১২:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ভ্যালেরিয়া লুইসেলির উপন্যাস ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ সীমান্ত পারি দেওয়ার যন্ত্রণার কথা বলে

মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশ: ০৯:৫০:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ অগাস্ট ২০২১
  • / ৪৮৯ বার পড়া হয়েছে

ভ্যালেরিয়া লুইসেলির উপন্যাস 'লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ সীমান্ত পারি দেওয়ার যন্ত্রণার কথা বলে

২০২১সালে আন্তর্জাতিক ডাবলিন সাহিত্য পুরুষ্কার পেয়েছেন মেক্সিকোর নারী লেখক ভ্যালেরিয়া লুইসেলি (Valeria Luiselli)। ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ (Lost Children Archive) উপন্যাসের জন্য তাকে এ পুরুষ্কার দেওয়া হয়। পুরুষ্কার হিসেবে তিনি পাবেন এক লাখ ইউরো। গত বছর এই উপন্যাসের জন্য ভ্যালেরিয়া পেয়েছেন রথবোনস ফোলিও পুরুষ্কার। বইটির ধারা বিবরণীতে পরিবার ও রাষ্ট্রের বিচিছন্নতা, বিভেদ এবং বিচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে কয়েকটি প্রশ্ন দিয়ে। শিশুরাই যদি আমাদের ভবিষ্যত হয় তাহলে দেশ তাদের রক্ষনাবেক্ষন করতে পারছেনা কেন? রাষ্ট্র এটি করতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে? রাষ্ট্রের ব্যর্থতায় শিশুদের ভবিষ্যত কি?

লুইসেলি একজন মেধাবী ও কল্পনাবিলাসী ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখা ভিনদেশে আশ্রয় অনুসন্ধানকারীদের পক্ষে কথা বলে। এখানে পরিবারের গল্পের সাথে সন্তানকে দক্ষহাতে সংযোগ করার গল্প। চরিত্রগুলো এমন যে, বাধ্য হয়ে তাদের বিচ্ছেদ ঘটেছে এবং অপরিচিত দেশে তাদের ঠাঁই হয়েছে। তাঁর ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ একটি স্মৃতির মতো গল্প। এটি নকশাদার চিত্রের মতো ধীরে ধীরে খুলতে থাকে এবং পাঠককে গল্পকারদের প্রধান জায়গার গভীরে নিয়ে যায়। লুইসেলি  আমাদেরকে পারিবারিক জীবনের অসংখ্য সন্ধি ও আলাপ আলোচনা বিশাল দৃষ্টিকোন দিয়ে ধীরে ধীরে তাকাতে বলেন । তিনি  অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ঘটনার বুনন করেছেন যা অসংখ্য প্রজন্ম এবং সংস্কৃতির ইতি টেনেছেন এমনভাবে যা দৃষ্টিনন্দন এককত্ব। ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ উপন্যাসটি আমেরিকা ও মেক্সিকোর সীমান্তে সংঘটিত মানবিক সংকটের হৃদয়বিদারক দৃশ্য ও ঘটনা তুলে ধরে।

ভ্যালেরি লুইসেসি মেক্সিকো সিটিতে জন্মগ্রহন করেন এবং বেড়ে ওঠেন দক্ষিন কোরিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা ও ভারতে। তিনি ফিকশন এবং নন-ফিকশন লেখিকা এবং ’সাইডওয়াকস’ নামক প্রবন্ধ সংগ্রহের লেখিকা। তার রচিত উপন্যাস হচ্ছে- ’ফেইসেস ইন দ্যা ক্রাউড, দ্য স্টোরি অফ মাই টিথ, এবং অতি সম্প্রতি ’ টেল মি হাউ ইট এন্ডস: অ্যান এএস ইন ফরটি কোয়েশ্চেনস’। তিনি ২০১৯সালের ম্যাক আর্থার ফেলোশিপ জয়ী, এবং দুটি লস অ্যালেঞ্জস টাইমস বুক প্রাইজেস জয়ী,আরও একটি আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোননীত হয়েছেন। তাঁর লেখা বিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ’রেসিডেন্স অ্যাট বার্ড কলেজের লেখিকা এবং নিউ ইয়র্কে বাস করেন। 

ভ্রমণ কাহিনী আকারে লিখিত ঘটনাবলী রাস্তায় ভ্রমণ করার ওপর কেন্দ্রীভূত। ভ্রমণটি সংঘটিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে মেক্সিকান সীমান্তে। বইটির শুরু ২০১৪ সাল। তখন মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দলে দলে অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা পার করেছেন। নামহীন বর্ণনাকারী ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন।  তিনি লুইসেলির সাথে গল্পগুলো বলছেন । তিনি বলছেন যে, অভিবাসীরা যখন সীমানা পার হন অনেক শিশু তখন হারিয়ে যায় কিংবা বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২০১৪সালের গ্রীষ্মকাল।  নিউইয়র্কে বসবাসকারী লুইসেলি  গ্রীন কার্ডের অপেক্ষা করছেন এবং একদিন সড়ক ভ্রমণে বের হন। তিনি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা একজন অভিবাসী, আইনগত অধিকার পাওয়া, তিনি তার স্বামী ও দুই সন্তানসহ যাত্রা করছেন কোকাইজ কাউন্টি, অ্যারিজোনার মধ্য দিয়ে যা মেক্সিকো সীমান্তের নিকট। তারা যখন ওকলাহোমার মধ্য দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন সংকটের খবর শুনতে পেলেন। একাকী শিশুদের অধিকাংশই সহিংসতা ও হুমকির মধ্য গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের মধ্য দিয়ে এসেছে। তারা বেশি সংখ্যায় সীমান্তে হাজির হচ্ছে অক্টোবর ২০১৩ জুন ২০১৪ সময়ের মধ্যে আশি হাজারের মতো উপস্থিত হয়েছে সীমান্তে। তাদের মধ্য অধিকাংশই অবর্ণনীয় বিপদের মধ্য দিয়ে এখানে এসেছে। 

শিশু অভিবাসীর দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য পাগলপ্রায়। সীমান্ত প্রহরীদের কাছে প্রথম তাদের আত্ম-সমর্পণ করতে হবে যাতে বৈধভাবে তারা দীর্ঘদিন আমেরিকায় থেকে যেতে পারে। তবে সেজন্য তাদের দীর্ঘ ও কঠিন ফর্মালিটি শুরু করতে হবে, কঠিন সময় পার করতে হবে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্বপ্নের দেশে কোন স্বপ্ন নিয়ে আসেনি, বরং তারা যে দু:স্বপ্ন ও আতংকের মধ্য জন্মগ্রহন করেছে এবং সেখানে থেকে দু:সাহসিক, কঠিন ও নিষ্ঠুর বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র আর মরুভূমি পারি দিয়ে এই সীমান্তে এসেছে তার প্রধান কারন হচেছ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদ, শুধুমাত্র জীবনের কঠিনতম ও নিষ্ঠুর অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার আর্তনাদ। তাই বলা হয়ে থাকে যে, উপন্যাসটি গভীরভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ। 

৩২০০ শতেরও বেশি অভিবাসী শিশুদের দক্ষিন টেক্সাস বর্ডার পেট্রোল ফ্যাসিটিতে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাদেরকে  বড়ো একটি তাবুর নীচে যেখানে মা-বাবা ছাড়া শিশুরা এবং শিশুসহ পরিবারদের অল্পকিছুদিনের জন্য রাখা হয়। কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন বিভাগ চায় যে, শিশুদের ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রে ৭২ঘন্টার মধ্যে স্থানান্তর করতে হবে। কিন্তু কেউই শিশুদের সেখানে স্থানান্তর করতে পারছেনা কারন সে ধরনের আশ্রয়কেন্দ্র নেই কিংবা থাকলেও তা অপ্রতুল। কাস্টমস ও বর্ডার প্রোটেকশন বিভাগের লোকবল কম, জায়গা কম এবং খাবারেরও অভাব। ভয়ে এবং একাকিত্বের কারণে অনেক শিশু অনাহারে থাকে এই ক্যাম্পে। এক সাক্ষাৎকারে দেখা যায় যে, শিশুরা বলছে তাদেরকে সপ্তাহে একবার গোসল করানো হয়। তাদেরকে পালাক্রমে ঘুমাতে হয় কারন জায়গার সংকুলান হয়না।  দ্যা সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সুপারিশ করছে যে, দুই বছর থেকে পরবর্তী বয়স্ক শিশুদের নিরাময় পদক্ষেপসমূহ জোরদার করতে এবং মুখে মাস্ক পড়তে অথচ ধারন ক্ষমতার বেশি অভিবাসীদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে। কেউ চিন্তাও করেনা শিশুদের সেখানে পাঠানো হলো কেন। তারা কত  বড়ো যুদ্ধ, নিষ্ঠুরতা, দারিদ্রসহ বহু ধরনের  কষ্টের কারনে সেখানে গিয়েছে। 

লুইসেলির ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’  উপন্যাসের বর্ণনাকারী সেই প্রশ্নগুলোই জিজ্ঞেস করছে শিশুরা কেন সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। তারা দূর-দূরান্তের পাহাড় নদী, সাগর, জঙ্গল পেরিয়ে , মরুভূমি পেরিয়ে কেন সেখানে আসছে। কেউ ঐতিহাসিক যুদ্ধ চলছে ঐ গোলার্ধে: কী যুদ্ধ, কেন যুদ্ধ? তারা কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে? তাদেরকে নিয়ে মার্কিন প্রশাসন কি করবে? কেউই জিজ্ঞেস করছে না তারা কেন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে সেখানে গেছে। লুইসেলি বলছেন এগুলো আমাদের সন্তান, এটি আমাদের মানবিক সংকট যা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে, আলোচনা করতে হবে, সমাধান বের করতে হবে এবং এটি বাস্তব যা আমরা এড়াতে পারিনা। এটি রূপক কোন দলিল বা কাগজপত্র নয়, এটি কোন আন্তপাঠ নয় কিংবা সাহিত্যিক কোন বিষয় নয় যা আমরা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ হতে দেখব। এটি হচ্ছে জ্বলন্ত সত্য যে হাজার হাজার অভিবাসীর গমন। এই শিশুরা তাদের সম্মান, তাদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। একজন শিক্ষাবিদ ও একজন অভিবাসী হিসেবে আমি অন্তত আমাদের শিক্ষাদানের মধ্যে দিয়ে চেষ্টা করতে পারি তাদের সম্মান ফিরিয়ে আনার। 

ভ্যালেরিয়া লুইসেলির উপন্যাস 'লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ সীমান্ত পারি দেওয়ার যন্ত্রণার কথা বলে
ভ্যালেরিয়া লুইসেলির উপন্যাস ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ সীমান্ত পারি দেওয়ার যন্ত্রণার কথা বলে

স্বামী-স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মেক্সিকো সীমান্তের দিকে ছুটছেন লেখিকা, যেন এক মহাকাব্যিক সড়ক ভ্রমন। টেনেসি, ওকলাহামা এবং টেক্সাসের মতো ভৌতিক শহরের মধ্য দিয়ে ছুটছে গাড়ী। একটি পরিবারের বিচ্ছেদ, নিজ বাসভুম থেকে উচ্ছে ও নির্বাসন। ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন করছে গল্প বলার প্রকৃতি ও গুরুত্ব সম্পর্কে, কল্পকাহিনি ও বাস্তব। একটি স্তরবিশিষ্ট বর্ণনা পরিবারের, অভিবাসীর, বিচার এবং আশার। উপন্যাসটির গঠন সহজ নয়, এর সমাপ্তিও সহজ নয়। তারপরেও গল্প লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে এবং সম্ভবত গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয়েছে। ঘটনার বক্তা এবং তার পরিবার যখন আরকানসাসের মধ্যে দিয়ে যাচেছন, তখন ম্যানুয়েলার কাছ থেকে একটি ফোন আসে। মেনুয়েলা  মামলায় হেরে গেছেন তাই তার মেয়েদের নির্বাসনে পাঠানোর সময় হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচেছনা । তারা সম্ভবত নিউ মেক্সিকো এবং আরিজোনার মাঝামাঝি কোন জায়গায় লুকিয়ে আছেন। ম্যানুয়েলা বুঝতে পেরেছেন যে, তার বাবা-মা তার দিকেই আসছেন। তারা তাকে নিউ মেক্সিকো এবং আরিজোনায় খুঁজতে পারেন। অতএব, বর্ণনাকারী ভ্রমণ, কেন্দ্রের গভীরতা খুঁজতে শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে, তিনি যাদের গল্প বলছেন তারা হারিয়ে গেছে, যাদের কন্ঠস্বর আর শোনা যাবেনা কারন তারা সম্ভবত চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।  সাহসের সাথে লেখিকা উপন্যাসটির প্রায় অর্ধেক জুড়ে তাদের আবিস্কার করার জন্য ধীরে ধীরে সময় নিয়েছেন আর এই বিষয়টিই এখন গুরুত্বপূর্ন পড়ার বিষয়। 

আমাদের শ্রেণিকক্ষের আলোচনায় আমরা রূপক থেকে আমরা সীমান্তে চলে যেতে পারি বাস্তব ও ধারনসূচক জায়গাতে। আমরা গ্লোরিয় ই. আনজালদু-র থিউরিটিক্যাল অর্কিটেক্ট, যিনি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সীমান্ত হচ্ছে এক ধরনের উন্মুক্ত যন্ত্রণা, উন্মুক্ত ব্যাথা যেখানে তৃতীয় বিশ্বের পদধ্বনি শোনা যায়, যেখানে তৃতীয় বিশ্ব কড়া নাড়ে প্রথম বিশ্বের বিরুদ্ধে অর্থাৎ ধনী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে। সেখানে  রক্তপাত ঘটছে, একটি খোসা গঠিত হওয়ার পূর্বেই রক্তক্ষরণ হচ্ছে, দুই বিশ্বের জীবনরক্ত মিশে একটি নতুন দেশ হচ্ছে- সীমান্ত সংস্কৃতি। আর এখানেই অভিবাসী শিশুদের ধরা হচ্ছে যা একধরনের ভিন্নতা তৈরি করছে, প্রদর্শিত হচ্ছে বৈপরীত্য, মধ্যখান অর্থাৎ এখানেও না, ওখানেও না। রাষ্ট্র আরোপিত প্রায়শ্চিত্ত করার জায়গা এটি। এটি পরিবর্তনের জায়গা। সীমান্ত হচেছ নিরাপদ ও অনিরাপদ জায়গা, এটি হচেছ ধনীদের থেকে গরীবদের  আলাদা করার জায়গা। তাই সীমান্ত মানুষদের আলাদা করার চিহ্ণ বহন করে। 

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)। সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর- ভাব বাংলাদেশ এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞ -ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। ইমেইল: [email protected]

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

ভ্যালেরিয়া লুইসেলির উপন্যাস ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ সীমান্ত পারি দেওয়ার যন্ত্রণার কথা বলে

প্রকাশ: ০৯:৫০:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ অগাস্ট ২০২১

২০২১সালে আন্তর্জাতিক ডাবলিন সাহিত্য পুরুষ্কার পেয়েছেন মেক্সিকোর নারী লেখক ভ্যালেরিয়া লুইসেলি (Valeria Luiselli)। ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ (Lost Children Archive) উপন্যাসের জন্য তাকে এ পুরুষ্কার দেওয়া হয়। পুরুষ্কার হিসেবে তিনি পাবেন এক লাখ ইউরো। গত বছর এই উপন্যাসের জন্য ভ্যালেরিয়া পেয়েছেন রথবোনস ফোলিও পুরুষ্কার। বইটির ধারা বিবরণীতে পরিবার ও রাষ্ট্রের বিচিছন্নতা, বিভেদ এবং বিচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে কয়েকটি প্রশ্ন দিয়ে। শিশুরাই যদি আমাদের ভবিষ্যত হয় তাহলে দেশ তাদের রক্ষনাবেক্ষন করতে পারছেনা কেন? রাষ্ট্র এটি করতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে? রাষ্ট্রের ব্যর্থতায় শিশুদের ভবিষ্যত কি?

লুইসেলি একজন মেধাবী ও কল্পনাবিলাসী ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখা ভিনদেশে আশ্রয় অনুসন্ধানকারীদের পক্ষে কথা বলে। এখানে পরিবারের গল্পের সাথে সন্তানকে দক্ষহাতে সংযোগ করার গল্প। চরিত্রগুলো এমন যে, বাধ্য হয়ে তাদের বিচ্ছেদ ঘটেছে এবং অপরিচিত দেশে তাদের ঠাঁই হয়েছে। তাঁর ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ একটি স্মৃতির মতো গল্প। এটি নকশাদার চিত্রের মতো ধীরে ধীরে খুলতে থাকে এবং পাঠককে গল্পকারদের প্রধান জায়গার গভীরে নিয়ে যায়। লুইসেলি  আমাদেরকে পারিবারিক জীবনের অসংখ্য সন্ধি ও আলাপ আলোচনা বিশাল দৃষ্টিকোন দিয়ে ধীরে ধীরে তাকাতে বলেন । তিনি  অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ঘটনার বুনন করেছেন যা অসংখ্য প্রজন্ম এবং সংস্কৃতির ইতি টেনেছেন এমনভাবে যা দৃষ্টিনন্দন এককত্ব। ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ উপন্যাসটি আমেরিকা ও মেক্সিকোর সীমান্তে সংঘটিত মানবিক সংকটের হৃদয়বিদারক দৃশ্য ও ঘটনা তুলে ধরে।

ভ্যালেরি লুইসেসি মেক্সিকো সিটিতে জন্মগ্রহন করেন এবং বেড়ে ওঠেন দক্ষিন কোরিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা ও ভারতে। তিনি ফিকশন এবং নন-ফিকশন লেখিকা এবং ’সাইডওয়াকস’ নামক প্রবন্ধ সংগ্রহের লেখিকা। তার রচিত উপন্যাস হচ্ছে- ’ফেইসেস ইন দ্যা ক্রাউড, দ্য স্টোরি অফ মাই টিথ, এবং অতি সম্প্রতি ’ টেল মি হাউ ইট এন্ডস: অ্যান এএস ইন ফরটি কোয়েশ্চেনস’। তিনি ২০১৯সালের ম্যাক আর্থার ফেলোশিপ জয়ী, এবং দুটি লস অ্যালেঞ্জস টাইমস বুক প্রাইজেস জয়ী,আরও একটি আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোননীত হয়েছেন। তাঁর লেখা বিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ’রেসিডেন্স অ্যাট বার্ড কলেজের লেখিকা এবং নিউ ইয়র্কে বাস করেন। 

ভ্রমণ কাহিনী আকারে লিখিত ঘটনাবলী রাস্তায় ভ্রমণ করার ওপর কেন্দ্রীভূত। ভ্রমণটি সংঘটিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে মেক্সিকান সীমান্তে। বইটির শুরু ২০১৪ সাল। তখন মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দলে দলে অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা পার করেছেন। নামহীন বর্ণনাকারী ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন।  তিনি লুইসেলির সাথে গল্পগুলো বলছেন । তিনি বলছেন যে, অভিবাসীরা যখন সীমানা পার হন অনেক শিশু তখন হারিয়ে যায় কিংবা বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২০১৪সালের গ্রীষ্মকাল।  নিউইয়র্কে বসবাসকারী লুইসেলি  গ্রীন কার্ডের অপেক্ষা করছেন এবং একদিন সড়ক ভ্রমণে বের হন। তিনি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা একজন অভিবাসী, আইনগত অধিকার পাওয়া, তিনি তার স্বামী ও দুই সন্তানসহ যাত্রা করছেন কোকাইজ কাউন্টি, অ্যারিজোনার মধ্য দিয়ে যা মেক্সিকো সীমান্তের নিকট। তারা যখন ওকলাহোমার মধ্য দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন সংকটের খবর শুনতে পেলেন। একাকী শিশুদের অধিকাংশই সহিংসতা ও হুমকির মধ্য গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের মধ্য দিয়ে এসেছে। তারা বেশি সংখ্যায় সীমান্তে হাজির হচ্ছে অক্টোবর ২০১৩ জুন ২০১৪ সময়ের মধ্যে আশি হাজারের মতো উপস্থিত হয়েছে সীমান্তে। তাদের মধ্য অধিকাংশই অবর্ণনীয় বিপদের মধ্য দিয়ে এখানে এসেছে। 

শিশু অভিবাসীর দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য পাগলপ্রায়। সীমান্ত প্রহরীদের কাছে প্রথম তাদের আত্ম-সমর্পণ করতে হবে যাতে বৈধভাবে তারা দীর্ঘদিন আমেরিকায় থেকে যেতে পারে। তবে সেজন্য তাদের দীর্ঘ ও কঠিন ফর্মালিটি শুরু করতে হবে, কঠিন সময় পার করতে হবে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্বপ্নের দেশে কোন স্বপ্ন নিয়ে আসেনি, বরং তারা যে দু:স্বপ্ন ও আতংকের মধ্য জন্মগ্রহন করেছে এবং সেখানে থেকে দু:সাহসিক, কঠিন ও নিষ্ঠুর বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র আর মরুভূমি পারি দিয়ে এই সীমান্তে এসেছে তার প্রধান কারন হচেছ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদ, শুধুমাত্র জীবনের কঠিনতম ও নিষ্ঠুর অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার আর্তনাদ। তাই বলা হয়ে থাকে যে, উপন্যাসটি গভীরভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ। 

৩২০০ শতেরও বেশি অভিবাসী শিশুদের দক্ষিন টেক্সাস বর্ডার পেট্রোল ফ্যাসিটিতে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাদেরকে  বড়ো একটি তাবুর নীচে যেখানে মা-বাবা ছাড়া শিশুরা এবং শিশুসহ পরিবারদের অল্পকিছুদিনের জন্য রাখা হয়। কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন বিভাগ চায় যে, শিশুদের ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রে ৭২ঘন্টার মধ্যে স্থানান্তর করতে হবে। কিন্তু কেউই শিশুদের সেখানে স্থানান্তর করতে পারছেনা কারন সে ধরনের আশ্রয়কেন্দ্র নেই কিংবা থাকলেও তা অপ্রতুল। কাস্টমস ও বর্ডার প্রোটেকশন বিভাগের লোকবল কম, জায়গা কম এবং খাবারেরও অভাব। ভয়ে এবং একাকিত্বের কারণে অনেক শিশু অনাহারে থাকে এই ক্যাম্পে। এক সাক্ষাৎকারে দেখা যায় যে, শিশুরা বলছে তাদেরকে সপ্তাহে একবার গোসল করানো হয়। তাদেরকে পালাক্রমে ঘুমাতে হয় কারন জায়গার সংকুলান হয়না।  দ্যা সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সুপারিশ করছে যে, দুই বছর থেকে পরবর্তী বয়স্ক শিশুদের নিরাময় পদক্ষেপসমূহ জোরদার করতে এবং মুখে মাস্ক পড়তে অথচ ধারন ক্ষমতার বেশি অভিবাসীদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে। কেউ চিন্তাও করেনা শিশুদের সেখানে পাঠানো হলো কেন। তারা কত  বড়ো যুদ্ধ, নিষ্ঠুরতা, দারিদ্রসহ বহু ধরনের  কষ্টের কারনে সেখানে গিয়েছে। 

লুইসেলির ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’  উপন্যাসের বর্ণনাকারী সেই প্রশ্নগুলোই জিজ্ঞেস করছে শিশুরা কেন সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। তারা দূর-দূরান্তের পাহাড় নদী, সাগর, জঙ্গল পেরিয়ে , মরুভূমি পেরিয়ে কেন সেখানে আসছে। কেউ ঐতিহাসিক যুদ্ধ চলছে ঐ গোলার্ধে: কী যুদ্ধ, কেন যুদ্ধ? তারা কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে? তাদেরকে নিয়ে মার্কিন প্রশাসন কি করবে? কেউই জিজ্ঞেস করছে না তারা কেন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে সেখানে গেছে। লুইসেলি বলছেন এগুলো আমাদের সন্তান, এটি আমাদের মানবিক সংকট যা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে, আলোচনা করতে হবে, সমাধান বের করতে হবে এবং এটি বাস্তব যা আমরা এড়াতে পারিনা। এটি রূপক কোন দলিল বা কাগজপত্র নয়, এটি কোন আন্তপাঠ নয় কিংবা সাহিত্যিক কোন বিষয় নয় যা আমরা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ হতে দেখব। এটি হচ্ছে জ্বলন্ত সত্য যে হাজার হাজার অভিবাসীর গমন। এই শিশুরা তাদের সম্মান, তাদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। একজন শিক্ষাবিদ ও একজন অভিবাসী হিসেবে আমি অন্তত আমাদের শিক্ষাদানের মধ্যে দিয়ে চেষ্টা করতে পারি তাদের সম্মান ফিরিয়ে আনার। 

ভ্যালেরিয়া লুইসেলির উপন্যাস 'লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ সীমান্ত পারি দেওয়ার যন্ত্রণার কথা বলে
ভ্যালেরিয়া লুইসেলির উপন্যাস ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ সীমান্ত পারি দেওয়ার যন্ত্রণার কথা বলে

স্বামী-স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মেক্সিকো সীমান্তের দিকে ছুটছেন লেখিকা, যেন এক মহাকাব্যিক সড়ক ভ্রমন। টেনেসি, ওকলাহামা এবং টেক্সাসের মতো ভৌতিক শহরের মধ্য দিয়ে ছুটছে গাড়ী। একটি পরিবারের বিচ্ছেদ, নিজ বাসভুম থেকে উচ্ছে ও নির্বাসন। ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’ গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন করছে গল্প বলার প্রকৃতি ও গুরুত্ব সম্পর্কে, কল্পকাহিনি ও বাস্তব। একটি স্তরবিশিষ্ট বর্ণনা পরিবারের, অভিবাসীর, বিচার এবং আশার। উপন্যাসটির গঠন সহজ নয়, এর সমাপ্তিও সহজ নয়। তারপরেও গল্প লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে এবং সম্ভবত গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয়েছে। ঘটনার বক্তা এবং তার পরিবার যখন আরকানসাসের মধ্যে দিয়ে যাচেছন, তখন ম্যানুয়েলার কাছ থেকে একটি ফোন আসে। মেনুয়েলা  মামলায় হেরে গেছেন তাই তার মেয়েদের নির্বাসনে পাঠানোর সময় হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচেছনা । তারা সম্ভবত নিউ মেক্সিকো এবং আরিজোনার মাঝামাঝি কোন জায়গায় লুকিয়ে আছেন। ম্যানুয়েলা বুঝতে পেরেছেন যে, তার বাবা-মা তার দিকেই আসছেন। তারা তাকে নিউ মেক্সিকো এবং আরিজোনায় খুঁজতে পারেন। অতএব, বর্ণনাকারী ভ্রমণ, কেন্দ্রের গভীরতা খুঁজতে শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে, তিনি যাদের গল্প বলছেন তারা হারিয়ে গেছে, যাদের কন্ঠস্বর আর শোনা যাবেনা কারন তারা সম্ভবত চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।  সাহসের সাথে লেখিকা উপন্যাসটির প্রায় অর্ধেক জুড়ে তাদের আবিস্কার করার জন্য ধীরে ধীরে সময় নিয়েছেন আর এই বিষয়টিই এখন গুরুত্বপূর্ন পড়ার বিষয়। 

আমাদের শ্রেণিকক্ষের আলোচনায় আমরা রূপক থেকে আমরা সীমান্তে চলে যেতে পারি বাস্তব ও ধারনসূচক জায়গাতে। আমরা গ্লোরিয় ই. আনজালদু-র থিউরিটিক্যাল অর্কিটেক্ট, যিনি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সীমান্ত হচ্ছে এক ধরনের উন্মুক্ত যন্ত্রণা, উন্মুক্ত ব্যাথা যেখানে তৃতীয় বিশ্বের পদধ্বনি শোনা যায়, যেখানে তৃতীয় বিশ্ব কড়া নাড়ে প্রথম বিশ্বের বিরুদ্ধে অর্থাৎ ধনী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে। সেখানে  রক্তপাত ঘটছে, একটি খোসা গঠিত হওয়ার পূর্বেই রক্তক্ষরণ হচ্ছে, দুই বিশ্বের জীবনরক্ত মিশে একটি নতুন দেশ হচ্ছে- সীমান্ত সংস্কৃতি। আর এখানেই অভিবাসী শিশুদের ধরা হচ্ছে যা একধরনের ভিন্নতা তৈরি করছে, প্রদর্শিত হচ্ছে বৈপরীত্য, মধ্যখান অর্থাৎ এখানেও না, ওখানেও না। রাষ্ট্র আরোপিত প্রায়শ্চিত্ত করার জায়গা এটি। এটি পরিবর্তনের জায়গা। সীমান্ত হচেছ নিরাপদ ও অনিরাপদ জায়গা, এটি হচেছ ধনীদের থেকে গরীবদের  আলাদা করার জায়গা। তাই সীমান্ত মানুষদের আলাদা করার চিহ্ণ বহন করে।