সোমবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২৩

আব্রাহাম লিংকনের চিঠিতে মানবগুণ

আসলে সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয়। আবার আমরা যাদেরকে খারাপ মানুষ হিসেবে চিনে থাকি বা স্বীকৃতি দিয়ে থাকি সেটা অনেক সময় ভুল হয়ে থাকে বা আমরা যাকে বদ মনে করি তাদের দ্বারাও অন্যরা উপকৃত হতে পারে সেটা আমরা ভাবি না, আমরা ভাবি না তাদের মত এমন কেউ রয়েছে যে একজন বীরের ক্ষমতা রাখে, এমন ইঙ্গিত রয়েছে এ চিঠিতে।

For all latest articles, follow on Google News

যখন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকায় ব্যাচেলর অব এডুকেশন (অনার্স) প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী ছিলাম তখন আমাদের একটি কোর্স ছিল ‘অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অব এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশনস’। সেমিস্টার শুরুর দিকে কোনো একদিন কোর্সের শ্রেণিকার্য পরিচালনা করতে এসে আমাদেরকে শিক্ষক জনাব জেসমিন নাহার আমাদেরকে বললেন আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সেই চিঠিটি পড়ে আসতে যেটি এই প্রেসিডেন্ট তাঁর সন্তানের প্রতি প্রধান শিক্ষককে দায়িত্ব মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। শিক্ষকগণ নিশ্চয়ই জানেন তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কেমন হওয়া উচিৎ শিক্ষার্থীদের প্রতি, তবে লিংকন চিঠিটি লিখেছিলেন এটি ভেবে যে, তাঁর সন্তানকে যদি শিক্ষকগণ অন্য আর দশজন শিক্ষার্থীর মতো না নিয়ে প্রেসিডেন্টের সন্তান বলে ভিন্ন আচরণ করেন তাহলে ছেলেটি সঠিক শিক্ষা নাও পেতে পারেন। কথামতো আমরা প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের লেখা সেই চিঠিটি পড়ে গিয়েছিলাম ক্লাসে। ক্লাসে আমাদের সেই শিক্ষক এসে আমাদের কাছে জানতে চাইলেন আমরা যারা চিঠিটি পরেছি তারা সেখানে কোনো মানবগুণ খুঁজে পেয়েছিলাম কি না আর পেয়ে থাকলে সেগুলো কী কী বা কতগুলো।

আমরা একেকজন একেক উত্তর দিচ্ছিলাম, কিন্তু ম্যাডাম বোর্ডে গোল দাগ দিয়ে সেটার ভেতরে মোটা দাগে লিখলেন ‘আব্রাহাম লিংকনের চিঠিতে মানবগুণ’। এরপর একেক করে সবাইকে বোর্ডে গিয়ে চিঠিটিতে যেসব গুণের কথা বলা রয়েছে তা থেকে প্রত্যেককে একটি করে লিখতে বললেন। একটি, দুটি, তিনটি এভাবে যখন লিখেই চলছিল তখন আমরা সত্যিকার অর্থেই চিঠিটি একটু একটু করে অনুধাবন করতে পারছিলাম। মনে মনে হাসছিলাম আর বলছিলাম যে, আমরা কতড়ো বোকার দলে রয়েছি; কেবল একটা চিঠি বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। এটি আমাদের অনেকের কাছেই ভালো লাগছিল। লক্ষ্য করছিলাম আমাদের মধ্যে অনেকেই মোবাইল ফোনে সফট কপি থেকে বা ইন্টারনেটে খুঁজে কিংবা যাদের কাছে পূর্ব থেকেই হার্ডকপি ছিল তারা আগ্রহ নিয়ে পুনরায় পড়ছিল। এই চিঠিটি সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে আরেকটি বিষয় আমার মাথায় এসেছিল, সেটি হলো কোনো শিক্ষক চাইলেই একটু বুদ্ধি খাটিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অজানা বিষয়কে জানার আন্তরিক মনোভাব সৃষ্টি করে দিতে পারেন।

আমরা প্রথমেই যে গুণ খুঁজে পেয়েছিলাম সেটি হলো জ্ঞানার্জন করা। জ্ঞান বলতে বোঝানো হয় কোনো বিষয় সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা থাকা যা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য আবশ্যক। এরপরেই লিংকন বলেছেন, প্রত্যেককেই ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। মানুষ সামাজিক জীব হবার কারণে একে অন্যের সঙ্গে চলতে হলে ন্যায়নীতি রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এই ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার ছাড়া মানুষ কোনো ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা আসতে সক্ষম হয় না। বিজ্ঞজনেরা বলেন, এই মহৎ গুণের অধিকারী হলেই কেবল মানুষ পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হয়।

পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আসলে সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয়। আবার আমরা যাদেরকে খারাপ মানুষ হিসেবে চিনে থাকি বা স্বীকৃতি দিয়ে থাকি সেটা অনেক সময় ভুল হয়ে থাকে বা আমরা যাকে বদ মনে করি তাদের দ্বারাও অন্যরা উপকৃত হতে পারে সেটা আমরা ভাবি না, আমরা ভাবি না তাদের মত এমন কেউ রয়েছে যে একজন বীরের ক্ষমতা রাখে, এমন ইঙ্গিত রয়েছে এ চিঠিতে। আমরা অনেকেই ভেবে থাকি যে, রাজনীতিবিদরা সর্বদা নিজের স্বার্থ দেখে চলেন, নিজের জন্য এরা যা খুশি তাই করতে পারে কিন্তু এদের পেছনেও কেউ না কেউ থাকে যারা সত্যিকার অর্থেই মানুষের পাশে দাঁড়ায় যা অগোচরেই থেকে যায়। আমাদের সবার এই রাজনীতির ওপরেও কম বেশি জ্ঞান থাকতে হবে। এটি অনেকটা এরকম, don’t judge a book by its cover; বোঝা গেল মানুষ চেনার গুণটিও কম বড়ো নয় আব্রাহাম লিংকন চিঠিটিতে অনেকটা এরকমই লিখেছিলেন, পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান। এ বিষয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই জ্ঞান থাকা জরুরি। সমাজে এক ধরনের মানুষ আছে যারা সব সময় অন্যের ধন-সম্পদের প্রতি লোভ করে থাকে, ওত পেতে থাকে কখন কাকে ঠকিয়ে বা ভয় দেখিয়ে অর্থকড়ি ও সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া যায়; এ ধরনের মানুষদের জন্য এ কথাটি মানা ভীষণ জরুরি। আবার এটি আত্মনির্ভরশীলতা ও নিজ সৎ কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টিতেও সহায়ক।

আমরা অনেকেই আছি যারা কোনো পরাজয়কে খুব সহজে মেনে নিতে পারি না, পরাজয় নিয়ে আমাদের মনের মধ্যে নানান রকম নেতিবাচক চিন্তা কিংবা প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষোভ কাজ করে। অনেক সময় প্রতিহিংসার জেরে অপ্রত্যাশিত কিছু করে ফেলতেও দ্বিধা করি না, আবার কখনো পরাজিত ব্যক্তি নিজেকেই নিজে ক্ষত-বিক্ষত করে থাকেন নানা পন্থা অবলম্বন করেন; অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে নিজেকে আড়াল করে নেন। এ সম্পর্কেও শিক্ষকের প্রতি অনুরোধ করে গেছেন কিভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে হয় তা শেখানোর জন্য। কিভাবে বিজয়োল্লাস উপভোগ করতে হয় সে বিষয়েও শিক্ষা দিতে আব্রাহাম লিংকন শিক্ষককে অনুরোধ করে গেছেন, এ থেকেই বোঝা যায় পরাজয়কে যেমন মেনে নিতে হবে এবং বিজয়োল্লাসেরও একটা মাপকাঠি রয়েছে। সুতরাং পরাজয় বরণ করে নেওয়ার মনোভাববিজয়োল্লয়াসের সীমাবদ্ধতার জ্ঞান থাকা ও তা প্রয়োগ অন্যতম দুইটি গুণ।

এছাড়াও প্রেসিডেন্ট লিংকন তাঁর সন্তানের প্রধান শিক্ষকের কাছে আরও যেসব বিষয়ের ওপর সন্তানের শিক্ষালাভ করার প্রত্যাশা করেছিলেন তা হলো-  কীভাবে দুঃখের মাঝে হাসতে হয়, কাঁদার মধ্যেও যে লজ্জা নেই একথা বোঝা, নির্দয় ও নির্মম মানুষদের ঘৃণা করতে শেখা এবং অতিরিক্ত আরাম-আয়েশ থেকে সাবধান থাকার কৌশল। আবেগ নিয়ন্ত্রণ বা আবেগ প্রকাশের গুণের পাশাপাশি উপযুক্ত কারণেকিছু অসাধু মানুষকে ঘৃণা করাও যে একটা গুণ সেটা বোঝা যায়, যদিও একটি প্রবাদ আছে ‘পাপিকে নয় পাপকে ঘৃণা করো’।

তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষক সন্তানের প্রতি সদয় আচরণ করুক তবে সোহাগ করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করছিলেন। এই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করতেন  আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। তিনি চাননি তার সন্তান খুব সহজেই কোনো কিছুতে অধৈর্য হয়ে পড়ুক বরং চিঠিতে অনুরোধ ছিল তার সন্তানকে শিক্ষক যেন ধৈর্য ধারণ করার সাহস জোগান। শেষের দিকে তিনি আবারও বলেছেন, সন্তান তাঁর নিজের কর্মের প্রতি সন্তানের যেন সুমহান আস্থা থাকে আর এতেই তার সুমহান আস্থা থাকবে মানবজাতির প্রতি। এখানে খুব সাধারণ একটি কথা বলা হলেও আমি দুইটি গুণ খুঁজে পেয়েছি, যথা- আত্মবিশ্বাসপারস্পরিক বিশ্বাস

আব্রাহাম লিংকনের লেখা চিঠিটি যেমন একজন শিক্ষকের খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করা উচিত, তেমনই উচিত একেকজন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সমাজের অন্যসব সদস্য, জনপ্রতিনিধি, কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ সকল সাধারণ মানুষের। বহু ভাষায় অনূদিত এই চিঠিটিকে শুধু একজন আব্রাহাম লিংকন এবং যাকে লিখেছিলেন সেই শিক্ষক কেন্দ্রিক চিন্তা করলে হবে না; এটি সকল অভিভাবকের প্রতিনিধিত্ব করছে। এছাড়া আমরা সাধারণেরা কি বুঝতে পারছি না যে, উপরের গুণগুলো সবার ভেতরই প্রোথিত করা উচিত? শ্রদ্ধা ও সম্মান রইল আদর্শ শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি।

সম্মানিত পাঠক, আপনি যদি প্রধানশিক্ষকের উদ্দেশে লেখা আব্রাহাম লিংকনের লেখা চিঠিটি পড়ে থাকেন তাহলে বলুন আপনার কাছে আব্রাহাম লিংকনের চিঠিতে কোন কোন মানবগুণ আরও ধরা পড়েছে যা আমি তুলে আনতে পারিনি।

(এই লেখাটি কিছুটা ছোটো আকারে ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত)

মু. মিজানুর রহমান মিজান
মু. মিজানুর রহমান মিজানhttps://www.mizanurrmizan.info
মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ