১১:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

কারবালা যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগের মর্মকথা

এম. ফজলুর রহমান
  • প্রকাশ: ১২:০৩:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ অগাস্ট ২০২১
  • / ১৫৯৯ বার পড়া হয়েছে

পৃথিবীর ইতিহাসে কারবালা হত্যাকাণ্ডের মতো নির্মম ও জঘন্য হৃদয়বিদারক রক্তপাত হওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। কেন যায় না এবং কি জন্য যায় না, আসুন, এবার তার তত্ত্ব ও মর্ম উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। সকল অবস্থায় আল্লাহপাকই আমাদের সহায়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নবি করিম (সা.) হিজরি একাদশ সালের ১২ রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করেন। দুনিয়া হতে পর্দা করার পূর্বে তিনি মসজিদে নববির মিম্বরে বসে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার ইন্তেকালের পর ‘খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াত’ অর্থাৎ নবুওয়াতের প্রশাসনিক রূপরেখা অনুসারে প্রতিনিধিত্বসুলভ শাসনব্যবস্থা ত্রিশ বছর যাবত অব্যাহত থাকবে। তারপর এই শাসনব্যবস্থা ‘আমারত’ অর্থাৎ রাজতন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করবে।’ এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতা সাধিত হয়েছিল সাইয়্যেদেনা হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর খলীফার পদ পরিত্যাগের মাধ্যমে। যার মূলে ছিল কুটিল ষড়যন্ত্রের এক অন্ধকার প্রতিচ্ছায়া।

এই সুবাদে হযরত মুয়াবিয়া রা. খলীফা পদে সমাসীন হন এবং নিজেকে ‘আমির’ উপাধিতে বিভংষিত করেন। এতে করে ‘খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াত’-এর পরিসমাপ্তি ঘটে। এই বিষয়টি আরো প্রকট রূপ ধারণ করে হযরত মুয়াবিয়া (রা.) কর্তৃক স্বীয় পুত্র এজিদকে খলিফা বলে ঘোষণার মাধ্যমে। এতসব ষড়যন্ত্র ও দুনিয়ালোভী কার্যক্রম সাইয়্যেদেনা হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে ব্যথিত ও মর্মাহত করে তুলেছিল। তিনি মনে-প্রাণে খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন এবং সত্য, ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

তাই তিনি অগণতান্ত্রিকভাবে ঘোষিত খলিফা এজিদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করাকে ঘৃণাভরে বর্জন করেছিলেন। তার এই দৃঢ় প্রত্যয় সম্ভূত ন্যায় ও কল্যাণবহ আকুতি প্রকাশ পেয়েছিল স্বীয় স্বজনদের অনুরোধের উত্তরে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, যে খেলাফত নবুওয়াতের ক্রমধারাপুষ্ট ব্যবস্থার বিপরীত, তা আমি এবং আমরা মেনে নিতে পারি না। এর জন্য যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত। কেননা, আমরা আল্লাহর অনুগত বান্দাহ এবং বিশ্বনবি মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রতি একান্তই বিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীল। এর ব্যতিক্রম কোনো কিছু আমরা কখনোই মেনে নেব না।

কারবালা ময়দানে যুদ্ধের পূর্বক্ষণে তিনি এজিদপক্ষীয় সৈন্য ও কুফাবাসীদের লক্ষ করে বলে ছিলেন, আমি কে তা আপনাদের অজানা নয়। আমি পরকালে জান্নাতি যুবকদের সর্দাররূপে বরিত হব। আমাকে কুফা আগমনের জন্য আপনারাই বহু আমন্ত্রণপত্র প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু আজ আপনারা এসব কথা বেমালুম ভুলে গেছেন কেন? এই কেন এর সদুত্তর প্রতিপক্ষের দিক থেকে উচ্চারিত হয়নি। বরং তারা তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে সত্যোজ্জ্বল কিরণ ধারাকে নির্বাপিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, যা কালের খাতায়, ইতিহাসের পাতায় কলঙ্ক-কালিমার পঙ্কিল আবর্তে চিরকাল ঘুরপাক খেতে থাকবে।

বস্তুত সাইয়্যেদেনা হযরত ইমাম হোসাইন রা. খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াতকে চির উন্নত ও চির প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ধূসর কারবালার তপ্ত মরুর দাবদাহ ও ক্ষুৎ-পিপাসার জ্বালা সহ্য করে আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি জানতেন, এই পথে বুকের রক্ত অকাতরে বিলিয়ে যে দিতে পারে, সে-ই পরকালে কামিয়াবী ও সফলতা লাভে ধন্য হবে এবং আল্লাহপাকের কুরবত ও নৈকট্যের শামিয়ানার নিচে আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ লাভ করবে। এর কোনো অন্যথা হবে না।

আমরা এ-ও জানি যে, খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াত অবশ্যই দুনিয়াতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। এই খিলাফতের ঘোষণা পবিত্র কাবা গৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে হযরত জিব্রাইল (আ.) প্রদান করবেন। তিনি বলবেন, ‘হাজা খালিফাতুল্লাহিল মাহদিয়্যি, ফাআবিহু ওয়াত্তাবিয়ূহুণ অর্থাৎ তিনিই হচ্ছেন, আল্লাহর খলীফা মাহদি (আ.)। তোমরা তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করো। চলতি হিজরী ১৪৪২ সালের পৈঠায় দাঁড়িয়ে আমরা এর প্রতীক্ষার প্রহর গুনে চলেছি। জানি না, সেই মধুময় ক্ষণ আমাদের জীবনে দেখা দেবে কি না। তবুও ‘আশায় মোরা বাঁধছি বাসা মর্তবাসী ক্ষুদ্র নর।’ আল্লাহপাক আমাদের সহায় হোন। আমিন।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

কারবালা যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগের মর্মকথা

প্রকাশ: ১২:০৩:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ অগাস্ট ২০২১

পৃথিবীর ইতিহাসে কারবালা হত্যাকাণ্ডের মতো নির্মম ও জঘন্য হৃদয়বিদারক রক্তপাত হওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। কেন যায় না এবং কি জন্য যায় না, আসুন, এবার তার তত্ত্ব ও মর্ম উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। সকল অবস্থায় আল্লাহপাকই আমাদের সহায়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নবি করিম (সা.) হিজরি একাদশ সালের ১২ রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করেন। দুনিয়া হতে পর্দা করার পূর্বে তিনি মসজিদে নববির মিম্বরে বসে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার ইন্তেকালের পর ‘খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াত’ অর্থাৎ নবুওয়াতের প্রশাসনিক রূপরেখা অনুসারে প্রতিনিধিত্বসুলভ শাসনব্যবস্থা ত্রিশ বছর যাবত অব্যাহত থাকবে। তারপর এই শাসনব্যবস্থা ‘আমারত’ অর্থাৎ রাজতন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করবে।’ এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতা সাধিত হয়েছিল সাইয়্যেদেনা হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর খলীফার পদ পরিত্যাগের মাধ্যমে। যার মূলে ছিল কুটিল ষড়যন্ত্রের এক অন্ধকার প্রতিচ্ছায়া।

এই সুবাদে হযরত মুয়াবিয়া রা. খলীফা পদে সমাসীন হন এবং নিজেকে ‘আমির’ উপাধিতে বিভংষিত করেন। এতে করে ‘খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াত’-এর পরিসমাপ্তি ঘটে। এই বিষয়টি আরো প্রকট রূপ ধারণ করে হযরত মুয়াবিয়া (রা.) কর্তৃক স্বীয় পুত্র এজিদকে খলিফা বলে ঘোষণার মাধ্যমে। এতসব ষড়যন্ত্র ও দুনিয়ালোভী কার্যক্রম সাইয়্যেদেনা হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে ব্যথিত ও মর্মাহত করে তুলেছিল। তিনি মনে-প্রাণে খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন এবং সত্য, ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

তাই তিনি অগণতান্ত্রিকভাবে ঘোষিত খলিফা এজিদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করাকে ঘৃণাভরে বর্জন করেছিলেন। তার এই দৃঢ় প্রত্যয় সম্ভূত ন্যায় ও কল্যাণবহ আকুতি প্রকাশ পেয়েছিল স্বীয় স্বজনদের অনুরোধের উত্তরে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, যে খেলাফত নবুওয়াতের ক্রমধারাপুষ্ট ব্যবস্থার বিপরীত, তা আমি এবং আমরা মেনে নিতে পারি না। এর জন্য যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত। কেননা, আমরা আল্লাহর অনুগত বান্দাহ এবং বিশ্বনবি মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রতি একান্তই বিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীল। এর ব্যতিক্রম কোনো কিছু আমরা কখনোই মেনে নেব না।

কারবালা ময়দানে যুদ্ধের পূর্বক্ষণে তিনি এজিদপক্ষীয় সৈন্য ও কুফাবাসীদের লক্ষ করে বলে ছিলেন, আমি কে তা আপনাদের অজানা নয়। আমি পরকালে জান্নাতি যুবকদের সর্দাররূপে বরিত হব। আমাকে কুফা আগমনের জন্য আপনারাই বহু আমন্ত্রণপত্র প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু আজ আপনারা এসব কথা বেমালুম ভুলে গেছেন কেন? এই কেন এর সদুত্তর প্রতিপক্ষের দিক থেকে উচ্চারিত হয়নি। বরং তারা তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে সত্যোজ্জ্বল কিরণ ধারাকে নির্বাপিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, যা কালের খাতায়, ইতিহাসের পাতায় কলঙ্ক-কালিমার পঙ্কিল আবর্তে চিরকাল ঘুরপাক খেতে থাকবে।

বস্তুত সাইয়্যেদেনা হযরত ইমাম হোসাইন রা. খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াতকে চির উন্নত ও চির প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ধূসর কারবালার তপ্ত মরুর দাবদাহ ও ক্ষুৎ-পিপাসার জ্বালা সহ্য করে আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি জানতেন, এই পথে বুকের রক্ত অকাতরে বিলিয়ে যে দিতে পারে, সে-ই পরকালে কামিয়াবী ও সফলতা লাভে ধন্য হবে এবং আল্লাহপাকের কুরবত ও নৈকট্যের শামিয়ানার নিচে আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ লাভ করবে। এর কোনো অন্যথা হবে না।

আমরা এ-ও জানি যে, খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়াত অবশ্যই দুনিয়াতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। এই খিলাফতের ঘোষণা পবিত্র কাবা গৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে হযরত জিব্রাইল (আ.) প্রদান করবেন। তিনি বলবেন, ‘হাজা খালিফাতুল্লাহিল মাহদিয়্যি, ফাআবিহু ওয়াত্তাবিয়ূহুণ অর্থাৎ তিনিই হচ্ছেন, আল্লাহর খলীফা মাহদি (আ.)। তোমরা তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করো। চলতি হিজরী ১৪৪২ সালের পৈঠায় দাঁড়িয়ে আমরা এর প্রতীক্ষার প্রহর গুনে চলেছি। জানি না, সেই মধুময় ক্ষণ আমাদের জীবনে দেখা দেবে কি না। তবুও ‘আশায় মোরা বাঁধছি বাসা মর্তবাসী ক্ষুদ্র নর।’ আল্লাহপাক আমাদের সহায় হোন। আমিন।