সোমবার, জুন ৫, ২০২৩

ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে মুক্তির উপায় কী?

ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি (dengue) বর্তমান বাংলাদেশের এক অন্যতম আতঙ্কের নাম। একদিকে যখন করোনা মহামারীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে মানুষ ক্লান্ত ঠিক তখনই অন্যদিক থেকে আকস্মাৎ আঘাত হানছে ডেঙ্গু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)- এর তথ্যানুযায়ী বিশ্বে মশাবাহী রোগসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী হলো ডেঙ্গু।

বিগত ৫০ বছরে ডেঙ্গু বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩০ গুণ। ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং পাঁচ হাজার পাঁচশো মানুষ আক্রান্ত হয়। প্রতিবছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করে  ২০১৯ সালে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সেবছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ১৭৯ জন মারা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ৭০১ জন। এবং মৃত্যু ৫৯ জন।

ডেঙ্গু কেন হয়?

মূলত এডিস এজিপ্টি (Aedes aegypti) নামক এক জাতের মশার কামড় থেকে ডেঙ্গু নামের এই রোগ হয়। ট্রপিক্যাল বা সাব ট্রপিক্যাল এলাকা এই মশাদের আবাসস্থল হিসেবে বিশেষ পছন্দের। ছোট ও কালো রং এবং পায়ের সাদা ও শরীরের রূপালী সাদা ব্যান্ড দেখে এদেরকে শনাক্ত করা যায়। একটি সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক মশা যে কোন স্থানে জমে থাকা পানিতে বংশবিস্তার করতে পারে। সাধারণত এরা ফেলে রাখা টায়ার, ব্যারেল, প্লাস্টিকের ড্রাম, ফুলের টব, ডাবের খোলা, দীর্ঘদিন পাত্রে জমে থাকা পানির মধ্যে বংশবিস্তার করতে পছন্দ করে। এছাড়াও এডিস মশাদের বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ আরও অনেক ইনডোর ও আউটডোর সাইট রয়েছে। এক চামচ পরিমাণ পানিতেই এরা ডিম পাড়তে পারে ও সেখানে সৃষ্ট লার্ভা থেকে সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক মশা তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ, এরা মূলত  যেখানে স্বচ্ছ ও স্থির পানি জমে থাকে সেখানেই বংশবিস্তার করতে সক্ষম। স্ত্রী এডিস মশা পানি জমে থাকা পাত্রের ভিতরের ভেজা দেওয়ালে ডিম পাড়ে, এবং প্রায় ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে তা থেকে লার্ভা বেরিয়ে আসে। ৪ দিনের মধ্যে, সেই লার্ভা মাইক্রো- অরগ্যানিজম ও ক্ষুদ্র জৈব পদার্থগুলো খাওয়া শুরু করে এবং লার্ভা থেকে পিউপা’তে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেগুলো মাত্র দুই দিনের মধ্যেই প্রাপ্তবয়স্ক শরীরে পরিণত হয়ে ওড়ার যোগ্য মশা হয়ে ওঠে।

কখন ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়?

বাংলাদেশে সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়।  ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী  মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয়দিনের ভিতর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবানুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেটিও ডেঙ্গুর জীবাণুবাহীতে পরিণত হয়। এভাবেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি হতে মশার মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে ডেঙ্গু সংক্রমিত হয়। 

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষ্মণ উপসর্গ

  • ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সাথে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে।
  • জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। 
  • শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমড়, পিঠ সহ অস্থি সন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় বুঝি হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’।
  • জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র‌্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো।
  • বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে।
  • রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়।

ঝুঁকি কতটুকু?

সাধারণত ৪ বা ৫ দিন জ্বর থাকার পর তা এমনিতেই চলে যায় এবং কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে এর ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। এছাড়াও সবচেয়ে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয় হেমোরেজিক জ্বরে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনী আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতায় প্রাণসংশয় পর্যন্ত ঘটতে পারে।

ডেঙ্গুর প্রতিষেধক নেই, কিন্তু প্রতিরোধের উপায় কী?

এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তাই প্রতিরোধই এ ভাইরাস মোকাবেলার সর্বোত্তম পন্থা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রধান হাতিয়ার হলো সচেতনতা। সরকার এবং জনগণের সমন্বিত সচেতনতাই পারে এই মহামারী থেকে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার আগে দৃষ্টি দিতে হবে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি এবং উৎপত্তিস্থলের দিকে। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস এবং পূর্ণবয়স্ক মশার বিনাশ এই দুটি পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সরকার এবং জনগণ সমন্বিত ভাবে এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে পারে। জনগণ যেমন  মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের ব্যাপের সচেতন হবে একই সাথে বয়স্ক মশক নিধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে।

ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে জনগনের কাজ গুলো হবে, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।বাড়িতে থাকা ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা যেন সেগুলোতে পানি জমতে না পারে। ব্যবহৃত জিনিস যেমন মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যাপারে সচেতন থাকা। ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি রাখা যাবে না।  একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচের পানিও যেন দীর্ঘদিন জমে না সেদিকে নজর রাখা। দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে বের হতে হওয়া, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমানো। বাচ্চাদের যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফপ্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট বা পায়জামা পরিয়ে স্কুলে পাঠানো। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখা, যাতে করে রোগীকে কোন মশা কামড়াতে না পারে। মশক নিধনের জন্য স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সাথে সাথে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করা। ” অন্যদিকে ডেঙ্গু বিস্তার রোধে সরকারের সর্বপ্রধান কাজ হবে জনগনকে সচেতনতার আওতায় নিয়ে আসা। ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ পদ্ধতিতে কিভাবে ডেঙ্গু নিধন করা যায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট গবেষকরদের কাজে লাগানো। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত ন্যাশনাল গাইডলাইন প্রদান করা। নিয়মিত মশক নিধন স্প্রে ছিটানো। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণ এবং  প্রয়োজনে বিশেষ ফোর্স কাজে লাগানো।

শেষ কথা

সর্বোপরি, ডেঙ্গু মহামারী থেকে সুরক্ষিত থাকতে জনগণ এবং সরকার উভয়পক্ষকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল থাকতে হবে। নিজে সচেতন না থেকে শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা যেমন ডেঙ্গু থেকে মুক্তি দিতে পারবে না একইভাবে তা হবে জাতীয় স্বার্থের জন্যও হুমকিস্বরূপ। তাই সবার আগে প্রয়োজন আত্নসচেতনতা। পাশাপাশি প্রয়োজন সরকার-জনগণ সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রয়োগ। একমাত্র উভয় পক্ষের দায়িত্বশীল আচরণই পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমিয়ে এই সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করতে।

সৈয়দ রিফাত
সৈয়দ রিফাত
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

For all latest articles, follow on Google News

বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে 'বিশ্লেষণ'-এর জন্য স্পনসরশিপ খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইমেইল: contact.bishleshon@gmail.com

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here