০৯:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

তবে কি তুমি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই

  • প্রকাশ: ১১:১৫:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ নভেম্বর ২০২১
  • / ৭৮৭ বার পড়া হয়েছে

বাঙালির ইতিহাস গৌরবের আর ঐতিহ্যের ইতিহাস। এই ইহিাস ভুলে কীভাবে বিপথে যাবে তুমি? তবে কি তুমি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই... এই ইতিহাস ভুলে যাব... আমি কি তেমন সন্তান... যখন আমার পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ সামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ শীর্ষক কবিতার একটি লাইন আমার আজকের লেখার শিরোনাম। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের ইতিহাসে এ দেশে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং অন্য ধার্মাবলম্বীরা একসঙ্গে সম্প্রীতির মধ্যদিয়ে বসবাস করে আসছে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে লড়াই সংগ্রাম করেছে। ইতিহাস পড়তে পড়তে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি নির্বিশেষে এ অঞ্চলের মানুষের পরিচয় ছিল ‘বাঙালি’ হিসেবে; ধর্মীয় পরিচয়ে নয়। ধর্ম আমাদের পবিত্র হতে শিখিয়েছে, অনুগত করেছে; কিন্তু জাতীয়তার পরিচয় আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে শক্তি-সাহস যুগিয়েছে। বাঙালি কখনও পরাজয় মেনে নেয়নি। অন্যায়-অত্যাচার আর অবিচারের বিরেুদ্ধে বিদ্রোহ করা বাঙালির বৈশিষ্ট্য।

বাঙালি জাতীর ইতিহাসে গঙ্গারিডি থেকে বঙ্গ, গৌড়, সমতট, হরিকেল, পুন্ড্রবর্ধন বিভিন্ন জনপদ বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর দ্বারা শাসিত হয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ রাজাদের দ্বারা শাসিত এসব সাম্রাজ্য ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সম্রাট শশাংক তিনটি (গৌড় বঙ্গ ও সমতট) জনপদকে একত্রিত করে ‘বঙ্গ’ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে শাসন করে। ১২০৪ সালে মুসলমান সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন। এর আগে পর্যন্ত বাঙলা শাসিত হয়েছে হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজাদের দ্বারা।

১২০৫ সালে বখতিয়ার খিলজি গৌড়কে বাংলার রাজধানী করেছিল। লক্ষণ সেন পরবর্তী সময়ে বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ) দখল করে সেখানে তাদের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। যশোহরের রাজা প্রদাপাদিত্য ও বর্ধমানের রাজা সীতারাম রায় মোগল আমলেও বাংলায় কিছু কিছু জনপদ শাসন করেছে। উল্লেখ্য, মুসলমান সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ছিলেন তুর্কি যোদ্ধা। তরবারি নিয়ে রাজ্য জয় করতে বাংলায় এসেছিল। সে বাঙালি ছিল না।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে গুপ্ত, পাল-সেন, সুলতান, ব্রিটিশরা বাংলা শাসন করেছে। প্রত্যেক শাসকই বাংলায় তাদের শাসন চিহ্ন রেখে গেছেন। গুপ্ত যুগের হিন্দু রাজাদের নির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে উজ্জ্বল নিদর্শন বহন করে চলেছে। পাল যুগে বৌদ্ধ রাজাদের সোমপুর বৌদ্ধ বিহার (পাহাড়পুর), জগদ্দল বিহার, তাম্রলিপি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বাংলায় বিদ্যমান। সেন যুগের সংস্কৃত কবি জয়দেবের ‘গীতা গোবিন্দ’ বিখ্যাত সৃষ্টি। বিক্রমপুরকে রাজধানী করে বাংলাকে পৃথক মর্যাদা দিয়েছিল সেন রাজারা। সুলতানী আমলে শামসুদ্দিন ইলিয়াছ শাহ বঙ্গকে ‘বাঙ্গালাহ’ নামে একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল ঘোষণা করেছিলেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁকে বাংলার রাজধানী করেছিলেন। মোগল আমলে ইসলাম খাঁ ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করেছিল ১৬০৮ সালে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ইসলাম খাঁ সুবেদার হয়েছিলেন বলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে নাম দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর।

এই বাংলাদেশে কিশোরগঞ্জের ইটনার সন্তান সমাজ সংস্কারক, আইনবিদ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা রাজনীতিক আনন্দ মোহন বসু ময়মনসিংহে নিজের নামে আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সব শ্রেণি গোত্র ধর্মের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়াশোনা করছে। বরিশালের কৃতী সন্তান প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ অশনি কুমার দত্ত ‘সত্য প্রেম ও পবিত্রতা’ এই ধারণা লালন করে নিজের পিতার নামে ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন কলেজ (বিএম)। বাংলাদেশের এক গৌরবজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান বিএম কলেজ। সিলেটের রাজা গিরিশ চন্দ্র রয় তার নানার নামে ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মুরারি চাঁদ কলেজ (এমসি)। সিলেটের জনগণের শিক্ষার অভাব মোচনের উদ্দেশে রাজা গিরিশ চন্দ্র রয় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুন্সীগঞ্জের কৃতী সন্তান আশুতোশ গাঙ্গুলি ১৯৩৮ সালে বাবা হরনাথ গাঙ্গুলি ও মা গঙ্গাশ্বরি দেবির নামে হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার অভাব পূরণ করাই ছিল আশুতোশ গাঙ্গুলির উদ্দেশ্য। কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ হিন্দু রাজাদের অবদান। নারায়ণগঞ্জের খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ১৯৩৭ সালে বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তোলারাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মা স্কুল মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল চৌধুরী তার বাবার নামে প্রথমে জগন্নাথ স্কুল পরে জগন্নাথ কলেজ নামকরণ করেন। বাংলায় শিক্ষা বিস্তারে হিন্দু জমিদার ও বিদ্যোৎসাহী রাজাদের অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি মুসলমান রাজা ও বিদ্যোৎসাহী দানবির ব্যক্তিদের অবদানেই ১৯২১ সালে নওয়াব নবাব আলীসহ অনেকের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। মাদার বখস্সহ আরও অনেক বিদ্যোৎসাহীদের ইচ্ছায় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহী বিশবিদ্যালয়। হিন্দু, মুসলামানের সম্মিলিত অবদানেই বাংলায় শিক্ষার প্রসার ঘটেছে।

এই বাংলায় সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.), হজরত শাহপরাণ (রহ.), বাগেরহাটে খান জাহান আলী (রহ.), চট্টগ্রামে বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-এর মতো ধর্ম প্রচারকের আগমনে বাংলার মাটি পবিত্র হয়েছে। অন্যদিকে কুষ্টিয়ায় লালন, সুনামগঞ্জে রাধারমণ, হাছন রাজা, দিরাইয়ে শাহ আবদুল করিমের জন্ম এদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। মাদারের গান, গাজন, কির্তন, যাত্রাপালা, বৈশাখী মেলা, ঘোড়াদৌড়, নৌকাবাইচ আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে এসব পেয়েছি। আমাদের পূর্ব-পুরুষরা ধুতি পাঞ্জাবি পরে বছরের শেষ দিনে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করত। পহেলা বৈশাখে হালখাতায় মিষ্টি-বাতাশা খেয়ে মোড়ল শেখ ঠাকুর সুত্রধর একসঙ্গে বাড়ি ফিরত। পূজা, জন্মাষ্টমী, ইদ কিংবা বড়োদিনে একই আনন্দ হতো। বাঙালি সংস্কৃতি একই ধারায় প্রবাহিত। ভূপেন হাজারিকার গানের মতো… গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা… দুই চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা যমুনা…। হিন্দু-মুসলমান পরস্পর সম্প্রীতির নাম। একই মায়ের দুই চোখে দুই জলের ধারা।

এই বাংলায় রচিত হয়েছে মনসামঙ্গল, পদ্মাবতী, শ্রীকৃষ্ণ কির্তন, রাধা-কৃষ্ণ, লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, মহাভারত, রামায়ণ। মহাকবি আলাওয়াল, আবদুল হাকিম, শাহ সুলতান, ফকির গরিবুল্লাহ, শাহ মো. সগীর এই মাটির কবি। পুরাণ, পুঁথি রচিত হয়েছে এই মাটি জলের জীবন কাহিনি থেকে। চাঁদ সওদাগর, গাজী কালু চম্পাবতি, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর আমাদের সংস্কৃতির অংশ। ময়নামতি, মহাস্থানগড়, সোনামসজিদ, আতিয়া জামে মসজিদ, ঢাকেশ্বরী আমাদের ধর্ম-কর্মের ফল। প্রতিমায় কোরআন শরিফ দিয়ে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। মসজিদণ্ডমন্দির-গির্জা-প্যাগোডা আমাদের ঠিকানা। বাঙালির জাতির ইতিহাস আমাদের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান শিখিয়েছে। আমরা বিপথে গেলে আশ্রয় নেই মহাগ্রন্থ আল কোরআন, গীতাণ্ডবাইবেল ত্রিপিটকের কাছে। অনুসরণ করি প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.), যিষু, গৌতম বুদ্ধ, শীব আর গুরু নানককে।

’৪৬-৪৭-এ আমরা পাশপাশি ছিলাম, একজন অন্যজনকে রক্ষা করেছি। চৌষট্টিতে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ থেকেছি, বুকে বুক লাগিয়ে ঠেকিয়েছি দাঙা। একাত্তুরে হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে লড়েছি। বাহাত্তুরে সম্প্রীতিতে ভ্রাতৃত্ববোধে মিলেমিশে সংবিধান করেছি। সকলের তরে সকলে আমরা… এত সহজেই সম্প্রীতি ভেঙে যাবে? তাহলে রংপুরের নূরুলদীন, ফরিদপুরের হাজী শরিয়তুল্লাহ, চট্টগ্রামের সূর্যসেন, প্রীতিলতা আর নুর হোসেনের ত্যাগ সংগ্রাম আর সাহস আমাদের ক্ষমা করবে না। বাঙালির ইতিহাস গৌরবের আর ঐতিহ্যের ইতিহাস। এই ইহিাস ভুলে কীভাবে বিপথে যাবে তুমি? তবে কি তুমি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই… এই ইতিহাস ভুলে যাব… আমি কি তেমন সন্তান… যখন আমার পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

তবে কি তুমি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই

প্রকাশ: ১১:১৫:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ নভেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ সামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ শীর্ষক কবিতার একটি লাইন আমার আজকের লেখার শিরোনাম। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের ইতিহাসে এ দেশে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং অন্য ধার্মাবলম্বীরা একসঙ্গে সম্প্রীতির মধ্যদিয়ে বসবাস করে আসছে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে লড়াই সংগ্রাম করেছে। ইতিহাস পড়তে পড়তে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি নির্বিশেষে এ অঞ্চলের মানুষের পরিচয় ছিল ‘বাঙালি’ হিসেবে; ধর্মীয় পরিচয়ে নয়। ধর্ম আমাদের পবিত্র হতে শিখিয়েছে, অনুগত করেছে; কিন্তু জাতীয়তার পরিচয় আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে শক্তি-সাহস যুগিয়েছে। বাঙালি কখনও পরাজয় মেনে নেয়নি। অন্যায়-অত্যাচার আর অবিচারের বিরেুদ্ধে বিদ্রোহ করা বাঙালির বৈশিষ্ট্য।

বাঙালি জাতীর ইতিহাসে গঙ্গারিডি থেকে বঙ্গ, গৌড়, সমতট, হরিকেল, পুন্ড্রবর্ধন বিভিন্ন জনপদ বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর দ্বারা শাসিত হয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ রাজাদের দ্বারা শাসিত এসব সাম্রাজ্য ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সম্রাট শশাংক তিনটি (গৌড় বঙ্গ ও সমতট) জনপদকে একত্রিত করে ‘বঙ্গ’ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে শাসন করে। ১২০৪ সালে মুসলমান সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন। এর আগে পর্যন্ত বাঙলা শাসিত হয়েছে হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজাদের দ্বারা।

১২০৫ সালে বখতিয়ার খিলজি গৌড়কে বাংলার রাজধানী করেছিল। লক্ষণ সেন পরবর্তী সময়ে বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ) দখল করে সেখানে তাদের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। যশোহরের রাজা প্রদাপাদিত্য ও বর্ধমানের রাজা সীতারাম রায় মোগল আমলেও বাংলায় কিছু কিছু জনপদ শাসন করেছে। উল্লেখ্য, মুসলমান সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ছিলেন তুর্কি যোদ্ধা। তরবারি নিয়ে রাজ্য জয় করতে বাংলায় এসেছিল। সে বাঙালি ছিল না।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে গুপ্ত, পাল-সেন, সুলতান, ব্রিটিশরা বাংলা শাসন করেছে। প্রত্যেক শাসকই বাংলায় তাদের শাসন চিহ্ন রেখে গেছেন। গুপ্ত যুগের হিন্দু রাজাদের নির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে উজ্জ্বল নিদর্শন বহন করে চলেছে। পাল যুগে বৌদ্ধ রাজাদের সোমপুর বৌদ্ধ বিহার (পাহাড়পুর), জগদ্দল বিহার, তাম্রলিপি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বাংলায় বিদ্যমান। সেন যুগের সংস্কৃত কবি জয়দেবের ‘গীতা গোবিন্দ’ বিখ্যাত সৃষ্টি। বিক্রমপুরকে রাজধানী করে বাংলাকে পৃথক মর্যাদা দিয়েছিল সেন রাজারা। সুলতানী আমলে শামসুদ্দিন ইলিয়াছ শাহ বঙ্গকে ‘বাঙ্গালাহ’ নামে একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল ঘোষণা করেছিলেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁকে বাংলার রাজধানী করেছিলেন। মোগল আমলে ইসলাম খাঁ ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করেছিল ১৬০৮ সালে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ইসলাম খাঁ সুবেদার হয়েছিলেন বলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে নাম দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর।

এই বাংলাদেশে কিশোরগঞ্জের ইটনার সন্তান সমাজ সংস্কারক, আইনবিদ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা রাজনীতিক আনন্দ মোহন বসু ময়মনসিংহে নিজের নামে আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সব শ্রেণি গোত্র ধর্মের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়াশোনা করছে। বরিশালের কৃতী সন্তান প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ অশনি কুমার দত্ত ‘সত্য প্রেম ও পবিত্রতা’ এই ধারণা লালন করে নিজের পিতার নামে ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন কলেজ (বিএম)। বাংলাদেশের এক গৌরবজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান বিএম কলেজ। সিলেটের রাজা গিরিশ চন্দ্র রয় তার নানার নামে ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মুরারি চাঁদ কলেজ (এমসি)। সিলেটের জনগণের শিক্ষার অভাব মোচনের উদ্দেশে রাজা গিরিশ চন্দ্র রয় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুন্সীগঞ্জের কৃতী সন্তান আশুতোশ গাঙ্গুলি ১৯৩৮ সালে বাবা হরনাথ গাঙ্গুলি ও মা গঙ্গাশ্বরি দেবির নামে হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার অভাব পূরণ করাই ছিল আশুতোশ গাঙ্গুলির উদ্দেশ্য। কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ হিন্দু রাজাদের অবদান। নারায়ণগঞ্জের খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ১৯৩৭ সালে বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তোলারাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মা স্কুল মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল চৌধুরী তার বাবার নামে প্রথমে জগন্নাথ স্কুল পরে জগন্নাথ কলেজ নামকরণ করেন। বাংলায় শিক্ষা বিস্তারে হিন্দু জমিদার ও বিদ্যোৎসাহী রাজাদের অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি মুসলমান রাজা ও বিদ্যোৎসাহী দানবির ব্যক্তিদের অবদানেই ১৯২১ সালে নওয়াব নবাব আলীসহ অনেকের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। মাদার বখস্সহ আরও অনেক বিদ্যোৎসাহীদের ইচ্ছায় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহী বিশবিদ্যালয়। হিন্দু, মুসলামানের সম্মিলিত অবদানেই বাংলায় শিক্ষার প্রসার ঘটেছে।

এই বাংলায় সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.), হজরত শাহপরাণ (রহ.), বাগেরহাটে খান জাহান আলী (রহ.), চট্টগ্রামে বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-এর মতো ধর্ম প্রচারকের আগমনে বাংলার মাটি পবিত্র হয়েছে। অন্যদিকে কুষ্টিয়ায় লালন, সুনামগঞ্জে রাধারমণ, হাছন রাজা, দিরাইয়ে শাহ আবদুল করিমের জন্ম এদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। মাদারের গান, গাজন, কির্তন, যাত্রাপালা, বৈশাখী মেলা, ঘোড়াদৌড়, নৌকাবাইচ আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে এসব পেয়েছি। আমাদের পূর্ব-পুরুষরা ধুতি পাঞ্জাবি পরে বছরের শেষ দিনে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করত। পহেলা বৈশাখে হালখাতায় মিষ্টি-বাতাশা খেয়ে মোড়ল শেখ ঠাকুর সুত্রধর একসঙ্গে বাড়ি ফিরত। পূজা, জন্মাষ্টমী, ইদ কিংবা বড়োদিনে একই আনন্দ হতো। বাঙালি সংস্কৃতি একই ধারায় প্রবাহিত। ভূপেন হাজারিকার গানের মতো… গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা… দুই চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা যমুনা…। হিন্দু-মুসলমান পরস্পর সম্প্রীতির নাম। একই মায়ের দুই চোখে দুই জলের ধারা।

এই বাংলায় রচিত হয়েছে মনসামঙ্গল, পদ্মাবতী, শ্রীকৃষ্ণ কির্তন, রাধা-কৃষ্ণ, লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, মহাভারত, রামায়ণ। মহাকবি আলাওয়াল, আবদুল হাকিম, শাহ সুলতান, ফকির গরিবুল্লাহ, শাহ মো. সগীর এই মাটির কবি। পুরাণ, পুঁথি রচিত হয়েছে এই মাটি জলের জীবন কাহিনি থেকে। চাঁদ সওদাগর, গাজী কালু চম্পাবতি, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর আমাদের সংস্কৃতির অংশ। ময়নামতি, মহাস্থানগড়, সোনামসজিদ, আতিয়া জামে মসজিদ, ঢাকেশ্বরী আমাদের ধর্ম-কর্মের ফল। প্রতিমায় কোরআন শরিফ দিয়ে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। মসজিদণ্ডমন্দির-গির্জা-প্যাগোডা আমাদের ঠিকানা। বাঙালির জাতির ইতিহাস আমাদের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান শিখিয়েছে। আমরা বিপথে গেলে আশ্রয় নেই মহাগ্রন্থ আল কোরআন, গীতাণ্ডবাইবেল ত্রিপিটকের কাছে। অনুসরণ করি প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.), যিষু, গৌতম বুদ্ধ, শীব আর গুরু নানককে।

’৪৬-৪৭-এ আমরা পাশপাশি ছিলাম, একজন অন্যজনকে রক্ষা করেছি। চৌষট্টিতে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ থেকেছি, বুকে বুক লাগিয়ে ঠেকিয়েছি দাঙা। একাত্তুরে হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে লড়েছি। বাহাত্তুরে সম্প্রীতিতে ভ্রাতৃত্ববোধে মিলেমিশে সংবিধান করেছি। সকলের তরে সকলে আমরা… এত সহজেই সম্প্রীতি ভেঙে যাবে? তাহলে রংপুরের নূরুলদীন, ফরিদপুরের হাজী শরিয়তুল্লাহ, চট্টগ্রামের সূর্যসেন, প্রীতিলতা আর নুর হোসেনের ত্যাগ সংগ্রাম আর সাহস আমাদের ক্ষমা করবে না। বাঙালির ইতিহাস গৌরবের আর ঐতিহ্যের ইতিহাস। এই ইহিাস ভুলে কীভাবে বিপথে যাবে তুমি? তবে কি তুমি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই… এই ইতিহাস ভুলে যাব… আমি কি তেমন সন্তান… যখন আমার পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।