সোমবার, জুন ৫, ২০২৩

পরিবেশ কাকে বলে? প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান কী?

অধিক জনসংখ্যার কারণে নবায়নযোগ্য নয় এমন সম্পদের উপর বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাপ বাড়ছে; ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ বিপন্ন।

আমাদের চারপাশে যা কিছু রয়েছে সব কিছু মিলেই আমাদের পরিবেশ। এই পরিবেশের অনেক কিছুই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই আবার কিছু উপাদান দেখতে হলে যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। আবার এমন কিছু আছে যা অদৃশ্যমান, আমরা কখনোই সেগুলো দেখতে পাই না। নিচে পরিবেশ কী বা পরিবেশের হসংজ্ঞা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

পরিবেশের সংজ্ঞা

ভূপৃষ্ঠস্থ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য যাবতীয় জৈব ও অজৈব পদার্থের সমন্বয়ে পরিবেশ গঠিত। অজৈব পদার্থের আওতাভূক্ত বিষয়সমূহের মধ্যে পানি, বায়ুমন্ডল ও শিলা-মৃত্তিকা অন্যতম।

বায়ুমন্ডল অদৃশ্য হলেও, শিলা-মৃত্তিকা ও পানি দৃশ্যমান। পানি, বায়ুমন্ডল ও শিলা-মৃত্তিকা সম্মিলিতভাবে জৈব পরিবেশের ভিত্তি গড়ে তুলেছে। পরিবেশকে তার গঠন মৌলের আলোকে জৈব ও অজৈব এ দুই পরিবেশে ভাগ করা যায়। অজৈব পরিবেশ মূলতঃ প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলে।

পানি, শিলা ও বায়ুমন্ডল প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রধান গঠনকারী উপাদান। অপরদিকে, এ সব প্রাকৃতিক পরিবেশ গঠনকারী উপাদানই আবার সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের গঠন ভিত্তি গড়ে তোলে এবং শক্তি ও খনিজজোগানের মাধ্যমে পরিবেশ টিকিয়ে রেখেছে।

মানুষ বা অন্যান্য জীব যে পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বসবাস করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, তাকে পরিবেশ বলে।

কোনো এলাকায় পরিবেশ বলতে ঐ এলাকার ঘর-বাড়ি, প্রসিদ্ধস্থান, রাস্তাঘাট, মানুষ, তাদের জীবনযাত্রার মান, কৃষ্টি, আচার-আচরণ সব কিছুকে বোঝায় ।

মাসটন বেটস-এর মতে, পরিবেশ হলো সেই সব বাহ্যিক অবস্থার সমষ্টি যা জীবনের বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে ।

পরিবেশের প্রকৃতি

পরিবেশের প্রকৃতি বলতে এর গঠনকারী উপাদানসমূহের প্রকৃতিই বুঝানো হয়। প্রাকৃতিক ও জৈব এই উভয় পরিবেশই আপাত: সহজ মনে হলেও তা অত্যন্ত জটিল এবং এদের গঠন উপাদানসমূহ পরস্পরে নিবীড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। নিম্নে এসব প্রাকৃতিক ও জৈব পরিবেশের বিভিন্ন গঠন উপাদানসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

প্রাকৃতিক পরিবেশ

ভূমি বা মাটি

প্রাকৃতিক পরিবেশ এর অন্যতম গঠন মৌল ভূমি বা মাটি, যা শিলা ও খনিজের সমন্বয়ে গঠিত। ভূ-পৃষ্ঠের কঠিন বহিরাবরনই বিভিন্ন ধরনের শিলায় গঠিত। এ সব বিভিন্নধর্মী শিলা ভূ-প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন অবয়বের ভূমিরূপ গঠন করে থাকে। এসব ভূমিরূপ কোথাও যেমন কঠিন, কোথাও নরম শিলার, আবার অন্যত্র উভয়ের সংমিশ্রণে গঠিত হতে পারে।

আবার, ভূমিরূপের প্রকৃতি কোথাও সুউচ্চ পার্বত্যময় বা পাহাড়ি; আর কোথাও মৃদুঢালবিশিষ্ট।

ভূমিরূপের এ আকার, আকৃতি ও গঠন প্রকৃতি যে প্রাকৃতিক পরিবেশীয় কাঠামো সৃষ্টি করে তা সব প্রাণী কিংবা উদ্ভিদের জন্য সমানভাবে উপযোগী নয়। তাই, ভূমিরূপ যেমন বৈচিত্রময়, তেমনি প্রাণী ও উদ্ভিদের স্থানভেদে বন্টন বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। যেমন, হিমালয়ের বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় যে সব প্রাণী বাস করে তা বাংলাদেশের মত সমতল ভূমিতে দেখা যায় না। আবার, পার্বত্য এলাকারগাছপালার ধরনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমতল ভূমির অনুরূপ নয়। একইভাবে উষর মরুভূমির প্রাণী কিংবা উদ্ভিদজ প্রকৃতিও পাহাড়ী পরিবেশের চেয়ে ভিন্ন। তবে, এখানে উল্লেখ্য যে প্রানী কিংবা উদ্ভিদের বন্টন বৈচিত্রের জন্য শুধুমাত্র ভূমিরূপ এককভাবে দায়ী নয়, আরো অনেক নিয়ামক এর সাথে জড়িত।

পানি

ভূপৃষ্ঠের তিনভাগই পানির আওতায়। সমুদ্রই পানির প্রধান উৎস। তাছাড়া, তুষার আচ্ছাদিত মেরু দেশীয় ভূখন্ড ও উচ্চ পার্বত্য এলাকার বরফাচ্ছন্ন এলাকাসমূহ, নদ-নদী, হ্রদ, জলাভূমি পানির অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উৎস। পানি, প্রাণী কিংবা উদ্ভিদ উভয়েরই টিকে থাকার অন্যতম উপাদান।

পানির উৎসকে কেন্দ্র করেই প্রাচীন মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে। উম্নুক্ত ভূপৃষ্ঠের পানি সূর্যালোক থেকে প্রাপ্ত শক্তির মাধ্যমে বাস্পায়িত হয়ে বিভিন্ন জীব ও জৈব স্তরের মাধ্যমে আবার তা ভূপৃষ্ঠেই ফিরে আসে, যা পানি চক্র নামে পরিচিত। এ পানি চক্র শক্তি স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মোট কথা, পানি জীবজগতকে সচল রাখে।

বায়ুমন্ডল

ভূঅভ্যন্তর থেকে বের হওয়া গ্যাসীয় পদার্থ থেকেই বায়ুমন্ডলের সৃষ্টি। এর প্রধান গ্যাস নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আরগন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং সামান্য পরিমাণে অন্যান্য গ্যাস আছে।

বায়ুমন্ডল সম্পূর্ণ ভূ-গোলক মুড়িয়ে রেখেছে এবং মাধ্যকর্ষন শক্তির কারনেই তা পৃথিবীর সাথে লেপটে আছে। বায়ুমন্ডলের পুরুত্ব বিষুবীয় অঞ্চলে বেশী এবং মেরু অঞ্চলে সব চেয়ে কম।

ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০ কি:মি: উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুমন্ডলের গ্যাসীয় মিশ্রণ প্রায় সমান। বায়ুমন্ডলীয় গ্যাস, অক্সিজেন সমস্ত জীব জগতের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বায়ুমন্ডলীয় অবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহের মধ্যে সূর্যালোক, উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ ও মেঘ গুরুত্বপূর্ণ। এ সব নিয়ামকের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া থেকেই জলবায়ুর উদ্ভব। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর ব্যাপক তারতম্য আছে। জীবজগতের বন্টন গত বৈশিষ্ট্যে জলবায়ুগত বৈচিত্র্যের যোগসূত্র সুস্পষ্ট।

পৃথিবীর জৈব জলবায়ুজ (ইরড়পষরসধঃরপ) পরিবেশের ভিন্নতা অনুযায়ী বিষুবীয় অঞ্চল থেকে উত্তর ও দক্ষিণের উভয় গোলার্ধে উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন অক্ষাংশীয় অঞ্চলে ভাগ করা যায়। এসব জৈব জলবায়ুজ পরিবেশের বৈচিত্রতা প্রাণী ও উদ্ভিদের বন্টনে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।

জীবজগতের অন্যতম প্রাণী, মানুষ। মানুষের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী বর্তমানে প্রায় ৬ বিলিয়ন (ছয়শত কোটি) যা পৃথিবীর ভূভাগের প্রায় ৩০ শতাংশ জুড়ে আছে। বাকী ৭০ শতাংশ ভূভাগে জনবসতি

খুবই পাতলা বা জনমানবশূন্য। হালকা বসতি এলাকায় মানুষজন মৎস্য আহরণ, শিকার, সংগ্রহকরণ, পশুচারণ এবং সামান্য ফসল আবাদের সাথে যুক্ত। এ সব জনবসতি মূলত: তিনটি প্রাকৃতিক পরিবেশে দেখা যায়:

  • এশিয়া ও আফ্রিকার মরুময় এলাকায়,
  • দক্ষিণ আমেরিকা,
  • আফ্রিকা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ক্রান্তীয় অঞ্চলে এবং এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার শীত প্রধান এলাকায়।

গত কয়েক হাজার বছর ধরে এ সব জনগোষ্ঠি প্রকৃতির সাথে খাপ-খাইয়ে প্রায় প্রাকৃতিক জীবন- যাপন করছে। তবে, বর্তমানে এদের জীবন যাত্রায় আধুনিকতার সংস্পর্শে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে।

ঘনবসতির জনগোষ্ঠি মধ্য অক্ষাংশে ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে বসবাস করে। উত্তর গোলার্ধের ২০গ্দ থেকে ৫০গ্দ অক্ষাংশের মধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ বসবাস করে। ঘনবসতিপূর্ণ জনপদসমূহের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক লোকই সমুদ্র উপকূলের ১০০ কি.মি. এর মধ্যে বসবাস করে। পৃথিবীর প্রধান ১০টি বৃহৎ নগরীর ৯টিই সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত।

বিভিন্ন কারণে মানুষ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। ফলে, ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। যেমন, বাড়তি জনসংখ্যার প্রয়োজনে প্রতিদিন অধিক হারে ভূমি ও সম্পদের যোগান দরকার হচ্ছে, যার বেশ কিছুই নবায়ন যোগ্য নয়। এতে, মৃত্তিকার উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে। জ্বালানি ভান্ডার নিঃশেষ হচ্ছে, জলাধার সংকোচিত হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ধারণা করা হয় বিশ্বের জনসংখ্যা ২০০ কোটিতে (১৯৩০ সন) পৌঁছাতে ১ লক্ষ বছর লাগলেও তা বেড়ে ৪০০ কোটিতে পৌঁছাতে লেগেছে মাত্র পরবর্তী ৪৬ বৎসর।

বর্তমানে, প্রতি বছর ৯০ মিলিয়ন লোক বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেরই অভিমত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত পৃথিবী বাসপোযোগী রাখা দু:সাধ্য হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, উন্নত যন্ত্র, নতুন রাসায়নিক পদার্থ এবং নতুন ভূমি ব্যবহারের অনেক কিছুই সবক্ষেত্রে পরিবেশ উপযোগী না হওয়ায়, বাস্তু পদ্ধতিতে, পানি কিংবা বায়ুমন্ডলীয় পরিবেশের মারাত্নক ক্ষতি সাধিত হয়। ভৌগোলিকভাবে পৃথিবী, পানি, ভূমি ও বায়ুমন্ডল এবং এর জৈব মন্ডল নিয়ে একটি সুসমন্বিত গ্রহ। ফলে, যে কোন স্থানের অজৈব বা জৈব মন্ডলীয় কোন পরিবর্তন বহুদূরের পরিবেশকেও তা প্রভাবিত করে থাকে। বিশেষ করে, তা বায়ুমন্ডলের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

যেমন, কোন মহাদেশের একটি আগ্নেয়গিরির উদগীরিত লাভা বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যেতে পারে এবং তা বহুদিন জলবায়ুকে প্রভাবিত করে। তাছাড়া, শিল্প উন্নত দেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (CFC) বায়ুমন্ডলে যাচ্ছে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এর প্রমাণ স্বরূপ, CFC এর কারণে এন্টার্কটিকা মহাদেশের স্ট্রেটোমন্ডলের ওজন স্তরের পুরুত্ব ঋতুভিত্তিক হ্রাস পাচ্ছে। অথচ, এই মহাদেশটিতে অন্য সব মহাদেশের চাইতে বিশুদ্ধ পরিবেশ বিরাজ করে।

তাই পরিবেশ সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর এ সমন্বিত প্রকৃতিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা আশু প্রয়োজন।

পাঠ সংক্ষেপ

গঠনমৌলের আলোকে জৈব ও অজৈব পদার্থের সমন্বয়ে পরিবেশ গঠিত। অজৈব পরিবেশ মূলত: প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলে। পানি, শিলা ও বায়ুমন্ডলের প্রধান গঠন উপাদান। আবার, এ সব প্রাকৃতিক পরিবেশ গঠনকারী উপাদানই সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের গঠন ভিত্তি গড়ে তোলে এবং শক্তি ও খনিজ জোগানের মাধ্যমে জৈব পরিবেশ টিকিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর জৈব পরিবেশ যে সব বহুবিধ কারণে হুমকির সম্মুখিন, তম্মধ্যে বিপুল জনসংখ্যা অন্যতম। অধিক জনসংখ্যার কারণে নবায়নযোগ্য নয় এমন সম্পদের উপর বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাপ বাড়ছে; ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ বিপন্ন।

(বিশ্লেষণ টিম কর্তৃক সম্পাদিত)

For all latest articles, follow on Google News

বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে 'বিশ্লেষণ'-এর জন্য স্পনসরশিপ খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইমেইল: contact.bishleshon@gmail.com

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here