০৮:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

গবেষণা নিয়ে সাম্প্রতিক উপলব্ধি ও কিছু পরামর্শ

  • প্রকাশ: ০৬:০২:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
  • / ৩৩২৫ বার পড়া হয়েছে

বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার লক্ষ্য কী?

গবেষণা ছাড়া কোনো জাতি তার নিজ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারে না; উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। করোনা ভাইরাস মহামারির প্রাক্কালে তা পরিলক্ষিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অপেক্ষা বেশ কয়েক মাস পরে এই মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটলেও বাংলাদেশ গবেষণা বা পূর্ব পরিকল্পনার অভাবে কিংবা বলা যায়, মহামারির ব্যাপকতা অনুধাবনে ব্যর্থতার দরুন শুরু থেকেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে লকডাউন, টিকা ব্যবস্থাপনা, পরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে। বড় বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করা হয় না এখানে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফলাফল তাই কাঙ্ক্ষিত হয় না। তথাপি আমাদের বোধোদয় হয় না।

অথচ গবেষণা ছাড়া উন্নত দেশসমূহ না নিজেদের ইতিহাস জানে, না বর্তমান বা ভবিষ্যত্ নির্মাণ করে। বাংলাদেশে ইতিহাস, গবেষণা বা জ্ঞানান্বেষণ প্রসঙ্গে ডাচ ইতিহাসবিদ বাংলাদেশ গবেষক উইলেম ভ্যান শেন্ডেলের মূল্যায়ন যথার্থ। তিনি ‘ফ্রান্সিস বুকানন ইন সাউথইস্ট বেঙ্গল ১৭৯৮’ গ্রম্হে (১৯৯২) যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন যে, সমসাময়িক বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি জরুরি। তবে অনুন্নয়নের আরেকটি দিক, যা প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়, তা হলো, ‘জ্ঞানের অনুন্নয়ন’ (আন্ডার ডেভেলপমেন্ট অব নলেজ)। ‘ঐতিহাসিক জ্ঞানের (হিস্টোরিক্যাল নলেজ) ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে স্পষ্ট।’ ফলস্বরূপ, অনুন্নয়ন মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিগুলো গৃহীত হয় সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বোঝাবুঝির ওপর ভিত্তি করে। গবেষণা বা প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টির স্হলে প্রাধান্য পায় অনুমান। ভ্যান সেন্ডেলের মতে, এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গবেষণার অনুন্নয়নের ফল। দুঃখজনক হলেও, উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদগণও মনে করেন, ‘ঐতিহাসিক গবেষণা বিলাসিতা থেকে একটু বেশি’। অথচ উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, দেশকে জানতে হলে, দেশের ইতিহাস ও সমস্যাদি বুঝতে হলে এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐতিহাসিক জ্ঞান ও গবেষণা অনস্বীকার্য।

তথ্য বিন্যস্তকরণ ও নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য উপকরণ ও উত্সগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান ও অধ্যয়নই গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান সমস্যাদির প্রকৃতি ও গভীরতা জানা যায়, এবং একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য পম্হা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। সামাজিক সমস্যাদি বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক মেরামত করে, যা স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য তথা মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিধানে গবেষণা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। গবেষণার মাধ্যমে অতীত সর্বদা বর্তমান থাকে, ফলে কোনো জাতিকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় না। উন্নত দেশগুলোতে তাই অতীত নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক বা তথ্যবিভ্রাট নেই; যতটা বাংলাদেশের মতো অ-উন্নত দেশে দেখা যায়। তাছাড়া গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যের উপকারিতা ও সংকট, মানুষের আচরণ, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি দিক সম্পর্কে জানা যায়। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান, চিন্তা ও আবিষ্কার ঘটে থাকে; যার ফলে বর্তমান বিশ্বে চিকিত্স্যশাস্ত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে গবেষণার উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা আরো প্রকটভাবে উপলব্ধি হয়েছে। গবেষণার ফলে ভাইরাসের নানান প্রকরণ ও গতি-প্রকৃতি যেমন জানা গেছে, তেমনি ওষুধসহ টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। যদি গবেষণালব্ধ উপায়ে টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব না হতো, এই মহামারির পরিণতি লেখা বা পড়ার জন্য মানুষ জীবিত থাকত কি না, বলা মুশকিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশসহ সর্বত্র এখন গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েক বার গবেষণার ওপর মনোযোগ প্রদানের জন্য শিক্ষক, চিকিত্সকসহ সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানিয়েছেন।

সামাজিক গবেষণা ছাড়াও গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র হলো প্রাণী হিসেবে মানুষ ও প্রকৃতির সহসম্পর্ক স্থাপন, অনুধাবন ও প্রয়োজনে মেরামতকরণ। জৈবিক প্রাণী হিসেবে মানুষের কী করণীয়, কী খাওয়া উচিত, কী করা উচিত কিংবা কোনো রোগব্যাধি হলে উপশম কী এবং নিরাময় ও প্রতিরোধের উপায়ান্তর ইত্যাদির জন্য গবেষণার ওপর নির্ভর করতে হয়। যে দেশ যত বেশি গবেষণানির্ভর, সে দেশ তত বেশি অগ্রসরমান। যে দেশে যত বেশি গবেষণার জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়, সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। যেমন—যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশে পুনঃপুন গবেষণা ছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় না। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বাত্সরিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়, সে রকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থাকলেও বাংলাদেশ বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় না। শিক্ষার বাজেট জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, যেখানে ইউনেসকোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত। সুতরাং গবেষণার প্রণোদনা সহজেই অনুমেয়।

তবে বাংলাদেশের গবেষণার অন্যতম সমস্যা সঠিক বণ্টন ও যোগ্য ব্যক্তিকে গবেষণার সুযোগ প্রদান। আর্থিক বরাদ্দ যা-ই থাকুক না কেন, তার যথাযথ ব্যবহারই মূল চ্যালেঞ্জ। বরাদ্দকৃত অর্থ সত্যিকার অর্থে গবেষণা খাতে যথাযথভাবে ব্যয় হয় না, এমনকি অব্যয়িত থেকে যায়। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে গবেষণার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গবেষণার জন্য (সমন্বিত স্বাস্থ্যবিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল) ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বছর শেষে জানা যায়, গবেষণার জন্য একটি টাকাও ব্যয় করা হয়নি। যে সময়ে কিনা গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভূত, সেই সময়েও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং গবেষণার আবশ্যকতা উপলব্ধি করতে না পারার কারণে গবেষণা সম্পন্ন হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় সীমিত আর্থিক প্রণোদনা এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কারণে সঠিকভাবে তা পরিচালিত হয় না। সম্প্রতি ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি ১৫০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫ টি ২০২০ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। মাত্র ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বছর দুই-চারটি প্রকাশনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়নি (ইত্তেফাক, জানুয়ারি ৪, ২০২২)। তবে যাদের ভালো ভালো গবেষণা ও প্রকাশনা রয়েছে, তাদের মূল্যায়ন করার রীতি প্রচলিত নেই, যা গবেষণাকর্মকে উত্সাহিত করতে পারত।

বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো অধ্যাপক-গবেষক রয়েছেন, যারা আর্থিক প্রণোদনা, মূল্যায়ন ও নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বর্তমান প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ও ধারণার জন্ম হবে, সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গবেষণালব্ধ সমাধান আসবে; যে কোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কৌশল গ্রহণ করা হবে গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। কী বা কেমন পরিস্থিতি দেশ ও বিশ্ববাসীকে সামনে মোকাবিলা করতে হবে, সেটিও উদ্ঘাটিত হবে গবেষণার মাধ্যমে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে বাংলাদেশের মতো গবেষণাবিমুখ দেশের। পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তনশীল। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত শিক্ষা কয়েক বছর পর পর অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পুরোনো দক্ষতা বর্তমানের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় সমাজের সব খাতের সুষম ও সমন্বিত বিকাশের জন্য পুনঃপুন গবেষণা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে পরিকল্পনা বা গবেষণার স্বরূপ বোঝা যায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও পরিণতি দেখে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে একটি বিশালাকৃতির ফ্লাইওভার তৈরির কাজ চলেছে প্রায় বছরখানেক। এতে নগরবাসীর কী কষ্ট, সেটা ভাবার কারো ফুসরত নেই, সেটা মানতে নগরবাসী বাধ্য, যেহেতু বাংলাদেশের জন্য সেটা খুবই ‘মামুলি’ ব্যাপার। কিন্তু কিছুদিন পর কাজ চলাকালীন দেখা গেল, ফ্লাইওভারের পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে জিইসিতে কোনো পকেট ছিল না; পরে সেটা সংযোজন করা হয়েছে। জাতিকে গবেষণামুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি গবেষকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণার ফলাফলের জন্য যদি গবেষককে ভুগতে হয়, সচিবালয় কিংবা আদালতে যদি হাজিরা দিতে হয়, তাহলে গবেষকগণ নিরুত্সাহিত হবেন। গবেষণার গুণমান রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট গবেষককেও নির্মোহ, নির্দলীয় ও সৎ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

গবেষণা জ্ঞান তৈরি, সমস্যা অনুধাবন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ব্যবসার প্রসার, মানুষের চাহিদা ও আচরণ বোঝার জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা ও সঠিক-ভ্রান্ত ইতিহাস জানা যায়। এমনকি খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, প্রেম, ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়াদি সম্পর্কেও সঠিক ধারণা পাওয়ার প্রধানতম উপায় গবেষণা। তাই গবেষণায় উদাসীনতা মানে নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে অবহেলা করা। অনেক অবহেলা হয়েছে, আর নয়। এখন গবেষণানির্ভর সমাজ নির্মাণ সময়ের প্রয়োজন।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

গবেষণা নিয়ে সাম্প্রতিক উপলব্ধি ও কিছু পরামর্শ

প্রকাশ: ০৬:০২:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

গবেষণা ছাড়া কোনো জাতি তার নিজ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারে না; উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। করোনা ভাইরাস মহামারির প্রাক্কালে তা পরিলক্ষিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অপেক্ষা বেশ কয়েক মাস পরে এই মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটলেও বাংলাদেশ গবেষণা বা পূর্ব পরিকল্পনার অভাবে কিংবা বলা যায়, মহামারির ব্যাপকতা অনুধাবনে ব্যর্থতার দরুন শুরু থেকেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে লকডাউন, টিকা ব্যবস্থাপনা, পরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে। বড় বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করা হয় না এখানে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফলাফল তাই কাঙ্ক্ষিত হয় না। তথাপি আমাদের বোধোদয় হয় না।

অথচ গবেষণা ছাড়া উন্নত দেশসমূহ না নিজেদের ইতিহাস জানে, না বর্তমান বা ভবিষ্যত্ নির্মাণ করে। বাংলাদেশে ইতিহাস, গবেষণা বা জ্ঞানান্বেষণ প্রসঙ্গে ডাচ ইতিহাসবিদ বাংলাদেশ গবেষক উইলেম ভ্যান শেন্ডেলের মূল্যায়ন যথার্থ। তিনি ‘ফ্রান্সিস বুকানন ইন সাউথইস্ট বেঙ্গল ১৭৯৮’ গ্রম্হে (১৯৯২) যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন যে, সমসাময়িক বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি জরুরি। তবে অনুন্নয়নের আরেকটি দিক, যা প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়, তা হলো, ‘জ্ঞানের অনুন্নয়ন’ (আন্ডার ডেভেলপমেন্ট অব নলেজ)। ‘ঐতিহাসিক জ্ঞানের (হিস্টোরিক্যাল নলেজ) ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে স্পষ্ট।’ ফলস্বরূপ, অনুন্নয়ন মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিগুলো গৃহীত হয় সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বোঝাবুঝির ওপর ভিত্তি করে। গবেষণা বা প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টির স্হলে প্রাধান্য পায় অনুমান। ভ্যান সেন্ডেলের মতে, এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গবেষণার অনুন্নয়নের ফল। দুঃখজনক হলেও, উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদগণও মনে করেন, ‘ঐতিহাসিক গবেষণা বিলাসিতা থেকে একটু বেশি’। অথচ উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, দেশকে জানতে হলে, দেশের ইতিহাস ও সমস্যাদি বুঝতে হলে এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐতিহাসিক জ্ঞান ও গবেষণা অনস্বীকার্য।

তথ্য বিন্যস্তকরণ ও নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য উপকরণ ও উত্সগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান ও অধ্যয়নই গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান সমস্যাদির প্রকৃতি ও গভীরতা জানা যায়, এবং একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য পম্হা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। সামাজিক সমস্যাদি বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক মেরামত করে, যা স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য তথা মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিধানে গবেষণা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। গবেষণার মাধ্যমে অতীত সর্বদা বর্তমান থাকে, ফলে কোনো জাতিকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় না। উন্নত দেশগুলোতে তাই অতীত নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক বা তথ্যবিভ্রাট নেই; যতটা বাংলাদেশের মতো অ-উন্নত দেশে দেখা যায়। তাছাড়া গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যের উপকারিতা ও সংকট, মানুষের আচরণ, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি দিক সম্পর্কে জানা যায়। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান, চিন্তা ও আবিষ্কার ঘটে থাকে; যার ফলে বর্তমান বিশ্বে চিকিত্স্যশাস্ত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে গবেষণার উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা আরো প্রকটভাবে উপলব্ধি হয়েছে। গবেষণার ফলে ভাইরাসের নানান প্রকরণ ও গতি-প্রকৃতি যেমন জানা গেছে, তেমনি ওষুধসহ টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। যদি গবেষণালব্ধ উপায়ে টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব না হতো, এই মহামারির পরিণতি লেখা বা পড়ার জন্য মানুষ জীবিত থাকত কি না, বলা মুশকিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশসহ সর্বত্র এখন গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েক বার গবেষণার ওপর মনোযোগ প্রদানের জন্য শিক্ষক, চিকিত্সকসহ সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানিয়েছেন।

সামাজিক গবেষণা ছাড়াও গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র হলো প্রাণী হিসেবে মানুষ ও প্রকৃতির সহসম্পর্ক স্থাপন, অনুধাবন ও প্রয়োজনে মেরামতকরণ। জৈবিক প্রাণী হিসেবে মানুষের কী করণীয়, কী খাওয়া উচিত, কী করা উচিত কিংবা কোনো রোগব্যাধি হলে উপশম কী এবং নিরাময় ও প্রতিরোধের উপায়ান্তর ইত্যাদির জন্য গবেষণার ওপর নির্ভর করতে হয়। যে দেশ যত বেশি গবেষণানির্ভর, সে দেশ তত বেশি অগ্রসরমান। যে দেশে যত বেশি গবেষণার জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়, সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। যেমন—যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশে পুনঃপুন গবেষণা ছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় না। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বাত্সরিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়, সে রকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থাকলেও বাংলাদেশ বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় না। শিক্ষার বাজেট জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, যেখানে ইউনেসকোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত। সুতরাং গবেষণার প্রণোদনা সহজেই অনুমেয়।

তবে বাংলাদেশের গবেষণার অন্যতম সমস্যা সঠিক বণ্টন ও যোগ্য ব্যক্তিকে গবেষণার সুযোগ প্রদান। আর্থিক বরাদ্দ যা-ই থাকুক না কেন, তার যথাযথ ব্যবহারই মূল চ্যালেঞ্জ। বরাদ্দকৃত অর্থ সত্যিকার অর্থে গবেষণা খাতে যথাযথভাবে ব্যয় হয় না, এমনকি অব্যয়িত থেকে যায়। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে গবেষণার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গবেষণার জন্য (সমন্বিত স্বাস্থ্যবিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল) ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বছর শেষে জানা যায়, গবেষণার জন্য একটি টাকাও ব্যয় করা হয়নি। যে সময়ে কিনা গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভূত, সেই সময়েও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং গবেষণার আবশ্যকতা উপলব্ধি করতে না পারার কারণে গবেষণা সম্পন্ন হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় সীমিত আর্থিক প্রণোদনা এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কারণে সঠিকভাবে তা পরিচালিত হয় না। সম্প্রতি ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি ১৫০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫ টি ২০২০ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। মাত্র ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বছর দুই-চারটি প্রকাশনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়নি (ইত্তেফাক, জানুয়ারি ৪, ২০২২)। তবে যাদের ভালো ভালো গবেষণা ও প্রকাশনা রয়েছে, তাদের মূল্যায়ন করার রীতি প্রচলিত নেই, যা গবেষণাকর্মকে উত্সাহিত করতে পারত।

বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো অধ্যাপক-গবেষক রয়েছেন, যারা আর্থিক প্রণোদনা, মূল্যায়ন ও নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বর্তমান প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ও ধারণার জন্ম হবে, সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গবেষণালব্ধ সমাধান আসবে; যে কোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কৌশল গ্রহণ করা হবে গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। কী বা কেমন পরিস্থিতি দেশ ও বিশ্ববাসীকে সামনে মোকাবিলা করতে হবে, সেটিও উদ্ঘাটিত হবে গবেষণার মাধ্যমে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে বাংলাদেশের মতো গবেষণাবিমুখ দেশের। পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তনশীল। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত শিক্ষা কয়েক বছর পর পর অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পুরোনো দক্ষতা বর্তমানের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় সমাজের সব খাতের সুষম ও সমন্বিত বিকাশের জন্য পুনঃপুন গবেষণা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে পরিকল্পনা বা গবেষণার স্বরূপ বোঝা যায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও পরিণতি দেখে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে একটি বিশালাকৃতির ফ্লাইওভার তৈরির কাজ চলেছে প্রায় বছরখানেক। এতে নগরবাসীর কী কষ্ট, সেটা ভাবার কারো ফুসরত নেই, সেটা মানতে নগরবাসী বাধ্য, যেহেতু বাংলাদেশের জন্য সেটা খুবই ‘মামুলি’ ব্যাপার। কিন্তু কিছুদিন পর কাজ চলাকালীন দেখা গেল, ফ্লাইওভারের পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে জিইসিতে কোনো পকেট ছিল না; পরে সেটা সংযোজন করা হয়েছে। জাতিকে গবেষণামুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি গবেষকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণার ফলাফলের জন্য যদি গবেষককে ভুগতে হয়, সচিবালয় কিংবা আদালতে যদি হাজিরা দিতে হয়, তাহলে গবেষকগণ নিরুত্সাহিত হবেন। গবেষণার গুণমান রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট গবেষককেও নির্মোহ, নির্দলীয় ও সৎ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

গবেষণা জ্ঞান তৈরি, সমস্যা অনুধাবন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ব্যবসার প্রসার, মানুষের চাহিদা ও আচরণ বোঝার জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা ও সঠিক-ভ্রান্ত ইতিহাস জানা যায়। এমনকি খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, প্রেম, ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়াদি সম্পর্কেও সঠিক ধারণা পাওয়ার প্রধানতম উপায় গবেষণা। তাই গবেষণায় উদাসীনতা মানে নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে অবহেলা করা। অনেক অবহেলা হয়েছে, আর নয়। এখন গবেষণানির্ভর সমাজ নির্মাণ সময়ের প্রয়োজন।