০১:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ফররুখ আহমদের কাব্যনাট্য ‘নৌফেল  ও হাতেম’ রিভিউ

অধ্যাপক আশরাফ জামান
  • প্রকাশ: ১১:৪১:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১
  • / ২২৫৪ বার পড়া হয়েছে

ফররুখ আহমদ

Drama শব্দটির মূল গ্রিক শব্দ Drama আর মূল শব্দের অর্থ হলো to do করা। নাটক মানে নড়াচড়া করা, অঙ্গ চালনা করা বা উচ্চারণ করা। নাটক মানব জীবনের কথা উচ্চারণ করে। নাটক হলো মানব সমাজের দর্পন। দৃশ্য কাব্য ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে গতিমান মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে মিশরে থিয়েটারের সূত্রপাত হয়, পরে গ্রিকদের দ্বারা তা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। পাক ভারতে সংস্কৃত নাটকও অতি প্রাচীন কাল থেকে। বিশ্বখ্যাত গ্লোব থিয়েটারের সান্নিধ্য না পেলে শেক্সপিয়রের মতো বিশেষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকারের আবিষ্কার হয়তো ঘটতো না।

রাশিয়ান পরিব্রাজক হেরোমিন থেকে ডক এ দেশে প্রথম কলকাতায় বেঙ্গলি থিয়েটার নাম দিয়ে ১৭৯৫ সালের ২৭শে নবেম্বর বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করলেন। বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী এতে অংশ নিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তারা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

কলকাতার হিন্দু বাবুরা হিন্দু থিয়েটার নাম দিয়ে নাট্যগোষ্ঠী তৈরি করে এবং তাতে ইংরেজি নাটক মঞ্চস্থ করে। দর্শকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে বাংলা নাটক অভিনীত হতে থাকে। 

বাংলা সাহিত্যে প্রথম দিকের নাট্যকারদের মধ্যে ছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন, অমৃত লাল বসু, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, মাইকেল মধূসুদন দত্ত প্রমুখ।

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মাধ্যমে প্রথম আধুনিক নাটকের সূত্রপাত ঘটে। শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী, পদ্মাবতী  নাটকগুলো কলকাতার দর্শক মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ সময় দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পন নাটকটি মঞ্চস্থ হবার পর ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়ে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। মাইকেলের একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড়োশালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসন দুটিও সমাজের বাস্তব চিত্র প্রস্ফুটিত হওয়ায় জনপ্রিয়তা লাভ করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের সকল শাখায় অসাধারণ সফল্য অর্জন করেছেন। তিনি নাট্যকার হিসেবে সাফল্য লাভ করেছেন। তিনি কাব্যনাট্য, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, সাংকেতিক নাট্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও নাটক, নাটিকা, কিশোর নাটিকা মিলিয়ে একুশটি ছোট-বড় গ্রন্থ রচনা করেছেন। অবশ্য তার লেখা সবগুলো পাওয়া যায় না।

ফররুখ আহমদ কর্তৃক রচিত কাব্য নাট্য ‘নৌফেল ও হাতেম’। | বিশ্লেষণ

ফররুখ আহমদ ও তাঁর ‘নৌফেল ও হাতেম’

কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) পরবর্তী যুগের অন্যতম কবি হিসেবে আমরা ফররুখ আহমদকে (১৯১৮-১৯৭৪) মনে করি। তিনি নজরুলের মতো সাহিত্যের নানা দিকে বিচরণ করেছেন। যদিও তিনি কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত।

আরব্য উপন্যাসের বিখ্যাত কাহিনী থেকে কবি ফররুখ আহমদ ‘নৌফেল ও হাতেম’ নামে একটি কাব্যনাট্য রচনা করেছেন। ১৯৬১ সালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউটে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ ‘নৌফেল ও হাতেম’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন এবং নাট্যমোদীদের দ্বারা তা উচ্চ প্রশংসিত হয়। ইতিপূর্বে ‘মাহে নও’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পায় এবং ১৯৬১ সালের জুন মাসে পাকিস্তান লেখক সংঘের পক্ষে ড. কাজী মোতাহার হোসেন তা প্রকাশ করেন।

ইসলামি রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ ‘নৌফেল ও হাতেম’ নাটকটিতে ইয়েমেনের শাহজাদা হাতেমকে মানবতাবাদী চরিত্র ও প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছেন। হাতেমকে আদর্শবাদী ‘ন্যায়পরায়ণ’, পরোপকারী, সেবাব্রতী, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ও মহৎ মানবতাবাদীরূপে চিত্রিত করেছেন। অন্যদিকে নৌফেল ঈর্ষাপরায়ণ, অত্যাচারী, অহংকারী বাদশাহর প্রতীকে চিত্রিত করেছেন। বিজয় দেখিয়েছেন মানবতার। মুক্তি দেখিয়েছেন ইনসাফের।

নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী হলো: ক্ষমতালোভী, অহংকারী, অত্যাচারী, খ্যাতির অভিলাষী বাদশাহ নৌফেল ইয়েমেনের শাহজাদা মহৎপ্রাণ, সেবাব্রতী পরোপকারী ও মানবতাবাদী হাতেম তায়ীর বিপুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে হাতেমের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। তার খাওয়া-দাওয়া নিদ্রা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। হাতেমের শিরোচ্ছেদের জন্য বিপুল অংকের পুরস্কার ঘোষণা করেন। পুরস্কারের আশায় এক বৃদ্ধ ও দরিদ্র কাঠুরে হাতেমকে নিয়ে নৌফেলের দরবারে হাজির হয়। হাতেম স্বেচ্ছায় কাঠুরিয়াকে নিজের শির দিয়ে নৌফেলের কাছ থেকে মোটা অংকের পুরস্কার লাভের ব্যবস্থা করে দিতে চায়। তার সারা জীবনের দারিদ্র্য তাতে ঘুচবে। সাধারণ মানুষের কাছে হাতেমের ঔদার্যের খবর শুনে ঈর্ষাতুর হলেও অন্যের জন্য জীবন দান করার এ মহানুভবতায় তার ঈর্ষাকাতর থাকতে পারেন না। অত্যাচারী বাদশাহ নৌফেল তার হৃদয় মনের কঠিন বরফ গলে পানি হয়ে যায়। নত হয়ে পরে তার শির হাতেমের কাছে। তাই ছুরি নয় গলায় বিজয়ের মালা মাথায় মানবতার মুকুট পড়িয়ে দেন।

এক সময় হাতেমকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে বাদশাহ নৌফেল নিজের দানের কথা ঘোষণা দেন:

খাজাঞ্চিখানার দ্বার খুলে দাও। প্রার্থী আছে যতো যতো রাহী মুসাফির সর্বহারা অনাথ এতিম অথবা সায়েল যতো নিয়ে যাক নিজ প্রয়োজনে।                 

(নৌফেল)

শাহজাদা হাতেমকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে নৌফেল ঘোষণা দেন তার উজির বা সৈন্যদের উদ্দেশ্যে, শেষ করে যাব তার শেষ সম্ভাবনা।

(নৌফেল)

নৌফেলের হুকুম পেয়ে তার উজির ঘোষণা করে:

তায়ী পুত্র হাতেমের দেশে

রাত্রি শেষে যেতে হবে নিতে হবে তার তখত লুটে,

কেননা সে খ্যাতিমান; এ পৃথিবী ভালবাসে তাকে।         

(উজীর)

সেখানে হাতেম নৌফেলের ঈর্ষাপরায়ণতায় বিন্দুমাত্র বিভ্রান্ত হয় না। বাদশাহ মানবতার উপকারের ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলে সে করবে। হাতেম বলে:

দাতার মুখ্যাতি? নাম? অর্থহীন। সে বা ব্রতী প্রাণ আল্লাহর বান্দাকে চায়। ভালবেসে মিটাতে পিপাসা আত্মার সর্বস্ব যদি চায় নৌফেল তাহলে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে যাব আমি দূর দেশান্তরে।          (হাতেম)

বাদশাহ নৌফেলের নির্দেশ শুনে হাতেম ভীত নয়, ভীত জনসাধারণ এ জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আশংকাগ্রস্ত।   

হায়াত দারাজ হোক হাতেমের

দোয়া করি প্রতিরাতে। সবচেয়ে কঠিন সময়ে

দুর্ভিক্ষে দুর্দিনে দুঃখে দাঁড়ালো সে পাশে।  (১ম বৃদ্ধ)

হাতেমের খ্যাতির প্রতি ঈর্ষাতুর হিংসুটে স্বঘোষিত শত্রু যে বাদশাহ নৌফেল তার

প্রতি হাতেমের বিদ্বেষ নেই। বরং তার প্রতি রয়েছে সহানুভূতি আর শ্রদ্ধা। তাই হাতেম বলে : নানা অসম্ভব রাজ্যলিপ্সা তার। কঠিন সে দারাজদিল মুক্ত মন।

সর্বস্ব বিলাতে পারে অনায়াসে।

নৌফেলের সৈন্যরা হাতেমকে হন্যে হয়ে খুঁজে

তাকে বন্দী করার জন্য। বাদশাহর ঘোষিত পুরস্কারের অর্থ পেলে একটা গরিব কাঠুরে পরিবারের অভাব দুঃখ ঘুচে যাবে। কাজেই বৃদ্ধ হাতেমকে নিয়ে যাচ্ছে অরণ্য বিজন পথ দিয়ে। নৌফেলের দরবারে পৌঁছে যখন হাতেম তার পরিচয় দিল বাদশাহর কাছে তখন তা ছিল না বিশ^াসযোগ্য এবং নৌফেলের মনে হলো তা পরিহাস মূলক। নৌফেল বলেন, কাঠুরিয়া এই বৃদ্ধ। এ জয়িফ অস্থি চর্মকার তোমাকে করেছে বন্দী! একি পরিহাস?

হাতেম বলে : মিথ্যা নয়, নয় পরিহাস। আমাকে করেছে বন্দী এই বৃদ্ধ দুঃখের পিঞ্জরে। তোমার ঘোষণা তুমি পূর্ণ করো নৌফেল।

হাতেমের প্রতি ঈর্ষা বিদ্বেষ ঘৃণার প্রকাশ নৌফেলের বুকে চেপে থাকা পাথরটা সরে গিয়ে ফল্গুধারা বয়ে গেল মুহূর্তে।

নৌফেল তখন বলে- যে মানুষ প্রাণ দিয়ে করে যায় বিশ্ববাসির কল্যাণ কুল মাখলুকের বুকে স্থান তার; দুনিয়া জাহানে পায় সে বিপুল মান জীবনে অথবা মৃত্যু পারে। য়েমেনের শাহজাদা! ক্ষমা করো শত্রুতা আমার। নিজের ভুল বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত নৌফেল মাথার বাদশাহী মুকুট হাতেম তায়ীর মাথায় পরিয়ে দেন।

হাতেম তায়ীর আদর্শবাদীতা নৌফেলের চরিত্র এবং চিন্তা চেতনাকে বদলে দিয়েছে। বাদশাহর হাজার সৈন্যসামন্ত একজন হাতেমকে পরিবর্তন করতে পারেনি। এখানে একজন মাত্র আদর্শবাদী আল্লাহওয়ালা লোক শক্তিশালী এক স্বৈরাচার শাসকের মনমানসিকতার পরিবর্তন বিরাট ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন কাব্যনাট্যে দেখা যায়, আদর্শবাদী রাজা গোবিন্দ মানিক্যের কাছে পুরোহিত রঘুপতির সাময়িক পরাজয় ঘটেছে যেন তেমনি। তবে সেখানে রঘুপতি পরাজয় মেনে নেননি নিজের আদর্শ থেকে এখানে নৌফেল নিয়েছে। সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করেছে শাহজাদা হাতেমের কাছে।

ফররুখ আহমদ ছাত্র জীবনে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। আন্দোলনে লাখো মানুষের মিছিলে শ্লোগান ছিল লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান দীনকে লেঙ্গে পাকিস্তান। স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ শাসিত পাক ভারতকে স্বাধীন করে। একটি সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র কায়েম হবে। যে রাষ্ট্র হবে ন্যায় ইনসাফ আর কল্যাণমূলক একটি রাষ্ট্র। পাকিস্তান নামক এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে কবি আশা করেছিলেন সে রাষ্ট্রের শাসক হবেন ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক। নৌফেল ও হাতেম নাটকের হাতেম সেই ন্যায় বিচারক শাসক। 

কবির স্বপ্ন ছিল যে দেশের শাসক হবেন খলিফা ওমরের মত মানবতার সর্বপ্রকার গুণ সম্পন্ন একজন মহামানব। হাতেমকে তাই কবি রূপদান করেছেন সেই জনগণ নন্দিত নায়ক হিসেবে। আর দেশের স্বৈরচারী, অত্যাচারী, লোভী শাসক যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন জনগণের ন্যায্য দাবী দাওয়া, রাজনৈতিক-সামাজিক অধিকারের গলা চেপে ধরে ক্ষমতায় টিকে থেকেছেন তারা হলেন কবির নৌফেলরূপী পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। এদিক থেকে আমরা নাটকটিকে একটি রূপক নাটক বলতে পারি।

ফররুখ সাহিত্য গবেষক ড. সুশীল কুমার মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরার কবি স্বপ্নই যে নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাট্যে সার্থকতার পথ খুঁজে ফিরেছে তা বুঝতে মনোযোগী পাঠকের মুহূর্ত কালও বিলম্ব হয় না। একটু মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলে এ তিন কাব্যগ্রন্থেই যে কবি ভাবনা একটি অখ- ঐক্যসূত্রে বিধৃত বুঝতে কষ্ট হয় না।

কবি ফররুখ আহমদ তার সৃষ্টি ধারায় জনগণ নন্দিত নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বিশ-একুশ শতকের ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ বিশ্ব নেতৃত্ব দানের মত যোগ্যতাসম্পন্ন মহামানব রূপী যে চরিত্র কোথাও বাস্তবতাসম্পন্ন কোথাও বা রোমান্টিক রক্তমাংসের মানুষ। সাজ্যবাদী দেশের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নির্যাতিত নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত সংগ্রামী মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্বদানের যোগ্যতাসম্পন্ন অকুতোভয় নেতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ নেতা কখনো সিরাজাম মুনীরা কখনো সিন্দাবাদ কখনো পাঞ্জেরী কখনো সাতসাগরের মাঝি আবার কখনো হাতেম তায়ী।

কবি জীবনানন্দ দাশের একদন্ড শান্তি দেবার মত মানসী প্রতিমা বনলতা সেন এখানে নয়। কবির সৃষ্ট নেতা একা তাকে নয়, শান্তি এনে দেবে একটা জাতি বা বিশে^র কোটি কোটি মানুষের তিনি শান্তিকামী নেতা। নেতৃত্বদানের মত শক্তিশালী চরিত্র আদর্শবান সর্বগুণে গুণী সে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আছে অবসাদ আছে ক্লান্তি। ফররুখ আহমদের লেখায় কোথাও তা নেই বরং আছে আশার বাণী। আছে পথচলার নির্দেশ। 

‘নৌফেল ও হাটেম’ নাটকের গল্প পুঁথি সাহিত্য থেকে নেওয়া হয়েছে। কবি পুঁথি সাহিত্য থেকে নৌফেল ও হাতেম নাটকের গল্প আনলেও তার লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন আধুনিক কাব্য বৈশিষ্ট্য।

ফররুখ সাহিত্য গবেষক অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান লিখেছেন: ফররুখ আহমদ ইতিহাস আশ্রিত কাহিনী অবলম্বনে নৌফেল ও হাতেম তাই রচনা করেছেন। এতে অতিমানবীয় কোন বিষয়ের অবতারণা করা হয়নি। এর কাহিনী ও বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ জাগতিক বাস্তব ও মানবিক সংবেদনা ও রসে পূর্ণ। নাটকীয় কাহিনী, ঘটনা ও চরিত্রের সন্নিবেশনার ক্ষেত্রে তার পারদর্শিতা প্রশংসাযোগ্য।

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন : “একথা অনস্বীকার্য যে, নজরুল ইসলামেও পুঁথির বিশিষ্ট মিশাল রীতির প্রাচুর্য আছে। নজরুল কাব্যের বলদৃপ্ত কৌরুষে সে শব্দ ব্যবহার রীতির কাছ থেকে পোষকতা পেয়েছে। নৌফেল ও হাতেম এ প্রবহমানতা আছে কিন্তু নজরুলের এসেই উদ্দীপ্ত কলকণ্ঠ নেই। তা না থাক, কিন্তু বৈশিষ্ট্য এখানেই যে, অমিত্রাক্ষরের নিটোলে শরীরে ঐ পুঁথির শব্দ গ্রন্থন এখানে সুঠাম।”

বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা প্রথম দিকে দেখা যায় সেখানে হিন্দু পুরান থেকে গল্প নিয়ে নাটক রচনা করা হতো। নাটকে বর্ণিত চরিত্রগুলো প্রায়শঃ দেবতা কেন্দ্রিক অতিমানবীয় গুণ কীর্তন করা হতো। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাও প্রায়ই এ জাতীয়। ইতিহাস আশ্রিত বা পুঁথি সাহিত্যের গল্প থেকে কাহিনী নিয়ে এসে ফররুখ আহমদ নৌফেল ও হাতেম রচনা করলেও কবি এখানে হাতেম চরিত্রে অতিমানবতায় গুণ অবতারণ করেননি। নাটকীয় কাহিনী রচনা ও চরিত্রের সন্নিবেশের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত করেছেন। আদর্শবাদী জননন্দিত মানব হিসেবে চিত্রিত করেছেন হাতেমকে।

সুসাহিত্যিক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ লিখেছেন: ‘ফররুখ আহমদ গীতি কবি নন, তিনি অনেকটা মাইকেলের অনুসারী (ভাষার ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে নয়) ক্লাসিকধর্মী কবি এবং ধ্রুপদী রীতির পরিপোষক। তাঁর কাব্য নাটকের সংলাপ সংহত ও ঘনবদ্ধ। পাঠ্য নাটক হিসাবেও ফররুখ আহমদের কাব্য নাটকের আবেদন কম নয়। তার বহু খন্ড ক্ষুদ্র ও দীর্ঘ কবিতা ও সংলাপ নাট্যগুণ সমৃদ্ধ। নৌফেল ও হাতেম কাব্য নাটক পাঠকালে কাব্য ঐশ পরিচয় মেলে।’

কবি ফররুখ আহমদ রচিত নৌফেল ও হাতেম একটি স্বার্থক কাব্য নাট্য। এর আবেদন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অক্ষুণে থাকবে। কবির রচিত হাতেম তায়ী মহাকাব্যের বিশালতাকে সংক্ষিপ্ত সারভাবে যারা কম সময়ের মধ্যে পেতে চান তারা এ থেকে সেই রস আস্বাদন করতে পারবেন। বর্তমান শতকের ব্যস্ততাময় সময়ের মধ্যে এক নিমেষের গল্প হিসেবেই আস্বাদন পাবেন।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

অধ্যাপক আশরাফ জামান

আশরাফ জামান একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইলে দৈনিক সংগ্রাম ও দৈনিক আজাদ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প, প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়ে আসছে। তিনি কবি ফররুখ ফাউন্ডেশন ও সেন্টার ফর ন্যাশনাল কালচার (সিএনসি)-এর আজীবন সদস্য।
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

ফররুখ আহমদের কাব্যনাট্য ‘নৌফেল  ও হাতেম’ রিভিউ

প্রকাশ: ১১:৪১:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১

Drama শব্দটির মূল গ্রিক শব্দ Drama আর মূল শব্দের অর্থ হলো to do করা। নাটক মানে নড়াচড়া করা, অঙ্গ চালনা করা বা উচ্চারণ করা। নাটক মানব জীবনের কথা উচ্চারণ করে। নাটক হলো মানব সমাজের দর্পন। দৃশ্য কাব্য ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে গতিমান মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে মিশরে থিয়েটারের সূত্রপাত হয়, পরে গ্রিকদের দ্বারা তা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। পাক ভারতে সংস্কৃত নাটকও অতি প্রাচীন কাল থেকে। বিশ্বখ্যাত গ্লোব থিয়েটারের সান্নিধ্য না পেলে শেক্সপিয়রের মতো বিশেষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকারের আবিষ্কার হয়তো ঘটতো না।

রাশিয়ান পরিব্রাজক হেরোমিন থেকে ডক এ দেশে প্রথম কলকাতায় বেঙ্গলি থিয়েটার নাম দিয়ে ১৭৯৫ সালের ২৭শে নবেম্বর বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করলেন। বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী এতে অংশ নিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তারা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

কলকাতার হিন্দু বাবুরা হিন্দু থিয়েটার নাম দিয়ে নাট্যগোষ্ঠী তৈরি করে এবং তাতে ইংরেজি নাটক মঞ্চস্থ করে। দর্শকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে বাংলা নাটক অভিনীত হতে থাকে। 

বাংলা সাহিত্যে প্রথম দিকের নাট্যকারদের মধ্যে ছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন, অমৃত লাল বসু, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, মাইকেল মধূসুদন দত্ত প্রমুখ।

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মাধ্যমে প্রথম আধুনিক নাটকের সূত্রপাত ঘটে। শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী, পদ্মাবতী  নাটকগুলো কলকাতার দর্শক মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ সময় দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পন নাটকটি মঞ্চস্থ হবার পর ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়ে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। মাইকেলের একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড়োশালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসন দুটিও সমাজের বাস্তব চিত্র প্রস্ফুটিত হওয়ায় জনপ্রিয়তা লাভ করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের সকল শাখায় অসাধারণ সফল্য অর্জন করেছেন। তিনি নাট্যকার হিসেবে সাফল্য লাভ করেছেন। তিনি কাব্যনাট্য, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, সাংকেতিক নাট্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও নাটক, নাটিকা, কিশোর নাটিকা মিলিয়ে একুশটি ছোট-বড় গ্রন্থ রচনা করেছেন। অবশ্য তার লেখা সবগুলো পাওয়া যায় না।

ফররুখ আহমদ কর্তৃক রচিত কাব্য নাট্য ‘নৌফেল ও হাতেম’। | বিশ্লেষণ

ফররুখ আহমদ ও তাঁর ‘নৌফেল ও হাতেম’

কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) পরবর্তী যুগের অন্যতম কবি হিসেবে আমরা ফররুখ আহমদকে (১৯১৮-১৯৭৪) মনে করি। তিনি নজরুলের মতো সাহিত্যের নানা দিকে বিচরণ করেছেন। যদিও তিনি কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত।

আরব্য উপন্যাসের বিখ্যাত কাহিনী থেকে কবি ফররুখ আহমদ ‘নৌফেল ও হাতেম’ নামে একটি কাব্যনাট্য রচনা করেছেন। ১৯৬১ সালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউটে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ ‘নৌফেল ও হাতেম’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন এবং নাট্যমোদীদের দ্বারা তা উচ্চ প্রশংসিত হয়। ইতিপূর্বে ‘মাহে নও’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পায় এবং ১৯৬১ সালের জুন মাসে পাকিস্তান লেখক সংঘের পক্ষে ড. কাজী মোতাহার হোসেন তা প্রকাশ করেন।

ইসলামি রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ ‘নৌফেল ও হাতেম’ নাটকটিতে ইয়েমেনের শাহজাদা হাতেমকে মানবতাবাদী চরিত্র ও প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছেন। হাতেমকে আদর্শবাদী ‘ন্যায়পরায়ণ’, পরোপকারী, সেবাব্রতী, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ও মহৎ মানবতাবাদীরূপে চিত্রিত করেছেন। অন্যদিকে নৌফেল ঈর্ষাপরায়ণ, অত্যাচারী, অহংকারী বাদশাহর প্রতীকে চিত্রিত করেছেন। বিজয় দেখিয়েছেন মানবতার। মুক্তি দেখিয়েছেন ইনসাফের।

নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী হলো: ক্ষমতালোভী, অহংকারী, অত্যাচারী, খ্যাতির অভিলাষী বাদশাহ নৌফেল ইয়েমেনের শাহজাদা মহৎপ্রাণ, সেবাব্রতী পরোপকারী ও মানবতাবাদী হাতেম তায়ীর বিপুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে হাতেমের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। তার খাওয়া-দাওয়া নিদ্রা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। হাতেমের শিরোচ্ছেদের জন্য বিপুল অংকের পুরস্কার ঘোষণা করেন। পুরস্কারের আশায় এক বৃদ্ধ ও দরিদ্র কাঠুরে হাতেমকে নিয়ে নৌফেলের দরবারে হাজির হয়। হাতেম স্বেচ্ছায় কাঠুরিয়াকে নিজের শির দিয়ে নৌফেলের কাছ থেকে মোটা অংকের পুরস্কার লাভের ব্যবস্থা করে দিতে চায়। তার সারা জীবনের দারিদ্র্য তাতে ঘুচবে। সাধারণ মানুষের কাছে হাতেমের ঔদার্যের খবর শুনে ঈর্ষাতুর হলেও অন্যের জন্য জীবন দান করার এ মহানুভবতায় তার ঈর্ষাকাতর থাকতে পারেন না। অত্যাচারী বাদশাহ নৌফেল তার হৃদয় মনের কঠিন বরফ গলে পানি হয়ে যায়। নত হয়ে পরে তার শির হাতেমের কাছে। তাই ছুরি নয় গলায় বিজয়ের মালা মাথায় মানবতার মুকুট পড়িয়ে দেন।

এক সময় হাতেমকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে বাদশাহ নৌফেল নিজের দানের কথা ঘোষণা দেন:

খাজাঞ্চিখানার দ্বার খুলে দাও। প্রার্থী আছে যতো যতো রাহী মুসাফির সর্বহারা অনাথ এতিম অথবা সায়েল যতো নিয়ে যাক নিজ প্রয়োজনে।                 

(নৌফেল)

শাহজাদা হাতেমকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে নৌফেল ঘোষণা দেন তার উজির বা সৈন্যদের উদ্দেশ্যে, শেষ করে যাব তার শেষ সম্ভাবনা।

(নৌফেল)

নৌফেলের হুকুম পেয়ে তার উজির ঘোষণা করে:

তায়ী পুত্র হাতেমের দেশে

রাত্রি শেষে যেতে হবে নিতে হবে তার তখত লুটে,

কেননা সে খ্যাতিমান; এ পৃথিবী ভালবাসে তাকে।         

(উজীর)

সেখানে হাতেম নৌফেলের ঈর্ষাপরায়ণতায় বিন্দুমাত্র বিভ্রান্ত হয় না। বাদশাহ মানবতার উপকারের ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলে সে করবে। হাতেম বলে:

দাতার মুখ্যাতি? নাম? অর্থহীন। সে বা ব্রতী প্রাণ আল্লাহর বান্দাকে চায়। ভালবেসে মিটাতে পিপাসা আত্মার সর্বস্ব যদি চায় নৌফেল তাহলে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে যাব আমি দূর দেশান্তরে।          (হাতেম)

বাদশাহ নৌফেলের নির্দেশ শুনে হাতেম ভীত নয়, ভীত জনসাধারণ এ জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আশংকাগ্রস্ত।   

হায়াত দারাজ হোক হাতেমের

দোয়া করি প্রতিরাতে। সবচেয়ে কঠিন সময়ে

দুর্ভিক্ষে দুর্দিনে দুঃখে দাঁড়ালো সে পাশে।  (১ম বৃদ্ধ)

হাতেমের খ্যাতির প্রতি ঈর্ষাতুর হিংসুটে স্বঘোষিত শত্রু যে বাদশাহ নৌফেল তার

প্রতি হাতেমের বিদ্বেষ নেই। বরং তার প্রতি রয়েছে সহানুভূতি আর শ্রদ্ধা। তাই হাতেম বলে : নানা অসম্ভব রাজ্যলিপ্সা তার। কঠিন সে দারাজদিল মুক্ত মন।

সর্বস্ব বিলাতে পারে অনায়াসে।

নৌফেলের সৈন্যরা হাতেমকে হন্যে হয়ে খুঁজে

তাকে বন্দী করার জন্য। বাদশাহর ঘোষিত পুরস্কারের অর্থ পেলে একটা গরিব কাঠুরে পরিবারের অভাব দুঃখ ঘুচে যাবে। কাজেই বৃদ্ধ হাতেমকে নিয়ে যাচ্ছে অরণ্য বিজন পথ দিয়ে। নৌফেলের দরবারে পৌঁছে যখন হাতেম তার পরিচয় দিল বাদশাহর কাছে তখন তা ছিল না বিশ^াসযোগ্য এবং নৌফেলের মনে হলো তা পরিহাস মূলক। নৌফেল বলেন, কাঠুরিয়া এই বৃদ্ধ। এ জয়িফ অস্থি চর্মকার তোমাকে করেছে বন্দী! একি পরিহাস?

হাতেম বলে : মিথ্যা নয়, নয় পরিহাস। আমাকে করেছে বন্দী এই বৃদ্ধ দুঃখের পিঞ্জরে। তোমার ঘোষণা তুমি পূর্ণ করো নৌফেল।

হাতেমের প্রতি ঈর্ষা বিদ্বেষ ঘৃণার প্রকাশ নৌফেলের বুকে চেপে থাকা পাথরটা সরে গিয়ে ফল্গুধারা বয়ে গেল মুহূর্তে।

নৌফেল তখন বলে- যে মানুষ প্রাণ দিয়ে করে যায় বিশ্ববাসির কল্যাণ কুল মাখলুকের বুকে স্থান তার; দুনিয়া জাহানে পায় সে বিপুল মান জীবনে অথবা মৃত্যু পারে। য়েমেনের শাহজাদা! ক্ষমা করো শত্রুতা আমার। নিজের ভুল বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত নৌফেল মাথার বাদশাহী মুকুট হাতেম তায়ীর মাথায় পরিয়ে দেন।

হাতেম তায়ীর আদর্শবাদীতা নৌফেলের চরিত্র এবং চিন্তা চেতনাকে বদলে দিয়েছে। বাদশাহর হাজার সৈন্যসামন্ত একজন হাতেমকে পরিবর্তন করতে পারেনি। এখানে একজন মাত্র আদর্শবাদী আল্লাহওয়ালা লোক শক্তিশালী এক স্বৈরাচার শাসকের মনমানসিকতার পরিবর্তন বিরাট ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন কাব্যনাট্যে দেখা যায়, আদর্শবাদী রাজা গোবিন্দ মানিক্যের কাছে পুরোহিত রঘুপতির সাময়িক পরাজয় ঘটেছে যেন তেমনি। তবে সেখানে রঘুপতি পরাজয় মেনে নেননি নিজের আদর্শ থেকে এখানে নৌফেল নিয়েছে। সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করেছে শাহজাদা হাতেমের কাছে।

ফররুখ আহমদ ছাত্র জীবনে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। আন্দোলনে লাখো মানুষের মিছিলে শ্লোগান ছিল লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান দীনকে লেঙ্গে পাকিস্তান। স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ শাসিত পাক ভারতকে স্বাধীন করে। একটি সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র কায়েম হবে। যে রাষ্ট্র হবে ন্যায় ইনসাফ আর কল্যাণমূলক একটি রাষ্ট্র। পাকিস্তান নামক এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে কবি আশা করেছিলেন সে রাষ্ট্রের শাসক হবেন ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক। নৌফেল ও হাতেম নাটকের হাতেম সেই ন্যায় বিচারক শাসক। 

কবির স্বপ্ন ছিল যে দেশের শাসক হবেন খলিফা ওমরের মত মানবতার সর্বপ্রকার গুণ সম্পন্ন একজন মহামানব। হাতেমকে তাই কবি রূপদান করেছেন সেই জনগণ নন্দিত নায়ক হিসেবে। আর দেশের স্বৈরচারী, অত্যাচারী, লোভী শাসক যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন জনগণের ন্যায্য দাবী দাওয়া, রাজনৈতিক-সামাজিক অধিকারের গলা চেপে ধরে ক্ষমতায় টিকে থেকেছেন তারা হলেন কবির নৌফেলরূপী পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। এদিক থেকে আমরা নাটকটিকে একটি রূপক নাটক বলতে পারি।

ফররুখ সাহিত্য গবেষক ড. সুশীল কুমার মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরার কবি স্বপ্নই যে নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাট্যে সার্থকতার পথ খুঁজে ফিরেছে তা বুঝতে মনোযোগী পাঠকের মুহূর্ত কালও বিলম্ব হয় না। একটু মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলে এ তিন কাব্যগ্রন্থেই যে কবি ভাবনা একটি অখ- ঐক্যসূত্রে বিধৃত বুঝতে কষ্ট হয় না।

কবি ফররুখ আহমদ তার সৃষ্টি ধারায় জনগণ নন্দিত নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বিশ-একুশ শতকের ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ বিশ্ব নেতৃত্ব দানের মত যোগ্যতাসম্পন্ন মহামানব রূপী যে চরিত্র কোথাও বাস্তবতাসম্পন্ন কোথাও বা রোমান্টিক রক্তমাংসের মানুষ। সাজ্যবাদী দেশের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নির্যাতিত নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত সংগ্রামী মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্বদানের যোগ্যতাসম্পন্ন অকুতোভয় নেতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ নেতা কখনো সিরাজাম মুনীরা কখনো সিন্দাবাদ কখনো পাঞ্জেরী কখনো সাতসাগরের মাঝি আবার কখনো হাতেম তায়ী।

কবি জীবনানন্দ দাশের একদন্ড শান্তি দেবার মত মানসী প্রতিমা বনলতা সেন এখানে নয়। কবির সৃষ্ট নেতা একা তাকে নয়, শান্তি এনে দেবে একটা জাতি বা বিশে^র কোটি কোটি মানুষের তিনি শান্তিকামী নেতা। নেতৃত্বদানের মত শক্তিশালী চরিত্র আদর্শবান সর্বগুণে গুণী সে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আছে অবসাদ আছে ক্লান্তি। ফররুখ আহমদের লেখায় কোথাও তা নেই বরং আছে আশার বাণী। আছে পথচলার নির্দেশ। 

‘নৌফেল ও হাটেম’ নাটকের গল্প পুঁথি সাহিত্য থেকে নেওয়া হয়েছে। কবি পুঁথি সাহিত্য থেকে নৌফেল ও হাতেম নাটকের গল্প আনলেও তার লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন আধুনিক কাব্য বৈশিষ্ট্য।

ফররুখ সাহিত্য গবেষক অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান লিখেছেন: ফররুখ আহমদ ইতিহাস আশ্রিত কাহিনী অবলম্বনে নৌফেল ও হাতেম তাই রচনা করেছেন। এতে অতিমানবীয় কোন বিষয়ের অবতারণা করা হয়নি। এর কাহিনী ও বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ জাগতিক বাস্তব ও মানবিক সংবেদনা ও রসে পূর্ণ। নাটকীয় কাহিনী, ঘটনা ও চরিত্রের সন্নিবেশনার ক্ষেত্রে তার পারদর্শিতা প্রশংসাযোগ্য।

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন : “একথা অনস্বীকার্য যে, নজরুল ইসলামেও পুঁথির বিশিষ্ট মিশাল রীতির প্রাচুর্য আছে। নজরুল কাব্যের বলদৃপ্ত কৌরুষে সে শব্দ ব্যবহার রীতির কাছ থেকে পোষকতা পেয়েছে। নৌফেল ও হাতেম এ প্রবহমানতা আছে কিন্তু নজরুলের এসেই উদ্দীপ্ত কলকণ্ঠ নেই। তা না থাক, কিন্তু বৈশিষ্ট্য এখানেই যে, অমিত্রাক্ষরের নিটোলে শরীরে ঐ পুঁথির শব্দ গ্রন্থন এখানে সুঠাম।”

বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা প্রথম দিকে দেখা যায় সেখানে হিন্দু পুরান থেকে গল্প নিয়ে নাটক রচনা করা হতো। নাটকে বর্ণিত চরিত্রগুলো প্রায়শঃ দেবতা কেন্দ্রিক অতিমানবীয় গুণ কীর্তন করা হতো। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাও প্রায়ই এ জাতীয়। ইতিহাস আশ্রিত বা পুঁথি সাহিত্যের গল্প থেকে কাহিনী নিয়ে এসে ফররুখ আহমদ নৌফেল ও হাতেম রচনা করলেও কবি এখানে হাতেম চরিত্রে অতিমানবতায় গুণ অবতারণ করেননি। নাটকীয় কাহিনী রচনা ও চরিত্রের সন্নিবেশের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত করেছেন। আদর্শবাদী জননন্দিত মানব হিসেবে চিত্রিত করেছেন হাতেমকে।

সুসাহিত্যিক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ লিখেছেন: ‘ফররুখ আহমদ গীতি কবি নন, তিনি অনেকটা মাইকেলের অনুসারী (ভাষার ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে নয়) ক্লাসিকধর্মী কবি এবং ধ্রুপদী রীতির পরিপোষক। তাঁর কাব্য নাটকের সংলাপ সংহত ও ঘনবদ্ধ। পাঠ্য নাটক হিসাবেও ফররুখ আহমদের কাব্য নাটকের আবেদন কম নয়। তার বহু খন্ড ক্ষুদ্র ও দীর্ঘ কবিতা ও সংলাপ নাট্যগুণ সমৃদ্ধ। নৌফেল ও হাতেম কাব্য নাটক পাঠকালে কাব্য ঐশ পরিচয় মেলে।’

কবি ফররুখ আহমদ রচিত নৌফেল ও হাতেম একটি স্বার্থক কাব্য নাট্য। এর আবেদন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অক্ষুণে থাকবে। কবির রচিত হাতেম তায়ী মহাকাব্যের বিশালতাকে সংক্ষিপ্ত সারভাবে যারা কম সময়ের মধ্যে পেতে চান তারা এ থেকে সেই রস আস্বাদন করতে পারবেন। বর্তমান শতকের ব্যস্ততাময় সময়ের মধ্যে এক নিমেষের গল্প হিসেবেই আস্বাদন পাবেন।