০৫:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ভারতের রাজধানী কলকাতা!

আশিকুল আলম বিশ্বাস
  • প্রকাশ: ১০:৩৫:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ ২০২২
  • / ৩৭৫৪ বার পড়া হয়েছে

ব্রিটিশ আমলের কলকাতা শহর

ভারতের বর্তমান রাজধানী নতুন দিল্লি, একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু দেশের রাজধানী যে একসময় আমাদের প্রিয় শহর কলকাতাতেই ছিল, একথা জেনে অনেকেই অবাক হতে পারেন! তবে এটাই বাস্তব। ১৬৯০ সালে দিল্লি সম্রাটের সনদ পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলিকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর— এই তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে আধুনিক কলকাতার সূচনা করে। কোম্পানির লোকেরা প্রথম থেকেই কলকাতাকে তাদের আদরের শহর হিসেবে গড়ে তুলেছিল, ফেলে আসা লন্ডনের আদলে। ১৮৫৭ সালের পর যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জায়গায় ব্রিটেন সরাসরি ভারতের শাসনভার হাতে নিল, তখন কলকাতাই হলো তাদের রাজধানী।

একের পর এক গড়ে উঠতে থাকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, জিওলজিক্যাল সোসাইটি, এশিয়াটিক সোসাইটি, মেডিক্যাল কলেজ, মিউজিয়াম, এবং অবশ্যই লাটভবন। তখন লন্ডনের সাথে পাল্লা দিচ্ছিল কলকাতা। বিদ্যা, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, সবকিছুই ইংরেজরা কলকাতায় বসে চর্চা করেছেন। উৎকর্ষের দিক থেকে কলকাতা শহর তখন ভারতের মধ্যে প্রথম। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করলে প্রথম দিকের স্থানাধিকারীরা কলকাতায় পোস্টিং পেতেন।

ভালোই চলছিল সব। কিন্তু মুশকিল বাধলো অন্য জায়গায়। এত স্কুল-কলেজ, এত বিশ্বমানের বিনিময়ের ছোঁয়ায় বাংলায় নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল একদল আধুনিক মনস্ক বাঙালির সচেতনতার ফলে। ধর্ম, সমাজ, রীতিনীতি, ইংরেজি শিক্ষা, সব ক্ষেত্রে ঢেউ এলো পরিবর্তনের। প্রথমবার স্বদেশ চেতনার জন্ম হলো। বাঙালিরা তাদের ব্রিটিশ বিরোধিতা শুরু করে দিলো। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর সুশাসন ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করে দেন তদানীন্তন লাটসাহেব লর্ড কার্জন। নামে পূর্ব ও পশ্চিম হলেও তার আড়ালে ছিল ধর্মভিত্তিক বিভাজন। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলায় এ নিয়ে তেমন আপত্তি না থাকলেও, হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে এর প্রতিবাদে ঘোরতর আন্দোলন শুরু হয়। ‘স্বদেশী গ্রহণ, বিদেশি বর্জন’ এর মূল সুর হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিও তাতে শামিল হন। ব্রিটিশরা আন্দোলন ভাঙার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো ও বাংলা আবার যুক্ত হলো। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা বাঙালিদের অন্য উপায়ে শাস্তির ব্যবস্থা করল, কলকাতার রাজধানীর মুকুট কেড়ে নিয়ে। কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নতুন দিল্লিতে। আর কলকাতা হয়ে গেল একটা সাধারণ শহর, তার অসাধারণ স্থাপত্য, বিদ্যাচর্চা ইত্যাদি আর স্বদেশপ্রেম নিয়ে। রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে নতুন রাজধানী হিসেবে নয়া দিল্লির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল সেই ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর, ‘দিল্লি দরবার’ নামক রাজকীয় অনুষ্ঠানে। এরও ২০ বছর পর, ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড আরউইন নতুন রাজধানী হিসেবে উদ্বোধন ঘোষণা করেন নয়া দিল্লির।

ভারতের রাজধানী কেন কলকাতা থেকে সরিয়ে নয়া দিল্লিতে নিয়ে আসা হলো? আর কেনই বা রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে নয়া দিল্লিকে এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলো?

ভারতের ভাইসরয় যখন লর্ড হার্ডিঞ্জ, তাঁর লেখা একটি চিঠিতে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন গ্রেট ব্রিটেনের উচিত তাদের ভারতীয় ঔপনিবেশিক রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া। চিঠিটি ১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট পাঠানো হয়েছিল সিমলা থেকে লন্ডনে। প্রাপক ছিলেন তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া, আর্ল অব ত্রুইর। হার্ডিঞ্জ সেখানে গুরুত্বারোপ করেছিলেন ভারতের চরমভাবাপন্ন এলাকা কলকাতা থেকে গোটা অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে উদ্ভূত বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছিল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অনুযায়ী।

কিন্তু এ নীতি আঘাত হেনেছিল বাংলার, বিশেষত পশ্চিম বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদী চেতনায়। তারা ঘোষণা করেছিল, সকল বিদেশি পণ্য বর্জনের। এবং বঙ্গভঙ্গ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন এক পর্যায়ে এমন চরম রূপ নিয়েছিল যে, বোমাবাজি ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়েছিল কলকাতার নিত্যকার ঘটনায়। কলকাতার আকাশ-বাতাস যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তখন লর্ড হার্ডিঞ্জ বেশ ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিলেন, কলকাতা আর তাদের জন্য শাসনকার্য পরিচালনার উপযোগী, মিত্রভাবাপন্ন শহর নেই। তাই তিনি চাইছিলেন যত দ্রুত সম্ভব এই শহর ত্যাগ করতে। হার্ডিঞ্জ তার পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার কথা লিখে পাঠান, এবং তা অনুমোদন পেয়ে যায় রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে। তিনি ঘোষণা করলেন কলকাতার পরিবেশ ঠান্ডা করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করার, কিন্তু সেই একই সাথে অতিসত্ত্বর রাজধানী অন্য কোথাও স্থানান্তরেরও।

এছাড়া নয়া দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের পেছনে ছিল আরো দুইটি প্রধান কারণ। দিল্লিতে রাজধানী স্থাপনের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, অতীতে ভারতবর্ষ শাসন করা বেশ কিছু সাম্রাজ্যেরও বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল এই দিল্লিই। আরেকটি প্রধান কারণ অবশ্যই দিল্লির অবস্থান। কলকাতা যেখানে অবস্থিত দেশের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে, সেখানে দিল্লির অবস্থান দেশের উত্তরাঞ্চলে। তবে ১৯১১ সালে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে হতে ১৯৩১ সাল চলে আসার পেছনেও রয়েছে কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ। 

কালো বিন্দু দিয়ে কলকাতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কলকাতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী।

নিঃসন্দেহে শাহজাহানবাদ (পুরনো দিল্লি) ছিল মুঘল যুগের রাজধানী। কিন্তু তারপরও ব্রিটিশদের ধারণ করার মতো পর্যাপ্ত যোগ্যতা তখনো ছিল না এই শহরের। তাই দুই ব্রিটিশ স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েন্স ও স্যার হারবার্ট বেকারের উপর দেয়া হয়েছিল শহরটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব। নতুন রাজধানীটিকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল তৎকালীন অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে, এবং ১৯২৭ সালে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘নয়া দিল্লি’। 

প্রাথমিকভাবে সকলে ভেবেছিল, নতুন রাজধানীটিকে প্রস্তুত করে ফেলতে প্রয়োজন হবে বড়োজোর চার বছর। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে নষ্ট করে দেয় যাবতীয় পরিকল্পনা। তাই তো চার বছর শেষমেশ গিয়ে স্পর্শ করে বিশ বছরে। প্রথম বিশযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশরাজ। তাই তাৎক্ষণিকভাবে নয়া দিল্লিতে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের হাতে ছিল না।

১৯১২ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য একটি সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংও তৈরি হয়ে যায়, এবং রাইসিনা হিলে স্থাপিত হয় উত্তর ও দক্ষিণ ব্লকগুলো। যেভাবে কাজ এগোচ্ছিল, তাতে লুটিয়েন্স ও বেকারের পক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলা খুব একটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল ও অর্থনৈতিক সংকটে খেই হারিয়ে ফেলেন তারা, এবং নয়া দিল্লি পুরোপুরি সংস্কার হতেই লেগে যায় ১৯৩১ সাল। তারপরই সম্ভব হয়েছিল এটিকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের নতুন রাজধানী হিসেবে উদ্বোধন করা। লর্ড কার্জন, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রাক্তন ভাইসরয়, বিরোধিতা করেছিলেন রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার। কার্জনের দৃষ্টিতে, ব্রিটিশ ভারতে দিল্লির থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল মাদ্রাজ ও রেঙ্গুন। সেই সময়ের ভারত সচিব লর্ড ত্রু« লন্ডনে বসেই বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষের বিদ্রোহ ও গোলমালের মূল কারণ বঙ্গবিভাগ। তিনি বঙ্গবিভাগ রদ করে এটিকে একটি গভর্নর শাসিত রাজ্যে পরিণত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। হার্ডিঞ্জ তখন পদে যোগদান করেছেন মাত্র দুই মাস আগে, তিনি অন্যান্য সেক্রেটারীদের সঙ্গে পরামর্শ করে এটিকে প্রত্যাখ্যান করলেন। হার্ডিঞ্জ কিন্তু পরে বুঝলেন যে, এই ভাগ বাঙালির আন্দোলন ও নানাবিধ নরম ও গরম পন্থার একটি জ্বালানি স্বরূপ।

এই সময় ১৭ জুন ১৯১১ সালে, বড়োলাট কাউন্সিল-এর সদস্য স্যার জন জেঙ্কিন্স বঙ্গভঙ্গ রদ করে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার একটি প্রস্তাব পাঠালেন। বড়োলাট হার্ডিঞ্জ এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেন, ১৯ জুলাই ১৯১১ সালে এই প্রস্তাব বিলেতে পাঠানো হলো। লর্ড ত্রু« এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন এবং ১০ নভেম্বর ১৯১১-তে ব্রিটিশ মন্ত্রী পরিষদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করল।

লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁর পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার কথা লিখে পাঠান, এবং তা অনুমোদন পেয়ে যায় রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে। তিনি ঘোষণা করেন, কলকাতার পরিবেশ ঠান্ডা করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করার, কিন্তু সেই একই সাথে অতিসত্ত্বর রাজধানী অন্য কোথাও স্থানান্তরেরও। সমস্ত দিক বিবেচনা করে ১২ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে দিল্লি দরবারের সমাপ্তিকালে ব্রিটিশ ও ভারত সম্রাট, কিং জর্জ কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের কথা ঘোষণা করেছিলেন।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আশিকুল আলম বিশ্বাস

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

ভারতের রাজধানী কলকাতা!

প্রকাশ: ১০:৩৫:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ ২০২২

ভারতের বর্তমান রাজধানী নতুন দিল্লি, একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু দেশের রাজধানী যে একসময় আমাদের প্রিয় শহর কলকাতাতেই ছিল, একথা জেনে অনেকেই অবাক হতে পারেন! তবে এটাই বাস্তব। ১৬৯০ সালে দিল্লি সম্রাটের সনদ পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলিকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর— এই তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে আধুনিক কলকাতার সূচনা করে। কোম্পানির লোকেরা প্রথম থেকেই কলকাতাকে তাদের আদরের শহর হিসেবে গড়ে তুলেছিল, ফেলে আসা লন্ডনের আদলে। ১৮৫৭ সালের পর যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জায়গায় ব্রিটেন সরাসরি ভারতের শাসনভার হাতে নিল, তখন কলকাতাই হলো তাদের রাজধানী।

একের পর এক গড়ে উঠতে থাকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, জিওলজিক্যাল সোসাইটি, এশিয়াটিক সোসাইটি, মেডিক্যাল কলেজ, মিউজিয়াম, এবং অবশ্যই লাটভবন। তখন লন্ডনের সাথে পাল্লা দিচ্ছিল কলকাতা। বিদ্যা, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, সবকিছুই ইংরেজরা কলকাতায় বসে চর্চা করেছেন। উৎকর্ষের দিক থেকে কলকাতা শহর তখন ভারতের মধ্যে প্রথম। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করলে প্রথম দিকের স্থানাধিকারীরা কলকাতায় পোস্টিং পেতেন।

ভালোই চলছিল সব। কিন্তু মুশকিল বাধলো অন্য জায়গায়। এত স্কুল-কলেজ, এত বিশ্বমানের বিনিময়ের ছোঁয়ায় বাংলায় নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল একদল আধুনিক মনস্ক বাঙালির সচেতনতার ফলে। ধর্ম, সমাজ, রীতিনীতি, ইংরেজি শিক্ষা, সব ক্ষেত্রে ঢেউ এলো পরিবর্তনের। প্রথমবার স্বদেশ চেতনার জন্ম হলো। বাঙালিরা তাদের ব্রিটিশ বিরোধিতা শুরু করে দিলো। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর সুশাসন ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করে দেন তদানীন্তন লাটসাহেব লর্ড কার্জন। নামে পূর্ব ও পশ্চিম হলেও তার আড়ালে ছিল ধর্মভিত্তিক বিভাজন। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলায় এ নিয়ে তেমন আপত্তি না থাকলেও, হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে এর প্রতিবাদে ঘোরতর আন্দোলন শুরু হয়। ‘স্বদেশী গ্রহণ, বিদেশি বর্জন’ এর মূল সুর হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিও তাতে শামিল হন। ব্রিটিশরা আন্দোলন ভাঙার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো ও বাংলা আবার যুক্ত হলো। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা বাঙালিদের অন্য উপায়ে শাস্তির ব্যবস্থা করল, কলকাতার রাজধানীর মুকুট কেড়ে নিয়ে। কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নতুন দিল্লিতে। আর কলকাতা হয়ে গেল একটা সাধারণ শহর, তার অসাধারণ স্থাপত্য, বিদ্যাচর্চা ইত্যাদি আর স্বদেশপ্রেম নিয়ে। রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে নতুন রাজধানী হিসেবে নয়া দিল্লির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল সেই ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর, ‘দিল্লি দরবার’ নামক রাজকীয় অনুষ্ঠানে। এরও ২০ বছর পর, ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড আরউইন নতুন রাজধানী হিসেবে উদ্বোধন ঘোষণা করেন নয়া দিল্লির।

ভারতের রাজধানী কেন কলকাতা থেকে সরিয়ে নয়া দিল্লিতে নিয়ে আসা হলো? আর কেনই বা রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে নয়া দিল্লিকে এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলো?

ভারতের ভাইসরয় যখন লর্ড হার্ডিঞ্জ, তাঁর লেখা একটি চিঠিতে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন গ্রেট ব্রিটেনের উচিত তাদের ভারতীয় ঔপনিবেশিক রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া। চিঠিটি ১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট পাঠানো হয়েছিল সিমলা থেকে লন্ডনে। প্রাপক ছিলেন তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া, আর্ল অব ত্রুইর। হার্ডিঞ্জ সেখানে গুরুত্বারোপ করেছিলেন ভারতের চরমভাবাপন্ন এলাকা কলকাতা থেকে গোটা অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে উদ্ভূত বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছিল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অনুযায়ী।

কিন্তু এ নীতি আঘাত হেনেছিল বাংলার, বিশেষত পশ্চিম বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদী চেতনায়। তারা ঘোষণা করেছিল, সকল বিদেশি পণ্য বর্জনের। এবং বঙ্গভঙ্গ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন এক পর্যায়ে এমন চরম রূপ নিয়েছিল যে, বোমাবাজি ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়েছিল কলকাতার নিত্যকার ঘটনায়। কলকাতার আকাশ-বাতাস যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তখন লর্ড হার্ডিঞ্জ বেশ ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিলেন, কলকাতা আর তাদের জন্য শাসনকার্য পরিচালনার উপযোগী, মিত্রভাবাপন্ন শহর নেই। তাই তিনি চাইছিলেন যত দ্রুত সম্ভব এই শহর ত্যাগ করতে। হার্ডিঞ্জ তার পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার কথা লিখে পাঠান, এবং তা অনুমোদন পেয়ে যায় রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে। তিনি ঘোষণা করলেন কলকাতার পরিবেশ ঠান্ডা করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করার, কিন্তু সেই একই সাথে অতিসত্ত্বর রাজধানী অন্য কোথাও স্থানান্তরেরও।

এছাড়া নয়া দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের পেছনে ছিল আরো দুইটি প্রধান কারণ। দিল্লিতে রাজধানী স্থাপনের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, অতীতে ভারতবর্ষ শাসন করা বেশ কিছু সাম্রাজ্যেরও বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল এই দিল্লিই। আরেকটি প্রধান কারণ অবশ্যই দিল্লির অবস্থান। কলকাতা যেখানে অবস্থিত দেশের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে, সেখানে দিল্লির অবস্থান দেশের উত্তরাঞ্চলে। তবে ১৯১১ সালে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে হতে ১৯৩১ সাল চলে আসার পেছনেও রয়েছে কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ। 

কালো বিন্দু দিয়ে কলকাতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কলকাতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী।

নিঃসন্দেহে শাহজাহানবাদ (পুরনো দিল্লি) ছিল মুঘল যুগের রাজধানী। কিন্তু তারপরও ব্রিটিশদের ধারণ করার মতো পর্যাপ্ত যোগ্যতা তখনো ছিল না এই শহরের। তাই দুই ব্রিটিশ স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েন্স ও স্যার হারবার্ট বেকারের উপর দেয়া হয়েছিল শহরটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব। নতুন রাজধানীটিকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল তৎকালীন অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে, এবং ১৯২৭ সালে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘নয়া দিল্লি’। 

প্রাথমিকভাবে সকলে ভেবেছিল, নতুন রাজধানীটিকে প্রস্তুত করে ফেলতে প্রয়োজন হবে বড়োজোর চার বছর। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে নষ্ট করে দেয় যাবতীয় পরিকল্পনা। তাই তো চার বছর শেষমেশ গিয়ে স্পর্শ করে বিশ বছরে। প্রথম বিশযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশরাজ। তাই তাৎক্ষণিকভাবে নয়া দিল্লিতে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের হাতে ছিল না।

১৯১২ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য একটি সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংও তৈরি হয়ে যায়, এবং রাইসিনা হিলে স্থাপিত হয় উত্তর ও দক্ষিণ ব্লকগুলো। যেভাবে কাজ এগোচ্ছিল, তাতে লুটিয়েন্স ও বেকারের পক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলা খুব একটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল ও অর্থনৈতিক সংকটে খেই হারিয়ে ফেলেন তারা, এবং নয়া দিল্লি পুরোপুরি সংস্কার হতেই লেগে যায় ১৯৩১ সাল। তারপরই সম্ভব হয়েছিল এটিকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের নতুন রাজধানী হিসেবে উদ্বোধন করা। লর্ড কার্জন, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রাক্তন ভাইসরয়, বিরোধিতা করেছিলেন রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার। কার্জনের দৃষ্টিতে, ব্রিটিশ ভারতে দিল্লির থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল মাদ্রাজ ও রেঙ্গুন। সেই সময়ের ভারত সচিব লর্ড ত্রু« লন্ডনে বসেই বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষের বিদ্রোহ ও গোলমালের মূল কারণ বঙ্গবিভাগ। তিনি বঙ্গবিভাগ রদ করে এটিকে একটি গভর্নর শাসিত রাজ্যে পরিণত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। হার্ডিঞ্জ তখন পদে যোগদান করেছেন মাত্র দুই মাস আগে, তিনি অন্যান্য সেক্রেটারীদের সঙ্গে পরামর্শ করে এটিকে প্রত্যাখ্যান করলেন। হার্ডিঞ্জ কিন্তু পরে বুঝলেন যে, এই ভাগ বাঙালির আন্দোলন ও নানাবিধ নরম ও গরম পন্থার একটি জ্বালানি স্বরূপ।

এই সময় ১৭ জুন ১৯১১ সালে, বড়োলাট কাউন্সিল-এর সদস্য স্যার জন জেঙ্কিন্স বঙ্গভঙ্গ রদ করে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার একটি প্রস্তাব পাঠালেন। বড়োলাট হার্ডিঞ্জ এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেন, ১৯ জুলাই ১৯১১ সালে এই প্রস্তাব বিলেতে পাঠানো হলো। লর্ড ত্রু« এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন এবং ১০ নভেম্বর ১৯১১-তে ব্রিটিশ মন্ত্রী পরিষদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করল।

লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁর পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার কথা লিখে পাঠান, এবং তা অনুমোদন পেয়ে যায় রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে। তিনি ঘোষণা করেন, কলকাতার পরিবেশ ঠান্ডা করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করার, কিন্তু সেই একই সাথে অতিসত্ত্বর রাজধানী অন্য কোথাও স্থানান্তরেরও। সমস্ত দিক বিবেচনা করে ১২ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে দিল্লি দরবারের সমাপ্তিকালে ব্রিটিশ ও ভারত সম্রাট, কিং জর্জ কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের কথা ঘোষণা করেছিলেন।