০৫:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ফিডব্যাক বা ফলাবর্তন গ্রহণ ও প্রদান পদ্ধতি এবং জন হেরনের ফিডব্যাক মডেল

শেহনাজ ইসলাম মুক্তি
  • প্রকাশ: ০৪:২২:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ নভেম্বর ২০২১
  • / ১৮২৯০ বার পড়া হয়েছে

যে-কোনো পেশাগত উন্নয়নের একটি আধুনিক ও কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক (feedback)। | ছবি: Unsplash

ফলাফর্তন কিংবা ফিডব্যাক হলো এমন একটি মাধ্যম বা তথ্য ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কারো ব্যক্তিগত পেশাগত উন্নতি বা অবনতি সম্পর্কে জানা যায়। এই নিবন্ধে ফলাবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক কী? (What Is Feedback?) 

সাধারণভাবে একটি কাজের সম্পাদন প্রক্রিয়া এবং সম্পাদনের ফলাফল সম্পর্কে অন্যের মন্তব্য যা সম্পাদনকারীকে পরবর্তীতে কর্ম সম্পাদনের মান উন্নয়নে সহায়তা করে তাকে ফলাবর্তন বলা হয়। 

অন্যভাবে বলা যায়, পেশাগত উন্নয়নের লক্ষ্যে নিজের কাজের সবলতা-দুর্বলতা চিহ্নিত করার জন্য পেশাগতভাবে অভিজ্ঞ অন্যকে পর্যবেক্ষণ করিয়ে সে অনুযায়ী পরবর্তীতে যে সংশোধনমূলক ব্যবস্থাা নেওয়া তার সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে ফলাবর্তন বলা হয়। ফলাবর্তনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ফিডব্যাক  (feedback)।

যে-কোনো পেশাগত উন্নয়নের একটি আধুনিক ও কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক (feedback)। শিক্ষক প্রশিক্ষণে ফলাবর্তনের ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্যণীয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে ফিডব্যাক কী? (What Is Feedback in Education?)

ফলাবর্তন শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা প্রশিক্ষণার্থী, প্রত্যেকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ফলাবর্তন হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা প্রশিক্ষণার্থীদের দক্ষতা এবং পারদর্শীতার ভালো-মন্দ  ও উন্নয়ন-অবনতি সংক্রান্ত তথ্য যা বিপরিত প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত হয়।

শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক প্রদান করেন আবার শিক্ষক নিজেও শিক্ষার্থীদের থেকে ফিডব্যাক গ্রহণ করেন।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক পাঠদানকালে এবং পাঠদান শেষে শিক্ষার্থীদের এবং সতীর্থ শিক্ষকগণের নিকট থেকে মতামত, মূল্যায়ন, সমালোচনা, ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, নির্দেশনা ইত্যাদি আশা করেন। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকের পাঠদানের ওপর সতীর্থ শিক্ষকের, প্রশিক্ষকের কিংবা শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত মতামত, মূল্যায়ন, সমালোচনা, ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, নির্দেশনাকে ফলাবর্তন বলা হবে।

শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে যে কাজগুলো করেন তা তিনি পূর্ব পরিকল্পনা করে, অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সম্পাদন করে থাকেন। কিন্তু তার সেই কাজগুলো সত্যিই যথাযথভাবে সম্পাদন হচ্ছে কি না তা পাঠদানকারী শিক্ষক নিশ্চিত হতে পারেন না। কারণ তিনি নিজের সফলতা বা ব্যর্থতা চিহ্নিত করতে পারেন না। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এই পেশার অন্যজন যদি শিখন-শেখানো কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এ বিষয়ে পরামর্শ দেন, ভুল থাকলে সংশোধন করে দেন, ভাল কাজগুলোর জন্য প্রশংসা করেন এবং উৎসাহ দেন তাহলে পাঠদানকারী শিক্ষক পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারেন।

ফিডব্যাক গ্রহণ ও প্রদান পদ্ধতি

ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলাবর্তন শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। কার্যকর ফলাবর্তনের জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে- 

শিক্ষাক্ষেত্রে ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। | ছবি: Unsplash
  • পর্যবেক্ষক এবং পর্যবেক্ষিত শিক্ষক উভয়ই আলোচনা করে পাঠদানের পূর্বে শিখন-শেখানোর কিছু দক্ষতা ও কৌশলকে ফলাবর্তনের নির্ণায়ক হিসেবে চিহ্নিত করবেন; 
  • পর্যবেক্ষিত শিক্ষকের প্রত্যাশা অনুসারে চিহ্নিত দক্ষতা ও কৌশলগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণকারী শিক্ষকের সাথে আলোচনা করবেন;
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রম চলাকালীন পর্যবেক্ষক কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করবেন তা পূর্বে নির্ধারণ করবেন;
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রম রেকর্ড করতে চাইলে পূর্বেই পর্যবেক্ষিত শিক্ষকের সাথে আলোচনা করে নিবেন;
  • পর্যবেক্ষণ চলাকালীন সবল-দুর্বল দিকসমূহের নোট রাখবেন;
  • পাঠদান চলাকালীন কোন কথা বা মন্তব্য করে পাঠের সাবলীলতা ও গতিশীলতা ব্যহত করা যুক্তিসঙ্গত হবে না;
  • শিক্ষার্থীদের সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে পাঠদান কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যাবে না;
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রম শেষে পর্যবেক্ষক এবং পর্যবেক্ষিত শিক্ষক একসাথে বসে পূর্বনির্ধারিত নির্ণায়ক অনুসারে গঠনমূলক ফলাবর্তন দিবেন এবং ফলাবর্তন গ্রহণ করবেন;
  • সকল পর্যবেক্ষিত শিক্ষককে ভিন্নভাবে ফলাবর্তন দিতে হবে।

ফলাবর্তনের উপযোগিতা কী বা ফলাবর্তন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এটি প্রমাণিত যে, ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক (Feedback) শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলাবর্তন শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। ফলাবর্তন যেমন শিক্ষার্থীদের শিখন বুঝতে সহযোগিতা করে, তেমনই শিখন নির্দেশনা সম্পর্কেও ধারণা লাভ করতে পারে।

  • গুণগত পাঠদান ও কার্যকর শিখনের জন্য ফলাবর্তন গুরুত্বপূর্ণ;
  • মূল্যায়ন করার কৌশল রপ্ত হয়;
  • আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ দক্ষতার উন্নতি হয়;
  • সমালোচনা বা নেতিবাচক মন্তব্য গ্রহণ করা বা মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ হয়;
  • অর্জিত শিখনফল জানা যায়;
  • শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যোগাযোগ বৃদ্ধি করে;
  • প্রশিক্ষণার্থীর মনোভাব বোঝা যায়;
  • প্রশিক্ষণার্থীর চাহিদা নিরূপণ করা যায়;
  • প্রশিক্ষক সম্পর্কে জানা যায়।

ফলপ্রসূ ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক প্রদান কৌশল

ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক হলো প্রশিক্ষণের একটি বিষয়। ফলাবর্তনের মাধ্যমে প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী, শিক্ষার্থী নির্বিশেষে সবাই উপকৃত হয়। শিখন-শেখানোর গুনগত উন্নয়নে ফলাবর্তন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে তাই প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী ও কর্মসূচির উন্নয়ন ঘটাতে হলে ফলাবর্তনের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। ফলপ্রসূফলাবর্তন প্রদান করার জন্য নিম্নলিখিত কৌশলগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে।

  • পাঠদানের ফলাবর্তন প্রদান করার ক্ষেত্রে প্রথম থেকে ক্লাসে থাকতে হবে;
  • কোন কোন দিক বিবেচনা করে ফলাবর্তন দেওয়া হচ্ছে তা উল্লেখ করতে হবে;
  • খণ্ডিতভাবে ফলাবর্তন প্রদান করা উচিত নয়;
  • পূর্ব থেকেই ফলাবর্তনের নির্দিষ্ট নির্ণায়ক থাকা উচিত;
  • ফলাবর্তন অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে;
  • ফলাবর্তনে প্রথমে ইতিবাচক দিক এবং পরে নেতিবাচক দিক বলা উচিত;
  • ফলাবর্তন শুধু বিদ্যমান গুণ বা দোষ প্রকাশ করেনা, ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনাও থাকে।

জন হেরনের ফিডব্যাক মডেল

Pজন হেরন একজন বিখ্যাত গবেষক ও শিক্ষাবিদ। তিনি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান পোটেনশিয়াল রিসার্চ (Human Potential Research Project)-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। তিনি অংশগ্রহণমূলক গবেষণার প্রবক্তা হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিত। ফলাবর্তন পদ্ধতিটি পাঠদান অনুশীলন কার্যক্রমে খুবই কার্যকর। তাঁর ফলাবর্তন মডেলটি শিক্ষক প্রশিক্ষণের শিখন-শেখানো কার্যক্রম উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকগণের আত্মমূল্যায়ন এবং ঘনিষ্টভাবে পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন শিখন-শেখানো কার্যক্রম এবং অনুশীলন পাঠদান চলাকালীন শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে জন হেরন ফলাবর্তন মডেলটি ব্যবহৃত হয়। 

  • জন হেরনের ফিডব্যাক মডেলে শিক্ষক প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক, সতীর্থ সহকর্মী, বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষক বা সহযোগী শিক্ষক পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থাকবেন।
  • জন হেরনের মডেলের ৩টি স্তর একটি নির্দেশিত ক্রম অনুসরণ করে।
চিত্র: জন হেরনের ফিডব্যাক মডেল

১. শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার পূর্বে করণীয় 

প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক এবং পর্যবেক্ষক একত্রে বসে দ আলোচনা করে পূর্বেই শিক্ষণের কিছু দক্ষতা ফলাবর্তনের বা নির্ণায়ক নির্ধারণ করে নেবেন। নির্বাচিত নির্ণায়কগুলো সুনির্দিষ্ট পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নসংশ্লিষ্ট হতে হবে এবং পাঠদানের সময় পর্যবেক্ষণে মূল্যায়ন করা হবে।

২. শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনাকালীন করণীয়

প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষণ কার্যক্রম শেষ করার মধ্যে প্রশিক্ষক ও পর্যবেক্ষক তার পাঠের ভুলত্রুটিগুলো শনাক্ত করে নোট খাতায় লিখে রাখেন।   এ ছাড়া পাঠের সবলদিক এবং বিষয়বস্তুর জ্ঞানের শিক্ষণ কৌশল সম্পর্কে মতামত লিখে রাখেন।

৩. শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা শেষে করণীয় 

  • শিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক, প্রশিক্ষক বা পর্যবেক্ষক আলোচনায় বসবেন;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক ও পর্যবেক্ষক পূর্বে নির্ধারিত নির্ণায়কের ভিত্তিতে তার গঠনমূলক ফলাবর্তন পেশ করেন এবং পাঠের ভুলত্রুটি তুলে ধরেন;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক নির্ণায়কের ভিত্তিতে তার শিক্ষণ সম্পর্কে অনুধাবন করবেন এবং শিক্ষণের সবল ও দুর্বল দিকগুলো ব্যক্ত করে উন্নয়নে আর কী করা যেতে পারে তা বলবেন;
  • পর্যবেক্ষকগণ শিক্ষণ দক্ষতার উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক পরামর্শ দেবেন;
  • পর্যবেক্ষক প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকের শিক্ষণ কার্যক্রমের ওপর গঠনমূলক মন্তব্য এবং বর্ণনামূলক ফলাবর্তন দেবেন;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক পর্যবেক্ষকের মন্তব্যের আলোকে পরবর্তী শিক্ষণ কার্যক্রম উন্নয়নে সম্মত হবেন।

ফলাবর্তনের বা ফিডব্যাকের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা

  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক পর্যবেক্ষকের ফলাবর্তনের সময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে তার বক্তব্য শুনবেন পরে তিনি ‘ভালো’এবং ‘কম প্রয়োজন’ এ সংক্রান্ত মন্তব্য করতে পারবেন;
  • পর্যবেক্ষকও প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকের ফলাবর্তনের সময় কোন বাধা না দিয়ে শুনবেন;
  • ফলাবর্তনের জন্য প্রয়োজন দায়িত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক আচরণ। দুর্বল দিক নিয়ে আলোচনার আগে সবল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন;
  • সুনির্দিষ্ট দক্ষতার ওপর আলোচনা করা উচিত;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক যে বিষয়গুলো আগে উল্লেখ করেছেন পর্যবেক্ষকের সে দিকগুলো পুনরায় আলোচনা না করা
  • ফলাবর্তন হওয়া উচিত পূর্বনির্ধারিত নির্ণায়ক বা শর্ত অনুসারে;
  • ফলাবর্তন হবে গঠনমূলক এবং সহজ, সুনির্দিষ্ট ও বর্ণনামূলক;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক অনুশীলন পাঠদান চলাকালীন শিক্ষক প্রশিক্ষক, সতীর্থ প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে এ মডেলের ভিত্তিতে ফলাবর্তন পেতে পারেন যা তার শিক্ষণ দক্ষতার সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে সহায়তা করবে।

পেশাগত বা আত্মউন্নয়নের জন্য  পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ফিডব্যাক বা ফলাবর্তনের চর্চা থাকা খুবই জরুরি, এতে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা বা সংশোধনমূলক ব্যবস্থা সম্ভব হয়।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

ফিডব্যাক বা ফলাবর্তন গ্রহণ ও প্রদান পদ্ধতি এবং জন হেরনের ফিডব্যাক মডেল

প্রকাশ: ০৪:২২:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ নভেম্বর ২০২১

ফলাফর্তন কিংবা ফিডব্যাক হলো এমন একটি মাধ্যম বা তথ্য ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কারো ব্যক্তিগত পেশাগত উন্নতি বা অবনতি সম্পর্কে জানা যায়। এই নিবন্ধে ফলাবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক কী? (What Is Feedback?) 

সাধারণভাবে একটি কাজের সম্পাদন প্রক্রিয়া এবং সম্পাদনের ফলাফল সম্পর্কে অন্যের মন্তব্য যা সম্পাদনকারীকে পরবর্তীতে কর্ম সম্পাদনের মান উন্নয়নে সহায়তা করে তাকে ফলাবর্তন বলা হয়। 

অন্যভাবে বলা যায়, পেশাগত উন্নয়নের লক্ষ্যে নিজের কাজের সবলতা-দুর্বলতা চিহ্নিত করার জন্য পেশাগতভাবে অভিজ্ঞ অন্যকে পর্যবেক্ষণ করিয়ে সে অনুযায়ী পরবর্তীতে যে সংশোধনমূলক ব্যবস্থাা নেওয়া তার সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে ফলাবর্তন বলা হয়। ফলাবর্তনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ফিডব্যাক  (feedback)।

যে-কোনো পেশাগত উন্নয়নের একটি আধুনিক ও কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক (feedback)। শিক্ষক প্রশিক্ষণে ফলাবর্তনের ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্যণীয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে ফিডব্যাক কী? (What Is Feedback in Education?)

ফলাবর্তন শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা প্রশিক্ষণার্থী, প্রত্যেকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ফলাবর্তন হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা প্রশিক্ষণার্থীদের দক্ষতা এবং পারদর্শীতার ভালো-মন্দ  ও উন্নয়ন-অবনতি সংক্রান্ত তথ্য যা বিপরিত প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত হয়।

শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক প্রদান করেন আবার শিক্ষক নিজেও শিক্ষার্থীদের থেকে ফিডব্যাক গ্রহণ করেন।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক পাঠদানকালে এবং পাঠদান শেষে শিক্ষার্থীদের এবং সতীর্থ শিক্ষকগণের নিকট থেকে মতামত, মূল্যায়ন, সমালোচনা, ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, নির্দেশনা ইত্যাদি আশা করেন। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকের পাঠদানের ওপর সতীর্থ শিক্ষকের, প্রশিক্ষকের কিংবা শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত মতামত, মূল্যায়ন, সমালোচনা, ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, নির্দেশনাকে ফলাবর্তন বলা হবে।

শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে যে কাজগুলো করেন তা তিনি পূর্ব পরিকল্পনা করে, অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সম্পাদন করে থাকেন। কিন্তু তার সেই কাজগুলো সত্যিই যথাযথভাবে সম্পাদন হচ্ছে কি না তা পাঠদানকারী শিক্ষক নিশ্চিত হতে পারেন না। কারণ তিনি নিজের সফলতা বা ব্যর্থতা চিহ্নিত করতে পারেন না। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এই পেশার অন্যজন যদি শিখন-শেখানো কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এ বিষয়ে পরামর্শ দেন, ভুল থাকলে সংশোধন করে দেন, ভাল কাজগুলোর জন্য প্রশংসা করেন এবং উৎসাহ দেন তাহলে পাঠদানকারী শিক্ষক পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারেন।

ফিডব্যাক গ্রহণ ও প্রদান পদ্ধতি

ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলাবর্তন শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। কার্যকর ফলাবর্তনের জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে- 

শিক্ষাক্ষেত্রে ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। | ছবি: Unsplash
  • পর্যবেক্ষক এবং পর্যবেক্ষিত শিক্ষক উভয়ই আলোচনা করে পাঠদানের পূর্বে শিখন-শেখানোর কিছু দক্ষতা ও কৌশলকে ফলাবর্তনের নির্ণায়ক হিসেবে চিহ্নিত করবেন; 
  • পর্যবেক্ষিত শিক্ষকের প্রত্যাশা অনুসারে চিহ্নিত দক্ষতা ও কৌশলগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণকারী শিক্ষকের সাথে আলোচনা করবেন;
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রম চলাকালীন পর্যবেক্ষক কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করবেন তা পূর্বে নির্ধারণ করবেন;
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রম রেকর্ড করতে চাইলে পূর্বেই পর্যবেক্ষিত শিক্ষকের সাথে আলোচনা করে নিবেন;
  • পর্যবেক্ষণ চলাকালীন সবল-দুর্বল দিকসমূহের নোট রাখবেন;
  • পাঠদান চলাকালীন কোন কথা বা মন্তব্য করে পাঠের সাবলীলতা ও গতিশীলতা ব্যহত করা যুক্তিসঙ্গত হবে না;
  • শিক্ষার্থীদের সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে পাঠদান কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যাবে না;
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রম শেষে পর্যবেক্ষক এবং পর্যবেক্ষিত শিক্ষক একসাথে বসে পূর্বনির্ধারিত নির্ণায়ক অনুসারে গঠনমূলক ফলাবর্তন দিবেন এবং ফলাবর্তন গ্রহণ করবেন;
  • সকল পর্যবেক্ষিত শিক্ষককে ভিন্নভাবে ফলাবর্তন দিতে হবে।

ফলাবর্তনের উপযোগিতা কী বা ফলাবর্তন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এটি প্রমাণিত যে, ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক (Feedback) শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলাবর্তন শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। ফলাবর্তন যেমন শিক্ষার্থীদের শিখন বুঝতে সহযোগিতা করে, তেমনই শিখন নির্দেশনা সম্পর্কেও ধারণা লাভ করতে পারে।

  • গুণগত পাঠদান ও কার্যকর শিখনের জন্য ফলাবর্তন গুরুত্বপূর্ণ;
  • মূল্যায়ন করার কৌশল রপ্ত হয়;
  • আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ দক্ষতার উন্নতি হয়;
  • সমালোচনা বা নেতিবাচক মন্তব্য গ্রহণ করা বা মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ হয়;
  • অর্জিত শিখনফল জানা যায়;
  • শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যোগাযোগ বৃদ্ধি করে;
  • প্রশিক্ষণার্থীর মনোভাব বোঝা যায়;
  • প্রশিক্ষণার্থীর চাহিদা নিরূপণ করা যায়;
  • প্রশিক্ষক সম্পর্কে জানা যায়।

ফলপ্রসূ ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক প্রদান কৌশল

ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক হলো প্রশিক্ষণের একটি বিষয়। ফলাবর্তনের মাধ্যমে প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী, শিক্ষার্থী নির্বিশেষে সবাই উপকৃত হয়। শিখন-শেখানোর গুনগত উন্নয়নে ফলাবর্তন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে তাই প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী ও কর্মসূচির উন্নয়ন ঘটাতে হলে ফলাবর্তনের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। ফলপ্রসূফলাবর্তন প্রদান করার জন্য নিম্নলিখিত কৌশলগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে।

  • পাঠদানের ফলাবর্তন প্রদান করার ক্ষেত্রে প্রথম থেকে ক্লাসে থাকতে হবে;
  • কোন কোন দিক বিবেচনা করে ফলাবর্তন দেওয়া হচ্ছে তা উল্লেখ করতে হবে;
  • খণ্ডিতভাবে ফলাবর্তন প্রদান করা উচিত নয়;
  • পূর্ব থেকেই ফলাবর্তনের নির্দিষ্ট নির্ণায়ক থাকা উচিত;
  • ফলাবর্তন অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে;
  • ফলাবর্তনে প্রথমে ইতিবাচক দিক এবং পরে নেতিবাচক দিক বলা উচিত;
  • ফলাবর্তন শুধু বিদ্যমান গুণ বা দোষ প্রকাশ করেনা, ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনাও থাকে।

জন হেরনের ফিডব্যাক মডেল

Pজন হেরন একজন বিখ্যাত গবেষক ও শিক্ষাবিদ। তিনি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান পোটেনশিয়াল রিসার্চ (Human Potential Research Project)-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। তিনি অংশগ্রহণমূলক গবেষণার প্রবক্তা হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিত। ফলাবর্তন পদ্ধতিটি পাঠদান অনুশীলন কার্যক্রমে খুবই কার্যকর। তাঁর ফলাবর্তন মডেলটি শিক্ষক প্রশিক্ষণের শিখন-শেখানো কার্যক্রম উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকগণের আত্মমূল্যায়ন এবং ঘনিষ্টভাবে পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন শিখন-শেখানো কার্যক্রম এবং অনুশীলন পাঠদান চলাকালীন শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে জন হেরন ফলাবর্তন মডেলটি ব্যবহৃত হয়। 

  • জন হেরনের ফিডব্যাক মডেলে শিক্ষক প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক, সতীর্থ সহকর্মী, বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষক বা সহযোগী শিক্ষক পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থাকবেন।
  • জন হেরনের মডেলের ৩টি স্তর একটি নির্দেশিত ক্রম অনুসরণ করে।
চিত্র: জন হেরনের ফিডব্যাক মডেল

১. শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার পূর্বে করণীয় 

প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক এবং পর্যবেক্ষক একত্রে বসে দ আলোচনা করে পূর্বেই শিক্ষণের কিছু দক্ষতা ফলাবর্তনের বা নির্ণায়ক নির্ধারণ করে নেবেন। নির্বাচিত নির্ণায়কগুলো সুনির্দিষ্ট পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নসংশ্লিষ্ট হতে হবে এবং পাঠদানের সময় পর্যবেক্ষণে মূল্যায়ন করা হবে।

২. শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনাকালীন করণীয়

প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষণ কার্যক্রম শেষ করার মধ্যে প্রশিক্ষক ও পর্যবেক্ষক তার পাঠের ভুলত্রুটিগুলো শনাক্ত করে নোট খাতায় লিখে রাখেন।   এ ছাড়া পাঠের সবলদিক এবং বিষয়বস্তুর জ্ঞানের শিক্ষণ কৌশল সম্পর্কে মতামত লিখে রাখেন।

৩. শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা শেষে করণীয় 

  • শিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক, প্রশিক্ষক বা পর্যবেক্ষক আলোচনায় বসবেন;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক ও পর্যবেক্ষক পূর্বে নির্ধারিত নির্ণায়কের ভিত্তিতে তার গঠনমূলক ফলাবর্তন পেশ করেন এবং পাঠের ভুলত্রুটি তুলে ধরেন;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক নির্ণায়কের ভিত্তিতে তার শিক্ষণ সম্পর্কে অনুধাবন করবেন এবং শিক্ষণের সবল ও দুর্বল দিকগুলো ব্যক্ত করে উন্নয়নে আর কী করা যেতে পারে তা বলবেন;
  • পর্যবেক্ষকগণ শিক্ষণ দক্ষতার উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক পরামর্শ দেবেন;
  • পর্যবেক্ষক প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকের শিক্ষণ কার্যক্রমের ওপর গঠনমূলক মন্তব্য এবং বর্ণনামূলক ফলাবর্তন দেবেন;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক পর্যবেক্ষকের মন্তব্যের আলোকে পরবর্তী শিক্ষণ কার্যক্রম উন্নয়নে সম্মত হবেন।

ফলাবর্তনের বা ফিডব্যাকের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা

  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক পর্যবেক্ষকের ফলাবর্তনের সময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে তার বক্তব্য শুনবেন পরে তিনি ‘ভালো’এবং ‘কম প্রয়োজন’ এ সংক্রান্ত মন্তব্য করতে পারবেন;
  • পর্যবেক্ষকও প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকের ফলাবর্তনের সময় কোন বাধা না দিয়ে শুনবেন;
  • ফলাবর্তনের জন্য প্রয়োজন দায়িত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক আচরণ। দুর্বল দিক নিয়ে আলোচনার আগে সবল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন;
  • সুনির্দিষ্ট দক্ষতার ওপর আলোচনা করা উচিত;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক যে বিষয়গুলো আগে উল্লেখ করেছেন পর্যবেক্ষকের সে দিকগুলো পুনরায় আলোচনা না করা
  • ফলাবর্তন হওয়া উচিত পূর্বনির্ধারিত নির্ণায়ক বা শর্ত অনুসারে;
  • ফলাবর্তন হবে গঠনমূলক এবং সহজ, সুনির্দিষ্ট ও বর্ণনামূলক;
  • প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক অনুশীলন পাঠদান চলাকালীন শিক্ষক প্রশিক্ষক, সতীর্থ প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে এ মডেলের ভিত্তিতে ফলাবর্তন পেতে পারেন যা তার শিক্ষণ দক্ষতার সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে সহায়তা করবে।

পেশাগত বা আত্মউন্নয়নের জন্য  পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ফিডব্যাক বা ফলাবর্তনের চর্চা থাকা খুবই জরুরি, এতে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা বা সংশোধনমূলক ব্যবস্থা সম্ভব হয়।