০৪:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

স্টকহোম সিনড্রোম: ভয় যখন ভালোবাসায় রুপ নেয়

এইচ এম তৌফিকুর রহমান
  • প্রকাশ: ০১:৫৫:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০২২
  • / ২১৩৭ বার পড়া হয়েছে

স্টকহোম সিনড্রোম | ছবি: DocumentaryTube

ধরুন আপনাকে কোনো একজন ব্যক্তি অথবা অপহরণকারী একটি দল অপহরণ করল। আপনাকে নেয়া হলো অজানা-অচেনা একটি জায়গায়।এদিকে পরিবারের লোকজন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আপনাকে খুঁজে হয়রান।এভাবে কেটে গেল কয়েকদিন, মাস এমনকি কয়েক বছর। অবশেষে আপনাকে এই বন্দী দশা থেকে মুক্ত  করল উদ্ধারকারী দল।

স্বাভাবিক ভাবেই এখন আপনার সাথে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা কথা বলবেন। আর আপনি প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে বলবেন আপনার সাথে কী কী খারাপ ঘটনা ঘটেছে এই সময়টাতে। কিংবা বলবেন আপনার কতটা কষ্ট হয়েছে। প্রত্যাশা থাকে এমনটাই। 

কিন্তু না! আপনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে অপহরণকারীদের পক্ষ অবলম্বন করলেন। এমনকি আরও অবাক করা কথা বললেন যে, অপহরণকারীদের মধ্যে কোনো একজনের প্রেমে পড়ে গিয়েছেন আপনি।

আর, আদর করে সাইকোলজিস্টরা এই অদ্ভুত পরিস্থিতির নাম দিয়েছেন  স্টকহোম সিনড্রোম (Stockholm syndrome)।

আরও সহজ করে বললে, ধরুন আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকা মারাত্মক রকমভাবে আপনাকে অপব্যবহার করেন। প্রচন্ড গালাগালি এমনকি গায়ে হাতও তোলেন। কিন্তু তারপরও আপনি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটাও এক ধরনের স্টকহোম সিনড্রোম। 

“স্টকহোম সিনড্রোম বলতে মূলত এমন একটি মানসিক অবস্থা বোঝায় যেখানে জিম্মি ব্যক্তিরা তাদের অপহরণকারীদের প্রতি আনুগত্য ও আবেগপ্রবণ টান অনুভব করেন”।

এফবিআই এর একটি সমীক্ষায় উঠে আসে যে, মোট ভিকটিমদের ৮% এই স্টকহোম সিনড্রোম প্রদর্শন করেন।বেশ আলোচিত কিছু ঘটনার মধ্যে একটিতে দেখা যায় ভিকটিম আত্মহত্যা করেছিলেন এই স্টকহোম সিনড্রোমের কবলে পড়ে।

STOCKHOLM SYNDROME

ঐতিহাসিক পটভূমি

১৯৭৩ সালের ২৩শে আগস্টের সকালে এরিক এবং ক্লার্ক দুজন কুখ্যাত ডাকাত তাদের দলবল সহ আক্রমণ করে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের স্পেরিকাস ক্রেডিট ব্যাংকে। ঘটনাটি ইউরোপ, আমেরিকা সহ সারা বিশ্বেই খবরের শিরোনাম হয়। তৎকালীন সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেন। ছয়দিন ধরে জিম্মি থাকেন ব্যাংকের চার কর্মকর্তা। অবশেষে পুলিশ সবাইকে উদ্ধার করে এবং ডাকাত দলকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। মজার ব্যাপার হলো ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তা এরিকের প্রেমে পড়ে যান। বাকি সদস্যরাও ডাকাতদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন এবং শাস্তি কমানোর জন্য আবেদন করেন। যা সে সময় প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। 

কেন ঘটে স্টকহোম সিনড্রোম

  • ইভোল্যুশনারি সাইকোলজিস্টদের মতে মানুষের অতীত শিক্ষণ এর জন্য দায়ী। অতীতে লোকজন একে অন্যের সাথে মারাত্মক শত্রুতায় লিপ্ত ছিল। একটা সময় মানুষ একে অন্যকে অর্থাৎ শত্রুকেই ভালোবেসে শান্তির নিঃশ্বাস নিল। এভাবেই এটা বংশ পরম্পরায় আমাদের মাঝে এখন উপস্থিত। 
  • স্টকহোম সিনড্রোম মূলত একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। প্রচন্ড ভয়ের সময়ে মানুষ যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে বাঁচতে চায়। যা থেকে তৈরী হয় ভালোবাসা।
  • আরো একটি কারণ হচ্ছে প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্ষতি না হওয়া। তার মানে হল, ব্যক্তি ধরেই ন্যায় তার অনেক ক্ষতি করা হবে। শেষে তাকে হত্যা করা হবে। যখন এমনটা করা হয় না তখন আক্রমণকারী ব্যক্তিকে আক্রান্ত ব্যক্তি মহৎ ভাবা শুরু করে। তখনই মনের জানালায় উঁকি  দেয় প্রেম। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন কাউকে কি তাহলে ভালোবাসা অন্যায়?

এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। কেননা, এই সমস্ত কেইসে অপরাধী সহজে পার পেয়ে যায়। সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ঘাটতি হওয়ায় পুরো মামলাটাই মুখ থুবরে পড়ে। একজনের আবেগ একজন অপরাধীর জন্য কাজ করলেও দিনশেষে সমাজের জন্য এটা মারাত্মক ঝুঁকি।

স্টকহোম সিনড্রোমের চিকিৎসা

খুব বেশি গবেষণা না হওয়ায় এই জটিল মানসিক সমস্যার চিকিৎসা বের করা এখনো সম্ভব হয়নি।তবে মনোচিকিৎসকগণ Post Traumatic Stress Disorder (PTSD) এর স্ট্রাটেজি ফলো করে থাকেন। এছাড়াও ভিকটিমকে কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হয়। এর বাইরে অন্যান্য সাইকোথেরাপিও প্রয়োগ করা হয় ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে। 

পরিশেষে বলব, এটা মানসিক রোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না হলেও একটি জটিল মানসিক অবস্থা। যা ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়কেই ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। তাই সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি একজন ব্যক্তির জন্য যিনি এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। 

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

এইচ এম তৌফিকুর রহমান

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

স্টকহোম সিনড্রোম: ভয় যখন ভালোবাসায় রুপ নেয়

প্রকাশ: ০১:৫৫:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০২২

ধরুন আপনাকে কোনো একজন ব্যক্তি অথবা অপহরণকারী একটি দল অপহরণ করল। আপনাকে নেয়া হলো অজানা-অচেনা একটি জায়গায়।এদিকে পরিবারের লোকজন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আপনাকে খুঁজে হয়রান।এভাবে কেটে গেল কয়েকদিন, মাস এমনকি কয়েক বছর। অবশেষে আপনাকে এই বন্দী দশা থেকে মুক্ত  করল উদ্ধারকারী দল।

স্বাভাবিক ভাবেই এখন আপনার সাথে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা কথা বলবেন। আর আপনি প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে বলবেন আপনার সাথে কী কী খারাপ ঘটনা ঘটেছে এই সময়টাতে। কিংবা বলবেন আপনার কতটা কষ্ট হয়েছে। প্রত্যাশা থাকে এমনটাই। 

কিন্তু না! আপনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে অপহরণকারীদের পক্ষ অবলম্বন করলেন। এমনকি আরও অবাক করা কথা বললেন যে, অপহরণকারীদের মধ্যে কোনো একজনের প্রেমে পড়ে গিয়েছেন আপনি।

আর, আদর করে সাইকোলজিস্টরা এই অদ্ভুত পরিস্থিতির নাম দিয়েছেন  স্টকহোম সিনড্রোম (Stockholm syndrome)।

আরও সহজ করে বললে, ধরুন আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকা মারাত্মক রকমভাবে আপনাকে অপব্যবহার করেন। প্রচন্ড গালাগালি এমনকি গায়ে হাতও তোলেন। কিন্তু তারপরও আপনি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটাও এক ধরনের স্টকহোম সিনড্রোম। 

“স্টকহোম সিনড্রোম বলতে মূলত এমন একটি মানসিক অবস্থা বোঝায় যেখানে জিম্মি ব্যক্তিরা তাদের অপহরণকারীদের প্রতি আনুগত্য ও আবেগপ্রবণ টান অনুভব করেন”।

এফবিআই এর একটি সমীক্ষায় উঠে আসে যে, মোট ভিকটিমদের ৮% এই স্টকহোম সিনড্রোম প্রদর্শন করেন।বেশ আলোচিত কিছু ঘটনার মধ্যে একটিতে দেখা যায় ভিকটিম আত্মহত্যা করেছিলেন এই স্টকহোম সিনড্রোমের কবলে পড়ে।

STOCKHOLM SYNDROME

ঐতিহাসিক পটভূমি

১৯৭৩ সালের ২৩শে আগস্টের সকালে এরিক এবং ক্লার্ক দুজন কুখ্যাত ডাকাত তাদের দলবল সহ আক্রমণ করে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের স্পেরিকাস ক্রেডিট ব্যাংকে। ঘটনাটি ইউরোপ, আমেরিকা সহ সারা বিশ্বেই খবরের শিরোনাম হয়। তৎকালীন সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেন। ছয়দিন ধরে জিম্মি থাকেন ব্যাংকের চার কর্মকর্তা। অবশেষে পুলিশ সবাইকে উদ্ধার করে এবং ডাকাত দলকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। মজার ব্যাপার হলো ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তা এরিকের প্রেমে পড়ে যান। বাকি সদস্যরাও ডাকাতদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন এবং শাস্তি কমানোর জন্য আবেদন করেন। যা সে সময় প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। 

কেন ঘটে স্টকহোম সিনড্রোম

  • ইভোল্যুশনারি সাইকোলজিস্টদের মতে মানুষের অতীত শিক্ষণ এর জন্য দায়ী। অতীতে লোকজন একে অন্যের সাথে মারাত্মক শত্রুতায় লিপ্ত ছিল। একটা সময় মানুষ একে অন্যকে অর্থাৎ শত্রুকেই ভালোবেসে শান্তির নিঃশ্বাস নিল। এভাবেই এটা বংশ পরম্পরায় আমাদের মাঝে এখন উপস্থিত। 
  • স্টকহোম সিনড্রোম মূলত একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। প্রচন্ড ভয়ের সময়ে মানুষ যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে বাঁচতে চায়। যা থেকে তৈরী হয় ভালোবাসা।
  • আরো একটি কারণ হচ্ছে প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্ষতি না হওয়া। তার মানে হল, ব্যক্তি ধরেই ন্যায় তার অনেক ক্ষতি করা হবে। শেষে তাকে হত্যা করা হবে। যখন এমনটা করা হয় না তখন আক্রমণকারী ব্যক্তিকে আক্রান্ত ব্যক্তি মহৎ ভাবা শুরু করে। তখনই মনের জানালায় উঁকি  দেয় প্রেম। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন কাউকে কি তাহলে ভালোবাসা অন্যায়?

এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। কেননা, এই সমস্ত কেইসে অপরাধী সহজে পার পেয়ে যায়। সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ঘাটতি হওয়ায় পুরো মামলাটাই মুখ থুবরে পড়ে। একজনের আবেগ একজন অপরাধীর জন্য কাজ করলেও দিনশেষে সমাজের জন্য এটা মারাত্মক ঝুঁকি।

স্টকহোম সিনড্রোমের চিকিৎসা

খুব বেশি গবেষণা না হওয়ায় এই জটিল মানসিক সমস্যার চিকিৎসা বের করা এখনো সম্ভব হয়নি।তবে মনোচিকিৎসকগণ Post Traumatic Stress Disorder (PTSD) এর স্ট্রাটেজি ফলো করে থাকেন। এছাড়াও ভিকটিমকে কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হয়। এর বাইরে অন্যান্য সাইকোথেরাপিও প্রয়োগ করা হয় ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে। 

পরিশেষে বলব, এটা মানসিক রোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না হলেও একটি জটিল মানসিক অবস্থা। যা ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়কেই ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। তাই সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি একজন ব্যক্তির জন্য যিনি এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।