০৩:০৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

জীবনী: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়, কর্মজীবন, চলচ্চিত্র, সাহিত্যকর্ম এবং পুরস্কার ও সম্মাননা

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ০৬:৪১:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ এপ্রিল ২০২২
  • / ৫২৩৩ বার পড়া হয়েছে

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা। অভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তি, তবে আবৃত্তি শিল্পী হিসেবেও তার নাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয়। তিনি কবি এবং অনুবাদকও। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪ টি সিনেমার ভিতর ১৪ টিতে অভিনয় করেছেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর কোভিড-১৯ মহামারীতে মৃত্যুবরণ করেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অপুর সংসার ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মতো পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা, এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন।

অভিনয়ের বাইরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটক ও কবিতা লিখেছেন এবং নাটক পরিচালনা করেছেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বংশ পরিচয় ও শিক্ষাজীবন

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্রর পিসিমা তারা দেবীর সঙ্গে ‘স্যার’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় | TBS Sketch, TBS News

সৌমিত্রর পিতৃদেব কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন এবং প্রতি সপ্তাহান্তে বাড়ি আসতেন। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স বিদ্যালয়ে। তারপর পিতৃদেবের চাকরি বদলের কারণে সৌমিত্রর বিদ্যালয়ও বদল হতে থাকে এবং উনি বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন হাওড়া জিলা স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অব আর্টস-এ দুই বছর পড়াশোনা করেন।

কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার সময় নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির কুমার ভাদুড়ীর সাথে যোগাযোগ ঘটে তার। তখন থেকে অভিনয়কে জীবনের প্রধান লক্ষ্য করে নেবার কথা দেখেছিলেন। ভাদুড়ির অভিনয় সৌমিত্রকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

রেডিয়োতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কর্মজীবন শুরু করেন আকাশবাণীর ঘোষক হিসেবে। পাশাপাশি থিয়েটারে অভিনয় এবং ছবিতে অডিশন দিচ্ছিলেন। ১৯৫৭ সালে পরিচালক কার্তিক বসুর নীলাচলে মহাপ্রভু ছবিতে অডিশন দিলেও জায়গা পাননা, তার বদলে সুযোগ পেয়েছিলেন অসীমকুমার।

চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সুদীর্ঘ ষাট বছরের চলচ্চিত্রজীবনে ৩০০’র বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন প্রমুখ অভিনেত্রীর প্রথম কাজও তার বিপরীতে ছিল।

১৯৬০ সালে তপন সিংহের পরিচালনায় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পরের বছর আবার কাজ সত্যজিতের সঙ্গে। ‘তিন কন্যা’র ‘সমাপ্তি’-তে অপর্ণা সেনের বিপরীতে তিনি অমূল্য চরিত্রে অভিনয় করেন। তপন সিংহের ‘ঝিন্দের বন্দি’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে উত্তম কুমারের সাথে অভিনয় করেন তিনি। তখন শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে উত্তম কুমারের সাথে তাকে নিয়ে ভক্তরা বিভক্ত ছিল। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পুনশ্চ চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মত মৃণাল সেনের পরিচালনায় অভিনয় করেন। ১৯৬২ সালে অজয় করের পরিচালনায় সূচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

থিয়েটারের প্রতি তার আজন্ম ভালোবাসা ছিল। ‘সোনার কেল্লার’ দৃশ্যায়নের সময় কেল্লার এক স্থানে দ্রুত দৃশ্যায়ন করা হয়, যেন পরবর্তীতে সৌমিত্র দ্রুত কলকাতায় ফিরে থিয়েটারে অভিনয় করতে পারেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর সর্বপ্রথম কাজ প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে, যা ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। ছবিটি পরিচালকের ৫ম চলচ্চিত্র পরিচালনা। তিনি এর আগে রেডিয়োর ঘোষক ছিলেন এবং মঞ্চে ছোটো চরিত্রে অভিনয় করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ২৭টি চলচ্চিত্রের ১৪ টিতে অভিনয় করেন।

সত্যজিৎ রায় নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয় যে তাকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্যগুলো লেখা হয়। সত্যজিৎ রায়-এর দ্বিতীয় শেষ চলচ্চিত্র শাখা প্রশাখা-তেও তিনি অভিনয় করেন। তার চেহারা দেখে সত্যজিৎ বলেছিলেন, “তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ”। অনেকের মতে, সত্যজিতের মানসপুত্র সৌমিত্র।

সত্যজিত রায়কে নিয়ে সৌমিত্র মানিকদার সঙ্গে নামে একটি বইও লিখেছিলেন । তার ইংরেজি অনুবাদটির নাম “দা মাস্টার অ্যান্ড আই”

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি ‘সোনার কেল্লা’ বের হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারতেন না।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত সেরা কিছু চলচ্চিত্র

ক্লাসিক অপু

ক্লাসিক অপুর সংসার সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন কিংবদন্তী সৌমিত্র। সিনেমাটি প্রকাশ হওয়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’; শর্মিলা ঠাকুরের সাথে তার এ সংলাপ ও রসায়ন এখনও বাঙালির মনে ঢেউ তোলে। পরে নারী মহলে ঢেউ তোলা এ সুদর্শন পুরুষকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

অপুর সংসার

১৯৫৯ সালে সেনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। চলচ্চিত্রটি অপু ট্রিলোজির শেষ পর্ব। এই চলচ্চিত্রতেই বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং শর্মিলা ঠাকুর প্রথমবার অভিনয় করেন।

দেবী

১৯৬০ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এ ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, ছবি বিশ্বাস, অনিল চট্টোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এ সিনেমা সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার রাষ্ট্রপতি রৌপ্য পদক লাভ করে ১৯৬০ সালে। এছাড়াও ১৯৬২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পালমে ডি’অর এ মনোনীত হয়েছিল সেই সময়।

সাত পাকে বাধা

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা সেন এতে অভিনয় করেন। ছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক অজয় কর।

চারুলতা

‘চারুলতা’ হলো সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়োগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি ইংরেজিভাষী বিশ্বে The Lonely Wife নামে পরিচিত। সার্থক চিত্রায়নের খাতিরে এতে গল্পের কাহিনি খানিকটা পরিবর্তন করা হয়। এতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অমল চরিত্রে অভিনয় করেন।

কাপুরুষ

১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাপুরুষ’ সিনেমার মূল নাম ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’। দুটি পৃথক গল্পকে একত্র করে নির্মিত এ সিনেমা। প্রথম গল্পের নাম কাপুরুষ; এর মূল গল্পকার সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের জনৈক কাপুরুষের গল্প থেকে নেয়া।

বাক্স বদল

১৯৬৫ সালের নিত্যানন্দ দত্ত পরিচালিত ‘বাক্স বদল’ চলচ্চিত্রটি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গীতায়োজনে প্রকাশ করেছিল ডিএম প্রডাকশন্স হাউজ। এতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও আরও অভিনয় করেছেন অপর্ণা সেন, প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, সুব্রত সেন, এবং সাবিত্রি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সিনেমাটি সম্পূর্ণ কমেডি ধাঁচের।

অশনি সংকেত

ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। অশনি সংকেত সিনেমার পরিচালক সত্যজিৎ রায়। অশনি সংকেত চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরিতে অভিনয় করেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী ববিতা।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা

বসন্ত বিলাপ

১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পরিচালক দীনেন গুপ্তর হাস্য রসাত্মক ছবি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, রবি ঘোষ প্রমুখ শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেন। 

জয় বাবা ফেলুনাথ

সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় নির্মিত তারই রচিত একই নামের ফেলুদার গোয়েন্দা উপন্যাস নিয়ে একটি চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মগনলাল মেঘরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত। এটা সত্যজিৎ রায় নির্মিত দ্বিতীয় ও শেষ ফেলুদা চলচ্চিত্র।

সোনার কেল্লা

সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় নির্মিত একটি রহস্য রোমাঞ্চ চলচ্চিত্র। সত্যজিৎ রায় নিজের কাহিনী নিয়েই চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছিলেন। তিনি সোনার কেল্লা উপন্যাসটি রচনা করেন ১৯৭১ সালে। সোনার কেল্লা মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে।

দেবদাস

১৯৭৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি। ছবিটিতে দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। 

হীরক রাজার দেশে

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। রুপকের আশ্রয় নিয়ে চলচ্চিত্রটিতে কিছু ধ্রুব সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিরিজের একটি চলচ্চিত্র। এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে মূল শিল্পীদের সকল সংলাপ ছড়ার আকারে করা হয়েছে। তবে কেবল একটি চরিত্র ছড়ার ভাষায় কথা বলেননি। তিনি হলেন শিক্ষক। এ দ্বারা বোঝানো হয়েছে একমাত্র শিক্ষক মুক্ত চিন্তার অধিকারী, বাদবাকি সবার চিন্তাই নির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ। ‘গুপি বাঘা’ সিরিজের এই গল্পে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে এক বিশেষ ভূমিকাতে দেখা গিয়েছিলে।  

ঘরে বাইরে

ঘরে বাইরেও সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একই নামের একটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। এই ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, জেনিফার কাপুর ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। সত্যজিৎ রায় ১৯৪০-এর দশকে তার প্রথম ছবি পথের পাঁচালী নির্মাণেরও আগে এই ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন। এই ছবির বিষয়বস্তু নারীমুক্তি, যা সত্যজিতের বহু ছবিতে বহু ভাবে উঠে এসেছে।

বেলা শেষে

২০১৫ সালের মে মাসের ১ তারিখে কলকাতায় মুক্তি পায় এ ভারতীয় চলচ্চিত্রটি। এতে সাহিত্যপ্রেমী সৌমিত্র দুর্গা উৎসব উপলক্ষে ছেলে, ছেলের বউ, তিন মেয়ে এবং মেয়ের জামাইদের একত্র করেন। সকলের চিন্তা ভাবনা— বাবা বোধয় তার সম্পত্তির উইল পড়ে শোনাবেন তাদের; কিন্তু না। উপস্থিত সবাইকে অবাক হওয়ার মতো বার্তা শোনান সৌমিত্র। দীর্ঘ ৪৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি চান তিনি। স্ত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তার সাথে আর একত্রে থাকবেন না। বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছেন। তাই আদালতের দ্বারস্থ হলে তাদের ১৫ দিন একসঙ্গে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তারা আবার সেই আগের মতো শুরু করেন জীবন-যাপন।

সাহিত্যিক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

চলচ্চিত্র ও থিয়েটারে অভিনয়ের বাইরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন সাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রধানতঃ কবিতা লিখতেন, সে হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন কবি ছিলেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিছু বইয়ের তালিকা দেওয়া হলো—

  • শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩)
  • মানিক দা’র সঙ্গে (২০১৪)
  • পরিচয় (২০১৩)
  • অগ্রপথিকেরা (২০১০)
  • প্রতিদিন তব গাঁথা (২০০৯)
  • চরিত্রের সন্ধানে (২০০৪)
  • শব্দরা আমার বাগানে
  • কবিতা সমগ্র (২০১৪)
  • মধ্যরাতের সংকেত (২০১২)
  • নাটক সমগ্র ১ (২০১৫)
  • নাটক সমগ্র ২ (২০১৭)
  • নাটক সমগ্র ৩
  • গদ্য সংগ্রহ (২ খন্ডে)
  • শেষ বেলায় (২০২২)

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পুরষ্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি

প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান ১৯৯১ সালে, অন্তর্ধান চলচ্চিত্রের জন্য বিশেষ জুরি বিভাগে। ৯ বছর পরে দেখা চলচ্চিত্রের জন্য একই বিভাগে পুরস্কার পান। অভিনয়জীবনের সুদীর্ঘ পাঁচ দশক পর ২০০৬ সালে পদক্ষেপ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সম্মানিত হন তিনি। ২০১২-এ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।

  • ২০০৪ সালে পদ্মভূষণ সম্মান, ভারত সরকার
  • ২০১২ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ
  • ফরাসি সরকারের দেওয়া সম্মান ‘লেজিয়ঁ দ্য নর’ এবং ‘কম্যান্দর দ্য লার্দ্র দে আর্ত্ এ দে লের্ত্র’-এ ভূষিত হন তিনি।
  • ২০০০ সালে সাম্মানিক ডি.লিট., রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
  • ২০০৪ সালে পদ্ম ভূষণ, ভারত সরকার
  • ২০১২ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ভারত সরকার
  • ২০১৭ সালে লিজিওন অফ অনার ফ্রান্স সরকার
  • কম্যান্দর দ্য লার্দ্র দে আর্ত্ এ দে লের্ত্র, (Commandeur de l’Ordre des Arts et des Lettres), ফ্রান্স
  • ২০১৭ সালে বঙ্গবিভূষণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার (২০১৩ সালে এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন)

মৃত্যু

২০২০ সালের ১ অক্টোবর বাড়িতে থাকা অবস্থাতে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শমতে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৫ অক্টোবর কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। এর পরের দিন ৬ অক্টোবর তাকে বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করা‌নো হয়। এখানে ১৪ অক্টোবর করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। এরপর সৌমিত্র খানিক সুস্থ হতে থাকেন। চিকিৎসা চলা অবস্থাতে ২৪ অক্টোবর রাতে অবস্থার অবনতি ঘটে। কিডনির ডায়ালাইসিস করানো হয়, প্লাজমা থেরাপি পূর্বেই দেয়া হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হতে থাকলে পরিবারের লোকজনকে জানানো হয়। অবশেষে ১৫ই নভেম্বর, ২০২০ তারিখে ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ অভিনেতা অঙ্গনের অনেকেই শোকপ্রকাশ করেন। গান স্যালুটে ক্যাওড়াতলায় বিদায় জানানো হয় তাকে।

উৎস

  • ইত্তেফাক
  • উইকিপিডিয়া
  • প্রথম আলো
  • আনন্দবাজার
  • বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

জীবনী: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়, কর্মজীবন, চলচ্চিত্র, সাহিত্যকর্ম এবং পুরস্কার ও সম্মাননা

প্রকাশ: ০৬:৪১:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ এপ্রিল ২০২২

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা। অভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তি, তবে আবৃত্তি শিল্পী হিসেবেও তার নাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয়। তিনি কবি এবং অনুবাদকও। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪ টি সিনেমার ভিতর ১৪ টিতে অভিনয় করেছেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর কোভিড-১৯ মহামারীতে মৃত্যুবরণ করেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অপুর সংসার ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মতো পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা, এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন।

অভিনয়ের বাইরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটক ও কবিতা লিখেছেন এবং নাটক পরিচালনা করেছেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বংশ পরিচয় ও শিক্ষাজীবন

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্রর পিসিমা তারা দেবীর সঙ্গে ‘স্যার’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় | TBS Sketch, TBS News

সৌমিত্রর পিতৃদেব কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন এবং প্রতি সপ্তাহান্তে বাড়ি আসতেন। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স বিদ্যালয়ে। তারপর পিতৃদেবের চাকরি বদলের কারণে সৌমিত্রর বিদ্যালয়ও বদল হতে থাকে এবং উনি বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন হাওড়া জিলা স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অব আর্টস-এ দুই বছর পড়াশোনা করেন।

কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার সময় নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির কুমার ভাদুড়ীর সাথে যোগাযোগ ঘটে তার। তখন থেকে অভিনয়কে জীবনের প্রধান লক্ষ্য করে নেবার কথা দেখেছিলেন। ভাদুড়ির অভিনয় সৌমিত্রকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

রেডিয়োতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কর্মজীবন শুরু করেন আকাশবাণীর ঘোষক হিসেবে। পাশাপাশি থিয়েটারে অভিনয় এবং ছবিতে অডিশন দিচ্ছিলেন। ১৯৫৭ সালে পরিচালক কার্তিক বসুর নীলাচলে মহাপ্রভু ছবিতে অডিশন দিলেও জায়গা পাননা, তার বদলে সুযোগ পেয়েছিলেন অসীমকুমার।

চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সুদীর্ঘ ষাট বছরের চলচ্চিত্রজীবনে ৩০০’র বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন প্রমুখ অভিনেত্রীর প্রথম কাজও তার বিপরীতে ছিল।

১৯৬০ সালে তপন সিংহের পরিচালনায় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পরের বছর আবার কাজ সত্যজিতের সঙ্গে। ‘তিন কন্যা’র ‘সমাপ্তি’-তে অপর্ণা সেনের বিপরীতে তিনি অমূল্য চরিত্রে অভিনয় করেন। তপন সিংহের ‘ঝিন্দের বন্দি’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে উত্তম কুমারের সাথে অভিনয় করেন তিনি। তখন শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে উত্তম কুমারের সাথে তাকে নিয়ে ভক্তরা বিভক্ত ছিল। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পুনশ্চ চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মত মৃণাল সেনের পরিচালনায় অভিনয় করেন। ১৯৬২ সালে অজয় করের পরিচালনায় সূচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

থিয়েটারের প্রতি তার আজন্ম ভালোবাসা ছিল। ‘সোনার কেল্লার’ দৃশ্যায়নের সময় কেল্লার এক স্থানে দ্রুত দৃশ্যায়ন করা হয়, যেন পরবর্তীতে সৌমিত্র দ্রুত কলকাতায় ফিরে থিয়েটারে অভিনয় করতে পারেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর সর্বপ্রথম কাজ প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে, যা ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। ছবিটি পরিচালকের ৫ম চলচ্চিত্র পরিচালনা। তিনি এর আগে রেডিয়োর ঘোষক ছিলেন এবং মঞ্চে ছোটো চরিত্রে অভিনয় করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ২৭টি চলচ্চিত্রের ১৪ টিতে অভিনয় করেন।

সত্যজিৎ রায় নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয় যে তাকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্যগুলো লেখা হয়। সত্যজিৎ রায়-এর দ্বিতীয় শেষ চলচ্চিত্র শাখা প্রশাখা-তেও তিনি অভিনয় করেন। তার চেহারা দেখে সত্যজিৎ বলেছিলেন, “তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ”। অনেকের মতে, সত্যজিতের মানসপুত্র সৌমিত্র।

সত্যজিত রায়কে নিয়ে সৌমিত্র মানিকদার সঙ্গে নামে একটি বইও লিখেছিলেন । তার ইংরেজি অনুবাদটির নাম “দা মাস্টার অ্যান্ড আই”

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি ‘সোনার কেল্লা’ বের হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারতেন না।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত সেরা কিছু চলচ্চিত্র

ক্লাসিক অপু

ক্লাসিক অপুর সংসার সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন কিংবদন্তী সৌমিত্র। সিনেমাটি প্রকাশ হওয়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’; শর্মিলা ঠাকুরের সাথে তার এ সংলাপ ও রসায়ন এখনও বাঙালির মনে ঢেউ তোলে। পরে নারী মহলে ঢেউ তোলা এ সুদর্শন পুরুষকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

অপুর সংসার

১৯৫৯ সালে সেনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। চলচ্চিত্রটি অপু ট্রিলোজির শেষ পর্ব। এই চলচ্চিত্রতেই বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং শর্মিলা ঠাকুর প্রথমবার অভিনয় করেন।

দেবী

১৯৬০ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এ ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, ছবি বিশ্বাস, অনিল চট্টোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এ সিনেমা সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার রাষ্ট্রপতি রৌপ্য পদক লাভ করে ১৯৬০ সালে। এছাড়াও ১৯৬২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পালমে ডি’অর এ মনোনীত হয়েছিল সেই সময়।

সাত পাকে বাধা

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা সেন এতে অভিনয় করেন। ছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়। পরিচালক অজয় কর।

চারুলতা

‘চারুলতা’ হলো সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়োগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি ইংরেজিভাষী বিশ্বে The Lonely Wife নামে পরিচিত। সার্থক চিত্রায়নের খাতিরে এতে গল্পের কাহিনি খানিকটা পরিবর্তন করা হয়। এতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অমল চরিত্রে অভিনয় করেন।

কাপুরুষ

১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাপুরুষ’ সিনেমার মূল নাম ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’। দুটি পৃথক গল্পকে একত্র করে নির্মিত এ সিনেমা। প্রথম গল্পের নাম কাপুরুষ; এর মূল গল্পকার সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের জনৈক কাপুরুষের গল্প থেকে নেয়া।

বাক্স বদল

১৯৬৫ সালের নিত্যানন্দ দত্ত পরিচালিত ‘বাক্স বদল’ চলচ্চিত্রটি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গীতায়োজনে প্রকাশ করেছিল ডিএম প্রডাকশন্স হাউজ। এতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও আরও অভিনয় করেছেন অপর্ণা সেন, প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, সুব্রত সেন, এবং সাবিত্রি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সিনেমাটি সম্পূর্ণ কমেডি ধাঁচের।

অশনি সংকেত

ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। অশনি সংকেত সিনেমার পরিচালক সত্যজিৎ রায়। অশনি সংকেত চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরিতে অভিনয় করেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী ববিতা।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা

বসন্ত বিলাপ

১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পরিচালক দীনেন গুপ্তর হাস্য রসাত্মক ছবি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, রবি ঘোষ প্রমুখ শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেন। 

জয় বাবা ফেলুনাথ

সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় নির্মিত তারই রচিত একই নামের ফেলুদার গোয়েন্দা উপন্যাস নিয়ে একটি চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মগনলাল মেঘরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত। এটা সত্যজিৎ রায় নির্মিত দ্বিতীয় ও শেষ ফেলুদা চলচ্চিত্র।

সোনার কেল্লা

সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় নির্মিত একটি রহস্য রোমাঞ্চ চলচ্চিত্র। সত্যজিৎ রায় নিজের কাহিনী নিয়েই চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছিলেন। তিনি সোনার কেল্লা উপন্যাসটি রচনা করেন ১৯৭১ সালে। সোনার কেল্লা মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে।

দেবদাস

১৯৭৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি। ছবিটিতে দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। 

হীরক রাজার দেশে

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। রুপকের আশ্রয় নিয়ে চলচ্চিত্রটিতে কিছু ধ্রুব সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিরিজের একটি চলচ্চিত্র। এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে মূল শিল্পীদের সকল সংলাপ ছড়ার আকারে করা হয়েছে। তবে কেবল একটি চরিত্র ছড়ার ভাষায় কথা বলেননি। তিনি হলেন শিক্ষক। এ দ্বারা বোঝানো হয়েছে একমাত্র শিক্ষক মুক্ত চিন্তার অধিকারী, বাদবাকি সবার চিন্তাই নির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ। ‘গুপি বাঘা’ সিরিজের এই গল্পে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে এক বিশেষ ভূমিকাতে দেখা গিয়েছিলে।  

ঘরে বাইরে

ঘরে বাইরেও সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একই নামের একটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। এই ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, জেনিফার কাপুর ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। সত্যজিৎ রায় ১৯৪০-এর দশকে তার প্রথম ছবি পথের পাঁচালী নির্মাণেরও আগে এই ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন। এই ছবির বিষয়বস্তু নারীমুক্তি, যা সত্যজিতের বহু ছবিতে বহু ভাবে উঠে এসেছে।

বেলা শেষে

২০১৫ সালের মে মাসের ১ তারিখে কলকাতায় মুক্তি পায় এ ভারতীয় চলচ্চিত্রটি। এতে সাহিত্যপ্রেমী সৌমিত্র দুর্গা উৎসব উপলক্ষে ছেলে, ছেলের বউ, তিন মেয়ে এবং মেয়ের জামাইদের একত্র করেন। সকলের চিন্তা ভাবনা— বাবা বোধয় তার সম্পত্তির উইল পড়ে শোনাবেন তাদের; কিন্তু না। উপস্থিত সবাইকে অবাক হওয়ার মতো বার্তা শোনান সৌমিত্র। দীর্ঘ ৪৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি চান তিনি। স্ত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তার সাথে আর একত্রে থাকবেন না। বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছেন। তাই আদালতের দ্বারস্থ হলে তাদের ১৫ দিন একসঙ্গে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তারা আবার সেই আগের মতো শুরু করেন জীবন-যাপন।

সাহিত্যিক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

চলচ্চিত্র ও থিয়েটারে অভিনয়ের বাইরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন সাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রধানতঃ কবিতা লিখতেন, সে হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন কবি ছিলেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিছু বইয়ের তালিকা দেওয়া হলো—

  • শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩)
  • মানিক দা’র সঙ্গে (২০১৪)
  • পরিচয় (২০১৩)
  • অগ্রপথিকেরা (২০১০)
  • প্রতিদিন তব গাঁথা (২০০৯)
  • চরিত্রের সন্ধানে (২০০৪)
  • শব্দরা আমার বাগানে
  • কবিতা সমগ্র (২০১৪)
  • মধ্যরাতের সংকেত (২০১২)
  • নাটক সমগ্র ১ (২০১৫)
  • নাটক সমগ্র ২ (২০১৭)
  • নাটক সমগ্র ৩
  • গদ্য সংগ্রহ (২ খন্ডে)
  • শেষ বেলায় (২০২২)

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পুরষ্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি

প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান ১৯৯১ সালে, অন্তর্ধান চলচ্চিত্রের জন্য বিশেষ জুরি বিভাগে। ৯ বছর পরে দেখা চলচ্চিত্রের জন্য একই বিভাগে পুরস্কার পান। অভিনয়জীবনের সুদীর্ঘ পাঁচ দশক পর ২০০৬ সালে পদক্ষেপ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সম্মানিত হন তিনি। ২০১২-এ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।

  • ২০০৪ সালে পদ্মভূষণ সম্মান, ভারত সরকার
  • ২০১২ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ
  • ফরাসি সরকারের দেওয়া সম্মান ‘লেজিয়ঁ দ্য নর’ এবং ‘কম্যান্দর দ্য লার্দ্র দে আর্ত্ এ দে লের্ত্র’-এ ভূষিত হন তিনি।
  • ২০০০ সালে সাম্মানিক ডি.লিট., রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
  • ২০০৪ সালে পদ্ম ভূষণ, ভারত সরকার
  • ২০১২ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ভারত সরকার
  • ২০১৭ সালে লিজিওন অফ অনার ফ্রান্স সরকার
  • কম্যান্দর দ্য লার্দ্র দে আর্ত্ এ দে লের্ত্র, (Commandeur de l’Ordre des Arts et des Lettres), ফ্রান্স
  • ২০১৭ সালে বঙ্গবিভূষণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার (২০১৩ সালে এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন)

মৃত্যু

২০২০ সালের ১ অক্টোবর বাড়িতে থাকা অবস্থাতে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শমতে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৫ অক্টোবর কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। এর পরের দিন ৬ অক্টোবর তাকে বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করা‌নো হয়। এখানে ১৪ অক্টোবর করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। এরপর সৌমিত্র খানিক সুস্থ হতে থাকেন। চিকিৎসা চলা অবস্থাতে ২৪ অক্টোবর রাতে অবস্থার অবনতি ঘটে। কিডনির ডায়ালাইসিস করানো হয়, প্লাজমা থেরাপি পূর্বেই দেয়া হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হতে থাকলে পরিবারের লোকজনকে জানানো হয়। অবশেষে ১৫ই নভেম্বর, ২০২০ তারিখে ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ অভিনেতা অঙ্গনের অনেকেই শোকপ্রকাশ করেন। গান স্যালুটে ক্যাওড়াতলায় বিদায় জানানো হয় তাকে।

উৎস

  • ইত্তেফাক
  • উইকিপিডিয়া
  • প্রথম আলো
  • আনন্দবাজার
  • বিবিসি বাংলা