকে শক্তি উৎপাদনের কৌশল হিসেবে অণুজীব থেকে উচ্চতরজীবসহ মানুষ পর্যন্ত তিনটি প্রধান প্রক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছে: গ্লাইকোলাইসিস, সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র বা ক্রেবস চক্র ও অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশন, যার এনজাইম-ভিত্তিক পর্যায়ক্রমিক বিস্তারিত রাসায়নিক বিক্রিয়া এই প্রবন্ধে ব্যাখ্যাত হয় নি (বিস্তারিত জানতে পড়ুন কোনো পাঠ্যপুস্তক), কারণ এটি কোষে গ্লুকোজের অবদান নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক লেখা। এই তিনটি প্রক্রিয়ার ফলাফলে একটি গ্লুকোজ অণু ভেঙে তৈরি হয় শক্তিরূপে ৩৬ থেকে ৩৮টি ATP। স্বাভাবিক অবস্থায় একটি ATP অণু উৎপন্ন করে প্রায় ৮ Kcal শক্তিl ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষ পর্যন্ত সকল জীবের জন্য গ্লুকোজ হলো সার্বজনীন জ্বালানী-শক্তির একটি প্রধান উৎস। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে কিছু টিস্যু তাদের বিপাকীয় শক্তির জন্য সম্পূর্ণরূপে গ্লুকোজের ওপর নির্ভরশীল, যেমন মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, লোহিত রক্ত কণিকা, বৃক্ক, ভ্রূণীয় টিস্যু ইত্যাদি। 

গ্লুকোজ অবক্ষয়ের মাধ্যমে, এমনকি অক্সিজেনের অনুপস্থিতেও, ATP-রূপে শক্তি তৈরির যে প্রক্রিয়া গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) তা উদ্ভব হয়েছিল আদিকোষীয় জীবে, অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ায়।  কোষের সাইটোপ্লাজমে সংঘটিত গ্লাইকোলাইসিসের মাধ্যমে গ্লুকোজ (C6H12O6) অণু দশটি এনজাইমের পর্যায়ক্রমিক অনুঘটনে অবশেষে রূপান্তরিত হয় পাইরুভিক অ্যাসিড (CH3COCO2H) বা পাইরুভেট অণুতে। এই প্রক্রিয়ায় মুক্ত হয় উচ্চ-শক্তি সম্পন্ন অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট (ATP) এবং বিজারিত নিকোটিনামাইড অ্যাডিনাইন ডাইনিউক্লিওটাইড (NADH)। যেহেতু গ্লাইকোলাইসিস একটি অতি প্রাচীন বিপাকীয় পদ্ধতি, যার উদ্ভব হয়েছিল ৪,০০০ থেকে ২,৫০০ মিলিয়ন বছর আগে, যখন আর্কিয়ান মহাসাগরে অক্সিজেনের উপস্থিতি ছিল না, তখন সে সময়ে এনজাইমের অনুপস্থিতিতে গ্লাইকোলাইসিস সম্পন্ন হতো কিছু ধাতুর অনুঘটন প্রক্রিয়ার দ্বারা। সে সময়ে আরও একটি সমান্তরাল বিপাকীয় পথের উদ্ভব হয়েছিল, যা পেন্টোজ ফসফেট (pentose phosphate pathway) পদ্ধতি  নামে অভিহিত, যার মাধ্যমে উৎপন্ন হয় NADH, পেন্টোজ (pentose) চিনি ও নিউক্লিওটাইডের পূর্বসূরি রাইবোজ ৫-ফসফেট (ribose 5-phosphate)। লোহিত রক্ত কণিকায় (এরিথ্রোসাইট) এই পদ্ধতি এখনও রয়ে গেছে এবং সেখানে এই পথটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে সে সময়ে আরো একটি জীবনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সম্প্রতি আবিষ্কৃত (২০১৯) সেই অণুজীবগুলি  এখনো রয়ে গেছে এবং অক্সিজেন নয়,  বরং সালফার পরমাণুই হচ্ছে তাদের জীবন। ভূপৃষ্ঠের ৮০০০ ফুট নীচে বাস করা কিছু অণুজীব, যেমন সালফিডোজেনিক (sulfidogenic) অণুজীব, আণবিক অক্সিজেন (O2) এর পরিবর্তে “শ্বাস নেয়” সালফেট (SO42-)। অবাত শ্বসনে  তারা প্রান্তিক ইলেক্ট্রন গ্রহণকারী হিসেবে  সালফেট ব্যবহার করে, সাথে তৈরি করে হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S)। 

গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়াকে প্রাথমিকভাবে দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: বিনিয়োগ ফেজ ও পে-অফ ফেজ। একটি ATP অণুর বিনিয়োগে গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয় ও হেক্সোকাইনেজ বা গ্লুকোকাইনেজ (যকৃত কোষে) এনজাইমের সাহায্যে তৈরি হয় একটি গ্লুকোজ ৬-ফসফেট অণু (গ্লুকোজ অণুর ৬নং কার্বনে যুক্ত হয় একটি ফসফেট)। গ্লুকোজের এই রূপান্তরটি একটি অভিনব কৌশল বলা যেতে পারে। কারণ, কোষের ভিতরে গ্লুকোজের প্রবেশ মাত্রই তাকে কোষাভ্যন্তরে আটকানো জরুরী, নইলে দ্বিমুখী GLUT ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে সে কোষের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে, GLUT ট্রান্সপোর্টার গ্লুকোজ ৬-ফসফেটকে বেরিয়ে যেতে অনুমতি দেয় না। বিনিয়োগ দশায় শক্তি যোগাতে দুইটি ATP খরচ করা হয়। গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় দেখা যায়  যে, কার্বন বন্ধনের নমনীয় বিশিষ্টতার কারণে ৬-কার্বন গ্লুকোজ তিন-কার্বনবিশিষ্ট দুটি ফসফেট-যুক্ত (ডাইহাইড্রোক্সি অ্যাসিটোন ও ফসফেট গ্লিসেরালডিহাইড ৩-ফসফেট)অণুতে বিভক্ত হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে পাইরুভেট কাইনেজ দ্বারা পরিণত হয় পাইরুভেটে-এক অণু গ্লুকোজ থেকে তৈরি হয় দুই অণু পাইরুভেট। গ্লাইকোলাইসিস বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় একটি গ্লুকোজ অণু ভেঙে দুইটি তিন-কার্বনবিশিষ্ট পাইরুভেট অণুতে রূপান্তর হতে খরচ হয় দুইটি ATP, কিন্তু খরচ বাদ দিয়ে নিট অর্জন হয় ২টি ATP, আর ২টি ইলেক্ট্রন দাতা, NADH।

গ্লাইকোলাইসিসের সামগ্রিক প্রক্রিয়া হল:  Glucose + 2 NAD+ + 2 ADP + 2 Pi → 2 pyruvate + 2 NADH + 2 H+ + 2 ATP।  গ্লাইকোলাইসিস সম্পন্ন করতে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না, তাই এই প্রক্রিয়াটি অ্যানারোবিক।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ অক্সিজেনের অপর্যাপ্ততায় ল্যাকটিক অ্যাসিড গাঁজন প্রক্রিয়ায় পাইরুভেট অণুকে ল্যাকটেট-এ রূপান্তর করা যেতে পারে:  পাইরুভেট + NADH + H+ → ল্যাকটেট + NAD+; নতুবা, অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পাইরুভেট মাইটোকন্ড্রিয়ায় প্রবেশ ক’রে পাইরুভেট ডিকারবক্সিলেশন (decarboxylation) নামক প্রক্রিয়ায় ২-কার্বনবিশিষ্ট অ্যাসিটিল-কোএ (Acetyl CoA)-তে রূপান্তরিত হয়ে ক্রেব’স/সাইট্রিক অ্যাসিড চক্রের সূচনা করতে পারে। পাইরুভেট জারিত হয় পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজ (pyruvate dehydrogenase) কমপ্লেক্স দ্বারা, উৎপন্ন করে অ্যাসিটিল-কোএ ও CO2।  

পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেজ (pyruvate dehydrogenase) এবং কার্বক্সিলেজ (carboxylase) এনজাইমদুটি মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্সে অবস্থান করে। তাই পাইরুভেটকে সাইটোসল থেকে মাইটোকন্ড্রিয়ার বহিঃস্ত ও আভ্যন্তর উভয় ঝিল্লির মধ্য দিয়ে পরিবাহিত হতে হয় দুইটি বাহক প্রোটিন (VDAC- Voltage-dependent anion channel ও MPC- Mitochondrial pyruvate carrier)র মাধ্যমে। সংক্ষেপে, সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র (ক্রেব’স চক্র) হলো একটি ৮-পদক্ষেপ প্রক্রিয়া,  যেখানে ৮টি ভিন্ন এনজাইম ও অন্যান্য কো-এনজাইম জড়িত। প্রক্রিয়া চলাকালীন, অ্যাসিটিল-কোএ (২ কার্বন)+ অক্সালোঅ্যাসিটেট (৪ কার্বন) একীভূত বা  ঘনীভূত হয়ে উৎপাদন করে একটি সাইট্রেট অণু (৬ কার্বন), যা আরও প্রতিক্রিয়াশীল আকারে পুনর্বিন্যসিত হয় আইসোসাইট্রেট (৬ কার্বন)-এ। জারণ প্রক্রিয়ায় আইসোসাইট্রেট পরিবর্তিত হয়ে α-কিটোগ্লুটারেট (৫ কার্বন) ও সাকসিনিল-কোএ (৪-কার্বন) এবং সেখান থেকে সাক্সিনেট (৪-কার্বন), ফিউমারেট (৪-কার্বন), ম্যালেট (৪-কার্বন) এবং অবশেষে পূনরুদ্ধার হয়  অক্সালোঅ্যাসিটেট (৪-কার্বন)। একটি চক্র থেকে নিট অর্জন হয় ৩টি NADH, ১টি FADH2, প্রোটন প্লাস ইলেকট্রন বহনকারী যৌগ, এবং ১টি উচ্চ-শক্তি জিটিপি (GTP), যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয় এটিপি-তে, সাথে নির্গত হয় ২টি CO2।  যেহেতু প্রতিটি গ্লুকোজ অণু থেকে দুটি অ্যাসিটিল-কোএ অণু উত্পাদিত হয়, তাই প্রতি গ্লুকোজ অণুতে দুটি চক্রের প্রয়োজন হয়। এইভাবে, ১ গ্লুকোজ অণু (২ পাইরুভেট অণু তৈরি হবার ফলে)-র থেকে মোট ফলন হয় ৬টি NADH, ২টি FADH2, এবং ২টি ATP।

‘শ্বসন’ শব্দটি মানেই শুধু শ্বাস নেয়া নয়, কোষীয় শ্বসন (গ্লাইকোলাইসিস, সাইট্রিক অ্যাসিড বা ক্রেবস চক্র  এবং অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশন) আসলে একটি বিপাকীয় প্রক্রিয়া যা গ্লুকোজ ভেঙ্গে এটিপি নামক কোষীয় শক্তি উৎপন্ন করে। কোষীয় শ্বসন আদিকোষীয় (ব্যাকটেরিয়া) ও প্রকৃতকোষীয় (ইউক্যারিওট) উভয় জীবেই সম্পন্ন হয়। যেহেতু আদিকোষীয় জীবে মাইটোকন্ড্রিয়া নামক কোনো অঙ্গাণু থাকে না, তাই সেখানে ক্রেবস চক্রসহ কোষীয় শ্বসনের প্রতিটি প্রক্রিয়া ঘটে থাকে সাইটোপ্লাজমে ও প্লাজমা মেমব্রেনে। অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের মতে মাইটোকন্ড্রিয়া এক সময়ে ছিল স্বতন্ত্র ব্যাকটেরিয়া, যেমন ছিল উদ্ভিদ কোষের ক্লোরোপ্লাস্ট। জীব বিবর্তনের কোনো এক সময় এই আগন্তক এসে পড়ে প্রকৃতকোষে এবং সেই থেকে অন্তঃমিথোজীবী পরিচয় নিয়ে প্রকৃতকোষীয় জীবদের সাথেই রয়ে গেল চিরতরে। অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশনের দুটি অংশ রয়েছে: ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন (electron transfer chain, ETC) এবং কেমিওসমোসিস (chemiosmosis)। প্রকৃতকোষীয় জীবে, মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্রিষ্টিতে অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশন ঘটে। এই প্রক্রিয়াটি চার-প্রোটিন-কমপ্লেক্সবিশিষ্ট একটি ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন নিয়ে গঠিত যা ক্রেবস চক্র থেকে উৎপন্ন NADH ও FADH-কে জারণ করে, ব্যাকটেরিয়া ও মাইটোকন্ড্রিয়া উভয় ক্ষেত্রেই, আভ্যন্তরীণ ঝিল্লিজুড়ে একটি ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল প্রোটন গ্রেডিয়েন্ট স্থাপন করে এবং ইলেকট্রনের প্রবাহ অবশেষে গিয়ে পৌঁছয় গ্রহীতা আণবিক অক্সিজেনের কাছে। ফলশ্রুতিতে, অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশন প্রক্রিয়ায় এটিপি সিন্থেজ (ATP synthase) এনজাইমের মাধ্যমে শক্তির অণু হিসেবে ADP ফসফোরিলেশনের মাধমে এটিপি সংশ্লেষিত হয়। এটি সবাত শ্বসনেরই অঙ্গ,  যেখানে  ATP উৎপাদনের জন্য ইলেকট্রনগুলি আসে ইলেক্ট্রন দাতা NADH ও FADH থেকে। ৪টি H+/প্রোটনের পক্ষে এটিপি সিন্থেজ একটি এটিপি (ATP) অণু সংশ্লেষ করে। গ্লাইকোলাইসিস ও ক্রেবস চক্রের তুলনায়, যেখানে উৎপন্ন হয় মাত্র ২টি করে এটিপি, সেখানে ETC-অক্সিডেটিভ ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে ৩২ থেকে ৩৪টি এটিপি অণু তৈরি হয়। অর্থাৎ, একটি ৬-কার্বনবিশিষ্ট গ্লুকোজ অণু ব্যবহার করে  উপরোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সর্বমোট ৩৬ থেকে ৩৮টি এটিপি অণু। একটি কোষের জন্য এটি এক বিশাল অর্জন।

অনাহারে-স্বল্পাহারে গ্লুকোজের প্রাপ্তি

দীর্ঘ সময় ধরে অনাহার, স্বল্প শর্করাজাতীয় খাবার গ্রহণ বা অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে রক্ত প্রবাহে দেখা দেয় গ্লুকোজের অনাটন. এবং সেক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হবার সম্ভাবনাও থাকে অনেক বেশি। ফলে দেহের শক্তি যোগাতে নির্ভরশীল হতে হয় সঞ্চিত গ্লুকোজ (গ্লাইকোজেন) বা বিভিন্ন গ্লুকোজেনিক পদার্থের ওপর, যারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাময়িকভাবে গ্লুকোজ অণু তৈরি করতে সক্ষম। গ্লুকোনিওজেনেসিস (gluconeogenesis) তেমনি একটি সর্বব্যাপী বিপাকীয় প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট অ-শর্করা (যেমন গ্লুকোজেনিক অ্যামিনো অ্যাসিড, ল্যাকটিক অ্যাসিড/ল্যাকটেট, পাইরুভেট ও গ্লিসেরল) অণু থেকে গ্লুকোজ তৈরি হয়। ট্রাইগ্লিসেরাইড ভেঙে রূপান্তরিত হয় গ্লিসেরল ও ফ্যাটি অ্যাসিডে। প্রোটিন পদার্থের বিপাকীয় বিশ্লেষণে কোষে  মুক্ত হয় অ্যামিনো অ্যাসিড (গ্লুকোজেনিক ও কিটোজেনিক)। ১৩টি গ্লুকোজেনিক অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে, তম্মধ্যে  অ্যালানিন (alanine) ও গ্লুটামিন (glutamine) হচ্ছে গ্লুকোজ তৈরির প্রধান উৎস। এছাড়াও, অনাহারের সময় ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে প্রাপ্ত কিটোন বডি ১১% পর্যন্ত গ্লুকোনিওজেনেসিসে অবদান রাখতে পারে। গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়া দেখা যায় প্রায় সমস্ত জীবেই- ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলে। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে গ্লুকোনিওজেনেসিস অধিকাংশক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে যকৃতে এবং কিছুটা হলেও ঘটে বৃক্কের কর্টেক্স, পেশি, অন্ত্র ও মস্তিষ্কের অ্যাস্ট্রোসাইটে (astrocyte)। গ্লুকোনিওজেনিক পূর্বসূরি হিসাবে, যকৃত ব্যবহার করে তিন-কার্বনবিশিষ্ট  ল্যাকটেট (C3H6O3), গ্লিসারল (C3H8O3) এবং অ্যামিনো অ্যাসিড, অ্যালানিন (C3H7NO2)। গ্লাইকোজেনোলাইসিস (গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজ তৈরি) ও গ্লুকোনিওজেনেসিস এই দুটি প্রক্রিয়া রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখতে ও হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়াতে প্রায় সমস্ত জীবেই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে, কিছু টিস্যু তাদের বিপাকীয় শক্তির জন্য সম্পূর্ণরূপে গ্লুকোজের ওপর নির্ভরশীল, যেমন মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, লোহিত রক্ত কণিকা, বৃক্ক, ভ্রূণীয় টিস্যু ইত্যাদি।

কোরি চক্র  (Cori cycle) থেকে উৎপন্ন ল্যাকটেট পাইরুভেটে রূপান্তরিত হয় ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজিনেজ (lactate dehydrogenase) এনজাইম দ্বারা। গ্লুকোনিওজেনেসিস এবং গ্লাইকোলাইসিস এই দুটি প্রক্রিয়া মূলতঃ একই এনজাইমের অনুঘটনে পরস্পর বিপরীত দিকে সংঘঠিত হয়। গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ার ১০টি এনজাইম বিক্রিয়ার মধ্যে ৭টি বিক্রিয়া পূর্বানুবৃত্তিমূলক (reversible), অর্থাৎ একটির থেকে আরেকটিতে ফিরে আসা যায়; কিন্তু তিনটি বিক্রিয়া অনিবর্তনীয় (irreversible), যেমন হেক্সোকাইনেজ/গ্লুকোকাইনেজ, ফসফোফ্রুকটোকাইনেজ এবং পাইরুভেট কাইনেজ-জনিত বিক্রিয়া (দেখুন ছবি)। গ্লাইকোলাইসিসের এই তিনটি এনজাইমকে গ্লুকোনিওজেনেসিসে প্রতিস্থাপিত করা হয় গ্লুকোজ-৬-ফসফাটেজ (Glucose-6-phosphatase, G6Pase), ফ্রুক্টোজ-1,6-বিসফসফেটেজ (Fructose bisphophatase, FBPase) এবং পেপ কার্বোক্সিকাইনেজ (Phosphoenol pyruvate carboxykinase, PEPCK) দ্বারা। গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণ করতে এই অনিবর্তনীয় তিনটি জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন তিনটি এনজাইম ব্যবহার করা হয় (ছবি দেখুন)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ গ্লুকোজ বিপাক সংক্রান্ত তিনটি প্রক্রিয়া (গ্লাইকোলাইসিস, গ্লাইকোজেনোলাইসিস ও গ্লুকোনিওজেনেসিস) সংঘটিত হয় সাইটোপ্লাজমে; তবে, গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে সহযোগিতা প্রয়োজন মাইটোকন্ড্রিয়া ও মসৃন এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের। গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় পাইরুভেট কার্বোক্সিলেজ (pyruvate carboxylase) দ্বারা পাইরুভেট থেকে তৈরী হয় অক্সালোএসিটেট, যা ঘটে  শুধুমাত্র মাইটোকন্ড্রিয়ায় ক্রেবস চক্রের মাধ্যমে।  অক্সালোএসিটেট (Oxaloacetate)কে সাইটসলে বের করার জন্য মাইটোকন্ড্রিয়ার ঝিল্লিতে কোনো ট্রান্সপোর্টার নেই। ফলে, ম্যালেট ডিহাইড্রোজিনেজ বিজারণের মাধ্যমে অক্সালোএসিটেট-কে প্রথমে ম্যালেটে (malic acid) রূপান্তরিত হওয়া আবশ্যক। নিজস্ব ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে ম্যালেট মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসে সাইটোসলে, যেখানে ম্যালেট ডিহাইড্রোজিনেজ দ্বারা ম্যালেট  জারিত হয়ে আবারো ফিরে যায় অক্সালোঅ্যাসিটেটে। অক্সালোঅ্যাসিটেটের মাধ্যমে গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটির হয় সূচনা এবং প্রক্রিয়াটির অন্তিমে গিয়ে তৈরি হয় গ্লুকোজ-৬-ফসফেট, যা এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে প্রবেশ করে G6Pase এনজাইম দ্বারা রূপান্তরিত হয় মুক্ত গ্লুকোজে। এছাড়া, গ্লাইকোলাইসিস বা গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় যে বাকি এনজাইমগুলি প্রয়োজন সেগুলি সবই পাওয়া যায় সাইটোসলে। মুক্ত গ্লুকোজ কোষ থেকে নির্গত হয় রক্ত প্রবাহে GLUT2 (যকৃত কোষে) ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের মাধ্যমে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক্সারগোনিক বিক্রিয়ায় পাইরুভেট থেকে গ্লুকোজ-৬-ফসফেট তৈরী হওয়ার (গ্লুকোনিওজেনেসিস) প্রক্রিয়াটি পরিচালনার জন্য ৪ অণু ATP এবং ২ অণু GTP প্রয়োজন পড়ে। এই ATP গুলি ফ্যাটি এসিডের অক্সিডেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।

বিভিন্ন প্রোটিন ফ্যাক্টর ও হরমোন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে। ইন্সুলিন ও গ্লুকাগন বিপরীতমুখী প্রভাব ফেলে। অনাহার অবস্থায় গ্লুকাগন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটিকে উদ্দীপিত করে; আর, রক্তে গ্লুকোজের আধিক্যে ইন্সুলিন তা রোধ করে। গ্লুকাগন (Glucagon) ও ইন্সুলিন (Insulin) মূলতঃ তাদের কাজটি করে ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের মাধ্যমে। গ্লুকাগন হরমোনের সক্রিয়তায় অনাহার অবস্থায় ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর CREB (cAMP response element binding protein), FoxO1 (forkhead transcription factor) ও FoxO6 প্রোটিন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত জিনদের (যেমন PEPCK, G6Pase, Fbpase, এবং pyruvate carboxylase) উদ্দীপিত করে ও তাদের প্রকাশকে বৃদ্ধি করে। অপরদিকে, রক্তে গ্লুকোজের প্রাচুর্য্যে ইনসুলিনের সক্রিয়তায় প্রোটিন কাইনেজ B (Akt) দ্বারা FoxO1 ও FoxO6কে ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে তার ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করে। ফলে, গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটি স্থগিত হয়ে যায়। ইনসুলিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাবার (insulin resistance) ফলে ইনসুলিন FoxO6-কে ব্লক করতে ব্যর্থ হয়, ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অধিক থাকা সত্ত্বেও গ্লুকোনিওজেনেসিস অব্যাহত থাকে, দেহে সৃষ্টি হয় হাইপারগ্লাইসেমিয়া (hyperglycemia)। এই অবস্থায় ওষুধ মেটফরমিন FoxO6কে বাধা দিতে সমর্থ হয়। এই কারণে গ্লুকোনিওজেনেসিস হলো টাইপ২ ডায়াবেটিস থেরাপির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এছাড়াও, গ্লুকোনিওজেনেসিস এপিনেফ্রিন, নর-এপিনেফ্রিন, কর্টিসল, থাইরয়েড হরমোন এবং গ্রোথ হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। 

গ্লুকোজের পর্যাপ্ত সরবরাহে কোষে তৈরি হয় গ্লুকোজভান্ডার

রক্ত প্রবাহে গ্লুকোজের পরিমাণ যখন অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন  দেহে মূলতঃ যকৃত ও পেশি কোষে গ্লুকোজ সঞ্চিত থাকে গ্লাইকোজেন হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ: যকৃতে ও পেশিতে গ্লাইকোজেন সঞ্চিত থাকে যথাক্রমে প্রায় ১৫০ গ্রাম ও ২৫০ গ্রাম। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় গ্লাইকোজেনেসিস (glycogenesis), যা জীব সৃষ্টির আদি থেকেই এই সঞ্চয়ের প্রবণতা দেখা যায় আর্কিয়া, ব্যাকটেরিয়া ও হেটেরোট্রপ জীবে এবং কতটা অল্প পরিসরে লক্ষ-লক্ষ গ্লুকোজ অণুগুলিকে থরে-বিথরে সাজানো যায় তার কৌশল দেখলে আধুনিক গ্রন্থাগারগুলিও হার মেনে যায় (ছবি দেখুন)। উদ্ভিদ কোষের একটি বিশেষ অঙ্গাণু অ্যামেলোপ্লাস্টে স্টার্চ থাকে অ্যামাইলোপেকটিন (amylopectin) হিসেবে। গ্লাইকোজেনেসিস প্রক্রিয়াটিতে গ্লুকোজ ছাড়াও প্রয়োজন ATP (adenosine triphosphate) ও UTP (uridine triphosphate), সাথে প্রয়োজন পাঁচটি অপরিহার্য এনজাইম। এ ছাড়াও গ্লাইকোজেন নির্মাণের জন্য প্রয়োজন একটি প্রোটিন-নির্ভর ভিত্তি বা পত্তন যার ওপর ভর করে তৈরি হয় গ্লাইকোজেনের একাধিক শাখা (ছবি দেখুন)। প্রাণিকূলে এই ভিত্তি স্থাপনকারী প্রোটিনটি হচ্ছে গ্লাইকোজেনিন (glycogenin)। কোষাভ্যন্তরে গ্লুকোজ-৬-ফসফেট এনজাইম ফসফোগ্লুকোমিউটেজ (phosphoglucomutase) দ্বারা রূপান্তরিত হয় গ্লুকোজ-১-ফসফেট অণুতে, যা এনজাইম ইউডিপি-গ্লুকোজ পাইরোফসফোরিলেজের (UDP-glucose pyrophosphorylase) অনুঘটনে পরিবর্তিত হয় ইউডিপি-গ্লুকোজ (UDP-glucose) অণুতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ পাইরোফসফাটেজ (pyrophosphatase) এনজাইমের মাধ্যমে গঠিত হয় পাইরোফসফেট যা UDP-গ্লুকোজ গঠনে সহায়ক। গ্লাইকোজেনিন প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করে গ্লাইকোজেন পলিমারের শৃঙ্খল তৈরি করতে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন সাতটি গ্লুকোজ মনোমারের একটি প্রাইমার (primer), যার সূত্র ধরে গ্লাইকোজেন সিনথেজ (glycogen synthase) এনজাইম UDP-গ্লুকোজ সংযুক্ত ক’রে ক্রমবর্ধমান গ্লাইকোজেন চেইনটি সৃষ্টি করে। পলিমার শৃঙ্খলে রৈখিকভাবে বেশিরভাগ গ্লুকোজ অণুগুলি একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে α-১,৪ (কার্বন ১ → কার্বন ৪) গ্লাইকোসিডিক (glycosidic) বন্ড দ্বারা এবং প্রতি দশ থেকে বিশটি গ্লুকোজ অণুসহ সৃষ্টি হয় একটি নতুন শাখা, যা পূর্ববর্তী শাখার সাথে যুক্ত থাকে একটি α-১,৬-গ্লাইকোসিডিক বন্ড দ্বারা। এইভাবে গ্লাইকোজেন পলিমারের অসংখ্য শাখা তৈরি করে এক চাঞ্চল্যকর ‘গ্লাইকোজেন ব্রাঞ্চিং এনজাইম’ (glycogen branching enzyme, GBE)। Escherichia coli জিনোমে, গ্লাইকোজেন বিপাকের জন্য পাঁচটি অপরিহার্য জিন একটি একক অপেরন (operon glgBXCAP) অঞ্চলে  সংগঠিত থাকে, যা একটি মাত্র জিন ‘প্রমোটর’ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। আর, মানব জিনোমে GBE1 জিনটি অবস্থান করে ৩নং ক্রোমোজোমে।

দীর্ঘকালীন অনাহারে দেহের রক্ত প্রবাহে শর্করাজাতীয় পদার্থের ঘাটতিতে অগ্নাশয়ের আলফা কোষ থেকে নিঃসৃত গ্লুকাগন হরমোন ছুটে যায় যকৃতে- মুক্ত করে গ্লুকোজ অণুগুলিকে গ্লুকোজভাণ্ডার (গ্লাইকোজেন) থেকে মোট চারটি এনজাইমের সাহায্যে। এই প্রক্রিয়াটি হলো গ্লাইকোজেনোলাইসিস (glycogenolysis)। ঠিক যেভাবে এক অভিনব কৌশলে গ্লুকোজগুলিকে সাজানো হয়েছিল পলিমারগু, ঠিক তার উল্টোপথে গ্লুকোজগুলিকে মুক্ত করা হয় গ্লাইকোজেন থেকে। গ্লাইকোজেনের একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খল থেকে ফসফোরোলাইসিস (phosphorolysis) প্রক্রিয়ায় গ্লাইকোজেন ফসফরিলেজ (glycogen phosphorylase) এনজাইমের মাধ্যমে (শেষের চারটি গ্লুকোজ অণু ছাড়া) গ্লুকোজ ১-ফসফেট অণুগুলি  পলিমার থেকে মুক্ত হয়। গ্লুকোজ-১-ফসফেট থেকে গ্লুকোজ-৬-ফসফেটে রূপান্তরিত হয় এনজাইম ফসফোগ্লুকোমিউটেজ (phosphoglucomutase) দ্বারা। গ্লুকোজ-৬-ফসফেট প্রবেশ করে যকৃতের এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম (endoplasmic reticulum, ER) অঙ্গাণুতে GLUT1 ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে, যেখানে অবস্থান করছে গ্লুকোজ-৬-ফসফাটেজ (glucose-6-phosphatase, G6Pase) এনজাইম, যা ৬ নং কার্বন থেকে ফসফেটকে অপসারণ করে মুক্ত করা হয় ব্যবহারযোগ্য গ্লুকোজ অণুতে।  তবে. অন্ত্র, পেশী, মস্তিষ্ক ও কিডনি কোষে G6Pase না থাকার কারণে মুক্ত গ্লুকোজ সৃষ্টিও হয় না এবং রক্তেও ফিরে আসে না। এছাড়া, গ্লুকোজ-৬-ফসফেট অণুর জন্য পেশি কোষে কোনো নির্ধারিত GLUT ট্রান্সপোর্টার-ও অবস্থান করে না। শুধুমাত্র, ফসফেট-মুক্ত গ্লুকোজ GLUT2 ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে ER থেকে ও অবশেষে যকৃত কোষ থেকে ফিরে আসে রক্ত প্রবাহে। উল্লেখিত গ্লাইকোজেন শৃঙ্খলের যে চারটি গ্লুকোজ অণু অবশিষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে তার তিনটি অণু গ্লাইকোজেনের নিকটস্থ পার্শ্ববর্তী শৃঙ্খলে স্থানান্তরিত হয় গ্লাইকোজেন ডিব্র্যাঞ্চিং (glycogen debranching enzyme) উৎসেচকের মাধ্যমে।  ডিব্র্যাঞ্চিং এনজাইম পরিবার দুইটি এনজাইম নিয়ে গঠিত- ট্রান্সফারেজ (transferase) ও আলফা-গ্লুকোসিডেজ (α-glucosidase)। পূর্ববর্তী শৃঙ্খলের অন্তিম গ্লুকোজটি যা পার্শ্ববর্তী শৃঙ্খলের সাথে গ্লাইকোসাইড (glycoside) বন্ধন (কার্বন ১→৬) দিয়ে যুক্ত তা আলফা-গ্লুকোসিডেজ এনজাইম দ্বারা ভেঙে ফেলে তাকেও মুক্ত করা হয়। এভাবেই, দেহে গ্লুকোজের অভাব মিটাতে, প্রয়োজনবোধে একের পর এক শৃঙ্খল থেকে সঞ্চিত গ্লুকোজ অণুগুলিকে মুক্ত করে বজায় রাখা হয় গ্লুকোজের ভারসাম্যতা। রক্তে শর্করার মাত্রার প্রতিক্রিয়া হিসেবে গ্লাইকোজেনোলাইসিস প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত হয় গ্লুকাগন, ইনসুলিন ও এপিনেফ্রিন হরমোন দ্বারা।

উপসংহার

সৃষ্টিকর্তা এই মর্তলোকে জীবজগতের সকল জীবন কার্বন উপাদানের ওপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি করেছেন, সিলিকন বা অন্য কোনো মৌলিক উপাদানের উপর ভিত্তি করে নয়। দেহে শুধু কার্বন-ই নয়, সাথে রয়েছে আরও পাঁচটি মূল উপাদান -অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম, ও ফসফরাস- যা গঠন করেছে আমাদের দেহের ৯৯ শতাংশ। কার্বন তার সমস্ত প্রতিবেশী উপাদানগুলির সাথে চারটি পারমাণবিক বন্ধন তৈরি করে ও বন্ধনগুলির শক্তি হয় একই রকম। পক্ষান্তরে, সিলিকন-ও চারটি পারমাণবিক বন্ধন তৈরি করার সক্ষমতা রাখে- কিন্তু, সিলিকনের অন্যান্য উপাদানগুলির সাথে বন্ধন অনেক বেশি দৃঢ় ও স্থিতিশীল, তাদের আলাদা করা খুব কঠিন। কার্বনবন্ধনগুলির ক্ষেত্রে তা নয়- জৈব অণুতে কার্বন-কার্বন, কার্বন-অক্সিজেন, কার্বন-হাইড্রোজেন এবং কার্বন-নাইট্রোজেন বন্ধন সবই প্রায় একই রকম। এর মানে হলো যে, শক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, পরমাণুগুলিকে অদলবদল করা বেশ সহজ। সেই সহজ রদবদল, যেমন আইসোমেরাইজেশন, ৬-কার্বন অণু থেকে ৫-,৪-, বা ৩-কার্বন অণুতে রূপান্তর (বা তার বিপরীত) ইত্যাদি, আমরা দেখেছি গ্লাইকোলাইসিস, ক্রেবস চক্র ও অন্যান্য প্রক্রিয়াগুলিতে। কোষের গ্লুকোজ অণুগুলি তাদের সমযোজী বন্ধনে প্রচুর সংগঠিত শক্তি ধারণ করে। তাই, ওইসব পুনর্বিন্যাসে তাদের কোভ্যালেন্ট বন্ডগুলিতে সঞ্চিত শক্তি (যেমন C – H ৯৮ kcal/mole, C – O ৭৮ kcal/mole, C – N ৬৫ kcal/mole ইত্যাদি) মুক্তি পেয়েও যায়। আমরা শ্বাসের সাথে অক্সিজেন নিই, ত্যাগ করি আঙ্গারিক গ্যাস (কার্বন ডাই অক্সাইড)। ভাবুন তো আমরা ত্যাগ করছি সিলিকন ডাই অক্সাইড – সে তো সিলিকন-ভিত্তিক নুড়ি, আর বালি। একশর্করা অণুগুলির মধ্যে শরীরের প্রতিটি কোষ গ্লুকোজ-কেই প্রাধান্য দিয়েছে জ্বালানী হিসেবে, ফ্রুক্টোজ বা গ্যালাকটোজ-কে নয়। তাই, অশিকাংশ ক্ষেত্রে, ফ্রুক্টোজ কোষে রূপান্তরিত হয় গ্লুকোজে। যকৃতই একমাত্র অঙ্গ, যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফ্রুক্টোজ বিপাক করতে পারে। তাছাড়া, অতিরিক্ত ফ্রুক্টোজ গ্রহণে ফ্যাটি লিভার এবং প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলির চারপাশে ভিসারাল ফ্যাট জমতে পারে। এছাড়া, গ্লুকোজের শক্তি উৎপাদনের হার ফ্রুক্টোজের চেয়ে তিনগুণ বেশি। তাই সবকিছু ভেবেই দেহ বেছে নিয়েছে কার্বন-ভিত্তিক গ্লুকোজ অনুকে তার শক্তি উৎপাদনের উৎস হিসেবে।