১২:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
                       

বংশগতি, জিনতত্ত্ব, মেন্ডেলবাদ এবং জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্সে ব্যবহৃত কিছু প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা

জারিন তাসনিম
  • প্রকাশ: ০৭:৪০:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল ২০২২
  • / ২৯৬৩ বার পড়া হয়েছে

প্রজনন জীবের একটি বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য পরবর্তী বংশধরে সঞ্চালিত হওয়ার মাধ্যমে জীব তার নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখে, একে বংশগতি (Heredity) বলে। বিজ্ঞানের যে শাখায় জিনের গঠন, কার্যপদ্ধতি ও তার বংশানুক্রমিক সঞ্চালন পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয় তাই জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স (Genetics)। আর জিন হলো বংশগতির মৌলিক একক যা বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে বংশধারা ধরে রাখে। অপরদিকে প্রকৃতিতে যে মন্থর ও ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অতীতে উদ্ভূত কোনো সরল জীব হতে জটিল ও উন্নত জীবের আবির্ভাব ঘটে তাকে বিবর্তন (Evolution) বলে। এখানে জিনতত্ত্ব ও বিবর্তন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

মেন্ডেলিজম ও মেন্ডেলিয়ান বংশগতি (Mendelism and Mendelian Inheritance)

গ্রেগর জোহান মেন্ডেল সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি বংশগতির নীতিসমূহ উদ্ভাবনে সমর্থ হন। মেন্ডেল ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই ২ তারিখ তৎকালীন অস্ট্রোহাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সাইলেসিয়া (Silesia) অঞ্চলের হাইজেনডর্ফ (Heinzendorf) বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের অংশ) গ্রামের এক গরিব কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জার্মান ও চেক শ্রি বংশোদ্ভুত পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর মেন্ডেল প্রধানত আর্থিক কারণে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার মোরাভিয়া অঞ্চলে ব্রন (Brun, বর্তমানে ব্রুনো: Brno; চেক প্রজাতন্ত্র) নামক স্থানের অগাস্টিনিয়ান মঠে শিক্ষানবীশ হিসেব যোগদান করেন। চার বৎসর পর তিনি যাজক হন। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে স্নেম প্রিপারেটরি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অতঃপর ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৮৫৩ পর্যন্ত পড়াশোনা করে ব্রুনে ফিরে আসেন। ব্রুনে মডার্ন স্কুলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১২ বৎসর একজন সার্থক শিক্ষক হিসেবে সুনামের সাথে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ সাত বৎসর গবেষণা করেন।

জোহান গ্রেগর মেন্ডেল স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় মঠের বাগানে অবসর সময়ে মটরশুঁটি উদ্ভিদ নিয়ে ১৮৫৭ থেকে গবেষণা শুরু করেন। উল্লেখ্য, মটরশুঁটির বৈজ্ঞানিক নাম— Pisum sativum (পিসাম স্যাভিটাম)। সঙ্করায়ণ (Hybridization) পরীক্ষার জন্য মটরশুঁটি উদ্ভিদকে নির্বাচন করেন। মটরশুঁটি উদ্ভিদ উভলিঙ্গী, স্বপরাগায়নের মাধ্যমে যৌন প্রজনন সম্পন্ন হয়। পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবককে ঘিরে দলমণ্ডল (Corolla) এমনভাবে সজ্জিত যে, পরনিষেকের (Cross fertilization) কোন সম্ভাবনা নেই। ফলে বিভিন্ন জাতের (Variety) মটরশুঁটি উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যগুলো খাঁটি বা বিশুদ্ধ অবস্থায় আছে। অত্যন্ত অল্প সময়ে এর জীবনচক্র সম্পন্ন হয় এবং স্বল্প শ্রম ও ব্যয়ে অধিক সংখ্যক অপত্য বংশ উৎপন্ন হয়। অপত্য বংশে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট প্রকাশ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল।

মেন্ডেল বিভিন্ন উৎস হতে ৩৪ ধরনের মটরশুঁটি উদ্ভিদের বীজ সংগ্রহ করে আশ্রমের বাগানে প্রায় এক বৎসর প্রত্যেক ধরনের বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর পরীক্ষায় ব্যবহৃত সাতটি চরিত্রের (trait) জন্য (কাণ্ডের দৈর্ঘ্য, ফুলের অবস্থান, ফুলের রং, ফলের বর্ণ, ফলের আকৃতি, বীজের বর্ণ এবং বীজের আকৃতি) একজোড়া করে বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ১৪টি খাঁটি উদ্ভিদ নির্বাচন করেন। প্রতি জোড়া বৈশিষ্ট্য পরস্পর বিপরীতধর্মী।

মটরশুঁটি উদ্ভিদের নির্বাচিত বৈশিষ্ট্যের প্রতিটি একটি মাত্র জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। বৈশিষ্ট্য নির্বাচনের বিষয়ে মেন্ডেল অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ছিলেন। কারণ জটিল বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করলে মেন্ডেল বংশগতির অন্তর্নিহিত নীতিগুলো হয়তোবা আবিষ্কার করতে পারতেন না।

জোহান গ্রেগর মেন্ডেল একটি যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে সঙ্করায়ন পরীক্ষা পরিচালনা করেন। অত্যন্ত সাবধানতার সাথে পরীক্ষণসমূহ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তিনি যে পরাগরেণু স্থানান্তর করেছেন তার দ্বারাই পরাগায়ন হয়েছে তা নিশ্চিত করেন। সঙ্করায়নকালে মেন্ডেল অপত্য অংশে একসাথে মাত্র একটি চরিত্র পর্যবেক্ষণ করেন এবং সম্পূর্ণ উপাত্ত (data) সংরক্ষণ করেন। অতঃপর পরিসংখ্যান (statistics) এর প্রয়োগ দ্বারা এ উপাত্ত থেকেই লব্ধ ফলাফলের যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণপূর্বক এবং একটানা প্রায় এক দশকের নিরলস পরিশ্রম দ্বারা বংশগতির নিয়ম সম্পর্কে পার্টিকুলেট থিওরি (Particulate Theory) উপস্থাপন করেন।

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সঙ্করায়ন ও বংশগতি সম্বন্ধে তাঁর গবেষণার বিবরণ ও ফলাফল ব্রুন ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির পরপর দুটি বৈজ্ঞানিক সভায় উপস্থাপন করেন। সোসাইটির বার্ষিক মুখপত্রেও গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয়। 

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় তৎকালীন বিশ্বে কেউই ধর্মযাজক মেন্ডেল এর গবেষণা ফলাফলের গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেন্ডেল মঠাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ৬ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জীবদ্দশায় তাঁর গবেষণা কর্মের জন্য তিনি কোনো স্বীকৃতি লাভ করেননি।

মেন্ডেলের গবেষণাপত্র প্রকাশের ৩৫ বৎসর পর বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই হল্যান্ডের ডি ভ্রিস (de Vries), জার্মানির কার্ল করেন্স (Karl Correns) ও অস্ট্রিয়ার শেরমাক (Tschermak) পৃথক পৃথকভাবে গবেষণা করে মেন্ডেল এর ফলাফলকে সমর্থন করেন। বর্তমানে বিশ্বে মেন্ডেল এর আবিষ্কার অর্থাৎ পার্টিকুলেট থিওরি (Particulate Theory) একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পার্টিকুলেট থিওরিতে বর্ণিত সুত্রগুলো জেনেটিক্সে মেন্ডেলের সূত্র (Mendel’s Law) নামে অভিহিত। মেন্ডেলের সূত্র অনুযায়ী জীবের বৈশিষ্ট্যসমূহ বংশগতিতে সঞ্চারণের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তাকেই মেন্ডেলতত্ত্ব Mendelism) বলে। মেন্ডেলতত্ত্ব আধুনিক জেনেটিক্স এর প্রধান ভিত্তি। এ কারণেই মেন্ডেলকে জেনেটিক্স এর জনক বলা হয়ে থাকে।

পার্টিকুলেট থিওরী (Particulate Theory) বা মেন্ডেলতত্ত্ব (Mendelism) অনুযায়ী জীবে বংশগতির একক বিদ্যমান থাকে বা মিশ্রিত হয়না, শুধুমাত্র সুপ্ত থাকে। মেন্ডেলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মটরশুঁটি উদ্ভিদে প্রতিটি চরিত্রের (trait) জন্য (কাণ্ডের দৈর্ঘ্য, ফুলের অবস্থান, রং, ফলের বর্ণ, ফলের আকৃতি, বীজের বর্ণ এবং বীজের আকৃতি) এক জোড়া ফ্যাক্টর থাকে, যার একটি আসে পিতা থেকে এবং অপর একটি আসে মাতা থেকে। গ্যামিটে শুধু একটি একক উপস্থিত থাকে এবং পরবর্তী জনুতে সঞ্চারিত হয়। মেন্ডেল বর্ণিত পার্টিকল বা ফ্যাক্টর অবশ্যই জিন। আর একটি মাত্র জিন দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত বৈশিষ্ট্য মেন্ডেলিয়ান বৈশিষ্ট্য (Mendelian trait) বলে এবং মেন্ডেলিয়ান বৈশিষ্ট্যর সঞ্চায়ণকে মেন্ডেলিয়ান বংশগতি (Mendelian inheritance) বলা হয়।

মেন্ডেলের প্রথম সূত্র

সংকর জীবে বিপরীত বৈশিষ্টের জীনগুলো মিশ্রিত বা পরিবর্তিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং জননকোষ সৃষ্টির সময় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়।

মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র

দুই বা ততোধিক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্টের জীবের মধ্যে ক্রস ঘটালে প্রথম সংকর পুরুষে শুধু প্রকট বৈশিষ্টগুলোই প্রকাশিত হবে , কিন্তু জনন কোষ উৎপাদন কালে বৈশিষ্ট্যগুলো জোড়া ভেঙ্গে পরস্পর থেকে সতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জনন কোষে প্রবেশ করে ।

জেনেটিক্সে ব্যবহৃত কয়েকটি প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা

জিন (Gene)

ডব্লিউ. এল.  জোহানসেন (W. L. Johannsen) ১৯০৯ খিস্টাব্দে জিন শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে মেন্ডেল এর অনুমানকৃত জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারক বস্তুটি হলো এলিমেন্টিস বা ফ্যাক্টর (elements or factor) যা পরবর্তীকালে জিন নামে অভিহিত হয়। জিন হচ্ছে বংশগতির মৌলিক একক (basic unit of heredity) এবং এরা বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে বংশগতিধারা অব্যাহত রাখে। জিনকে সংজ্ঞায়িত করা যায় এভাবে- জিন হচ্ছে পলিপেপটাইড সংশ্লেষের জন্য সংকেত প্রদানকারী DNA অণুর অংশ বিশেষ (gene is a part of a DNA molecule code for polypeptide synthesis)।

লোকাস (Locus.Pl-Loci)

ক্রোমোসোমে একটি জিনের অবস্থানকে লোকাস বলে।

অ্যালিল (Allele), অ্যালিলোমর্ফ (Allelomorph)

ক্রোমোসোমের একই লোকাসে অবস্থানকারী জিনগুলোকে পরস্পরের অ্যালিল বলা হয়। জিনগুলোর একত্রে অবস্থান করাকে অ্যালিলোমর্ফ বলে। মনে করি, মানুষে বাদামী চোখের রং এর জন্য দায়ী জিন ই ও নীল চোখের রং এর জন্য দায়ী জিন b পরস্পরের অ্যালিল।

জিনোটাইপ (Genotype)

জীবদেহের দৃশ্যমান অথবা সুপ্ত বেশিষ্ট্যগুলোর নিয়ন্ত্রক জিনসমূহের গঠনকে জিনোটাইপ বলে। 

ফিনোটাইপ (Phenotype)

জীবদেহের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যসমূহকে ফিনোটাইপ বলে। ফিনোটাইপ প্রকৃতপক্ষে জিনোটাইপের জিনসমূহের বাহ্যিক প্রকাশ। 

হোমোজাইগাস (Homozygous) ও হেটারোজাইগাস (Heterozygous)

জীবে একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিন জোড়া একই রকমের (উভয় জিনই প্রকট বা প্রচ্ছন্ন) হলে তাকে হোমোজাইগাস জীব বলে। জিন জোড়া ভিন্ন রকমের হলে সে জীবকে হেটারোজাইগাস জীব বলে।

প্রকট (Dominant) ও প্রচ্ছন্ন (Recessive)

এক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবে সঙ্করায়ন ঘটালে ১ম অপত্য বংশে সঙ্কর জীবে ঐ বৈশিষ্ট্য দুটির যেটি প্রকাশিত হয় তাকে প্রকট বৈশিষ্ট্য এবং যে বৈশিষ্ট্য সুপ্ত থাকে তাকে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বলে।

এক সঙ্কর (Monohybrid) ও দ্বিসঙ্কর (Dihybrid) ক্রস

যখন কোন ক্রসে মাত্র একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জিন বিবেচনা করা হয় তাকে এক সঙ্কর ক্রস বলে। 

অপরদিকে, যখন কোনো ক্রসে দুই জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জিন থাকে তখন তাকে দ্বিসঙ্কর ক্রস বলা হয়।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

জারিন তাসনিম

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং স্বাধীন লেখক।
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

বংশগতি, জিনতত্ত্ব, মেন্ডেলবাদ এবং জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্সে ব্যবহৃত কিছু প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা

প্রকাশ: ০৭:৪০:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল ২০২২

প্রজনন জীবের একটি বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য পরবর্তী বংশধরে সঞ্চালিত হওয়ার মাধ্যমে জীব তার নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখে, একে বংশগতি (Heredity) বলে। বিজ্ঞানের যে শাখায় জিনের গঠন, কার্যপদ্ধতি ও তার বংশানুক্রমিক সঞ্চালন পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয় তাই জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স (Genetics)। আর জিন হলো বংশগতির মৌলিক একক যা বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে বংশধারা ধরে রাখে। অপরদিকে প্রকৃতিতে যে মন্থর ও ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অতীতে উদ্ভূত কোনো সরল জীব হতে জটিল ও উন্নত জীবের আবির্ভাব ঘটে তাকে বিবর্তন (Evolution) বলে। এখানে জিনতত্ত্ব ও বিবর্তন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

মেন্ডেলিজম ও মেন্ডেলিয়ান বংশগতি (Mendelism and Mendelian Inheritance)

গ্রেগর জোহান মেন্ডেল সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি বংশগতির নীতিসমূহ উদ্ভাবনে সমর্থ হন। মেন্ডেল ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই ২ তারিখ তৎকালীন অস্ট্রোহাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সাইলেসিয়া (Silesia) অঞ্চলের হাইজেনডর্ফ (Heinzendorf) বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের অংশ) গ্রামের এক গরিব কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জার্মান ও চেক শ্রি বংশোদ্ভুত পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর মেন্ডেল প্রধানত আর্থিক কারণে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার মোরাভিয়া অঞ্চলে ব্রন (Brun, বর্তমানে ব্রুনো: Brno; চেক প্রজাতন্ত্র) নামক স্থানের অগাস্টিনিয়ান মঠে শিক্ষানবীশ হিসেব যোগদান করেন। চার বৎসর পর তিনি যাজক হন। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে স্নেম প্রিপারেটরি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অতঃপর ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৮৫৩ পর্যন্ত পড়াশোনা করে ব্রুনে ফিরে আসেন। ব্রুনে মডার্ন স্কুলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১২ বৎসর একজন সার্থক শিক্ষক হিসেবে সুনামের সাথে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ সাত বৎসর গবেষণা করেন।

জোহান গ্রেগর মেন্ডেল স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় মঠের বাগানে অবসর সময়ে মটরশুঁটি উদ্ভিদ নিয়ে ১৮৫৭ থেকে গবেষণা শুরু করেন। উল্লেখ্য, মটরশুঁটির বৈজ্ঞানিক নাম— Pisum sativum (পিসাম স্যাভিটাম)। সঙ্করায়ণ (Hybridization) পরীক্ষার জন্য মটরশুঁটি উদ্ভিদকে নির্বাচন করেন। মটরশুঁটি উদ্ভিদ উভলিঙ্গী, স্বপরাগায়নের মাধ্যমে যৌন প্রজনন সম্পন্ন হয়। পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবককে ঘিরে দলমণ্ডল (Corolla) এমনভাবে সজ্জিত যে, পরনিষেকের (Cross fertilization) কোন সম্ভাবনা নেই। ফলে বিভিন্ন জাতের (Variety) মটরশুঁটি উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যগুলো খাঁটি বা বিশুদ্ধ অবস্থায় আছে। অত্যন্ত অল্প সময়ে এর জীবনচক্র সম্পন্ন হয় এবং স্বল্প শ্রম ও ব্যয়ে অধিক সংখ্যক অপত্য বংশ উৎপন্ন হয়। অপত্য বংশে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট প্রকাশ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল।

মেন্ডেল বিভিন্ন উৎস হতে ৩৪ ধরনের মটরশুঁটি উদ্ভিদের বীজ সংগ্রহ করে আশ্রমের বাগানে প্রায় এক বৎসর প্রত্যেক ধরনের বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর পরীক্ষায় ব্যবহৃত সাতটি চরিত্রের (trait) জন্য (কাণ্ডের দৈর্ঘ্য, ফুলের অবস্থান, ফুলের রং, ফলের বর্ণ, ফলের আকৃতি, বীজের বর্ণ এবং বীজের আকৃতি) একজোড়া করে বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ১৪টি খাঁটি উদ্ভিদ নির্বাচন করেন। প্রতি জোড়া বৈশিষ্ট্য পরস্পর বিপরীতধর্মী।

মটরশুঁটি উদ্ভিদের নির্বাচিত বৈশিষ্ট্যের প্রতিটি একটি মাত্র জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। বৈশিষ্ট্য নির্বাচনের বিষয়ে মেন্ডেল অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ছিলেন। কারণ জটিল বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করলে মেন্ডেল বংশগতির অন্তর্নিহিত নীতিগুলো হয়তোবা আবিষ্কার করতে পারতেন না।

জোহান গ্রেগর মেন্ডেল একটি যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে সঙ্করায়ন পরীক্ষা পরিচালনা করেন। অত্যন্ত সাবধানতার সাথে পরীক্ষণসমূহ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তিনি যে পরাগরেণু স্থানান্তর করেছেন তার দ্বারাই পরাগায়ন হয়েছে তা নিশ্চিত করেন। সঙ্করায়নকালে মেন্ডেল অপত্য অংশে একসাথে মাত্র একটি চরিত্র পর্যবেক্ষণ করেন এবং সম্পূর্ণ উপাত্ত (data) সংরক্ষণ করেন। অতঃপর পরিসংখ্যান (statistics) এর প্রয়োগ দ্বারা এ উপাত্ত থেকেই লব্ধ ফলাফলের যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণপূর্বক এবং একটানা প্রায় এক দশকের নিরলস পরিশ্রম দ্বারা বংশগতির নিয়ম সম্পর্কে পার্টিকুলেট থিওরি (Particulate Theory) উপস্থাপন করেন।

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সঙ্করায়ন ও বংশগতি সম্বন্ধে তাঁর গবেষণার বিবরণ ও ফলাফল ব্রুন ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির পরপর দুটি বৈজ্ঞানিক সভায় উপস্থাপন করেন। সোসাইটির বার্ষিক মুখপত্রেও গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয়। 

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় তৎকালীন বিশ্বে কেউই ধর্মযাজক মেন্ডেল এর গবেষণা ফলাফলের গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেন্ডেল মঠাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ৬ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জীবদ্দশায় তাঁর গবেষণা কর্মের জন্য তিনি কোনো স্বীকৃতি লাভ করেননি।

মেন্ডেলের গবেষণাপত্র প্রকাশের ৩৫ বৎসর পর বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই হল্যান্ডের ডি ভ্রিস (de Vries), জার্মানির কার্ল করেন্স (Karl Correns) ও অস্ট্রিয়ার শেরমাক (Tschermak) পৃথক পৃথকভাবে গবেষণা করে মেন্ডেল এর ফলাফলকে সমর্থন করেন। বর্তমানে বিশ্বে মেন্ডেল এর আবিষ্কার অর্থাৎ পার্টিকুলেট থিওরি (Particulate Theory) একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পার্টিকুলেট থিওরিতে বর্ণিত সুত্রগুলো জেনেটিক্সে মেন্ডেলের সূত্র (Mendel’s Law) নামে অভিহিত। মেন্ডেলের সূত্র অনুযায়ী জীবের বৈশিষ্ট্যসমূহ বংশগতিতে সঞ্চারণের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তাকেই মেন্ডেলতত্ত্ব Mendelism) বলে। মেন্ডেলতত্ত্ব আধুনিক জেনেটিক্স এর প্রধান ভিত্তি। এ কারণেই মেন্ডেলকে জেনেটিক্স এর জনক বলা হয়ে থাকে।

পার্টিকুলেট থিওরী (Particulate Theory) বা মেন্ডেলতত্ত্ব (Mendelism) অনুযায়ী জীবে বংশগতির একক বিদ্যমান থাকে বা মিশ্রিত হয়না, শুধুমাত্র সুপ্ত থাকে। মেন্ডেলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মটরশুঁটি উদ্ভিদে প্রতিটি চরিত্রের (trait) জন্য (কাণ্ডের দৈর্ঘ্য, ফুলের অবস্থান, রং, ফলের বর্ণ, ফলের আকৃতি, বীজের বর্ণ এবং বীজের আকৃতি) এক জোড়া ফ্যাক্টর থাকে, যার একটি আসে পিতা থেকে এবং অপর একটি আসে মাতা থেকে। গ্যামিটে শুধু একটি একক উপস্থিত থাকে এবং পরবর্তী জনুতে সঞ্চারিত হয়। মেন্ডেল বর্ণিত পার্টিকল বা ফ্যাক্টর অবশ্যই জিন। আর একটি মাত্র জিন দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত বৈশিষ্ট্য মেন্ডেলিয়ান বৈশিষ্ট্য (Mendelian trait) বলে এবং মেন্ডেলিয়ান বৈশিষ্ট্যর সঞ্চায়ণকে মেন্ডেলিয়ান বংশগতি (Mendelian inheritance) বলা হয়।

মেন্ডেলের প্রথম সূত্র

সংকর জীবে বিপরীত বৈশিষ্টের জীনগুলো মিশ্রিত বা পরিবর্তিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং জননকোষ সৃষ্টির সময় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়।

মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র

দুই বা ততোধিক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্টের জীবের মধ্যে ক্রস ঘটালে প্রথম সংকর পুরুষে শুধু প্রকট বৈশিষ্টগুলোই প্রকাশিত হবে , কিন্তু জনন কোষ উৎপাদন কালে বৈশিষ্ট্যগুলো জোড়া ভেঙ্গে পরস্পর থেকে সতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জনন কোষে প্রবেশ করে ।

জেনেটিক্সে ব্যবহৃত কয়েকটি প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা

জিন (Gene)

ডব্লিউ. এল.  জোহানসেন (W. L. Johannsen) ১৯০৯ খিস্টাব্দে জিন শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে মেন্ডেল এর অনুমানকৃত জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারক বস্তুটি হলো এলিমেন্টিস বা ফ্যাক্টর (elements or factor) যা পরবর্তীকালে জিন নামে অভিহিত হয়। জিন হচ্ছে বংশগতির মৌলিক একক (basic unit of heredity) এবং এরা বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে বংশগতিধারা অব্যাহত রাখে। জিনকে সংজ্ঞায়িত করা যায় এভাবে- জিন হচ্ছে পলিপেপটাইড সংশ্লেষের জন্য সংকেত প্রদানকারী DNA অণুর অংশ বিশেষ (gene is a part of a DNA molecule code for polypeptide synthesis)।

লোকাস (Locus.Pl-Loci)

ক্রোমোসোমে একটি জিনের অবস্থানকে লোকাস বলে।

অ্যালিল (Allele), অ্যালিলোমর্ফ (Allelomorph)

ক্রোমোসোমের একই লোকাসে অবস্থানকারী জিনগুলোকে পরস্পরের অ্যালিল বলা হয়। জিনগুলোর একত্রে অবস্থান করাকে অ্যালিলোমর্ফ বলে। মনে করি, মানুষে বাদামী চোখের রং এর জন্য দায়ী জিন ই ও নীল চোখের রং এর জন্য দায়ী জিন b পরস্পরের অ্যালিল।

জিনোটাইপ (Genotype)

জীবদেহের দৃশ্যমান অথবা সুপ্ত বেশিষ্ট্যগুলোর নিয়ন্ত্রক জিনসমূহের গঠনকে জিনোটাইপ বলে। 

ফিনোটাইপ (Phenotype)

জীবদেহের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যসমূহকে ফিনোটাইপ বলে। ফিনোটাইপ প্রকৃতপক্ষে জিনোটাইপের জিনসমূহের বাহ্যিক প্রকাশ। 

হোমোজাইগাস (Homozygous) ও হেটারোজাইগাস (Heterozygous)

জীবে একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিন জোড়া একই রকমের (উভয় জিনই প্রকট বা প্রচ্ছন্ন) হলে তাকে হোমোজাইগাস জীব বলে। জিন জোড়া ভিন্ন রকমের হলে সে জীবকে হেটারোজাইগাস জীব বলে।

প্রকট (Dominant) ও প্রচ্ছন্ন (Recessive)

এক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবে সঙ্করায়ন ঘটালে ১ম অপত্য বংশে সঙ্কর জীবে ঐ বৈশিষ্ট্য দুটির যেটি প্রকাশিত হয় তাকে প্রকট বৈশিষ্ট্য এবং যে বৈশিষ্ট্য সুপ্ত থাকে তাকে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বলে।

এক সঙ্কর (Monohybrid) ও দ্বিসঙ্কর (Dihybrid) ক্রস

যখন কোন ক্রসে মাত্র একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জিন বিবেচনা করা হয় তাকে এক সঙ্কর ক্রস বলে। 

অপরদিকে, যখন কোনো ক্রসে দুই জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জিন থাকে তখন তাকে দ্বিসঙ্কর ক্রস বলা হয়।