০৪:০৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
                       

হিসাববিজ্ঞান কী? হিসাববিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ধারণা

হাসান মাহমুদ রি
  • প্রকাশ: ০১:০৯:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অক্টোবর ২০২১
  • / ১৯৬৯০ বার পড়া হয়েছে

হিসাববিজ্ঞান হলো ব্যবসায়ের ভাষা

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ তাই সহজে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে পারে। অর্থাৎ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে সেবার আদান প্রদান শুরু হয়। তাই সেবা যখন অর্থের মাধ্যমে আদান প্রদান হতে থাকে তখন এই হিসাব নিকাশের প্রয়োজন হয়। এজন্য বলা হয়, হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতোই পুরাতন। মানুষের জীবন যত বৈচিত্রময় হয়ে উঠেছে, তেমনি হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োজনও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ঘটনা ঘটতে পারে, সেগুলোকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংরক্ষণ না করা হলে, সঠিক ফলাফল বুঝতে পারা যায় না। এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কিছু আর্থিক ঘটনা এবং কিছু অনার্থিক ঘটনা। যে সকল আর্থিক ঘটনাগুলোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে সেগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় বে। কারণ, আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এমন ঘটনাকে লেনদেন বলা হয়। হিসাববিজ্ঞানের প্রধান কাজ হলো এই লেনদেনগুলো লিপিবদ্ধ করা এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে ফলাফল নির্ণয় করা। এই নিবন্ধে হিসাববিজ্ঞান কী বা হিসাববিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

হিসাববিজ্ঞান কী? (What is Accounting?)

হিসাববিজ্ঞান শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো অ্যাকাউন্টিং (Accounting)। হিসাববিজ্ঞান হলো এমন একটি বাস্তব বিষয়, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিধিবদ্ধ ও নিয়ম অনুসারে আর্থিক ফলাফল নির্ণয় করে এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং আগ্রহী পক্ষসমূহের নিকট তথ্য প্রকাশ করে। তাই আমরা বলি, বর্তমানে হিসাববিজ্ঞানের কার্যক্রম ও এর পরিধি দিনে দিনে বাস্তবভিত্তিক, আধুনিকভাবে প্রয়োগ এবং উন্নতি উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

  • এ. ডব্লিউ জনসন এর মতে, টাকায় পরিমাপযোগ্য কারবারী লেনদেন সংগ্রহ, সংকলন, সুসংঘবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধকরণ, আর্থিক ফলাফল তৈরি করণ , সেগুলো বিশ্লেষণ ও বিশদ ব্যাখ্যাকরণকে হিসাববিজ্ঞান বলে
  • American Accounting Association এর মতে, “যে পদ্ধতি অর্থনৈতিক তথ্য নির্ণয়, পরিমাপ ও সরবরাহ করে, এর ব্যবহারকারীদের বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে তাকে হিসাববিজ্ঞান বলে”
  • Weygandt, Kimmel and Kieso এর মতে, প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ঘটনাসমূহ শনাক্তকরণ, লিপিবদ্ধকরণএবং আগ্রহী ব্যবহারকারীর নিকট সরবরাহ করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে হিসাববিজ্ঞান

উপরের আলোচনা থেকে হিসাববিজ্ঞানের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় –

  • প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন সংগ্রহ করা। 
  • সংরক্ষিত লেনদেনগুলো সুশৃংখলভাবে হিসাবের বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়।
  • আর্থিক ফলাফল নির্ণয় করার জন্য তথ্যগুলো শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।
  • নির্দিষ্ট সময় শেষে আর্থিক ফলাফল নির্ণয় ও আর্থিক অবস্থা নিরুপণ করা হয়।
  • তথ্যগুলোর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হয়।

সুতরাং, হিসাববিজ্ঞান হলো এমন একটি তথ্য ব্যবস্থা প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় কারবারে লেনদেন সংরক্ষণ, লিপিবদ্ধকরণ শ্রেনীবিন্যাসকরণ, আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নির্ণয় এবং এগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করে উহার ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছানো।

হিসাববিজ্ঞানের ধারণা (Concept of Accounting)

“প্রায় দুই হাজার বৎসর পূর্বে ‘আজিজে মিশর’ তার রাজ্যে উৎপাদিত খাদ্য শস্যের মিতব্যয়ি ব্যবহার ও সঞ্চিত মজুদের সঠিক হিসাব রেখে গোটা জাতিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করেন”।

মানব সভ্যতায় বিনিময় প্রথার সূচনা হতে কালক্রমে বিনিময়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং মানুষ তখন থেকে নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতিতে হিসাব রাখা শুরু করে। কালের বিবর্তনে ব্যবসায় বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের ফলে অসংখ্য ও জটিল ব্যবসায়িক লেনদেনগুলোকে সুনির্ধারিত নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়।

১৪৯৪ সালে ইটালির ধর্মযাজক ও গণিত শাস্ত্রবিদ লুকা পেসিওলি (Luca Pecioli) ‘সুম্মা ডি এরিথমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরশোন এটপ্রপোরশনালিটা’ (Summa de arithmetica, geometria, proportione etproportionalite) গ্রন্থ রচনা করেন।

লুকা প্যাসিওলি তার ‘Summa de arithmetica, geometria, proportione etproportionalite’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ব্যবসায়িক লেনদেন লিপিবব্ধকরণের সোনালী সূত্রের উল্লেখ করেন। যার উপর ভিত্তি করেই কারবারি লেনদেন লিপিবদ্ধকরণে পদ্ধতিগতভাবে হিসাববিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের জনক লুকা প্যাসিওলি।

এরপর ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রভুত উন্নয়নের ফলে লেনদেনের ধরন পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়োজন অনুযায়ী হিসাবরক্ষণের কলা কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

হিসাববিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ধারায় বর্তমান আধুনিক ও জটিল ব্যবসায় ও বাণিজ্যের যুগে কারবারের আর্থিক লেনদেনসমূহের হিসাবরক্ষণ,ফলাফল নিরূপণ ও প্রতিবেদন প্রণয়ন পূর্বক কারবারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় হিসাবজ্ঞিান সম্পর্কে নিম্নোক্ত ধারণা পোষণ করা হয়।

হিসাববিজ্ঞান একটি তথ্য ব্যবস্থা (Accounting is an Information System)

হিসাববিজ্ঞান কারবারের আর্থিক লেনদেনগুলোকে লিপিবদ্ধকরণ এবং তা থেকে আর্থিক বিবরণী প্রস্ততের মাধ্যমে ব্যবসায়িক কার্যকলাপের ফলাফল (লাভ বা ক্ষতি) ও ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থার চিত্র (সম্পদ ও দায়ের অবস্থা) নিরূপণ করে এবং প্রস্ততকৃত আর্থিক বিবরণীর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহকারে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পক্ষের নিকট তথ্য আকারে উপস্থাপন করে।

হিসাববিজ্ঞান তথ্যের ব্যবহারকারীগণ তাদের নিজ নিজ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে যেমন:

  • মালিক ব্যবসায় চলমান রাখবেন না বন্ধ করবেন, না অতিরিক্ত মূলধন বিনিয়োগ করবেন;
  • ব্যবস্থাপক ব্যবসায়ের মুনাফা অর্জনের জন্য ভবিষ্যতে কী কী কৌশল গ্রহণ করবেন;
  • ঋণদানকারীসংস্থা উক্ত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ ধারণ ক্ষমতার ভিত্তিতে ঋণ প্রদান করবে কি করবে না;
  • কর্মী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে উক্ত প্রতিষ্ঠানে থেকে যাবে না অন্যত্র চলে যাবে;
  • কর কর্তৃপক্ষ আর্থিক বা ব্যবসায়িক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত কর যথাযথ হয়েছে কি না ইত্যাদি।যেহেতু একমাত্র হিসাববিজ্ঞান কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যত আর্থিক পরিকল্পনা করে বিধায় হিসাববিজ্ঞানকে তথ্য ব্যবস্থা (Information System) নামে অভিহিত করা হয়।

হিসাববিজ্ঞান এক প্রকার ব্যবহারিক জ্ঞান (Accounting is a Practical Knowledge)

হিসাববিজ্ঞান কারবারের আর্থিক লেনদেনসমূহকে লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণিবদ্ধকরণ, সংক্ষেপন এবং চূড়ান্ত হিসাব বা আর্থিক বিবরণী প্রস্তত করার কৌশল শেখায়।

মালিক কর্তৃক মূলধন বিনিয়োগ, প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সম্পদ সংগ্রহ,ব্যবসায়িক পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয়, নগদ আদান ও প্রদান, বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও অব্যবসায়িক ব্যয় বা খরচ পরিশোধকরণ ইত্যাদি কার্যকলাপগুলো হিসাবের বহিতে লিপিবদ্ধকরণ এবং তা থেকে আর্থিক বিবরণী প্রস্ততের ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ফলে সারা বিশ্বে অবস্থিত হিসাববিজ্ঞান বিষয়ের জ্ঞানসমৃদ্ধ হিসাবরক্ষকগণ কর্তৃক প্রস্ততকৃত আর্থিক বিবরণী সার্বজনীন ভাবে গৃহিত এবং বোধগম্য হয়।

আবার হিসাববিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে আর্থিক বিবরণী প্রস্তত করে তা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি বা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রকাশ করে।

হিসাববিজ্ঞান ব্যবসায়ের ভাষা (Accounting is the Language of Business)

ভাষা যেমন মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে তেমনি হিসাববিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের যে আর্থিক বিবরণী প্রস্তত করে যা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কার্যাবলীর প্রতিচ্ছবি বা দর্পণ যার মাধ্যমে ব্যবসার মনোভাব প্রকাশ পায়। যেমন প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে সবল না রুগ্ন, সম্পদশালী না দায়গ্রস্থ, লাভজনক না অলাভজনক ইত্যাদি। এই জন্যে হিসাববিজ্ঞানকে ব্যবসায়ের ভাষা বলা হয়।

প্রতিটি ভাষার যেমন নিজস্ব ও পৃথক শব্দ ভান্ডার থাকে যা ঐ ভাষাভাষির মানুষ বুঝে থাকে এবং ভাষাকে জানতে বা বুঝতে হলে ভাষা চর্চার মাধ্যমে ঐ ভাষার জ্ঞান অর্জন করতে হয় ঠিক তেমনি হিসাববিজ্ঞানেরও কিছু শব্দ আছে যেমন ডেবিট, ক্রেডিট, সম্পদ, দায়, আয়, ব্যয়, মালিকানা স্বত্ব ইত্যাদি যা একমাত্র হিসাববিজ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বা হিসাববিজ্ঞানের জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গ বুঝে থাকেন এবং অন্যান্য ভাষার মতোই ব্যবসায়ের ভাষা হিসেবে হিসাববিজ্ঞানের জ্ঞান দীর্ঘমেয়াদী অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

হিসাববিজ্ঞান কী? হিসাববিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ধারণা

প্রকাশ: ০১:০৯:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অক্টোবর ২০২১

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ তাই সহজে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে পারে। অর্থাৎ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে সেবার আদান প্রদান শুরু হয়। তাই সেবা যখন অর্থের মাধ্যমে আদান প্রদান হতে থাকে তখন এই হিসাব নিকাশের প্রয়োজন হয়। এজন্য বলা হয়, হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতোই পুরাতন। মানুষের জীবন যত বৈচিত্রময় হয়ে উঠেছে, তেমনি হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োজনও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ঘটনা ঘটতে পারে, সেগুলোকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংরক্ষণ না করা হলে, সঠিক ফলাফল বুঝতে পারা যায় না। এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কিছু আর্থিক ঘটনা এবং কিছু অনার্থিক ঘটনা। যে সকল আর্থিক ঘটনাগুলোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে সেগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় বে। কারণ, আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এমন ঘটনাকে লেনদেন বলা হয়। হিসাববিজ্ঞানের প্রধান কাজ হলো এই লেনদেনগুলো লিপিবদ্ধ করা এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে ফলাফল নির্ণয় করা। এই নিবন্ধে হিসাববিজ্ঞান কী বা হিসাববিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

হিসাববিজ্ঞান কী? (What is Accounting?)

হিসাববিজ্ঞান শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো অ্যাকাউন্টিং (Accounting)। হিসাববিজ্ঞান হলো এমন একটি বাস্তব বিষয়, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিধিবদ্ধ ও নিয়ম অনুসারে আর্থিক ফলাফল নির্ণয় করে এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং আগ্রহী পক্ষসমূহের নিকট তথ্য প্রকাশ করে। তাই আমরা বলি, বর্তমানে হিসাববিজ্ঞানের কার্যক্রম ও এর পরিধি দিনে দিনে বাস্তবভিত্তিক, আধুনিকভাবে প্রয়োগ এবং উন্নতি উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

  • এ. ডব্লিউ জনসন এর মতে, টাকায় পরিমাপযোগ্য কারবারী লেনদেন সংগ্রহ, সংকলন, সুসংঘবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধকরণ, আর্থিক ফলাফল তৈরি করণ , সেগুলো বিশ্লেষণ ও বিশদ ব্যাখ্যাকরণকে হিসাববিজ্ঞান বলে
  • American Accounting Association এর মতে, “যে পদ্ধতি অর্থনৈতিক তথ্য নির্ণয়, পরিমাপ ও সরবরাহ করে, এর ব্যবহারকারীদের বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে তাকে হিসাববিজ্ঞান বলে”
  • Weygandt, Kimmel and Kieso এর মতে, প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ঘটনাসমূহ শনাক্তকরণ, লিপিবদ্ধকরণএবং আগ্রহী ব্যবহারকারীর নিকট সরবরাহ করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে হিসাববিজ্ঞান

উপরের আলোচনা থেকে হিসাববিজ্ঞানের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় –

  • প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন সংগ্রহ করা। 
  • সংরক্ষিত লেনদেনগুলো সুশৃংখলভাবে হিসাবের বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়।
  • আর্থিক ফলাফল নির্ণয় করার জন্য তথ্যগুলো শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।
  • নির্দিষ্ট সময় শেষে আর্থিক ফলাফল নির্ণয় ও আর্থিক অবস্থা নিরুপণ করা হয়।
  • তথ্যগুলোর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হয়।

সুতরাং, হিসাববিজ্ঞান হলো এমন একটি তথ্য ব্যবস্থা প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় কারবারে লেনদেন সংরক্ষণ, লিপিবদ্ধকরণ শ্রেনীবিন্যাসকরণ, আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নির্ণয় এবং এগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করে উহার ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছানো।

হিসাববিজ্ঞানের ধারণা (Concept of Accounting)

“প্রায় দুই হাজার বৎসর পূর্বে ‘আজিজে মিশর’ তার রাজ্যে উৎপাদিত খাদ্য শস্যের মিতব্যয়ি ব্যবহার ও সঞ্চিত মজুদের সঠিক হিসাব রেখে গোটা জাতিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করেন”।

মানব সভ্যতায় বিনিময় প্রথার সূচনা হতে কালক্রমে বিনিময়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং মানুষ তখন থেকে নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতিতে হিসাব রাখা শুরু করে। কালের বিবর্তনে ব্যবসায় বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের ফলে অসংখ্য ও জটিল ব্যবসায়িক লেনদেনগুলোকে সুনির্ধারিত নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়।

১৪৯৪ সালে ইটালির ধর্মযাজক ও গণিত শাস্ত্রবিদ লুকা পেসিওলি (Luca Pecioli) ‘সুম্মা ডি এরিথমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরশোন এটপ্রপোরশনালিটা’ (Summa de arithmetica, geometria, proportione etproportionalite) গ্রন্থ রচনা করেন।

লুকা প্যাসিওলি তার ‘Summa de arithmetica, geometria, proportione etproportionalite’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ব্যবসায়িক লেনদেন লিপিবব্ধকরণের সোনালী সূত্রের উল্লেখ করেন। যার উপর ভিত্তি করেই কারবারি লেনদেন লিপিবদ্ধকরণে পদ্ধতিগতভাবে হিসাববিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের জনক লুকা প্যাসিওলি।

এরপর ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রভুত উন্নয়নের ফলে লেনদেনের ধরন পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়োজন অনুযায়ী হিসাবরক্ষণের কলা কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

হিসাববিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ধারায় বর্তমান আধুনিক ও জটিল ব্যবসায় ও বাণিজ্যের যুগে কারবারের আর্থিক লেনদেনসমূহের হিসাবরক্ষণ,ফলাফল নিরূপণ ও প্রতিবেদন প্রণয়ন পূর্বক কারবারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় হিসাবজ্ঞিান সম্পর্কে নিম্নোক্ত ধারণা পোষণ করা হয়।

হিসাববিজ্ঞান একটি তথ্য ব্যবস্থা (Accounting is an Information System)

হিসাববিজ্ঞান কারবারের আর্থিক লেনদেনগুলোকে লিপিবদ্ধকরণ এবং তা থেকে আর্থিক বিবরণী প্রস্ততের মাধ্যমে ব্যবসায়িক কার্যকলাপের ফলাফল (লাভ বা ক্ষতি) ও ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থার চিত্র (সম্পদ ও দায়ের অবস্থা) নিরূপণ করে এবং প্রস্ততকৃত আর্থিক বিবরণীর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহকারে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পক্ষের নিকট তথ্য আকারে উপস্থাপন করে।

হিসাববিজ্ঞান তথ্যের ব্যবহারকারীগণ তাদের নিজ নিজ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে যেমন:

  • মালিক ব্যবসায় চলমান রাখবেন না বন্ধ করবেন, না অতিরিক্ত মূলধন বিনিয়োগ করবেন;
  • ব্যবস্থাপক ব্যবসায়ের মুনাফা অর্জনের জন্য ভবিষ্যতে কী কী কৌশল গ্রহণ করবেন;
  • ঋণদানকারীসংস্থা উক্ত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ ধারণ ক্ষমতার ভিত্তিতে ঋণ প্রদান করবে কি করবে না;
  • কর্মী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে উক্ত প্রতিষ্ঠানে থেকে যাবে না অন্যত্র চলে যাবে;
  • কর কর্তৃপক্ষ আর্থিক বা ব্যবসায়িক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত কর যথাযথ হয়েছে কি না ইত্যাদি।যেহেতু একমাত্র হিসাববিজ্ঞান কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যত আর্থিক পরিকল্পনা করে বিধায় হিসাববিজ্ঞানকে তথ্য ব্যবস্থা (Information System) নামে অভিহিত করা হয়।

হিসাববিজ্ঞান এক প্রকার ব্যবহারিক জ্ঞান (Accounting is a Practical Knowledge)

হিসাববিজ্ঞান কারবারের আর্থিক লেনদেনসমূহকে লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণিবদ্ধকরণ, সংক্ষেপন এবং চূড়ান্ত হিসাব বা আর্থিক বিবরণী প্রস্তত করার কৌশল শেখায়।

মালিক কর্তৃক মূলধন বিনিয়োগ, প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সম্পদ সংগ্রহ,ব্যবসায়িক পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয়, নগদ আদান ও প্রদান, বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও অব্যবসায়িক ব্যয় বা খরচ পরিশোধকরণ ইত্যাদি কার্যকলাপগুলো হিসাবের বহিতে লিপিবদ্ধকরণ এবং তা থেকে আর্থিক বিবরণী প্রস্ততের ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ফলে সারা বিশ্বে অবস্থিত হিসাববিজ্ঞান বিষয়ের জ্ঞানসমৃদ্ধ হিসাবরক্ষকগণ কর্তৃক প্রস্ততকৃত আর্থিক বিবরণী সার্বজনীন ভাবে গৃহিত এবং বোধগম্য হয়।

আবার হিসাববিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে আর্থিক বিবরণী প্রস্তত করে তা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি বা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রকাশ করে।

হিসাববিজ্ঞান ব্যবসায়ের ভাষা (Accounting is the Language of Business)

ভাষা যেমন মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে তেমনি হিসাববিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের যে আর্থিক বিবরণী প্রস্তত করে যা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কার্যাবলীর প্রতিচ্ছবি বা দর্পণ যার মাধ্যমে ব্যবসার মনোভাব প্রকাশ পায়। যেমন প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে সবল না রুগ্ন, সম্পদশালী না দায়গ্রস্থ, লাভজনক না অলাভজনক ইত্যাদি। এই জন্যে হিসাববিজ্ঞানকে ব্যবসায়ের ভাষা বলা হয়।

প্রতিটি ভাষার যেমন নিজস্ব ও পৃথক শব্দ ভান্ডার থাকে যা ঐ ভাষাভাষির মানুষ বুঝে থাকে এবং ভাষাকে জানতে বা বুঝতে হলে ভাষা চর্চার মাধ্যমে ঐ ভাষার জ্ঞান অর্জন করতে হয় ঠিক তেমনি হিসাববিজ্ঞানেরও কিছু শব্দ আছে যেমন ডেবিট, ক্রেডিট, সম্পদ, দায়, আয়, ব্যয়, মালিকানা স্বত্ব ইত্যাদি যা একমাত্র হিসাববিজ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বা হিসাববিজ্ঞানের জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গ বুঝে থাকেন এবং অন্যান্য ভাষার মতোই ব্যবসায়ের ভাষা হিসেবে হিসাববিজ্ঞানের জ্ঞান দীর্ঘমেয়াদী অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।