০৭:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং ও কাউন্সেলিং পদ্ধতি

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ০৪:৪৩:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২
  • / ১২৯৬ বার পড়া হয়েছে

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর প্রতীকী চিত্র | পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সরকার

মনস্তত্ত্ববিদেরা মনে করেন সুস্থ ও উন্নত বিবাহিত জীবন পেতে হলে অবশ্যই প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং বা পরামর্শ নেওয়া দরকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবাহিত জীবনে দুই জন মানুষের মধ্যে যেসব সমস্যা দেখা যায়, তার অনেকটাই আসে ভুল প্রত্যাশা থেকে এবং বিয়ে-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানার কারণে। প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর সাহায্যে এই বিষয়গুলোর মোকাবিলা করা যায়। এই কারণেই একজন পরিবার কল্যাণ কর্মী হিসেবে ভবিষ্যৎ দম্পতিকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং কী এবং কোন পদ্ধতিতে প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং করা যেতে পারে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং

কাউন্সেলিং জেনে শুনে বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। বিশেষ করে মানুষ যখন নতুন পরিবেশে বা অবস্থানে জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তখন কাউন্সেলিং সেই অবস্থা থেকে উত্তরণে সাহায্য করে । এটা এমন একটা প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা যা মানুষকে তাদের নিজেদেরকে ভালো করে চিনতে শেখায় বা বুঝতে শেখায়। আর সেই সঙ্গে আমরা যে বিরূপ বা জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মনে স্বচ্ছ ধারণার জন্ম দেয়। এর সাহায্যে আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা বা বোধ গড়ে ওঠে, নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হয়ে উঠি এবং গঠনমূলক উপায়ে প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করতে সক্ষম হই।

কাউন্সেলিং ক্লায়েন্টের আচার-আচরণে পরিবর্তন আনে, আত্মনির্ভরতা ও মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে। এসব কিছুই একজন মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশে সহায়তা করে এবং জীবনের সফলতার সাথেও এর গভীর যোগাযোগ রয়েছে।

অবিবাহিত যুবক বা যুবতীদের বিয়ে সম্পর্কে তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে কাউন্সেলিং করার সময় সঠিক তথ্য দিয়ে তাদের সাহায্য করতে হবে। বিবাহ কোনো জটিল বা বিরূপ পরিস্থিতি নয়। এটি মানব জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া— যার মাধ্যমে মানুষ জীবনের একটি নতুন অধ্যায়/ধাপে/পরিবেশে/নতুন জীবনে প্রবেশ করে। এটি পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের চুক্তি বা অঙ্গীকার। পারস্পরিক আশা, ভরসা, নির্ভরতা ও অঙ্গীকারের সমন্বয়। এতে পরস্পরকে খাপ খাওয়াতে হয়। না পারলে বিরোধের আশঙ্কা থেকেই যায়। দ্বন্দ্ব ও বিরোধ মীমাংসা না হলে তা থেকে অশান্তি, অস্থিতিশীলতা, নির্যাতন ও চূড়ান্ত পর্যায়ে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। বিবাহপূর্ব কাউন্সেলিং এক্ষেত্রে যুব বয়সীদের সাহায্য করতে পারে।

বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স কোনটি বা বিয়ের পর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কীভাবে করতে হবে, সেই বিষয়ে কাউন্সেলিং সহায়তা করবে। সাধারণত দেখা যায় বিয়ের পাত্র-পাত্রীরা তাদের সঙ্গী কেমন হবে, পরিবারের সদস্যরা কেমন হবে, যৌন জীবন কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন। কাউন্সেলরের দায়িত্ব হবে তাদের কী কী সমস্যা আছে তা প্রথমে চিহ্নিত করা এবং সমস্যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা যেন তারা বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক তথ্য পায় ও তাদের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনেক সময় বিয়ে নিয়ে যুববয়সীদের মনে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়, যা নিরসন করা জরুরি। আবার অতীতের কোন অভিজ্ঞতাও তাদের বর্তমান আচরণ এবং সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক সময় কেউ কেউ কোনো একটা বিষয় নিয়ে ভবিষ্যৎ আশংকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কাউন্সেলিং তাদের জীবনের হতাশা, উৎকন্ঠা বা ভুল ধারণা দূর করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং করার সময় যে সব বাধা আসতে পারে

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর সময় সামনাসামনি মৌখিক যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রেকাউন্সেলরকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে তাকে সাহায্য করতে হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ব্যক্তির জীবনের সমস্যার সমাধানে কাউন্সেলর অনেকগুলো দিক নির্দেশনা বা উদাহরণ তুলে ধরেন, যা থেকে ব্যক্তি তার জন্য উপযুক্ত নির্দেশনাটি বেছে নেন এবং নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে যে বাধা আসতে পারে—

  • কাউন্সেলরের নিজের প্রস্তুতি না থাকলে ক্লায়েন্টের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক হতে না পারলে
  • কাউন্সেলরের নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কম থাকলে
  • বিষয় সম্পর্কে কাউন্সেলরের সার্বিক জ্ঞান না থাকলে
  • কাউন্সেলর এবং অবিবাহিত যুবক-যুবতীর মধ্যে বয়সের বেশি পার্থক্য থাকলে গ্রহীতার চাহিদা/প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে
  • বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে না পারলেবার্তা উপলব্ধি করতে না পারলে
  • ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা বজায় রাখতে না পারলে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে
  • অংশগ্রহণকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে বা বিশ্বাস স্থাপন করতে না পারলে 
  • কৌশলগত দিক, ভাষার ব্যবহার, উপকরণের যথাযথ ব্যবহার করতে না পারলে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ক্লায়েন্টের উপর প্রভাব খাটালে
  • ক্লায়েন্টের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে না পারলে
  • নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখাতে পারলে
  • ক্লায়েন্টের প্রতি অবহেলা বা অবজ্ঞা প্রকাশ করলে
  • সবজান্তা ভাব, গর্বিত বা উদ্ধত ভাব প্রদর্শন করলে।

ক্লায়েন্টের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও আন্তরিকতার সাথে কথা বলে কাউন্সেলিং-এর অনেক বাধা দূর করা যায়।

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর মূলনীতি

আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে, কাউন্সেলিং একটি প্রক্রিয়া যা প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে অবিবাহিত যুবক-যুবতীদের সিদ্ধান্ত নিতে এবং সিদ্ধান্তগুলি চর্চা করতে সহায়তা করে। গুণগত ও কার্যকর কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে ক্লায়েন্ট-কেন্দ্রিক পরামর্শ প্রদান।

বিয়ের উপযুক্ত বয়সে উপনীত যুবক-যুবতীদের কাউন্সেলিং-এ ইতিবাচক ফলাফল আনতে অর্থাৎ কাউন্সেলিং-এর উদ্দেশ্য সফল করতে যার সাথে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

কাউন্সেলর আগ্রহ নিয়ে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে কথা বলা শুরু করতে পারেন এবং ফলো-আপসহ কাউন্সেলিং এর প্রত্যেকটি ধাপে যুবক-যুবতীদের গুরুত্ব দিয়ে ভালো ব্যবহার ও সম্মান দেখিয়ে ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করতে পারেন। প্রাক-বৈবাহিক সময়ে যুবক-যুবতীদের কার্যকর কাউন্সেলিং-এর আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে তাদের চাহিদা বোঝা এবং সেইভাবে তাকে তথ্য দেয়া। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, বিবাহ সম্পর্কিত ভাবনা বা আশংকাগুলো সবার একই রকম হবে না। পরিবেশ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিস্থিতির উপর চাহিদা নির্ভর করে। একজন সফল কাউন্সেলরকে সবকিছু বিবেচনা করে চাহিদা বের করতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারলে অবিবাহিত যুবক-যুবতীরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। শুধু সঠিক তথ্য না জানার কারণে অনেক কিশোরী ও নারী বিয়ের প্রথম রাত থেকেই গর্ভধারণের দিকে এগিয়ে যায়। আবার তথ্য না থাকার কারণেই দেখা যায় একজন অপুষ্ট মা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দিচ্ছে কিংবা গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে মা ও শিশু স্বাস্থ্যগত জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন, এমন কি অকালে মারা যাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে যে, কাউন্সেলর যেন কিছুতেই নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে না দেন। বরং জীবন ঘনিষ্ট উপযুক্ত উদাহরণ ও তথ্য দিয়ে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন এবং তাদের পছন্দ অনুযায়ী সেবা প্রদান করেন। কাউন্সেলরের আরেকটি বড় কাজ হবে তথ্যগুলো ক্লায়েন্টকে মনে রাখতে সাহায্য করা এবং তিনি যে ইতিবাচক সিদ্ধান্তই নিন না কেন, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাকে সহায়তা করা। 

কাউন্সেলিং-এর মূলনীতি

কাউন্সেলিং-এর মূলনীতি হলো, ক্লায়েন্টের সাথে ভালো ব্যবহার ও সম্মান দেখিয়ে তার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা। উপযুক্ত তথ্য প্রদান করে পছন্দ অনুযায়ী তথ্য দেওয়া। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সাহায্য করা। কোনো কিছু বুঝতে ও মনে রাখতে না পারলে তাকে সহায়তা করা।

কাউন্সেলিং-এর সময় যোগাযোগ উপকরণ ব্যবহারের সুবিধা

মানুষ দেখে ও শুনে শিখতে পছন্দ করে। কাউন্সেলিং-এর সময় শুধু আলোচনা না করে বা পরামর্শ না দিয়ে যোগাযোগ উপকরণ দেখিয়ে বিষয় সম্পর্কে তাদের মনোযোগী করে তুলতে পারা যায়। আনন্দের মাধ্যমে শিখতে পারলে মানুষ তা মনে রাখতে পারে এবং ঘটনা ও বিষয়ের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়। এতে করে ফলপ্রসূ আলোচনা করা সম্ভব হয়। যোগাযোগ উপকরণের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে আপনার দেওয়া তথ্যের গুরুত্ব বাড়বে এবং আপনার গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হবে। উপকরণ দেখা ও শিখনের একটি পরিবেশ তৈরি করা যা আলোচনাকে অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক করে। উপকরণ ব্যবহার করার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে যে, এটি অভিজ্ঞতামূলক শিখনে সহায়তা করে যা অনেক বেশি জীবন ঘনিষ্ট হয় এবং বার্তাগুলো বুঝে, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে আচরণ পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে এবং বার্তাকে নিজের মতো করে ধারণ করতে (আত্মীকরণ) এবং মনে রাখতে সহায়তা করে।

— প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং বিষয়ক গাইডবুক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং ও কাউন্সেলিং পদ্ধতি

প্রকাশ: ০৪:৪৩:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২

মনস্তত্ত্ববিদেরা মনে করেন সুস্থ ও উন্নত বিবাহিত জীবন পেতে হলে অবশ্যই প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং বা পরামর্শ নেওয়া দরকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবাহিত জীবনে দুই জন মানুষের মধ্যে যেসব সমস্যা দেখা যায়, তার অনেকটাই আসে ভুল প্রত্যাশা থেকে এবং বিয়ে-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানার কারণে। প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর সাহায্যে এই বিষয়গুলোর মোকাবিলা করা যায়। এই কারণেই একজন পরিবার কল্যাণ কর্মী হিসেবে ভবিষ্যৎ দম্পতিকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং কী এবং কোন পদ্ধতিতে প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং করা যেতে পারে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং

কাউন্সেলিং জেনে শুনে বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। বিশেষ করে মানুষ যখন নতুন পরিবেশে বা অবস্থানে জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তখন কাউন্সেলিং সেই অবস্থা থেকে উত্তরণে সাহায্য করে । এটা এমন একটা প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা যা মানুষকে তাদের নিজেদেরকে ভালো করে চিনতে শেখায় বা বুঝতে শেখায়। আর সেই সঙ্গে আমরা যে বিরূপ বা জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মনে স্বচ্ছ ধারণার জন্ম দেয়। এর সাহায্যে আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা বা বোধ গড়ে ওঠে, নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হয়ে উঠি এবং গঠনমূলক উপায়ে প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করতে সক্ষম হই।

কাউন্সেলিং ক্লায়েন্টের আচার-আচরণে পরিবর্তন আনে, আত্মনির্ভরতা ও মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে। এসব কিছুই একজন মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশে সহায়তা করে এবং জীবনের সফলতার সাথেও এর গভীর যোগাযোগ রয়েছে।

অবিবাহিত যুবক বা যুবতীদের বিয়ে সম্পর্কে তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে কাউন্সেলিং করার সময় সঠিক তথ্য দিয়ে তাদের সাহায্য করতে হবে। বিবাহ কোনো জটিল বা বিরূপ পরিস্থিতি নয়। এটি মানব জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া— যার মাধ্যমে মানুষ জীবনের একটি নতুন অধ্যায়/ধাপে/পরিবেশে/নতুন জীবনে প্রবেশ করে। এটি পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের চুক্তি বা অঙ্গীকার। পারস্পরিক আশা, ভরসা, নির্ভরতা ও অঙ্গীকারের সমন্বয়। এতে পরস্পরকে খাপ খাওয়াতে হয়। না পারলে বিরোধের আশঙ্কা থেকেই যায়। দ্বন্দ্ব ও বিরোধ মীমাংসা না হলে তা থেকে অশান্তি, অস্থিতিশীলতা, নির্যাতন ও চূড়ান্ত পর্যায়ে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। বিবাহপূর্ব কাউন্সেলিং এক্ষেত্রে যুব বয়সীদের সাহায্য করতে পারে।

বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স কোনটি বা বিয়ের পর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কীভাবে করতে হবে, সেই বিষয়ে কাউন্সেলিং সহায়তা করবে। সাধারণত দেখা যায় বিয়ের পাত্র-পাত্রীরা তাদের সঙ্গী কেমন হবে, পরিবারের সদস্যরা কেমন হবে, যৌন জীবন কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন। কাউন্সেলরের দায়িত্ব হবে তাদের কী কী সমস্যা আছে তা প্রথমে চিহ্নিত করা এবং সমস্যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা যেন তারা বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক তথ্য পায় ও তাদের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনেক সময় বিয়ে নিয়ে যুববয়সীদের মনে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়, যা নিরসন করা জরুরি। আবার অতীতের কোন অভিজ্ঞতাও তাদের বর্তমান আচরণ এবং সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক সময় কেউ কেউ কোনো একটা বিষয় নিয়ে ভবিষ্যৎ আশংকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কাউন্সেলিং তাদের জীবনের হতাশা, উৎকন্ঠা বা ভুল ধারণা দূর করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং করার সময় যে সব বাধা আসতে পারে

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর সময় সামনাসামনি মৌখিক যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রেকাউন্সেলরকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে তাকে সাহায্য করতে হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ব্যক্তির জীবনের সমস্যার সমাধানে কাউন্সেলর অনেকগুলো দিক নির্দেশনা বা উদাহরণ তুলে ধরেন, যা থেকে ব্যক্তি তার জন্য উপযুক্ত নির্দেশনাটি বেছে নেন এবং নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে যে বাধা আসতে পারে—

  • কাউন্সেলরের নিজের প্রস্তুতি না থাকলে ক্লায়েন্টের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক হতে না পারলে
  • কাউন্সেলরের নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কম থাকলে
  • বিষয় সম্পর্কে কাউন্সেলরের সার্বিক জ্ঞান না থাকলে
  • কাউন্সেলর এবং অবিবাহিত যুবক-যুবতীর মধ্যে বয়সের বেশি পার্থক্য থাকলে গ্রহীতার চাহিদা/প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে
  • বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে না পারলেবার্তা উপলব্ধি করতে না পারলে
  • ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা বজায় রাখতে না পারলে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে
  • অংশগ্রহণকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে বা বিশ্বাস স্থাপন করতে না পারলে 
  • কৌশলগত দিক, ভাষার ব্যবহার, উপকরণের যথাযথ ব্যবহার করতে না পারলে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ক্লায়েন্টের উপর প্রভাব খাটালে
  • ক্লায়েন্টের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে না পারলে
  • নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখাতে পারলে
  • ক্লায়েন্টের প্রতি অবহেলা বা অবজ্ঞা প্রকাশ করলে
  • সবজান্তা ভাব, গর্বিত বা উদ্ধত ভাব প্রদর্শন করলে।

ক্লায়েন্টের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও আন্তরিকতার সাথে কথা বলে কাউন্সেলিং-এর অনেক বাধা দূর করা যায়।

প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর মূলনীতি

আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে, কাউন্সেলিং একটি প্রক্রিয়া যা প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে অবিবাহিত যুবক-যুবতীদের সিদ্ধান্ত নিতে এবং সিদ্ধান্তগুলি চর্চা করতে সহায়তা করে। গুণগত ও কার্যকর কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে ক্লায়েন্ট-কেন্দ্রিক পরামর্শ প্রদান।

বিয়ের উপযুক্ত বয়সে উপনীত যুবক-যুবতীদের কাউন্সেলিং-এ ইতিবাচক ফলাফল আনতে অর্থাৎ কাউন্সেলিং-এর উদ্দেশ্য সফল করতে যার সাথে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

কাউন্সেলর আগ্রহ নিয়ে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে কথা বলা শুরু করতে পারেন এবং ফলো-আপসহ কাউন্সেলিং এর প্রত্যেকটি ধাপে যুবক-যুবতীদের গুরুত্ব দিয়ে ভালো ব্যবহার ও সম্মান দেখিয়ে ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করতে পারেন। প্রাক-বৈবাহিক সময়ে যুবক-যুবতীদের কার্যকর কাউন্সেলিং-এর আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে তাদের চাহিদা বোঝা এবং সেইভাবে তাকে তথ্য দেয়া। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, বিবাহ সম্পর্কিত ভাবনা বা আশংকাগুলো সবার একই রকম হবে না। পরিবেশ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিস্থিতির উপর চাহিদা নির্ভর করে। একজন সফল কাউন্সেলরকে সবকিছু বিবেচনা করে চাহিদা বের করতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারলে অবিবাহিত যুবক-যুবতীরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। শুধু সঠিক তথ্য না জানার কারণে অনেক কিশোরী ও নারী বিয়ের প্রথম রাত থেকেই গর্ভধারণের দিকে এগিয়ে যায়। আবার তথ্য না থাকার কারণেই দেখা যায় একজন অপুষ্ট মা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দিচ্ছে কিংবা গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে মা ও শিশু স্বাস্থ্যগত জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন, এমন কি অকালে মারা যাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে যে, কাউন্সেলর যেন কিছুতেই নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে না দেন। বরং জীবন ঘনিষ্ট উপযুক্ত উদাহরণ ও তথ্য দিয়ে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন এবং তাদের পছন্দ অনুযায়ী সেবা প্রদান করেন। কাউন্সেলরের আরেকটি বড় কাজ হবে তথ্যগুলো ক্লায়েন্টকে মনে রাখতে সাহায্য করা এবং তিনি যে ইতিবাচক সিদ্ধান্তই নিন না কেন, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাকে সহায়তা করা। 

কাউন্সেলিং-এর মূলনীতি

কাউন্সেলিং-এর মূলনীতি হলো, ক্লায়েন্টের সাথে ভালো ব্যবহার ও সম্মান দেখিয়ে তার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা। উপযুক্ত তথ্য প্রদান করে পছন্দ অনুযায়ী তথ্য দেওয়া। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সাহায্য করা। কোনো কিছু বুঝতে ও মনে রাখতে না পারলে তাকে সহায়তা করা।

কাউন্সেলিং-এর সময় যোগাযোগ উপকরণ ব্যবহারের সুবিধা

মানুষ দেখে ও শুনে শিখতে পছন্দ করে। কাউন্সেলিং-এর সময় শুধু আলোচনা না করে বা পরামর্শ না দিয়ে যোগাযোগ উপকরণ দেখিয়ে বিষয় সম্পর্কে তাদের মনোযোগী করে তুলতে পারা যায়। আনন্দের মাধ্যমে শিখতে পারলে মানুষ তা মনে রাখতে পারে এবং ঘটনা ও বিষয়ের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়। এতে করে ফলপ্রসূ আলোচনা করা সম্ভব হয়। যোগাযোগ উপকরণের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে আপনার দেওয়া তথ্যের গুরুত্ব বাড়বে এবং আপনার গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হবে। উপকরণ দেখা ও শিখনের একটি পরিবেশ তৈরি করা যা আলোচনাকে অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক করে। উপকরণ ব্যবহার করার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে যে, এটি অভিজ্ঞতামূলক শিখনে সহায়তা করে যা অনেক বেশি জীবন ঘনিষ্ট হয় এবং বার্তাগুলো বুঝে, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে আচরণ পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে এবং বার্তাকে নিজের মতো করে ধারণ করতে (আত্মীকরণ) এবং মনে রাখতে সহায়তা করে।

— প্রাক-বৈবাহিক কাউন্সেলিং বিষয়ক গাইডবুক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার