০২:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

সমাজকল্যাণ কাকে বলে? সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের ধারণা, বৈশিষ্ট্য, সম্পর্ক ও পার্থক্য কী?

ড. এ. এস. এম. আতীকুর রহমান
  • প্রকাশ: ১১:৫০:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১
  • / ১৪০৬৮ বার পড়া হয়েছে

সমাজকল্যাণ একটি ব্যাপক ধারণা

সমাজকল্যাণ সৃষ্টি হয়েছে সে দিন যেদিন সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ যখন সংঘপবব্ধ হয়ে বসবাস শুরু করল সেদিন সমজাকল্যাণের জন্ম হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত আসতে এর বিভিন্ন রকম পরিবর্তন,  সংযোজন, বিয়োজন বা গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে এসেছে। এখানে সমাজকল্যানের সংজ্ঞা, সনাতন সমাজকল্যাণ, আধুনিক সমাজকল্যাণ এবং উভয় প্রকারের সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্য, সম্পর্ক ও পার্থক্য আলোচনা করা হলো।

সমাজকল্যাণের সংজ্ঞা

সমাজ সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই সমাজকল্যাণ মূলক তৎপরতা চালু রয়েছে। সমাজকল্যাণের ইতিহাস মানব ইতিহাসের মতই প্রাচীন। সমাজ বা জনসমষ্টির সার্বিক মঙ্গল সাধনই হলো সমাজকল্যাণ। সমাজকল্যাণ এমন কিছু সামাজিক প্রচেষ্টা, ব্যবস্থা, পদ্ধতি বা সংগঠিত কার্যাবলীর সমষ্টি যার মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ বিধান হয়। আবার সমাজকল্যাণ বলতেসুসংঘবদ্ধ সামাজিক প্রচেষ্টার চূড়ান্ত লক্ষ্যকেও বুঝানো হয়।

সমাজকর্ম অভিধানে বরার্ট এল বার্ক তাঁর সমাজকল্যাণের সংজ্ঞায় বলেছেন যে, “মানুষের অপরিহার্য সামাজিক, অর্থনৈতিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রচলিত কর্মসূচি,সুযোগ ও সেবা জাতীয় ব্যবস্থা।”

আবার ওয়াল্টার এ ফ্রিডল্যান্ডার উল্লেখ করেছেন যে, “সমাজকল্যাণ হলো সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের এমন এক সুসংগঠিত ব্যবস্থা যা ব্যক্তি ও দলকে সন্তোষজনক জীবনমান ও স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিকসম্পর্ক লাভে সহায়তা করে যা তাদের ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশে এবং তাদের পরিবার ও জনসমষ্টির চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উন্নতি বিধানে সহায়তা করে।”

এক কথায়, সমাজকল্যাণ হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত ঐ সকল প্রচেষ্টা বা উদ্যোগযার মাধ্যমে মানুষ ব্যক্তিগত, দলীয়, পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে সাচ্ছন্দময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করে।

সনাতন সমাজকল্যাণ কী?

সামাজিক জীবনের প্রারম্ভে মানুষের জীবন ধারা ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল। পশু শিকার ও ফলমুল সংগ্রহ থেকে মানুষ ক্রমশঃ কৃষি কাজ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি শুরু করে এবং সমাজের আদি প্রাতিষ্ঠান পরিবারের উদ্ভব হয়। প্রাচীনকালে মানুষের চাহিদা ছিল সীমিত এবং সমস্যাও ছিল মুলতঃ বস্তুগত অর্থনির্ভর। কিন্তু কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। জন্ম নেয় দুঃস্থতা ও রোগ-শোক, অসহায়ত্ব, অস্থিরতা, দরিদ্রতা ইত্যাদি। তখন এসব সমস্যা সমাধানে ধনীরা মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন এবং বদান্যতা নির্ভর সমাজ সেবা মুলক কাজ শুরু করেন। এতে ধর্মীয় মুল্যবোধ ও অনুপ্রেরণা যোগায়। ফলে মানুষ ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির আশায়, দুস্থ, দরিদ্র, অসহায়, অসুস্থ, অক্ষম, বিধবা, প্রবীণ, শিশু ইত্যাদি শ্রেণির লোকদের সাহায্যর্থে এগিয়ে আসে। 

প্রাক-শিল্প যুগের সমাজকল্যাণ মূলক প্রচেষ্টাই সনাতন সমাজকল্যাণ নামে পরিচিত। প্রাচীন কালে মানবতাবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন, নীতি ও মূল্যবোধে অনুপ্রানিত হয়ে দুঃস্থ, অসহায়, অভাব-অনটনগ্রস্থ ও আর্ত-মানবতার সেবায় নিয়োজিত অসংগঠিত, অপরিকল্পিত ও বিচ্ছিন্ন কল্যাণমুলক প্রচেষ্টাকে সনাতন সমাজকল্যাণ বলে। সনাতন সমাজকল্যাণ বস্তুগত সাহায্য দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধানে তৎপর ছিল না। শুধু বস্তুগত সাহায্যের দ্বারা সমস্যার সামগ্রিক সমাধান দেয়া হত। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সনাতন সমাজকল্যাণ কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করত। সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলো হলো যেমন- দানশীলতা, যাকাত, এতিমখানা, ওয়াকফ, দেবোত্তর, লঙ্গরখানা, সরাইখানা, ধর্মগোলা, সদ্কা, বায়তুলমাল ইত্যাদি।

সনাতন সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্য কী?

প্রাক-শিল্প যুগে সমাজকল্যাণ বলতে সনাতন সমাজকল্যাণকেই বুঝানো হতো। নিম্নে সনাতন সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা হলো:

১. অসংগঠিত সেবা প্রক্রিয়া: সনাতন সমাজকল্যাণ একটি অংশগঠিত সেবাদান প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত এ কার্যক্রমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠির ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলিত হয়। 

২. বস্তুগত সাহায্য: সনাতন সমাজকল্যাণ বস্তুগত সাহায্য নির্ভর। অর্থনির্ভর সমস্যা সমাধানে এটি পরিচালিত হয়। যেমন- ভিক্ষাদান, খাদ্যদান ইত্যাদি। মানবিক ও সামাজিক সমস্যাসমূহ এখানে উপেক্ষিত। 

৩. অবৈজ্ঞানিক: সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে পরিকল্পনামাফিক এটি পরিচালিত হয় না। এতে সমস্যার যথোপযুক্ত কার্যকারণ ও সমাজের প্রকৃত চাহিদা নির্ণীত হয় না। 

৪. সাময়িক ও তাৎক্ষণিক: সনাতন সমাজকল্যাণ সাময়িক ও তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান পদ্ধতি। যেমন- বস্ত্রহীনে বস্ত্র দান, কন্যাদায়গ্রস্থকে সাহায্য ইত্যাদি। এটি স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয় না। 

৫. করুণা নির্ভর: এটি দাতার করুণার উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি প্রচেষ্টায় এটি গৃহীত ও পরিচালিত হওয়ায় ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের সুযোগ এখানে থাকে। যেমন- দান-খয়রাত। অনুভূত চাহিদা এখানে গুরুত্বহীন। 

৬. সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব: এতে মানব জীবনের সামগ্রিক দিকের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে কেবল অর্থনৈতিক দিকের প্রতি জোর দেওয়া হয়। সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, আত্মিক প্রভৃতি দিকগুলো এখানে উপেক্ষিত থাকে। 

৭. নির্ভরশীলতা: সনাতন সমাজকল্যাণের উপর সাহায্যপ্রার্থী নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার কোন প্রচেষ্টা এখানে নেই। যেমন- ভিক্ষুক। 

৮. আত্মনিয়ন্ত্রনহীন: এটি সাহায্য প্রার্থীর কোন মতামত, সিদ্ধান্ত বা নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয় না। এটি সম্পূর্ণরূপে দাতার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। দাতা যত ইচ্ছা, যা ইচ্ছা তাই-ই সাহায্য করতে পারে। 

৯. মর্যাদা হানীকর: সাহায্য গ্রহণ গ্রহীতার জন্য মারাত্মক মর্যাদা হানীকর। এখানে ব্যক্তির মুল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া হয় না। উপরন্তু মানুষের অসহায়ত্ব, দারিদ্র্য বা দুঃখ-দূর্দশাকে তাদের পাপের ফল বলে মনে করা হয়। 

১০. অপরিবর্তনীয় কর্মসূচী: চিরাচরিতভাবে একই ধরনের কর্মসূচি এখানে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে কোন পরিবর্তন, গতিশীলতা বা বৈচিত্র নেই। 

১১. অপেশাদার: প্রাক-শিল্পযুগে সমাজকর্মে পেশাগত শিক্ষার উদ্ভব না হওয়ায় অপেশাদার সমাজকর্মীদের দ্বারা কর্মসূচি পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হয়। 

১২. সমন্বয়হীন: সনাতন সমাজকল্যাণের মধ্যে সমন্বয়ে ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় না। 

১৩. উপশমধর্মী: এটি প্রতিকারমূলক কর্মসূচি। সমস্যা সমাধানে প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। 

১৪. বিশেষ নীতিমালা, মুল্যবোধ ও পদ্ধতির অনুপস্থিতি: এটি পেশাগত নীতিমালা, মুল্যবোধ ও পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া নয়। এটি সাধারণ, মানবিকতাবোধ ও ধর্মীয় মুল্যবোধ আশ্রিত। 

সনাতন সমাজকল্যাণের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমুহ আধুনিক সমাজকল্যাণের দৃষ্টিতে ক্রটিপূর্ণ। তবে দুস্থ, অসহায়, দরিদ্র শ্রেণি তথা আর্তমানবতার সেবায় আধুনিক সমাজকল্যাণের পাশাপাশি এটি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

আধুনিক সমাজকল্যাণের ধারণা 

আধুনিক সমাজকল্যানের উদ্ভব হয় শিল্প বিপ্লবের পর। ‘শিল্প বিপ্লব’ শক্তি, শিল্প, উৎপাদন, যাতায়াত, যোগাযোগ সহ মানুষের ধ্যান-ধারনা, চিন্তা-ভাবনা, মুল্যবোধ-দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সহ সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা করে। শিল্প-পূর্ব সমাজে সমস্যা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান নিতান্তই সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ সমস্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাধারণত একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ফলে সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও একমুখী প্রচেষ্টা অনুসরণ করা হতো। 

শিল্প বিপ্লবের পর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হলেও সমাজ সমস্যামুক্ত হয়নি। বরং আগের সমস্যার সাথে বিশেষ ধরনের বহু নতুন সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। ফলে সমস্যা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় এবং সমাজবিজ্ঞানীরা উপলদ্ধি করেন যে, ‘বহুমুখী কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়’ ফলে সমাধানের জন্যও বহুমুখী প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুভূত হয়। শিল্প বিপ্লবের পর ‘সমস্যা’ এবং ‘সমাধান প্রচেষ্টা’ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তায় যে ‘মৌলিক ও বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন’ সূচিত হয় তাই সমাজকর্ম প্রচেষ্টার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচনা করে। শিল্প পরবর্তী সমাজের জটিল পরিস্থিতিতে সমাজকল্যাণমুলক কাজের জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সমাজকর্মীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে ‘পেশাগত সমাজকর্মের’ ভিত্তি স্থাপন করা হয়। 

পরবর্তীতে বাস্তব পরিস্থিতিতে কল্যাণমুলক কাজের অনুশীলনের প্রেক্ষাপটে সমাজকল্যাণের জ্ঞানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংযোজন করে একে আধুনিক সমাজকল্যাণ রূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।অনুশীলনের মাধ্যমে বিকাশ সাধন করা হয়েছে বলে আধুনিক সমাজকল্যাণকে বলা হয় অনুশীলনের বিজ্ঞান। আধুনিক সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার বা পদ্ধতি হচ্ছে পেশাদার সমাজকর্ম। আধুনিক সমাজকল্যাণ বিজ্ঞান নয় তবে এর জ্ঞান বিজ্ঞানভিত্তিক। এজন্যই বলা হয়- ‘আধুনিক সমাজকল্যাণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানর উপর ভিত্তিশীল একটি ফলিত কলা’। বর্তমানে আধুনিক সমাজকল্যাণ হচ্ছে সমাজ সেবা ও প্রতিষ্ঠানের সুসংগঠিত পদ্ধতি যা মানুষের প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তাদের সার্বিক কল্যাণ সাধনের প্রচেষ্টা চালায়।

আধুনিক সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্য কী?

আধুনিক সমাজকল্যাণ একটি বৈজ্ঞানিক ও সুসংগঠিত সাহায্য পদ্ধতি। এর সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে নিম্নের বৈশিষ্ট্য সমূহ পরিলক্ষিত হয়। 

১. সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের সুসংগঠিত পদ্ধতি: আধুনিক সমাজকল্যাণ সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের একটি সুসংগঠিত পদ্ধতি হিসেবে সুপরিকল্পিত ভাবে জনগণের সার্বিক কল্যাণে সাহায্য করে থাকে। 

২. সকলের জন্য কল্যাণ: সমাজকল্যাণ শুধু কোন বিশেষ শ্রেণির মানুষের কল্যাণ সাধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল মত নির্বিশেষে সমাজে বসবাসকারী আপামর মানুষের কল্যাণে সংকল্পবদ্ধ। 

৩. সার্বিক কল্যাণ: সমাজকল্যাণ মানবজীবনের কোন নির্দিষ্ট দিক বা বিভাগের কল্যাণে ব্রতী না হয়ে মানুষের ব্যক্তিগত, দৈহিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, পারিপার্শ্বকি, ধর্মীয়ও নৈতিক ইত্যাদি সার্বিক দিকের কল্যাণ সাধনে প্রচেষ্টা চালায়। 

৪. মানবজীবনের প্রতি অবিভাজ্য দৃষ্টিভঙ্গি: সমাজকল্যাণ ব্যক্তি, পরিবার, দল, সমষ্টি ও সামাজিক পরিবেশকে আলাদাভাবে বিচার না করে মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে। 

৫. সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন: সমাজকল্যাণ সমাজের প্রতিটি মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী করে তুলতে সাহায্য করে। 

৬. সমস্যার স্থায়ী সমাধান: সমাজকল্যাণ সমাজকর্মের বিভিন্ন পদ্ধতি, নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করে ব্যক্তির নিজস্ব গুণগত ও বস্তুগত সম্পদ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করে। 

৭. সম্পদের সদ্ব্যবহার: সমাজকল্যাণ সম্পদের অপচয় রোধ এবং সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে। 

৮. পরিকল্পিত পরিবর্তন: সমাজকল্যাণ বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজের কাংখিত পরিবর্তন আনয়ন করে। 

৯. প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমুলক সমাজকল্যাণ: সমাজের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য সকল কর্মসূচীতে প্রতিকার প্রতিরোধ ও উন্নয়নমুলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। 

১০. বৈজ্ঞানিক সমাধান প্রক্রিয়া: সমাজকল্যাণ সকল সমস্যা সমাধানের জন্যে বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকে। 

১১. জনগণের মাধ্যমে কাজ করা: আধুনিক সমাজকল্যাণ জনগণের জন্য কাজ করে না জনগনের দ্বারা জনগণের কাজ করে। 

১২. পদ্ধতিগত সমাধান: সমাজকল্যাণ মৌলিক ও সাহায্যকারী পদ্ধতির মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কাজ করে। পদ্ধতিগুলো হলো যেমন- ব্যক্তি, দল, সমষ্টিকেন্দ্রিক সমাজকর্ম, সমাজকর্ম গবেষণা, সামাজিক কার্যক্রম ও সমাজকল্যাণ প্রশাসন। 

১৩. সমস্যা সমাধানে জনগণের অংশগ্রহণ: জনগনই সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নের মুল হাতিয়ার। তাই তাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। 

১৪. গতিশীল ভূমিকা: সমাজ পরিবর্তণশীল। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সামাজিক সমস্যার ও পরিবর্তন ঘটে। সমস্যা সমাধানে পরিবর্তনশীল তথা গতিশীল পদক্ষেপ ও গ্রহণ করা হয়। 

১৫. পেশাগত রূপ: সমাজকর্ম বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল একটি পেশা। 

১৬. সমন্বয়ধর্মী সমাজবিজ্ঞান: সমাজকল্যাণ, বিভিন্ন বিজ্ঞান যেমন- অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নীতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, দর্শন, লোকপ্রশাসন, নৃ-তত্ত্ব ইত্যাদি বিজ্ঞান থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে উঠেছে। 

১৭. বিশেষ নীতিমালা ও মুল্যবোধ: সমাজকল্যাণ একটি পেশা। অন্যান্য পেশার ন্যায় এর রয়েছে বিশেষ নীতিমালা, মুল্যবোধ ও কৌশল।

১৮. বাস্তবমুখী কর্মসূচী: সমাজকল্যাণ নিজস্ব সম্পদ ও অনুভূত চাহিদার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবমুখী কর্মসূচী প্রণয়ন করে থাকে। 

আধুনিক সমাজকল্যাণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সমাজের আপামর মানুষকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের মধ্যকার সম্পর্ক কী?

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ উভয়েরই উদ্দেশ্য হচ্ছে আর্ত-মানবতার সেবা করা। এ দুটো ধারণা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উভয়ের মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি সম্পর্ক ও বিদ্যমান, নিম্নে পারস্পরিক সম্পর্ক দেখানো হল। 

১. অভিন্ন লক্ষ্য: উভয় সমাজকল্যাণের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ সমস্যা কবলিত মানুষের দুঃখ দুর্দশা দুর করা। 

২. মানবতাবোধ: উভয় সমাজকল্যাণেই মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ মাুনষের সেবাকর্মে নিয়োজিত। 

৩. ধর্মীয় দর্শন, নীতি ও মুল্যবোধের প্রভাব: উভয় সমাজকল্যাণই ধর্মীয় দর্শন, মুল্যবোধ ও নীতিমালার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। 

৪. পাশাপাশি অবস্থান: সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ পাশাপাশি অবস্থান করে মানুষের কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত। 

৫. মৌলিক মানিবক চাহিদা পূরণ: উভয় সমাজকল্যাণ মানুষের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে। 

৬. সামাজিক দায়িত্ববোধ: সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ মানুষের পারস্পরিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে। 

৭. নিঃস্বার্থ মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি: সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ স্বার্থের বশবর্তী হয়ে কোন কাজ করে না। আপামর 

জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণই উভয়ের লক্ষ্য। 

৮. ত্রান ও সাহায্য কর্মসূচী: প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খড়া, ভূমিকম্প, টর্নেডো, জলোচ্ছাস, মহামারী ইত্যাদি পরিস্থিতিতে উভয় সমাজকল্যাণই ত্রান ও সাহায্য কর্মসূচী পরিচালনা করে।

৯. সার্বজনীন কল্যাণ: সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সেবায় নিয়োজিত। 

১০. সার্বিক কল্যাণ: উভয় সমাজকল্যাণ মানুষের ব্যক্তিগত, দৈহিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক ইত্যাদি সকল দিক বা বিভাগের কল্যাণে প্রচেষ্টা চালায়। 

১১. পরস্পর পরিপূরক: সনাতন সমাজকল্যাণ ও আধুনিক সমাজকল্যাণ সমাজ সেবার অনেক ক্ষেত্রে একই জাতীয় সেবা 

কাজ করে পারস্পরিক পরিপূরক ভূমিকা পালন করে।

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের মধ্যকার পার্থক্য কী?

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের মধ্যে যেমন- সাদৃশ্য বা সম্পর্ক রয়েছে তেমনি উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য ও রয়েছে।

সনাতন সমাজকল্যাণআধুনিক সমাজকল্যাণ
১. প্রাক-শিল্পযুগে মানবতাবোধ, ধর্মীয় দর্শনে প্রভাবিত বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত প্রথা প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতিই সনাতন সমাজকল্যাণ নামে পরিচিত। ১. আধুনিক সমাজকল্যাণ হলো শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের একটি সুসংগঠিত প্রচেষ্টা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও পদ্ধতি নির্ভর এক ব্যবস্থা যা সমস্যা গ্রস্থ মানুষকে নিজস্ব সম্পদ, সামর্থ ও সুযোগ সুবিধার সদ্ধ্যহরের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের সমস্যা মোকাবেলা করে সাবলম্বী হতে পারে। 
২. সনাতন সমাজকল্যাণ বয়সে মানব সমাজের মতই প্রাচীন।২. আধুনিক সমাজকল্যাণ বয়সে নবীন। 
৩. সনাতন সমাজকল্যাণে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।৩. আধুনিক সমাজকল্যাণ বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। 
৪. সনাতন সমাজকল্যাণ সমস্যার স্থায়ী ও কার্যকর সমাধান দিতে অক্ষম। ৪. আধুনিক সমাজকল্যাণ সমস্যার স্থায়ী ও কার্যকরী সমাধান দিতে সক্ষম। 
৫. সনাতন সমাজকল্যাণ সাময়িক অর্থনির্ভর একটি সাহায্য প্রক্রিয়া যা মানুষেকে পরনির্ভরশীল ও পরমুখাপেক্ষী করে তোলে। ৫. আধুনিক সমাজকল্যাণ স্বাবলম্বন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। 
৬. সনাতন সমাজকল্যাণের মুল ভিত্তি হলো ধর্মীয় মুল্যবোধ। ৬. আধুনিক সমাজকল্যাণের মুল ভিত্তি হলো সামাজিক দায়িত্ববোধ।
৭. সনাতন সমাজকল্যাণে মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ নেই। ৭. আধুনিক সমাজকল্যাণে মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ আছে। 
৮. সনাতন সমাজকল্যাণ বস্তুগত সাহায্য দানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ৮. আধুনিক সমাজকল্যাণ অবস্তুগত অর্থাৎ প্রতিকার প্রতিরোধ ও উন্নয়ন মুলক ব্যবস্থা গ্রহণে গুরুত্ব দেয়। 
৯. সনাতন সমাজকল্যাণ ধর্মীয় প্রথা প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়। ৯. আধুনিক সমাজকল্যাণ বিভিন্ন পেশাগত প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়। 
১০. সনাতন সমাজকল্যাণে দাতা ও গ্রহীতার অপেশাগত সম্পর্ক থাকে। ১০. আধুনিক সমাজকল্যাণে সাহায্য প্রার্থীর সাথে সমাজকর্মীর পেশাগত সম্পর্ক থাকে। 
১১. সনাতন সমাজকল্যাণে পেশাগত নীতি ও মুল্যবোধ অনুসরণ করা হয় না। ১১. আধুনিক সমাজকল্যাণে পেশাগত নীতি ও মুল্যবোধ অনুসরণ করা হয়। 
১২. সনাতন সমাজকল্যাণ অপেশাদার সমাজকর্মী দ্বারা পরিচালিত হয়। ১২. আধুনিক সমাজকল্যাণ পেশাদার সমাজকর্মী দ্বারা পরিচালিত হয়। 
১৩. সনাতন সমাজকল্যাণ জনগণের অংশগ্রহণের উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করে না। ১৩. আধুনিক সমাজকল্যাণ জনগণের অংশগ্রহণের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। 
১৪. সনাতন সমাজকল্যাণ স্বাবলম্বণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।১৪. আধুনিক সমাজকল্যাণ স্বাবলম্বন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। 
১৫. সনাতন সমাজকল্যাণের পরিধি ব্যাপক নয়। ১৫. আধুনিক সমাজকল্যানের পরিধি ব্যাপক।

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ উভয়েই অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে। উভয়েই মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের সেবা করে। ধর্মীয় দর্শন, নীতি ও মুল্যবোধ উভয় সমাজকল্যানকে প্রভাবিত করে। উভয়ে পাশাপাশি থেকে সমাজ সেবায় নিয়োজিত থাকে। মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ উভয় সমাজকল্যাণেরই মুল লক্ষ্য। উভয় সমাজকল্যাণই সমাজের সম্পদের সদ্ব্যব্যবহার করে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে আপামর মানুষের সার্বিক দিকের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে বিশ্বাসী।

[বিশ্লেষণ সংকলন টিম কর্তৃক সম্পাদিত]

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

সমাজকল্যাণ কাকে বলে? সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের ধারণা, বৈশিষ্ট্য, সম্পর্ক ও পার্থক্য কী?

প্রকাশ: ১১:৫০:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১

সমাজকল্যাণ সৃষ্টি হয়েছে সে দিন যেদিন সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ যখন সংঘপবব্ধ হয়ে বসবাস শুরু করল সেদিন সমজাকল্যাণের জন্ম হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত আসতে এর বিভিন্ন রকম পরিবর্তন,  সংযোজন, বিয়োজন বা গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে এসেছে। এখানে সমাজকল্যানের সংজ্ঞা, সনাতন সমাজকল্যাণ, আধুনিক সমাজকল্যাণ এবং উভয় প্রকারের সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্য, সম্পর্ক ও পার্থক্য আলোচনা করা হলো।

সমাজকল্যাণের সংজ্ঞা

সমাজ সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই সমাজকল্যাণ মূলক তৎপরতা চালু রয়েছে। সমাজকল্যাণের ইতিহাস মানব ইতিহাসের মতই প্রাচীন। সমাজ বা জনসমষ্টির সার্বিক মঙ্গল সাধনই হলো সমাজকল্যাণ। সমাজকল্যাণ এমন কিছু সামাজিক প্রচেষ্টা, ব্যবস্থা, পদ্ধতি বা সংগঠিত কার্যাবলীর সমষ্টি যার মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ বিধান হয়। আবার সমাজকল্যাণ বলতেসুসংঘবদ্ধ সামাজিক প্রচেষ্টার চূড়ান্ত লক্ষ্যকেও বুঝানো হয়।

সমাজকর্ম অভিধানে বরার্ট এল বার্ক তাঁর সমাজকল্যাণের সংজ্ঞায় বলেছেন যে, “মানুষের অপরিহার্য সামাজিক, অর্থনৈতিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রচলিত কর্মসূচি,সুযোগ ও সেবা জাতীয় ব্যবস্থা।”

আবার ওয়াল্টার এ ফ্রিডল্যান্ডার উল্লেখ করেছেন যে, “সমাজকল্যাণ হলো সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের এমন এক সুসংগঠিত ব্যবস্থা যা ব্যক্তি ও দলকে সন্তোষজনক জীবনমান ও স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিকসম্পর্ক লাভে সহায়তা করে যা তাদের ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশে এবং তাদের পরিবার ও জনসমষ্টির চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উন্নতি বিধানে সহায়তা করে।”

এক কথায়, সমাজকল্যাণ হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত ঐ সকল প্রচেষ্টা বা উদ্যোগযার মাধ্যমে মানুষ ব্যক্তিগত, দলীয়, পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে সাচ্ছন্দময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করে।

সনাতন সমাজকল্যাণ কী?

সামাজিক জীবনের প্রারম্ভে মানুষের জীবন ধারা ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল। পশু শিকার ও ফলমুল সংগ্রহ থেকে মানুষ ক্রমশঃ কৃষি কাজ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি শুরু করে এবং সমাজের আদি প্রাতিষ্ঠান পরিবারের উদ্ভব হয়। প্রাচীনকালে মানুষের চাহিদা ছিল সীমিত এবং সমস্যাও ছিল মুলতঃ বস্তুগত অর্থনির্ভর। কিন্তু কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। জন্ম নেয় দুঃস্থতা ও রোগ-শোক, অসহায়ত্ব, অস্থিরতা, দরিদ্রতা ইত্যাদি। তখন এসব সমস্যা সমাধানে ধনীরা মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন এবং বদান্যতা নির্ভর সমাজ সেবা মুলক কাজ শুরু করেন। এতে ধর্মীয় মুল্যবোধ ও অনুপ্রেরণা যোগায়। ফলে মানুষ ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির আশায়, দুস্থ, দরিদ্র, অসহায়, অসুস্থ, অক্ষম, বিধবা, প্রবীণ, শিশু ইত্যাদি শ্রেণির লোকদের সাহায্যর্থে এগিয়ে আসে। 

প্রাক-শিল্প যুগের সমাজকল্যাণ মূলক প্রচেষ্টাই সনাতন সমাজকল্যাণ নামে পরিচিত। প্রাচীন কালে মানবতাবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন, নীতি ও মূল্যবোধে অনুপ্রানিত হয়ে দুঃস্থ, অসহায়, অভাব-অনটনগ্রস্থ ও আর্ত-মানবতার সেবায় নিয়োজিত অসংগঠিত, অপরিকল্পিত ও বিচ্ছিন্ন কল্যাণমুলক প্রচেষ্টাকে সনাতন সমাজকল্যাণ বলে। সনাতন সমাজকল্যাণ বস্তুগত সাহায্য দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধানে তৎপর ছিল না। শুধু বস্তুগত সাহায্যের দ্বারা সমস্যার সামগ্রিক সমাধান দেয়া হত। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সনাতন সমাজকল্যাণ কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করত। সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলো হলো যেমন- দানশীলতা, যাকাত, এতিমখানা, ওয়াকফ, দেবোত্তর, লঙ্গরখানা, সরাইখানা, ধর্মগোলা, সদ্কা, বায়তুলমাল ইত্যাদি।

সনাতন সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্য কী?

প্রাক-শিল্প যুগে সমাজকল্যাণ বলতে সনাতন সমাজকল্যাণকেই বুঝানো হতো। নিম্নে সনাতন সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা হলো:

১. অসংগঠিত সেবা প্রক্রিয়া: সনাতন সমাজকল্যাণ একটি অংশগঠিত সেবাদান প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত এ কার্যক্রমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠির ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলিত হয়। 

২. বস্তুগত সাহায্য: সনাতন সমাজকল্যাণ বস্তুগত সাহায্য নির্ভর। অর্থনির্ভর সমস্যা সমাধানে এটি পরিচালিত হয়। যেমন- ভিক্ষাদান, খাদ্যদান ইত্যাদি। মানবিক ও সামাজিক সমস্যাসমূহ এখানে উপেক্ষিত। 

৩. অবৈজ্ঞানিক: সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে পরিকল্পনামাফিক এটি পরিচালিত হয় না। এতে সমস্যার যথোপযুক্ত কার্যকারণ ও সমাজের প্রকৃত চাহিদা নির্ণীত হয় না। 

৪. সাময়িক ও তাৎক্ষণিক: সনাতন সমাজকল্যাণ সাময়িক ও তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান পদ্ধতি। যেমন- বস্ত্রহীনে বস্ত্র দান, কন্যাদায়গ্রস্থকে সাহায্য ইত্যাদি। এটি স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয় না। 

৫. করুণা নির্ভর: এটি দাতার করুণার উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি প্রচেষ্টায় এটি গৃহীত ও পরিচালিত হওয়ায় ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের সুযোগ এখানে থাকে। যেমন- দান-খয়রাত। অনুভূত চাহিদা এখানে গুরুত্বহীন। 

৬. সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব: এতে মানব জীবনের সামগ্রিক দিকের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে কেবল অর্থনৈতিক দিকের প্রতি জোর দেওয়া হয়। সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, আত্মিক প্রভৃতি দিকগুলো এখানে উপেক্ষিত থাকে। 

৭. নির্ভরশীলতা: সনাতন সমাজকল্যাণের উপর সাহায্যপ্রার্থী নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার কোন প্রচেষ্টা এখানে নেই। যেমন- ভিক্ষুক। 

৮. আত্মনিয়ন্ত্রনহীন: এটি সাহায্য প্রার্থীর কোন মতামত, সিদ্ধান্ত বা নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয় না। এটি সম্পূর্ণরূপে দাতার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। দাতা যত ইচ্ছা, যা ইচ্ছা তাই-ই সাহায্য করতে পারে। 

৯. মর্যাদা হানীকর: সাহায্য গ্রহণ গ্রহীতার জন্য মারাত্মক মর্যাদা হানীকর। এখানে ব্যক্তির মুল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া হয় না। উপরন্তু মানুষের অসহায়ত্ব, দারিদ্র্য বা দুঃখ-দূর্দশাকে তাদের পাপের ফল বলে মনে করা হয়। 

১০. অপরিবর্তনীয় কর্মসূচী: চিরাচরিতভাবে একই ধরনের কর্মসূচি এখানে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে কোন পরিবর্তন, গতিশীলতা বা বৈচিত্র নেই। 

১১. অপেশাদার: প্রাক-শিল্পযুগে সমাজকর্মে পেশাগত শিক্ষার উদ্ভব না হওয়ায় অপেশাদার সমাজকর্মীদের দ্বারা কর্মসূচি পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হয়। 

১২. সমন্বয়হীন: সনাতন সমাজকল্যাণের মধ্যে সমন্বয়ে ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় না। 

১৩. উপশমধর্মী: এটি প্রতিকারমূলক কর্মসূচি। সমস্যা সমাধানে প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। 

১৪. বিশেষ নীতিমালা, মুল্যবোধ ও পদ্ধতির অনুপস্থিতি: এটি পেশাগত নীতিমালা, মুল্যবোধ ও পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া নয়। এটি সাধারণ, মানবিকতাবোধ ও ধর্মীয় মুল্যবোধ আশ্রিত। 

সনাতন সমাজকল্যাণের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমুহ আধুনিক সমাজকল্যাণের দৃষ্টিতে ক্রটিপূর্ণ। তবে দুস্থ, অসহায়, দরিদ্র শ্রেণি তথা আর্তমানবতার সেবায় আধুনিক সমাজকল্যাণের পাশাপাশি এটি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

আধুনিক সমাজকল্যাণের ধারণা 

আধুনিক সমাজকল্যানের উদ্ভব হয় শিল্প বিপ্লবের পর। ‘শিল্প বিপ্লব’ শক্তি, শিল্প, উৎপাদন, যাতায়াত, যোগাযোগ সহ মানুষের ধ্যান-ধারনা, চিন্তা-ভাবনা, মুল্যবোধ-দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সহ সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা করে। শিল্প-পূর্ব সমাজে সমস্যা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান নিতান্তই সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ সমস্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাধারণত একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ফলে সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও একমুখী প্রচেষ্টা অনুসরণ করা হতো। 

শিল্প বিপ্লবের পর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হলেও সমাজ সমস্যামুক্ত হয়নি। বরং আগের সমস্যার সাথে বিশেষ ধরনের বহু নতুন সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। ফলে সমস্যা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় এবং সমাজবিজ্ঞানীরা উপলদ্ধি করেন যে, ‘বহুমুখী কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়’ ফলে সমাধানের জন্যও বহুমুখী প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুভূত হয়। শিল্প বিপ্লবের পর ‘সমস্যা’ এবং ‘সমাধান প্রচেষ্টা’ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তায় যে ‘মৌলিক ও বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন’ সূচিত হয় তাই সমাজকর্ম প্রচেষ্টার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচনা করে। শিল্প পরবর্তী সমাজের জটিল পরিস্থিতিতে সমাজকল্যাণমুলক কাজের জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সমাজকর্মীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে ‘পেশাগত সমাজকর্মের’ ভিত্তি স্থাপন করা হয়। 

পরবর্তীতে বাস্তব পরিস্থিতিতে কল্যাণমুলক কাজের অনুশীলনের প্রেক্ষাপটে সমাজকল্যাণের জ্ঞানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংযোজন করে একে আধুনিক সমাজকল্যাণ রূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।অনুশীলনের মাধ্যমে বিকাশ সাধন করা হয়েছে বলে আধুনিক সমাজকল্যাণকে বলা হয় অনুশীলনের বিজ্ঞান। আধুনিক সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার বা পদ্ধতি হচ্ছে পেশাদার সমাজকর্ম। আধুনিক সমাজকল্যাণ বিজ্ঞান নয় তবে এর জ্ঞান বিজ্ঞানভিত্তিক। এজন্যই বলা হয়- ‘আধুনিক সমাজকল্যাণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানর উপর ভিত্তিশীল একটি ফলিত কলা’। বর্তমানে আধুনিক সমাজকল্যাণ হচ্ছে সমাজ সেবা ও প্রতিষ্ঠানের সুসংগঠিত পদ্ধতি যা মানুষের প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তাদের সার্বিক কল্যাণ সাধনের প্রচেষ্টা চালায়।

আধুনিক সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্য কী?

আধুনিক সমাজকল্যাণ একটি বৈজ্ঞানিক ও সুসংগঠিত সাহায্য পদ্ধতি। এর সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে নিম্নের বৈশিষ্ট্য সমূহ পরিলক্ষিত হয়। 

১. সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের সুসংগঠিত পদ্ধতি: আধুনিক সমাজকল্যাণ সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের একটি সুসংগঠিত পদ্ধতি হিসেবে সুপরিকল্পিত ভাবে জনগণের সার্বিক কল্যাণে সাহায্য করে থাকে। 

২. সকলের জন্য কল্যাণ: সমাজকল্যাণ শুধু কোন বিশেষ শ্রেণির মানুষের কল্যাণ সাধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল মত নির্বিশেষে সমাজে বসবাসকারী আপামর মানুষের কল্যাণে সংকল্পবদ্ধ। 

৩. সার্বিক কল্যাণ: সমাজকল্যাণ মানবজীবনের কোন নির্দিষ্ট দিক বা বিভাগের কল্যাণে ব্রতী না হয়ে মানুষের ব্যক্তিগত, দৈহিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, পারিপার্শ্বকি, ধর্মীয়ও নৈতিক ইত্যাদি সার্বিক দিকের কল্যাণ সাধনে প্রচেষ্টা চালায়। 

৪. মানবজীবনের প্রতি অবিভাজ্য দৃষ্টিভঙ্গি: সমাজকল্যাণ ব্যক্তি, পরিবার, দল, সমষ্টি ও সামাজিক পরিবেশকে আলাদাভাবে বিচার না করে মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে। 

৫. সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন: সমাজকল্যাণ সমাজের প্রতিটি মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী করে তুলতে সাহায্য করে। 

৬. সমস্যার স্থায়ী সমাধান: সমাজকল্যাণ সমাজকর্মের বিভিন্ন পদ্ধতি, নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করে ব্যক্তির নিজস্ব গুণগত ও বস্তুগত সম্পদ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করে। 

৭. সম্পদের সদ্ব্যবহার: সমাজকল্যাণ সম্পদের অপচয় রোধ এবং সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে। 

৮. পরিকল্পিত পরিবর্তন: সমাজকল্যাণ বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজের কাংখিত পরিবর্তন আনয়ন করে। 

৯. প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমুলক সমাজকল্যাণ: সমাজের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য সকল কর্মসূচীতে প্রতিকার প্রতিরোধ ও উন্নয়নমুলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। 

১০. বৈজ্ঞানিক সমাধান প্রক্রিয়া: সমাজকল্যাণ সকল সমস্যা সমাধানের জন্যে বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকে। 

১১. জনগণের মাধ্যমে কাজ করা: আধুনিক সমাজকল্যাণ জনগণের জন্য কাজ করে না জনগনের দ্বারা জনগণের কাজ করে। 

১২. পদ্ধতিগত সমাধান: সমাজকল্যাণ মৌলিক ও সাহায্যকারী পদ্ধতির মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কাজ করে। পদ্ধতিগুলো হলো যেমন- ব্যক্তি, দল, সমষ্টিকেন্দ্রিক সমাজকর্ম, সমাজকর্ম গবেষণা, সামাজিক কার্যক্রম ও সমাজকল্যাণ প্রশাসন। 

১৩. সমস্যা সমাধানে জনগণের অংশগ্রহণ: জনগনই সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নের মুল হাতিয়ার। তাই তাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। 

১৪. গতিশীল ভূমিকা: সমাজ পরিবর্তণশীল। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সামাজিক সমস্যার ও পরিবর্তন ঘটে। সমস্যা সমাধানে পরিবর্তনশীল তথা গতিশীল পদক্ষেপ ও গ্রহণ করা হয়। 

১৫. পেশাগত রূপ: সমাজকর্ম বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল একটি পেশা। 

১৬. সমন্বয়ধর্মী সমাজবিজ্ঞান: সমাজকল্যাণ, বিভিন্ন বিজ্ঞান যেমন- অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নীতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, দর্শন, লোকপ্রশাসন, নৃ-তত্ত্ব ইত্যাদি বিজ্ঞান থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে উঠেছে। 

১৭. বিশেষ নীতিমালা ও মুল্যবোধ: সমাজকল্যাণ একটি পেশা। অন্যান্য পেশার ন্যায় এর রয়েছে বিশেষ নীতিমালা, মুল্যবোধ ও কৌশল।

১৮. বাস্তবমুখী কর্মসূচী: সমাজকল্যাণ নিজস্ব সম্পদ ও অনুভূত চাহিদার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবমুখী কর্মসূচী প্রণয়ন করে থাকে। 

আধুনিক সমাজকল্যাণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সমাজের আপামর মানুষকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের মধ্যকার সম্পর্ক কী?

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ উভয়েরই উদ্দেশ্য হচ্ছে আর্ত-মানবতার সেবা করা। এ দুটো ধারণা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উভয়ের মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি সম্পর্ক ও বিদ্যমান, নিম্নে পারস্পরিক সম্পর্ক দেখানো হল। 

১. অভিন্ন লক্ষ্য: উভয় সমাজকল্যাণের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ সমস্যা কবলিত মানুষের দুঃখ দুর্দশা দুর করা। 

২. মানবতাবোধ: উভয় সমাজকল্যাণেই মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ মাুনষের সেবাকর্মে নিয়োজিত। 

৩. ধর্মীয় দর্শন, নীতি ও মুল্যবোধের প্রভাব: উভয় সমাজকল্যাণই ধর্মীয় দর্শন, মুল্যবোধ ও নীতিমালার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। 

৪. পাশাপাশি অবস্থান: সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ পাশাপাশি অবস্থান করে মানুষের কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত। 

৫. মৌলিক মানিবক চাহিদা পূরণ: উভয় সমাজকল্যাণ মানুষের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে। 

৬. সামাজিক দায়িত্ববোধ: সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ মানুষের পারস্পরিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে। 

৭. নিঃস্বার্থ মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি: সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ স্বার্থের বশবর্তী হয়ে কোন কাজ করে না। আপামর 

জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণই উভয়ের লক্ষ্য। 

৮. ত্রান ও সাহায্য কর্মসূচী: প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খড়া, ভূমিকম্প, টর্নেডো, জলোচ্ছাস, মহামারী ইত্যাদি পরিস্থিতিতে উভয় সমাজকল্যাণই ত্রান ও সাহায্য কর্মসূচী পরিচালনা করে।

৯. সার্বজনীন কল্যাণ: সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সেবায় নিয়োজিত। 

১০. সার্বিক কল্যাণ: উভয় সমাজকল্যাণ মানুষের ব্যক্তিগত, দৈহিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক ইত্যাদি সকল দিক বা বিভাগের কল্যাণে প্রচেষ্টা চালায়। 

১১. পরস্পর পরিপূরক: সনাতন সমাজকল্যাণ ও আধুনিক সমাজকল্যাণ সমাজ সেবার অনেক ক্ষেত্রে একই জাতীয় সেবা 

কাজ করে পারস্পরিক পরিপূরক ভূমিকা পালন করে।

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের মধ্যকার পার্থক্য কী?

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের মধ্যে যেমন- সাদৃশ্য বা সম্পর্ক রয়েছে তেমনি উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য ও রয়েছে।

সনাতন সমাজকল্যাণআধুনিক সমাজকল্যাণ
১. প্রাক-শিল্পযুগে মানবতাবোধ, ধর্মীয় দর্শনে প্রভাবিত বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত প্রথা প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতিই সনাতন সমাজকল্যাণ নামে পরিচিত। ১. আধুনিক সমাজকল্যাণ হলো শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের একটি সুসংগঠিত প্রচেষ্টা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও পদ্ধতি নির্ভর এক ব্যবস্থা যা সমস্যা গ্রস্থ মানুষকে নিজস্ব সম্পদ, সামর্থ ও সুযোগ সুবিধার সদ্ধ্যহরের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের সমস্যা মোকাবেলা করে সাবলম্বী হতে পারে। 
২. সনাতন সমাজকল্যাণ বয়সে মানব সমাজের মতই প্রাচীন।২. আধুনিক সমাজকল্যাণ বয়সে নবীন। 
৩. সনাতন সমাজকল্যাণে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।৩. আধুনিক সমাজকল্যাণ বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। 
৪. সনাতন সমাজকল্যাণ সমস্যার স্থায়ী ও কার্যকর সমাধান দিতে অক্ষম। ৪. আধুনিক সমাজকল্যাণ সমস্যার স্থায়ী ও কার্যকরী সমাধান দিতে সক্ষম। 
৫. সনাতন সমাজকল্যাণ সাময়িক অর্থনির্ভর একটি সাহায্য প্রক্রিয়া যা মানুষেকে পরনির্ভরশীল ও পরমুখাপেক্ষী করে তোলে। ৫. আধুনিক সমাজকল্যাণ স্বাবলম্বন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। 
৬. সনাতন সমাজকল্যাণের মুল ভিত্তি হলো ধর্মীয় মুল্যবোধ। ৬. আধুনিক সমাজকল্যাণের মুল ভিত্তি হলো সামাজিক দায়িত্ববোধ।
৭. সনাতন সমাজকল্যাণে মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ নেই। ৭. আধুনিক সমাজকল্যাণে মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ আছে। 
৮. সনাতন সমাজকল্যাণ বস্তুগত সাহায্য দানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ৮. আধুনিক সমাজকল্যাণ অবস্তুগত অর্থাৎ প্রতিকার প্রতিরোধ ও উন্নয়ন মুলক ব্যবস্থা গ্রহণে গুরুত্ব দেয়। 
৯. সনাতন সমাজকল্যাণ ধর্মীয় প্রথা প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়। ৯. আধুনিক সমাজকল্যাণ বিভিন্ন পেশাগত প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়। 
১০. সনাতন সমাজকল্যাণে দাতা ও গ্রহীতার অপেশাগত সম্পর্ক থাকে। ১০. আধুনিক সমাজকল্যাণে সাহায্য প্রার্থীর সাথে সমাজকর্মীর পেশাগত সম্পর্ক থাকে। 
১১. সনাতন সমাজকল্যাণে পেশাগত নীতি ও মুল্যবোধ অনুসরণ করা হয় না। ১১. আধুনিক সমাজকল্যাণে পেশাগত নীতি ও মুল্যবোধ অনুসরণ করা হয়। 
১২. সনাতন সমাজকল্যাণ অপেশাদার সমাজকর্মী দ্বারা পরিচালিত হয়। ১২. আধুনিক সমাজকল্যাণ পেশাদার সমাজকর্মী দ্বারা পরিচালিত হয়। 
১৩. সনাতন সমাজকল্যাণ জনগণের অংশগ্রহণের উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করে না। ১৩. আধুনিক সমাজকল্যাণ জনগণের অংশগ্রহণের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। 
১৪. সনাতন সমাজকল্যাণ স্বাবলম্বণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।১৪. আধুনিক সমাজকল্যাণ স্বাবলম্বন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। 
১৫. সনাতন সমাজকল্যাণের পরিধি ব্যাপক নয়। ১৫. আধুনিক সমাজকল্যানের পরিধি ব্যাপক।

সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ উভয়েই অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে। উভয়েই মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের সেবা করে। ধর্মীয় দর্শন, নীতি ও মুল্যবোধ উভয় সমাজকল্যানকে প্রভাবিত করে। উভয়ে পাশাপাশি থেকে সমাজ সেবায় নিয়োজিত থাকে। মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ উভয় সমাজকল্যাণেরই মুল লক্ষ্য। উভয় সমাজকল্যাণই সমাজের সম্পদের সদ্ব্যব্যবহার করে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে আপামর মানুষের সার্বিক দিকের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে বিশ্বাসী।

[বিশ্লেষণ সংকলন টিম কর্তৃক সম্পাদিত]