০৯:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য

সাধন চন্দ্র মজুমদার
  • প্রকাশ: ০৮:০২:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
  • / ২৮৭১ বার পড়া হয়েছে

২১শে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে ঢাকায় নির্মিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।

মাতৃভাষা প্রত্যেকটি জাতির জাতিসত্তা বিকাশের অনবদ্য মাধ্যম। মাতৃভাষা ব্যতীত আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা সমৃদ্ধ হয় না। তাই পৃথিবীর প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীই তার মাতৃভাষাকে মর্যাদা দিয়ে থাকে। মাতৃভাষার মর্যাদার ওপর ভিত্তি করেই একটা জাতিকে এগিয়ে যেতে হয়। এই পথচলায় বিপত্তি ঘটে পরাধীন জাতির। যেটি আমাদের বাঙালি জাতির ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের জাঁতাকলে বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন কষ্টভোগ করেছে। যে কষ্টের ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না। ব্রিটিশরাজদের কাছ থেকে মুক্ত হবার পর ভারতবর্ষ তিন খণ্ডে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হয়। ভারত-পাকিস্তান নামে রাষ্ট্র দুটোর জন্ম হয় ধর্মভিত্তিক। দ্বিজাতিতত্ত্ব নামের একটি অদ্ভুত দর্শনকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তান অংশের বাঙালিরা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দর্শনকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। আর গান্ধীজির ধ্যানের ভারত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হলেও জন্মলগ্ন থেকেই ধর্মনিরেক্ষপতায় বিশ্বাসী হয়ে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলে। সেটি ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের পরিচয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালি অধু্যষিত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী খামচে ধরে। একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অশুভ ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

১৯৪৮ সালে ঢাকার এক সভায় পাকিস্তানের কথিত জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ উদু‌র্কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করলে বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (তখন বঙ্গবন্ধু হননি) ‘না না’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন উক্ত সভায়। তরুণ তুর্কি বাঙালিরা শেখ মুজিবের ‘না না’ ধ্বনির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে। এরপর ১৯৫০ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ও ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পুনরুক্তি করেন। ১৯৪৮ সালের পর থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। এ আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা দেশের মানুষ এ আন্দোলনকে সমর্থন করে।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি সরকার আন্দোলন দমাতে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা পূর্ব সিদ্ধান্তানুসারে এ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে মিছিল বের করে। নিষ্ঠুর জালিম সরকার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে শহিদ হন, সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউরসহ নাম না-জানা আরো অনেকে। এছাড়া আহত হন বেশ কিছু ভাষা সংগ্রামী। সৃষ্টি হয় রক্ত লেখা নতুন ইতিহাস। ২১ ফেব্রুয়ারি একদিকে শোকের অন্যদিকে আত্মগৌরবের একটি দিন। ভাষা প্রতিষ্ঠার একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামের পথ বেয়েই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন শক্তিশালী হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আন্দোলনের সফল পরিণতি ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভু্যদয়ের মাধ্যমে।

২১শে ফেব্রুয়ারিকে আমরা ইতিপূর্বে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করতাম। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। বিশ্বের ১৯১ টি দেশ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে মর্যাদার সঙ্গে। এ এক গৌরবময় ইতিহাস। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ফোরাম ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে বিশ্বের প্রতিটি ভাষার জনগণকে সচেতন করে তোলার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যুগান্তকারী এ সিদ্ধান্তটি জানার পর কানাডীয় ১০ জনের মাতৃভাষাপ্রেমিক একটি গ্রুপ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রফিকুল ইসলাম নামের এক প্রবাসী বাঙালি তদানীন্তন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে প্রস্তাব প্রেরণ করেন। অতঃপর এ প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষে ইউনেসকোতে পাঠানো হয়। আমাদের সৌভাগ্য, তখন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে জাতিসংঘে ও প্যারিসে গিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিচক্ষণতায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব অর্জন করে। ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ খ্রি. ইউনেসকোর ৩১তম সম্মেলনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি ১৮৮ দেশের সমর্থনে পাশ হয়; এর মাধ্যমে ভাষার জন্য আত্মবিসর্জনের দৃষ্টান্ত স্হাপনের ইতিহাস আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাঙালির আত্মাহুতি মর্মান্তিক হলেও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করে জাতিকে মহিমান্বিত করেছে। শহিদদের প্রতি লাল সালাম।

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি— এই তিনটি শব্দের অর্থ এক নয়। এর প্রত্যেকটির রয়েছে আলাদা আলাদা অর্থ ও বৈশিষ্ট্য। আভিধানিকভাবে অর্থ ও বৈশিষ্টে্যর ভিন্নতা থাকলেও এর তাৎপর্য এক ও অভিন্ন। তিনটি শব্দের সঙ্গেই ‘মা, যুক্ত। মা যেমন তার সন্তানের কাছে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার পাত্র, তেমনি একটি জাতির কাছে তার ভাষা, দেশও শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার বস্ত্ত। নিজের ভাষা ও দেশকে নিজের মায়ের মতোই দেখা উচিত। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি শব্দ একই তাৎপর্যে অন্বিত।

যার গর্ভে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করি, যার দুগ্ধপান করে বেড়ে উঠি, তিনি মা। মায়ের মুখ থেকে যে ভাষার ব্যঞ্জনায় মঞ্জুরিত হয়ে উঠি, সেটি মাতৃভাষা, আর যে ভূখণ্ডে আমার জন্ম, সেই ভূখণ্ড একটি দেশ। সেই দেশের প্রকৃতি, সৌন্দর্যে জীবন অতিবাহিত করি, সেটি আমার মাতৃভূমি প্রিয় স্বদেশ। স্বদেশের ভাষা ও স্বদেশের মর্যাদা রক্ষা মানেই মায়ের মর্যাদা রক্ষা। মাতৃভাষার সম্মান এবং মাতৃভূমির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে প্রতিটি জাতিকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া মাতৃভূমি সমৃদ্ধ হয় না। মানুষ সাধারণত মাতৃভাষার মাধ্যমেই স্বাধীনভাবে মনের ভাব প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। জনগণের কথায় ‘ভাষা হচ্ছে চিন্তার পোশাক।’

জার্মান দার্শনিক ফিক্ট জাতি গঠনের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। মা, মাতৃভাষা নাড়ির টান ও সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমরা বাঙালি জাতি, বাঙালা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের অনেক সংগ্রাম ও রক্ত দিতে হয়েছে। তারই ফলে আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ লাভ করেছি।

অন্যান্য আন্তর্জাতিক দিবসের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

জাতিসংঘের ইউনেসকো কতৃ‌র্ক ঘোষিত আন্তর্জাতিক ‘নারীদিবস, ‘শিক্ষাদিবস, ‘স্বাস্হ্যদিবস, ‘মে দিবস, পালিত হয় দেশে দেশে। তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনন্য এক গৌরবময় মহান দিবস। মে দিবসের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। ১৮৮৬ সালের ১লা মে, আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিক শ্রেণি ন্যাঘ্য অধিকার আদায় করতে গিয়ে রক্ত দিয়েছিল। এর তিন বছর পর ১৮৮৯ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সভায় ঐ দিবসটিকে শ্রমিকদের স্মরণে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা লাভ করে। মেহনতি মানুষের বঞ্চনার কথা, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কাহিনি ব্যাপক প্রচার লাভ করে ১লা মে দিবস পালনের মাধ্যমে। তেমনি মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জনের বীরত্বগাথা সংগ্রামের ইতিহাস এ জাতিকে করেছে মহান। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে উচ্চতর মর্যাদার আসনে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ আরো সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হব। বাংলাদেশের জনগণকে জ্ঞানের সব স্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। একুশের চেতনাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি বাঙালিকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলা ভাষার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিশ্বপরিচয়ে বাঙালি হয়ে উঠবে অনন্য এক শক্তিশালী জাতি।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

সাধন চন্দ্র মজুমদার

সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী, খাদ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য

প্রকাশ: ০৮:০২:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মাতৃভাষা প্রত্যেকটি জাতির জাতিসত্তা বিকাশের অনবদ্য মাধ্যম। মাতৃভাষা ব্যতীত আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা সমৃদ্ধ হয় না। তাই পৃথিবীর প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীই তার মাতৃভাষাকে মর্যাদা দিয়ে থাকে। মাতৃভাষার মর্যাদার ওপর ভিত্তি করেই একটা জাতিকে এগিয়ে যেতে হয়। এই পথচলায় বিপত্তি ঘটে পরাধীন জাতির। যেটি আমাদের বাঙালি জাতির ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের জাঁতাকলে বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন কষ্টভোগ করেছে। যে কষ্টের ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না। ব্রিটিশরাজদের কাছ থেকে মুক্ত হবার পর ভারতবর্ষ তিন খণ্ডে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হয়। ভারত-পাকিস্তান নামে রাষ্ট্র দুটোর জন্ম হয় ধর্মভিত্তিক। দ্বিজাতিতত্ত্ব নামের একটি অদ্ভুত দর্শনকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তান অংশের বাঙালিরা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দর্শনকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। আর গান্ধীজির ধ্যানের ভারত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হলেও জন্মলগ্ন থেকেই ধর্মনিরেক্ষপতায় বিশ্বাসী হয়ে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলে। সেটি ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের পরিচয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালি অধু্যষিত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী খামচে ধরে। একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অশুভ ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

১৯৪৮ সালে ঢাকার এক সভায় পাকিস্তানের কথিত জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ উদু‌র্কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করলে বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (তখন বঙ্গবন্ধু হননি) ‘না না’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন উক্ত সভায়। তরুণ তুর্কি বাঙালিরা শেখ মুজিবের ‘না না’ ধ্বনির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে। এরপর ১৯৫০ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ও ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পুনরুক্তি করেন। ১৯৪৮ সালের পর থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। এ আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা দেশের মানুষ এ আন্দোলনকে সমর্থন করে।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি সরকার আন্দোলন দমাতে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা পূর্ব সিদ্ধান্তানুসারে এ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে মিছিল বের করে। নিষ্ঠুর জালিম সরকার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে শহিদ হন, সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউরসহ নাম না-জানা আরো অনেকে। এছাড়া আহত হন বেশ কিছু ভাষা সংগ্রামী। সৃষ্টি হয় রক্ত লেখা নতুন ইতিহাস। ২১ ফেব্রুয়ারি একদিকে শোকের অন্যদিকে আত্মগৌরবের একটি দিন। ভাষা প্রতিষ্ঠার একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামের পথ বেয়েই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন শক্তিশালী হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আন্দোলনের সফল পরিণতি ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভু্যদয়ের মাধ্যমে।

২১শে ফেব্রুয়ারিকে আমরা ইতিপূর্বে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করতাম। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। বিশ্বের ১৯১ টি দেশ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে মর্যাদার সঙ্গে। এ এক গৌরবময় ইতিহাস। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ফোরাম ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে বিশ্বের প্রতিটি ভাষার জনগণকে সচেতন করে তোলার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যুগান্তকারী এ সিদ্ধান্তটি জানার পর কানাডীয় ১০ জনের মাতৃভাষাপ্রেমিক একটি গ্রুপ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রফিকুল ইসলাম নামের এক প্রবাসী বাঙালি তদানীন্তন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে প্রস্তাব প্রেরণ করেন। অতঃপর এ প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষে ইউনেসকোতে পাঠানো হয়। আমাদের সৌভাগ্য, তখন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে জাতিসংঘে ও প্যারিসে গিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিচক্ষণতায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব অর্জন করে। ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ খ্রি. ইউনেসকোর ৩১তম সম্মেলনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি ১৮৮ দেশের সমর্থনে পাশ হয়; এর মাধ্যমে ভাষার জন্য আত্মবিসর্জনের দৃষ্টান্ত স্হাপনের ইতিহাস আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাঙালির আত্মাহুতি মর্মান্তিক হলেও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করে জাতিকে মহিমান্বিত করেছে। শহিদদের প্রতি লাল সালাম।

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি— এই তিনটি শব্দের অর্থ এক নয়। এর প্রত্যেকটির রয়েছে আলাদা আলাদা অর্থ ও বৈশিষ্ট্য। আভিধানিকভাবে অর্থ ও বৈশিষ্টে্যর ভিন্নতা থাকলেও এর তাৎপর্য এক ও অভিন্ন। তিনটি শব্দের সঙ্গেই ‘মা, যুক্ত। মা যেমন তার সন্তানের কাছে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার পাত্র, তেমনি একটি জাতির কাছে তার ভাষা, দেশও শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার বস্ত্ত। নিজের ভাষা ও দেশকে নিজের মায়ের মতোই দেখা উচিত। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি শব্দ একই তাৎপর্যে অন্বিত।

যার গর্ভে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করি, যার দুগ্ধপান করে বেড়ে উঠি, তিনি মা। মায়ের মুখ থেকে যে ভাষার ব্যঞ্জনায় মঞ্জুরিত হয়ে উঠি, সেটি মাতৃভাষা, আর যে ভূখণ্ডে আমার জন্ম, সেই ভূখণ্ড একটি দেশ। সেই দেশের প্রকৃতি, সৌন্দর্যে জীবন অতিবাহিত করি, সেটি আমার মাতৃভূমি প্রিয় স্বদেশ। স্বদেশের ভাষা ও স্বদেশের মর্যাদা রক্ষা মানেই মায়ের মর্যাদা রক্ষা। মাতৃভাষার সম্মান এবং মাতৃভূমির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে প্রতিটি জাতিকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া মাতৃভূমি সমৃদ্ধ হয় না। মানুষ সাধারণত মাতৃভাষার মাধ্যমেই স্বাধীনভাবে মনের ভাব প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। জনগণের কথায় ‘ভাষা হচ্ছে চিন্তার পোশাক।’

জার্মান দার্শনিক ফিক্ট জাতি গঠনের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। মা, মাতৃভাষা নাড়ির টান ও সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমরা বাঙালি জাতি, বাঙালা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের অনেক সংগ্রাম ও রক্ত দিতে হয়েছে। তারই ফলে আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ লাভ করেছি।

অন্যান্য আন্তর্জাতিক দিবসের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

জাতিসংঘের ইউনেসকো কতৃ‌র্ক ঘোষিত আন্তর্জাতিক ‘নারীদিবস, ‘শিক্ষাদিবস, ‘স্বাস্হ্যদিবস, ‘মে দিবস, পালিত হয় দেশে দেশে। তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনন্য এক গৌরবময় মহান দিবস। মে দিবসের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। ১৮৮৬ সালের ১লা মে, আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিক শ্রেণি ন্যাঘ্য অধিকার আদায় করতে গিয়ে রক্ত দিয়েছিল। এর তিন বছর পর ১৮৮৯ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সভায় ঐ দিবসটিকে শ্রমিকদের স্মরণে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা লাভ করে। মেহনতি মানুষের বঞ্চনার কথা, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কাহিনি ব্যাপক প্রচার লাভ করে ১লা মে দিবস পালনের মাধ্যমে। তেমনি মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জনের বীরত্বগাথা সংগ্রামের ইতিহাস এ জাতিকে করেছে মহান। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে উচ্চতর মর্যাদার আসনে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ আরো সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হব। বাংলাদেশের জনগণকে জ্ঞানের সব স্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। একুশের চেতনাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি বাঙালিকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলা ভাষার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিশ্বপরিচয়ে বাঙালি হয়ে উঠবে অনন্য এক শক্তিশালী জাতি।