০৭:০৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শিক্ষার তিন ধারা: অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা

অধ্যাপক আবু হামিদ লতিফ
  • প্রকাশ: ০৮:৩৯:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ অগাস্ট ২০২১
  • / ১৫৭৯৯ বার পড়া হয়েছে

শিক্ষার ধারা তিনটি | ছবি: Pexels

মানবজাতির অগ্রযাত্রায় শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শিক্ষার ইতিহাস অনুসরণ করলে শিক্ষার তিনটি ধারা (three streams of education) পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষার এই তিনটি ধারা হলো- অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (informal education), উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (non-formal.education) ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (formal education)। শিক্ষার এই ত্রিধারা কোনো না কোনোভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। সেজন্য শিক্ষার এই তিন ধারাই অতি গুরুত্বপূর্ণ। 

অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Informal Education) 

মানুষের জীবনে শিক্ষার সূত্রপাত হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারায় এবং এই প্রক্রিয়া আমৃত্যু অব্যাহত থাকে। জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে জীবনব্যাপী দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মানুষ শুনে, দেখে, অনুকরণ করে, ঠেকে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে যা শেখে তাই অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা হচ্ছে একটি অনিঃশেষ প্রক্রিয়া। এই শিক্ষার পাঠশালা প্রকৃতি, পরিবেশ, পরিবার, সমাজ ও কর্মের ভুবন। শৈশবাবস্থায় শরীরের অঙগপ্রত্যঙ্গের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার এবং মাতৃভাষায় উচ্চারিত শব্দমালা শেখার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পাঠ। ধীরে ধীরে শিশু বড়ো হতে থাকে, চলতে থাকে তার শেখার পালা। সে হাটতে শেখে, কথা বলতে শেখে, ভালোমন্দ বিচার করতে শেখে। পরিবার, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের জীবনধারা ও ধ্যান-ধারণা থেকে গড়ে ওঠে তার অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ ও আচার-আচরণ। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের সাথে মেলামেশায় গড়ে ওঠে তার ব্যবহার, চরিত্র ও মানসিকতা। গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত নানা প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান ও লোকাচার থেকে সে শেখে সামাজিক রীতি-নীতি। পারিবারিক ধর্ম থেকে জন্ম হয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস।

প্রাচীন সমাজে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিল শিক্ষালাভের একমাত্র উপায় এবং এ শিক্ষা ছিল সর্বজনীন। বাঁচার জন্য এবং বাঁচার মধ্য দিয়ে এ শিক্ষা অর্জিত হতো, সামাজিকীকরণ ও শিক্ষার মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিল না। আধুনিক সমাজে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাধান্য সত্ত্বেও পারিবারিক শিক্ষাই এখনো শিশুর মনমানস ও চরিত্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিশুর কথাবার্তা, চলাফেরা, গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ, ভাষা শেখা, সদাচরণ, শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, দয়া-মায়া, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা প্রভৃতি সদগুণাবলির অনুশীলন হয়ে থাকে পারিবারিক পরিবেশে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে। আজকের যুগে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সংযোজিত হয়েছে পত্রপত্রিকা, খবরের কাগজ, রেডিয়ো, সিনেমা, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট ইত্যাদি। এসব প্রভাবশালী মাধ্যম সকলের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। আজকের শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী ও বয়স্ক লোকদের চিন্তা-ভাবনা, মতামত, অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ, মানসিকতা ও আচরণ গড়ে তুলতে এসব মাধ্যমের অবদান অনস্থীকার্য। অবশ্য একথা স্মরণীয় যে, বর্তমান যুগে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধরন ও পরিসীমা অনেকাংশে নির্ভর করে পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ওপর। একটি অখ্যাত গ্রামের সাওতাল পরিবারে একটি শিশু, কিশোর কিংবা বয়ঃপ্রাপ্ত লোকের সঙ্গে একটি অবস্থাপন্ন ও শিক্ষিত পরিবারের সদস্যদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধরন ও মানে দুস্তর ব্যবধান থাকবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মোটকথা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাবমুক্ত কেউই নয়। জীবনে অবস্থানের তারতম্য অনুযায়ী ব্যক্তির নিজস্ব পরিমণ্ডলে আজীবন এই শিক্ষা প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Non-formal Education) 

সমাজ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রাও পরিবর্তন হয়। এমনি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে দক্ষতার ভিত্তিতে মানুষের শ্রমবিভাজন (division of labour)। একসময় লোকের পেশা ছিল কৃষি। কিন্তু কালক্রমে কৃষি ছেড়ে একদল হলো কারিগর, একদল বণিক, একদল কল-কারখানার শ্রমিক। কেউ পুরোহিত, কেউ বৈদ্য, কেউ হেকিম। মেয়েরা হলো প্রধানত গৃহিণী। তাদের প্রধান কাজ সন্তানের জন্মদান ও লালন-পালন, গৃহপালিত প্রাণীর দেখাশোনা, রান্নাবান্না ও অন্যান্য সাংসারিক কাজকর্ম। 

বৃহদাংশের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক পেশায় বিদ্যা ও দক্ষতা অর্জন করা। ছেলেরা পিতা, বড়ো ভাই এবং পরিবারের অন্য বয়স্ক লোকদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষানবিশি (apprenticeship) করত এবং ধীরে ধীরে তারা পেশাগত দক্ষতা ও নৈপুণ্য আয়ত্ত করত। কখনো কখনো পরিবারবহিররভূত কোনো জ্ঞানীগুণী লোকের কাছে শিক্ষানবিশি করে কোনো বিশেষ বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করত। মেয়েরা মা, বড় বোন এবং অন্যান্য বয়স্ক মহিলার কাছে ঘরকন্না, সুচিকর্ম ও গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজকর্ম শিখত। কোনো কোনো মহিলা ভিন্নধর্মী কাজ যেমন দাইয়ের কাজ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখত। পেশাগত বিদ্যা ও দক্ষতা অর্জনের এ ধরনের শিক্ষানবিশি ও কর্ম অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারা সূচিত হতো। পরবর্তী পর্যায়ে কিছু কিছু কাজ সংগঠিত উপায়ে পরিচালিত হতো। যেমন, জনগণের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান প্রচার ও আচার-অনুষ্ঠান সঠিকভাবে পালনের নিয়মকানুন শিক্ষা দেয়া, খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ইত্যাদি। এ জাতীয় সংগঠিত কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম পরিচালনার প্রচেষ্টা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আদিপর্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পরবর্তীকালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষার দ্বিতীয় ধারা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। 

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সংজ্ঞা ও ধারণা

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার যে সংজ্ঞাটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তা হলো: আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত নির্দিষ্ট শিক্ষার্থী দলের জন্য বিশেষ উদ্দেশ্যে সংগঠিত শিক্ষামূলক কার্যক্রমই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আলাদা কার্যক্রম হিসেবে বা সমন্বিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়ে থাকে। 

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসর: উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হওয়ায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধারণাও নবতর ও ব্যাপকতর অর্থে সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার বয়সী ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই প্রধানত দরিদ্রতার কারণে স্কুলে যেতে পারে না কিংবা স্কুলে গেলেও প্রাথমিক শিক্ষাচক্র (primary cycle) সমাপ্ত করার পূর্বেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে (drop out)। এসব দেশের বিশাল দরিদ্র নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়ে ও বিভিন্ন ধরনের অসুবিধাগ্রস্ত ছেলেমেয়ে যারা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি বা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, যেসব কিশোর-কিশোরী স্কুলে যায়নি বা ঝরে পড়েছে এবং নিরক্ষর বয়স্ক জনগোষ্ঠী তাদের সবাইকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগ (second chance of education) প্রদান করা যায়। সেজন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে দ্বিতীয় সুযোগদানকারী শিক্ষা কার্যক্রম বলা হয়। এছাড়া জনবহুল কর্মসূচি, পরিবেশ সচেতনতা, পুষ্টি উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন এবং আধুনিকায়ন ইত্যাদি নানা রকমের চাহিদা কেবল আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসর ও কার্যক্রমের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পূরক (complementary) ও পরিপূরক (supplementary) শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন বয়সী মানুষের নানারকম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে কোনো দেশেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা (parallel education system) হিসেবে স্বীকৃত নয় ৷ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কোনো কোনো দেশে শিক্ষাব্যবস্থার একটি সাব-সিস্টেম (sub-system) হিসেবে স্বীকৃত। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষা সেক্টরের একটি সাব-সেক্টর (sub-sector) হিসেবেও গণ্য করা হয়। 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (Formal Education) 

মানব সমাজ কর্তৃক উদ্ভাবিত শিক্ষার্জনের সর্বশেষ শিক্ষাধারা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সব দেশের শিক্ষার মূলধারা (mainstream of education) এবং শিক্ষা সেক্টরের (sector) প্রধান সাব-সেক্টর (sub-sector)। 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনালগ্নে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা দেখা যায়। ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষা আয়ত্ত করে জনগণের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রীতিনীতি প্রচারের জন্য মসজিদ, মন্দির ও গির্জাকে কেন্দ্র করেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত। মৌখিক শিক্ষা, স্ব-অধ্যয়ন, ধ্যান এবং আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবহারিক অনুশীলন ছিল এই শিক্ষার পদ্ধতি। এভাবেই পুরোহিত, যাজক, মোল্লা, মৌলবি প্রভৃতি ধর্ম সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী শ্রেণির সৃষ্টি হয়। 

অপর দিকে মানব সমাজের অগ্রগতির ফলে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃততর হয় এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নতুনতর উপাদান সংযোজিত হয়। মানব সমাজের জ্ঞানের সংরক্ষণ, বিতরণ ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও পারদর্শী লোক সরবরাহ করার জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে সামাজিক উদ্যোগে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে থাকে। সমাজের সদস্যদের শিক্ষার্জনের জন্য সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষায়তন গড়ে ওঠে সামাজিক প্রতিষ্ঠান (social institution) হিসেবে।

বিভিন্ন ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন, মক্তব-মাদ্রাসা, পাঠশালা, টোল, স্কুল-কলেজ এবং বৃত্তিমূলক উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজের বহুমুখী শিক্ষার প্রয়োজন মেটায়। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকালে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ‘গুরুকুল’ স্থাপিত হয়। গুরুর পারিবারিক বাসস্থানকে গুরুকুল বলা হতো। শিক্ষার্থীরা এই গুরুকুলে এসে গুরুর পরিবারের সাথে বাস করত। শহর ও নগর থেকে দূরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গুরুকুল স্থাপন করা হতো এবং গুরু উন্মুক্ত আকাশের নিচে প্রকৃতির কোলে বিদ্যার্থীদের জ্ঞান বিতরণ করতেন। গুরুকুলের জীবন অত্যন্ত কঠোর ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। 

সেকালেও ভারতীয় উপমহাদেশে শিশু শিক্ষার ব্যাপারে সবিশেষ মনোযোগ দেয়া হতো। বেশ সমারোহ সহকারে পর্বপালনের মধ্য দিয়ে শিশুকে বিদ্যালয়ে বা গুরু মহাশয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পাঠানো হতো। এ ব্যাপারে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারে কিছু পার্থক্য ছিল। হিন্দুর ছেলেরা পাঁচ বছর বয়সে গুরুগৃহে যেত। জ্যোতিষীর গোনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যার্থ শিক্ষকের কাছ থেকে তার জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করত। গুরু ছিলেন শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা এবং শিষ্য জীবনের পরবর্তীকালে আশ্রমে প্রবেশ না করা পর্যন্ত তিনি তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। 

মুসলমান পরিবারের শিশুদের চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হলেই ‘বিসমিল্লাহ খানি’ পর্ব পালিত হতো অর্থাৎ ছেলেদের এ দিন মক্তবে ভর্তি করা হতো। মক্তব শেষ করে মুসলমান ছেলেরা যেত মাদরাসায়। হিন্দু ছেলেরা পাঠশালার পড়া শেষ করার পর যারা ব্রাহ্মণ বা বৈদ্য তারা যেত চতুষ্পাঠীতে বা টোলে। মক্তব বা মাদরাসার দুয়ার হিন্দু ছেলেদের জন্য খোলা থাকত। তারা আরবি, ফারসি শিখে সরকারি চাকরি লাভ করত। এরূপ উদারতা হিন্দু শিক্ষায়তনগুলোর ছিল না। মুসলমানদের প্রতি উদার হওয়া দুরে থাক হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের প্রতি তারা উদার হয়নি। পাঠশালা পর্যন্তই ছিল নিম্নবর্ণের দৌড়। প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে ভারতবর্ষে টোল ও পাঠশালা এবং মক্তব- মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষার একটি বিস্তৃত ধারা থাকলেও তার কোনো বিস্তারিত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। 

পশ্চিমা দেশগুলোতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের পর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, বিশেষ করে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ত্বরান্বিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে প্রধানত সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় উপমহাদেশে একটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন ও মূল কাঠামো সৃষ্টি হয় ব্রিটিশ ওপনিবেশিক (colonial) আমলে। ১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যান্টের শিক্ষা বিষয়ক সুপারিশমালা, ১৮৩৫ সালের মেকলের শিক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদন, ১৮৩৮ সালের উইলিয়াম অ্যাডামসের শিক্ষা বিষয়ক জরিপ, ১৮৫৪ সালের চার্লস উডের শিক্ষা বিষয়ক ডেসপাচ, ১৮৮২ সালের উইলিয়াম হান্টারের নেতৃতাধীন প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন এবং ১৯০৪ সালের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯১৪ সালের নাথান রিপোর্ট ইত্যাদির ভিত্তিতে উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা রূপলাভ করে এবং ক্রমান্বয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাধান্য বিস্তার করে। 

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় ভারত এবং পাকিস্তান (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানসহ) ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে। পাকিস্তান আমল (১৯৪৭ থেকে ১৯৭০) পেরিয়ে বাংলাদেশে যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে তার মুল কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য ব্রিটিশ ভারতে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিচয় বহন করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার সামাজিক চাহিদা বেড়েছে এবং তা পূরণের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা বিস্তার লাভ করছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত শিক্ষা কমিশন প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Goal and Objective of Formal Education) 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য (goal) হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন। একটি দেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষার প্রশস্ত ভিত গড়ে তোলে শিক্ষার্থীর মেধা অনুযায়ী মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিচালিত। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ কর্মপ্রচেষ্টায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার শিক্ষার্থী, কার্যক্রম ও কলা কৌশল ভিন্নতর ৷ তবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্যও মানবসম্পদ উন্নয়ন। 

শিক্ষার উদ্দেশ্য (objective) হচ্ছে একটি পাঠের নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাবার প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত অর্জনগুলোর বিবরণ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট, স্পষ্ট, সহজবোধ্য শব্দ ও বাক্যের সাহায্যে প্রণীত, আচরণের সাথে সম্পর্কিত, অর্জনযোগ্য ও পরিমাপযোগ্য।

শেয়ার করুন

One thought on “শিক্ষার তিন ধারা: অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা

  1. ভারতীয় উপমহাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধারণা দেন কে?

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

শিক্ষার তিন ধারা: অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা

প্রকাশ: ০৮:৩৯:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ অগাস্ট ২০২১

মানবজাতির অগ্রযাত্রায় শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শিক্ষার ইতিহাস অনুসরণ করলে শিক্ষার তিনটি ধারা (three streams of education) পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষার এই তিনটি ধারা হলো- অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (informal education), উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (non-formal.education) ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (formal education)। শিক্ষার এই ত্রিধারা কোনো না কোনোভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। সেজন্য শিক্ষার এই তিন ধারাই অতি গুরুত্বপূর্ণ। 

অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Informal Education) 

মানুষের জীবনে শিক্ষার সূত্রপাত হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারায় এবং এই প্রক্রিয়া আমৃত্যু অব্যাহত থাকে। জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে জীবনব্যাপী দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মানুষ শুনে, দেখে, অনুকরণ করে, ঠেকে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে যা শেখে তাই অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা হচ্ছে একটি অনিঃশেষ প্রক্রিয়া। এই শিক্ষার পাঠশালা প্রকৃতি, পরিবেশ, পরিবার, সমাজ ও কর্মের ভুবন। শৈশবাবস্থায় শরীরের অঙগপ্রত্যঙ্গের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার এবং মাতৃভাষায় উচ্চারিত শব্দমালা শেখার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পাঠ। ধীরে ধীরে শিশু বড়ো হতে থাকে, চলতে থাকে তার শেখার পালা। সে হাটতে শেখে, কথা বলতে শেখে, ভালোমন্দ বিচার করতে শেখে। পরিবার, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের জীবনধারা ও ধ্যান-ধারণা থেকে গড়ে ওঠে তার অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ ও আচার-আচরণ। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের সাথে মেলামেশায় গড়ে ওঠে তার ব্যবহার, চরিত্র ও মানসিকতা। গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত নানা প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান ও লোকাচার থেকে সে শেখে সামাজিক রীতি-নীতি। পারিবারিক ধর্ম থেকে জন্ম হয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস।

প্রাচীন সমাজে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিল শিক্ষালাভের একমাত্র উপায় এবং এ শিক্ষা ছিল সর্বজনীন। বাঁচার জন্য এবং বাঁচার মধ্য দিয়ে এ শিক্ষা অর্জিত হতো, সামাজিকীকরণ ও শিক্ষার মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিল না। আধুনিক সমাজে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাধান্য সত্ত্বেও পারিবারিক শিক্ষাই এখনো শিশুর মনমানস ও চরিত্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিশুর কথাবার্তা, চলাফেরা, গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ, ভাষা শেখা, সদাচরণ, শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, দয়া-মায়া, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা প্রভৃতি সদগুণাবলির অনুশীলন হয়ে থাকে পারিবারিক পরিবেশে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে। আজকের যুগে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সংযোজিত হয়েছে পত্রপত্রিকা, খবরের কাগজ, রেডিয়ো, সিনেমা, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট ইত্যাদি। এসব প্রভাবশালী মাধ্যম সকলের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। আজকের শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী ও বয়স্ক লোকদের চিন্তা-ভাবনা, মতামত, অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ, মানসিকতা ও আচরণ গড়ে তুলতে এসব মাধ্যমের অবদান অনস্থীকার্য। অবশ্য একথা স্মরণীয় যে, বর্তমান যুগে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধরন ও পরিসীমা অনেকাংশে নির্ভর করে পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ওপর। একটি অখ্যাত গ্রামের সাওতাল পরিবারে একটি শিশু, কিশোর কিংবা বয়ঃপ্রাপ্ত লোকের সঙ্গে একটি অবস্থাপন্ন ও শিক্ষিত পরিবারের সদস্যদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধরন ও মানে দুস্তর ব্যবধান থাকবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মোটকথা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাবমুক্ত কেউই নয়। জীবনে অবস্থানের তারতম্য অনুযায়ী ব্যক্তির নিজস্ব পরিমণ্ডলে আজীবন এই শিক্ষা প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Non-formal Education) 

সমাজ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রাও পরিবর্তন হয়। এমনি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে দক্ষতার ভিত্তিতে মানুষের শ্রমবিভাজন (division of labour)। একসময় লোকের পেশা ছিল কৃষি। কিন্তু কালক্রমে কৃষি ছেড়ে একদল হলো কারিগর, একদল বণিক, একদল কল-কারখানার শ্রমিক। কেউ পুরোহিত, কেউ বৈদ্য, কেউ হেকিম। মেয়েরা হলো প্রধানত গৃহিণী। তাদের প্রধান কাজ সন্তানের জন্মদান ও লালন-পালন, গৃহপালিত প্রাণীর দেখাশোনা, রান্নাবান্না ও অন্যান্য সাংসারিক কাজকর্ম। 

বৃহদাংশের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক পেশায় বিদ্যা ও দক্ষতা অর্জন করা। ছেলেরা পিতা, বড়ো ভাই এবং পরিবারের অন্য বয়স্ক লোকদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষানবিশি (apprenticeship) করত এবং ধীরে ধীরে তারা পেশাগত দক্ষতা ও নৈপুণ্য আয়ত্ত করত। কখনো কখনো পরিবারবহিররভূত কোনো জ্ঞানীগুণী লোকের কাছে শিক্ষানবিশি করে কোনো বিশেষ বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করত। মেয়েরা মা, বড় বোন এবং অন্যান্য বয়স্ক মহিলার কাছে ঘরকন্না, সুচিকর্ম ও গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজকর্ম শিখত। কোনো কোনো মহিলা ভিন্নধর্মী কাজ যেমন দাইয়ের কাজ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখত। পেশাগত বিদ্যা ও দক্ষতা অর্জনের এ ধরনের শিক্ষানবিশি ও কর্ম অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারা সূচিত হতো। পরবর্তী পর্যায়ে কিছু কিছু কাজ সংগঠিত উপায়ে পরিচালিত হতো। যেমন, জনগণের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান প্রচার ও আচার-অনুষ্ঠান সঠিকভাবে পালনের নিয়মকানুন শিক্ষা দেয়া, খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ইত্যাদি। এ জাতীয় সংগঠিত কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম পরিচালনার প্রচেষ্টা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আদিপর্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পরবর্তীকালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষার দ্বিতীয় ধারা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। 

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সংজ্ঞা ও ধারণা

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার যে সংজ্ঞাটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তা হলো: আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত নির্দিষ্ট শিক্ষার্থী দলের জন্য বিশেষ উদ্দেশ্যে সংগঠিত শিক্ষামূলক কার্যক্রমই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আলাদা কার্যক্রম হিসেবে বা সমন্বিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়ে থাকে। 

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসর: উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হওয়ায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধারণাও নবতর ও ব্যাপকতর অর্থে সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার বয়সী ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই প্রধানত দরিদ্রতার কারণে স্কুলে যেতে পারে না কিংবা স্কুলে গেলেও প্রাথমিক শিক্ষাচক্র (primary cycle) সমাপ্ত করার পূর্বেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে (drop out)। এসব দেশের বিশাল দরিদ্র নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়ে ও বিভিন্ন ধরনের অসুবিধাগ্রস্ত ছেলেমেয়ে যারা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি বা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, যেসব কিশোর-কিশোরী স্কুলে যায়নি বা ঝরে পড়েছে এবং নিরক্ষর বয়স্ক জনগোষ্ঠী তাদের সবাইকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগ (second chance of education) প্রদান করা যায়। সেজন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে দ্বিতীয় সুযোগদানকারী শিক্ষা কার্যক্রম বলা হয়। এছাড়া জনবহুল কর্মসূচি, পরিবেশ সচেতনতা, পুষ্টি উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন এবং আধুনিকায়ন ইত্যাদি নানা রকমের চাহিদা কেবল আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসর ও কার্যক্রমের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পূরক (complementary) ও পরিপূরক (supplementary) শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন বয়সী মানুষের নানারকম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে কোনো দেশেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা (parallel education system) হিসেবে স্বীকৃত নয় ৷ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কোনো কোনো দেশে শিক্ষাব্যবস্থার একটি সাব-সিস্টেম (sub-system) হিসেবে স্বীকৃত। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষা সেক্টরের একটি সাব-সেক্টর (sub-sector) হিসেবেও গণ্য করা হয়। 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (Formal Education) 

মানব সমাজ কর্তৃক উদ্ভাবিত শিক্ষার্জনের সর্বশেষ শিক্ষাধারা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সব দেশের শিক্ষার মূলধারা (mainstream of education) এবং শিক্ষা সেক্টরের (sector) প্রধান সাব-সেক্টর (sub-sector)। 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনালগ্নে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা দেখা যায়। ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষা আয়ত্ত করে জনগণের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রীতিনীতি প্রচারের জন্য মসজিদ, মন্দির ও গির্জাকে কেন্দ্র করেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত। মৌখিক শিক্ষা, স্ব-অধ্যয়ন, ধ্যান এবং আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবহারিক অনুশীলন ছিল এই শিক্ষার পদ্ধতি। এভাবেই পুরোহিত, যাজক, মোল্লা, মৌলবি প্রভৃতি ধর্ম সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী শ্রেণির সৃষ্টি হয়। 

অপর দিকে মানব সমাজের অগ্রগতির ফলে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃততর হয় এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নতুনতর উপাদান সংযোজিত হয়। মানব সমাজের জ্ঞানের সংরক্ষণ, বিতরণ ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও পারদর্শী লোক সরবরাহ করার জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে সামাজিক উদ্যোগে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে থাকে। সমাজের সদস্যদের শিক্ষার্জনের জন্য সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষায়তন গড়ে ওঠে সামাজিক প্রতিষ্ঠান (social institution) হিসেবে।

বিভিন্ন ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন, মক্তব-মাদ্রাসা, পাঠশালা, টোল, স্কুল-কলেজ এবং বৃত্তিমূলক উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজের বহুমুখী শিক্ষার প্রয়োজন মেটায়। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকালে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ‘গুরুকুল’ স্থাপিত হয়। গুরুর পারিবারিক বাসস্থানকে গুরুকুল বলা হতো। শিক্ষার্থীরা এই গুরুকুলে এসে গুরুর পরিবারের সাথে বাস করত। শহর ও নগর থেকে দূরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গুরুকুল স্থাপন করা হতো এবং গুরু উন্মুক্ত আকাশের নিচে প্রকৃতির কোলে বিদ্যার্থীদের জ্ঞান বিতরণ করতেন। গুরুকুলের জীবন অত্যন্ত কঠোর ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। 

সেকালেও ভারতীয় উপমহাদেশে শিশু শিক্ষার ব্যাপারে সবিশেষ মনোযোগ দেয়া হতো। বেশ সমারোহ সহকারে পর্বপালনের মধ্য দিয়ে শিশুকে বিদ্যালয়ে বা গুরু মহাশয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পাঠানো হতো। এ ব্যাপারে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারে কিছু পার্থক্য ছিল। হিন্দুর ছেলেরা পাঁচ বছর বয়সে গুরুগৃহে যেত। জ্যোতিষীর গোনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যার্থ শিক্ষকের কাছ থেকে তার জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করত। গুরু ছিলেন শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা এবং শিষ্য জীবনের পরবর্তীকালে আশ্রমে প্রবেশ না করা পর্যন্ত তিনি তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। 

মুসলমান পরিবারের শিশুদের চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হলেই ‘বিসমিল্লাহ খানি’ পর্ব পালিত হতো অর্থাৎ ছেলেদের এ দিন মক্তবে ভর্তি করা হতো। মক্তব শেষ করে মুসলমান ছেলেরা যেত মাদরাসায়। হিন্দু ছেলেরা পাঠশালার পড়া শেষ করার পর যারা ব্রাহ্মণ বা বৈদ্য তারা যেত চতুষ্পাঠীতে বা টোলে। মক্তব বা মাদরাসার দুয়ার হিন্দু ছেলেদের জন্য খোলা থাকত। তারা আরবি, ফারসি শিখে সরকারি চাকরি লাভ করত। এরূপ উদারতা হিন্দু শিক্ষায়তনগুলোর ছিল না। মুসলমানদের প্রতি উদার হওয়া দুরে থাক হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের প্রতি তারা উদার হয়নি। পাঠশালা পর্যন্তই ছিল নিম্নবর্ণের দৌড়। প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে ভারতবর্ষে টোল ও পাঠশালা এবং মক্তব- মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষার একটি বিস্তৃত ধারা থাকলেও তার কোনো বিস্তারিত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। 

পশ্চিমা দেশগুলোতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের পর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, বিশেষ করে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ত্বরান্বিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে প্রধানত সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় উপমহাদেশে একটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন ও মূল কাঠামো সৃষ্টি হয় ব্রিটিশ ওপনিবেশিক (colonial) আমলে। ১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যান্টের শিক্ষা বিষয়ক সুপারিশমালা, ১৮৩৫ সালের মেকলের শিক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদন, ১৮৩৮ সালের উইলিয়াম অ্যাডামসের শিক্ষা বিষয়ক জরিপ, ১৮৫৪ সালের চার্লস উডের শিক্ষা বিষয়ক ডেসপাচ, ১৮৮২ সালের উইলিয়াম হান্টারের নেতৃতাধীন প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন এবং ১৯০৪ সালের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯১৪ সালের নাথান রিপোর্ট ইত্যাদির ভিত্তিতে উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা রূপলাভ করে এবং ক্রমান্বয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাধান্য বিস্তার করে। 

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় ভারত এবং পাকিস্তান (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানসহ) ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে। পাকিস্তান আমল (১৯৪৭ থেকে ১৯৭০) পেরিয়ে বাংলাদেশে যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে তার মুল কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য ব্রিটিশ ভারতে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিচয় বহন করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার সামাজিক চাহিদা বেড়েছে এবং তা পূরণের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা বিস্তার লাভ করছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত শিক্ষা কমিশন প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Goal and Objective of Formal Education) 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য (goal) হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন। একটি দেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষার প্রশস্ত ভিত গড়ে তোলে শিক্ষার্থীর মেধা অনুযায়ী মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিচালিত। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ কর্মপ্রচেষ্টায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার শিক্ষার্থী, কার্যক্রম ও কলা কৌশল ভিন্নতর ৷ তবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্যও মানবসম্পদ উন্নয়ন। 

শিক্ষার উদ্দেশ্য (objective) হচ্ছে একটি পাঠের নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাবার প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত অর্জনগুলোর বিবরণ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট, স্পষ্ট, সহজবোধ্য শব্দ ও বাক্যের সাহায্যে প্রণীত, আচরণের সাথে সম্পর্কিত, অর্জনযোগ্য ও পরিমাপযোগ্য।