০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

কাজী নজরুল ইসলাম: দুই বাংলার সমাদৃত কবি

আশিকুল আলম বিশ্বাস
  • প্রকাশ: ০৪:২৮:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১
  • / ১৫৮১ বার পড়া হয়েছে

কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি।

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে, ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। ব্যক্তি নজরুল ইসলাম ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা মানুষ এবং মানবতার পূজারি। তিনি সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এক মানবপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। সব ধর্মের ও বর্ণের মানুষের আপনজন। এই বিষয়ে বহু ঘটনার কথা ছড়িয়ে আছে তাঁর বর্ণময় জীবনকে নিয়ে। মনের আকাশকে কখনো খণ্ড করে দেখেননি। জীবনভর পেয়েছেন মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা। তাঁর কাব্য জুড়ে আছে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা, কথায় ও কাজে তাঁর পরিচয় সুস্পষ্ট। তিনি খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। এটা তাঁর অসাধারণ জনপ্রিয়তার মাইলফলক। মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে তাঁর সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত।

কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ব্রিটিশ নির্যাতনের দিনগুলোতে কী যন্ত্রণাই না ভোগ করতে হয়েছিল বাঙালি জাতিকে। তখন বাংলার বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখনির মাধ্যমে ব্রিটিশদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালি জাতিকে কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও বত্তৃ«তা দিয়ে জাগ্রত করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাই নজরুল অবিভক্ত বাংলার চেতনার কবি হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পেরেছিলেন। তার লেখায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও শোষণহীন সমাজ অগ্রাধিকার পেত। তাই তো বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে বাংলার জাতীয় কবি হিসেবে বরণ করা হয়, ভারত ভাগ হওয়ার আট বছর আগেই। যে নজরুল সুগঠিত দেহ, অপরিমেয় স্বাস্থ্য ও প্রাণখোলা হাসির জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলাম মারাত্মকভাবে স্নায়বিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে আকস্মিকভাবে তাঁর সকল সক্রিয়তার অবসান হয়। অনেকেই মনে করেন জেলে থাকাকালীন অবস্থায় তাঁকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হত, যাতে ব্রিটিশ বিরোধী লেখা তিনি না লিখতে পারেন। ফলে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু অবধি সুদীর্ঘ ৩৪ বছর তাঁকে সাহিত্যকর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। 

বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছায় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকাতে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭৬ সালে তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে সম্মাননা প্রদান করা হয়। ঢাকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন। নজরুলের রচনার মধ্যে যে আবেগ এবং প্রাণবন্যা ছিল তা একদিকে যেমন জনমানসে প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, অপরদিকে তেমনই ইংরেজ শাসক ও রক্ষণশীলদের মনে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। তাঁর কবিতা ও গান এদেশের অসংখ্য মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে টেনে এনেছে অনায়াসে, আত্মদানে উদ্বুদ্ধ করেছে। জনমানসে তিনি যে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন, তার কারণ শুধুমাত্র তাঁর কবিমানস নয়, ব্যক্তিমানসেও তিনি তৎকালীন যুবসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হতে পেরেছিলেন।

২০২১ সাল একটি ঐতিহাসিক কাল। কবি নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ। দেশ-কালের সঙ্গে এই কবিতা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে বিদ্রোহ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অধর্মের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুল ইসলামের জীবনে নি¨া ও প্রশংসা দুই এনেছিল।

১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ সাল ২৯ অগ্রহায়ণ ১৩৩৬ বাংলা রবিবার, এই দিনটিতে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলার কবি হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়। কলকাতার এলবার্ট হলে কবি নজরুলকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সংবর্ধনায় সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। সভায় প্রধান অতিথি থেকে আলোচনা করেন সর্বভারতের পক্ষে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। সম্মাননা পত্র বা অভিন¨ন পত্র পাঠ করেন ব্যারিষ্টার এস. ওয়াজেদ আলি। সভায় বাংলার খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন। নজরুলকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল এখন থেকে ঠিক ৯২ বছর আগে। এরপর গঙ্গা দিয়ে কত জল প্রবাহিত হল। কত ইতিহাস চাপা পড়ে গেল লেখনির অভাবে, কে এর খোঁজ রাখে! তারপর আলোচনা, পর্যালোচনা অথবা স্মৃতিচারণে উঠে আসে অনেক ফেলে আসা চির সত্য তথ্য।

‘বিদ্রোহী’, ‘খেয়াপারের তরণী’ মানুষ নজরুলকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা হতে সাহায্য করে। নজরুলের সমাজ চেতনা ছিল বাস্তবিক। সৈনিক জীবনে প্রবেশ করে কঠিন সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নজরুল দেখেছিলেন ব্রিটিশদের অন্য রাষ্ট্রের প্রতি দমনপীড়ন নীতি। তাই তাঁর কবিতা স্বাধীনতাকামী ভারতীয় বাঙালিদের সাহস ও শক্তি জোগাতো। আর এই প্রেক্ষাপটেই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সহ অসংখ্য পণ্ডিত বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয় কলকাতার এলবার্ট হলে। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নজরুলের অনেক গান-গল্প-কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছে। তাই কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯ বাংলা সনে ঢাকায় নিয়ে আসেন। পরের দিন ১১ জ্যৈষ্ঠ ২৪ মে ছিল কবির ৭৩তম জন্মদিন।

ভারত থেকে কবি নজরুলকে বহন করা বিমানটি যখন ঢাকা বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করল, তখন বেলা ১১ ৪০ মিনিট। কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা বিমানবন্দরে সমবেত হয় ১৯৭২ সালে। ২৪ মে ১৯৭৩ সালে, ধানমণ্ডির কবি ভবনে ৫০ হাজারের মতো ভক্ত উপস্থিত হয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার জাতীয়ভাবে পালন করেছিল। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করেন। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে পদ্মভূষণ উপাধি ও সম্মাননা প্রদান করেন।

২২ জুলাই ১৯৭৫ সালে কবি নজরুল খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে ঢাকা পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) ভর্তি করে এবং মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সরকারিভাবে। ওষুধপত্র সরকারিভাবে প্রদান করা হতো।

১৯৭৬ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে নজরুলকে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করা হয়। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৩ বাংলা ২৪ মে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ নজরুলের ৭৭তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান কাজী নজরুল ইসলামকে ‘আর্মি-শ্রেষ্ঠ’ পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কবিকে নিজ হাতে পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে গিয়ে পদক প্রদান করেন।

কবি নজরুল ইসলাম ১৯৪২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত দীর্ঘদিন নির্বাক ছিলেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর নির্বাক থাকার পর ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ বাংলা ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ সালে ঢাকার পিজি হাসপাতালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মারা যান। সময়টা ছিল রবিবার সকাল ৯.৪০ মিনিট।

কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৩ বাংলা, ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। কাজী নজরুলকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। কবি নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিক ছিলেন। তাই কবির সমাধিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ সম্মান দেখায়।

কাজী নজরুল ইসলামের দাফনের পর সেনাবাহিনীর প্রধান ‘চল্ চল্ চল্’ কবিতাটিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রণসংগীত হিসেবে ঘোষণা দেন। কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি। কাজী নজরুল ইসলাম সুগঠিত দেহ, অপরিমেয় স্বাস্থ্য ও প্রাণখোলা হাসির জন্য ও আপামর বাঙালির কাছে বিখ্যাত ছিলেন।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আশিকুল আলম বিশ্বাস

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

কাজী নজরুল ইসলাম: দুই বাংলার সমাদৃত কবি

প্রকাশ: ০৪:২৮:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে, ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। ব্যক্তি নজরুল ইসলাম ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা মানুষ এবং মানবতার পূজারি। তিনি সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এক মানবপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। সব ধর্মের ও বর্ণের মানুষের আপনজন। এই বিষয়ে বহু ঘটনার কথা ছড়িয়ে আছে তাঁর বর্ণময় জীবনকে নিয়ে। মনের আকাশকে কখনো খণ্ড করে দেখেননি। জীবনভর পেয়েছেন মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা। তাঁর কাব্য জুড়ে আছে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা, কথায় ও কাজে তাঁর পরিচয় সুস্পষ্ট। তিনি খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। এটা তাঁর অসাধারণ জনপ্রিয়তার মাইলফলক। মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে তাঁর সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত।

কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ব্রিটিশ নির্যাতনের দিনগুলোতে কী যন্ত্রণাই না ভোগ করতে হয়েছিল বাঙালি জাতিকে। তখন বাংলার বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখনির মাধ্যমে ব্রিটিশদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালি জাতিকে কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও বত্তৃ«তা দিয়ে জাগ্রত করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাই নজরুল অবিভক্ত বাংলার চেতনার কবি হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পেরেছিলেন। তার লেখায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও শোষণহীন সমাজ অগ্রাধিকার পেত। তাই তো বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে বাংলার জাতীয় কবি হিসেবে বরণ করা হয়, ভারত ভাগ হওয়ার আট বছর আগেই। যে নজরুল সুগঠিত দেহ, অপরিমেয় স্বাস্থ্য ও প্রাণখোলা হাসির জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলাম মারাত্মকভাবে স্নায়বিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে আকস্মিকভাবে তাঁর সকল সক্রিয়তার অবসান হয়। অনেকেই মনে করেন জেলে থাকাকালীন অবস্থায় তাঁকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হত, যাতে ব্রিটিশ বিরোধী লেখা তিনি না লিখতে পারেন। ফলে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু অবধি সুদীর্ঘ ৩৪ বছর তাঁকে সাহিত্যকর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। 

বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছায় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকাতে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭৬ সালে তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে সম্মাননা প্রদান করা হয়। ঢাকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন। নজরুলের রচনার মধ্যে যে আবেগ এবং প্রাণবন্যা ছিল তা একদিকে যেমন জনমানসে প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, অপরদিকে তেমনই ইংরেজ শাসক ও রক্ষণশীলদের মনে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। তাঁর কবিতা ও গান এদেশের অসংখ্য মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে টেনে এনেছে অনায়াসে, আত্মদানে উদ্বুদ্ধ করেছে। জনমানসে তিনি যে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন, তার কারণ শুধুমাত্র তাঁর কবিমানস নয়, ব্যক্তিমানসেও তিনি তৎকালীন যুবসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হতে পেরেছিলেন।

২০২১ সাল একটি ঐতিহাসিক কাল। কবি নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ। দেশ-কালের সঙ্গে এই কবিতা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে বিদ্রোহ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অধর্মের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুল ইসলামের জীবনে নি¨া ও প্রশংসা দুই এনেছিল।

১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ সাল ২৯ অগ্রহায়ণ ১৩৩৬ বাংলা রবিবার, এই দিনটিতে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলার কবি হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়। কলকাতার এলবার্ট হলে কবি নজরুলকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সংবর্ধনায় সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। সভায় প্রধান অতিথি থেকে আলোচনা করেন সর্বভারতের পক্ষে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। সম্মাননা পত্র বা অভিন¨ন পত্র পাঠ করেন ব্যারিষ্টার এস. ওয়াজেদ আলি। সভায় বাংলার খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন। নজরুলকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল এখন থেকে ঠিক ৯২ বছর আগে। এরপর গঙ্গা দিয়ে কত জল প্রবাহিত হল। কত ইতিহাস চাপা পড়ে গেল লেখনির অভাবে, কে এর খোঁজ রাখে! তারপর আলোচনা, পর্যালোচনা অথবা স্মৃতিচারণে উঠে আসে অনেক ফেলে আসা চির সত্য তথ্য।

‘বিদ্রোহী’, ‘খেয়াপারের তরণী’ মানুষ নজরুলকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা হতে সাহায্য করে। নজরুলের সমাজ চেতনা ছিল বাস্তবিক। সৈনিক জীবনে প্রবেশ করে কঠিন সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নজরুল দেখেছিলেন ব্রিটিশদের অন্য রাষ্ট্রের প্রতি দমনপীড়ন নীতি। তাই তাঁর কবিতা স্বাধীনতাকামী ভারতীয় বাঙালিদের সাহস ও শক্তি জোগাতো। আর এই প্রেক্ষাপটেই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সহ অসংখ্য পণ্ডিত বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয় কলকাতার এলবার্ট হলে। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নজরুলের অনেক গান-গল্প-কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছে। তাই কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯ বাংলা সনে ঢাকায় নিয়ে আসেন। পরের দিন ১১ জ্যৈষ্ঠ ২৪ মে ছিল কবির ৭৩তম জন্মদিন।

ভারত থেকে কবি নজরুলকে বহন করা বিমানটি যখন ঢাকা বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করল, তখন বেলা ১১ ৪০ মিনিট। কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা বিমানবন্দরে সমবেত হয় ১৯৭২ সালে। ২৪ মে ১৯৭৩ সালে, ধানমণ্ডির কবি ভবনে ৫০ হাজারের মতো ভক্ত উপস্থিত হয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার জাতীয়ভাবে পালন করেছিল। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করেন। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে পদ্মভূষণ উপাধি ও সম্মাননা প্রদান করেন।

২২ জুলাই ১৯৭৫ সালে কবি নজরুল খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে ঢাকা পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) ভর্তি করে এবং মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সরকারিভাবে। ওষুধপত্র সরকারিভাবে প্রদান করা হতো।

১৯৭৬ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে নজরুলকে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করা হয়। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৩ বাংলা ২৪ মে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ নজরুলের ৭৭তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান কাজী নজরুল ইসলামকে ‘আর্মি-শ্রেষ্ঠ’ পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কবিকে নিজ হাতে পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে গিয়ে পদক প্রদান করেন।

কবি নজরুল ইসলাম ১৯৪২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত দীর্ঘদিন নির্বাক ছিলেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর নির্বাক থাকার পর ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ বাংলা ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ সালে ঢাকার পিজি হাসপাতালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মারা যান। সময়টা ছিল রবিবার সকাল ৯.৪০ মিনিট।

কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৩ বাংলা, ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। কাজী নজরুলকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। কবি নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিক ছিলেন। তাই কবির সমাধিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ সম্মান দেখায়।

কাজী নজরুল ইসলামের দাফনের পর সেনাবাহিনীর প্রধান ‘চল্ চল্ চল্’ কবিতাটিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রণসংগীত হিসেবে ঘোষণা দেন। কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি। কাজী নজরুল ইসলাম সুগঠিত দেহ, অপরিমেয় স্বাস্থ্য ও প্রাণখোলা হাসির জন্য ও আপামর বাঙালির কাছে বিখ্যাত ছিলেন।