বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৫, ২০২৩

হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বড়ো পদক্ষেপ

হার্ট প্রতিস্থাপনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ডা. ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২২ সালের ৮ নভেম্বর এবং মৃত্যুবরণ করেন ২০০১ সালের ২ সেপ্টেম্বর।

For all latest articles, follow on Google News

সর্বপ্রথম হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট বা হৃৎযন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। সেই দিন বাইরে বেশ ঠান্ডা। অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে কিন্তু সেটা বোঝার উপায় নেই। একটা নির্দিষ্ট টেম্পারেচার কৃত্রিম উপায়ে বজায় রাখা হয়েছে ওটির ভেতর। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের নামকরা হাসপাতাল গ্রুট স্কুর (Groote Schuur)। সেখানে সেদিন ইতিহাস তৈরি করার মতো একটি অপারেশন হচ্ছে। অপারেশন করছেন দক্ষিণ দেশের নামকরা সার্জন ডা. ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড (Christiaan Neethling Barnard)। যে সে অপারেশন নয়, একেবারে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট। কিন্তু মনিটরের দিকে তাকিয়ে সবার হাত-পা ঠান্ডা। ডা. ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নতুন করে বসানো হার্টটার কোনও স্পন্দন নেই। প্রায় পাঁচঘন্টা ধরে চলা অপারেশনটা কি তাহলে বিফল হলো?

ড. ক্রিশ্চিয়ান বার্নাডের তত্ত্বাবধানে সেদিন রোগী ছিলেন চুয়ান্ন বছর বয়সি লুই ওয়াসকানস্কি নামের এক নারী। বেচারির হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। যে-কোনো মুহূর্তে হার্ট ফেইলিয়র হবে। হার্ট প্রতিস্থাপন জনিত সমস্ত রকম জটিলতা তাকে জানিয়ে রাখা আছে। সবকিছুর জন্য মনে মনে প্রস্তুত লুই ওয়াসকানস্কি। পৃথিবীতে এর আগে কোনো সফল হার্ট প্রতিস্থাপন হয়নি। তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে এক চব্বিশ বছর বয়সি তরতাজা যুবতীর হার্ট সে পাচ্ছে। যুবতীটি আগেই তার দেহদানের অঙ্গীকার করে রেখেছে। মৃত্যুর পর যেন তার দেহের যন্ত্রাংশ অন্যের অথবা চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাজে লাগে।  মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। ডা. ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের টিম খুব দ্রুত মৃতদেহ থেকে হৃদপিণ্ড বের করে নিয়েছে। হার্ট জোড়া লাগানোর সময়টারও চাই নিখুঁত টাইমিং। সে কাজটাও বার্নার্ড সাহেবের সারা। কিন্তু হার্টবিট কই? 

ডাক্তার বার্নার্ড চেঁচিয়ে ওঠেন ‘ডি-ফিব্রিলেটর লাগাও’। মুহূর্তে হার্টে শক দেবার ব্যবস্থা হয়। লুইয়ের পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। পুরো অপারেশন থিয়েটার ভর্তি ডাক্তার, নার্স, ওটিবয় আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। অপারেশন সাকসেসফুল। লুইয়ের হৃৎস্পন্দনের ওয়েভগুলো মনিটরে আঁকিবুঁকি কাটতে শুরু করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছিল লুই ওয়াসকানস্কির শরীরে; বলাই বাহুল্য যে, প্রথম হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হৃতপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেন দক্ষিণ আফ্রিকার চিকিৎসক ডা. ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড।

অবশ্য লুই ওয়াসকানস্কি তারপর মাত্র ঊনিশদিন বেঁচেছিল। অর্গান রিজেকশন আটকাতে তাকে অনেক ইমিউনোসাপ্রেসান্ট দেওয়া হয়েছিল। ফলে তার দেহের আভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। ফলে ইতিহাসে যার শরীরে প্রথম হৃদয় প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল সে রোগী লুই ওয়াসকানস্কি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিললেন।

বেশ দু-একটা ডাক্তারি কঠিন কথা লেখা হয়ে গেল। আমাদের শরীরের ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। জীবাণুর যে প্রোটিন সেটাকে চিনে নিয়ে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। অ্যান্টিবডি সেই শত্রু প্রোটিনকে আক্রমণ করে। এখন এটাকেই মোটামুটি ইমিউনিটি বলা যায়। শরীরে যদি অন্যের দেহাংশ বসানো হয় তাহলে ইমিউনিটি সেই দেহাংশকে শত্রু প্রোটিন ভেবে তাকে ধ্বংস করে ফেলবে। হয়ে যাবে ‘অর্গান রিজেকশন’।

সুতরাং অন্যের দেহাংশ বসাতে গেলে রোগীর ইমিউনিটি কমিয়ে নিতে হবে। ইমিউনিটি কমিয়ে আনার জন্য ব্যবহার করা হয় ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ। আরো কয়েকটি জিনিস দেখে নেওয়া হয়। রক্তের গ্রুপ এবং অন্যান্য কিছু জিনিস দাতা ও গ্রহীতার একই রকম হওয়া বাঞ্ছনীয়।

প্রথম ব্যাপারটা নজরে আসে, যখন ১৮৯০-এর দশকে সফলভাবে চামড়া প্রতিস্থাপনের কাজ করা হয়। সেটা একই মানুষের এক অংশের চামড়া তুলে অন্য অংশে লাগানো হয়। ১৮৯৪ সালে অগ্ন্যাশয় প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। সেটা করা হয় ইমিউনিটির নিয়ম না মেনেই। যথারীতি অর্গান রিজেকশন হয় সেই অপারেশনে। আরো একটা ব্যাপার অর্গান প্রতিস্থাপনের সময় মাথার রাখতে হয় সেটা হল শিরা ধমনীগুলো ঠিকঠাক ভাবে জোড়া লাগানো। সঠিকভাবে শিরা সেলাই করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ফরাসি সার্জন আলেক্সিস ক্যারেল ১৯০১ থেকে ১৯১০-এর মধ্যে।

কুকুরের ওপর প্রথম দেহাংশ প্রতিস্থাপনের কাজ করা হয়। কিডনি প্রতিস্থাপনের বেশকিছু পর শুরু হয় হার্ট নিয়ে কাজ। প্রথমবার কুকুরের সফল হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করেন নরমান লুমওয়ে ও রিচার্ড লোয়ার আমেরিকার স্ট্যানফোর্ডে, ১৯৫৯ সালে। তারা কুকুরের হৃদপিণ্ডটি বসানোর আগে একেবারে ঠান্ডা করে নিয়েছিলেন, যাতে কোনো টিস্যু না নষ্ট হয়।

মানুষের ওপর প্রথম সফল অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয় ১৯৫৪ সালে। দুই যমজ ভাইয়ের একজনের কিডনি নিয়ে অন্যের দেহে বসানো হয়। ন’বছর সুস্থ ভাবে বেঁচেছিল গ্রহীতা ভাইটি। সেই সময়টায় ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো খুব হাই ডোজে এক্সরে দেওয়া। প্রথম ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ড্রাগ আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৯ সালে। আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ চিকিৎসক রয় ক্যালনে। এরপরে হার্ট-লাঙস মেশিন আবিষ্কার হতে আরও কিছুটা সহজ হয়ে আসে হার্ট প্রতিস্থাপনের অপারেশন।

প্রথম হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের রোগী ঊনিশদিনের মাথায় মারা গেলেও বার্নার্ড দমে যাননি। ১৯৬৮ সালে ফিলিপ ব্লাইবার্গের ওপর দ্বিতীয় হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করেন। ফিলিপ বেঁচেছিল ৫৯৪ দিন। অন্যান্য দেশেও শুরু হয়ে গেল হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশন। ১৯৭১-এর মধ্যে ১৮০টা হার্ট প্রতিস্থাপন হয় সারাবিশ্বে।

১৯৭৬ সালে বেলজিয়ান ইমিউনলজিস্ট জে এফ বোরেল সাইক্লোস্পোরিন আবিষ্কার করেন। এই ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের সাইড এফেক্ট অনেক কম।

এখন ‘হৃদয় দেওয়া নেওয়া’ অনেক সহজ হয়ে গেছে। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশন হয়। ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের রোগী এখন দশ-বছরের ওপর বাঁচে। জন ম্যাকক্যাফার্টি তো হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের পরে তেত্রিশ বছর বেঁচেছিলেন। ২০১৬ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান।

হার্ট প্রতিস্থাপনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ডা. ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২২ সালের ৮ নভেম্বর এবং মৃত্যুবরণ করেন ২০০১ সালের ২ সেপ্টেম্বর।

অনির্বাণ জানা
অনির্বাণ জানা
ভারতীয় চিকিৎসক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ