০৬:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আমার স্মৃতিতে অম্লান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক
  • প্রকাশ: ০৯:২৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ ২০২২
  • / ১৭০৬ বার পড়া হয়েছে

বিচারপতি হাবিবুর রহমান

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর যেসব উচ্চশিক্ষিত পরিবার পূর্ববাংলায় স্থানান্তরিত হয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার জংগীপুর এলাকায় বসবাসরত প্রখ্যাত আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও জাতীয় যুক্তফ্রন্টের বিভাগীয় নেতা জহিরউদ্দিন বিশ্বাস। তিনি প্রাথমিকভাবে স্থানান্তরিত হন রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমায়। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন৷ জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন হাবিবুর রহমানের পিতা। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মাতৃকুল ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর-বাজিতপুরের সার্ধশতব্যাপী এক ঐতিহ্যবাহী বুনিয়াদি বংশ- চৌধুরীবংশ। তাঁর মাতা ছিলেন গুল হাবীবা, চৌধুরী বংশের উত্তরসূরি, আব্দুল করিম পেশকারের দৌহিত্রী। আব্দুল করিম  বিশ্বাস (জন্ম: ১৮৪৪,পেশায় বিচারালয়ে পেশকার) ছিলেন শিবগঞ্জ উপজেলায় শ্যামপুর- চৌধুরীবংশের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব  এবং সেই বংশের কিংবদন্তি। সে সময়ে তাঁর দুটো বই ‘আশা বৃক্ষ’ এবং  ‘মোহিনী জগৎ’  অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। হাবিবুর রহমানের শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এই শ্যামপুরে, অর্থাৎ তাঁর মাতামহীর বাড়িতে। শুধু নানিবাড়ি নয়, শ্যামপুর চৌধুরী পাড়ার সঙ্গে তাঁর আরো এক সূত্রে যোগাযোগ স্থাপন হয়েছিল। তিনি বিয়ে করেছিলেন সেই বংশের ইস্কান্দার আলী চৌধুরীর কন্যা ইসলামা রহমান শিরির সাথে।  কাজেই শ্যামপুর চৌধুরীপাড়ার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ট। হাবিবুর রহমান ছিলেন আমার মা’য়ের খালাতো ভাই। সেই সম্পর্কে তিনি ছিলেন আমার মামা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা ছিল আরো মধুর। যেহেতু তাঁর স্ত্রী ছিলেন আমার মাতুলাতো বোন, তাই বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে সম্মোধন করতাম দুলাভাই বলে। এছাড়া, শিরি আপা ছিলেন আমার স্ত্রীর দ্বিতীয় কাজিন।  সেই দুলাভাই সম্ভাষণে আমরা ছিলাম তাঁর স্নেহের পাত্র-পাত্রী।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান’র সাথে লেখক, ডিসেম্বর ২৪, ২০১১, ঢাকা ।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ন হবার পর ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি ছিলেন পূর্বাপর একজন মেধাবী ছাত্র। তিনি ১৯৪৯ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক সম্মান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে ১৯৫১ সালে স্নাতকোত্তর (এমএ) ডিগ্রি অর্জন করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে তিনি আইন বিষয়েও স্নাতক হন ১৯৫৫ সনে। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যে পড়াশুনা করেন ও বেলিয়ল কলেজ (Balliol College), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, থেকে আধুনিক ইতিহাসে ১৯৫৮ সালে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ও লিঙ্কনস ইন থেকে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫৯ সালে। তাঁর কর্মজীবনে হাবিবুর রহমান পঞ্চাশ ও ষাট দশকে ঢাকা ও রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে তিনি ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) ও আইন বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইনব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেন ১৯৬৪ সালে। তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তথা দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যে সময়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রগতি ছিল হুমকির মুখে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের আশঙ্কা প্রকট, সেই ক্রান্তিকালে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান। তিনি প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার সাথে এ সমস্যা মোকাবেলা করে দেশে গণতন্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন।

হাবিবুর রহমান ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। তিনি ক্যাম্পাসে একজন নেতৃস্থানীয় ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ও তাঁর বন্ধু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা) হয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক। জিল্লুর রহমান ছিলেন হাবিবুর রহমানের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। মহান এই দুই ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু সালও ছিল একই -১৯২৮ ও ২০১৪। ভাষা আন্দোলনে তাঁরা  উভয়ই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য, পল্টন ময়দানের জনসভায় বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও একই কথা বলে বাঙালির মনে আগুন লাগিয়ে গিয়েছিলেন। আন্দোলনস্বরূপ দেশের শিক্ষায়তনগুলিতে উপর্যুপুরি ধর্মঘট পালন করা হয়। পাকিস্তান সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সমস্ত সভা, বিক্ষোভ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সেই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন, যদিও তার বিপক্ষে অনেকে ছাত্র অবস্থান নিয়েছিলেন। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বই ছিল আমাদের ভাষা আন্দোলনের জাতীয় চালিকা শক্তি। চারদিক কাঁপিয়ে স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই…১৪৪ ধারা মানি না, মানবো না’। কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই একত্রে মিছিলে যোগ না দিয়ে ‘১০ জনী মিছিল’করে দল বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক পেরিয়ে তারা রাস্তায় মিছিল বের করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সরকারের সেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রথম ‘১০ জনী মিছিল’র নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান শেলী। তার মত হাজার হাজার ছাত্র সে সময়ের তারুণ্য আর যৌবন দীপ্ত শক্তি দিয়ে শপথ নিয়েছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার। ভাষা আন্দোলনে লড়াকু বীর সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ ঝরেছে অনেকের রক্ত আর মহামূল্যবান প্রাণ।  

বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একজন সাহিত্যানুরাগী মানুষ। একজন গবেষক ও মননশীল লেখক হিসেবে হাবিবুর রহমানের খ্যাতি ছিল দেশ জুড়ে। তাঁর আগ্রহ ও দখলও ছিল বিচিত্র বিষয়ে। তিনি সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ প্রভৃতি বিচিত্র পরিসরে লিখেছেন অনেক বই। তাঁর গবেষণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকে বিচিত্র ও অভিনব রূপে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তাঁর বইসমূহ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ। তাঁর রচিত প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০টি । সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (১৯৮৪) ও একুশে পদক (২০০৭) সম্মাননায় ভূষিত হন। বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায়, এমনকি উচ্চ শিক্ষাস্তরেও, বাংলা ভাষা প্রয়োগের কথা তিনি বার বার বলেছেন। তিনি হাইকোর্টের অনেক মামলার রায়ও দিয়েছেন বাংলায়। একটি ব্যক্তিগত আলাপে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “উচ্চশিক্ষায়, এমনকি আইনবিষয়েও, বাংলার প্রচলন প্রাথমিকভাবে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও সেটা খুব দুরূহ বা দুঃসাধ্য কিছু নয়”। তাই, তিনি এককভাবে ‘যথা-শব্দ’ এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে সাথে নিয়ে একত্রে প্রণয়ন করেন ‘আইন-শব্দকোষ’, যা আদালতের বাংলায় রায় প্রদান, মুসাবিদা লিখন, কিংবা সংসদের বাংলায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি সর্বোত্তম গ্রন্থ। 

হাবিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে প্রকাশ করেন ‘যথাশব্দ’ -বাংলাভাষার প্রথম ভাব অভিধান । বাংলা সাহিত্যে খুব পরিচিত একটি নাম সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (জন্ম. ১৮৯০)। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও ধ্বনিতত্ত্ববিদ। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ভাষাচার্য উপাধি দেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বিচারপতি হাবিবুর রহমান রচিত ‘যথাশব্দ’ অভিধানটি নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “এই বইখানি বাঙ্গলা ভাষায় একটি বড়ো অভাব বহুলভাবে পূরণ করিল। বাঙ্গলা ভাষা, শব্দকোষ, সাহিত্য প্রভৃতি সব দিকেই বহু অনুসন্ধান ও গবেষণা হইয়াছে, ভাল অভিধানও বাহির হইয়াছে এবং আরও হইতেছে। কিন্তু ইংরেজি Thesaurus-এর মত বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিচারশৈলী অনুসারে, বিভিন্ন প্রকারের দ্যোতনার শব্দের বিশেষ কার্য্যকর অভিধান ছিল না। বাঙালি সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকের পক্ষে যথাশব্দ অভিধানখানি এইরূপ একখানি অপরিহার্য্য পুস্তক-রূপে এখন দেখা দিল।“ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন এমন সিদ্ধিলাভের পর কাউকে আর পেছনে তাকাতে হয় না, তাঁকেও হয়নি। 

রবীন্দ্রভাবনায় তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হচ্ছে: রবীন্দ্র-প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার, রবীন্দ্রকাব্যে আর্ট, সঙ্গীত ও সাহিত্য, মাতৃভাষার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র রচনায় আইনি ভাবনা, কবি তুমি নহ গুরুদেব, একজন ভারতীয় বাঙালির আত্মসমালোচনা  এবং রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সংকট।  ১৯৯৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩৪তম জন্ম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রধান অতিথি। বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, “আকস্মিক দুর্ঘটনায় বাংলা ভাষার সব লেখা যদি মুছে যায় বা উবে যায়, কেবল  রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী বেঁচে থাকে, তবু আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো” (সূত্র: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার)। 

তিনি ছিলেন ইতিহাসের ছাত্র। এক্ষেত্রে তিনি স্বাক্ষরতা রেখে গেছেন তাঁর লেখা বইয়ে “গঙ্গাখদ্ধি থেকে বাংলাদেশ”।  জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রয়োগে তিনি ছিলেন অগ্রদূত। তাই তিনি লিখে গেছেন:  আমরা কি যাবো না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে, বাংলার সংগ্রাম এখনও অসমাপ্ত, প্রথমে মাতৃভাষা পরভাষা পরে এবং একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা কয়। এই প্রসঙ্গে তাঁর একটি গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কাগজের স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান আমলে। ভাষা থেকে রাষ্ট্র হলো। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা কে জনগণের মাঝে সাক্ষরতার মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ার ঐকান্তিক চেষ্টা এখনো সার্থক হয়নি। আজ ৫৬ বছর পরও আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার আওয়াজ তুলি। কারণ সর্বস্তরে আজও রাষ্ট্রভাষা চালু হয়নি। রাষ্ট্রীয় ভোজে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান রাষ্ট্রের পক্ষে অ-রাষ্ট্রভাষায় বক্তৃতা  করতে লজ্জা বা অধোবদন হন না। দেশের শেষ বিচারালয়ে আজও অ-রাষ্ট্রভাষায় রায় ঘোষিত হয়” (সূত্র: যে ভাষা ছড়িয়ে গেছে সব খানে, প্রকাশ, ২০১১)। এছাড়া অন্যান্য বিষয়েও তিনি রচনা করেছিলেন আরো অনেক বই: বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সরকার সংবিধান ও অধিকার, দায়মুক্তি এবং স্বাধীনতার দায়ভার প্রভৃতি। তিনি পবিত্র কুরআনকে সরলভাবে বাংলায় অনুবাদও করেছেন। তিনি নবীন বিজ্ঞানীদের সুপ্ত প্রতিভার উম্মেষ ঘটানো ও বিজ্ঞানমনস্কতা সৃষ্টির  কথাও বলেছেন।

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সাথে লেখক, ফোবানা সম্মেলন, ওয়াশিংটন ডিসি, ২০০৩।

‘রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা’সহ তিনি বেশ কয়েকটি বই রচনা করেন ২০১০ সালে। সেই বছরেই একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার’। শেষোক্ত বইটি তাঁর গুলশানের বাড়িতে আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন ২০১০ সালের মার্চ মাসের ১ তারিখ। তাঁর সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। এর আগে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দেশে ও বিদেশে আমার সাক্ষাত হয়েছে। 

হাবিবুর রহমান ছিলেন অতিশয় সাধারণ একজন মানুষ, ধর্মপরায়ণ ও উদার প্রকৃতির। জীবনের নানাদিকেই তাঁর উৎসাহ ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন তিন মেয়ের পিতা- রুবাবা রহমান, নুসরাত হাবিব ও রওনাক শিরিন। নুসরাত হাবিব ও রওনাক শিরিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান শুধু তাঁর ও আমার মাতৃকুল শ্যামপুর চৌধুরীবংশের-ই গর্ব নন, তিনি সমগ্র বাংলাদেশের গর্ব। হাবিবুর রহমান ৮৫ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন ২০১৪ সালের ১১ই জানুয়ারি। আমি এই মহান প্রজ্ঞাবান মানুষটিকে আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক: সাবেক উপ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, এবং সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র, ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

আমার স্মৃতিতে অম্লান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

প্রকাশ: ০৯:২৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ ২০২২

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর যেসব উচ্চশিক্ষিত পরিবার পূর্ববাংলায় স্থানান্তরিত হয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার জংগীপুর এলাকায় বসবাসরত প্রখ্যাত আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও জাতীয় যুক্তফ্রন্টের বিভাগীয় নেতা জহিরউদ্দিন বিশ্বাস। তিনি প্রাথমিকভাবে স্থানান্তরিত হন রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমায়। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন৷ জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন হাবিবুর রহমানের পিতা। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মাতৃকুল ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর-বাজিতপুরের সার্ধশতব্যাপী এক ঐতিহ্যবাহী বুনিয়াদি বংশ- চৌধুরীবংশ। তাঁর মাতা ছিলেন গুল হাবীবা, চৌধুরী বংশের উত্তরসূরি, আব্দুল করিম পেশকারের দৌহিত্রী। আব্দুল করিম  বিশ্বাস (জন্ম: ১৮৪৪,পেশায় বিচারালয়ে পেশকার) ছিলেন শিবগঞ্জ উপজেলায় শ্যামপুর- চৌধুরীবংশের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব  এবং সেই বংশের কিংবদন্তি। সে সময়ে তাঁর দুটো বই ‘আশা বৃক্ষ’ এবং  ‘মোহিনী জগৎ’  অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। হাবিবুর রহমানের শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এই শ্যামপুরে, অর্থাৎ তাঁর মাতামহীর বাড়িতে। শুধু নানিবাড়ি নয়, শ্যামপুর চৌধুরী পাড়ার সঙ্গে তাঁর আরো এক সূত্রে যোগাযোগ স্থাপন হয়েছিল। তিনি বিয়ে করেছিলেন সেই বংশের ইস্কান্দার আলী চৌধুরীর কন্যা ইসলামা রহমান শিরির সাথে।  কাজেই শ্যামপুর চৌধুরীপাড়ার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ট। হাবিবুর রহমান ছিলেন আমার মা’য়ের খালাতো ভাই। সেই সম্পর্কে তিনি ছিলেন আমার মামা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা ছিল আরো মধুর। যেহেতু তাঁর স্ত্রী ছিলেন আমার মাতুলাতো বোন, তাই বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে সম্মোধন করতাম দুলাভাই বলে। এছাড়া, শিরি আপা ছিলেন আমার স্ত্রীর দ্বিতীয় কাজিন।  সেই দুলাভাই সম্ভাষণে আমরা ছিলাম তাঁর স্নেহের পাত্র-পাত্রী।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান’র সাথে লেখক, ডিসেম্বর ২৪, ২০১১, ঢাকা ।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ন হবার পর ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি ছিলেন পূর্বাপর একজন মেধাবী ছাত্র। তিনি ১৯৪৯ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক সম্মান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে ১৯৫১ সালে স্নাতকোত্তর (এমএ) ডিগ্রি অর্জন করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে তিনি আইন বিষয়েও স্নাতক হন ১৯৫৫ সনে। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যে পড়াশুনা করেন ও বেলিয়ল কলেজ (Balliol College), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, থেকে আধুনিক ইতিহাসে ১৯৫৮ সালে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ও লিঙ্কনস ইন থেকে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫৯ সালে। তাঁর কর্মজীবনে হাবিবুর রহমান পঞ্চাশ ও ষাট দশকে ঢাকা ও রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে তিনি ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) ও আইন বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইনব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেন ১৯৬৪ সালে। তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তথা দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যে সময়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রগতি ছিল হুমকির মুখে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের আশঙ্কা প্রকট, সেই ক্রান্তিকালে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান। তিনি প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার সাথে এ সমস্যা মোকাবেলা করে দেশে গণতন্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন।

হাবিবুর রহমান ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। তিনি ক্যাম্পাসে একজন নেতৃস্থানীয় ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ও তাঁর বন্ধু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা) হয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক। জিল্লুর রহমান ছিলেন হাবিবুর রহমানের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। মহান এই দুই ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু সালও ছিল একই -১৯২৮ ও ২০১৪। ভাষা আন্দোলনে তাঁরা  উভয়ই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য, পল্টন ময়দানের জনসভায় বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও একই কথা বলে বাঙালির মনে আগুন লাগিয়ে গিয়েছিলেন। আন্দোলনস্বরূপ দেশের শিক্ষায়তনগুলিতে উপর্যুপুরি ধর্মঘট পালন করা হয়। পাকিস্তান সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সমস্ত সভা, বিক্ষোভ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সেই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন, যদিও তার বিপক্ষে অনেকে ছাত্র অবস্থান নিয়েছিলেন। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বই ছিল আমাদের ভাষা আন্দোলনের জাতীয় চালিকা শক্তি। চারদিক কাঁপিয়ে স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই…১৪৪ ধারা মানি না, মানবো না’। কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই একত্রে মিছিলে যোগ না দিয়ে ‘১০ জনী মিছিল’করে দল বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক পেরিয়ে তারা রাস্তায় মিছিল বের করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সরকারের সেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রথম ‘১০ জনী মিছিল’র নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান শেলী। তার মত হাজার হাজার ছাত্র সে সময়ের তারুণ্য আর যৌবন দীপ্ত শক্তি দিয়ে শপথ নিয়েছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার। ভাষা আন্দোলনে লড়াকু বীর সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ ঝরেছে অনেকের রক্ত আর মহামূল্যবান প্রাণ।  

বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একজন সাহিত্যানুরাগী মানুষ। একজন গবেষক ও মননশীল লেখক হিসেবে হাবিবুর রহমানের খ্যাতি ছিল দেশ জুড়ে। তাঁর আগ্রহ ও দখলও ছিল বিচিত্র বিষয়ে। তিনি সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ প্রভৃতি বিচিত্র পরিসরে লিখেছেন অনেক বই। তাঁর গবেষণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকে বিচিত্র ও অভিনব রূপে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তাঁর বইসমূহ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ। তাঁর রচিত প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০টি । সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (১৯৮৪) ও একুশে পদক (২০০৭) সম্মাননায় ভূষিত হন। বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায়, এমনকি উচ্চ শিক্ষাস্তরেও, বাংলা ভাষা প্রয়োগের কথা তিনি বার বার বলেছেন। তিনি হাইকোর্টের অনেক মামলার রায়ও দিয়েছেন বাংলায়। একটি ব্যক্তিগত আলাপে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “উচ্চশিক্ষায়, এমনকি আইনবিষয়েও, বাংলার প্রচলন প্রাথমিকভাবে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও সেটা খুব দুরূহ বা দুঃসাধ্য কিছু নয়”। তাই, তিনি এককভাবে ‘যথা-শব্দ’ এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে সাথে নিয়ে একত্রে প্রণয়ন করেন ‘আইন-শব্দকোষ’, যা আদালতের বাংলায় রায় প্রদান, মুসাবিদা লিখন, কিংবা সংসদের বাংলায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি সর্বোত্তম গ্রন্থ। 

হাবিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে প্রকাশ করেন ‘যথাশব্দ’ -বাংলাভাষার প্রথম ভাব অভিধান । বাংলা সাহিত্যে খুব পরিচিত একটি নাম সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (জন্ম. ১৮৯০)। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও ধ্বনিতত্ত্ববিদ। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ভাষাচার্য উপাধি দেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বিচারপতি হাবিবুর রহমান রচিত ‘যথাশব্দ’ অভিধানটি নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “এই বইখানি বাঙ্গলা ভাষায় একটি বড়ো অভাব বহুলভাবে পূরণ করিল। বাঙ্গলা ভাষা, শব্দকোষ, সাহিত্য প্রভৃতি সব দিকেই বহু অনুসন্ধান ও গবেষণা হইয়াছে, ভাল অভিধানও বাহির হইয়াছে এবং আরও হইতেছে। কিন্তু ইংরেজি Thesaurus-এর মত বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিচারশৈলী অনুসারে, বিভিন্ন প্রকারের দ্যোতনার শব্দের বিশেষ কার্য্যকর অভিধান ছিল না। বাঙালি সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকের পক্ষে যথাশব্দ অভিধানখানি এইরূপ একখানি অপরিহার্য্য পুস্তক-রূপে এখন দেখা দিল।“ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন এমন সিদ্ধিলাভের পর কাউকে আর পেছনে তাকাতে হয় না, তাঁকেও হয়নি। 

রবীন্দ্রভাবনায় তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হচ্ছে: রবীন্দ্র-প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার, রবীন্দ্রকাব্যে আর্ট, সঙ্গীত ও সাহিত্য, মাতৃভাষার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র রচনায় আইনি ভাবনা, কবি তুমি নহ গুরুদেব, একজন ভারতীয় বাঙালির আত্মসমালোচনা  এবং রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সংকট।  ১৯৯৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩৪তম জন্ম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রধান অতিথি। বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, “আকস্মিক দুর্ঘটনায় বাংলা ভাষার সব লেখা যদি মুছে যায় বা উবে যায়, কেবল  রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী বেঁচে থাকে, তবু আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো” (সূত্র: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার)। 

তিনি ছিলেন ইতিহাসের ছাত্র। এক্ষেত্রে তিনি স্বাক্ষরতা রেখে গেছেন তাঁর লেখা বইয়ে “গঙ্গাখদ্ধি থেকে বাংলাদেশ”।  জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রয়োগে তিনি ছিলেন অগ্রদূত। তাই তিনি লিখে গেছেন:  আমরা কি যাবো না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে, বাংলার সংগ্রাম এখনও অসমাপ্ত, প্রথমে মাতৃভাষা পরভাষা পরে এবং একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা কয়। এই প্রসঙ্গে তাঁর একটি গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কাগজের স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান আমলে। ভাষা থেকে রাষ্ট্র হলো। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা কে জনগণের মাঝে সাক্ষরতার মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ার ঐকান্তিক চেষ্টা এখনো সার্থক হয়নি। আজ ৫৬ বছর পরও আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার আওয়াজ তুলি। কারণ সর্বস্তরে আজও রাষ্ট্রভাষা চালু হয়নি। রাষ্ট্রীয় ভোজে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান রাষ্ট্রের পক্ষে অ-রাষ্ট্রভাষায় বক্তৃতা  করতে লজ্জা বা অধোবদন হন না। দেশের শেষ বিচারালয়ে আজও অ-রাষ্ট্রভাষায় রায় ঘোষিত হয়” (সূত্র: যে ভাষা ছড়িয়ে গেছে সব খানে, প্রকাশ, ২০১১)। এছাড়া অন্যান্য বিষয়েও তিনি রচনা করেছিলেন আরো অনেক বই: বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সরকার সংবিধান ও অধিকার, দায়মুক্তি এবং স্বাধীনতার দায়ভার প্রভৃতি। তিনি পবিত্র কুরআনকে সরলভাবে বাংলায় অনুবাদও করেছেন। তিনি নবীন বিজ্ঞানীদের সুপ্ত প্রতিভার উম্মেষ ঘটানো ও বিজ্ঞানমনস্কতা সৃষ্টির  কথাও বলেছেন।

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সাথে লেখক, ফোবানা সম্মেলন, ওয়াশিংটন ডিসি, ২০০৩।

‘রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা’সহ তিনি বেশ কয়েকটি বই রচনা করেন ২০১০ সালে। সেই বছরেই একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার’। শেষোক্ত বইটি তাঁর গুলশানের বাড়িতে আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন ২০১০ সালের মার্চ মাসের ১ তারিখ। তাঁর সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। এর আগে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দেশে ও বিদেশে আমার সাক্ষাত হয়েছে। 

হাবিবুর রহমান ছিলেন অতিশয় সাধারণ একজন মানুষ, ধর্মপরায়ণ ও উদার প্রকৃতির। জীবনের নানাদিকেই তাঁর উৎসাহ ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন তিন মেয়ের পিতা- রুবাবা রহমান, নুসরাত হাবিব ও রওনাক শিরিন। নুসরাত হাবিব ও রওনাক শিরিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান শুধু তাঁর ও আমার মাতৃকুল শ্যামপুর চৌধুরীবংশের-ই গর্ব নন, তিনি সমগ্র বাংলাদেশের গর্ব। হাবিবুর রহমান ৮৫ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন ২০১৪ সালের ১১ই জানুয়ারি। আমি এই মহান প্রজ্ঞাবান মানুষটিকে আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।