০৮:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

উপমহাদেশের রাজনীতি এবং বাঙালি

  • প্রকাশ: ১১:২১:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২১
  • / ১৩১১ বার পড়া হয়েছে

উপমহাদেশের রাজনীতি এবং বাঙালি

উপমহাদেশে রাজনীতির পরিসরে বাঙালির উপস্থিতি গত শতকের গোড়ার দিক থেকেই একটা অন্যরকম স্র্রোতস্বিনী ধারার সংযোগ ঘটিয়েছিল। গোপালকৃষ্ণ গোখেল যে বলেছিলেন; বাংলা আজ যা ভাবে, গোটা দেশ আগামীদিনে তা ভাবে- এই কথাটি শুধু অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিকদের চেতনাজগতকে নিয়েই তো বলা হয়নি। বলা হয়েছিল, সেইসময়ের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি রাজনীতিকদের সৌজন্যবোধ, রুচি, সহবত, শিক্ষা- অবশ্যই প্রথাগত এবং মানবিক শিক্ষা, সততা… এসব কিছুর মিশ্রণের অভিব্যক্তি ছিল গোখেলের কথার ভেতরে। এই সম্মিলিত ধারা পথেই বাঙালি হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশবিরোধী গণসংগ্রামের আঁতুরঘরের কুশীলব।

জাতীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উপমহাদেশে প্রথম যে বাঙালির নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে তার প্রভাব যেভাবে পড়েছিল বিশ শতকে সেই ভাবে কোনো একটি দেশের জাতীয় রাজনীতিতে কোনো বাঙালির প্রভাব তেমন পরিপূর্ণভাবে তার আগে আর পড়েনি। আত্মবলিদানের এত বছর পরেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী জ্যোতিষ্ক।

রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ প্রদান করছেন
রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ প্রদান করছেন

বঙ্গবন্ধুর পরেই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী ব্যক্তিত্ব হিসেবে জ্যোতি বসুর নাম করতে হয়। ভারতীয় রাজনীতিতে জাতীয় স্তরে নিজের জীবদ্দশায় যে প্রভাব এবং পরিচিতি বিস্তার করতে পেরেছিলেন জ্যোতি বসু, ১৯৪৭ সালের পরবর্তী পর্যায়ে তেমনটা আর কোনো বাঙালি পারেননি। প্রণব মুখোপাধ্যায় ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালের শেষ পর্বে কার্যত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। নরসিংহ রায়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের কালে যোজনা কমিশনের সহ-সভাপতি হিসেবেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। ড. মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার কার্যত দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। তারপর দেশের রাষ্ট্রপতি। এত গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও জ্যোতি বসুর কাছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ যেভাবে এসেছিল এবং দলীয় বাধ্যবাধকতায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃত হওয়ার মতো যে ব্যতিক্রমী ভূমিকা তিনি রেখেছিলেন, তা স্বাধীনতা উত্তর ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে সব থেকে আলাদা একজন বাঙালি রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হয়েও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই সময়ে ভারতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম বিবেচনার ভেতরেই আনেনি। না আনার কারণটা কি? তার প্রতি আনুগত্য ঘিরে তো স্বয়ং শ্রীমতী গান্ধীর কোন সংশয় ছিল না। এক সময়ের তাবড় তাবড় সহযোদ্ধারা তিনি পরাজিত হওয়ার পর তাকে ছেড়ে গেছে। কিন্তু কোন ছাপ বা বাড়তি প্রলোভনের তাগিদে প্রণববাবু ছাড়েননি শ্রীমতী গান্ধীকে। তা সত্ত্বেও সরাসরি ভোটে জিতে লোকসভায় আসতে না পারা প্রণববাবুর দলীয় বৃত্তের বাইরে জনসংযোগ যে প্রায় শূন্য এটা জানতেন শ্রীমতী গান্ধী। কংগ্রেসের দলীয় নেতৃত্ব এবং স্বয়ং রাজীব গান্ধীও জানতেন এই শিকড়বিহীন রাজনীতিককে কেন তার মা ইন্দিরা কখনোই নিজের উত্তরাধিকারী বলে ভাবেননি। তাই ইন্দিরার মৃত্যুর পর গান্ধী পরিবারের সদস্য না হওয়ার কারণে নয়, শিকড়বিহীন রাজনীতিক হওয়ার জন্যেই ইন্দিরার উত্তরাধিকারী হিসেবে সেই সময়ের মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস নেতৃত্ব একটি বারের জন্যও প্রণববাবুর কথা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবেনি।

প্রণব মুখার্জি, ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি

আর মানুষের ভেতরে সম্পর্কের শিকড়টা জ্যোতিবাবুর এতটাই গভীর ছিল যে, যে মানুষটি তার দীর্ঘকালের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে কখনও লোকসভা বা রাজ্যসভার সদস্যই হননি, সেই মানুষটিকেই নয়ের দশকে, সমস্ত অবিজেপি রাজনৈতিক শক্তি, মায় কংগ্রেস দল ও দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাইল! আধুনিক ভারতের ইতিহাসে, ব্রিটিশ শাসনকালেই হোক বা স্বাধীন ভারতে, এর আগে ও না, এর পরে আজ পর্যন্ত আর আসমুদ্র হিমালয় একজন বাঙালিকে দেশের নেতৃত্বের প্রশ্নে এমন বিরল সম্মান দেয়নি। জ্যোতিবাবুর দল চায়নি, তাই ব্যক্তি পছন্দকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রীর মতো পদ হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। যদিও তার দলেরই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, রাজনৈতিক কারণেই যখন তার দল চায়নি, তিনি আর লোকসভার অধ্যক্ষ থাকুন, তখন রাজনীতির নানা নীতিবাক্য উচ্চারণ করে দল তাকে ত্যাজ্য করলেও স্পিকার পদ ছাড়েননি তিনি। এই খানেই রাজনীতির পরিমন্ডলে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন জ্যোতি বসু।

অবিভক্ত বাংলায় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যে রাজনৈতিক উচ্চতায় উঠেছিলেন তাতে লাহোর প্রস্তাব তাকে দিয়েই উত্থাপনে কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন জিন্নাহসহ সেই সময়ের তাবড় তাবড় মুসলিম লীগ নেতারা। হক সাহেব অবিভক্ত বাংলার রাজনীতির পরিমন্ডলের বাইরে খুব একটা নিজেকে মেলে ধরতে চাইতেন না। যেমনটা চাইতেন না স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যার কর্মকান্ড ঘিরেও রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকদের আগ্রহ কোনো অংশে কম নয়, সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ডা. বিধানচন্দ্র রায়।

ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতের রাজনীতিতে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ তথা আজকের উত্তরপ্রদেশের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। পন্ডিত নেহরু চেয়েছিলেন ডা. রায়কে যুক্তপ্রদেশের রাজ্যপাল করতে। রাজ্যপাল পদটি প্রত্যক্ষ রাজনীতির প্রাঙ্গণে আদর্শগতভাবে তেমন প্রাসঙ্গিক কোন পদ না হলেও সেই সময়ের রাজনীতির প্রেক্ষিতে যুক্তপ্রদেশের রাজনীতির যে প্রভাব ছিল জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে, তাতে সেই পদটির যথেষ্টই গুরুত্ব ছিল। ডা. রায় কোনো অবস্থাতেই সেই পদ গ্রহণে রাজি হননি। তিনি চেয়েছিলেন পেশা জীবনের বাইরে যদি তাকে রাজনীতিই করতে হয়, তাহলে সেটা তিনি করবেন বাংলা থেকেই। যুক্তপ্রদেশের রাজ্যপাল হলে জাতীয় রাজনীতিতে ধীরে ধীরে অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবার যে সম্ভাবনা ছিল, তাকে বিধানবাবু কোনো অবস্থাতেই আমল দিতে রাজি ছিলেন না।

বিধানচন্দ্র রায় থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হয়ে সাম্প্রতিক অতীতের প্রণব মুখোপাধ্যায় বা এবিএ গণিখান চৌধুরীর মতো জাতীয় স্তরে পরিচিত বাঙালি নেতারা কখনোই পশ্চিমবঙ্গের সীমায়িত পরিমন্ডলের বাইরে জাতীয় প্রশ্নে, দেশের সংবিধানকে রক্ষার প্রশ্নে কখনো জ্যোতি বসুর মতো সরব হননি।

জাতীয় আন্দোলনের সময়ে বিধান রায়ের যে কার্যক্রম এবং চিকিৎসক হিসেবে তার যে জাতীয় স্তরের পরিচিতি, তার প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বিধানবাবুর পক্ষে আদৌ কষ্টকর ছিল না। পন্ডিত নেহরুর সঙ্গে তার ছিল যথেষ্ট প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক। ফলে তিনি যদি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আগ্রহী হতেন, পন্ডিত নেহরুর কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতার বদলে দারুণ সহযোগিতাই তিনি পেতেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিমন্ডলের বাইরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের রাজনীতিতে বিধানবাবুর তেমন আগারহই ছিল না। এমন কি সেই সময়ের জাতীয় রাজনীতির ঘন ঘটার প্রবাহ সম্পর্কেও তিনি যে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন, সে সব কর্মকান্ডে অংশ নিতে চাইতেন, তাও মনে হয় না। কারণ, সেই সময়ের খবরের কাগজগুলো ভালো করে দেখলে দেখা যাবে যে, জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে বিবৃতি, মন্তব্য বিধানচন্দ্র রায় করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তার আগ্রহের সমস্তটুকু ফোকাসই ছিল তার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে ঘিরে।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক

জ্যোতি বসু কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির বাইরে সর্বভারতীয় স্তরে কখনো রাজনীতি করেননি। কিন্তু ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ভারতের জাতীয় স্তরের রাজনীতি যেন স্বেচ্ছায়, পরম সমাদরে আত্মসমর্পণ করেছিল। বিরোধী রাজনীতিক হিসেবে জ্যোতিবাবু জাতীয় রাজনীতির যে কোনো গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে শুধু ওয়াকিবহালই ছিলেন না, সেই গতিপ্রকৃতির নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অভিমুখ কি হতে পারে, তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও ছিলেন সমকালীন রাজনীতিকদের ভেতরে একজন বিশেষ রকমের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। বিধান রায়ের জাতীয় রাজনীতিতে পদচারণার সব রকমের সুযোগ সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নীরবতা আর ঠিক সেই সময়েই নিজের মতাদর্শের রাজনীতির প্রসারে বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে সমানভাবে সক্রিয় হয়েও জাতীয় রাজনীতির সবরকম গলি থেকে রাজপথ ঘিরে জ্যোতি বসুর যে আগ্রহ, বিশ্লেষণ (তার সেই সময়ের বক্তৃতা, লেখালেখির ভেতরে অজস্র উদাহরণ আছে) পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির সাফল্যের পেছনে একটা বড়ো রকমের ইউএসপি হিসেবে কাজ করেছিল। বিধান রায় গোবলয়ের রাজনীতি ঘিরে একটু আধটু আগ্রহ দেখালেও বিন্ধ্য পর্বতের অপরপ্রান্তে ও যে একটা ভারতের অংশ আছে, সেখানকার রাজনীতির প্রভাব ও জাতীয় রাজনীতিতে কম নয় (দক্ষিণের কে কামরাজ, এস নিজলিঙ্গাপ্পাদের প্রভাব তখন ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে)- এ সম্পর্কে বিধানবাবু যে ওয়াকিবহাল ছিলেন, তার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ সমকালীন খবরের কাগজের প্রতিবেদনে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পত্রালাপের (এই পত্রালাপের খুব বড়ো রেওয়াজ ছিল তখন) ভিতরে নেই।

নিজে জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশ নেননি কখনো। কিন্তু শ্রীমতী গান্ধীর জীবদ্দশাতেই অকংগ্রসী মুখ্যমন্ত্রীদের ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সঠিক ব্যবহার এবং রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিতে যে ঐক্যের পরিমন্ডল জ্যোতিবাবু তৈরি করতে পেরেছিলেন তার অর্থমন্ত্রী ড. অশোক মিত্রের ঐকান্তিক সহযোগিতার দ্বারা। এই ঘটনা গোটা ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে শ্রীমতী গান্ধীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একজন বাঙালির আত্মপ্রকাশের নবদিগন্ত ছিল। উত্তরের ডা. ফারুক আবদুল্লা থেকে দক্ষিণের এনটিরামরাও বা রামকৃষ্ণ হেগড়ে সেদিন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে বনিয়াদ ভারতের সংবিধান তৈরি করেছে, কংগ্রেস যে বনিয়াদ ধ্বংস করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায় কেন্দ্রের হাতে, তাকে প্রতিহত করতে জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক উদ্যোগ কে দুহাত তুলে সমর্থন করেছিল। স্বাধীনতার পরে ভারতে এভাবে দেশের সুদূর উত্তর থেকে সুদূর দক্ষিণের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা জাতীয় কোনো ইস্যুতে কোনো বাঙালিকে অবিসংবাদী নেতা হিসেবে মেনে নেননি।

বিধানচন্দ্র রায় থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হয়ে সাম্প্রতিক অতীতের প্রণব মুখোপাধ্যায় বা এবিএ গণিখান চৌধুরীর মতো জাতীয় স্তরে পরিচিত বাঙালি নেতারা কখনোই পশ্চিমবঙ্গের সীমায়িত পরিমন্ডলের বাইরে জাতীয় প্রশ্নে, দেশের সংবিধানকে রক্ষার প্রশ্নে কখনো জ্যোতি বসুর মতো সরব হননি। আসমুদ্র হিমালয়কে নিজেদের দেশের সংবিধানকে রক্ষা করার সংকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সচেতন করেননি।

আজ একপর্যায়ে বিজেপি ভারতের সংবিধানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেদিন শ্রীমতী গান্ধী কিন্তু ভিন্ন কৌশলে তার একনায়কতন্ত্রী মানসিকতাকে চিরস্থায়ী করতে দেশের সংবিধানকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতার নিরিখে ’৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরে এসে গণতন্ত্রকে লুণ্ঠন করার, আধা ফ্যাসিবাদীরাজ কায়েম করবার প্রশ্নে অতীতের মতো কাঁচা রাস্তায় তিনি হাঁটেননি। এই সময়ে নিজের রাজনৈতিক অভিষ্পাকে ফলবতী করতে শ্রীমতী গান্ধী অনেক বেশি কৌশলী ছিলেন। অনেক বেশি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, আটঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন।

সেদিন যদি শ্রীমতী গান্ধীর এই রাজনৈতিক অভিসন্ধি ঘিরে দেশের মানুষকে সচেতন না করতেন জ্যোতিবাবু, মানুষকে সংগঠিত করবার কাজে নেতৃত্ব না দিতেন, তাহলে জরুরি অবস্থার আরও একটা কৌশলী চিত্রাবলি, সেই অঘোষিত জরুরি অবস্থার ভেতর দিয়ে দেশবাসীকে দেখিয়ে ছাড়তেন শ্রীমতী গান্ধী। ভারতের গণতন্ত্রকে, সংবিধানকে বাঁচাবার ক্ষেত্রে তাই জ্যোতিবাবুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের দাবিতে আন্দোলন, রাজ্যের হাতে অধিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার দাবিতে আন্দোলনের একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে।

জ্যোতি বসু
জ্যোতি বসু

ভারতের জাতীয় রাজনীতি তে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা যখন মন্ত্রী হয়েছেন, সে সময়টুকু, অর্থাৎ; তাদের মন্ত্রিত্বের কালটুকু তে তারা যথেষ্ট প্রভাবশালী থেকেছেন। আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব থেকে ছিটকে যাওয়ার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয় রাজনীতি তো দূরের কথা, নিজের রাজ্যের রাজনীতি তেই তারা আর তেমন প্রাসঙ্গিক থাকেননি। উদাহরণ হিসেবে শচীন চৌধুরী, ফুলরেণু গুহ, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, এবিএ গণিখান চৌধুরী, দেবী পাল, অজিত পাঁজা, তপন শিকদার, সত্য মুখার্জী (জুলু) প্রমুখের নাম করা যায়। প্রাসঙ্গিক থেকে যাওয়া প্রণব মুখোপাধ্যায়কে কখনোই তার দল দেশের নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত মনে করেনি। শ্রীমতী গান্ধীর হত্যাকান্ডের পর একটিবারের জন্য তার দল প্রধানমন্ত্রী পদে প্রণব বাবুর নাম বিবেচনা করেনি। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরে যখন নড়বড়ে সরকার কেন্দ্রে তৈরি করে কংগ্রেস, তখন প্রায় অবসর জীবনযাপন করা পিভি নরসিংহ রাওকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে। তবু ও কংগ্রেস দল একবারের জন্যেও বিবেচনার ভেতরেই আনেনি প্রণব বাবুর নাম। শেষ জীবনে কার্যত সান্তনা পুরস্কারের মতোই তাকে দেশের রাষ্ট্রপতি করে রাজনীতির মূল বৃত্ত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তার দল কংগ্রেস। এসব দিক কে অতিক্রম করে নিজে কখনো প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে না থেকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি তার পদতলে এসে ধরা দিয়েছিল। তবু দলীয় অবস্থানের জন্য হেলায় সে মুকুটকে ত্যাগ করবার হিম্মত দেখিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত সব থেকে সফল বাঙালি রাজনীতিক।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

উপমহাদেশের রাজনীতি এবং বাঙালি

প্রকাশ: ১১:২১:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২১

উপমহাদেশে রাজনীতির পরিসরে বাঙালির উপস্থিতি গত শতকের গোড়ার দিক থেকেই একটা অন্যরকম স্র্রোতস্বিনী ধারার সংযোগ ঘটিয়েছিল। গোপালকৃষ্ণ গোখেল যে বলেছিলেন; বাংলা আজ যা ভাবে, গোটা দেশ আগামীদিনে তা ভাবে- এই কথাটি শুধু অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিকদের চেতনাজগতকে নিয়েই তো বলা হয়নি। বলা হয়েছিল, সেইসময়ের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি রাজনীতিকদের সৌজন্যবোধ, রুচি, সহবত, শিক্ষা- অবশ্যই প্রথাগত এবং মানবিক শিক্ষা, সততা… এসব কিছুর মিশ্রণের অভিব্যক্তি ছিল গোখেলের কথার ভেতরে। এই সম্মিলিত ধারা পথেই বাঙালি হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশবিরোধী গণসংগ্রামের আঁতুরঘরের কুশীলব।

জাতীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উপমহাদেশে প্রথম যে বাঙালির নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে তার প্রভাব যেভাবে পড়েছিল বিশ শতকে সেই ভাবে কোনো একটি দেশের জাতীয় রাজনীতিতে কোনো বাঙালির প্রভাব তেমন পরিপূর্ণভাবে তার আগে আর পড়েনি। আত্মবলিদানের এত বছর পরেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী জ্যোতিষ্ক।

রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ প্রদান করছেন
রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ প্রদান করছেন

বঙ্গবন্ধুর পরেই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী ব্যক্তিত্ব হিসেবে জ্যোতি বসুর নাম করতে হয়। ভারতীয় রাজনীতিতে জাতীয় স্তরে নিজের জীবদ্দশায় যে প্রভাব এবং পরিচিতি বিস্তার করতে পেরেছিলেন জ্যোতি বসু, ১৯৪৭ সালের পরবর্তী পর্যায়ে তেমনটা আর কোনো বাঙালি পারেননি। প্রণব মুখোপাধ্যায় ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালের শেষ পর্বে কার্যত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। নরসিংহ রায়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের কালে যোজনা কমিশনের সহ-সভাপতি হিসেবেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। ড. মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার কার্যত দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। তারপর দেশের রাষ্ট্রপতি। এত গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও জ্যোতি বসুর কাছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ যেভাবে এসেছিল এবং দলীয় বাধ্যবাধকতায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃত হওয়ার মতো যে ব্যতিক্রমী ভূমিকা তিনি রেখেছিলেন, তা স্বাধীনতা উত্তর ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে সব থেকে আলাদা একজন বাঙালি রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হয়েও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই সময়ে ভারতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম বিবেচনার ভেতরেই আনেনি। না আনার কারণটা কি? তার প্রতি আনুগত্য ঘিরে তো স্বয়ং শ্রীমতী গান্ধীর কোন সংশয় ছিল না। এক সময়ের তাবড় তাবড় সহযোদ্ধারা তিনি পরাজিত হওয়ার পর তাকে ছেড়ে গেছে। কিন্তু কোন ছাপ বা বাড়তি প্রলোভনের তাগিদে প্রণববাবু ছাড়েননি শ্রীমতী গান্ধীকে। তা সত্ত্বেও সরাসরি ভোটে জিতে লোকসভায় আসতে না পারা প্রণববাবুর দলীয় বৃত্তের বাইরে জনসংযোগ যে প্রায় শূন্য এটা জানতেন শ্রীমতী গান্ধী। কংগ্রেসের দলীয় নেতৃত্ব এবং স্বয়ং রাজীব গান্ধীও জানতেন এই শিকড়বিহীন রাজনীতিককে কেন তার মা ইন্দিরা কখনোই নিজের উত্তরাধিকারী বলে ভাবেননি। তাই ইন্দিরার মৃত্যুর পর গান্ধী পরিবারের সদস্য না হওয়ার কারণে নয়, শিকড়বিহীন রাজনীতিক হওয়ার জন্যেই ইন্দিরার উত্তরাধিকারী হিসেবে সেই সময়ের মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস নেতৃত্ব একটি বারের জন্যও প্রণববাবুর কথা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবেনি।

প্রণব মুখার্জি, ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি

আর মানুষের ভেতরে সম্পর্কের শিকড়টা জ্যোতিবাবুর এতটাই গভীর ছিল যে, যে মানুষটি তার দীর্ঘকালের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে কখনও লোকসভা বা রাজ্যসভার সদস্যই হননি, সেই মানুষটিকেই নয়ের দশকে, সমস্ত অবিজেপি রাজনৈতিক শক্তি, মায় কংগ্রেস দল ও দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাইল! আধুনিক ভারতের ইতিহাসে, ব্রিটিশ শাসনকালেই হোক বা স্বাধীন ভারতে, এর আগে ও না, এর পরে আজ পর্যন্ত আর আসমুদ্র হিমালয় একজন বাঙালিকে দেশের নেতৃত্বের প্রশ্নে এমন বিরল সম্মান দেয়নি। জ্যোতিবাবুর দল চায়নি, তাই ব্যক্তি পছন্দকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রীর মতো পদ হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। যদিও তার দলেরই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, রাজনৈতিক কারণেই যখন তার দল চায়নি, তিনি আর লোকসভার অধ্যক্ষ থাকুন, তখন রাজনীতির নানা নীতিবাক্য উচ্চারণ করে দল তাকে ত্যাজ্য করলেও স্পিকার পদ ছাড়েননি তিনি। এই খানেই রাজনীতির পরিমন্ডলে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন জ্যোতি বসু।

অবিভক্ত বাংলায় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যে রাজনৈতিক উচ্চতায় উঠেছিলেন তাতে লাহোর প্রস্তাব তাকে দিয়েই উত্থাপনে কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন জিন্নাহসহ সেই সময়ের তাবড় তাবড় মুসলিম লীগ নেতারা। হক সাহেব অবিভক্ত বাংলার রাজনীতির পরিমন্ডলের বাইরে খুব একটা নিজেকে মেলে ধরতে চাইতেন না। যেমনটা চাইতেন না স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যার কর্মকান্ড ঘিরেও রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকদের আগ্রহ কোনো অংশে কম নয়, সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ডা. বিধানচন্দ্র রায়।

ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতের রাজনীতিতে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ তথা আজকের উত্তরপ্রদেশের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। পন্ডিত নেহরু চেয়েছিলেন ডা. রায়কে যুক্তপ্রদেশের রাজ্যপাল করতে। রাজ্যপাল পদটি প্রত্যক্ষ রাজনীতির প্রাঙ্গণে আদর্শগতভাবে তেমন প্রাসঙ্গিক কোন পদ না হলেও সেই সময়ের রাজনীতির প্রেক্ষিতে যুক্তপ্রদেশের রাজনীতির যে প্রভাব ছিল জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে, তাতে সেই পদটির যথেষ্টই গুরুত্ব ছিল। ডা. রায় কোনো অবস্থাতেই সেই পদ গ্রহণে রাজি হননি। তিনি চেয়েছিলেন পেশা জীবনের বাইরে যদি তাকে রাজনীতিই করতে হয়, তাহলে সেটা তিনি করবেন বাংলা থেকেই। যুক্তপ্রদেশের রাজ্যপাল হলে জাতীয় রাজনীতিতে ধীরে ধীরে অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবার যে সম্ভাবনা ছিল, তাকে বিধানবাবু কোনো অবস্থাতেই আমল দিতে রাজি ছিলেন না।

বিধানচন্দ্র রায় থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হয়ে সাম্প্রতিক অতীতের প্রণব মুখোপাধ্যায় বা এবিএ গণিখান চৌধুরীর মতো জাতীয় স্তরে পরিচিত বাঙালি নেতারা কখনোই পশ্চিমবঙ্গের সীমায়িত পরিমন্ডলের বাইরে জাতীয় প্রশ্নে, দেশের সংবিধানকে রক্ষার প্রশ্নে কখনো জ্যোতি বসুর মতো সরব হননি।

জাতীয় আন্দোলনের সময়ে বিধান রায়ের যে কার্যক্রম এবং চিকিৎসক হিসেবে তার যে জাতীয় স্তরের পরিচিতি, তার প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বিধানবাবুর পক্ষে আদৌ কষ্টকর ছিল না। পন্ডিত নেহরুর সঙ্গে তার ছিল যথেষ্ট প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক। ফলে তিনি যদি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আগ্রহী হতেন, পন্ডিত নেহরুর কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতার বদলে দারুণ সহযোগিতাই তিনি পেতেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিমন্ডলের বাইরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের রাজনীতিতে বিধানবাবুর তেমন আগারহই ছিল না। এমন কি সেই সময়ের জাতীয় রাজনীতির ঘন ঘটার প্রবাহ সম্পর্কেও তিনি যে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন, সে সব কর্মকান্ডে অংশ নিতে চাইতেন, তাও মনে হয় না। কারণ, সেই সময়ের খবরের কাগজগুলো ভালো করে দেখলে দেখা যাবে যে, জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে বিবৃতি, মন্তব্য বিধানচন্দ্র রায় করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তার আগ্রহের সমস্তটুকু ফোকাসই ছিল তার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে ঘিরে।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক

জ্যোতি বসু কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির বাইরে সর্বভারতীয় স্তরে কখনো রাজনীতি করেননি। কিন্তু ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ভারতের জাতীয় স্তরের রাজনীতি যেন স্বেচ্ছায়, পরম সমাদরে আত্মসমর্পণ করেছিল। বিরোধী রাজনীতিক হিসেবে জ্যোতিবাবু জাতীয় রাজনীতির যে কোনো গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে শুধু ওয়াকিবহালই ছিলেন না, সেই গতিপ্রকৃতির নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অভিমুখ কি হতে পারে, তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও ছিলেন সমকালীন রাজনীতিকদের ভেতরে একজন বিশেষ রকমের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। বিধান রায়ের জাতীয় রাজনীতিতে পদচারণার সব রকমের সুযোগ সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নীরবতা আর ঠিক সেই সময়েই নিজের মতাদর্শের রাজনীতির প্রসারে বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে সমানভাবে সক্রিয় হয়েও জাতীয় রাজনীতির সবরকম গলি থেকে রাজপথ ঘিরে জ্যোতি বসুর যে আগ্রহ, বিশ্লেষণ (তার সেই সময়ের বক্তৃতা, লেখালেখির ভেতরে অজস্র উদাহরণ আছে) পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির সাফল্যের পেছনে একটা বড়ো রকমের ইউএসপি হিসেবে কাজ করেছিল। বিধান রায় গোবলয়ের রাজনীতি ঘিরে একটু আধটু আগ্রহ দেখালেও বিন্ধ্য পর্বতের অপরপ্রান্তে ও যে একটা ভারতের অংশ আছে, সেখানকার রাজনীতির প্রভাব ও জাতীয় রাজনীতিতে কম নয় (দক্ষিণের কে কামরাজ, এস নিজলিঙ্গাপ্পাদের প্রভাব তখন ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে)- এ সম্পর্কে বিধানবাবু যে ওয়াকিবহাল ছিলেন, তার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ সমকালীন খবরের কাগজের প্রতিবেদনে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পত্রালাপের (এই পত্রালাপের খুব বড়ো রেওয়াজ ছিল তখন) ভিতরে নেই।

নিজে জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশ নেননি কখনো। কিন্তু শ্রীমতী গান্ধীর জীবদ্দশাতেই অকংগ্রসী মুখ্যমন্ত্রীদের ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সঠিক ব্যবহার এবং রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিতে যে ঐক্যের পরিমন্ডল জ্যোতিবাবু তৈরি করতে পেরেছিলেন তার অর্থমন্ত্রী ড. অশোক মিত্রের ঐকান্তিক সহযোগিতার দ্বারা। এই ঘটনা গোটা ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে শ্রীমতী গান্ধীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একজন বাঙালির আত্মপ্রকাশের নবদিগন্ত ছিল। উত্তরের ডা. ফারুক আবদুল্লা থেকে দক্ষিণের এনটিরামরাও বা রামকৃষ্ণ হেগড়ে সেদিন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে বনিয়াদ ভারতের সংবিধান তৈরি করেছে, কংগ্রেস যে বনিয়াদ ধ্বংস করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায় কেন্দ্রের হাতে, তাকে প্রতিহত করতে জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক উদ্যোগ কে দুহাত তুলে সমর্থন করেছিল। স্বাধীনতার পরে ভারতে এভাবে দেশের সুদূর উত্তর থেকে সুদূর দক্ষিণের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা জাতীয় কোনো ইস্যুতে কোনো বাঙালিকে অবিসংবাদী নেতা হিসেবে মেনে নেননি।

বিধানচন্দ্র রায় থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হয়ে সাম্প্রতিক অতীতের প্রণব মুখোপাধ্যায় বা এবিএ গণিখান চৌধুরীর মতো জাতীয় স্তরে পরিচিত বাঙালি নেতারা কখনোই পশ্চিমবঙ্গের সীমায়িত পরিমন্ডলের বাইরে জাতীয় প্রশ্নে, দেশের সংবিধানকে রক্ষার প্রশ্নে কখনো জ্যোতি বসুর মতো সরব হননি। আসমুদ্র হিমালয়কে নিজেদের দেশের সংবিধানকে রক্ষা করার সংকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সচেতন করেননি।

আজ একপর্যায়ে বিজেপি ভারতের সংবিধানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেদিন শ্রীমতী গান্ধী কিন্তু ভিন্ন কৌশলে তার একনায়কতন্ত্রী মানসিকতাকে চিরস্থায়ী করতে দেশের সংবিধানকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতার নিরিখে ’৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরে এসে গণতন্ত্রকে লুণ্ঠন করার, আধা ফ্যাসিবাদীরাজ কায়েম করবার প্রশ্নে অতীতের মতো কাঁচা রাস্তায় তিনি হাঁটেননি। এই সময়ে নিজের রাজনৈতিক অভিষ্পাকে ফলবতী করতে শ্রীমতী গান্ধী অনেক বেশি কৌশলী ছিলেন। অনেক বেশি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, আটঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন।

সেদিন যদি শ্রীমতী গান্ধীর এই রাজনৈতিক অভিসন্ধি ঘিরে দেশের মানুষকে সচেতন না করতেন জ্যোতিবাবু, মানুষকে সংগঠিত করবার কাজে নেতৃত্ব না দিতেন, তাহলে জরুরি অবস্থার আরও একটা কৌশলী চিত্রাবলি, সেই অঘোষিত জরুরি অবস্থার ভেতর দিয়ে দেশবাসীকে দেখিয়ে ছাড়তেন শ্রীমতী গান্ধী। ভারতের গণতন্ত্রকে, সংবিধানকে বাঁচাবার ক্ষেত্রে তাই জ্যোতিবাবুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের দাবিতে আন্দোলন, রাজ্যের হাতে অধিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার দাবিতে আন্দোলনের একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে।

জ্যোতি বসু
জ্যোতি বসু

ভারতের জাতীয় রাজনীতি তে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা যখন মন্ত্রী হয়েছেন, সে সময়টুকু, অর্থাৎ; তাদের মন্ত্রিত্বের কালটুকু তে তারা যথেষ্ট প্রভাবশালী থেকেছেন। আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব থেকে ছিটকে যাওয়ার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয় রাজনীতি তো দূরের কথা, নিজের রাজ্যের রাজনীতি তেই তারা আর তেমন প্রাসঙ্গিক থাকেননি। উদাহরণ হিসেবে শচীন চৌধুরী, ফুলরেণু গুহ, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, এবিএ গণিখান চৌধুরী, দেবী পাল, অজিত পাঁজা, তপন শিকদার, সত্য মুখার্জী (জুলু) প্রমুখের নাম করা যায়। প্রাসঙ্গিক থেকে যাওয়া প্রণব মুখোপাধ্যায়কে কখনোই তার দল দেশের নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত মনে করেনি। শ্রীমতী গান্ধীর হত্যাকান্ডের পর একটিবারের জন্য তার দল প্রধানমন্ত্রী পদে প্রণব বাবুর নাম বিবেচনা করেনি। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরে যখন নড়বড়ে সরকার কেন্দ্রে তৈরি করে কংগ্রেস, তখন প্রায় অবসর জীবনযাপন করা পিভি নরসিংহ রাওকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে। তবু ও কংগ্রেস দল একবারের জন্যেও বিবেচনার ভেতরেই আনেনি প্রণব বাবুর নাম। শেষ জীবনে কার্যত সান্তনা পুরস্কারের মতোই তাকে দেশের রাষ্ট্রপতি করে রাজনীতির মূল বৃত্ত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তার দল কংগ্রেস। এসব দিক কে অতিক্রম করে নিজে কখনো প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে না থেকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি তার পদতলে এসে ধরা দিয়েছিল। তবু দলীয় অবস্থানের জন্য হেলায় সে মুকুটকে ত্যাগ করবার হিম্মত দেখিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত সব থেকে সফল বাঙালি রাজনীতিক।