০৬:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

কবিতা: কবিতার স্বরূপ, শ্রেণিকরণ এবং বাংলা ও বাংলাদেশের কবিতা

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ১২:৫৩:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ১১৬৫৯ বার পড়া হয়েছে

কবিতা নিয়ে কথা বলা যতো সহজ এর সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা ততটা সহজ কাজ নয়

কবিতা

কবিতা নিয়ে কথা বলা যতো সহজ এর সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা ততটা সহজ কাজ নয়ম। কবিতা পছন্দ করে না পৃথিবীতে এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম। কবিতা সম্পর্কেযতো আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে, সাহিত্যের অন্য কোন রূপ সম্পর্কেতা হয়নি। প্রত্যেক সচেতন সংবেদনশীল মানুষের মধ্যেই কবিতার প্রতি আকর্ষণ রয়েছে। মানুষের বিস্ময়, স্মৃতি, স্বপ্ন, কল্পনার এক অপরূপ মিশ্রণে কবিতার সৃষ্টি। ব্যক্তির অনুভূতি, আবেগ, রহস্যানুভূতি প্রতিফলন ঘটায় প্রতিটি যথার্থ কবিতাই এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি। যথার্থ বলার কারণ, অনেক অনুকারী কবিতা আছে যেখানে মৌলিক অনুভবের পরিবর্তেঅন্য কোন কবির অনুভূতি, আবেগ ও সৃষ্টিশীল কল্পনার প্রতিধ্বনিই মুখ্য হয়ে ওঠে।

উপরের আলোচনা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, কবিতার সংজ্ঞার্থ নির্ণয় সহজ কাজ নয়। তবুও সাহিত্যের প্রতিটি শাখারই একটি মৌলিক মানদণ্ড আছে। সে মানদণ্ড বিচার করে কবিতা সম্পর্কেও একটা মোটামুটি ধারণা অর্জন করা যেতে পারে। বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের জন্য শব্দগুচ্ছের তাৎপর্যময় বিন্যাস থেকে কবিতার সৃষ্টি। কিন্তু এ ধারণাও পূর্ণাঙ্গ নয়। আরো সুস্পষ্ট করে বলা যায় আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানসের সাধারণ প্রবণতার অংশ; এগুলোর সঙ্গে যখন সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হয়, অনিবার্যশব্দের তাৎপর্যময় বিন্যাস তাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাময়। তখনই একটি কবিতার জন্ম সম্ভব হয়। এ গ্রন্থেঅন্তর্ভুক্ত পাঁচটি কবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের বিশেষণ থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করতে পারি। 

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভাষা’ কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে মাতৃভাষাপ্রেম ও গভীর দেশাত্মবোধ। কবি সনেটের আঙ্গিকে নিজের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা ও আত্মবিশেষণ থেকে মাতৃভাষার টানে স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়েছেন। চৌদ্দ মাত্রার চৌদ্দ চরণের সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনিবার্য কিছু শব্দের বিন্যাসের মাধ্যমে কবি নিজ অনুভূতি, আবেগ, স্মৃতি, স্বপ্ন ও বাস্তব প্রাপ্তির পরিপূর্ণছবি তুলে ধরেছেন এই কবিতায়। ‘বলাকা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আবেগের বেগকে স্মৃষ্টিজগতের অন্তর্নিহিত অবিরাম গতির ছন্দে অনুভব করেছেন। এ-কবিতায় শব্দ-ব্যবহার ও ছন্দ-পরিকল্পনা কবির অনুভূত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক-তরুর সারি’ কবিতায় প্রেমচেতনা ও প্রকৃতিচেতনার অনুপম মেলবন্ধন ঘটেছে। ‘বনলতা সেন’ সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

ব্যক্তিপ্রেম কিংবা দেশপ্রেম যাই-ই ব্যক্ত হোকনা কেন, হাজার বছরের পথচলার ক্লান্তপরিব্রাজক যখন উচ্চারণ করে  বলেছে সে, “এতদিন কোথায় ছিলেন?/পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’’  তখন দেশকালের সীমা লুপ্ত হয়ে মানুষের চিরকাঙ্ক্ষিত শুশ্রষার মমতাস্নিগ্ধ নারীর মাতৃমূর্তিই প্রধান হয়ে ওঠে। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’ ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত কবিতা। এ-কবিতায় মাতৃভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শোষণের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং সংগ্রামের দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা। পাঁচটি কবিতার বিষয়বস্তুর মতো আঙ্গিকরীতিও স্বতন্ত্র। শব্দচয়ন ও ব্যবহারে প্রত্যেক কবির রুচি আলাদা। কিন্তুপ্রতিটি কবিতাই আমাদের মধ্যে স্থায়ী আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম। সুতরাং সাধারণভাবে বলা যায়, কবির স্বতস্ফূর্ত অনুভূতি শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে জীবনের অন্তর্ময় এবং স্থায়ী আবেদন সৃষ্টির উপযোগী যে শব্দসৌধ সৃষ্টি করে তাই-ই কবিতা।

কবিতার শ্রেণিকরণ

প্রতিটি সাহিত্য আঙ্গিকেরই উপাদান মানুষের জীবন, পারিপার্শ্বকি সমাজ অর্থাৎ মানুষের চিন্তা ও কর্মের সঙ্গে সংশিষ্ট সকল প্রসঙ্গ। জীবনকে দেখার এবং উপস্থাপন করার বৈশিষ্ট্যই সাহিত্যের প্রতিটি আঙ্গিককে স্বতন্ত্রকরে দেয়। আবার এইসব সাহিত্যরূপের মধ্যে বিষয়বস্তু, আঙ্গিকবিন্যাস ও ভাষারীতির কারণে শ্রেণিকরণ অনিবার্যহয়ে পড়ে। কবিতার আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেধারণা অর্জন করতে হলে, তার বিভিন্নশ্রেণির স্বতন্ত্র-গঠনরীতি, ভাষাবিন্যাস, ছন্দরীতি প্রভৃতি বিষয়ে জানতে হবে।

নিম্নোক্তভাবে কবিতার বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থান বা প্রকারভেদ নির্দেশ করা যায়:

  • কবিতা
    • কাব্যনাট্য
    • মহাকাব্য
    • গীতিকবিতা
      • প্রার্থনাসংগীত (ঐুসহ)
      • ওড্ (Ode)
      • শোককবিতা (Elegy)
      • চতুর্দশপদী (ঝড়হবঃ)
      • ব্যালাড (Ballad)

কাব্যনাট্য

আদিযুগে কাব্যভাষাই ছিল সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। ফলে, নাটকের প্রাথমিক রূপ কাব্যনাটকেও কবিতার ভাষা ও ছন্দরীতি অনুসৃত হত। গ্রিক বা রোমান সাহিত্যের স্বর্ণযুগে নাটককে বলা হতো জীবনের অনুকরণ, ঘনিষ্ট প্রতিফলন। এলিজাবেথান যুগের (the Elizabethan Age) কালজয়ী নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের (William Shakespeare) নাটকগুলো জীবনের বহুমুখী বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করলেও কবিতার রূপরীতিই ছিলো তাঁর প্রধান অবলম্বন। সাধারণ দর্শক-শ্রোতার নিকট গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নাট্যসংলাপের ভাষাকে লৌকিক ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসেন নাট্যকাররা। মৌখিক ভাষার স্পন্দন নাটকের কাব্যগুণকে কিছুটা খণ্ডিত করলেও পরবর্তীকালে নাটকে গদ্যভাষার প্রয়োগ অনিবার্যকরে তোলে। কিন্তু কাব্যনাট্যের ধারা সাহিত্যের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়নি। উনিশ শতকে গিরিশচন্দ্রঘোষ, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু কাব্যনাটকের রূপরীতি, ভাষা ও ছন্দকে মানুষের পরিবর্তনশীল সাহিত্যরুচির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রভূত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

মহাকাব্য

কবিতার প্রাচীনতম শাখা মহাকাব্য; এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রিক  ‘এপোস’ (Epos) শব্দের ইংরেজি রূপান্তর ‘এপিক’ (Epic) মহাকাব্যের ইংরেজি প্রতিশব্দ। Epos শব্দের প্রাচীন অর্থ ‘শব্দ’। সময়ের বিবর্তনে এই শব্দের ওপর বিভিন্ন অর্থ আরোপিত হয়ে কখনো বিবরণ বা কাহিনি, কখনো গীতি বা বীরত্বব্যঞ্জক কাব্য। এভাবেই অর্থের রূপান্তর ঘটতে ঘটতে এক সময় Epic অর্থ দাঁড়িয়ে যায় আখ্যানমূলক বা বীরত্বব্যঞ্জক কবিতা।

গ্রিক সাহিত্যতাত্ত্বিক অ্যারিস্টটল তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘পোয়েটিক্স’-এ ট্র্যাজেডির ওপর বিস্তৃত আলোচনা করতে গিয়ে মহাকাব্যের লক্ষণ ও স্বরূপ সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন। কাহিনির বিস্তার-ধর্মিতা, ওজোগুণ-সম্পন্ন শব্দপ্রয়োগ ও হেকটামিটার ছন্দ মহাকাব্যের গঠনরীতির বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র্য। অ্যারিস্টটল আর যে দুটি লক্ষণের কথা বলেছেন, তা  অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। 

  • প্রথম লক্ষণ: বস্তুনিষ্ঠা বা objectivity কবির নির্লিপ্ততা, নিরাসক্তি। ঘটনা বা কাহিনির অন্তরালে কবির নিরপেক্ষ অবস্থান বা আত্মগোপন করার ক্ষমতা।
  • দ্বিতীয় লক্ষণ: অলৌকিক বিষয়বস্তুকে কাব্যসম্মতভাবে রূপদান করা। এ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের একটি মন্তব্য মূল্যবান ‘অবিশ্বাস্য সম্ভবের চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অসম্ভব অনেক বেশি কাম্য’।

মহাকাব্যের বিষয়বিন্যাস ও গঠনকৌশলে বৈচিত্র্য, ব্যাপকতা ও অভিনবত্ব সুস্পষ্ট। এর ঘটনা বা পট গ্রন্থনে আদি-মধ্য-অন্ত্যের ঐক্য থাকতে হবে, নায়ক বীর্যবত্তা ও দক্ষতায় বহুগুণে গুণান্বিত। এর বস্তু-উপাদান জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক তথ্য ও ঘটনা, এর অনুপ্রেরণা-উৎস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐশীশক্তি। মহাকাব্যে মানব-দানব, দেব-দেবী চরিত্রের সমাবেশ ঘটায় অলৌকিকতার প্রয়োগ ঘটে থাকে।

মহাকাব্য দুই প্রকার:

১. জাত মহাকাব্য (Epic of Growth)

জাত মহাকাব্যে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের যূথবদ্ধ জীবনপ্রণালী, মানব-মানবীর আচার-আচরণ, বিশ্বাস, প্রেম, সংগ্রাম বিন্যস্ত হয়। নির্দিষ্ট সময়খণ্ডের পরিবর্তেএকটি সমাজের অতীত বর্তমানের দীর্ঘসময়-সীমা জাত মহাকাব্যে অনুসৃত হয়। ব্যক্তিবিশেষ রচনা করলেও জাত মহাকাব্যে সামাজিক ঘটনা-পরিক্রমা ও জীবনের সমাগ্রিক রূপায়ণ ঘটে। বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত ‘মহাভারতে’র ঘটনা, বিষয়বস্তু ও চরিত্রের বৈচিত্র্য ভারতবর্ষের অদিকালের গোটা সমাজ ব্যবস্থাকেই উন্মোচন করেছে।

হোমার রচিত ইলিয়ড ও ওডেসি প্রাচীন গ্রীসের যৌথ সমাজব্যবস্থার মহাকাব্যিক রূপ। ইলিয়ড-এ ট্রয়যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের কাহিনি অবলম্বিত হলেও দশ বছর ব্যাপ্ত যুদ্ধের সমগ্র ছবিই কবির গ্রন্থণ নৈপুণ্যে এতে বিধৃত হয়েছে। ওডেসিতে ট্রয় যুদ্ধের ঘটনাপ্র বাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেই থাকা রাজ্যের জনজীবন, নায়ক ওডেসিয়ুসের অবিশ্বাস্য ভ্রমণ ও সংগ্রাম এবং পেনিলোপির বিড়ম্বিত ভাগ্য জীবন। হোমার ঘটনা ভারাক্রান্ত মহাকাব্যে চরিত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

২. সাহিত্যিক মহাকাব্য (Literary Epic)

সাহিত্যিক মহাকাব্য পৌরাণিক ঘটনা কিংবা কোনো জাত মহাকাব্যের ঘটনাসূত্র অবলম্বনে কবির যুগমানস, সমাজমানস ও দৃষ্টিভঙ্গির সমবায়ে এক আধুনিক সৃষ্টি। এই শ্রেণির মহাকাব্যের মধ্যে ভার্জিলের ‘ইনিদ’ (Eneid) তাসোর ‘জেরুজালেম ডেলিভার্ড’ (Jerusalem Delivered), দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’

(Divine Comedy), জন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (Paradise Lost) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ উলেখযোগ্য। পুরাতনের আশ্রয়ে নতুন যুগের জীবনসত্য প্রতিটি সাহিত্যিক মহাকাব্যেরই বিষয়বস্তু।

গীতিকবিতা

ব্যক্তি-অনুভূতির স্বত:স্ফূর্ত প্রকাশ গীতিকবিতার প্রধান লক্ষণ। সাবলীলতা ও সহজতায় এই কাব্য-আঙ্গিক সর্বাপেক্ষা বৈচিত্র্যময় ও প্রভাবশালী। প্রাচীন গ্রিসে বীণাযন্ত্র সহযোগে যে সংগীত পরিবেশিত হতো ম, তাকে বলা হতো লিরিক (Lyric)। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে Lyric বা গীতিকবিতার সঙ্গে সংগীত ধর্মের সম্পর্ক সুনিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা একই সঙ্গে কবিতা ও গান। তবুও মনে রাখতে হবে সংগীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুবিচিত্র। মানবীয় অনুভূতির বহুমুখী সত্য গীতিকবিতায় রূপ পায়। সংগীতে থাকে সুরের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ, আর গীতিকবিতায় কথা ও সুরের সমন্বয়। ফলে, সংগীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুগুণে বিস্তৃত। ব্যক্তি অনুভূতির সূক্ষ্মতর প্রকাশ অনিবার্য শব্দ, ধ্বনি এবং ছন্দ বিন্যাসে গীতিকবিতায় রূপ পায় বলে আদিকাল থেকেই কবিতার এই রীতি সর্বাধিক চর্চিত সাহিত্যধারা। এ প্রসঙ্গে মহাকাব্যের সঙ্গে গীতিকবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত পার্থক্যের স্বরূপ নির্দেশ করা প্রয়োজন। মহাকাব্যের বিষয় আঙ্গিক ও পূর্বনিরূপিত আর গীতিকবিতার বিষয়, রীতি ও সময়, সমাজ ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মহাকাব্য বস্তুনিষ্ঠ (objective) আর গীতিকবিতা ভাবনিষ্ঠ (subjective) কবিতা।

গীতিকবিতার বিচিত্র রূপ-রীতি

লিরিক বা গীতিকবিতার জনপ্রিয়তার ও ধারাবাহিকতা উৎস এর রূপগত বৈচিত্র্য থেকেই অনুধাবন করা সম্ভব।

স্তবসংগীত বা Hymn

সৃষ্টিকর্তা বা দেবতার উদ্দেশে রচিত প্রার্থনামূলক কবিতাকে বলা হয় হিম্ বা স্তব সংগীত। এ ধরনের কবিতা জনসাধারণের সামনে গাওয়া হতো আবার আবৃত্তিও করা হতো। অর্থাৎ সংগীতধর্ম বা কাব্যগুণ উভয়ই স্তবসংগীতের বৈশিষ্ট্য। আধ্যাত্মিকতা ও ভক্তিভাব এ কবিতার প্রাণ। শ্রোতাসাধারণের মনে মহৎ ভাবনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে স্তবসংগীত রচিত হতো। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে এ ধরনের সংগীতধর্মপ্রধান কবিতা হয়েছে প্রচুর। বৈষ্ণব পদাবলী, শ্যামাসংগীত ও বাউল গানে স্তবসংগীতের বৈশিষ্ট্য সুস্পট। রবীন্দ্রানাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ও ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় স্তবসীঙ্গত বা Hymn এর বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

স্তোত্রকবিতা বা ওড্ (Ode)

বাংলা ভাষায় ওড্-এর কোন প্রতিশব্দ নেই। বিষয়বস্তু ও গঠনবৈশিষ্ট্য অনুসারে একে স্তোত্রকবিতা বলা যেতে পারে। কবি কোনো মহৎ ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ব্যক্তি বা বস্তুর উদ্দেশে সমিল বা অমিল ছন্দে যে কবিতা রচনা করেন তাই-ই ওড্ বা স্তোত্র কবিতা । প্রাচীন গ্রিক কবি পিণ্ডার ওড্ রচনার ক্ষেত্রে পথিকৃত। রোমান কবি হোরেসও বেশ কিছু ওড্ রচনা করেছেন । বাংলা সাহিত্যে সচেতনভাবে ওড্ রচনার সূত্রপাত মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’ কিংবা ‘উর্বশী’ ওড্-এর আধুনিক রূপায়ণ। ওড্-এর লক্ষণযুক্ত উল্লেযোগ্য সংখ্যক কবিতা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে।

শোককবিতা বা এলিজি (Elegy)

মূল গ্রিক শব্দ ঊষবমরধ-এর অর্থ হলো বেদনার আর্তি। এই শব্দ থেকে Elegy শব্দের উৎপত্তি। ঊষবমরধ বা ঊষবমড়ং কেবল শোক অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হতো না। প্রাচীন গ্রিক এবং ল্যাটিন সাহিত্যে এলিজিয়াক (Elegiac) নামে ৬+৫ মাত্রায় (প্রথমে ছয় পরে পাঁচ) রচিত এক ধরনের কবিতা প্রচলিত ছিলো। সময়ের বিবর্তনে এলিজি বলতে এখন কেবল শোক কবিতাকেই বোঝায়। এ রীতির কবিতায় কবির ব্যক্তিগত শোক কিংবা জাতীয় শোক রূপায়িত হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত বিচ্ছেদ-বেদনা, কোনো জাতীয় ব্যক্তিত্বের মৃত্যুজনিত উপলব্ধি থেকে শোককবিতার সৃষ্টি। গ্রিক কবি বিয়ন রচিত ‘ল্যামেন্ট ফর অ্যাডোনিস’ (Lament for Adonis) বিশেষ ধরনের শোককবিতা প্যাসটাল এলিজির (Pastal Elegy)আদি দৃষ্টান্ত। জন মিল্টনের ‘লিসিডাস’ (Licidus) এবং শেলির ‘অ্যাডোনিস’ (Adonis) এই ধারার আরও অগ্রসর পর্যায়ের কবিতা। বিয়নের কবিতা শোকেই শুরু এবং সমাপ্তি। কিন্তু মিল্টন এবং শেলি তাঁদের শোকের মধ্যে প্রত্যাশা ও আনন্দের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। টমাস গ্রের Elegy written in country churchyard সর্বাধিক পঠিত শোক কবিতা। প্রিয়জন কিংবা কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়, নাম না জানা কোনো গ্রামের মৃত কৃষিজীবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে কবিতাটি। টেনিসনের এলিজিগুচ্ছের নাম In Memorium। 

বাংলা ভাষায় শোককবিতা রচিত হয়েছে প্রচুর। কিন্তসে-তুলনায় কালোত্তীর্ণকবিতার সংখ্যা কম। প্রায় সকল কবিই শোককে ভাষারূপ দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত স্ত্রীর উদ্দেশে রচিত কবিতা গুচ্ছ ‘স্মরণ’ শোককবিতারই আধুনিক রূপায়ন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮’, মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুতে প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘তিনটি গুলি’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু উপলক্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচিত ‘পাথরের ফুল’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ সার্থক এলিজির দৃষ্টান্ত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অকাল প্রয়াণে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘চিত্তনামা’। জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ পারিবারিক শোককবিতার অনন্য দৃষ্টান্ত। 

সনেট বা চতুর্দশপদী

সনেট শব্দটির উৎপত্তি ইটালিয়ান ‘সনেটো’ (soneto)। সনেটো শব্দের অর্থ মৃদুধ্বনি। ইটালিয়ান কবি দান্তেও পেত্রার্ক সনেটের জনক বা আদি রচিয়তা। একটি অখণ্ড অনুভূতি যখন ১৪ মাত্রার (কখনো কখনো ১৮ মাত্রাও হয়) ১৪ পংক্তিতে ( কখনো কখনো ১৮ পংক্তির ব্যবহারও দেখা যায়) বিন্যস্তহয়ে আবেগের শিখর স্পর্শকরে, তখনই একটি সার্থক সনেট জন্ম নেয়। বাংলা সাহিত্যের প্রথম বা আদি এবং সার্থক সনেট রচিয়তা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সনেটের আঙ্গিককে ‘চতুর্দশপদী’ হিসেবে নির্দিষ্টকরেছেন। পরবর্তীকালের সার্থক সনেট রচিয়তাগণ এই রীতিই মূলত অনুসরণ করেছেন। সনেটের প্রথম আট পংক্তিকে বলা হয় অষ্টক (octave)। এই প্রথম অংশে কবির ভাব বা কল্পনা ঈঙ্গিতময় রূপ লাভ করে। শেষ ছয় চরণকে বলা হয় ষটক (sestet)  এ-অংশে পূর্ববর্তীভাবের বিস্তৃতিসাধন বা ব্যাখ্যা দান করা হয়। সনেটের বক্তব্য বিন্যাসের এই রীতি মধুসূদন দত্ত অনুসরণ করেছেন। তাঁর ‘বঙ্গভাষা’ কবিতাটি বিশেষণ করলে এ মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হবে।

‘বঙ্গভাষা’ কবিতার প্রথম আট চরণে কবি নিজের আত্মরূপান্তরের ঈঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, বঙ্গভাণ্ডারে বিচিত্র রত্নসম্ভার থাকা সত্ত্বেও তিনি মত্ত থেকেছেন পরসম্পদ লোভে। পরদেশে (বিদেশে) ভ্রমণ করে জীবনযাপনের মধ্যে ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট অভিরুচিই ফুটে ওঠে। ব্যর্থসাধনায় তাঁর জীবনে সাফল্যের পরিবর্তে এসেছে হতাশা। মাতৃভূমি রূপ পদ্মকানন পরিত্যাগ করে শৈবালের আবেষ্টনীতে আবদ্ধ থেকে নষ্ট করেছেন জীবনের সকল সম্ভাবনার পথ। এই অংশে কবির আত্মবিশেষণ প্রাধান্য পেয়েছে। পরবর্তী ছয় চরণে কবি কুললক্ষ্মী তথা দেশমাতৃকার পথনির্দেশনা পেয়ে যান স্বপ্নে। ‘পালিলাম আজ্ঞা সুখে ; পাইলাম কালে/মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণমণিজালে॥’ অত্যন্তনিষ্ঠা ও সতর্কতায় মধুসূদন সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার আঙ্গিক নির্মাণ করেছিলেন।

ব্যালাড (Ballad)

গীতিকবিতার আদিরূপ হিসেবে বিচার করা যায় ব্যালাড বা গীতিগাথাকে। ইতালীয় শব্দ বালারে (ballare) থেকে ব্যালাড শব্দের উৎপত্তি। বালারে শব্দের অর্থ ‘নৃত্য করা’। অর্থাৎ কবিতার সঙ্গে নৃত্য ও নাটকীয়তার মিশ্রণে ব্যালাডের সৃষ্টি। ব্যালাড-এ প্রেম, ধর্ম, বীরত্ব, রাজনীতি, সামাজিক প্রসঙ্গ, হাস্যরস ও করুণরসের ঘটনা স্থান পেত। আদি ব্যালাডগুলোর রচয়িতারা অজ্ঞাতনামা। মূলত লোকজীবন তথা গ্রামজীবনের বিচিত্র প্রসঙ্গ ব্যালাড-এ স্থান পেয়েছে। এতে ব্যক্তি কিংবা সামষ্টিক জীবনের বেদনাকরুণ কাহিনিরই প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। আধুনিক রোমান্টিক যুগের কবিরা ব্যালাডের অনুসরণে লিখেছেন প্রচুর কবিতা। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হার্ডি, স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ, জন কিটস, মেরিডিথ, সুইনবার্ন প্রমুখ কবি ব্যালাডের অনুসরণে প্রচুর কবিতা লিখেছেন।

বাংলা ভাষার ব্যালাড জাতীয় আদি রচনা মৈমনসিংহ গীতিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কথা ও কাহিনি’ কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় মারাঠি ব্যালাডের অনুরণন আছে। রবীন্দ্রনাথই ব্যালাডের আধুনিক শিল্পসম্মত রূপকার। জসীমউদ্দীনের ‘নকসীকাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ব্যালাডের নিদর্শন হিসেবে অতুলনীয়।

বাংলা কবিতা

বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। ৭৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘চর্যাপদ’ রচনা 

করেছিলেন। ধর্মের গূঢ় রহস্য এর বিষয় হলেও সমকালের সামাজিক জীবনের বিভিন্নদিক এতে প্রতিফলিত হয়েছে। চর্যাপদের পর দীর্ঘকাল সামাজিক-রাষ্ট্রিক অস্থিরতার কারণে কবিতা রচিত হয়নি অথবা রচিত হয়ে থাকলে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগে প্রবেশ করে বড়ূ চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের মাধ্যমে। মধ্যযুগে বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি ঘটে বিচিত্রধারায়। নাথসাহিত্য, ধর্মমঙ্গল, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, জীবনী কাব্য, অনুবাদকাব্য, রোমান্সমূলক প্রণয়কথা (কারো কারো মতে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান) প্রভৃতি বিষয়ভাবনা ও রূপবৈচিত্র্যে বাংলা কবিতার বিকাশ ও উত্তরণে ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ইউরোপিয়ান শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রভাবে বাঙালি জীবনে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) প্রভৃতি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এদেশে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণঅবদান রেখেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় প্রথম আধুনিক জীবনের লক্ষণসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সর্বাঙ্গীন আধুনিক কবি। বিহারীলাল চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিক মান স্পর্শেসক্ষম হয়। কবিতার বিষয় ও রূপ-রীতি উদ্ভাবনে বাঙালি কবিরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

বাংলা কবিতার এক স্বতন্ত্রধারা বাংলাদেশের কবিতা। অভিন্নভাষায় রচিত হলেও সামাজিক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে বাংলাদেশের কবিতা পশ্চিমবাংলার কবিতা থেকে বিষয়বস্তুও আঙ্গিকে স্বতন্ত্র। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্রকরে বাংলাদেশের কবিতা নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের অভিজ্ঞতায় আমাদের কবিতায় যে চেতনা জন্ম নেয় পৃথিবীর কোনো দেশের সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এই সমাজ ও তার কবিতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের কবিতা

বাংলাদেশের কবিতায় স্বতন্ত্রভিত্তি রচিত হয় চলিশের দশকে। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্রধারার সঙ্গে শিল্পদৃষ্টির নতুনত্ব এ-সময়ের কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে। এ সময়ে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৬), আবুল হোসেন (১৯২১-), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-) প্রমুখ উলেখযোগ্য। আবুল হোসেনের ‘নববসন্ত’ (১৯৪০), ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৫), সৈয়দ আলী আহসানের ‘চাহার দরবেশ’ (১৯৪৫), আহসান হাবীরের ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭) কাব্যে উপকরণ, জীবনজিজ্ঞাসা ও শিল্পরীতির স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। 

পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প-ভাবনায় যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়। এ-সময়ের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুলাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গনি হাজারী, আজীজুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী উলেখযোগ্য। 

ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নবোদ্ভূত মধ্যবিত্তের জীবনচেতনার রূপায়ণে এ-পর্যায়ের কবিতা এক নতুন মাত্রা যোগ করে। 

ষাটের দশকে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মাহবুব সাদিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ উলেখযোগ্য। পাশ্চাত্য কবিতার ধ্যানধারণার সঙ্গে ব্যক্তিমানসের নিভৃতচারিতা ও রাজনীতি সচেতনতা এঁদের কবিতার স্বভাবধর্ম।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ-সময়ে উলেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ কবির আবির্ভাবে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন প্রাণবন্যা সূচিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্তবাংলাদেশের কবিতা যাঁদের সাধনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আবিদ আজাদ, সানাউল হক খান, সাজ্জাদ কাদির, সিকদার আমিনুল হক, আল মুজাহিদী, মাহবুব হাসান, হেলাল হাফিজ, রুদ্রমুহম্মদ শহীদুলাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ উলেখযোগ্য।

(জনাব মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এবং জনাব আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ কর্তৃক সম্পাদিত)

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

কবিতা: কবিতার স্বরূপ, শ্রেণিকরণ এবং বাংলা ও বাংলাদেশের কবিতা

প্রকাশ: ১২:৫৩:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

কবিতা

কবিতা নিয়ে কথা বলা যতো সহজ এর সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা ততটা সহজ কাজ নয়ম। কবিতা পছন্দ করে না পৃথিবীতে এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম। কবিতা সম্পর্কেযতো আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে, সাহিত্যের অন্য কোন রূপ সম্পর্কেতা হয়নি। প্রত্যেক সচেতন সংবেদনশীল মানুষের মধ্যেই কবিতার প্রতি আকর্ষণ রয়েছে। মানুষের বিস্ময়, স্মৃতি, স্বপ্ন, কল্পনার এক অপরূপ মিশ্রণে কবিতার সৃষ্টি। ব্যক্তির অনুভূতি, আবেগ, রহস্যানুভূতি প্রতিফলন ঘটায় প্রতিটি যথার্থ কবিতাই এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি। যথার্থ বলার কারণ, অনেক অনুকারী কবিতা আছে যেখানে মৌলিক অনুভবের পরিবর্তেঅন্য কোন কবির অনুভূতি, আবেগ ও সৃষ্টিশীল কল্পনার প্রতিধ্বনিই মুখ্য হয়ে ওঠে।

উপরের আলোচনা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, কবিতার সংজ্ঞার্থ নির্ণয় সহজ কাজ নয়। তবুও সাহিত্যের প্রতিটি শাখারই একটি মৌলিক মানদণ্ড আছে। সে মানদণ্ড বিচার করে কবিতা সম্পর্কেও একটা মোটামুটি ধারণা অর্জন করা যেতে পারে। বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের জন্য শব্দগুচ্ছের তাৎপর্যময় বিন্যাস থেকে কবিতার সৃষ্টি। কিন্তু এ ধারণাও পূর্ণাঙ্গ নয়। আরো সুস্পষ্ট করে বলা যায় আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানসের সাধারণ প্রবণতার অংশ; এগুলোর সঙ্গে যখন সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হয়, অনিবার্যশব্দের তাৎপর্যময় বিন্যাস তাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাময়। তখনই একটি কবিতার জন্ম সম্ভব হয়। এ গ্রন্থেঅন্তর্ভুক্ত পাঁচটি কবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের বিশেষণ থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করতে পারি। 

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভাষা’ কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে মাতৃভাষাপ্রেম ও গভীর দেশাত্মবোধ। কবি সনেটের আঙ্গিকে নিজের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা ও আত্মবিশেষণ থেকে মাতৃভাষার টানে স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়েছেন। চৌদ্দ মাত্রার চৌদ্দ চরণের সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনিবার্য কিছু শব্দের বিন্যাসের মাধ্যমে কবি নিজ অনুভূতি, আবেগ, স্মৃতি, স্বপ্ন ও বাস্তব প্রাপ্তির পরিপূর্ণছবি তুলে ধরেছেন এই কবিতায়। ‘বলাকা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আবেগের বেগকে স্মৃষ্টিজগতের অন্তর্নিহিত অবিরাম গতির ছন্দে অনুভব করেছেন। এ-কবিতায় শব্দ-ব্যবহার ও ছন্দ-পরিকল্পনা কবির অনুভূত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক-তরুর সারি’ কবিতায় প্রেমচেতনা ও প্রকৃতিচেতনার অনুপম মেলবন্ধন ঘটেছে। ‘বনলতা সেন’ সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

ব্যক্তিপ্রেম কিংবা দেশপ্রেম যাই-ই ব্যক্ত হোকনা কেন, হাজার বছরের পথচলার ক্লান্তপরিব্রাজক যখন উচ্চারণ করে  বলেছে সে, “এতদিন কোথায় ছিলেন?/পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’’  তখন দেশকালের সীমা লুপ্ত হয়ে মানুষের চিরকাঙ্ক্ষিত শুশ্রষার মমতাস্নিগ্ধ নারীর মাতৃমূর্তিই প্রধান হয়ে ওঠে। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’ ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত কবিতা। এ-কবিতায় মাতৃভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শোষণের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং সংগ্রামের দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা। পাঁচটি কবিতার বিষয়বস্তুর মতো আঙ্গিকরীতিও স্বতন্ত্র। শব্দচয়ন ও ব্যবহারে প্রত্যেক কবির রুচি আলাদা। কিন্তুপ্রতিটি কবিতাই আমাদের মধ্যে স্থায়ী আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম। সুতরাং সাধারণভাবে বলা যায়, কবির স্বতস্ফূর্ত অনুভূতি শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে জীবনের অন্তর্ময় এবং স্থায়ী আবেদন সৃষ্টির উপযোগী যে শব্দসৌধ সৃষ্টি করে তাই-ই কবিতা।

কবিতার শ্রেণিকরণ

প্রতিটি সাহিত্য আঙ্গিকেরই উপাদান মানুষের জীবন, পারিপার্শ্বকি সমাজ অর্থাৎ মানুষের চিন্তা ও কর্মের সঙ্গে সংশিষ্ট সকল প্রসঙ্গ। জীবনকে দেখার এবং উপস্থাপন করার বৈশিষ্ট্যই সাহিত্যের প্রতিটি আঙ্গিককে স্বতন্ত্রকরে দেয়। আবার এইসব সাহিত্যরূপের মধ্যে বিষয়বস্তু, আঙ্গিকবিন্যাস ও ভাষারীতির কারণে শ্রেণিকরণ অনিবার্যহয়ে পড়ে। কবিতার আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেধারণা অর্জন করতে হলে, তার বিভিন্নশ্রেণির স্বতন্ত্র-গঠনরীতি, ভাষাবিন্যাস, ছন্দরীতি প্রভৃতি বিষয়ে জানতে হবে।

নিম্নোক্তভাবে কবিতার বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থান বা প্রকারভেদ নির্দেশ করা যায়:

  • কবিতা
    • কাব্যনাট্য
    • মহাকাব্য
    • গীতিকবিতা
      • প্রার্থনাসংগীত (ঐুসহ)
      • ওড্ (Ode)
      • শোককবিতা (Elegy)
      • চতুর্দশপদী (ঝড়হবঃ)
      • ব্যালাড (Ballad)

কাব্যনাট্য

আদিযুগে কাব্যভাষাই ছিল সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। ফলে, নাটকের প্রাথমিক রূপ কাব্যনাটকেও কবিতার ভাষা ও ছন্দরীতি অনুসৃত হত। গ্রিক বা রোমান সাহিত্যের স্বর্ণযুগে নাটককে বলা হতো জীবনের অনুকরণ, ঘনিষ্ট প্রতিফলন। এলিজাবেথান যুগের (the Elizabethan Age) কালজয়ী নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের (William Shakespeare) নাটকগুলো জীবনের বহুমুখী বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করলেও কবিতার রূপরীতিই ছিলো তাঁর প্রধান অবলম্বন। সাধারণ দর্শক-শ্রোতার নিকট গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নাট্যসংলাপের ভাষাকে লৌকিক ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসেন নাট্যকাররা। মৌখিক ভাষার স্পন্দন নাটকের কাব্যগুণকে কিছুটা খণ্ডিত করলেও পরবর্তীকালে নাটকে গদ্যভাষার প্রয়োগ অনিবার্যকরে তোলে। কিন্তু কাব্যনাট্যের ধারা সাহিত্যের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়নি। উনিশ শতকে গিরিশচন্দ্রঘোষ, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু কাব্যনাটকের রূপরীতি, ভাষা ও ছন্দকে মানুষের পরিবর্তনশীল সাহিত্যরুচির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রভূত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

মহাকাব্য

কবিতার প্রাচীনতম শাখা মহাকাব্য; এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রিক  ‘এপোস’ (Epos) শব্দের ইংরেজি রূপান্তর ‘এপিক’ (Epic) মহাকাব্যের ইংরেজি প্রতিশব্দ। Epos শব্দের প্রাচীন অর্থ ‘শব্দ’। সময়ের বিবর্তনে এই শব্দের ওপর বিভিন্ন অর্থ আরোপিত হয়ে কখনো বিবরণ বা কাহিনি, কখনো গীতি বা বীরত্বব্যঞ্জক কাব্য। এভাবেই অর্থের রূপান্তর ঘটতে ঘটতে এক সময় Epic অর্থ দাঁড়িয়ে যায় আখ্যানমূলক বা বীরত্বব্যঞ্জক কবিতা।

গ্রিক সাহিত্যতাত্ত্বিক অ্যারিস্টটল তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘পোয়েটিক্স’-এ ট্র্যাজেডির ওপর বিস্তৃত আলোচনা করতে গিয়ে মহাকাব্যের লক্ষণ ও স্বরূপ সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন। কাহিনির বিস্তার-ধর্মিতা, ওজোগুণ-সম্পন্ন শব্দপ্রয়োগ ও হেকটামিটার ছন্দ মহাকাব্যের গঠনরীতির বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র্য। অ্যারিস্টটল আর যে দুটি লক্ষণের কথা বলেছেন, তা  অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। 

  • প্রথম লক্ষণ: বস্তুনিষ্ঠা বা objectivity কবির নির্লিপ্ততা, নিরাসক্তি। ঘটনা বা কাহিনির অন্তরালে কবির নিরপেক্ষ অবস্থান বা আত্মগোপন করার ক্ষমতা।
  • দ্বিতীয় লক্ষণ: অলৌকিক বিষয়বস্তুকে কাব্যসম্মতভাবে রূপদান করা। এ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের একটি মন্তব্য মূল্যবান ‘অবিশ্বাস্য সম্ভবের চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অসম্ভব অনেক বেশি কাম্য’।

মহাকাব্যের বিষয়বিন্যাস ও গঠনকৌশলে বৈচিত্র্য, ব্যাপকতা ও অভিনবত্ব সুস্পষ্ট। এর ঘটনা বা পট গ্রন্থনে আদি-মধ্য-অন্ত্যের ঐক্য থাকতে হবে, নায়ক বীর্যবত্তা ও দক্ষতায় বহুগুণে গুণান্বিত। এর বস্তু-উপাদান জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক তথ্য ও ঘটনা, এর অনুপ্রেরণা-উৎস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐশীশক্তি। মহাকাব্যে মানব-দানব, দেব-দেবী চরিত্রের সমাবেশ ঘটায় অলৌকিকতার প্রয়োগ ঘটে থাকে।

মহাকাব্য দুই প্রকার:

১. জাত মহাকাব্য (Epic of Growth)

জাত মহাকাব্যে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের যূথবদ্ধ জীবনপ্রণালী, মানব-মানবীর আচার-আচরণ, বিশ্বাস, প্রেম, সংগ্রাম বিন্যস্ত হয়। নির্দিষ্ট সময়খণ্ডের পরিবর্তেএকটি সমাজের অতীত বর্তমানের দীর্ঘসময়-সীমা জাত মহাকাব্যে অনুসৃত হয়। ব্যক্তিবিশেষ রচনা করলেও জাত মহাকাব্যে সামাজিক ঘটনা-পরিক্রমা ও জীবনের সমাগ্রিক রূপায়ণ ঘটে। বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত ‘মহাভারতে’র ঘটনা, বিষয়বস্তু ও চরিত্রের বৈচিত্র্য ভারতবর্ষের অদিকালের গোটা সমাজ ব্যবস্থাকেই উন্মোচন করেছে।

হোমার রচিত ইলিয়ড ও ওডেসি প্রাচীন গ্রীসের যৌথ সমাজব্যবস্থার মহাকাব্যিক রূপ। ইলিয়ড-এ ট্রয়যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের কাহিনি অবলম্বিত হলেও দশ বছর ব্যাপ্ত যুদ্ধের সমগ্র ছবিই কবির গ্রন্থণ নৈপুণ্যে এতে বিধৃত হয়েছে। ওডেসিতে ট্রয় যুদ্ধের ঘটনাপ্র বাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেই থাকা রাজ্যের জনজীবন, নায়ক ওডেসিয়ুসের অবিশ্বাস্য ভ্রমণ ও সংগ্রাম এবং পেনিলোপির বিড়ম্বিত ভাগ্য জীবন। হোমার ঘটনা ভারাক্রান্ত মহাকাব্যে চরিত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

২. সাহিত্যিক মহাকাব্য (Literary Epic)

সাহিত্যিক মহাকাব্য পৌরাণিক ঘটনা কিংবা কোনো জাত মহাকাব্যের ঘটনাসূত্র অবলম্বনে কবির যুগমানস, সমাজমানস ও দৃষ্টিভঙ্গির সমবায়ে এক আধুনিক সৃষ্টি। এই শ্রেণির মহাকাব্যের মধ্যে ভার্জিলের ‘ইনিদ’ (Eneid) তাসোর ‘জেরুজালেম ডেলিভার্ড’ (Jerusalem Delivered), দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’

(Divine Comedy), জন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (Paradise Lost) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ উলেখযোগ্য। পুরাতনের আশ্রয়ে নতুন যুগের জীবনসত্য প্রতিটি সাহিত্যিক মহাকাব্যেরই বিষয়বস্তু।

গীতিকবিতা

ব্যক্তি-অনুভূতির স্বত:স্ফূর্ত প্রকাশ গীতিকবিতার প্রধান লক্ষণ। সাবলীলতা ও সহজতায় এই কাব্য-আঙ্গিক সর্বাপেক্ষা বৈচিত্র্যময় ও প্রভাবশালী। প্রাচীন গ্রিসে বীণাযন্ত্র সহযোগে যে সংগীত পরিবেশিত হতো ম, তাকে বলা হতো লিরিক (Lyric)। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে Lyric বা গীতিকবিতার সঙ্গে সংগীত ধর্মের সম্পর্ক সুনিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা একই সঙ্গে কবিতা ও গান। তবুও মনে রাখতে হবে সংগীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুবিচিত্র। মানবীয় অনুভূতির বহুমুখী সত্য গীতিকবিতায় রূপ পায়। সংগীতে থাকে সুরের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ, আর গীতিকবিতায় কথা ও সুরের সমন্বয়। ফলে, সংগীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুগুণে বিস্তৃত। ব্যক্তি অনুভূতির সূক্ষ্মতর প্রকাশ অনিবার্য শব্দ, ধ্বনি এবং ছন্দ বিন্যাসে গীতিকবিতায় রূপ পায় বলে আদিকাল থেকেই কবিতার এই রীতি সর্বাধিক চর্চিত সাহিত্যধারা। এ প্রসঙ্গে মহাকাব্যের সঙ্গে গীতিকবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত পার্থক্যের স্বরূপ নির্দেশ করা প্রয়োজন। মহাকাব্যের বিষয় আঙ্গিক ও পূর্বনিরূপিত আর গীতিকবিতার বিষয়, রীতি ও সময়, সমাজ ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মহাকাব্য বস্তুনিষ্ঠ (objective) আর গীতিকবিতা ভাবনিষ্ঠ (subjective) কবিতা।

গীতিকবিতার বিচিত্র রূপ-রীতি

লিরিক বা গীতিকবিতার জনপ্রিয়তার ও ধারাবাহিকতা উৎস এর রূপগত বৈচিত্র্য থেকেই অনুধাবন করা সম্ভব।

স্তবসংগীত বা Hymn

সৃষ্টিকর্তা বা দেবতার উদ্দেশে রচিত প্রার্থনামূলক কবিতাকে বলা হয় হিম্ বা স্তব সংগীত। এ ধরনের কবিতা জনসাধারণের সামনে গাওয়া হতো আবার আবৃত্তিও করা হতো। অর্থাৎ সংগীতধর্ম বা কাব্যগুণ উভয়ই স্তবসংগীতের বৈশিষ্ট্য। আধ্যাত্মিকতা ও ভক্তিভাব এ কবিতার প্রাণ। শ্রোতাসাধারণের মনে মহৎ ভাবনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে স্তবসংগীত রচিত হতো। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে এ ধরনের সংগীতধর্মপ্রধান কবিতা হয়েছে প্রচুর। বৈষ্ণব পদাবলী, শ্যামাসংগীত ও বাউল গানে স্তবসংগীতের বৈশিষ্ট্য সুস্পট। রবীন্দ্রানাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ও ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় স্তবসীঙ্গত বা Hymn এর বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

স্তোত্রকবিতা বা ওড্ (Ode)

বাংলা ভাষায় ওড্-এর কোন প্রতিশব্দ নেই। বিষয়বস্তু ও গঠনবৈশিষ্ট্য অনুসারে একে স্তোত্রকবিতা বলা যেতে পারে। কবি কোনো মহৎ ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ব্যক্তি বা বস্তুর উদ্দেশে সমিল বা অমিল ছন্দে যে কবিতা রচনা করেন তাই-ই ওড্ বা স্তোত্র কবিতা । প্রাচীন গ্রিক কবি পিণ্ডার ওড্ রচনার ক্ষেত্রে পথিকৃত। রোমান কবি হোরেসও বেশ কিছু ওড্ রচনা করেছেন । বাংলা সাহিত্যে সচেতনভাবে ওড্ রচনার সূত্রপাত মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’ কিংবা ‘উর্বশী’ ওড্-এর আধুনিক রূপায়ণ। ওড্-এর লক্ষণযুক্ত উল্লেযোগ্য সংখ্যক কবিতা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে।

শোককবিতা বা এলিজি (Elegy)

মূল গ্রিক শব্দ ঊষবমরধ-এর অর্থ হলো বেদনার আর্তি। এই শব্দ থেকে Elegy শব্দের উৎপত্তি। ঊষবমরধ বা ঊষবমড়ং কেবল শোক অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হতো না। প্রাচীন গ্রিক এবং ল্যাটিন সাহিত্যে এলিজিয়াক (Elegiac) নামে ৬+৫ মাত্রায় (প্রথমে ছয় পরে পাঁচ) রচিত এক ধরনের কবিতা প্রচলিত ছিলো। সময়ের বিবর্তনে এলিজি বলতে এখন কেবল শোক কবিতাকেই বোঝায়। এ রীতির কবিতায় কবির ব্যক্তিগত শোক কিংবা জাতীয় শোক রূপায়িত হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত বিচ্ছেদ-বেদনা, কোনো জাতীয় ব্যক্তিত্বের মৃত্যুজনিত উপলব্ধি থেকে শোককবিতার সৃষ্টি। গ্রিক কবি বিয়ন রচিত ‘ল্যামেন্ট ফর অ্যাডোনিস’ (Lament for Adonis) বিশেষ ধরনের শোককবিতা প্যাসটাল এলিজির (Pastal Elegy)আদি দৃষ্টান্ত। জন মিল্টনের ‘লিসিডাস’ (Licidus) এবং শেলির ‘অ্যাডোনিস’ (Adonis) এই ধারার আরও অগ্রসর পর্যায়ের কবিতা। বিয়নের কবিতা শোকেই শুরু এবং সমাপ্তি। কিন্তু মিল্টন এবং শেলি তাঁদের শোকের মধ্যে প্রত্যাশা ও আনন্দের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। টমাস গ্রের Elegy written in country churchyard সর্বাধিক পঠিত শোক কবিতা। প্রিয়জন কিংবা কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়, নাম না জানা কোনো গ্রামের মৃত কৃষিজীবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে কবিতাটি। টেনিসনের এলিজিগুচ্ছের নাম In Memorium। 

বাংলা ভাষায় শোককবিতা রচিত হয়েছে প্রচুর। কিন্তসে-তুলনায় কালোত্তীর্ণকবিতার সংখ্যা কম। প্রায় সকল কবিই শোককে ভাষারূপ দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত স্ত্রীর উদ্দেশে রচিত কবিতা গুচ্ছ ‘স্মরণ’ শোককবিতারই আধুনিক রূপায়ন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮’, মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুতে প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘তিনটি গুলি’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু উপলক্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচিত ‘পাথরের ফুল’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ সার্থক এলিজির দৃষ্টান্ত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অকাল প্রয়াণে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘চিত্তনামা’। জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ পারিবারিক শোককবিতার অনন্য দৃষ্টান্ত। 

সনেট বা চতুর্দশপদী

সনেট শব্দটির উৎপত্তি ইটালিয়ান ‘সনেটো’ (soneto)। সনেটো শব্দের অর্থ মৃদুধ্বনি। ইটালিয়ান কবি দান্তেও পেত্রার্ক সনেটের জনক বা আদি রচিয়তা। একটি অখণ্ড অনুভূতি যখন ১৪ মাত্রার (কখনো কখনো ১৮ মাত্রাও হয়) ১৪ পংক্তিতে ( কখনো কখনো ১৮ পংক্তির ব্যবহারও দেখা যায়) বিন্যস্তহয়ে আবেগের শিখর স্পর্শকরে, তখনই একটি সার্থক সনেট জন্ম নেয়। বাংলা সাহিত্যের প্রথম বা আদি এবং সার্থক সনেট রচিয়তা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সনেটের আঙ্গিককে ‘চতুর্দশপদী’ হিসেবে নির্দিষ্টকরেছেন। পরবর্তীকালের সার্থক সনেট রচিয়তাগণ এই রীতিই মূলত অনুসরণ করেছেন। সনেটের প্রথম আট পংক্তিকে বলা হয় অষ্টক (octave)। এই প্রথম অংশে কবির ভাব বা কল্পনা ঈঙ্গিতময় রূপ লাভ করে। শেষ ছয় চরণকে বলা হয় ষটক (sestet)  এ-অংশে পূর্ববর্তীভাবের বিস্তৃতিসাধন বা ব্যাখ্যা দান করা হয়। সনেটের বক্তব্য বিন্যাসের এই রীতি মধুসূদন দত্ত অনুসরণ করেছেন। তাঁর ‘বঙ্গভাষা’ কবিতাটি বিশেষণ করলে এ মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হবে।

‘বঙ্গভাষা’ কবিতার প্রথম আট চরণে কবি নিজের আত্মরূপান্তরের ঈঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, বঙ্গভাণ্ডারে বিচিত্র রত্নসম্ভার থাকা সত্ত্বেও তিনি মত্ত থেকেছেন পরসম্পদ লোভে। পরদেশে (বিদেশে) ভ্রমণ করে জীবনযাপনের মধ্যে ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট অভিরুচিই ফুটে ওঠে। ব্যর্থসাধনায় তাঁর জীবনে সাফল্যের পরিবর্তে এসেছে হতাশা। মাতৃভূমি রূপ পদ্মকানন পরিত্যাগ করে শৈবালের আবেষ্টনীতে আবদ্ধ থেকে নষ্ট করেছেন জীবনের সকল সম্ভাবনার পথ। এই অংশে কবির আত্মবিশেষণ প্রাধান্য পেয়েছে। পরবর্তী ছয় চরণে কবি কুললক্ষ্মী তথা দেশমাতৃকার পথনির্দেশনা পেয়ে যান স্বপ্নে। ‘পালিলাম আজ্ঞা সুখে ; পাইলাম কালে/মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণমণিজালে॥’ অত্যন্তনিষ্ঠা ও সতর্কতায় মধুসূদন সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার আঙ্গিক নির্মাণ করেছিলেন।

ব্যালাড (Ballad)

গীতিকবিতার আদিরূপ হিসেবে বিচার করা যায় ব্যালাড বা গীতিগাথাকে। ইতালীয় শব্দ বালারে (ballare) থেকে ব্যালাড শব্দের উৎপত্তি। বালারে শব্দের অর্থ ‘নৃত্য করা’। অর্থাৎ কবিতার সঙ্গে নৃত্য ও নাটকীয়তার মিশ্রণে ব্যালাডের সৃষ্টি। ব্যালাড-এ প্রেম, ধর্ম, বীরত্ব, রাজনীতি, সামাজিক প্রসঙ্গ, হাস্যরস ও করুণরসের ঘটনা স্থান পেত। আদি ব্যালাডগুলোর রচয়িতারা অজ্ঞাতনামা। মূলত লোকজীবন তথা গ্রামজীবনের বিচিত্র প্রসঙ্গ ব্যালাড-এ স্থান পেয়েছে। এতে ব্যক্তি কিংবা সামষ্টিক জীবনের বেদনাকরুণ কাহিনিরই প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। আধুনিক রোমান্টিক যুগের কবিরা ব্যালাডের অনুসরণে লিখেছেন প্রচুর কবিতা। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হার্ডি, স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ, জন কিটস, মেরিডিথ, সুইনবার্ন প্রমুখ কবি ব্যালাডের অনুসরণে প্রচুর কবিতা লিখেছেন।

বাংলা ভাষার ব্যালাড জাতীয় আদি রচনা মৈমনসিংহ গীতিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কথা ও কাহিনি’ কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় মারাঠি ব্যালাডের অনুরণন আছে। রবীন্দ্রনাথই ব্যালাডের আধুনিক শিল্পসম্মত রূপকার। জসীমউদ্দীনের ‘নকসীকাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ব্যালাডের নিদর্শন হিসেবে অতুলনীয়।

বাংলা কবিতা

বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। ৭৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বৌদ্ধ সহজিয়ারা ‘চর্যাপদ’ রচনা 

করেছিলেন। ধর্মের গূঢ় রহস্য এর বিষয় হলেও সমকালের সামাজিক জীবনের বিভিন্নদিক এতে প্রতিফলিত হয়েছে। চর্যাপদের পর দীর্ঘকাল সামাজিক-রাষ্ট্রিক অস্থিরতার কারণে কবিতা রচিত হয়নি অথবা রচিত হয়ে থাকলে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগে প্রবেশ করে বড়ূ চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের মাধ্যমে। মধ্যযুগে বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি ঘটে বিচিত্রধারায়। নাথসাহিত্য, ধর্মমঙ্গল, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, জীবনী কাব্য, অনুবাদকাব্য, রোমান্সমূলক প্রণয়কথা (কারো কারো মতে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান) প্রভৃতি বিষয়ভাবনা ও রূপবৈচিত্র্যে বাংলা কবিতার বিকাশ ও উত্তরণে ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ইউরোপিয়ান শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রভাবে বাঙালি জীবনে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) প্রভৃতি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এদেশে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণঅবদান রেখেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় প্রথম আধুনিক জীবনের লক্ষণসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সর্বাঙ্গীন আধুনিক কবি। বিহারীলাল চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিক মান স্পর্শেসক্ষম হয়। কবিতার বিষয় ও রূপ-রীতি উদ্ভাবনে বাঙালি কবিরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

বাংলা কবিতার এক স্বতন্ত্রধারা বাংলাদেশের কবিতা। অভিন্নভাষায় রচিত হলেও সামাজিক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে বাংলাদেশের কবিতা পশ্চিমবাংলার কবিতা থেকে বিষয়বস্তুও আঙ্গিকে স্বতন্ত্র। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্রকরে বাংলাদেশের কবিতা নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের অভিজ্ঞতায় আমাদের কবিতায় যে চেতনা জন্ম নেয় পৃথিবীর কোনো দেশের সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এই সমাজ ও তার কবিতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের কবিতা

বাংলাদেশের কবিতায় স্বতন্ত্রভিত্তি রচিত হয় চলিশের দশকে। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্রধারার সঙ্গে শিল্পদৃষ্টির নতুনত্ব এ-সময়ের কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে। এ সময়ে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৬), আবুল হোসেন (১৯২১-), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-) প্রমুখ উলেখযোগ্য। আবুল হোসেনের ‘নববসন্ত’ (১৯৪০), ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৫), সৈয়দ আলী আহসানের ‘চাহার দরবেশ’ (১৯৪৫), আহসান হাবীরের ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭) কাব্যে উপকরণ, জীবনজিজ্ঞাসা ও শিল্পরীতির স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। 

পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প-ভাবনায় যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়। এ-সময়ের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুলাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গনি হাজারী, আজীজুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী উলেখযোগ্য। 

ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নবোদ্ভূত মধ্যবিত্তের জীবনচেতনার রূপায়ণে এ-পর্যায়ের কবিতা এক নতুন মাত্রা যোগ করে। 

ষাটের দশকে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মাহবুব সাদিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ উলেখযোগ্য। পাশ্চাত্য কবিতার ধ্যানধারণার সঙ্গে ব্যক্তিমানসের নিভৃতচারিতা ও রাজনীতি সচেতনতা এঁদের কবিতার স্বভাবধর্ম।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ-সময়ে উলেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ কবির আবির্ভাবে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন প্রাণবন্যা সূচিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্তবাংলাদেশের কবিতা যাঁদের সাধনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আবিদ আজাদ, সানাউল হক খান, সাজ্জাদ কাদির, সিকদার আমিনুল হক, আল মুজাহিদী, মাহবুব হাসান, হেলাল হাফিজ, রুদ্রমুহম্মদ শহীদুলাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ উলেখযোগ্য।

(জনাব মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এবং জনাব আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ কর্তৃক সম্পাদিত)