০১:৫৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

তরিকতে সম্রাট, সর্দারে আউলিয়া, গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.) এর আত্মদর্শন

মোস্তাক আহ্‌মাদ
  • প্রকাশ: ০১:৪৮:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ মার্চ ২০২১
  • / ১০৯৩ বার পড়া হয়েছে

গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.)-এর আত্মদর্শন বইয়ের প্রচ্ছদ

সৃষ্টি রাজ্যের সমুদয় অন্তর্নিহিত জ্ঞান ও রহস্য সম্পর্কে উপলব্ধি করার মত ক্ষমতাকে ‘মশিখত’ বলা হয়। এই মশিখতপ্রাপ্ত অলিআল্লাহ হলেন গাউসুল আজম হযরত মুহিউদ্দিন শেখ আব্দুল কাদির জেলানী (রা.)। যিনি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহধন্য হয়ে এই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। তিনি সুফিয়ে আজম তথা ‘মশিখতে মসনব’ উপাধীতে ভূষিত উচ্চস্তরের গাউল উল আজম পর্যায়ের আউলিয়া। এই স্তর সুফির কামালিয়াতের সর্বোচ্চ স্তর। এই শ্রেণিভুক্ত ‘সুফিদের’ সম্পর্কে আল্লামা জামী বলেন, সুফির জ্ঞানকে একটি সরল রেখা বা ‘আলিফ’ রূপে ধরে নেও। আর আল্লাহ তায়ালার মহাজ্ঞানকে একটি ‘নুক্তা’ বা বিন্দু রূপে ধরে নেও। এইরূপ কয়েকটি বিন্দুর সংযোগে যেমন একটি সরল রেখার অস্তিত্ব ফুটে ওঠে, ফলে তখন আর বিন্দুগুলোর অস্তিত্ব দেখা যায় না তদ্রুপ পরম জ্ঞান বা আল্লাহর মহাজ্ঞান তখন এক এক করে এই জাতীয় সুফির অন্তরে সন্নিবেশিত হতে হতে তাঁকে আল্লাহর মহাজ্ঞান ভাণ্ডারে পরিণত করে তোলে। তখনই সুফি হৃদয়ের যাবতীয় বিভেদ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে যায়। তিনি হয়ে যান গাউসুল আজম পদমর্যাদার অধিকারী। বড়পীর হযরত গাউসুল আজম পীরানে পীর দস্তগীর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানী (রা.) হলেন সেই উচ্চ পর্যায়ের মহান অলিয়ে কামেলীন। তাঁর পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন পারস্যের জিলান বা গিলান প্রদেশের অধিবাসী। তৎকালীন সময়ে গিলান প্রদেশটি বাগদাদের খলিফাদের অধীন ছিল। বাগদাদ শরিফ হতে গিলানের দূরত্ব ৪০০ মাইল উত্তর-পূর্বে। কারবালার ঘটনার পর উমাইয়া শাসনামলে রাজনৈতিক অত্যাচারে আরবের অনেক খান্দানী পরিবারই মক্কা ও মদিনা শরিফ ত্যাগ করে আরবের বাইরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইরাক, ওয়াছেত ও পারস্যের সাথে হযরত আলী (ক.) এবং ইমাম হাসান (আ.)-এর বৈবাহিক স¤পর্ক ছিল। সেই সূত্রে ইমাম বংশের অনেকেই হিজরত করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন। হযরত গাউসুল আজমের পূর্ব পিতৃপুরুষ ও মাতৃ পুরুষগণ এভাবেই এককালে জিলান প্রদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে হিজরত করেন।

গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.)-এর আত্মদর্শন
তরিকতে সম্রাট, সর্দারে আউলিয়া, গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.)-এর আত্মদর্শন বইয়ের প্রচ্ছদ।

হযরত বড়পীর সাহেবের পিতা সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত (র.) অতি উঁচুস্তরের একজন বুজুর্গ ও মোত্তাকী ছিলেন। তিনি রিয়াযত ও কঠোর সাধনায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তিনি প্রায় সময়ই বনে-জঙ্গলে ও নদীর তীরে একাকী সাধনা করতেন। তিনি কীভাবে সংসারে জড়িত হলেন, সে সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ ঘটনা আরমান সারহাদী রচিত ‘সাওয়ানেহে গাউসে আজম’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। ঘটনাটি নিম্নরূপ―

হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত (র.) জিলানের কোন এক নদীর তীরে ইবাদত, রিয়াযত ও মুরাকাবা মুশাহাদায় নিমগ্ন থাকতেন। দিনের পর দিন অর্ধাহারে ও অনাহারে থাকতেন। একবার তিনি নদীর তীরে গিয়ে দেখেন― নদীর তীর ঘেঁষে একটি পাকা আপেল নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ক্ষুধার তাড়নায় তিনি ফলটি তুলে এনে খেয়ে ফেললেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মধ্যে দারুন অনুশোচনা দেখা দিল। মালিকের অনুমতি ছাড়া পরিত্যক্ত ফলটি খাওয়া ঠিক হয়নি; যদিও শরিয়তে এ অবস্থায় ভেসে যাওয়া ফল খাওয়া বৈধ। তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন― নিশ্চয়ই উজানের কোন মালিকের বাগানের ফল পানিতে পড়ে স্রোতের টানে চলে এসেছে। এমন চিন্তার পর হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.) তৎক্ষণাৎ ফলের মালিকের অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়লেন। অনেক দূর চলার পর নদীর কিনারায় একটি আপেলের বাগান দেখতে পেলেন। আপেল বৃক্ষের একটি ডাল নদীর উপর ঝুঁকে আছে। ঐ ডালে পাকা আপেল দেখা যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে, ফলটি এ গাছেরই হবে। বাগানের মালিকের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, তাঁর নাম সৈয়দ আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.)। তিনি তৎক্ষণাৎ সৈয়দ আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.)-এর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রশান্ত ও নূরানী চেহারা দেখে ক্ষমার আশায় বুক বেঁধে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সৈয়দ আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.) সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গীর চেহারার দিকে নজর করেই বুঝতে পারলেন- ইনি সাধারণ যুবক নহেন। কারণ তিনিও মস্তবড় বুজুর্গ ও আল্লাহর মহান অলি ছিলেন।

এক অলির হৃদয় অপর অলির দর্পন স্বরূপ। হযরত আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.)-এর হৃদয় দর্পনে সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গীর আসল চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি তাঁর হাকিকত বুঝতে পারলেন। এমন পরশমণিকে হাতছাড়া করা যায় না। তিনি তাঁকে ধরে রাখার উপায় হিসাবে শর্ত দিলেন; যদি ১২ বৎসর আমার গৃহে থেকে আমার খেদমত করতে পার, তাহলে ক্ষমা করতে পারি। সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.) অগত্যা রাজী হলেন; তবুও খোদার শাস্তি হতে যদি নিষ্কৃতি লাভ করা যায়। বান্দার হক বড়ই কঠিন।

এখান থেকে শুরু হলো গাউসে পাকের পিতার সাধনার আর এক স্তর। হযরত সৈয়দ আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.) তাঁকে অন্য কাজে লাগিয়ে দিলেন। আধ্যাত্মিক সাধনা ও শিক্ষা-দীক্ষার কাজে তিনি তাঁকে নিয়োজিত করলেন। পরশমণির পরশে থেকে ১২ বৎসরে তিনি কামালিয়াতের উচ্চস্তরে উন্নীত হলেন। এদিকে তাঁর ১২ বৎসর পূর্ণ হলো। এবার বিদায়ের পালা।

তিনি মনিবের কাছে বিদায় প্রার্থনা করলেন। এমন পরশমণিকে হাত ছাড়া করতে হযরত ছাওমাঈ (র.)-এর ইচ্ছা হলোনা। তাই তিনি একটি নূতন শর্ত জুড়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘আপেলের ঋণমুক্ত হতে চাইলে আমার একটি প্রস্তাব তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। আমার একটি মেয়ে আছে। সে অন্ধ! খোঁড়া ও বধির। তাকে তোমার বিবাহ করতে হবে। নতুবা ঋণমুক্তি নেই।’

হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.) ভাবলেন, ক্ষমা না নিয়ে চলে গেলে সব পরিশ্রমই বৃথা। তদুপরি পরকালের শাস্তি তো আছেই। সুতরাং জীবন যৌবনের সব স্বাদ বিসর্জন দিয়ে হলেও ক্ষমা নিতে হবে। তাই তিনি অগত্যা এ বিবাহে রাজী হলেন। বিবাহ সুসম্পন্ন হলো। বিবাহ বাসরে দুলহান একাকী বসে আছেন। শ্বশুর সাহেব নূতন জামাইকে বাসর ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে চলে আসলেন। হযরত আবু সালেহ মুসা (র.) বাসর ঘরে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এক অনিন্দ্য সুন্দরী চক্ষুষ্মান দুলহান বসে আছেন। তাঁর হাত, পা, কান সবই ঠিক। তিনি ভাবলেন, বোধহয় মনিব আর এক অগ্নি পরীক্ষায় তাঁকে নিক্ষেপ করেছেন। তিনি পিছপা হয়ে চলে আসছিলেন। এমন সময় শ্বশুর সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘বাবা! তুমি আমার কথার মর্ম বুঝতে পারনি। আমার মেয়েকে আমি অন্ধ বলেছিলাম এজন্যে যে, সে অন্য পুরুষের দিকে কোন দিন তাকায়নি। তাকে খোঁড়া বলেছিলাম এ জন্যে যে, সে কোনদিন অন্যায় পথে পা বাড়ায়নি। তাকে বধির বলেছিলাম এ কারণে যে, সে কোনদিন অশ্লীল ও অধর্মের কথা তাঁর কানে শোনেনি। এবার তোমার চরিত্রের পরীক্ষা শেষ হলো। তোমার মত জামাই পেয়ে আমি ও আমার মেয়ে ধন্য।’ এরপর হযরত সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.) শ্বশুরের কথা শুনে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলেন। এমন স্ত্রী যার ঘরে আছে, দুনিয়াতেই তার বেহেস্ত। পরকালের হুর ও গেলমান তার কাছে তুচ্ছ। এই নব পরিণীতা বিবির নামই সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (র.)। যাঁদের ঘর আলোকিত করে দুনিয়ার বুকে আগমন করলেন গাউসে ছামদানী, নূরে ইয়াজদানী, মাহবুবে সোবহানী, কুতুবে রাববানী, গাউসুল আজম বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী আলা জাদ্দিহি নাবীয়ানা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম। এমন পিতা-মাতা হলে সন্তানও তেমনই হবে। আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। ১২ বৎসর যাঁর ঘরে থেকে খেদমত করলেন আবু সালেহ মুসা জঙ্গী, বিবাহের পূর্বে একটিবারও দেখলেন না সেই মনিব কন্যাকে। এটাই হলো আল্লাহর মহান আউলিয়াগণের চারিত্রিক উৎকর্ষতা।

এমনি এক মহান আউলিয়া পিতা-মাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন আউলিয়াদের শিরোমণি। তিনি বিশ্ব জগতকে আলোকিত করে ধরার বুকে আগমন করলেন গাউসুল আজম পীরানে পীর দস্তগীর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানী রূপে প্রখ্যাত আউলিয়া হিসেবে। তাঁর আগমনে ইসলাম পুনরুজ্জীবন লাভ করলো।

তাঁর আত্মদর্শন গ্রন্থে সুফি রহস্যভেদী কালাম, কারামত ও বেলায়েতের উচ্চতর দর্শনের পর্দা উন্মোচনের চেষ্টা করা হয়েছে। যা তরিকত জগতের আশেক-সালেক, পীর-মুর্শিদভক্ত পাঠক ও দরবারভুক্ত পীর-মাশায়েখসহ সকল পর্যায়ের প্রেমিকদের আত্মার খোরাক যোগাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যেদেনা ওয়া মাওলানা ওয়া নাবীয়ানা ওয়া শাফিয়ানা মোহাম্মাদিম মা’দানিল জুদে ওয়াল কারাম। ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া বারিক ওয়া সাল্লিম। ওয়া আলা সাইয়্যেদিল আম্বিয়া মুহিউদ্দিন শায়েখ মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানী মাহবুবে সুবহানী কুতুবে রব্বানী গাউসে সামদানী নূরে ইয়াজদানী আল হাসানী ওয়াল হুসাইনী আলা জাদ্দিহী নাবীয়ানা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম, উছিলাতী ইলাইকা। আমীন, ছুম্মা আমীন।

বইতরিকতে সম্রাট, সর্দারে আউলিয়া, গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.)-এর আত্মদর্শন
লেখকমোস্তাক আহমাদ
প্রকাশকরোদেলা প্রকাশনী
প্রকাশকালঅমর একুশে বইমেলা ২০২১
ধরণদর্শন, আত্মদর্শন, ধর্মদর্শন, জীবনচরিত
প্রচ্ছদশিল্পি
মূল্য
পরিবেশকরকমারি
বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মোস্তাক আহ্‌মাদ

চার শতাধিক গ্রন্থের লেখক ও গবেষক।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

তরিকতে সম্রাট, সর্দারে আউলিয়া, গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.) এর আত্মদর্শন

প্রকাশ: ০১:৪৮:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ মার্চ ২০২১

সৃষ্টি রাজ্যের সমুদয় অন্তর্নিহিত জ্ঞান ও রহস্য সম্পর্কে উপলব্ধি করার মত ক্ষমতাকে ‘মশিখত’ বলা হয়। এই মশিখতপ্রাপ্ত অলিআল্লাহ হলেন গাউসুল আজম হযরত মুহিউদ্দিন শেখ আব্দুল কাদির জেলানী (রা.)। যিনি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহধন্য হয়ে এই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। তিনি সুফিয়ে আজম তথা ‘মশিখতে মসনব’ উপাধীতে ভূষিত উচ্চস্তরের গাউল উল আজম পর্যায়ের আউলিয়া। এই স্তর সুফির কামালিয়াতের সর্বোচ্চ স্তর। এই শ্রেণিভুক্ত ‘সুফিদের’ সম্পর্কে আল্লামা জামী বলেন, সুফির জ্ঞানকে একটি সরল রেখা বা ‘আলিফ’ রূপে ধরে নেও। আর আল্লাহ তায়ালার মহাজ্ঞানকে একটি ‘নুক্তা’ বা বিন্দু রূপে ধরে নেও। এইরূপ কয়েকটি বিন্দুর সংযোগে যেমন একটি সরল রেখার অস্তিত্ব ফুটে ওঠে, ফলে তখন আর বিন্দুগুলোর অস্তিত্ব দেখা যায় না তদ্রুপ পরম জ্ঞান বা আল্লাহর মহাজ্ঞান তখন এক এক করে এই জাতীয় সুফির অন্তরে সন্নিবেশিত হতে হতে তাঁকে আল্লাহর মহাজ্ঞান ভাণ্ডারে পরিণত করে তোলে। তখনই সুফি হৃদয়ের যাবতীয় বিভেদ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে যায়। তিনি হয়ে যান গাউসুল আজম পদমর্যাদার অধিকারী। বড়পীর হযরত গাউসুল আজম পীরানে পীর দস্তগীর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানী (রা.) হলেন সেই উচ্চ পর্যায়ের মহান অলিয়ে কামেলীন। তাঁর পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন পারস্যের জিলান বা গিলান প্রদেশের অধিবাসী। তৎকালীন সময়ে গিলান প্রদেশটি বাগদাদের খলিফাদের অধীন ছিল। বাগদাদ শরিফ হতে গিলানের দূরত্ব ৪০০ মাইল উত্তর-পূর্বে। কারবালার ঘটনার পর উমাইয়া শাসনামলে রাজনৈতিক অত্যাচারে আরবের অনেক খান্দানী পরিবারই মক্কা ও মদিনা শরিফ ত্যাগ করে আরবের বাইরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইরাক, ওয়াছেত ও পারস্যের সাথে হযরত আলী (ক.) এবং ইমাম হাসান (আ.)-এর বৈবাহিক স¤পর্ক ছিল। সেই সূত্রে ইমাম বংশের অনেকেই হিজরত করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন। হযরত গাউসুল আজমের পূর্ব পিতৃপুরুষ ও মাতৃ পুরুষগণ এভাবেই এককালে জিলান প্রদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে হিজরত করেন।

গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.)-এর আত্মদর্শন
তরিকতে সম্রাট, সর্দারে আউলিয়া, গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.)-এর আত্মদর্শন বইয়ের প্রচ্ছদ।

হযরত বড়পীর সাহেবের পিতা সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত (র.) অতি উঁচুস্তরের একজন বুজুর্গ ও মোত্তাকী ছিলেন। তিনি রিয়াযত ও কঠোর সাধনায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তিনি প্রায় সময়ই বনে-জঙ্গলে ও নদীর তীরে একাকী সাধনা করতেন। তিনি কীভাবে সংসারে জড়িত হলেন, সে সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ ঘটনা আরমান সারহাদী রচিত ‘সাওয়ানেহে গাউসে আজম’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। ঘটনাটি নিম্নরূপ―

হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত (র.) জিলানের কোন এক নদীর তীরে ইবাদত, রিয়াযত ও মুরাকাবা মুশাহাদায় নিমগ্ন থাকতেন। দিনের পর দিন অর্ধাহারে ও অনাহারে থাকতেন। একবার তিনি নদীর তীরে গিয়ে দেখেন― নদীর তীর ঘেঁষে একটি পাকা আপেল নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ক্ষুধার তাড়নায় তিনি ফলটি তুলে এনে খেয়ে ফেললেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মধ্যে দারুন অনুশোচনা দেখা দিল। মালিকের অনুমতি ছাড়া পরিত্যক্ত ফলটি খাওয়া ঠিক হয়নি; যদিও শরিয়তে এ অবস্থায় ভেসে যাওয়া ফল খাওয়া বৈধ। তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন― নিশ্চয়ই উজানের কোন মালিকের বাগানের ফল পানিতে পড়ে স্রোতের টানে চলে এসেছে। এমন চিন্তার পর হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.) তৎক্ষণাৎ ফলের মালিকের অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়লেন। অনেক দূর চলার পর নদীর কিনারায় একটি আপেলের বাগান দেখতে পেলেন। আপেল বৃক্ষের একটি ডাল নদীর উপর ঝুঁকে আছে। ঐ ডালে পাকা আপেল দেখা যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে, ফলটি এ গাছেরই হবে। বাগানের মালিকের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, তাঁর নাম সৈয়দ আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.)। তিনি তৎক্ষণাৎ সৈয়দ আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.)-এর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রশান্ত ও নূরানী চেহারা দেখে ক্ষমার আশায় বুক বেঁধে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সৈয়দ আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.) সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গীর চেহারার দিকে নজর করেই বুঝতে পারলেন- ইনি সাধারণ যুবক নহেন। কারণ তিনিও মস্তবড় বুজুর্গ ও আল্লাহর মহান অলি ছিলেন।

এক অলির হৃদয় অপর অলির দর্পন স্বরূপ। হযরত আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.)-এর হৃদয় দর্পনে সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গীর আসল চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি তাঁর হাকিকত বুঝতে পারলেন। এমন পরশমণিকে হাতছাড়া করা যায় না। তিনি তাঁকে ধরে রাখার উপায় হিসাবে শর্ত দিলেন; যদি ১২ বৎসর আমার গৃহে থেকে আমার খেদমত করতে পার, তাহলে ক্ষমা করতে পারি। সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.) অগত্যা রাজী হলেন; তবুও খোদার শাস্তি হতে যদি নিষ্কৃতি লাভ করা যায়। বান্দার হক বড়ই কঠিন।

এখান থেকে শুরু হলো গাউসে পাকের পিতার সাধনার আর এক স্তর। হযরত সৈয়দ আব্দুল্লাহ ছাওমাঈ (র.) তাঁকে অন্য কাজে লাগিয়ে দিলেন। আধ্যাত্মিক সাধনা ও শিক্ষা-দীক্ষার কাজে তিনি তাঁকে নিয়োজিত করলেন। পরশমণির পরশে থেকে ১২ বৎসরে তিনি কামালিয়াতের উচ্চস্তরে উন্নীত হলেন। এদিকে তাঁর ১২ বৎসর পূর্ণ হলো। এবার বিদায়ের পালা।

তিনি মনিবের কাছে বিদায় প্রার্থনা করলেন। এমন পরশমণিকে হাত ছাড়া করতে হযরত ছাওমাঈ (র.)-এর ইচ্ছা হলোনা। তাই তিনি একটি নূতন শর্ত জুড়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘আপেলের ঋণমুক্ত হতে চাইলে আমার একটি প্রস্তাব তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। আমার একটি মেয়ে আছে। সে অন্ধ! খোঁড়া ও বধির। তাকে তোমার বিবাহ করতে হবে। নতুবা ঋণমুক্তি নেই।’

হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.) ভাবলেন, ক্ষমা না নিয়ে চলে গেলে সব পরিশ্রমই বৃথা। তদুপরি পরকালের শাস্তি তো আছেই। সুতরাং জীবন যৌবনের সব স্বাদ বিসর্জন দিয়ে হলেও ক্ষমা নিতে হবে। তাই তিনি অগত্যা এ বিবাহে রাজী হলেন। বিবাহ সুসম্পন্ন হলো। বিবাহ বাসরে দুলহান একাকী বসে আছেন। শ্বশুর সাহেব নূতন জামাইকে বাসর ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে চলে আসলেন। হযরত আবু সালেহ মুসা (র.) বাসর ঘরে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এক অনিন্দ্য সুন্দরী চক্ষুষ্মান দুলহান বসে আছেন। তাঁর হাত, পা, কান সবই ঠিক। তিনি ভাবলেন, বোধহয় মনিব আর এক অগ্নি পরীক্ষায় তাঁকে নিক্ষেপ করেছেন। তিনি পিছপা হয়ে চলে আসছিলেন। এমন সময় শ্বশুর সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘বাবা! তুমি আমার কথার মর্ম বুঝতে পারনি। আমার মেয়েকে আমি অন্ধ বলেছিলাম এজন্যে যে, সে অন্য পুরুষের দিকে কোন দিন তাকায়নি। তাকে খোঁড়া বলেছিলাম এ জন্যে যে, সে কোনদিন অন্যায় পথে পা বাড়ায়নি। তাকে বধির বলেছিলাম এ কারণে যে, সে কোনদিন অশ্লীল ও অধর্মের কথা তাঁর কানে শোনেনি। এবার তোমার চরিত্রের পরীক্ষা শেষ হলো। তোমার মত জামাই পেয়ে আমি ও আমার মেয়ে ধন্য।’ এরপর হযরত সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.) শ্বশুরের কথা শুনে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলেন। এমন স্ত্রী যার ঘরে আছে, দুনিয়াতেই তার বেহেস্ত। পরকালের হুর ও গেলমান তার কাছে তুচ্ছ। এই নব পরিণীতা বিবির নামই সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (র.)। যাঁদের ঘর আলোকিত করে দুনিয়ার বুকে আগমন করলেন গাউসে ছামদানী, নূরে ইয়াজদানী, মাহবুবে সোবহানী, কুতুবে রাববানী, গাউসুল আজম বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী আলা জাদ্দিহি নাবীয়ানা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম। এমন পিতা-মাতা হলে সন্তানও তেমনই হবে। আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। ১২ বৎসর যাঁর ঘরে থেকে খেদমত করলেন আবু সালেহ মুসা জঙ্গী, বিবাহের পূর্বে একটিবারও দেখলেন না সেই মনিব কন্যাকে। এটাই হলো আল্লাহর মহান আউলিয়াগণের চারিত্রিক উৎকর্ষতা।

এমনি এক মহান আউলিয়া পিতা-মাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন আউলিয়াদের শিরোমণি। তিনি বিশ্ব জগতকে আলোকিত করে ধরার বুকে আগমন করলেন গাউসুল আজম পীরানে পীর দস্তগীর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানী রূপে প্রখ্যাত আউলিয়া হিসেবে। তাঁর আগমনে ইসলাম পুনরুজ্জীবন লাভ করলো।

তাঁর আত্মদর্শন গ্রন্থে সুফি রহস্যভেদী কালাম, কারামত ও বেলায়েতের উচ্চতর দর্শনের পর্দা উন্মোচনের চেষ্টা করা হয়েছে। যা তরিকত জগতের আশেক-সালেক, পীর-মুর্শিদভক্ত পাঠক ও দরবারভুক্ত পীর-মাশায়েখসহ সকল পর্যায়ের প্রেমিকদের আত্মার খোরাক যোগাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যেদেনা ওয়া মাওলানা ওয়া নাবীয়ানা ওয়া শাফিয়ানা মোহাম্মাদিম মা’দানিল জুদে ওয়াল কারাম। ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া বারিক ওয়া সাল্লিম। ওয়া আলা সাইয়্যেদিল আম্বিয়া মুহিউদ্দিন শায়েখ মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানী মাহবুবে সুবহানী কুতুবে রব্বানী গাউসে সামদানী নূরে ইয়াজদানী আল হাসানী ওয়াল হুসাইনী আলা জাদ্দিহী নাবীয়ানা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম, উছিলাতী ইলাইকা। আমীন, ছুম্মা আমীন।

বইতরিকতে সম্রাট, সর্দারে আউলিয়া, গাউস উল আজম মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানি (রা.)-এর আত্মদর্শন
লেখকমোস্তাক আহমাদ
প্রকাশকরোদেলা প্রকাশনী
প্রকাশকালঅমর একুশে বইমেলা ২০২১
ধরণদর্শন, আত্মদর্শন, ধর্মদর্শন, জীবনচরিত
প্রচ্ছদশিল্পি
মূল্য
পরিবেশকরকমারি