শুক্রবার, জুন ৯, ২০২৩

সামাজিক স্তরবিন্যাস কী? সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরন কী কী?

“সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো সমাজে বসবাসকারী মানুষদেরকে স্থায়িভাবে দল অনুযায়ী বিন্যাস করা এবং তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও আনুগত্যের সম্পর্ক বজায় রাখা।”

সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আমরা দেখতে পাই প্রত্যেকেই একে অন্যের থেকে আলাদা। বয়স, লিঙ্গ, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মত হয় না। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্বের ভিত্তিতেআমরা সহজেই একজন থেকে অন্যজনকে পৃথক করে ফেলি। এ বিবেচনা অনুসারে আমরা কাউকে দক্ষ, কাউকে অদক্ষ, ভালো-মন্দ ইত্যাদি নানা ভাগে ভাগ করে থাকি। এ ধরনের শ্রেণিকরণকে সামাজিক বিভাজন বলা হয়। সমাজে আরেক ধরনের সামাজিক শ্রেণিকরণ আমাদের চোখে পড়ে— সেটি পদমর্যাদার ভিত্তিতে। ব্যক্তির এই পদমর্যাদার মূলে তাঁর আর্থিক সক্ষমতা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, জন্মসূত্রে পাওয়া পরিচিতি ও সম্মান ইত্যাদি অনেক কিছু। যেভাবেই এ পদমর্যাদা তৈরি হোক না কেন— এর ভিত্তিতে সমাজের মানুষকে আমরা স্তরে স্তরে ভাগ করে ফেলি এবং তার সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করি। 

সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা

সামাজিক বৈচিত্র্য, বিভাজন ও স্তরবিন্যাস অনেকটা প্রকৃতির নিয়মের মতোই সত্য। শারীরিক সৌন্দর্য্য, অবয়ব, বুদ্ধিমত্তা, নৈতিকতার ধারণা, দর্শন, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা, ধর্মীয় অনুরাগ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি বিচারে মানুষ একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে সৃষ্ট পদমর্যাদার নিরিখে আমরা সমাজের মানুষকে স্তরে স্তরে বিন্যাস করা হয় একেই সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে।

অগর্বান ও নিমকফ বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ কিংবা দলকে স্থায়ী বা অস্থায়িভাবে একেক পদমর্যাদার অধিকারী বলে বিন্যস্ত করা হয় তাকে স্তরবিন্যাস বলে।”

জিসবার্ট (Gisbert) বলেছেন, “সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো সমাজে বসবাসকারী মানুষদেরকে স্থায়িভাবে দল অনুযায়ী বিন্যাস করা এবং তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও আনুগত্যের সম্পর্ক বজায় রাখা।”

জিসবার্ট তাঁর ‘Fundamental of Sociology” গ্রন্থে বলেছেন, “সমাজকে একটি স্থায়ী দল বা প্রকরণে বিভক্ত করাই হচ্ছে সামাজিক স্তরবিন্যাস, যেখানে একে অন্যের সাথে উচ্চক্রম এবং নিম্নক্রমের ভিত্তিতে সম্পর্কিত। সামাজিক স্তরবিন্যাসের আলোকে সমাজে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত ছাড়াও শাসক, শোষিত, মালিকগশ্রমিক, ধনী-দরিদ্র শ্রেণি পরিলক্ষিত হয়।”

অর্থাৎ সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ সূচক অনুসারে সমাজের মানুষকে মর্যাদার ভিত্তিতে বিভক্ত করা। এই স্তরবিন্যাস সমাজ দীর্ঘ সময় ধরে ধারণ করে এবং মেনে চলে।

স্তরবিন্যাসের ধরন

স্তরবিন্যাসের চারটি ধরন এখানে আলোচনা করা হলো। যথা— দাস প্রথা, সামন্ত প্রথা, সামাজিক শ্রেণি এবং বর্ণ প্রথা।

দাস প্রথা

দাস প্রথা হল সমাজের অসমতার এক চরম নিদর্শন। মানব ইতিহাসের যে পর্যায়ে দাস প্রথার প্রচলন হয়েছিল সেখানে দাস নামে আখ্যায়িত এক শ্রেণির মানুষকে দাস মালিকেরা নিজেদের কাজে নির্বিচারে ব্যবহার করত। কোনো কোনো আইনে (যেমন হাম্মুরাবি প্রণীত আইন) দাস ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং দাসকে কেউ পালাতে সাহায্য করলে বা পলাতক দাসকে কেউ আশ্রয় দিলে তাকে শাস্তি পেতে হতো। দাসদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না, দাস মালিকদের ইচ্ছানুসারেই শ্রম দিতে হতো। দাস ছিল দাস মালিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অনেকটা হালের লাঙল, বলদ ইত্যাদির মতো। দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। সমাজের স্বাধীন মানুষ অপেক্ষা দাসের মর্যাদা অনেক নিচে ছিল।

অন্যান্য পণ্যের ন্যায় খোলাবাজারে দাস কেনাবেচা হতো এবং অনেক ক্ষেত্রে দাস মালিক কোনো কোনো দাসকে আজীবনের জন্য কিনে নিত। আদিম সমাজে দাসের কয়েকটা উৎস ছিল-কেউ যুদ্ধবন্দী হয়ে, কেউ ঋণগ্রস্থ হয়ে দাসে পরিণত হতো। কেউ বা বংশানুক্রমে দাসত্ব করতো।

সামন্ত প্রথা

ইউরোপের সামন্ত সমাজে এ প্রথা প্রধানত প্রচলিত ছিল বলা হলেও এর ব্যাপ্তি পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্ত প্রথার আংশিক প্রমাণ মেলে। এ ব্যবস্থা মূলত সম্রাটের ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। সম্রাট তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা সমস্ত ভূমিকে সামন্ত রাজাদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। এর মাধ্যমে সামন্ত রাজারা সম্রাটের সাথে এক ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতেন। এ চুক্তি অনুসারে নিজ সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য বা অন্য সাম্রাজ্য দখলের প্রয়োজনে সম্রাটের পরামর্শ বা সৈন্যসামন্তের প্রয়োজন হলে সামন্তরাজারা তা প্রদান করে সম্রাটকে সাহায্য করতেন। সামন্ত রাজারা তাঁদের জমি অভিজাত শ্রেণিকে আর অভিজাত শ্রেণি নাইটদেরকে, নাইটরা (যোদ্ধা শ্রেণি) কৃষককে খাজনার বিনিময়ে ভূমি জায়গীর হিসেবে প্রদান করতেন। এভাবেই সামন্ত সমাজে ভূমিভিত্তিক স্তরবিন্যাসের প্রচলন ছিল।

বর্ণপ্রথা

বর্ণভিত্তিক স্তরায়ন মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত। কোনো আর্থিক সচ্ছলতা বা মালিকানার ভিত্তিতে নয় বরং এ প্রথানুসারে মানুষের জন্মগ্রহণই তার পদমর্যাদা নির্ধারণ করে দেয়। এ প্রথার প্রচলন ও রীতিনীতিকে আইনসিদ্ধ করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ প্রথা অনুসারে মানুষ যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করবে সে পরিবারের মান ও সামাজিক মর্যাদা অনুসারে নবজাতকের মর্যাদা নির্ধারিত হয়ে থাকে। বর্ণপ্রথার বিভিন্ন ধরন দেখা যায়। যেমন: প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র— এই চার ধরনের বর্ণ দেখা যায়। এ বিভাজন জন্মসূত্রে। হিন্দু শাস্ত্রে গুণ ও কর্ম অনুসারে বিভাজনের কথা বলা হলেও প্রাচীন কাল থেকে জন্মসূত্রে এ বিভাজন চলে আসছে। পশ্চিমা সমাজে গায়ের বর্ণের ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস দেখা যায়। এ স্তরবিন্যাসও জন্মসূত্রে। জন্মসূত্রে ব্যক্তি যে সামাজিক মর্যাদা পেয়ে থাকে সে সারাজীবন সে মর্যাদা ভোগ করে। বর্ণপ্রথা অনুসারে সামাজিক গতিশীলতার প্রায় কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে।

সামাজিক শ্রেণি

শ্রেণি প্রত্যয়টি মূলত আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে জড়িত। মূলত অর্থ সম্পদ, পেশা, শিক্ষার ভিত্তিতে এ বিভাজন করা হয়ে থাকে। এ সকল বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটা শ্রেণি সহজেই অন্য শ্রেণির থেকে আলাদা হয়ে থাকে। 

সম্পদের মালিকানা বা আর্থিক সচ্ছলতার ভিত্তিতে সমাজের আলাদা আলাদা গোষ্ঠীগুলোতে শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করার এ প্রথা শুরু হয়েছে শিল্প বিপ্লবের পরপরই। শিল্প সমাজের বিকাশের সাথে সাথে মানুষের আর্থিক সম্পদের বৃদ্ধির ফলে সমাজে ধনী, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ইত্যাদি শ্রেণির বিকাশ হতে থাকে।

অগবার্ন ও নিমকফের মতে, সামাজিক শ্রেণি হল সমাজে বসবাসকারী এমন এক ধরনের মানুষের সমাহার যাদের প্রায় একই ধরনের আর্থিক সম্পদ থাকার কারণে একই ধরনের সমাজিক মর্যাদা রয়েছে। মার্কসীয় সংজ্ঞা অনুসারে শ্রেণি হল এমন এক গোষ্ঠী যাদের উৎপাদনের উপাদানের সাথে একই ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সমাজে উৎপাদনের বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেটাই মুখ্য বিষয়। উৎপাদনের উপায়সমূহ যার বা যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে তার একটা শ্রেণি (পুঁজিপতি) আর যাদের হাতে সে নিয়ন্ত্রণ থাকে না তারা অন্য শ্রেণি, যেমন-সর্বহারা, শ্রমিক শ্রেণি।

উপসংহার

বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে যথা সম্পদ, পেশা, শিক্ষা, বর্ণ, জাতি, নরগোষ্ঠী, জেন্ডার ইত্যাদির নিরিখে আমরা সমাজের মানুষকে স্তরে স্তরে বিন্যাস করি যাকে। সামাজিক স্তর বিন্যাস বলে। যদিও বলা হয় সকল সমাজেই স্তরবিন্যাস বর্তমান এবং এটি সার্বজনীন প্রক্রিয়া। মানব সমাজে মূলত চার ধরনের স্তরবিন্যাস লক্ষণীয়, এগুলো হলো- দাস প্রথা, সামন্ত প্রথা, সামাজিক শ্রেণি এবং বর্ণ প্রথা।

(সংকলিত)

For all latest articles, follow on Google News

বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে 'বিশ্লেষণ'-এর জন্য স্পনসরশিপ খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইমেইল: contact.bishleshon@gmail.com

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ
আরও পড়তে পারেন

4 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here