০৯:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাঠ পরিকল্পনা

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ১১:২৩:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ জুলাই ২০২১
  • / ২৫৯৫৪ বার পড়া হয়েছে

পাঠ পরিকল্পনা বা লেসন প্ল্যান অনুসরণ করে একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন । Photo by National Cancer Institute on Unsplash

পাঠ পরিকল্পনা হলো শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পূর্বে নির্দিষ্ট পাঠ বা পাঠ্যাংশের বিষয়বস্তু, শিখনফল ও দক্ষতার আলোকে শিখন-শেখানোর উপযুক্ত পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচন, সময়বণ্টন এবং মূল্যায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পাঠ পরিকল্পনা প্রধানত দুই প্রকারের হয়ে থাকে, যথা- ১. বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা এবং ২. ক্ষুদ্র পাট পরিকল্পনা। এখানে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র, উভয় প্রকার পাঠ পরিকল্পনা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

পাঠ পরিকল্পনা সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে

বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা বা ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান বা বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা কী?

ইংরেজি ম্যাক্রো (macro) শব্দটি গ্রিক ভাষার শব্দ ‘makros’ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। শব্দটির বাংলা অর্থ হলো বৃহৎ, দীর্ঘ, লম্বা বা বড়ো।

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান (Macro Lesson Plan) বা বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা হলো এমন এক প্রকারে পাঠ্যক্রমভিত্তিক বা শিক্ষাক্রমভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা যা কোনো শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনো নির্দিষ্ট পাঠ্য বিষয়কে দীর্ঘ সময় যেমন- সম্পূর্ণ মাস, সেমিস্টার কিংবা পূর্ণ শিক্ষাবর্ষে পাঠদান করার জন্য প্রণয়ন করা হয়।

বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয় শিখন শিক্ষণ প্রণালীকে বেশি সহজতর করে তোলার জন্য এবং নিয়মিত পাঠদানের অগ্রগতির একটু কার্যকর নথি তৈরী করার জন্য।

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান এর উদ্দেশ্য

কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট দক্ষতা বা শিখনফল অর্জনের জন্য নির্বাচিত পাঠ্যবিষয় যা পুরো শিক্ষাবর্ষে বা অর্ধ শিক্ষাবর্ষে পাঠদান করা হবে তার সঠিক শিখন শেখানো পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঠদানসহ পাঠদানের অগ্রগতি, অবনতি, সীমাবদ্ধতা, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ইত্যাদি নথিভুক্ত করার জন্য বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয়। বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনাকে বাংলাতে দীর্ঘ পাঠ পরিকল্পনা কিংবা বৃহৎ-পাঠটিকা নামেও সংজ্ঞায়িত করা হয়।

পাঠদান প্রক্রিয়াকে অথবা শিখন-শেখানো কার্যক্রমে আকর্ষণীয় ও সহজতর করে তোলার জন্য বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়। এ ধরনের পাঠ পরিকল্পনা প্রস্তুত করার ফলে পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সনাক্ত করা এবং উপকরণ যোগান করা সম্পর্কে নিখুঁত ও কার্যকর ধারণা লাভ করা যায়।

নির্বাচিত পাঠ্যবিষয় পাঠদানকালে শিক্ষার্থীদের প্রান্ত থেকে যে সকল সমস্যা হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে পূর্বেই অনেকটা অনুমান করা যায়, এর ফলে সম্ভাব্য সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তত থাকা সম্ভব হয়।

যে পাঠ্যবিষয় কিংবা বিষয়বস্তু একটি নির্দিষ্ট দীর্ঘ সময়ে পাঠদান করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেগুলোর শিখনফল (learning outcomes) অর্জনের জন্য উপযুক্ত ও অপেক্ষাকৃত উন্নত শিক্ষণ পদ্ধতি ও কৌশল আবিস্কার ও প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করারর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা।

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান এর সুবিধা

  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা বা ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান (macro lesson plan) এর মাধ্যমে যে-কোনো শ্রেণির সম্পূর্ণ শিক্ষাবর্ষের জন্য শিখন শেখানোর সঠিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা সম্ভব হয়।
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনার সাহায্যে শ্রেণিকক্ষে সংগঠিত হওয়া সকল কার্যক্রমের যাবতীয় বিবরণী লিপিবদ্ধ করা যায়।
  • পাঠদানের বৃহৎ পরিকল্পনায় শিখন শেখানোর সব ধরনের পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করা যায় বলে শিক্ষা গবেষকদের মতামত পাওয়া গেছে।
  • শিখনফল টেকসই করার জন্য পাঠদানের জন্য উৎস ও নির্দেশনা সামগ্রী সম্পর্কে বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনায় বিস্তারিত আকারে ফুটিয়ে তোলা যায়।
  • শিখন শেখানো কার্যক্রমে উদ্ভুত হতে পারে এমন সমস্যা সম্পর্কে আনুমানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
  • সমস্ত পাঠ্যবিষয় ও বিষয়বস্তুর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহারের সাধারণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
  • পদ্ধতি ও কৌশল ও শিখনফলের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা যায় বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে।

 ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান এর অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা

  • যেহেতু ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান হলো এক দীর্ঘ পরিকল্পনা এবং একসঙ্গে শ্রেণীকক্ষের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরী করা হয়ে থাকে তাই অনেক সময় এই পরিকল্পনায় শ্লথ ধীর শিক্ষার্থীরা (Slow Learner) কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে।
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়।
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা উল্লেখিত পদ্ধতি ও কৌশল অনেক সময় প্রয়োগের অনুপযোগী হয়।
  • শিক্ষকদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সক্ষম বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা। 
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কখনো কখনো ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার সাহায্য নিতে হয়।

ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা অনু পাঠটিকা বা মাইক্রো লেসন প্ল্যান

মাইক্রো লেসন প্ল্যান কী?

ইংরেজি মাইক্রো (micro) শব্দের উৎপত্তি হয় গ্রিক ভাষার শব্দ মিক্রোস (mikros) থেকে যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো- সংক্ষিপ্ত, ক্ষুদ্র বা অনু।

কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির নির্দিষ্ট পাঠ্যবিষয় থেকে কোনো নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে যতটুকু পাঠদান করা হবে ততটুকুর শিখন-শেখানোর যে কৌশলগত পরিকল্পনা করা হয় তা হলো ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা মাইক্রো লেসন প্ল্যান (micro lesson plan)। ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা ‘অনুপাঠ টিকা’ নামেও পরিচিত। ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষকই প্রণয়ন করে থাকেন।

মাইক্রো লেসন প্ল্যানের উদ্দেশ্য

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান বা বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা যেখানে একটি সেমিস্টার কিংবা একটি শিক্ষাবর্ষে নির্ধারিত পাঠ্যবিষয়ের সকল বিষয়বস্তু কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়, সেখানে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা মাইক্রো লেসন প্ল্যানের উদ্দেশ্য হলো নির্ধারিত পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত সুনির্দিষ্ট একটি পাঠ বা পাঠ্যাংশ একদিনের শ্রেণি কার্যক্রমে কীভাবে শেখানো হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়।

ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো দৈনিক পাঠদান প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা। উপযুক্ত পন্থা অবলম্বন করে সাধারণত দৈনিক শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদেরকে নির্ধারিত পাঠ কিংবা পাঠ্যাংশের শিখনফল অর্জনে সহায়তা করা এবং অগ্রগতি মূল্যায়ন করে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা অনু-পাঠটিকা করা হয়।

মাইক্রো লেসন প্ল্যানের সুবিধা

ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে যে সকল সুবিধা পাওয়া যায় তা হলো-

  • সমগ্র পাঠ্যবিষয় থেকে শিখন শেখানো কার্যক্রমের জন্য দৈনিক পাঠ বা পাঠ্যাংশ সহজেই নির্ধারণ করা যায়।
  • নির্ধারিত পাঠ বা পাঠ্যাংশের শিখনফল অর্জনে শিক্ষার্থীদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব।
  • শিখনফল অর্জনের অগ্রগতি মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সহজতর হয়।
  • কোনো নির্দিষ্ট পাঠ বা পাঠ্যাংশ শেখানোর জন্য ব্যবহৃত কোনো পদ্ধতি কিংবা কৌশল অনুপযোগী বলে বিবেচিত হলে তা উপযুক্ততর পদ্ধতি বা কৌশল দিয়ে তা প্রতিস্থাপন করা যায়।
  • ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার অন্যতম একটি সুবিধা হলো- এই পাঠ পরিকল্পনা দৈনিক ও পিরিয়ড ভিত্তিক হওয়ায় প্রণীত পরিকল্পনার সম্পূর্ণ অংশ বা যে-কোনো অংশ সহজেই নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়, যদি প্রয়োজন হয়।
  • শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সহযোগিতা ও ও যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা। 
  • এই ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা অনু পাঠটিকা চতুরতার সাথে (smartly) শিখন শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষকের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে।
  • প্রতিটি শিক্ষার্থী সম্পর্কে একজন শিক্ষককে গভীর ধারণা সৃষ্টিতে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা সাহায্য করতে পারে।

মাইক্রো লেসন প্ল্যানের অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা

ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার বেশ কিছু অসুবিধা সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করা হলো-

  • ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক না হয়ে বেশিরভাগ সময় দক্ষতা কেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
  • ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনায় যে সময় বন্টণ দেখানো হয়, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন বেশিরভাগ সময়েই অসম্ভব।
  • শুধু ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করে নির্ধারিত শিখনফল অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত নয়, এতে বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনারও প্রয়োজন হয়।

বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা ও ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা অনু-পাঠটিকার মধ্যে পার্থক্য

ম্যাক্রো ও মাইক্রো লেসন প্ল্যানের কয়েকটি পার্থক্য-

  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয় একটি সম্পূর্ণ সেমিস্টার অথবা শিক্ষাবর্ষের জন্য; অপরদিকে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় দৈনিক ভিত্তিক
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা করা হয় সম্পূর্ণ পাঠ্যবিষয়ের জন্য; অপরদিকে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা করা হয় একটি নির্দিষ্ট পাঠ বা পাঠ্যাংশের জন্য।
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনায় বিষয়বস্তু ও দক্ষতা সমানভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বেশিরভাগ সময় দক্ষতাকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
  • ফলাবর্তনের ক্ষেত্রে বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার চেয়ে কম উপযোগী।

এছাড়াও বেশ কিছু পার্থক্য সনাক্ত করা যায় যখন একজন শিক্ষক এই দুই ধরনেরই পাঠ পরিকল্পনা করেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন।

পাঠ পরিকল্পনা বৃহৎ হোক অথবা ক্ষুদ্র হোক, উভয় প্রকারেরই যেমন সুনির্দিষ্ট কিছু সবিধা রয়েছে, তেমনই সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। তবে কখনোই বলা যাবে না যে, একটি থেকে আরেকটি উত্তম। কিন্তু দুই ধরনের পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করার প্রয়োজন রয়েছে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাঠ পরিকল্পনা

প্রকাশ: ১১:২৩:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ জুলাই ২০২১

পাঠ পরিকল্পনা হলো শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পূর্বে নির্দিষ্ট পাঠ বা পাঠ্যাংশের বিষয়বস্তু, শিখনফল ও দক্ষতার আলোকে শিখন-শেখানোর উপযুক্ত পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচন, সময়বণ্টন এবং মূল্যায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পাঠ পরিকল্পনা প্রধানত দুই প্রকারের হয়ে থাকে, যথা- ১. বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা এবং ২. ক্ষুদ্র পাট পরিকল্পনা। এখানে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র, উভয় প্রকার পাঠ পরিকল্পনা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

পাঠ পরিকল্পনা সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে

বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা বা ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান বা বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা কী?

ইংরেজি ম্যাক্রো (macro) শব্দটি গ্রিক ভাষার শব্দ ‘makros’ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। শব্দটির বাংলা অর্থ হলো বৃহৎ, দীর্ঘ, লম্বা বা বড়ো।

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান (Macro Lesson Plan) বা বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা হলো এমন এক প্রকারে পাঠ্যক্রমভিত্তিক বা শিক্ষাক্রমভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা যা কোনো শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনো নির্দিষ্ট পাঠ্য বিষয়কে দীর্ঘ সময় যেমন- সম্পূর্ণ মাস, সেমিস্টার কিংবা পূর্ণ শিক্ষাবর্ষে পাঠদান করার জন্য প্রণয়ন করা হয়।

বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয় শিখন শিক্ষণ প্রণালীকে বেশি সহজতর করে তোলার জন্য এবং নিয়মিত পাঠদানের অগ্রগতির একটু কার্যকর নথি তৈরী করার জন্য।

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান এর উদ্দেশ্য

কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট দক্ষতা বা শিখনফল অর্জনের জন্য নির্বাচিত পাঠ্যবিষয় যা পুরো শিক্ষাবর্ষে বা অর্ধ শিক্ষাবর্ষে পাঠদান করা হবে তার সঠিক শিখন শেখানো পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঠদানসহ পাঠদানের অগ্রগতি, অবনতি, সীমাবদ্ধতা, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ইত্যাদি নথিভুক্ত করার জন্য বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয়। বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনাকে বাংলাতে দীর্ঘ পাঠ পরিকল্পনা কিংবা বৃহৎ-পাঠটিকা নামেও সংজ্ঞায়িত করা হয়।

পাঠদান প্রক্রিয়াকে অথবা শিখন-শেখানো কার্যক্রমে আকর্ষণীয় ও সহজতর করে তোলার জন্য বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়। এ ধরনের পাঠ পরিকল্পনা প্রস্তুত করার ফলে পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সনাক্ত করা এবং উপকরণ যোগান করা সম্পর্কে নিখুঁত ও কার্যকর ধারণা লাভ করা যায়।

নির্বাচিত পাঠ্যবিষয় পাঠদানকালে শিক্ষার্থীদের প্রান্ত থেকে যে সকল সমস্যা হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে পূর্বেই অনেকটা অনুমান করা যায়, এর ফলে সম্ভাব্য সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তত থাকা সম্ভব হয়।

যে পাঠ্যবিষয় কিংবা বিষয়বস্তু একটি নির্দিষ্ট দীর্ঘ সময়ে পাঠদান করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেগুলোর শিখনফল (learning outcomes) অর্জনের জন্য উপযুক্ত ও অপেক্ষাকৃত উন্নত শিক্ষণ পদ্ধতি ও কৌশল আবিস্কার ও প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করারর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা।

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান এর সুবিধা

  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা বা ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান (macro lesson plan) এর মাধ্যমে যে-কোনো শ্রেণির সম্পূর্ণ শিক্ষাবর্ষের জন্য শিখন শেখানোর সঠিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা সম্ভব হয়।
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনার সাহায্যে শ্রেণিকক্ষে সংগঠিত হওয়া সকল কার্যক্রমের যাবতীয় বিবরণী লিপিবদ্ধ করা যায়।
  • পাঠদানের বৃহৎ পরিকল্পনায় শিখন শেখানোর সব ধরনের পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করা যায় বলে শিক্ষা গবেষকদের মতামত পাওয়া গেছে।
  • শিখনফল টেকসই করার জন্য পাঠদানের জন্য উৎস ও নির্দেশনা সামগ্রী সম্পর্কে বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনায় বিস্তারিত আকারে ফুটিয়ে তোলা যায়।
  • শিখন শেখানো কার্যক্রমে উদ্ভুত হতে পারে এমন সমস্যা সম্পর্কে আনুমানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
  • সমস্ত পাঠ্যবিষয় ও বিষয়বস্তুর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহারের সাধারণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
  • পদ্ধতি ও কৌশল ও শিখনফলের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা যায় বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে।

 ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান এর অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা

  • যেহেতু ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান হলো এক দীর্ঘ পরিকল্পনা এবং একসঙ্গে শ্রেণীকক্ষের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরী করা হয়ে থাকে তাই অনেক সময় এই পরিকল্পনায় শ্লথ ধীর শিক্ষার্থীরা (Slow Learner) কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে।
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়।
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা উল্লেখিত পদ্ধতি ও কৌশল অনেক সময় প্রয়োগের অনুপযোগী হয়।
  • শিক্ষকদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সক্ষম বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা। 
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কখনো কখনো ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার সাহায্য নিতে হয়।

ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা অনু পাঠটিকা বা মাইক্রো লেসন প্ল্যান

মাইক্রো লেসন প্ল্যান কী?

ইংরেজি মাইক্রো (micro) শব্দের উৎপত্তি হয় গ্রিক ভাষার শব্দ মিক্রোস (mikros) থেকে যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো- সংক্ষিপ্ত, ক্ষুদ্র বা অনু।

কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির নির্দিষ্ট পাঠ্যবিষয় থেকে কোনো নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে যতটুকু পাঠদান করা হবে ততটুকুর শিখন-শেখানোর যে কৌশলগত পরিকল্পনা করা হয় তা হলো ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা মাইক্রো লেসন প্ল্যান (micro lesson plan)। ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা ‘অনুপাঠ টিকা’ নামেও পরিচিত। ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষকই প্রণয়ন করে থাকেন।

মাইক্রো লেসন প্ল্যানের উদ্দেশ্য

ম্যাক্রো লেসন প্ল্যান বা বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা যেখানে একটি সেমিস্টার কিংবা একটি শিক্ষাবর্ষে নির্ধারিত পাঠ্যবিষয়ের সকল বিষয়বস্তু কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়, সেখানে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা মাইক্রো লেসন প্ল্যানের উদ্দেশ্য হলো নির্ধারিত পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত সুনির্দিষ্ট একটি পাঠ বা পাঠ্যাংশ একদিনের শ্রেণি কার্যক্রমে কীভাবে শেখানো হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়।

ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো দৈনিক পাঠদান প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা। উপযুক্ত পন্থা অবলম্বন করে সাধারণত দৈনিক শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদেরকে নির্ধারিত পাঠ কিংবা পাঠ্যাংশের শিখনফল অর্জনে সহায়তা করা এবং অগ্রগতি মূল্যায়ন করে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা অনু-পাঠটিকা করা হয়।

মাইক্রো লেসন প্ল্যানের সুবিধা

ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে যে সকল সুবিধা পাওয়া যায় তা হলো-

  • সমগ্র পাঠ্যবিষয় থেকে শিখন শেখানো কার্যক্রমের জন্য দৈনিক পাঠ বা পাঠ্যাংশ সহজেই নির্ধারণ করা যায়।
  • নির্ধারিত পাঠ বা পাঠ্যাংশের শিখনফল অর্জনে শিক্ষার্থীদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব।
  • শিখনফল অর্জনের অগ্রগতি মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সহজতর হয়।
  • কোনো নির্দিষ্ট পাঠ বা পাঠ্যাংশ শেখানোর জন্য ব্যবহৃত কোনো পদ্ধতি কিংবা কৌশল অনুপযোগী বলে বিবেচিত হলে তা উপযুক্ততর পদ্ধতি বা কৌশল দিয়ে তা প্রতিস্থাপন করা যায়।
  • ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার অন্যতম একটি সুবিধা হলো- এই পাঠ পরিকল্পনা দৈনিক ও পিরিয়ড ভিত্তিক হওয়ায় প্রণীত পরিকল্পনার সম্পূর্ণ অংশ বা যে-কোনো অংশ সহজেই নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়, যদি প্রয়োজন হয়।
  • শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সহযোগিতা ও ও যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা। 
  • এই ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা অনু পাঠটিকা চতুরতার সাথে (smartly) শিখন শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষকের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে।
  • প্রতিটি শিক্ষার্থী সম্পর্কে একজন শিক্ষককে গভীর ধারণা সৃষ্টিতে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা সাহায্য করতে পারে।

মাইক্রো লেসন প্ল্যানের অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা

ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার বেশ কিছু অসুবিধা সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করা হলো-

  • ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক না হয়ে বেশিরভাগ সময় দক্ষতা কেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
  • ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনায় যে সময় বন্টণ দেখানো হয়, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন বেশিরভাগ সময়েই অসম্ভব।
  • শুধু ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করে নির্ধারিত শিখনফল অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত নয়, এতে বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনারও প্রয়োজন হয়।

বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা ও ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বা অনু-পাঠটিকার মধ্যে পার্থক্য

ম্যাক্রো ও মাইক্রো লেসন প্ল্যানের কয়েকটি পার্থক্য-

  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয় একটি সম্পূর্ণ সেমিস্টার অথবা শিক্ষাবর্ষের জন্য; অপরদিকে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় দৈনিক ভিত্তিক
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা করা হয় সম্পূর্ণ পাঠ্যবিষয়ের জন্য; অপরদিকে ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা করা হয় একটি নির্দিষ্ট পাঠ বা পাঠ্যাংশের জন্য।
  • বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনায় বিষয়বস্তু ও দক্ষতা সমানভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনা বেশিরভাগ সময় দক্ষতাকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
  • ফলাবর্তনের ক্ষেত্রে বৃহৎ পাঠ পরিকল্পনা ক্ষুদ্র পাঠ পরিকল্পনার চেয়ে কম উপযোগী।

এছাড়াও বেশ কিছু পার্থক্য সনাক্ত করা যায় যখন একজন শিক্ষক এই দুই ধরনেরই পাঠ পরিকল্পনা করেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন।

পাঠ পরিকল্পনা বৃহৎ হোক অথবা ক্ষুদ্র হোক, উভয় প্রকারেরই যেমন সুনির্দিষ্ট কিছু সবিধা রয়েছে, তেমনই সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। তবে কখনোই বলা যাবে না যে, একটি থেকে আরেকটি উত্তম। কিন্তু দুই ধরনের পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করার প্রয়োজন রয়েছে।