০১:৩৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

মহামারি ও ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব

ফারহানা ইয়াসমিন
  • প্রকাশ: ০২:১২:২২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ অগাস্ট ২০২১
  • / ১১১৮ বার পড়া হয়েছে

টমাস রবার্ট ম্যালথাস (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৭৭৬- ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৩৪)

ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ধর্মযাজক ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস (Thomas Robert Malthus) ১৭৯৮ সালে তাঁর একটি বই ‘An essay on the principle of population’ জনসংখ্যা নিয়ে একটি পর্যালোচনা করেন। যা পরবর্তী সময় ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব নামে পরিচিতি পায়। তার মতে, মানুষের টিকে থাকার জন্য প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্য। কিন্তু জমিতে ক্রমহ্রাসমান উত্পাদন ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ায় খাদ্যের জোগান ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ জমিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান থাকার ফলে এক পর্যায়ে সেই জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে। অন্যদিকে প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা থাকায় খাদ্যের জোগানের তুলনায় জনসংখ্যা বেড়েই চলে। সহজে তার তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বোঝানোর জন্য তিনি বলেছেন, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। যেমন: (১,২,৪,৮,১৬,৩২.) আর খাদ্যের উত্পাদন বাড়ে গাণিতিক হারে। যেমন: (১,২,৩,৪,৫,৬.) এতে করে এই দুটি জিনিসের মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি বলেন, প্রতি ২৫ বছর পর পর প্রতিটি দেশে দ্বিগুণ হারে জন্যসংখ্যা বাড়বে। অতঃপর, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্যের জোগানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপের।

টমাস রবার্ট ম্যালথাস  দুটি পদক্ষেপ বা উপায়ের কথা বলেছেন।

১. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: বাল্যবিবাহ রোধ, বিলম্বে বিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

২. প্রাকৃতিক প্রতিরোধ: অপুষ্টি, দারিদ্র্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ব্যবস্থাটি ক্ষণস্থায়ী, কারণ এটা মানুষের হাতে নেই।

ম্যালথাস মনে করেন, যখন কোনো দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যার সমস্যা দেখা দেয় এবং জনসংখ্যা ও খাদ্যের উত্পাদনের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তখন প্রাকৃতিক উদ্যোগের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়ে খাদ্যের জোগানের সঙ্গে পুনরায় ভারসাম্য ফিরে আসে। ম্যালথাসের তত্ত্বের আলোকে ধারণা করা যেতে পারে, প্রাকৃতিক প্রতিরোধ উপায়ে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চলমান কোভিড-১৯ মহামারির সূত্রপাত। তবে বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে গৃহীত নাও হতে পারে।

প্রতিদিনই লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি প্রয়োগ করা না গেলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই তত্ত্বটি অনেকাংশে সত্য হতে পারে। ভয়াবহ করোনা মহামারি বাংলাদেশে গত বছরের মার্চে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা বেশি থাকলেও মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কমই ছিল। কিন্তু এ বছরের জুলাইয়ের শেষ থেকে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। এভাবে প্রতিদিন যদি ২০০ জন করেও মানুষ মৃত্যুবরণ করতে থাকে তাহলে এক মাসে ৬ হাজার এবং এক বছরে ৭২ হাজার মানুষ বিয়োগ হয়ে যাবে মোট জনসংখ্যা থেকে। এরই মধ্যে করোনায় মৃত্যু ছড়িয়েছে ২১ হাজার। করোনায় প্রথম ১ হাজার মৃত্যু ৮১ দিনে হলেও, সবশেষ ১ হাজার মৃত্যু হয়েছে মাত্র পাঁচ দিনে। এই গতি চলমান থাকলে অচিরেই বাংলাদেশের বর্তমান মোট যে জনসংখ্যা (প্রায় ১৭ কোটি) তা নিয়ন্ত্রিত হবে।

ম্যালথাস আরো বলেছেন, যখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে জনসংখ্যার সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তখনই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ নামক ব্যবস্থাটি কার্যকর হয়। এবং এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জনসংখ্যা ও খাদ্যের জোগানের মধ্যে ভারসাম্য অর্জিত হয়। তবে এটার সময়কাল খুবই ক্ষণস্থায়ী। যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ করার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই তবে এর থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। এজন্যই বলা হচ্ছে, বর্তমানের কোভিড-১৯ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখলেও সেটা চিরস্থায়ী নয়। আবার এটির প্রাদুর্ভাব কবে নাগাদ শেষ হবে তাও আমরা জানি না।

উপর্যুক্ত আলোচনার কিছু বিপরীত চিত্রের দিকেও আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রথমত, করোনায় স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার ফলে বাল্যবিবাহের হার যেমন বেড়েছে তেমনি করে চাকরিজীবী মানুষসহ অন্যদের মধ্যে অধিক বাচ্চা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে জনসংখ্যার হার কিছুটা কমে গেলেও অন্যদিকে এসব কারণে জনসংখ্যার হার বেড়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে খাদ্য উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদিত খাদ্যশস্যের পাশাপাশি আমাদের দেশে বর্তমানে বিদেশ থেকেও খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে। ফলে খাদ্যের চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বিনষ্টের বিষয়টি যে জনসংখ্যা হ্রাসে ভূমিকা রাখবে এমন সম্ভবনা কম।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

ফারহানা ইয়াসমিন

ফারহানা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেন।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

মহামারি ও ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব

প্রকাশ: ০২:১২:২২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ অগাস্ট ২০২১

ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ধর্মযাজক ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস (Thomas Robert Malthus) ১৭৯৮ সালে তাঁর একটি বই ‘An essay on the principle of population’ জনসংখ্যা নিয়ে একটি পর্যালোচনা করেন। যা পরবর্তী সময় ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব নামে পরিচিতি পায়। তার মতে, মানুষের টিকে থাকার জন্য প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্য। কিন্তু জমিতে ক্রমহ্রাসমান উত্পাদন ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ায় খাদ্যের জোগান ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ জমিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান থাকার ফলে এক পর্যায়ে সেই জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে। অন্যদিকে প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা থাকায় খাদ্যের জোগানের তুলনায় জনসংখ্যা বেড়েই চলে। সহজে তার তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বোঝানোর জন্য তিনি বলেছেন, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। যেমন: (১,২,৪,৮,১৬,৩২.) আর খাদ্যের উত্পাদন বাড়ে গাণিতিক হারে। যেমন: (১,২,৩,৪,৫,৬.) এতে করে এই দুটি জিনিসের মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি বলেন, প্রতি ২৫ বছর পর পর প্রতিটি দেশে দ্বিগুণ হারে জন্যসংখ্যা বাড়বে। অতঃপর, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্যের জোগানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপের।

টমাস রবার্ট ম্যালথাস  দুটি পদক্ষেপ বা উপায়ের কথা বলেছেন।

১. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: বাল্যবিবাহ রোধ, বিলম্বে বিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

২. প্রাকৃতিক প্রতিরোধ: অপুষ্টি, দারিদ্র্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ব্যবস্থাটি ক্ষণস্থায়ী, কারণ এটা মানুষের হাতে নেই।

ম্যালথাস মনে করেন, যখন কোনো দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যার সমস্যা দেখা দেয় এবং জনসংখ্যা ও খাদ্যের উত্পাদনের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তখন প্রাকৃতিক উদ্যোগের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়ে খাদ্যের জোগানের সঙ্গে পুনরায় ভারসাম্য ফিরে আসে। ম্যালথাসের তত্ত্বের আলোকে ধারণা করা যেতে পারে, প্রাকৃতিক প্রতিরোধ উপায়ে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চলমান কোভিড-১৯ মহামারির সূত্রপাত। তবে বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে গৃহীত নাও হতে পারে।

প্রতিদিনই লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি প্রয়োগ করা না গেলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই তত্ত্বটি অনেকাংশে সত্য হতে পারে। ভয়াবহ করোনা মহামারি বাংলাদেশে গত বছরের মার্চে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা বেশি থাকলেও মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কমই ছিল। কিন্তু এ বছরের জুলাইয়ের শেষ থেকে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। এভাবে প্রতিদিন যদি ২০০ জন করেও মানুষ মৃত্যুবরণ করতে থাকে তাহলে এক মাসে ৬ হাজার এবং এক বছরে ৭২ হাজার মানুষ বিয়োগ হয়ে যাবে মোট জনসংখ্যা থেকে। এরই মধ্যে করোনায় মৃত্যু ছড়িয়েছে ২১ হাজার। করোনায় প্রথম ১ হাজার মৃত্যু ৮১ দিনে হলেও, সবশেষ ১ হাজার মৃত্যু হয়েছে মাত্র পাঁচ দিনে। এই গতি চলমান থাকলে অচিরেই বাংলাদেশের বর্তমান মোট যে জনসংখ্যা (প্রায় ১৭ কোটি) তা নিয়ন্ত্রিত হবে।

ম্যালথাস আরো বলেছেন, যখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে জনসংখ্যার সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তখনই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ নামক ব্যবস্থাটি কার্যকর হয়। এবং এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জনসংখ্যা ও খাদ্যের জোগানের মধ্যে ভারসাম্য অর্জিত হয়। তবে এটার সময়কাল খুবই ক্ষণস্থায়ী। যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ করার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই তবে এর থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। এজন্যই বলা হচ্ছে, বর্তমানের কোভিড-১৯ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখলেও সেটা চিরস্থায়ী নয়। আবার এটির প্রাদুর্ভাব কবে নাগাদ শেষ হবে তাও আমরা জানি না।

উপর্যুক্ত আলোচনার কিছু বিপরীত চিত্রের দিকেও আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রথমত, করোনায় স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার ফলে বাল্যবিবাহের হার যেমন বেড়েছে তেমনি করে চাকরিজীবী মানুষসহ অন্যদের মধ্যে অধিক বাচ্চা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে জনসংখ্যার হার কিছুটা কমে গেলেও অন্যদিকে এসব কারণে জনসংখ্যার হার বেড়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে খাদ্য উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদিত খাদ্যশস্যের পাশাপাশি আমাদের দেশে বর্তমানে বিদেশ থেকেও খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে। ফলে খাদ্যের চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বিনষ্টের বিষয়টি যে জনসংখ্যা হ্রাসে ভূমিকা রাখবে এমন সম্ভবনা কম।