০৩:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

অর্থায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ (ফিন্যান্সের ইতিহাস)

  • প্রকাশ: ১০:৪৯:২০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ৩৪০৮ বার পড়া হয়েছে

অর্থায়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এক সময় মানুষ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বিনিময় করতো। একটি পণ্যের বিনিময়ে আরেকটি পণ্য গ্রহণ এবং প্রদানকে বার্টার ট্রেড বা বার্টার সিস্টেমস বলা হতো। কিন্তু দ্রব্য বিনিময় প্রথার কিছু সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় এবং এ সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্যই অর্থের সূচনা হয়। অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পণ্য দ্রব্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমবিভাগের সূচনা ঘটে। অষ্টদাশ এবং উনবিংশ শতাব্দিতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও উৎপাদনক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে যা শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে অর্থায়ন বা ফিন্যান্সের (Finance) ধারণা ও ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থায়ন মূলত হিসাব-রক্ষণ ও আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কার্যক্রম ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতো। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্ল্যাসিক্যাল ধারার ব্যষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের সাথে অর্থায়ন সম্পৃক্ত ছিল। অর্থায়নের ক্রমবিকাশের ধারা অর্থায়নের প্রকৃতি ও আওতা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। তাছাড়া ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন রকম প্রতিবেদন প্রস্তুত করণ এবং নগদ অর্থের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান যাতে করে যথাসময়ে প্রদেয় বিল পরিশোধ করতে পারে, তা অর্থায়নের ধারায় অর্থায়নের কাজ হিসেবে অন্তরভূক্ত হয়। কিন্তু সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আওতা ও পরিধি বৃদ্ধি ও প্রযক্তিগত উন্নয়ন একজন  আর্থিক ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কার্যাবলীকে পরিবর্তন করেছে সেই সাথে অর্থায়ন বিষয়ক ধারণা ও পরিবর্তিত হয়েছে।

নিম্নোক্ত আলোচনায় অর্থায়নের ক্রমবিকাশের ধারা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো: 

১৯২০ এর পূর্ববর্তী দশক

বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে অর্থায়নের যাত্রা শুরু হয়। এর পূর্বে অর্থায়নকে অর্থনীতির একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সে সময় অর্থায়ন মূলধন বাজারের দলিলাদি, প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮৯০ সাল থেকে ১৯০০ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলির মধ্যে একত্রিকরণ প্রক্রিয়া চালু হয়। ১৮৯৯ সালে জে. ডি. রকি ফেলার যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি শহরে Standard Oil Company গঠনের মাধ্যমে Standard Oil Group of Companies গুলিকে একত্রিকরণ করে। এই একত্রিকরণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল স্থায়ী উৎপাদন খরচ কমিয়ে বাজারে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করা। ১৯০০ সালে ইউ. এস. স্টিল কোম্পানি (U. S. Steel Company)  গঠিত হয়ে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ৬৩ শতাংশ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে। ওই সময় ওই কোম্পানির মূলধন ছিল প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ইতোপূর্বে কখনও কোন কোম্পানির ছিল না। তখন আরও প্রায় ৩০৭টি কোম্পানি একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কাজ করছিল। স্টীল কোম্পানি ছাড়াও একত্রীকৃত কোম্পানি ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিল। আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি কোম্পানির সাথে অন্য একটি কোম্পানি একত্রীকরণ করলে প্রতিষ্ঠান লাভজনক হবে এই বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে আর্থিক ব্যবস্থাপকদের কে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তখন আর্থিক ব্যবস্থাপকদের কোম্পানিগুলোর একত্রীকরণে বড়ো অংকের অর্থসংস্থান ও আর্থিক বিবরণী তৈরির দায়িত্বও পালন করতে হয়। ঐ একত্রিকরণ প্রক্রিয়ার জন্য বড়ো ধরণের অর্থসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং মূলধন কাঠামো ব্যবস্থাপনা কোম্পানির একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। সেই সময় থেকে অর্থসংস্থান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটা পৃথক ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এটা উলেখ্য যে, ঐ সময়ে কোম্পানির আর্থিক বিবরণী তৈরি ও তার বিশ্লেষণ ছিল প্রাথমিক স্তরে যা শুধু কোম্পানির অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো। 

১৯৩০-এর দশক

একত্রীকরণ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রে আশানুরূপ সফলতা পায়নি। আগের দশকে একীভূত অনেক প্রতিষ্ঠানই পরের দশকে দেউলিয়া হয়ে যায়। উপরন্তু ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চরম মন্দা শুরু হয়। অনেক লাভজনক প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানির তালিকায় পড়ে যায়। এমতাবস্থায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করে কীভাবে দেউলিয়াত্ব থেকে রক্ষা করা রাখা যায়, সে ব্যাপারে আর্থিক ব্যবস্থাপক বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় বেকারত্বের হার ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে ৩.২% থেকে ২৫% এ উন্নীত হলো। কিছু কিছু কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেলো, এমন কি অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য টিকে থাকাই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।

প্রথমদিকে মূলধন কাঠামো সিদ্ধান্তে ঋণকে অর্থসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হতো যা ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা ও তারল্য সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দিলো। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পুনর্বাসন ও টিকে থাকার পরিকল্পনা আর্থিক ব্যবস্থাপনার নতুন কার্যাবলী হিসেবে বিবেচিত হলো। অর্থনৈতিক অবস্থাসমূহ ফেডারেল (Federal) বিধান চালু করল যা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। 

১৯৪০-এর দশক

চল্লিশের দশকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা হয়। নগদ অর্থপ্রবাহের বাজেট করে সুপরিকল্পিতভাবে নগদপ্রবাহের মাধ্যমে অর্থায়ন সে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৪৫ সালে শেষ হয়। এসময়ে অনেক কোম্পানি প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উৎপাদন শুরু করে। সরকার প্রতিরক্ষা শিল্প উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয়ে অর্থের যোগান দেয়। কিন্ত ঐ সকল কোম্পানির চলতি মূলধন ব্যবস্থাপনা আর্থিক ব্যবস্থাপকদের নিকট একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালে আর্থিক ব্যবস্থাপকদের স্বাভাবিক অবস্থায় যেসব কোম্পানি বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করত সেসব কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কিভাবে সংগ্রহ করা হবে সে দায়িত্ব পালন করতো। এছাড়াও ঐসব কোম্পানির বিক্রয়ের পরিমাণ অধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রয়োজনীয় চলতি মূলধন কিভাবে সংগ্রহ করা হবে সে দায়িত্বও পালন করে। 

১৯৫০ এর দশক

১৯৪০ থেকে ১৯৫০ এর দশকের প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সময়কে অর্থসংস্থানের সনাতন যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে বিকশিত হয়েছিলো। সে সময় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে বহিরাগতদের (Outsiders) থেকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। যেমন- বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতা, কিন্তু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ভিতর সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বিবেচনা করা হতো না। এই ধারাকে অর্থায়নের সনাতন ধারা বলা হয়। ১৯৫০ এর দশকে অর্থায়নের সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনার উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। তহবিল সংগ্রহ করে কিভাবে তা লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করা যায় তা অর্থায়নের প্রধান কাজ হিসেবে পরিগনিত হয়। এ সময়ে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের জন্য মূলধন বাজেটিং এবং প্রকল্প মূল্যায়ণে গাণিতিক বিশ্লেষনের ব্যবহার, নগদ বাজেটিং, অভ্যন্তরীণ অর্থসংস্থান ও নিয়ন্ত্রনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৫০ -এর দশকের মধ্যভাগে মূলধন বাজেটিং ও অন্যান্য সম্বন্ধযুক্ত বিষয়সমূহ অর্থসংস্থানকে পুরোপুরিভাবে ত্বরান্বিত করল। ফলে নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে নতুন কৌশল ও পদ্ধতির আবির্ভাব হলো যা ব্যবসায়ের মূলধনের দক্ষ বন্টনের কাজকে ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করলো।

১৯৬০-এর দশক

আধুনিক অর্থায়নের যাত্রা শুরু ১৯৬০ এর দশকে। অর্থায়ন মূলধন বাজারকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক শেয়ারহোল্ডাররা ফলে শেয়ার হোল্ডারদের সম্পদ বা শেয়ারের বাজারমূল্য সর্বাধীককরণই ছিল এই সময়ের অর্থায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য। আর এই উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য নানা রকম আর্থিক বিশ্লেষণমূলক কার্যাবলী শুরু হয়। সাধারণত অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঝুঁকির ধারণা হলো এই যে মুনাফা বৃদ্ধির সাথে সাথে ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং মুনাফা সর্বাদীককরণ সর্বদা কাক্সিক্ষত নাও হতে পারে। 

১৯৫০-এর দশকের পর মূল্যায়ন মডেল (Valuation Model) এর উদ্ভব হয়। সাধারনত এই মূল্যায়ন মডেল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যবহূত হতো। মূল্যায়ন মডেলের উন্নয়নের ফলে মূলধন কাঠামো ও লভ্যাংশ নীতি প্রচলিত হয়। মূলধন বাজেটিং -এর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করার জন্য অর্থসংস্থানে সমন্বিত প্রথার সৃষ্টি হলো। ১৯৫৮ ও ১৯৬১ সালে ফ্রাংকো মডিগলিয়ানি ও মার্টন মিলার (Modigliani & Miller) এই বিষয়ের উপর এক তত্ত্ব লেখেন যা তাত্ত্বিক অনুসন্ধানকে আরো বিকশিত করে, যা এখনও বিরাজমান রয়েছে।

১৯৬০ -এর দশকের প্রধান ঘটনা হলো পত্রকোষ তত্ত্ব Portfolio Theory এর উন্নয়ন এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এর যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগ। Markowitz সর্বপ্রথম ১৯৫২ সালে এই তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটান । তারপরে Willism Sharpe, Lintner, Fama এই তত্ত্বের আরো অনেক প্রবৃদ্ধি ঘটান । এই তত্ত্বের মূলকথা হলো- ‘কোন বিশেষ আর্থিক সম্পত্তির ঝুঁকি তার সম্ভাব্য আয়ের আলোকে বিচার করা হবেনা বরং এই বিশেষ আর্থিক সম্পত্তির যে প্রান্তিক প্রতিদান আছে মোট ঝুঁকির (মোট সম্পত্তির) ভেতর তার ভিত্তিতে ঐ বিশেষ সম্পত্তির ঝুঁকির মূল্যায়ন করা হবে।’ পত্রকোষের (Portfolio) অন্যান্য সম্পত্তির সাথে ঐ স্বতন্ত্র সম্পত্তির সম্পর্কের মাত্রার উপর নির্ভর করে নির্ণয় করা হবে যে ঐ সম্পত্তি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ না কম ঝুঁকিপূর্ণ। 

১৯৭০ এর দশক 

কম্পিউটার অধ্যায়ের শুত্রপাত হয় এই দশকে ফলে উৎপাদন কৌশল পরিবর্তন হয়, সেই সাথে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নকেও বদলে দেয়। অর্থায়ন তখন অংকনির্ভর হয়ে উঠে। বেশি ভাগ আর্থিক সিদ্ধান্ত মূলত জটিল অংকনির্ভর এবং কম্পিউটারের মাধ্যমেই সম্পাদন করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন ঝুঁকির পরিমান এখন অনেক সঠিকভাবে পরিমাপ ও ব্যবস্থাপনা করা যায়। মূলধনি কাঠামোর সনাতন ধারণাও অনেক অংকনির্ভর ও জটিল হয়। এই সময় যেসব তাত্ত্বিক ব্যবসায়িক অর্থায়নকে নানা তত্ত্বের বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তাদের মধ্যে হ্যারি মার্কোইজ, মার্টন মিলার, ফ্রাংকো মডিগলিয়ানি ছিলেন উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে এসব তাত্ত্বিকগণ ১৯৯০-এর দশকে গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অর্থায়নের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

উইলিয়াম শার্পে (William Sharpe) তাঁর পত্রকোষতত্ত্ব ১৯৭০ -এর দশকে পুনঃসংস্কার করেন। তিনি উন্নয়ন করলেন মূলধনী সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ মডেল (Capital Asset Pricing Model)। এই মডেল প্রয়োগ করে, কোন নির্দিষ্ট মূলধনী সম্পত্তির আয় নির্ধারন করা যায় ও ঝুঁকি পত্রকোষে সংরক্ষিত অন্যান্য সম্পত্তির সাথে মিশে যায়। ১৯৭০ এর দশকের বিখ্যাত অবদান ব্ল্যাক ও স্কোলস (Black & Scholes) এর পছন্দ করার ক্ষমতা মডেল (Option Model)। এই মডেল সম্পর্কযুক্ত আর্থিক দায়ের মূল্যায়নের জন্য ব্যবহূত হয়। 

১৯৮০ এর দশক

১৯৮০ এর দশকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মূল্যায়নে বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত ব্যাপক অগ্রগতি এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ব্যাপকভাবে উৎকর্ষতা লাভ করে। অর্থিক বাজার ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। আর্থিক ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার দ্রুত উঠানামা করার কারণে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের ফলে সৃষ্ট দায়দেনা হতে উদ্ভুত ঝুঁকি হ্রাস করতে ফিউচার, ফরওয়ার্ড, ও সোয়াপ চুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। ফলে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার অনেকগুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্য স্বল্প মেয়াদি আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অনেক বেড়ে যায়। এই সময়ে আর্থিক সেবা শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। অর্থসংস্থানের ক্রমবিকাশ আর্থিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপক প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তাকে বিকশিত করেছে। যার ফলে সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে একজন আর্থিক ব্যবস্থাপককে তহবিল সংগ্রহ, বণ্টন, বিনিয়োগ ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং মূল্যায়নে যুগে যুগে সহযোগিতা করেছে। ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপকগণ পরিবর্তনশীল পরিবেশকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছেন। 

১৯৯০-এর দশক ও আধুনিক অর্থায়নের সূচনা

এই দশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানির উপর থেকে প্রতিবন্ধকতা ও বিধিনিষেধ ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হয়। যার ফলে অর্থায়নও আন্তর্জাতিকতা লাভ করে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একদিকে যেমন বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পৃথিবীর কোথায়, তখন কোন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করলে ও বিক্রয় করা লাভজনক সেটা বিবেচনা করে, অন্যদিকে বিশ্বের কোন মূলধনি বাজার কী প্রকৃতির ও কোথা থেকে তহবিল সংগ্রহ করা হলে লাভজনক হবে, তাও অর্থায়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এভাবে এই তথ্য প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের যুগে অর্থয়নের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হতে থাকে। সুতরাং অর্থায়ন হলো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় একটি প্রায়োগিক সমাধানের ক্ষেত্র, যা হিসাবরক্ষণ, অর্থনীতি ও অন্যান্য আর্থিক বিষয়গুলোকে সংমিশ্রণ করে সৃষ্টি হয়েছে।

(বাউবি পাঠ্যবই অনুকরণে যথাযথ লাইসেন্স মেনে লেখা হয়েছে)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

অর্থায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ (ফিন্যান্সের ইতিহাস)

প্রকাশ: ১০:৪৯:২০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১

এক সময় মানুষ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বিনিময় করতো। একটি পণ্যের বিনিময়ে আরেকটি পণ্য গ্রহণ এবং প্রদানকে বার্টার ট্রেড বা বার্টার সিস্টেমস বলা হতো। কিন্তু দ্রব্য বিনিময় প্রথার কিছু সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় এবং এ সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্যই অর্থের সূচনা হয়। অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পণ্য দ্রব্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমবিভাগের সূচনা ঘটে। অষ্টদাশ এবং উনবিংশ শতাব্দিতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও উৎপাদনক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে যা শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে অর্থায়ন বা ফিন্যান্সের (Finance) ধারণা ও ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থায়ন মূলত হিসাব-রক্ষণ ও আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কার্যক্রম ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতো। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্ল্যাসিক্যাল ধারার ব্যষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের সাথে অর্থায়ন সম্পৃক্ত ছিল। অর্থায়নের ক্রমবিকাশের ধারা অর্থায়নের প্রকৃতি ও আওতা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। তাছাড়া ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন রকম প্রতিবেদন প্রস্তুত করণ এবং নগদ অর্থের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান যাতে করে যথাসময়ে প্রদেয় বিল পরিশোধ করতে পারে, তা অর্থায়নের ধারায় অর্থায়নের কাজ হিসেবে অন্তরভূক্ত হয়। কিন্তু সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আওতা ও পরিধি বৃদ্ধি ও প্রযক্তিগত উন্নয়ন একজন  আর্থিক ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কার্যাবলীকে পরিবর্তন করেছে সেই সাথে অর্থায়ন বিষয়ক ধারণা ও পরিবর্তিত হয়েছে।

নিম্নোক্ত আলোচনায় অর্থায়নের ক্রমবিকাশের ধারা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো: 

১৯২০ এর পূর্ববর্তী দশক

বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে অর্থায়নের যাত্রা শুরু হয়। এর পূর্বে অর্থায়নকে অর্থনীতির একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সে সময় অর্থায়ন মূলধন বাজারের দলিলাদি, প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮৯০ সাল থেকে ১৯০০ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলির মধ্যে একত্রিকরণ প্রক্রিয়া চালু হয়। ১৮৯৯ সালে জে. ডি. রকি ফেলার যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি শহরে Standard Oil Company গঠনের মাধ্যমে Standard Oil Group of Companies গুলিকে একত্রিকরণ করে। এই একত্রিকরণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল স্থায়ী উৎপাদন খরচ কমিয়ে বাজারে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করা। ১৯০০ সালে ইউ. এস. স্টিল কোম্পানি (U. S. Steel Company)  গঠিত হয়ে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ৬৩ শতাংশ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে। ওই সময় ওই কোম্পানির মূলধন ছিল প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ইতোপূর্বে কখনও কোন কোম্পানির ছিল না। তখন আরও প্রায় ৩০৭টি কোম্পানি একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কাজ করছিল। স্টীল কোম্পানি ছাড়াও একত্রীকৃত কোম্পানি ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিল। আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি কোম্পানির সাথে অন্য একটি কোম্পানি একত্রীকরণ করলে প্রতিষ্ঠান লাভজনক হবে এই বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে আর্থিক ব্যবস্থাপকদের কে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তখন আর্থিক ব্যবস্থাপকদের কোম্পানিগুলোর একত্রীকরণে বড়ো অংকের অর্থসংস্থান ও আর্থিক বিবরণী তৈরির দায়িত্বও পালন করতে হয়। ঐ একত্রিকরণ প্রক্রিয়ার জন্য বড়ো ধরণের অর্থসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং মূলধন কাঠামো ব্যবস্থাপনা কোম্পানির একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। সেই সময় থেকে অর্থসংস্থান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটা পৃথক ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এটা উলেখ্য যে, ঐ সময়ে কোম্পানির আর্থিক বিবরণী তৈরি ও তার বিশ্লেষণ ছিল প্রাথমিক স্তরে যা শুধু কোম্পানির অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো। 

১৯৩০-এর দশক

একত্রীকরণ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রে আশানুরূপ সফলতা পায়নি। আগের দশকে একীভূত অনেক প্রতিষ্ঠানই পরের দশকে দেউলিয়া হয়ে যায়। উপরন্তু ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চরম মন্দা শুরু হয়। অনেক লাভজনক প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানির তালিকায় পড়ে যায়। এমতাবস্থায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করে কীভাবে দেউলিয়াত্ব থেকে রক্ষা করা রাখা যায়, সে ব্যাপারে আর্থিক ব্যবস্থাপক বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় বেকারত্বের হার ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে ৩.২% থেকে ২৫% এ উন্নীত হলো। কিছু কিছু কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেলো, এমন কি অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য টিকে থাকাই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।

প্রথমদিকে মূলধন কাঠামো সিদ্ধান্তে ঋণকে অর্থসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হতো যা ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা ও তারল্য সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দিলো। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পুনর্বাসন ও টিকে থাকার পরিকল্পনা আর্থিক ব্যবস্থাপনার নতুন কার্যাবলী হিসেবে বিবেচিত হলো। অর্থনৈতিক অবস্থাসমূহ ফেডারেল (Federal) বিধান চালু করল যা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। 

১৯৪০-এর দশক

চল্লিশের দশকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা হয়। নগদ অর্থপ্রবাহের বাজেট করে সুপরিকল্পিতভাবে নগদপ্রবাহের মাধ্যমে অর্থায়ন সে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৪৫ সালে শেষ হয়। এসময়ে অনেক কোম্পানি প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উৎপাদন শুরু করে। সরকার প্রতিরক্ষা শিল্প উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয়ে অর্থের যোগান দেয়। কিন্ত ঐ সকল কোম্পানির চলতি মূলধন ব্যবস্থাপনা আর্থিক ব্যবস্থাপকদের নিকট একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালে আর্থিক ব্যবস্থাপকদের স্বাভাবিক অবস্থায় যেসব কোম্পানি বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করত সেসব কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কিভাবে সংগ্রহ করা হবে সে দায়িত্ব পালন করতো। এছাড়াও ঐসব কোম্পানির বিক্রয়ের পরিমাণ অধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রয়োজনীয় চলতি মূলধন কিভাবে সংগ্রহ করা হবে সে দায়িত্বও পালন করে। 

১৯৫০ এর দশক

১৯৪০ থেকে ১৯৫০ এর দশকের প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সময়কে অর্থসংস্থানের সনাতন যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে বিকশিত হয়েছিলো। সে সময় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে বহিরাগতদের (Outsiders) থেকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। যেমন- বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতা, কিন্তু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ভিতর সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বিবেচনা করা হতো না। এই ধারাকে অর্থায়নের সনাতন ধারা বলা হয়। ১৯৫০ এর দশকে অর্থায়নের সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনার উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। তহবিল সংগ্রহ করে কিভাবে তা লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করা যায় তা অর্থায়নের প্রধান কাজ হিসেবে পরিগনিত হয়। এ সময়ে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের জন্য মূলধন বাজেটিং এবং প্রকল্প মূল্যায়ণে গাণিতিক বিশ্লেষনের ব্যবহার, নগদ বাজেটিং, অভ্যন্তরীণ অর্থসংস্থান ও নিয়ন্ত্রনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৫০ -এর দশকের মধ্যভাগে মূলধন বাজেটিং ও অন্যান্য সম্বন্ধযুক্ত বিষয়সমূহ অর্থসংস্থানকে পুরোপুরিভাবে ত্বরান্বিত করল। ফলে নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে নতুন কৌশল ও পদ্ধতির আবির্ভাব হলো যা ব্যবসায়ের মূলধনের দক্ষ বন্টনের কাজকে ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করলো।

১৯৬০-এর দশক

আধুনিক অর্থায়নের যাত্রা শুরু ১৯৬০ এর দশকে। অর্থায়ন মূলধন বাজারকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক শেয়ারহোল্ডাররা ফলে শেয়ার হোল্ডারদের সম্পদ বা শেয়ারের বাজারমূল্য সর্বাধীককরণই ছিল এই সময়ের অর্থায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য। আর এই উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য নানা রকম আর্থিক বিশ্লেষণমূলক কার্যাবলী শুরু হয়। সাধারণত অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঝুঁকির ধারণা হলো এই যে মুনাফা বৃদ্ধির সাথে সাথে ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং মুনাফা সর্বাদীককরণ সর্বদা কাক্সিক্ষত নাও হতে পারে। 

১৯৫০-এর দশকের পর মূল্যায়ন মডেল (Valuation Model) এর উদ্ভব হয়। সাধারনত এই মূল্যায়ন মডেল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যবহূত হতো। মূল্যায়ন মডেলের উন্নয়নের ফলে মূলধন কাঠামো ও লভ্যাংশ নীতি প্রচলিত হয়। মূলধন বাজেটিং -এর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করার জন্য অর্থসংস্থানে সমন্বিত প্রথার সৃষ্টি হলো। ১৯৫৮ ও ১৯৬১ সালে ফ্রাংকো মডিগলিয়ানি ও মার্টন মিলার (Modigliani & Miller) এই বিষয়ের উপর এক তত্ত্ব লেখেন যা তাত্ত্বিক অনুসন্ধানকে আরো বিকশিত করে, যা এখনও বিরাজমান রয়েছে।

১৯৬০ -এর দশকের প্রধান ঘটনা হলো পত্রকোষ তত্ত্ব Portfolio Theory এর উন্নয়ন এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এর যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগ। Markowitz সর্বপ্রথম ১৯৫২ সালে এই তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটান । তারপরে Willism Sharpe, Lintner, Fama এই তত্ত্বের আরো অনেক প্রবৃদ্ধি ঘটান । এই তত্ত্বের মূলকথা হলো- ‘কোন বিশেষ আর্থিক সম্পত্তির ঝুঁকি তার সম্ভাব্য আয়ের আলোকে বিচার করা হবেনা বরং এই বিশেষ আর্থিক সম্পত্তির যে প্রান্তিক প্রতিদান আছে মোট ঝুঁকির (মোট সম্পত্তির) ভেতর তার ভিত্তিতে ঐ বিশেষ সম্পত্তির ঝুঁকির মূল্যায়ন করা হবে।’ পত্রকোষের (Portfolio) অন্যান্য সম্পত্তির সাথে ঐ স্বতন্ত্র সম্পত্তির সম্পর্কের মাত্রার উপর নির্ভর করে নির্ণয় করা হবে যে ঐ সম্পত্তি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ না কম ঝুঁকিপূর্ণ। 

১৯৭০ এর দশক 

কম্পিউটার অধ্যায়ের শুত্রপাত হয় এই দশকে ফলে উৎপাদন কৌশল পরিবর্তন হয়, সেই সাথে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নকেও বদলে দেয়। অর্থায়ন তখন অংকনির্ভর হয়ে উঠে। বেশি ভাগ আর্থিক সিদ্ধান্ত মূলত জটিল অংকনির্ভর এবং কম্পিউটারের মাধ্যমেই সম্পাদন করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন ঝুঁকির পরিমান এখন অনেক সঠিকভাবে পরিমাপ ও ব্যবস্থাপনা করা যায়। মূলধনি কাঠামোর সনাতন ধারণাও অনেক অংকনির্ভর ও জটিল হয়। এই সময় যেসব তাত্ত্বিক ব্যবসায়িক অর্থায়নকে নানা তত্ত্বের বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তাদের মধ্যে হ্যারি মার্কোইজ, মার্টন মিলার, ফ্রাংকো মডিগলিয়ানি ছিলেন উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে এসব তাত্ত্বিকগণ ১৯৯০-এর দশকে গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অর্থায়নের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

উইলিয়াম শার্পে (William Sharpe) তাঁর পত্রকোষতত্ত্ব ১৯৭০ -এর দশকে পুনঃসংস্কার করেন। তিনি উন্নয়ন করলেন মূলধনী সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ মডেল (Capital Asset Pricing Model)। এই মডেল প্রয়োগ করে, কোন নির্দিষ্ট মূলধনী সম্পত্তির আয় নির্ধারন করা যায় ও ঝুঁকি পত্রকোষে সংরক্ষিত অন্যান্য সম্পত্তির সাথে মিশে যায়। ১৯৭০ এর দশকের বিখ্যাত অবদান ব্ল্যাক ও স্কোলস (Black & Scholes) এর পছন্দ করার ক্ষমতা মডেল (Option Model)। এই মডেল সম্পর্কযুক্ত আর্থিক দায়ের মূল্যায়নের জন্য ব্যবহূত হয়। 

১৯৮০ এর দশক

১৯৮০ এর দশকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মূল্যায়নে বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত ব্যাপক অগ্রগতি এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ব্যাপকভাবে উৎকর্ষতা লাভ করে। অর্থিক বাজার ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। আর্থিক ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার দ্রুত উঠানামা করার কারণে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের ফলে সৃষ্ট দায়দেনা হতে উদ্ভুত ঝুঁকি হ্রাস করতে ফিউচার, ফরওয়ার্ড, ও সোয়াপ চুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। ফলে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার অনেকগুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্য স্বল্প মেয়াদি আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অনেক বেড়ে যায়। এই সময়ে আর্থিক সেবা শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। অর্থসংস্থানের ক্রমবিকাশ আর্থিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপক প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তাকে বিকশিত করেছে। যার ফলে সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে একজন আর্থিক ব্যবস্থাপককে তহবিল সংগ্রহ, বণ্টন, বিনিয়োগ ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং মূল্যায়নে যুগে যুগে সহযোগিতা করেছে। ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপকগণ পরিবর্তনশীল পরিবেশকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছেন। 

১৯৯০-এর দশক ও আধুনিক অর্থায়নের সূচনা

এই দশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানির উপর থেকে প্রতিবন্ধকতা ও বিধিনিষেধ ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হয়। যার ফলে অর্থায়নও আন্তর্জাতিকতা লাভ করে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একদিকে যেমন বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পৃথিবীর কোথায়, তখন কোন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করলে ও বিক্রয় করা লাভজনক সেটা বিবেচনা করে, অন্যদিকে বিশ্বের কোন মূলধনি বাজার কী প্রকৃতির ও কোথা থেকে তহবিল সংগ্রহ করা হলে লাভজনক হবে, তাও অর্থায়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এভাবে এই তথ্য প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের যুগে অর্থয়নের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হতে থাকে। সুতরাং অর্থায়ন হলো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় একটি প্রায়োগিক সমাধানের ক্ষেত্র, যা হিসাবরক্ষণ, অর্থনীতি ও অন্যান্য আর্থিক বিষয়গুলোকে সংমিশ্রণ করে সৃষ্টি হয়েছে।

(বাউবি পাঠ্যবই অনুকরণে যথাযথ লাইসেন্স মেনে লেখা হয়েছে)