১১:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চা

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক
  • প্রকাশ: ০৪:৩৬:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
  • / ১৫৬৭ বার পড়া হয়েছে

২১শে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে ঢাকায় নির্মিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।

একটি দেশের মাতৃভাষা তার অহঙ্কার। এ যাবৎ, বিশ্বে ২৫টি ভাষায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এবং তার মধ্যে বাংলা ভাষা একটি। এ ভাষায় কথা বলে প্রায় ২৮ কোটি বাঙালি। ভাষাভাষী জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ ভাষা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপ দিয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি উঠেছে। এরপরেও কী দেশে বাংলা ভাষাকে জীবনের সর্বস্তরে আমরা চালু করতে সক্ষম হয়েছি? বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে ছিলেন আপসহীন। 

যে জাতি তার নিজ ভাষায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উন্নত, সে জাতি তত অগ্রগামী। সে জাতি মাথা উঁচু করে সমগ্র বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন ভাষাকে সমুন্নত রাখার সেই সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে। সরকার ও প্রশাসনের সব দাপ্তরিক আদেশ, ঘোষণা বাংলা ভাষায় তৈরি হলেও দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা এখনো সম্ভব হয়নি। উচ্চ আদালতের রায়গুলো এখনো অধিকাংশ ইংরেজিতেই লেখা হয়। আমার প্রশ্ন, দেশের ক’জন বিচারপ্রার্থী ইংরেজিতে লেখা সেই রায়ে কী বলা হলো তা বুঝতে পারবেন? আইন-আদালতের ক্ষেত্রে মক্কেলদের ভাষার বাইরে যাওয়াটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, এমনকি অগণতান্ত্রিক। যদিও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান-সহ হাইকোর্টের কয়েকজন বিচারক বিভিন্ন মামলার রায় দিয়েছেন বাংলায়। অতি সম্প্রতি হাইকোর্ট একটি মামলার রায় বাংলায় লিখে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রশংসিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, “দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায় অচিরেই বাংলায় দেওয়া হবে, সেজন্য কাজ চলছে”। আদালতের রায় বাংলায় দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে বিভিন্ন আইনি পরিভাষা, যেগুলোর যথাযথ প্রতিশব্দ বাংলায় তৈরি হয়নি। 

ভাবতে অবাক লাগে যে, ভাষা আন্দোলনের সাত দশক পরেও দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে সেই ইংরেজিপ্রীতি মনোভাব নিয়েই আমরা এখনও বাস করছি। এখনও এদেশে বিদ্যা, বুদ্ধি এবং কর্মকুশলতার মাপকাঠি দাঁড়িয়ে রয়েছে ইংরেজি বলা বা লেখার কৃতিত্বে। এই তো সেদিন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক/সহকারি অধ্যাপক পদের চাকরি নিয়োগে বেশ কয়েকটি ইন্টারভিউ বোর্ডে আমি সদস্য ছিলাম। ইন্টারভিউ বোর্ডের সকলই প্রার্থীদের ইংরেজিতে প্রশ্ন করেছেন এবং প্রার্থীরাও মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছেন শিক্ষকদের খুশি করতে- অথচ শিক্ষক-প্রার্থী সবাই সেখানে বাঙালি। প্রার্থীগণ তাদের ইংরেজি ভাষায় কী বলতে চান তা ভাবার্থে খুব পরিষ্কার নয়। তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। যাইহোক, এইরকম একজন প্রার্থীকে বললাম, “তুমি আমার প্রশ্নটি মাতৃভাষায় আমাদের বুঝায়ে বলো। অনায়াস বাংলায় তার ওই বিষয়টির ওপর উত্তরজ্ঞান বিচারের মাপকাঠিতে সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার খাতায় যে-ছেলে ভালো ইংরেজি লেখে, চাকরির বাজার থেকে বিবাহযোগ্য কন্যার উদ্বিগ্ন পিতামাতা পর্যন্ত সর্বত্র তার আদর আছে। কারণ সেই হচ্ছে স্মার্ট ছেলে। বাঙালি হয়ে শুদ্ধভাষায় বাংলা ভালো বলতে পারে না, কিন্তু একটু জিহবা ঘুরিয়ে ঠুকঠাক ইংরেজি বলার অভ্যাস রপ্ত করেছে বেশ। এটা হাস্যকর। সুন্দর করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলাও যে বড় সম্মানের ও যোগ্যতার। মাতৃভাষা না জানলে একটা শূণ্যতা থেকেই যাবে। নিজের মন থেকে মনের ভাব প্রকাশের সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে। 

ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা নয়, কিন্তু ইংরেজি আমাদের শিখতে হয়। তাতে আপত্তি নেই, ক্ষোভও নেই- হয়তো লাভই আছে। স্বজাতিকতার আধুনিক ধারণা, ইংরেজিতে যাকে বলে ন্যাশন্যালইজম তার বেশিটা আমরা পেয়েছি ইংরেজি শিক্ষার ফলে। সারা বিশ্বে যে ভাষাটি দাপটে বিরাজ করছে ও অন্য অনেক ভাষাকে কোণঠাসা করে এগিয়ে চলেছে, সেটি ইংরেজি। রাষ্ট্রপুঞ্জ  অনেক ভাষাকে স্বীকৃতি দিলেও তার কাজকর্মের মূল ভাষা ইংরেজি। ইংরেজি হল আন্তর্জাতিক লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা, যোগাযোগের ভাষা। ফলে ইংরেজির প্রতি ঝোঁক সারা বিশ্বে সর্বত্র বেড়েছে। অনেকে মনে করেন ইংরেজি বিজ্ঞানের ভাষা। এ ছাড়া, ইংরেজি বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণেরও ভাষা। তবে, মাতৃভাষা ভাল ভাবে শিখে, তার চর্চা অব্যাহত রেখেও যে ইংরেজি ভালই শেখা যায়। আমি মনে করি ইংরেজি শেখার প্রয়োজন আছে, সেখানে তো  কারো কোনো বিরোধ নেই। বিদ্যাসাগর থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ থেকে হুমায়ুন কবির জীবন ও কর্ম থেকে আমরা সেটাই তো বুঝতে পেরেছি।

ভাষা মানুষের আত্মবিকাশের পথকে সম্প্রসারিত করে। আমরা সকলেই জানি যে আমরা যদি জটিল ধারণাগুলি বুঝতে চাই, ব্যাখ্যা করতে চাই বা কোনো বিষয়ে সত্যিকারের অনুভূতি প্রকাশ করতে চাই, তাহলে  মাতৃভাষার বিকল্প নেই। মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়টি সব সময় প্রাকৃতিক ও স্বয়ংক্রিয়। জন্ম থেকে পাওয়া নিজের ভাষাই হচ্ছে একমেবাদ্বিতীয়ম। এশিয়া, বিশেষকরে দক্ষিণ এশিয়া, ও আফ্রিকার অনেক উপনিবেশিত দেশ স্বাধীনতার পরেও ঔপনিবেশিক শক্তির ভাষা ব্যবহার করে চলেছে। এটা ঘটছে কারণ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নিজস্ব ভাষাকে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভাষা হিসেবে চালু করেছিল। এমনকি অফিস-আদালতেও ছিল তাই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে জনসাধারণের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু উচ্চ স্তরে গিয়ে শিক্ষার মাধ্যম হয়েছে একটি বিদেশি ভাষা। বাংলাদেশেও এ-রকমটাই ঘটছে এবং স্কুল থেকে আসা ছাত্ররা মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহার করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমে একটি অসুবিধাজনক অবস্থানে পড়ে। এমনকি গত শতাব্দীর শেষের দশকগুলিতে ইংরেজি উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো চিকিৎসা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ও আইনের মত বিশেষায়িত ক্ষেত্রে। বর্তমানে সেই চর্চার পরিবর্তন হয়তো কিছুটা এসেছে, তবে পুরোপুরি নয়। এর অজুহাত হিসেবে দেখানো হয় আমাদের কাছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষায় এখনো ভালো বই নেই, বা বিশেষায়িত বিষয়গুলিতে পরিভাষা সেভাবে এখনো সৃষ্টি হয় নি। এ ছাড়া, দেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা শাস্ত্রে বাংলা ভাষায় ভালো কোনো জার্নালও প্রকাশ হয় না। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই একটা উদাহরণ টানছি। সেটা ২০২১ সালের কথা। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান সম্পর্কিত পরিসংখ্যানমূলক একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় জার্নালের অভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি। অর্থাৎ দেশে উচ্চশিক্ষার স্তরে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বিজ্ঞানের প্রসারলাভ আশানুরূপভাবে ঘটেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয় নিয়ে জার্নাল প্রকাশনার ব্যাপারে বাংলা একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় আগের মত বিজ্ঞান প্রকাশনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখছে না। উক্ত সংস্থাগুলো আরও বেশি সক্রিয় হলে উচ্চ পর্যায়ে বিজ্ঞান পাঠ্য পুস্তক, বিজ্ঞান সাহিত্য, বিজ্ঞান গবেষণাপত্র প্রকাশনার মাধ্যমে দেশের ছাত্র শিক্ষক ও গবেষণা কর্মিরা উৎসাহিত ও উপকৃত হতেন।

‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেজদাদার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন “আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তার পরে ইংরেজি শেখার পত্তন।”  আমাদের দেশে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমস্যা হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম বাংলা বা ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোভাবে শিখছে না। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রমিত ভাষার ব্যবহার যেন প্রায় স্বদেশ হতে বহিস্কৃত। তারা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম দিচ্ছে। এতে ভাষা বিকৃতি ঘটছে চরমভাবে। ফেসবুক-ইন্টারনেটে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত ভাষা। রোমান হরফে বাংলা লেখা হচ্ছে। সেই বাংলার ধরনও আবার বড়ই বিচিত্র। প্রকৃতপক্ষে ভাষা ব্যবহারের সর্বক্ষেত্রেই যেন এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।

পরিভাষা প্রসঙ্গ: এটা দুঃখজনক যে, বিজ্ঞানের পরিভাষা এখনো সম্পূর্ণ বাংলায় হয়নি। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি মাতৃভাষা ব্যবহারের সাফল্য এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপানে। তারা সর্বস্তরে, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, এমনকি গবেষণার প্রতিটি ক্ষেত্রে, মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে বৈশ্বিক উন্নয়নের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইউনেস্কোসহ অনেক সংস্থার গবেষণাই তা প্রমাণ করেছে। শিক্ষার সর্বস্তরে মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার উপকারিতা জানা সত্ত্বেও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান চর্চায় বাংলাকে এখনও গ্রহণ করতে পারছি না। 

বাংলা ভাষা একটি ক্রমবর্ধমান ভাষা। তার শব্দ ভাণ্ডারের ক্রমশঃ বিস্তৃতি ঘটেছে। নতুন নতুন শব্দ  এসেছে বাংলা ভাষায়। বাংলা ভাষায় তৎসম ও তদ্ভব শব্দ ছাড়াও প্রচুর রয়েছে বিদেশি শব্দ। তম্মধ্যে আড়াই হাজার আরবি-ফার্সি, প্রায় চার শ’ তুর্কি, এক হাজার ইংরেজি, দেড় শ’ পর্তুগিজ-ফরাশি, এবং কিছু অন্যান্য ভাষার শব্দ।  তবে এটা অনস্বীকার্য যে, শব্দভাণ্ডার স্ফীত হলেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আইনিবিষয়সহ বিশেষায়িত বিষয়গুলো এখনো ইংরেজির ওপর তার নির্ভরশীলতা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ স্বাভাবিকতা ও সহজবোধ্য পরিভাষার অভাব।  প্রযুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্রে ও বিজ্ঞান শিক্ষার উচ্চপর্যায়ে বাংলার প্রচলন প্রাথমিকভাবে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও মোটেও তা দুরূহ বা দুঃসাধ্য নয়। আইন বিষয়ের ব্যাপারটি আইনবিদরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একত্রে প্রণয়ন করেন ‘আইন-শব্দকোষ’, যা আদালতের বাংলায় রায় প্রদান, মুসাবিদা লিখন, কিংবা সংসদের বাংলায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি সর্বোত্তম গ্রন্থ। 

বাংলায় লেখা করোনাভাইরাস সম্পর্কিত আমার সাম্প্রতিক একটি বই লিখতে গিয়েও আমি দেখেছি কতসব পরিভাষিত শব্দ কাঠিন্যে ভরা, যা মোটেই সহজবোধ্য নয়। তাছাড়া সেগুলো ল্যাটিন শব্দের সঙ্গে আদপে সামঞ্জস্য নয়। আমি সেইসব ক্ষেত্রে ল্যাটিন শব্দগুলি প্রায়শঃ বাংলা অক্ষরে ব্যবহার করেছি। বহুমূত্র উপসর্গ অনেক রোগের কারণেও হতে পারে-যেমন, বিষাদগ্রস্থতা, বর্ধিত ক্যালসিয়াম বা থাইরক্সিন হরমোন, ‘প্রস্টেট গ্রন্থি’র জটিলতা ইত্যাদি। আর, ক’জনেই বা ডায়াবেটিস মানে বুঝবে  ‘মধুমেহ’। অথচ বাঙলির মুখে মুখে কিন্তু ডায়াবেটিস, লেখেনও তাঁরা বাংলায় ‘ডায়াবেটিস’। তাই, Diabetis এর পরিভাষা  ‘ডায়াবেটিস’ হওয়াটাই যৌক্তিক। এইরকম আরো অনেক শব্দ: মিউটেশন (mutation), ইমিউন সিস্টেম (immune system), অ্যান্টিবডি (antibody) যা যথাক্রমে পরিব্যক্তি, অনাক্রম্যতন্ত্র, প্রতিরক্ষিকা হিসেবে বাংলায় পরিভাষিত। ফলে, বাংলায় লেখা ওই ইংরেজি বা ল্যাটিন শব্দগুলি একটা আন্তর্জাতিক রূপও পাবে। আর,  এগুলো আমাদের মুখে ব্যবহৃত হয়ে ‘বাংলা’ হয়ে-ই যাবে, যেমন হয়েছে সেল ফোন (‘মুঠোফোন’ কোনো টেকসই পরিভাষা হতে পারে না), টেলিভিশন, বা কম্পিউটার। এসব ক্ষেত্রে যত বিদেশি শব্দ আসবে ততই মঙ্গল। কারণ, এসব বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক যোগসূত্রে গাঁথা। কাজেই আমার অভিমত এই যে, বিজ্ঞান আর চিকিৎসা ও প্রকৌশল শাস্ত্রের বইতে বাংলা অক্ষরেই শক্ত ল্যাটিনজাত শব্দ ব্যবহার করতে হবে। সে জন্য পরিভাষা অনুসরণের প্রয়োজন কমে যাবে। এসব ক্ষেত্রে যত বিদেশি শব্দ আসবে ততই মঙ্গল। কারণ এসব বিষয় আন্তর্জাতিক যোগসূত্রে গাঁথা। উদ্দেশ্য, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিভাষাকে বিশ্বতোমুখী ও  বিজ্ঞানসম্মত করা। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান বাস্তবতাকে তুলে ধরেই বলেছেন, ‘যে শব্দগুলো বহুল প্রচলিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত সেগুলো যে ভাষাতেই আসুক আমাদের সেটাই গ্রহণ করতে হবে।…..সবজায়গায় প্রতিশব্দ বা পরিভাষা করতে হবে আমি সেটা বিশ্বাস করিনা।’

এখন থেকে শতাধিক বছর আগে বিখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করে সমগ্র বিশ্বে অমর হয়ে আছেন। বাঙালি জাতিকে অন্তর থেকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলাই ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। তাঁর কর্মজীবনে  কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একমাত্র বাংলা ব্যবহার করতেন তার অধ্যাপনায়। বিজ্ঞানের প্রসারে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রকল্পে তার অবদানও ছিল প্রচুর। তাঁর অনেক বিখ্যাত ছাত্রের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাথ সাহা প্রমুখ। এঁরা ছিলেন বিজ্ঞানের পথিকৃৎ। পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবল সমর্থকই ছিলেন না, তাঁর জীবনে তিনি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাটিকেও বৃদ্ধি করে গেছেন। এই প্রসঙ্গে তার একটি উক্তি অমর হয়ে আছে, “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না, তারা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।” বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ নামে একটি পত্রিকাও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়া, বাঙালিরা বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না তা প্রমাণ করেন জগদীশ চন্দ্র বসু। আর, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে ‘বিশ্ব পরিচয়’ বইটি লেখার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভান্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙ্গিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে তাতে  অগৌরব নেই’।

উচ্চশিক্ষায় ব্যবহার উপযোগী মাতৃভাষায় বইয়ের সংকট এখনও রয়ে গেছে। তবে, কলা ও মানবিক অনুষদ বা ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়গুলিতে পাঠ্য বইয়ের সংকট আছে তা বলা ঠিক হবে না। বাংলায় চিকিৎসা শাস্ত্র, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এই বিষয়গুলিতে এখনো যে উচ্চমানের বইয়ের প্রাপ্যতা নেই- তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এইসব ক্ষেত্রে এখনো শিক্ষার্থীদের অনেকটাই ইংরেজি বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলো শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন সামনে রেখে সেভাবে বাংলায় অনুবাদিত হয়নি বলে সেখানেও এক রকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

একুশের আরো একটি অর্জন হচ্ছে বাঙালির চেতনা ও আবেগের সঙ্গে জড়িত আমাদের বইমেলা। এবারের গ্রন্থমেলা করোনা অতিমারির কারণে দুই সপ্তাহ দেরিতে শুরু হয়েছে। বইমেলা মানেই পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের মিলনমেলা। বিভিন্ন স্টলগুলোতে দেখা মিলবে নতুন সব বইয়ের- সাহিত্য, আন্দোলন-সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক জগৎ, বিজ্ঞানভিত্তিক ইত্যাদি সম্পর্কিত নানাধরণের বই। বর্তমান করোনা মহামারি নিয়েও “করোনাভাইরাস সার্স-কোভি-২-বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা”  শিরোনামে আমার একটি  বইও এবারের বইমেলায় থাকবে বলে আমি আশাবাদী। বলা বাহুল্য, আমাদের পাঠাভ্যাস বাড়ানোর পাশাপাশি বই কেনার অভ্যাসও বাড়িয়ে দেয় এই বইমেলা। যে কোনো ভাষার চেয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজন স্বীকৃত। বইমেলাকে কেন্দ্র করে দেশে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার  প্রয়াস আরও বেগবান হোক- এই রইল আমার প্রত্যাশা।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক: সাবেক উপ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, এবং সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র, ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চা

প্রকাশ: ০৪:৩৬:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

একটি দেশের মাতৃভাষা তার অহঙ্কার। এ যাবৎ, বিশ্বে ২৫টি ভাষায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এবং তার মধ্যে বাংলা ভাষা একটি। এ ভাষায় কথা বলে প্রায় ২৮ কোটি বাঙালি। ভাষাভাষী জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ ভাষা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপ দিয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি উঠেছে। এরপরেও কী দেশে বাংলা ভাষাকে জীবনের সর্বস্তরে আমরা চালু করতে সক্ষম হয়েছি? বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে ছিলেন আপসহীন। 

যে জাতি তার নিজ ভাষায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উন্নত, সে জাতি তত অগ্রগামী। সে জাতি মাথা উঁচু করে সমগ্র বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন ভাষাকে সমুন্নত রাখার সেই সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে। সরকার ও প্রশাসনের সব দাপ্তরিক আদেশ, ঘোষণা বাংলা ভাষায় তৈরি হলেও দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা এখনো সম্ভব হয়নি। উচ্চ আদালতের রায়গুলো এখনো অধিকাংশ ইংরেজিতেই লেখা হয়। আমার প্রশ্ন, দেশের ক’জন বিচারপ্রার্থী ইংরেজিতে লেখা সেই রায়ে কী বলা হলো তা বুঝতে পারবেন? আইন-আদালতের ক্ষেত্রে মক্কেলদের ভাষার বাইরে যাওয়াটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, এমনকি অগণতান্ত্রিক। যদিও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান-সহ হাইকোর্টের কয়েকজন বিচারক বিভিন্ন মামলার রায় দিয়েছেন বাংলায়। অতি সম্প্রতি হাইকোর্ট একটি মামলার রায় বাংলায় লিখে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রশংসিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, “দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায় অচিরেই বাংলায় দেওয়া হবে, সেজন্য কাজ চলছে”। আদালতের রায় বাংলায় দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে বিভিন্ন আইনি পরিভাষা, যেগুলোর যথাযথ প্রতিশব্দ বাংলায় তৈরি হয়নি। 

ভাবতে অবাক লাগে যে, ভাষা আন্দোলনের সাত দশক পরেও দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে সেই ইংরেজিপ্রীতি মনোভাব নিয়েই আমরা এখনও বাস করছি। এখনও এদেশে বিদ্যা, বুদ্ধি এবং কর্মকুশলতার মাপকাঠি দাঁড়িয়ে রয়েছে ইংরেজি বলা বা লেখার কৃতিত্বে। এই তো সেদিন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক/সহকারি অধ্যাপক পদের চাকরি নিয়োগে বেশ কয়েকটি ইন্টারভিউ বোর্ডে আমি সদস্য ছিলাম। ইন্টারভিউ বোর্ডের সকলই প্রার্থীদের ইংরেজিতে প্রশ্ন করেছেন এবং প্রার্থীরাও মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছেন শিক্ষকদের খুশি করতে- অথচ শিক্ষক-প্রার্থী সবাই সেখানে বাঙালি। প্রার্থীগণ তাদের ইংরেজি ভাষায় কী বলতে চান তা ভাবার্থে খুব পরিষ্কার নয়। তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। যাইহোক, এইরকম একজন প্রার্থীকে বললাম, “তুমি আমার প্রশ্নটি মাতৃভাষায় আমাদের বুঝায়ে বলো। অনায়াস বাংলায় তার ওই বিষয়টির ওপর উত্তরজ্ঞান বিচারের মাপকাঠিতে সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার খাতায় যে-ছেলে ভালো ইংরেজি লেখে, চাকরির বাজার থেকে বিবাহযোগ্য কন্যার উদ্বিগ্ন পিতামাতা পর্যন্ত সর্বত্র তার আদর আছে। কারণ সেই হচ্ছে স্মার্ট ছেলে। বাঙালি হয়ে শুদ্ধভাষায় বাংলা ভালো বলতে পারে না, কিন্তু একটু জিহবা ঘুরিয়ে ঠুকঠাক ইংরেজি বলার অভ্যাস রপ্ত করেছে বেশ। এটা হাস্যকর। সুন্দর করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলাও যে বড় সম্মানের ও যোগ্যতার। মাতৃভাষা না জানলে একটা শূণ্যতা থেকেই যাবে। নিজের মন থেকে মনের ভাব প্রকাশের সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে। 

ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা নয়, কিন্তু ইংরেজি আমাদের শিখতে হয়। তাতে আপত্তি নেই, ক্ষোভও নেই- হয়তো লাভই আছে। স্বজাতিকতার আধুনিক ধারণা, ইংরেজিতে যাকে বলে ন্যাশন্যালইজম তার বেশিটা আমরা পেয়েছি ইংরেজি শিক্ষার ফলে। সারা বিশ্বে যে ভাষাটি দাপটে বিরাজ করছে ও অন্য অনেক ভাষাকে কোণঠাসা করে এগিয়ে চলেছে, সেটি ইংরেজি। রাষ্ট্রপুঞ্জ  অনেক ভাষাকে স্বীকৃতি দিলেও তার কাজকর্মের মূল ভাষা ইংরেজি। ইংরেজি হল আন্তর্জাতিক লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা, যোগাযোগের ভাষা। ফলে ইংরেজির প্রতি ঝোঁক সারা বিশ্বে সর্বত্র বেড়েছে। অনেকে মনে করেন ইংরেজি বিজ্ঞানের ভাষা। এ ছাড়া, ইংরেজি বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণেরও ভাষা। তবে, মাতৃভাষা ভাল ভাবে শিখে, তার চর্চা অব্যাহত রেখেও যে ইংরেজি ভালই শেখা যায়। আমি মনে করি ইংরেজি শেখার প্রয়োজন আছে, সেখানে তো  কারো কোনো বিরোধ নেই। বিদ্যাসাগর থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ থেকে হুমায়ুন কবির জীবন ও কর্ম থেকে আমরা সেটাই তো বুঝতে পেরেছি।

ভাষা মানুষের আত্মবিকাশের পথকে সম্প্রসারিত করে। আমরা সকলেই জানি যে আমরা যদি জটিল ধারণাগুলি বুঝতে চাই, ব্যাখ্যা করতে চাই বা কোনো বিষয়ে সত্যিকারের অনুভূতি প্রকাশ করতে চাই, তাহলে  মাতৃভাষার বিকল্প নেই। মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়টি সব সময় প্রাকৃতিক ও স্বয়ংক্রিয়। জন্ম থেকে পাওয়া নিজের ভাষাই হচ্ছে একমেবাদ্বিতীয়ম। এশিয়া, বিশেষকরে দক্ষিণ এশিয়া, ও আফ্রিকার অনেক উপনিবেশিত দেশ স্বাধীনতার পরেও ঔপনিবেশিক শক্তির ভাষা ব্যবহার করে চলেছে। এটা ঘটছে কারণ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নিজস্ব ভাষাকে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভাষা হিসেবে চালু করেছিল। এমনকি অফিস-আদালতেও ছিল তাই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে জনসাধারণের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু উচ্চ স্তরে গিয়ে শিক্ষার মাধ্যম হয়েছে একটি বিদেশি ভাষা। বাংলাদেশেও এ-রকমটাই ঘটছে এবং স্কুল থেকে আসা ছাত্ররা মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহার করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমে একটি অসুবিধাজনক অবস্থানে পড়ে। এমনকি গত শতাব্দীর শেষের দশকগুলিতে ইংরেজি উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো চিকিৎসা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ও আইনের মত বিশেষায়িত ক্ষেত্রে। বর্তমানে সেই চর্চার পরিবর্তন হয়তো কিছুটা এসেছে, তবে পুরোপুরি নয়। এর অজুহাত হিসেবে দেখানো হয় আমাদের কাছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষায় এখনো ভালো বই নেই, বা বিশেষায়িত বিষয়গুলিতে পরিভাষা সেভাবে এখনো সৃষ্টি হয় নি। এ ছাড়া, দেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা শাস্ত্রে বাংলা ভাষায় ভালো কোনো জার্নালও প্রকাশ হয় না। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই একটা উদাহরণ টানছি। সেটা ২০২১ সালের কথা। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান সম্পর্কিত পরিসংখ্যানমূলক একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় জার্নালের অভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি। অর্থাৎ দেশে উচ্চশিক্ষার স্তরে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বিজ্ঞানের প্রসারলাভ আশানুরূপভাবে ঘটেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয় নিয়ে জার্নাল প্রকাশনার ব্যাপারে বাংলা একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় আগের মত বিজ্ঞান প্রকাশনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখছে না। উক্ত সংস্থাগুলো আরও বেশি সক্রিয় হলে উচ্চ পর্যায়ে বিজ্ঞান পাঠ্য পুস্তক, বিজ্ঞান সাহিত্য, বিজ্ঞান গবেষণাপত্র প্রকাশনার মাধ্যমে দেশের ছাত্র শিক্ষক ও গবেষণা কর্মিরা উৎসাহিত ও উপকৃত হতেন।

‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেজদাদার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন “আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তার পরে ইংরেজি শেখার পত্তন।”  আমাদের দেশে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমস্যা হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম বাংলা বা ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোভাবে শিখছে না। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রমিত ভাষার ব্যবহার যেন প্রায় স্বদেশ হতে বহিস্কৃত। তারা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম দিচ্ছে। এতে ভাষা বিকৃতি ঘটছে চরমভাবে। ফেসবুক-ইন্টারনেটে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত ভাষা। রোমান হরফে বাংলা লেখা হচ্ছে। সেই বাংলার ধরনও আবার বড়ই বিচিত্র। প্রকৃতপক্ষে ভাষা ব্যবহারের সর্বক্ষেত্রেই যেন এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।

পরিভাষা প্রসঙ্গ: এটা দুঃখজনক যে, বিজ্ঞানের পরিভাষা এখনো সম্পূর্ণ বাংলায় হয়নি। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি মাতৃভাষা ব্যবহারের সাফল্য এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপানে। তারা সর্বস্তরে, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, এমনকি গবেষণার প্রতিটি ক্ষেত্রে, মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে বৈশ্বিক উন্নয়নের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইউনেস্কোসহ অনেক সংস্থার গবেষণাই তা প্রমাণ করেছে। শিক্ষার সর্বস্তরে মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার উপকারিতা জানা সত্ত্বেও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান চর্চায় বাংলাকে এখনও গ্রহণ করতে পারছি না। 

বাংলা ভাষা একটি ক্রমবর্ধমান ভাষা। তার শব্দ ভাণ্ডারের ক্রমশঃ বিস্তৃতি ঘটেছে। নতুন নতুন শব্দ  এসেছে বাংলা ভাষায়। বাংলা ভাষায় তৎসম ও তদ্ভব শব্দ ছাড়াও প্রচুর রয়েছে বিদেশি শব্দ। তম্মধ্যে আড়াই হাজার আরবি-ফার্সি, প্রায় চার শ’ তুর্কি, এক হাজার ইংরেজি, দেড় শ’ পর্তুগিজ-ফরাশি, এবং কিছু অন্যান্য ভাষার শব্দ।  তবে এটা অনস্বীকার্য যে, শব্দভাণ্ডার স্ফীত হলেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আইনিবিষয়সহ বিশেষায়িত বিষয়গুলো এখনো ইংরেজির ওপর তার নির্ভরশীলতা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ স্বাভাবিকতা ও সহজবোধ্য পরিভাষার অভাব।  প্রযুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্রে ও বিজ্ঞান শিক্ষার উচ্চপর্যায়ে বাংলার প্রচলন প্রাথমিকভাবে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও মোটেও তা দুরূহ বা দুঃসাধ্য নয়। আইন বিষয়ের ব্যাপারটি আইনবিদরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একত্রে প্রণয়ন করেন ‘আইন-শব্দকোষ’, যা আদালতের বাংলায় রায় প্রদান, মুসাবিদা লিখন, কিংবা সংসদের বাংলায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি সর্বোত্তম গ্রন্থ। 

বাংলায় লেখা করোনাভাইরাস সম্পর্কিত আমার সাম্প্রতিক একটি বই লিখতে গিয়েও আমি দেখেছি কতসব পরিভাষিত শব্দ কাঠিন্যে ভরা, যা মোটেই সহজবোধ্য নয়। তাছাড়া সেগুলো ল্যাটিন শব্দের সঙ্গে আদপে সামঞ্জস্য নয়। আমি সেইসব ক্ষেত্রে ল্যাটিন শব্দগুলি প্রায়শঃ বাংলা অক্ষরে ব্যবহার করেছি। বহুমূত্র উপসর্গ অনেক রোগের কারণেও হতে পারে-যেমন, বিষাদগ্রস্থতা, বর্ধিত ক্যালসিয়াম বা থাইরক্সিন হরমোন, ‘প্রস্টেট গ্রন্থি’র জটিলতা ইত্যাদি। আর, ক’জনেই বা ডায়াবেটিস মানে বুঝবে  ‘মধুমেহ’। অথচ বাঙলির মুখে মুখে কিন্তু ডায়াবেটিস, লেখেনও তাঁরা বাংলায় ‘ডায়াবেটিস’। তাই, Diabetis এর পরিভাষা  ‘ডায়াবেটিস’ হওয়াটাই যৌক্তিক। এইরকম আরো অনেক শব্দ: মিউটেশন (mutation), ইমিউন সিস্টেম (immune system), অ্যান্টিবডি (antibody) যা যথাক্রমে পরিব্যক্তি, অনাক্রম্যতন্ত্র, প্রতিরক্ষিকা হিসেবে বাংলায় পরিভাষিত। ফলে, বাংলায় লেখা ওই ইংরেজি বা ল্যাটিন শব্দগুলি একটা আন্তর্জাতিক রূপও পাবে। আর,  এগুলো আমাদের মুখে ব্যবহৃত হয়ে ‘বাংলা’ হয়ে-ই যাবে, যেমন হয়েছে সেল ফোন (‘মুঠোফোন’ কোনো টেকসই পরিভাষা হতে পারে না), টেলিভিশন, বা কম্পিউটার। এসব ক্ষেত্রে যত বিদেশি শব্দ আসবে ততই মঙ্গল। কারণ, এসব বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক যোগসূত্রে গাঁথা। কাজেই আমার অভিমত এই যে, বিজ্ঞান আর চিকিৎসা ও প্রকৌশল শাস্ত্রের বইতে বাংলা অক্ষরেই শক্ত ল্যাটিনজাত শব্দ ব্যবহার করতে হবে। সে জন্য পরিভাষা অনুসরণের প্রয়োজন কমে যাবে। এসব ক্ষেত্রে যত বিদেশি শব্দ আসবে ততই মঙ্গল। কারণ এসব বিষয় আন্তর্জাতিক যোগসূত্রে গাঁথা। উদ্দেশ্য, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিভাষাকে বিশ্বতোমুখী ও  বিজ্ঞানসম্মত করা। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান বাস্তবতাকে তুলে ধরেই বলেছেন, ‘যে শব্দগুলো বহুল প্রচলিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত সেগুলো যে ভাষাতেই আসুক আমাদের সেটাই গ্রহণ করতে হবে।…..সবজায়গায় প্রতিশব্দ বা পরিভাষা করতে হবে আমি সেটা বিশ্বাস করিনা।’

এখন থেকে শতাধিক বছর আগে বিখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করে সমগ্র বিশ্বে অমর হয়ে আছেন। বাঙালি জাতিকে অন্তর থেকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলাই ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। তাঁর কর্মজীবনে  কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একমাত্র বাংলা ব্যবহার করতেন তার অধ্যাপনায়। বিজ্ঞানের প্রসারে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রকল্পে তার অবদানও ছিল প্রচুর। তাঁর অনেক বিখ্যাত ছাত্রের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাথ সাহা প্রমুখ। এঁরা ছিলেন বিজ্ঞানের পথিকৃৎ। পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবল সমর্থকই ছিলেন না, তাঁর জীবনে তিনি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাটিকেও বৃদ্ধি করে গেছেন। এই প্রসঙ্গে তার একটি উক্তি অমর হয়ে আছে, “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না, তারা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।” বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ নামে একটি পত্রিকাও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়া, বাঙালিরা বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না তা প্রমাণ করেন জগদীশ চন্দ্র বসু। আর, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে ‘বিশ্ব পরিচয়’ বইটি লেখার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভান্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙ্গিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে তাতে  অগৌরব নেই’।

উচ্চশিক্ষায় ব্যবহার উপযোগী মাতৃভাষায় বইয়ের সংকট এখনও রয়ে গেছে। তবে, কলা ও মানবিক অনুষদ বা ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়গুলিতে পাঠ্য বইয়ের সংকট আছে তা বলা ঠিক হবে না। বাংলায় চিকিৎসা শাস্ত্র, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এই বিষয়গুলিতে এখনো যে উচ্চমানের বইয়ের প্রাপ্যতা নেই- তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এইসব ক্ষেত্রে এখনো শিক্ষার্থীদের অনেকটাই ইংরেজি বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলো শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন সামনে রেখে সেভাবে বাংলায় অনুবাদিত হয়নি বলে সেখানেও এক রকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

একুশের আরো একটি অর্জন হচ্ছে বাঙালির চেতনা ও আবেগের সঙ্গে জড়িত আমাদের বইমেলা। এবারের গ্রন্থমেলা করোনা অতিমারির কারণে দুই সপ্তাহ দেরিতে শুরু হয়েছে। বইমেলা মানেই পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের মিলনমেলা। বিভিন্ন স্টলগুলোতে দেখা মিলবে নতুন সব বইয়ের- সাহিত্য, আন্দোলন-সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক জগৎ, বিজ্ঞানভিত্তিক ইত্যাদি সম্পর্কিত নানাধরণের বই। বর্তমান করোনা মহামারি নিয়েও “করোনাভাইরাস সার্স-কোভি-২-বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা”  শিরোনামে আমার একটি  বইও এবারের বইমেলায় থাকবে বলে আমি আশাবাদী। বলা বাহুল্য, আমাদের পাঠাভ্যাস বাড়ানোর পাশাপাশি বই কেনার অভ্যাসও বাড়িয়ে দেয় এই বইমেলা। যে কোনো ভাষার চেয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজন স্বীকৃত। বইমেলাকে কেন্দ্র করে দেশে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার  প্রয়াস আরও বেগবান হোক- এই রইল আমার প্রত্যাশা।