০১:৫৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
                       

শিক্ষা গবেষণার ধারণা, বৈশিষ্ট্য ও ধাপ

প্রফেসর মো. তবারক উল ইসলাম
  • প্রকাশ: ০১:৩২:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ অগাস্ট ২০২১
  • / ১১৬৪১ বার পড়া হয়েছে

শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য শিক্ষা গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ | ছবি Annie Spratt/Unsplush

আমরা যদি একটি শ্রেণির দুইজন শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখা যাবে যে, এই একই শ্রেণির দুইজন শিক্ষার্থীর জন্য প্রেষণা প্রদানের পদ্ধতি একরকম নাও হতে পারে। একজনকে হয়তো বকা দিলে তার ফলাফল ভালো হয় বা ক্লাসে মনোনিবেশ করে, অন্যজনকে হয়তো প্রতিনিয়ত প্রশংসা করে উৎসাহ প্রদান করতে হয় ও সাহস যোগাতে হয়। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে বোঝা যাবে কার জন্য কী ধরনের প্রেষণা পদ্ধতি প্রয়োজন? শিক্ষা গবেষণা এই ধরনের পরিস্থিতিতে সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম। বর্তমানে প্রতিযোগিতার যুগে যে কোন পেশার পেশাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য ক্রমাগতভাবে পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গবেষণার মাধ্যমে যে-কোনো সমস্যার বৈজ্ঞানিকভাবে সমাধান করা সম্ভব। জ্ঞানের যেকোন শাখায় গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং সকল কর্মকাণ্ডের উন্নতি, অগ্রগতি, সকল-দুর্বল দিক চিহ্নিত করা সম্ভব। শিক্ষকতা একটি অন্যতম প্রাচীন পেশা হলেও এই পেশায়ও বর্তমানে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্বের সকল দেশই কম-বেশি শিক্ষা সংক্রান্ত মৌলিক (basic) বা প্রয়োগমূলক (applied) গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এই নিবন্ধে শিক্ষা গবেষণার ধারণা, বৈশিষ্ট্য,এবং ধাপ নিয়ে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে।

শিক্ষা গবেষণার ধারণা

মানব মন কৌতুহলী। প্রতিনিয়ত তার মনে নিত্য নতুন প্রশ্নের সঞ্চার হয়। মানুষের আত্মজিজ্ঞাসার একটি সুনির্দিষ্ট রূপই হলো গবেষণা। মানব মনের অসংখ্য প্রশ্ন বা জানার ইচ্ছে থেকেই গবেষণার উৎপত্তি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যে সুনির্দিষ্ট উপায় বা কৌশল প্রয়োগে মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় তাই হলো গবেষণা। সুপরিকল্পিত ও সুসংঘবদ্ধ উপায়ে ধারবাহিক তথ্য সংগ্রহপূর্বক সেই তথ্যের সঠিক বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যার মাধ্যমে যখন কোনো সমস্যার নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় সেই পদ্ধতিকে গবেষণা বলা হয়। শিক্ষা গবেষক John W. Best এর মতে, “বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ দ্বারা বিশে­ষণেরআরও আনুষ্ঠানিক, সুসংবদ্ধ ও ব্যাপক প্রক্রিয়াকে গবেষণা হিসেবে অভিহিত করা যায়।” জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি, প্রসার, উন্নতি অথবা পরিবেশের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা, নিজস্ব উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করা কিংবা নিজের সংঘাতের সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সময়ের সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীগণ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। এভাবেই সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যেকোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া ও নতুন জ্ঞানের সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাগবেষণা বিশ্বস্তরূপে আবির্ভুত হয়েছে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণা করার উদ্দেশ্য হলো শিখন-শেখানো কার্যক্রমের জন্য নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি ও এর মাধ্যমে শিক্ষা অনুশীলনের মানোন্নয়ন করা।

শিক্ষা গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এমন বিষয়

যে সকল বিষয়গুলো শিক্ষা গবেষণার আওতাভুক্ত সে সকল বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে আলোচনা করা হলো-

শিক্ষার্থীর শিখন (Learning): কোন পদ্ধতি বা কৌশলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয় ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারে সে ব্যাপারে দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়।

শিক্ষকের শিক্ষণ পদ্ধতি নির্বাচন (Teaching Method): শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের পথ সুগম করার জন্য কোন শিক্ষণ পদ্ধতি সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে তার বিশদ ধারণা লাভ করা যায়।

প্রেষণা (Motivation): কীভাবে শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করা যায় ও প্রেষণা দেওয়া সম্ভব যা শিক্ষার্থীকে একজন পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।

শিক্ষার্থীর বিকাশ (Students’ Development/Improvement): শিক্ষার্থীর পরিণমন ও তার জ্ঞানগত, সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতার বিকাশ কিভাবে শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের সাথে সম্পর্কিত এবং শিক্ষার্থীর বিকাশে ভূমিকা পালন করে তা জানা যায়।

শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা (Classroom Management): কী কী কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ফলপ্রসূ শ্রেণি ব্যবস্থাপনা সম্ভব সে ব্যাপারে জ্ঞানলাভ করা যায়।

শিক্ষাক্ষেত্রে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Urgent decision making): শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো বিশেষ কারণে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলার জন্য জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

শিক্ষা নীতি ও ব্যবস্থার উন্নয়ন (Education Policy and System Development):  একটি দেশে প্রচলিত শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থার পরিবর্তন বা উন্নয়ন করতে গবেষণার বিকল্প নেই।

এক কথায় বলা যায়, শিক্ষা গবেষণা হলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কিত সুপরিকল্পিত উপায়ে সংগৃহীত তথ্য ও এর যথাযথ বিশ্লেষণ। শিক্ষা গবেষণায় শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন বিষয় (aspects) অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেমন: শিক্ষার্থীর শিখন, শিক্ষণ-পদ্ধতি, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, শ্রেণিকক্ষের উন্নয়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শিক্ষা নীতি ও ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি।

শিক্ষা গবেষণার বৈশিষ্ট্য

শিক্ষা গবেষণা সাধারণত কোনো সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে করা হয়। এক্ষেত্রে প্রাথমিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় বা প্রচলিত তথ্যকে নতুনভাবে যাচাই করা হয়। পর্যবেক্ষণযোগ্য ঘটনা বা বাস্তবসম্মত বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণা সুসম্পন্ন করার জন্য সঠিক পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনা প্রয়োজন। শিক্ষা গবেষণায় সতর্কভাবে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে গবেষণা পদ্ধতি নির্ণয় ও তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণার ফলাফল সাধারণীকরণ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় যেন পরবর্তীতে তা অনুমান বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

নিম্নে শিক্ষা গবেষণার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

নতুন জ্ঞানের সন্ধান ও সমস্যা সমাধান: নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ করাই গবেষণার প্রথম কাজ। গবেষকগণ পুরাতন সত্য ও সূত্রের স্থলে নতুন জ্ঞান ও সূত্র সন্ধান করে থাকে। এতে প্রাথমিক উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করে জ্ঞান লাভ করা যায়। গবেষক সর্বদা কোনো না কোনো সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। গবেষণার বিষয়কে সমস্যা আকারে বিবেচনা করা হয়। উক্ত সমস্যা সমাধানের জন্যই গবেষণা করা হয়।

চলকগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়: গবেষণা দুই বা ততোধিক চলকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে থাকে। এই চলকগুলোর মধ্যে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক সম্পর্ক নির্ণয় করাই গবেষণার একটি অন্যতম প্রধান কাজ।

যুক্তি প্রয়োগে সমস্যাদির বিশ্লেষণ ও তত্ত্বের প্রসার: গবেষণায় কঠোর যুক্তি প্রয়োগ করে সমস্যাদির ব্যাখ্যা করা হয়। যুক্তিনির্ভর উপায়েই সমস্যার বিশ্লেষণ করা উচিত। গবেষণা তত্ত্বের প্রসার ঘটায়। গবেষণার ফলাফলের সার্বিকীকরণের মাধ্যমে তত্ত্বকে প্রসারিত করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র গবেষণা থেকে বৃহৎ তত্ত্ব এভাবে বেরিয়ে আসতে পারে।

নিরপেক্ষতা, যথার্থতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা: গবেষককে নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে হবে। কঠোর পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হয়ে গবেষক গবেষণার তথ্যাদি সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ফলাফল তৈরি করবেন। এক্ষেত্রে অনুমিত সিদ্ধান্তকে শুধু প্রমাণ করার দিকে অবিচল না থেকে যুক্তি, তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণা হবে যথার্থ ও নৈব্যক্তিক। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা করা হয় বলে এতে প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষতা থাকে এবং গবেষণাটি যথার্থ ও নৈর্ব্যক্তিক হয়।

সাধারণ সূত্র আবিস্কার ও ভবিষ্যৎবাণী: গবেষণার মাধ্যমে যুক্তিসম্মত তত্ত্ব বা সাধারণ সূত্র আবিস্কার করা হয়। প্রতিটি গবেষণার প্রাপ্ত সিদ্ধান্তসমূহ বা ফলাফল তার সাধারণ সূত্র প্রদান করে থাকে। সঠিক গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতের ঘটনাপুঞ্জ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব। ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে বা পরিস্থিতির কিরূপ পরিবর্তন হতে পারে তা বর্তমানে গবেষণা করে অনেকটাই নির্ণয় করা সম্ভব।

সুনিপুণ, ধারবাহিক ও সঠিক অনুসন্ধান সংখ্যায় প্রকাশ: অতি সতর্কতার সাথে গবেষণা পরিকল্পনার পর গবেষণা করা হয়ে থাকে। এতে সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ, লিপিবদ্ধ ও বিশ্লেষণ করা হয়। ভুলত্রুটি এড়িয়ে সুনিপুণ, ধারবাহিক ও সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে গবেষণা কর্মটি করা হয়। গবেষণার প্রাপ্ত পরিমানগত ও গুণগত তথ্যাদি যতদূর সম্ভব সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। সংখ্যায় প্রকাশিত তথ্যাদি অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, নির্ভরযোগ্য ও সহজে বোধগম্য হয়।

সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাপেক্ষ, ব্যয় বহুল ও কষ্টকর কাজ: গবেষণা অধিক সময় ও পরিশ্রমেরকাজ। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সত্যের অনুসন্ধান গবেষণার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গবেষণা করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুদক্ষ গবেষক দ্বারা গবেষণাকর্ম করলে কাংঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়, কিন্তু এতে ব্যয় হয় প্রচুর।

ধৈর্য্যশীল, ধীরস্থির ও সাহসিকতাপূর্ণ কার্যক্রম: গবেষণার জন্য প্রচুর সময়, শ্রম ও কষ্ট করতে হয়। তাই গবেষককে ধৈর্য্যশীল ও ধীরস্থির থাকতে হবে। গবেষককে হতে হবে খুবই সাহসী। কোনো কোনো গবেষণা করতে ও ফলাফল প্রকাশ করতে গবেষককে অপ্রিয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সাহসিকতার সাথে এসব মোকাবেলা করে সত্যের অনুসন্ধান ও প্রকাশ করা গবেষকের উচিত।

সতর্ক রেকর্ড ও রিপোর্ট প্রকাশ করার কাজ: গবেষককে একজন জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ হতে হয়। যে বিষয়ে তিনি গবেষণা করতে ইচ্ছুক ঐ বিষয়ে তার প্রচুর জ্ঞান, দক্ষতা থাকা উচিত। গবেষণার তথ্যাদি অতি সতর্কতার সাথে রেকর্ড করতে হয়। এসব তথ্যাদির ভিত্তিতে প্রাপ্ত ফলাফল রিপোর্ট করার জন্য আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

শিক্ষা গবেষণার ধাপসমূহ

শিক্ষা গবেষণা সুপরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে, তাই এই গবেষণা ফলপ্রসূভাবে সম্পন্ন করার জন্য কিছু ধারাবাহিক ধাপ অনুসরণ করা হয়। শিক্ষা গবেষণার এই ধাপসমূহ একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত। যদি কোনো একটি ধাপে পরিবর্তন আনা হয় তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিতে সেটি প্রতিফলিত হবে। অন্যান্য যে-কোনো প্রকৃতির গবেষণার ন্যায় শিক্ষা গবেষণার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে নিম্নোক্ত ধাপগুলো সংযুক্ত থাকে।

সাধারণত, গবেষণায় ছয়টি ধাপ রয়েছে; এগুলো হলো-

১. গবেষণার সমস্যা চিহ্নিতকরণ (Problem Identifying): অর্থাৎ কি সমস্যা নিরুপণ বা সমাধানের উদ্দেশ্যে গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হবে তার একটি বিস্তৃত ধারণা নেয়া। এর মধ্যে গবেষণার বিষয় বা ইস্যু নির্বাচন করা এবং এই বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটাও প্রমাণ করতে হবে, সেই সাথে কে বা করা এই গবেষণা থেকে উপকৃত হবে সেটিও চিহ্নিত করতে হবে।

২. গবেষণা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনা (Literature Review): সংশ্লিষ্ট সাহিত্য হতে পারে কোনো জার্নাল আর্টিকেল, ম্যাগাজিন, বই, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কিত কোনো তথ্য বা উপাত্ত। সাহিত্য পর্যালোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো এই বিষয়ের বর্তমান অবস্থান ও অন্যান্য গবেষণায় সেটি কোন আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে তা তুলে ধরা।

৩. গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণ ((Specifying a Research purpose): এই ধাপে গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে এবং সেই উদ্দেশ্য অনুযায়ী গবেষণার প্রশ্ন নির্বাচন করা হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুমিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গবেষণার প্রশ্ন সবসময় গবেষণার উদ্দেশ্যকে সংকীর্ণ আকারে সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়। গবেষণা পদ্ধতি নির্বাচনের পূর্বেই গবেষণার প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়।গবেষণার আকার অনুযায়ী সাধারণত কয়েকটি গবেষণা প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়ে থাকে।

৪. গবেষণা পদ্ধতি নির্বাচন (Designing Research Study): গবেষণা প্রশ্নের (Research Question) উত্তর পাওয়ার জন্য কোন পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি উপযোগী তা ঠিক করা হয়। তিন ধরনের গবেষণা পদ্ধতি রয়েছে। যেমন: গুণগত (Qualitative) গবেষণা, পরিমাণগত (Quantitative) গবেষণা ও মিশ (গরীবফ) গবেষণা পদ্ধতি। গবেষণা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে পুরো গবেষণা কার্য পরিচালিত হয়। এই ধাপে গবেষণার তথ্যবিশ্ব (Population) নির্বাচন করা হবে এবং নমুনায়ন পদ্ধতি কি হবে তা সমগ্র পপুলেশন এর প্রতিনিধিত্বশীল কিনা সে ব্যাপারে বর্ণনা করা হবে। গবেষণার কাজে কে বা কারা তথ্যদাতা হবে, কি কারণে তাদেরকে তথ্যদাতা হিসেবে নির্বাচন করা হলো তার কারণ উল্লেখ করা থাকবে। কি কি উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে সে ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা করা হবে এবং তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার কি হবে তা পাইলট টেস্টিং এর মাধ্যমে যথার্থতা নির্ণয় পূর্বক উল্লেখ করা হবে।

গবেষণা কাজে যে প্রশ্নমালা ব্যবহৃত হয় তা সাধারণত নিম্নোক্ত তিনটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হয়-

  • উত্তরদাতা (Respondent) পড়তে পারেন এবং প্রশ্নের অর্থ অনুধাবনে সক্ষম
  • প্রশ্নের উত্তর প্রদানের মত তথ্য উত্তরদাতার নিকট রয়েছে
  • উত্তরদাতা সম্পূর্ণ সততার সাথে উত্তর প্রদানে সম্মত

৫. তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা (Analyzing and Interpreting the Data): প্রথমে তথ্যগুলো পরিষ্কারভাবে সাজাতে হবে। সংগৃহীত তথ্য বিন্যাস ও শ্রেণিবদ্ধকরণ করা হবে। এরপর গবেষণা পদ্ধতি অর্থাৎ গুণগত/পরিমাণগত/মিশ্র গবেষণার ধারা অনুযায়ী বিশ্লেষণ করতে হবে। তথ্য বিশ্লেষণ করা শেষ হয়ে গেলে আনুমানিক যে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছিল সেটির যৌক্তিকতা যাচাই করতে হবে। যাচাই পর্বের পর এর গ্রহণযোগ্যতা দেখা দিলে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হবে। অন্যথায় এটিকে একেবারে বর্জন করতে হবে কিংবা দেখতে হবে সংশোধন করা সম্ভব কিনা। সিদ্ধান্ত সংশোধন করা সম্ভব হলে নতুনভাবে সিদ্ধান্তটি লিখতে হবে এবং তার ভিত্তিতে আবার তথ্য সংগ্রহ পর্যায়ে ফিরে যেতে হবে। অর্থাৎ নতুনভাবে পরীক্ষণটি শুরু করতে হবে। তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা শেষ হলে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে ফলাফল পাওয়া যাবে তার বর্ণনা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনার ফলাফলের সাথে তুলনা করতে হবে। এই গবেষণার কি কি সীমাবদ্ধতা আছে তা উল্লেখ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এই বিষয় নিয়ে কি ধরনের গবেষণা করা সম্ভব তার উল্লেখ থাকবে।

৬. গবেষণার রিপোর্ট তৈরি (Reporting Research): গবেষণার রিপোর্ট তৈরির জন্য প্রথমে একটি সারাংশ লেখা হবে এবং পর্যায়ক্রমে ভূমিকা, সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনা, গবেষণা পদ্ধতি, তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা, ফলাফল ও সবশেষে উপসংহার এর বিশদ বর্ণনা দিতে হবে। তবে গবেষণার বিশদ রিপোর্ট থেকে যখন কোনো জার্নাল আর্টিকেল প্রকাশ করা হয় তখন নির্দিষ্ট জার্নাল এর নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়। সাধারণত বিভিন্ন জার্নালের নির্দেশনা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে, তবে মূল ধাপগুলো একই থাকে।

অবশ্য প্রয়োজনবোধে গবেষক কোন পদক্ষেপ দীর্ঘায়িত করতে পারেন বা কোনো একটি ধাপকে এড়িয়ে যেতে পারেন। উন্নত বিশ্বে গবেষক কখনো কখনো নিজস্ব গতিতে নিজস্ব পদ্ধতিতেও গবেষণা করে থাকেন।

(যথাযথ লাইসেন্সের আওতায় নিবন্ধটি সংগ্রহ, সংযোজন, বর্জন ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হলো। মূল সম্পত্তি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সংরক্ষিত)

শেয়ার করুন

One thought on “শিক্ষা গবেষণার ধারণা, বৈশিষ্ট্য ও ধাপ

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

প্রফেসর মো. তবারক উল ইসলাম

প্রফেসর মো. তবারক উল ইসলাম সম্পাদিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত বই 'শিক্ষা গবেষণা'র লেখকগণ হলেন যথাক্রমে প্রফেসর ড. সেলিনা আক্তার, প্রফেসর মো. তবারক উল ইসলাম, প্রফেসর হোসনে আরা আহমেদ, প্রফেসর এস এম হাফিজুর রহমান এবং এমএস মেরিন সুলতানা
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

শিক্ষা গবেষণার ধারণা, বৈশিষ্ট্য ও ধাপ

প্রকাশ: ০১:৩২:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ অগাস্ট ২০২১

আমরা যদি একটি শ্রেণির দুইজন শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখা যাবে যে, এই একই শ্রেণির দুইজন শিক্ষার্থীর জন্য প্রেষণা প্রদানের পদ্ধতি একরকম নাও হতে পারে। একজনকে হয়তো বকা দিলে তার ফলাফল ভালো হয় বা ক্লাসে মনোনিবেশ করে, অন্যজনকে হয়তো প্রতিনিয়ত প্রশংসা করে উৎসাহ প্রদান করতে হয় ও সাহস যোগাতে হয়। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে বোঝা যাবে কার জন্য কী ধরনের প্রেষণা পদ্ধতি প্রয়োজন? শিক্ষা গবেষণা এই ধরনের পরিস্থিতিতে সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম। বর্তমানে প্রতিযোগিতার যুগে যে কোন পেশার পেশাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য ক্রমাগতভাবে পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গবেষণার মাধ্যমে যে-কোনো সমস্যার বৈজ্ঞানিকভাবে সমাধান করা সম্ভব। জ্ঞানের যেকোন শাখায় গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং সকল কর্মকাণ্ডের উন্নতি, অগ্রগতি, সকল-দুর্বল দিক চিহ্নিত করা সম্ভব। শিক্ষকতা একটি অন্যতম প্রাচীন পেশা হলেও এই পেশায়ও বর্তমানে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্বের সকল দেশই কম-বেশি শিক্ষা সংক্রান্ত মৌলিক (basic) বা প্রয়োগমূলক (applied) গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এই নিবন্ধে শিক্ষা গবেষণার ধারণা, বৈশিষ্ট্য,এবং ধাপ নিয়ে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে।

শিক্ষা গবেষণার ধারণা

মানব মন কৌতুহলী। প্রতিনিয়ত তার মনে নিত্য নতুন প্রশ্নের সঞ্চার হয়। মানুষের আত্মজিজ্ঞাসার একটি সুনির্দিষ্ট রূপই হলো গবেষণা। মানব মনের অসংখ্য প্রশ্ন বা জানার ইচ্ছে থেকেই গবেষণার উৎপত্তি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যে সুনির্দিষ্ট উপায় বা কৌশল প্রয়োগে মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় তাই হলো গবেষণা। সুপরিকল্পিত ও সুসংঘবদ্ধ উপায়ে ধারবাহিক তথ্য সংগ্রহপূর্বক সেই তথ্যের সঠিক বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যার মাধ্যমে যখন কোনো সমস্যার নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় সেই পদ্ধতিকে গবেষণা বলা হয়। শিক্ষা গবেষক John W. Best এর মতে, “বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ দ্বারা বিশে­ষণেরআরও আনুষ্ঠানিক, সুসংবদ্ধ ও ব্যাপক প্রক্রিয়াকে গবেষণা হিসেবে অভিহিত করা যায়।” জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি, প্রসার, উন্নতি অথবা পরিবেশের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা, নিজস্ব উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করা কিংবা নিজের সংঘাতের সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সময়ের সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীগণ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। এভাবেই সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যেকোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া ও নতুন জ্ঞানের সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাগবেষণা বিশ্বস্তরূপে আবির্ভুত হয়েছে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণা করার উদ্দেশ্য হলো শিখন-শেখানো কার্যক্রমের জন্য নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি ও এর মাধ্যমে শিক্ষা অনুশীলনের মানোন্নয়ন করা।

শিক্ষা গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এমন বিষয়

যে সকল বিষয়গুলো শিক্ষা গবেষণার আওতাভুক্ত সে সকল বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে আলোচনা করা হলো-

শিক্ষার্থীর শিখন (Learning): কোন পদ্ধতি বা কৌশলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয় ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারে সে ব্যাপারে দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়।

শিক্ষকের শিক্ষণ পদ্ধতি নির্বাচন (Teaching Method): শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের পথ সুগম করার জন্য কোন শিক্ষণ পদ্ধতি সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে তার বিশদ ধারণা লাভ করা যায়।

প্রেষণা (Motivation): কীভাবে শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করা যায় ও প্রেষণা দেওয়া সম্ভব যা শিক্ষার্থীকে একজন পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।

শিক্ষার্থীর বিকাশ (Students’ Development/Improvement): শিক্ষার্থীর পরিণমন ও তার জ্ঞানগত, সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতার বিকাশ কিভাবে শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের সাথে সম্পর্কিত এবং শিক্ষার্থীর বিকাশে ভূমিকা পালন করে তা জানা যায়।

শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা (Classroom Management): কী কী কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ফলপ্রসূ শ্রেণি ব্যবস্থাপনা সম্ভব সে ব্যাপারে জ্ঞানলাভ করা যায়।

শিক্ষাক্ষেত্রে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Urgent decision making): শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো বিশেষ কারণে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলার জন্য জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

শিক্ষা নীতি ও ব্যবস্থার উন্নয়ন (Education Policy and System Development):  একটি দেশে প্রচলিত শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থার পরিবর্তন বা উন্নয়ন করতে গবেষণার বিকল্প নেই।

এক কথায় বলা যায়, শিক্ষা গবেষণা হলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কিত সুপরিকল্পিত উপায়ে সংগৃহীত তথ্য ও এর যথাযথ বিশ্লেষণ। শিক্ষা গবেষণায় শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন বিষয় (aspects) অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেমন: শিক্ষার্থীর শিখন, শিক্ষণ-পদ্ধতি, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, শ্রেণিকক্ষের উন্নয়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শিক্ষা নীতি ও ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি।

শিক্ষা গবেষণার বৈশিষ্ট্য

শিক্ষা গবেষণা সাধারণত কোনো সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে করা হয়। এক্ষেত্রে প্রাথমিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় বা প্রচলিত তথ্যকে নতুনভাবে যাচাই করা হয়। পর্যবেক্ষণযোগ্য ঘটনা বা বাস্তবসম্মত বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণা সুসম্পন্ন করার জন্য সঠিক পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনা প্রয়োজন। শিক্ষা গবেষণায় সতর্কভাবে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে গবেষণা পদ্ধতি নির্ণয় ও তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণার ফলাফল সাধারণীকরণ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় যেন পরবর্তীতে তা অনুমান বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

নিম্নে শিক্ষা গবেষণার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

নতুন জ্ঞানের সন্ধান ও সমস্যা সমাধান: নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ করাই গবেষণার প্রথম কাজ। গবেষকগণ পুরাতন সত্য ও সূত্রের স্থলে নতুন জ্ঞান ও সূত্র সন্ধান করে থাকে। এতে প্রাথমিক উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করে জ্ঞান লাভ করা যায়। গবেষক সর্বদা কোনো না কোনো সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। গবেষণার বিষয়কে সমস্যা আকারে বিবেচনা করা হয়। উক্ত সমস্যা সমাধানের জন্যই গবেষণা করা হয়।

চলকগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়: গবেষণা দুই বা ততোধিক চলকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে থাকে। এই চলকগুলোর মধ্যে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক সম্পর্ক নির্ণয় করাই গবেষণার একটি অন্যতম প্রধান কাজ।

যুক্তি প্রয়োগে সমস্যাদির বিশ্লেষণ ও তত্ত্বের প্রসার: গবেষণায় কঠোর যুক্তি প্রয়োগ করে সমস্যাদির ব্যাখ্যা করা হয়। যুক্তিনির্ভর উপায়েই সমস্যার বিশ্লেষণ করা উচিত। গবেষণা তত্ত্বের প্রসার ঘটায়। গবেষণার ফলাফলের সার্বিকীকরণের মাধ্যমে তত্ত্বকে প্রসারিত করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র গবেষণা থেকে বৃহৎ তত্ত্ব এভাবে বেরিয়ে আসতে পারে।

নিরপেক্ষতা, যথার্থতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা: গবেষককে নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে হবে। কঠোর পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হয়ে গবেষক গবেষণার তথ্যাদি সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ফলাফল তৈরি করবেন। এক্ষেত্রে অনুমিত সিদ্ধান্তকে শুধু প্রমাণ করার দিকে অবিচল না থেকে যুক্তি, তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণা হবে যথার্থ ও নৈব্যক্তিক। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা করা হয় বলে এতে প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষতা থাকে এবং গবেষণাটি যথার্থ ও নৈর্ব্যক্তিক হয়।

সাধারণ সূত্র আবিস্কার ও ভবিষ্যৎবাণী: গবেষণার মাধ্যমে যুক্তিসম্মত তত্ত্ব বা সাধারণ সূত্র আবিস্কার করা হয়। প্রতিটি গবেষণার প্রাপ্ত সিদ্ধান্তসমূহ বা ফলাফল তার সাধারণ সূত্র প্রদান করে থাকে। সঠিক গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতের ঘটনাপুঞ্জ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব। ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে বা পরিস্থিতির কিরূপ পরিবর্তন হতে পারে তা বর্তমানে গবেষণা করে অনেকটাই নির্ণয় করা সম্ভব।

সুনিপুণ, ধারবাহিক ও সঠিক অনুসন্ধান সংখ্যায় প্রকাশ: অতি সতর্কতার সাথে গবেষণা পরিকল্পনার পর গবেষণা করা হয়ে থাকে। এতে সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ, লিপিবদ্ধ ও বিশ্লেষণ করা হয়। ভুলত্রুটি এড়িয়ে সুনিপুণ, ধারবাহিক ও সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে গবেষণা কর্মটি করা হয়। গবেষণার প্রাপ্ত পরিমানগত ও গুণগত তথ্যাদি যতদূর সম্ভব সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। সংখ্যায় প্রকাশিত তথ্যাদি অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, নির্ভরযোগ্য ও সহজে বোধগম্য হয়।

সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাপেক্ষ, ব্যয় বহুল ও কষ্টকর কাজ: গবেষণা অধিক সময় ও পরিশ্রমেরকাজ। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সত্যের অনুসন্ধান গবেষণার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গবেষণা করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুদক্ষ গবেষক দ্বারা গবেষণাকর্ম করলে কাংঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়, কিন্তু এতে ব্যয় হয় প্রচুর।

ধৈর্য্যশীল, ধীরস্থির ও সাহসিকতাপূর্ণ কার্যক্রম: গবেষণার জন্য প্রচুর সময়, শ্রম ও কষ্ট করতে হয়। তাই গবেষককে ধৈর্য্যশীল ও ধীরস্থির থাকতে হবে। গবেষককে হতে হবে খুবই সাহসী। কোনো কোনো গবেষণা করতে ও ফলাফল প্রকাশ করতে গবেষককে অপ্রিয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সাহসিকতার সাথে এসব মোকাবেলা করে সত্যের অনুসন্ধান ও প্রকাশ করা গবেষকের উচিত।

সতর্ক রেকর্ড ও রিপোর্ট প্রকাশ করার কাজ: গবেষককে একজন জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ হতে হয়। যে বিষয়ে তিনি গবেষণা করতে ইচ্ছুক ঐ বিষয়ে তার প্রচুর জ্ঞান, দক্ষতা থাকা উচিত। গবেষণার তথ্যাদি অতি সতর্কতার সাথে রেকর্ড করতে হয়। এসব তথ্যাদির ভিত্তিতে প্রাপ্ত ফলাফল রিপোর্ট করার জন্য আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

শিক্ষা গবেষণার ধাপসমূহ

শিক্ষা গবেষণা সুপরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে, তাই এই গবেষণা ফলপ্রসূভাবে সম্পন্ন করার জন্য কিছু ধারাবাহিক ধাপ অনুসরণ করা হয়। শিক্ষা গবেষণার এই ধাপসমূহ একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত। যদি কোনো একটি ধাপে পরিবর্তন আনা হয় তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিতে সেটি প্রতিফলিত হবে। অন্যান্য যে-কোনো প্রকৃতির গবেষণার ন্যায় শিক্ষা গবেষণার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে নিম্নোক্ত ধাপগুলো সংযুক্ত থাকে।

সাধারণত, গবেষণায় ছয়টি ধাপ রয়েছে; এগুলো হলো-

১. গবেষণার সমস্যা চিহ্নিতকরণ (Problem Identifying): অর্থাৎ কি সমস্যা নিরুপণ বা সমাধানের উদ্দেশ্যে গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হবে তার একটি বিস্তৃত ধারণা নেয়া। এর মধ্যে গবেষণার বিষয় বা ইস্যু নির্বাচন করা এবং এই বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটাও প্রমাণ করতে হবে, সেই সাথে কে বা করা এই গবেষণা থেকে উপকৃত হবে সেটিও চিহ্নিত করতে হবে।

২. গবেষণা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনা (Literature Review): সংশ্লিষ্ট সাহিত্য হতে পারে কোনো জার্নাল আর্টিকেল, ম্যাগাজিন, বই, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কিত কোনো তথ্য বা উপাত্ত। সাহিত্য পর্যালোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো এই বিষয়ের বর্তমান অবস্থান ও অন্যান্য গবেষণায় সেটি কোন আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে তা তুলে ধরা।

৩. গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণ ((Specifying a Research purpose): এই ধাপে গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে এবং সেই উদ্দেশ্য অনুযায়ী গবেষণার প্রশ্ন নির্বাচন করা হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুমিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গবেষণার প্রশ্ন সবসময় গবেষণার উদ্দেশ্যকে সংকীর্ণ আকারে সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়। গবেষণা পদ্ধতি নির্বাচনের পূর্বেই গবেষণার প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়।গবেষণার আকার অনুযায়ী সাধারণত কয়েকটি গবেষণা প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়ে থাকে।

৪. গবেষণা পদ্ধতি নির্বাচন (Designing Research Study): গবেষণা প্রশ্নের (Research Question) উত্তর পাওয়ার জন্য কোন পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি উপযোগী তা ঠিক করা হয়। তিন ধরনের গবেষণা পদ্ধতি রয়েছে। যেমন: গুণগত (Qualitative) গবেষণা, পরিমাণগত (Quantitative) গবেষণা ও মিশ (গরীবফ) গবেষণা পদ্ধতি। গবেষণা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে পুরো গবেষণা কার্য পরিচালিত হয়। এই ধাপে গবেষণার তথ্যবিশ্ব (Population) নির্বাচন করা হবে এবং নমুনায়ন পদ্ধতি কি হবে তা সমগ্র পপুলেশন এর প্রতিনিধিত্বশীল কিনা সে ব্যাপারে বর্ণনা করা হবে। গবেষণার কাজে কে বা কারা তথ্যদাতা হবে, কি কারণে তাদেরকে তথ্যদাতা হিসেবে নির্বাচন করা হলো তার কারণ উল্লেখ করা থাকবে। কি কি উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে সে ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা করা হবে এবং তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার কি হবে তা পাইলট টেস্টিং এর মাধ্যমে যথার্থতা নির্ণয় পূর্বক উল্লেখ করা হবে।

গবেষণা কাজে যে প্রশ্নমালা ব্যবহৃত হয় তা সাধারণত নিম্নোক্ত তিনটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হয়-

  • উত্তরদাতা (Respondent) পড়তে পারেন এবং প্রশ্নের অর্থ অনুধাবনে সক্ষম
  • প্রশ্নের উত্তর প্রদানের মত তথ্য উত্তরদাতার নিকট রয়েছে
  • উত্তরদাতা সম্পূর্ণ সততার সাথে উত্তর প্রদানে সম্মত

৫. তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা (Analyzing and Interpreting the Data): প্রথমে তথ্যগুলো পরিষ্কারভাবে সাজাতে হবে। সংগৃহীত তথ্য বিন্যাস ও শ্রেণিবদ্ধকরণ করা হবে। এরপর গবেষণা পদ্ধতি অর্থাৎ গুণগত/পরিমাণগত/মিশ্র গবেষণার ধারা অনুযায়ী বিশ্লেষণ করতে হবে। তথ্য বিশ্লেষণ করা শেষ হয়ে গেলে আনুমানিক যে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছিল সেটির যৌক্তিকতা যাচাই করতে হবে। যাচাই পর্বের পর এর গ্রহণযোগ্যতা দেখা দিলে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হবে। অন্যথায় এটিকে একেবারে বর্জন করতে হবে কিংবা দেখতে হবে সংশোধন করা সম্ভব কিনা। সিদ্ধান্ত সংশোধন করা সম্ভব হলে নতুনভাবে সিদ্ধান্তটি লিখতে হবে এবং তার ভিত্তিতে আবার তথ্য সংগ্রহ পর্যায়ে ফিরে যেতে হবে। অর্থাৎ নতুনভাবে পরীক্ষণটি শুরু করতে হবে। তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা শেষ হলে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে ফলাফল পাওয়া যাবে তার বর্ণনা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনার ফলাফলের সাথে তুলনা করতে হবে। এই গবেষণার কি কি সীমাবদ্ধতা আছে তা উল্লেখ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এই বিষয় নিয়ে কি ধরনের গবেষণা করা সম্ভব তার উল্লেখ থাকবে।

৬. গবেষণার রিপোর্ট তৈরি (Reporting Research): গবেষণার রিপোর্ট তৈরির জন্য প্রথমে একটি সারাংশ লেখা হবে এবং পর্যায়ক্রমে ভূমিকা, সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনা, গবেষণা পদ্ধতি, তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা, ফলাফল ও সবশেষে উপসংহার এর বিশদ বর্ণনা দিতে হবে। তবে গবেষণার বিশদ রিপোর্ট থেকে যখন কোনো জার্নাল আর্টিকেল প্রকাশ করা হয় তখন নির্দিষ্ট জার্নাল এর নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়। সাধারণত বিভিন্ন জার্নালের নির্দেশনা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে, তবে মূল ধাপগুলো একই থাকে।

অবশ্য প্রয়োজনবোধে গবেষক কোন পদক্ষেপ দীর্ঘায়িত করতে পারেন বা কোনো একটি ধাপকে এড়িয়ে যেতে পারেন। উন্নত বিশ্বে গবেষক কখনো কখনো নিজস্ব গতিতে নিজস্ব পদ্ধতিতেও গবেষণা করে থাকেন।

(যথাযথ লাইসেন্সের আওতায় নিবন্ধটি সংগ্রহ, সংযোজন, বর্জন ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হলো। মূল সম্পত্তি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সংরক্ষিত)