১২:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস: গরিবের ব্যাংকার, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা এবং সামাজিক ব্যবসায়ের উদ্ভাবক

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০৭:৫২:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুন ২০২১
  • / ১৬২০ বার পড়া হয়েছে

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস: গরীবের ব্যাংকার, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা এবং সামাজিক ব্যবসায়ের উদ্ভাবক Photo: Inc.

প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস হলেন একজন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা যিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে বলা হয় ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোক্রেডিটের (microcredit) জনক বা প্রবক্তা। প্রফেসর ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার (Noble Prize) লাভ করেন। বাংলাদেশ থেকে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের দরবারে ব্যাংকার টু দ্য পোর (Banker to the Poor) হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকেন। এই নিবন্ধে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, হতে পারে এর মধ্যে কিছু আপনার কাছে এখনো অজানা।

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস

মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম

বাংলাদেশি নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অধীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারি উপজেলায় একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর গ্রামের নাম বাথুয়া। প্রফেসর ইউনূসের বাবার নাম হাজি দুলা মিয়াঁ সওদাগর এবং মায়ের নাম সুফিয়া খাতুন। তিনি ইউনূস তাঁর বাবা-মায়ের ৯ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়।

মুহাম্মদ ইউনূসের শৈশব

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের শৈশব গ্রামেই কেটেছে। তবে ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে এক বছরের মতো চট্টগ্রাম শহরে কাটান। কারণ সে সময় কোনো এক জাপানি বোমা হালমায় তাঁদের গ্রামের একটি বিল্ডিং ধ্বংস হয়। এই ভয়ে তাঁর বাবা তাঁদেরকে নিজের কাছে নিয়ে যান। ইউনূসের বাবা চট্টগ্রাম শহরে একটি জুয়েলারি দোকান চালাতেন।

১৯৪৫ সালে গ্রামে ফেরার পর বেশিরভাগ সময় মায়ের সাথেই কাটাতে হয়। বাবা সপ্তাহে ১ বার আসতেন চট্টগ্রাম শহর থেকে। গ্রামের অন্য সকল ছেলেমেয়ের মতোই দুরন্ত শৈশব কাটিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

শিক্ষা জীবনে ইউনূস

মুহাম্মদ ইউনূসের শৈশব বাথুয়া গ্রামেই কাটে এবং সেখানেই তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু। ১৯৪৪ সালে ইউনূস তাঁর পরিবারের সাথে গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম শহরে স্থানান্তরিত হন এবং সেখানে লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম থেকেই সম্পন্ন করেন কারণ ১৯৪৫ সালেই তাঁর পরিবার গ্রামে ফিরেছিল। তিনি যে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন সে বিদ্যালয়ের নাম ছিল মহাজন ফকিরের স্কুল।

তিনি বয় স্কাউটের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, সে সময় ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত এবং ১৯৫৫ সালে কানাডা ভ্রমণ করেছিলেন জাম্বোরিতে অংশগ্রহণের জন্য।

মুহাম্মদ ইউনূস চিটাগিং কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় তিনি ৩৯ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন।

ম্যাট্রিকুলেশন শেষে তিনি চিটাগং কলেজে ভর্তি হন, এই সময় তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও জড়িয়ে যান। পরবর্তিতে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে যথাক্রমে ১৯৬০ সালে বিএ এবং ১৯৬১ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবনে মুহাম্মদ ইউনূস

মুহাম্মদ ইউনূস কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে পুরনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ব্যুরো অব ইকোনোমিক রিসার্চ’-এর গবেষণা সহকারী হিসেবে। সেখানে তিনি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল আমিন এবং অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপরে তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

মুহাম্মদ ইউনূস যখন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করছিলেন তখন তিনি সেখানের মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক পদে থেকে শিক্ষকতা করেছিলেন।

স্বাধীনতার পরে ড. ইউনূস সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে যোগদান করেন, এই কমিশনের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক নুরুল আমিন। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের যে দায়িত্বে তিনি ছিলেন তাতে তাঁর মন বসেনি। পরিকল্পনা কমিশন থেকে পদত্যাগ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। শুরুতেই তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের শুরু থেকে ২০১১ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।

বর্তমানে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ায় অবস্থিত আলবুখারি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটর চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মুহাম্মদ ইউনূসের পিএইচডি অর্জন

চট্টগ্রাম কলেজে মুহাম্মদ ইউনূস যখন শিক্ষকতা করতেন তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট স্কলারশিপের জন্য মনোনিত হন। এটি ছিল ১৯৬৫ সালের ঘটনা। ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন।

মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম উদ্যোগ

মুহাম্মদ ইউনূস যখন চট্টগ্রাম কলেজের প্রভাষক ছিলেন, তখনই তিনি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে প্রকাশ করেন। সে সময় তিনি একটি প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি গড়ে তোলেন। প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিটি থেকে তিনি ভালোই আয় করেন। এই প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিই ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম কোনো উদ্যোগ।

মুক্তিযুদ্ধে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তখন তিনি সেখানের কিছু স্বদেশিকে নিয়ে একটি নাগরিক পরিষদ বা citizen committee গঠন করেন এবং বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র (Bnagldesh Information Center) পরিচালনা করেন। এই নাগরিক পরিষদ এবং বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করা। এছাড়া তিনি সেখানে বাংলাদেশ নিউজলেটার নামে পত্রিকাও প্রকাশ করেন।

দারিদ্র্য বিমোচনে মানুষের পাশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ এবং দ্য প্র্যাকডিক্যাল প্রফেসর

স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালে যখন বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে তখন দেশের মানুষের অবস্থা খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের পথে খেয়াল করলেন এবং দেখলেন প্রচুর চাষযোগ্য জমি খালি পড়ে রয়েছে। আর ওই জমিগুলোর মালিকেরা অনাহার ও অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। এই ব্যাপারটি তাকে ভাবালো। ড. ইউনূস তাঁর শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন দুর্বল সেচ ব্যবস্থার কারণে ওই সমস্যা হয়েছিল। মুহাম্মদ ইউনূস এই সমস্যাকেই সমাধানযোগ্য বলে মনে করলেন।

ড. ইউনূস এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা, বই-পুস্তক, দুর্ভোগে পড়া মানুষের সাথে যোগাযোগ এবং শ্রেণিকক্ষের মধ্যে একটি সমন্বয় ঘটাতে চাইলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (Rural Development Project) এবং এই প্রজেক্টে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ ও স্থানীয় গরিব মানুষদের সাহায্য করার মধ্য দিয়ে অ্যাকাডেমিক ক্রেডিট অর্জন করেছিল। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে সেচ সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি এবং কৃষকদের নানান দক্ষতা নিয়ে কাজ করেছিল। সাফল্য পাওয়া এই প্রজেক্টটি তাকে প্র্যাকটিক্যাল প্রফেসর হিসেবে পরিচিতি প্রদান করে।

এছাড়া তিনি নিজের অর্থায়নে তখন কৃষি সমবায় নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন।

মাইক্রোক্রেডিট ধারণার জনক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট সফল হলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুভব করলেন যে, তিনি যা করলেন তা যথেষ্ট নয়। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের গ্রামগুলোতে অনেক ভূমিহীন মানুষের দেখা পাওয়া গেলে যারা ছোটোছোটো জিনিসপত্র হাতে বানিয়ে তা বিক্রি করতেন নিকটস্থ বাজারে, শহরে বা পাইকারদের কাছে। এই মানুষগুলো যা কিছু বানাতেন সেসবের উপাদান কেনার জন্য পুঁজি জোগানোর জন্য তাঁরা সুদের টাকার ওপর নির্ভর করতেন।

মুহাম্মদ ইউনূস ও অ্যালান জলিসের লেখা ‘ব্যাংকার টু দ্য পোর: মাইক্রো লেন্ডিং অ্যন্ড দ্য ব্যাটল অ্যাগেইন্সট ওয়ার্ল্ড প্রোভার্টি’ বই দেখা যায়, সে সময় সুদের হার ছিল সপ্তাহ বা দৈনিক ভিত্তিতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। তখন চট্টগ্রামের জোবরা নামক গ্রামে যারা এই চড়া হারে সুদের কারবারিদের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন, তিনি নিজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করেন। ড. ইউনূস বিনাসুদে তাদেরকে ঋণ দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

এই অ্যাড-হক সমাধান বড়ো পরিসরে খুব একটা কাজে আসেনি। তাই তিনি স্থানীয় জনতা ব্যাংকের শাখায় গিয়ে শাখার ব্যবস্থাপককে এই দরিদ্র মানুষদের অল্প পরিমাণে অল্পহারে ঋন দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। ব্যাংক ব্যবস্থাপক অপারগ ছিলেন এবং জানালেন এখানের লোকজন অশিক্ষিত হবার কারণে তাঁরা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ফরম পূরণ করতে পারবেন না এবং ঋণের টাকা যে ফেরত দিবেন তেমনও নিশ্চয়তা ছিল না, এটাকে সত্যই বলা যায়। এই ঘটনাটি ১৯৭৬ সালের। তিনি ব্যাংকের সাথে নিজের কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ড. ইউনূস ব্যাংককে বলেন, দরিদ্র লোকগুলো যদি টাকা না দেয় তাহলে ঐ টাকা তিনি নিজে পরিশোধ করবেন। ব্যাংক রাজী হলো। তবে শর্ত হলো, আনুষঙ্গিক কাগজপত্র ড. ইউনূস পূরণ করবেন এবং এই ঋণের জন্য তিনিই দায়বদ্ধ থাকবেন।

ড. ইউনূসের বিশ্বাস ছিল যে, দরিদ্র মানুষেরা নিশ্চয়ই ওই আনসিকিউরড ঋণ পরিশোধ করবে। কারণ ওটাই ছিল তাঁদের একমাত্র সুযোগ, যা হারালে তাঁদের আর কোনো উপায় থাকবে না।

তিনি ব্যাংক থেকে নিজের দায়িত্বে ঋণ করে মানুষদের অল্প অল্প করে সেগুলো পুনরায় ঋণ দিতেন, এখানে জামানত ছিল বিশ্বাস এবং লক্ষ্য ছিল দারিদ্য দূরীকরণ। এভাবেই ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোক্রেডিট (microcredit) ধারণার কথা সামনে নিয়ে আসেন। মাইক্রোক্রেডিট আবার গ্রামীণক্রেডিট (grameen-credit) নামেও পরিচিত।

গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন যেভাব

জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এবং দেওয়ার পর এটাকে একটি স্থায়ী রুপ দিতে চাইলেন। ২০১২ সালের বিবিসি বাংলার একটি রিপোর্টে জানা যায় ড. ইউনূস নবযুগ তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করলেন। তবে এটি প্রথমে ছিল তেভাগা ক্লাব। সেখানে একটি সমিতির মতো সৃষ্টি করলেন। ওই সমিতি থেকে দরিদ্র লোকজনকে ধরে ধরে এনে অর্থ দেওয়া হতো আর বলা হতো তা নির্ধারিত সময়ে ফেরত দেওয়ার জন্য। এতে যেমন অনেকেই লাভবান হয়েছিল তেমনই লাভের মুখ না দেখতে পাওয়াদের সংখ্যাও কম নয়।

নবযুগ তেভাগা খামারের প্রথম ঋণ গ্রহীতা যাকে বলা হয় তিনিও খুব একটা সফল ছিলেন না। এটি বিবিসির রিপোর্টে উঠে আসে। তবে নবযুগ তেভাগা খামার এগিয়ে চলে খুবই দ্রুত, জনপ্রিয়তাও পায় বেশ। এমনই এক সময়ে সরকারের চোখে পড়লো এই উদ্যোগ। ১৯৭৯ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে একটি প্রকল্প হিসেবে নেয়। এই প্রকল্পটি চলে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে তৎকালীন প্রত্যেকটি ব্যাংকই এই প্রকল্পে এগিয়ে আসে। পরবর্তিতে ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩ তারিখ গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে একে ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। গ্রামীন ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২ অক্টোবর, ১৯৮৩।

২০১৩ সালে গ্রামীন ব্যাংক আইন, ২০১৩ পাশ করার মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশ বাতিল করে গ্রামীন ব্যাংককে নতুন রুপ বা কাঠামোতে সাজানো হয়। গ্রামীণ ব্যাংক এখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।

২০০৬ সালে গ্রামীন ব্যাংক নোবেল শান্তি পুরষ্কার লাভ করেন। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছে।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তবে ২০১১ সালে আদালতের রায়ে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

গ্রামীণ ফাউন্ডেশন

যুক্তরাষ্ট্রে অ্যালেক্স কাউন্টস নামের এক ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাংক মাইক্রোক্রেডিট মডেলকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার জন্য এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্রামীণ ফাউন্ডেশন ইউএসএ’। এটি বর্তমানে শুধু ‘গ্রামীণ ফাইন্ডেশন’ নামেই পরিচিত। এই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

নোবেল বিজয়

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ২০০৬ সালে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যৌথভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে ‘নোবেল শান্তি পুরষ্কার’ লাভ করেন। তিনিই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশ থেকে নোবেল বিজয়ী হন। নোবেল প্রাপ্তিতে গ্রামীণ ব্যাংকও বাংলাদেশি একমাত্র প্রতিষ্ঠান।

ইউনূস সেন্টার প্রতিষ্ঠা

ইউনূস সেন্টার হলো প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত একটি গবেষণা, পরামর্শ ও সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি সকল সামাজিক ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কিত সকল কার্যক্রমের ওয়ান-স্টপ রিসোর্স সেন্টার। সামাজিক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত অথবা সামাজিক ব্যবসায়ে আসতে চায়, এমন যে কেউ ইউনূস সেন্টার থেকে সহযোগিতা নিতে পারে।

২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং প্রফেসর ইউনূস নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেলে সে বছরই তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে নিজের জন্য ‘ইউনূস সেক্রেটারিয়েট’ নামে একটি অফিস খোলেন। পরিবর্তিতে এর নাম পরিবর্তন করে ‘ইউনূস সেন্টার’ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক ব্যবসায় বা সোশ্যাল বিজনেস ধারণার জন্ম দিয়েছে সে ধারণা এবং দারিদ্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ড. ইউনূসের মতাদর্শের প্রচারণাও করে।

গ্রামীণ টেলিকম

১৯৯৭ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম (Grameen Telecom) প্রতিষ্ঠা করেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বল্পমূল্যে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। গ্রামীণ টেলিকমের সেবা নিতে হলে প্রথমে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য হতে হতো। গ্রামীণ টেলিকম শুরু থেকেই একটি অলাভজনক সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান। কিছুদিনের মাথায় নরয়ের টেলিনর (Telenor Mobile Communications) এর গ্রামীণ টেলিকম বাংলাদেশে গ্রামীণফোনে (Grameenphone) প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামীণফোনে গ্রামীণ টেলিকমের শেয়ারের পরিমাণ ৩৪.২০ শতাংশ এবং ৫৫.৮০ শতাংশ টেলিনরের এবং ১০ শতাংশ পাবলিক শেয়ার।

গ্রামীণ ইউনিক্লো

জাপানের বিখ্যাত পোশাক ডিজাইনার, উৎপাদক এবং খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইউনিক্লো (UNIQLO) ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে ‘গ্রামীণ ইউনিক্লো’ নামে সামাজিক ব্যবসায় চালু করে। ইউনূস সেন্টারের হস্তক্ষেপে ইউনিক্লোর সাথে যুক্ত হয়ে গ্রামীণ ইউনিক্লো প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য দারিদ্র্য দূরীকরণ।

ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস (Yunus Social Business)

সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সমাজ উন্নয়নের জন্য প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’। সামাজিক ব্যবসায় হলো এমন একটি ব্যব্যসায়িক ধারণা যার মাধ্যমে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ থেকে শুরু করে সমাজের নানামুখী সমস্যার সমাধান করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যাবসায় ধারণার প্রবর্তক বা উদ্ভাবক।

বর্তমান প্রফেসর ইউনূস এই ইউনূস সোশ্যাল বিজনেসের চেয়ারম্যান। ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’র মিশন হলো ইউনূস সেন্টার যে সামাজিক ব্যবসায় বা সোশ্যাল বিজনেসের ধারণার জন্ম দিয়েছে তা বিশ্বজুড়ে বাস্তবায়ন করা।

ড. ইউনূস এই সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণ প্রথম উপস্থাপন করেন ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম (World Economic Forum)-এ ২০০৮ সালে। পরবর্তিতে ২০১১ সালে তিনি তাঁর সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণাকে ভিত্তি ধরে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। আলবানিয়া, কলোম্বিয়া, কোস্টারিকা, ব্রাজিল, হাইতি, ভারত, তিউনিসিয়া ও উগান্ডাতে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’ কাজ করে যাচ্ছে।

ইউনূস ফান্ডস (Yunus Social Budiness Funds)

ইউনূস ফান্ডস-এর মাধ্যমে ব এর আওতায় মুহাম্মদ ইউনূসের ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’ এর একটি অংশ পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে পূর্ব আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ভারতের ৯০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসুরক্ষা, নিরাপদ পানি ও শক্তি পাচ্ছে। এটি একটি চ্যারিটি প্রকল্প।

ইউনূস করপোরেট ইনোভেশন (Yunus Corporate Innovation)

‘ইউনূস করপোরেট ইনোভেশন’ সাধারণত বড়ো বড়ো কোম্পানি বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ইউনূস সেন্টার উদ্ভাবিত বিভিন্ন পদ্ধতি ও দক্ষতাসমূহ প্রয়োগ করার নির্দেশনা প্রদান করে, যার মাধ্যমে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। ইউনূস সোশ্যাল বিজিনেস’এর চ্যারিট্যাবল এন্টিটি থেকে এটি আলাদা। তবে এখান থেকে যা আয় হয় তা পুনরায় সোশ্যাল বিজনেসে বিনিয়োগ করা হয়।

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস: গরিবের ব্যাংকার, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা এবং সামাজিক ব্যবসায়ের উদ্ভাবক
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস: গরিবের ব্যাংকার, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা এবং সামাজিক ব্যবসায়ের উদ্ভাবক | Photo: Inc.

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বই

  • ব্যাংকার টু দ্য পোর: মাইক্রো লেন্ডিং অ্যন্ড দ্য ব্যাটল অ্যাগেইন্সট ওয়ার্ল্ড প্রোভার্টি (১৯৯১); সহলেখক: অ্যালান জলিস
  • ক্রিয়েটিং আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট পোভার্টি: সোশ্যাল বিজনেস অ্যান্ড ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম (১৯৯৯); সহলেখক: কার্ল ওয়েবার
  • বিল্ডিং সোশ্যাল বিজনেস: দ্য নিউ কাইন্ড অব ক্যাপিটালিজম দ্যাট সার্ভস হিউম্যানিটিস মোস্ট প্রেসিং নিডস (১৯৯৭)
  • আ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস: দ্য নিউ একোনোমিক অব জিরো পোভার্টি, জিরো আনএমপ্লয়েমেন্ট, অ্যান্ড জিরো নেট কার্বন এমিশন (২০১৭)
  • পথের বাধা সরিয়ে নিন, মানুষকে এগুতে দিন (১৯৯৪)
  • এসেনশিয়াল ম্যাসেজ অব ইসলাম (২০১০); সহলেখক: আশফাক সাইদ

পুরষ্কার ও সম্মাননা

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রচুর পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। এসবের মধ্যে যে গুলো উল্লেখ না করলেই নয়, সেগুলো হলো- স্বাধীনতা পুরষ্কার (১৯৮৭), নোবেল শান্তি পুরষ্কার (২০০৬), সিওল শান্তি পুরষ্কার (২০০৬), বিশ্ব খাদ্য পুরষ্কার (১৯৯৪), সিডনি শান্তি পুরষ্কার (১৯৯৮), যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯) ও কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল (২০১০), প্রিন্স অব অস্ট্রিয়াস অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৮), র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরষ্কার (১৯৮৪), রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার (১৯৭৮) ইত্যাদি। বিশ্বের ইতিহাসে সেরা সাত পুরষ্কারপ্রাপ্তদের তিনি একজন। ফোর্বসের ‘টেন মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল বিজনেস গুরুস’ তালিকায় মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন।

প্রফেসর  ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে এখানে যা কিছু তুলে ধরা হয়েছে তা তাঁর সম্পর্কে অসম্পূর্ণ তবে সত্য। প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে আরও জানতে আপনাকে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হবে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস: গরিবের ব্যাংকার, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা এবং সামাজিক ব্যবসায়ের উদ্ভাবক

প্রকাশ: ০৭:৫২:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুন ২০২১

প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস হলেন একজন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা যিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে বলা হয় ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোক্রেডিটের (microcredit) জনক বা প্রবক্তা। প্রফেসর ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার (Noble Prize) লাভ করেন। বাংলাদেশ থেকে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের দরবারে ব্যাংকার টু দ্য পোর (Banker to the Poor) হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকেন। এই নিবন্ধে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, হতে পারে এর মধ্যে কিছু আপনার কাছে এখনো অজানা।

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস

মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম

বাংলাদেশি নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অধীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারি উপজেলায় একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর গ্রামের নাম বাথুয়া। প্রফেসর ইউনূসের বাবার নাম হাজি দুলা মিয়াঁ সওদাগর এবং মায়ের নাম সুফিয়া খাতুন। তিনি ইউনূস তাঁর বাবা-মায়ের ৯ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়।

মুহাম্মদ ইউনূসের শৈশব

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের শৈশব গ্রামেই কেটেছে। তবে ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে এক বছরের মতো চট্টগ্রাম শহরে কাটান। কারণ সে সময় কোনো এক জাপানি বোমা হালমায় তাঁদের গ্রামের একটি বিল্ডিং ধ্বংস হয়। এই ভয়ে তাঁর বাবা তাঁদেরকে নিজের কাছে নিয়ে যান। ইউনূসের বাবা চট্টগ্রাম শহরে একটি জুয়েলারি দোকান চালাতেন।

১৯৪৫ সালে গ্রামে ফেরার পর বেশিরভাগ সময় মায়ের সাথেই কাটাতে হয়। বাবা সপ্তাহে ১ বার আসতেন চট্টগ্রাম শহর থেকে। গ্রামের অন্য সকল ছেলেমেয়ের মতোই দুরন্ত শৈশব কাটিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

শিক্ষা জীবনে ইউনূস

মুহাম্মদ ইউনূসের শৈশব বাথুয়া গ্রামেই কাটে এবং সেখানেই তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু। ১৯৪৪ সালে ইউনূস তাঁর পরিবারের সাথে গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম শহরে স্থানান্তরিত হন এবং সেখানে লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম থেকেই সম্পন্ন করেন কারণ ১৯৪৫ সালেই তাঁর পরিবার গ্রামে ফিরেছিল। তিনি যে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন সে বিদ্যালয়ের নাম ছিল মহাজন ফকিরের স্কুল।

তিনি বয় স্কাউটের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, সে সময় ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত এবং ১৯৫৫ সালে কানাডা ভ্রমণ করেছিলেন জাম্বোরিতে অংশগ্রহণের জন্য।

মুহাম্মদ ইউনূস চিটাগিং কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় তিনি ৩৯ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন।

ম্যাট্রিকুলেশন শেষে তিনি চিটাগং কলেজে ভর্তি হন, এই সময় তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও জড়িয়ে যান। পরবর্তিতে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে যথাক্রমে ১৯৬০ সালে বিএ এবং ১৯৬১ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবনে মুহাম্মদ ইউনূস

মুহাম্মদ ইউনূস কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে পুরনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ব্যুরো অব ইকোনোমিক রিসার্চ’-এর গবেষণা সহকারী হিসেবে। সেখানে তিনি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল আমিন এবং অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপরে তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

মুহাম্মদ ইউনূস যখন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করছিলেন তখন তিনি সেখানের মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক পদে থেকে শিক্ষকতা করেছিলেন।

স্বাধীনতার পরে ড. ইউনূস সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে যোগদান করেন, এই কমিশনের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক নুরুল আমিন। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের যে দায়িত্বে তিনি ছিলেন তাতে তাঁর মন বসেনি। পরিকল্পনা কমিশন থেকে পদত্যাগ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। শুরুতেই তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের শুরু থেকে ২০১১ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।

বর্তমানে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ায় অবস্থিত আলবুখারি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটর চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মুহাম্মদ ইউনূসের পিএইচডি অর্জন

চট্টগ্রাম কলেজে মুহাম্মদ ইউনূস যখন শিক্ষকতা করতেন তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট স্কলারশিপের জন্য মনোনিত হন। এটি ছিল ১৯৬৫ সালের ঘটনা। ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন।

মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম উদ্যোগ

মুহাম্মদ ইউনূস যখন চট্টগ্রাম কলেজের প্রভাষক ছিলেন, তখনই তিনি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে প্রকাশ করেন। সে সময় তিনি একটি প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি গড়ে তোলেন। প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিটি থেকে তিনি ভালোই আয় করেন। এই প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিই ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম কোনো উদ্যোগ।

মুক্তিযুদ্ধে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তখন তিনি সেখানের কিছু স্বদেশিকে নিয়ে একটি নাগরিক পরিষদ বা citizen committee গঠন করেন এবং বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র (Bnagldesh Information Center) পরিচালনা করেন। এই নাগরিক পরিষদ এবং বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করা। এছাড়া তিনি সেখানে বাংলাদেশ নিউজলেটার নামে পত্রিকাও প্রকাশ করেন।

দারিদ্র্য বিমোচনে মানুষের পাশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ এবং দ্য প্র্যাকডিক্যাল প্রফেসর

স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালে যখন বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে তখন দেশের মানুষের অবস্থা খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের পথে খেয়াল করলেন এবং দেখলেন প্রচুর চাষযোগ্য জমি খালি পড়ে রয়েছে। আর ওই জমিগুলোর মালিকেরা অনাহার ও অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। এই ব্যাপারটি তাকে ভাবালো। ড. ইউনূস তাঁর শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন দুর্বল সেচ ব্যবস্থার কারণে ওই সমস্যা হয়েছিল। মুহাম্মদ ইউনূস এই সমস্যাকেই সমাধানযোগ্য বলে মনে করলেন।

ড. ইউনূস এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা, বই-পুস্তক, দুর্ভোগে পড়া মানুষের সাথে যোগাযোগ এবং শ্রেণিকক্ষের মধ্যে একটি সমন্বয় ঘটাতে চাইলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (Rural Development Project) এবং এই প্রজেক্টে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ ও স্থানীয় গরিব মানুষদের সাহায্য করার মধ্য দিয়ে অ্যাকাডেমিক ক্রেডিট অর্জন করেছিল। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে সেচ সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি এবং কৃষকদের নানান দক্ষতা নিয়ে কাজ করেছিল। সাফল্য পাওয়া এই প্রজেক্টটি তাকে প্র্যাকটিক্যাল প্রফেসর হিসেবে পরিচিতি প্রদান করে।

এছাড়া তিনি নিজের অর্থায়নে তখন কৃষি সমবায় নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন।

মাইক্রোক্রেডিট ধারণার জনক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট সফল হলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুভব করলেন যে, তিনি যা করলেন তা যথেষ্ট নয়। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের গ্রামগুলোতে অনেক ভূমিহীন মানুষের দেখা পাওয়া গেলে যারা ছোটোছোটো জিনিসপত্র হাতে বানিয়ে তা বিক্রি করতেন নিকটস্থ বাজারে, শহরে বা পাইকারদের কাছে। এই মানুষগুলো যা কিছু বানাতেন সেসবের উপাদান কেনার জন্য পুঁজি জোগানোর জন্য তাঁরা সুদের টাকার ওপর নির্ভর করতেন।

মুহাম্মদ ইউনূস ও অ্যালান জলিসের লেখা ‘ব্যাংকার টু দ্য পোর: মাইক্রো লেন্ডিং অ্যন্ড দ্য ব্যাটল অ্যাগেইন্সট ওয়ার্ল্ড প্রোভার্টি’ বই দেখা যায়, সে সময় সুদের হার ছিল সপ্তাহ বা দৈনিক ভিত্তিতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। তখন চট্টগ্রামের জোবরা নামক গ্রামে যারা এই চড়া হারে সুদের কারবারিদের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন, তিনি নিজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করেন। ড. ইউনূস বিনাসুদে তাদেরকে ঋণ দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

এই অ্যাড-হক সমাধান বড়ো পরিসরে খুব একটা কাজে আসেনি। তাই তিনি স্থানীয় জনতা ব্যাংকের শাখায় গিয়ে শাখার ব্যবস্থাপককে এই দরিদ্র মানুষদের অল্প পরিমাণে অল্পহারে ঋন দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। ব্যাংক ব্যবস্থাপক অপারগ ছিলেন এবং জানালেন এখানের লোকজন অশিক্ষিত হবার কারণে তাঁরা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ফরম পূরণ করতে পারবেন না এবং ঋণের টাকা যে ফেরত দিবেন তেমনও নিশ্চয়তা ছিল না, এটাকে সত্যই বলা যায়। এই ঘটনাটি ১৯৭৬ সালের। তিনি ব্যাংকের সাথে নিজের কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ড. ইউনূস ব্যাংককে বলেন, দরিদ্র লোকগুলো যদি টাকা না দেয় তাহলে ঐ টাকা তিনি নিজে পরিশোধ করবেন। ব্যাংক রাজী হলো। তবে শর্ত হলো, আনুষঙ্গিক কাগজপত্র ড. ইউনূস পূরণ করবেন এবং এই ঋণের জন্য তিনিই দায়বদ্ধ থাকবেন।

ড. ইউনূসের বিশ্বাস ছিল যে, দরিদ্র মানুষেরা নিশ্চয়ই ওই আনসিকিউরড ঋণ পরিশোধ করবে। কারণ ওটাই ছিল তাঁদের একমাত্র সুযোগ, যা হারালে তাঁদের আর কোনো উপায় থাকবে না।

তিনি ব্যাংক থেকে নিজের দায়িত্বে ঋণ করে মানুষদের অল্প অল্প করে সেগুলো পুনরায় ঋণ দিতেন, এখানে জামানত ছিল বিশ্বাস এবং লক্ষ্য ছিল দারিদ্য দূরীকরণ। এভাবেই ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোক্রেডিট (microcredit) ধারণার কথা সামনে নিয়ে আসেন। মাইক্রোক্রেডিট আবার গ্রামীণক্রেডিট (grameen-credit) নামেও পরিচিত।

গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন যেভাব

জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এবং দেওয়ার পর এটাকে একটি স্থায়ী রুপ দিতে চাইলেন। ২০১২ সালের বিবিসি বাংলার একটি রিপোর্টে জানা যায় ড. ইউনূস নবযুগ তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করলেন। তবে এটি প্রথমে ছিল তেভাগা ক্লাব। সেখানে একটি সমিতির মতো সৃষ্টি করলেন। ওই সমিতি থেকে দরিদ্র লোকজনকে ধরে ধরে এনে অর্থ দেওয়া হতো আর বলা হতো তা নির্ধারিত সময়ে ফেরত দেওয়ার জন্য। এতে যেমন অনেকেই লাভবান হয়েছিল তেমনই লাভের মুখ না দেখতে পাওয়াদের সংখ্যাও কম নয়।

নবযুগ তেভাগা খামারের প্রথম ঋণ গ্রহীতা যাকে বলা হয় তিনিও খুব একটা সফল ছিলেন না। এটি বিবিসির রিপোর্টে উঠে আসে। তবে নবযুগ তেভাগা খামার এগিয়ে চলে খুবই দ্রুত, জনপ্রিয়তাও পায় বেশ। এমনই এক সময়ে সরকারের চোখে পড়লো এই উদ্যোগ। ১৯৭৯ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে একটি প্রকল্প হিসেবে নেয়। এই প্রকল্পটি চলে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে তৎকালীন প্রত্যেকটি ব্যাংকই এই প্রকল্পে এগিয়ে আসে। পরবর্তিতে ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩ তারিখ গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে একে ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। গ্রামীন ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২ অক্টোবর, ১৯৮৩।

২০১৩ সালে গ্রামীন ব্যাংক আইন, ২০১৩ পাশ করার মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশ বাতিল করে গ্রামীন ব্যাংককে নতুন রুপ বা কাঠামোতে সাজানো হয়। গ্রামীণ ব্যাংক এখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।

২০০৬ সালে গ্রামীন ব্যাংক নোবেল শান্তি পুরষ্কার লাভ করেন। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছে।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তবে ২০১১ সালে আদালতের রায়ে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

গ্রামীণ ফাউন্ডেশন

যুক্তরাষ্ট্রে অ্যালেক্স কাউন্টস নামের এক ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাংক মাইক্রোক্রেডিট মডেলকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার জন্য এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্রামীণ ফাউন্ডেশন ইউএসএ’। এটি বর্তমানে শুধু ‘গ্রামীণ ফাইন্ডেশন’ নামেই পরিচিত। এই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

নোবেল বিজয়

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ২০০৬ সালে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যৌথভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে ‘নোবেল শান্তি পুরষ্কার’ লাভ করেন। তিনিই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশ থেকে নোবেল বিজয়ী হন। নোবেল প্রাপ্তিতে গ্রামীণ ব্যাংকও বাংলাদেশি একমাত্র প্রতিষ্ঠান।

ইউনূস সেন্টার প্রতিষ্ঠা

ইউনূস সেন্টার হলো প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত একটি গবেষণা, পরামর্শ ও সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি সকল সামাজিক ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কিত সকল কার্যক্রমের ওয়ান-স্টপ রিসোর্স সেন্টার। সামাজিক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত অথবা সামাজিক ব্যবসায়ে আসতে চায়, এমন যে কেউ ইউনূস সেন্টার থেকে সহযোগিতা নিতে পারে।

২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং প্রফেসর ইউনূস নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেলে সে বছরই তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে নিজের জন্য ‘ইউনূস সেক্রেটারিয়েট’ নামে একটি অফিস খোলেন। পরিবর্তিতে এর নাম পরিবর্তন করে ‘ইউনূস সেন্টার’ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক ব্যবসায় বা সোশ্যাল বিজনেস ধারণার জন্ম দিয়েছে সে ধারণা এবং দারিদ্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ড. ইউনূসের মতাদর্শের প্রচারণাও করে।

গ্রামীণ টেলিকম

১৯৯৭ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম (Grameen Telecom) প্রতিষ্ঠা করেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বল্পমূল্যে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। গ্রামীণ টেলিকমের সেবা নিতে হলে প্রথমে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য হতে হতো। গ্রামীণ টেলিকম শুরু থেকেই একটি অলাভজনক সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান। কিছুদিনের মাথায় নরয়ের টেলিনর (Telenor Mobile Communications) এর গ্রামীণ টেলিকম বাংলাদেশে গ্রামীণফোনে (Grameenphone) প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামীণফোনে গ্রামীণ টেলিকমের শেয়ারের পরিমাণ ৩৪.২০ শতাংশ এবং ৫৫.৮০ শতাংশ টেলিনরের এবং ১০ শতাংশ পাবলিক শেয়ার।

গ্রামীণ ইউনিক্লো

জাপানের বিখ্যাত পোশাক ডিজাইনার, উৎপাদক এবং খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইউনিক্লো (UNIQLO) ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে ‘গ্রামীণ ইউনিক্লো’ নামে সামাজিক ব্যবসায় চালু করে। ইউনূস সেন্টারের হস্তক্ষেপে ইউনিক্লোর সাথে যুক্ত হয়ে গ্রামীণ ইউনিক্লো প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য দারিদ্র্য দূরীকরণ।

ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস (Yunus Social Business)

সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সমাজ উন্নয়নের জন্য প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’। সামাজিক ব্যবসায় হলো এমন একটি ব্যব্যসায়িক ধারণা যার মাধ্যমে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ থেকে শুরু করে সমাজের নানামুখী সমস্যার সমাধান করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যাবসায় ধারণার প্রবর্তক বা উদ্ভাবক।

বর্তমান প্রফেসর ইউনূস এই ইউনূস সোশ্যাল বিজনেসের চেয়ারম্যান। ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’র মিশন হলো ইউনূস সেন্টার যে সামাজিক ব্যবসায় বা সোশ্যাল বিজনেসের ধারণার জন্ম দিয়েছে তা বিশ্বজুড়ে বাস্তবায়ন করা।

ড. ইউনূস এই সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণ প্রথম উপস্থাপন করেন ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম (World Economic Forum)-এ ২০০৮ সালে। পরবর্তিতে ২০১১ সালে তিনি তাঁর সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণাকে ভিত্তি ধরে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। আলবানিয়া, কলোম্বিয়া, কোস্টারিকা, ব্রাজিল, হাইতি, ভারত, তিউনিসিয়া ও উগান্ডাতে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’ কাজ করে যাচ্ছে।

ইউনূস ফান্ডস (Yunus Social Budiness Funds)

ইউনূস ফান্ডস-এর মাধ্যমে ব এর আওতায় মুহাম্মদ ইউনূসের ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস’ এর একটি অংশ পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে পূর্ব আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ভারতের ৯০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসুরক্ষা, নিরাপদ পানি ও শক্তি পাচ্ছে। এটি একটি চ্যারিটি প্রকল্প।

ইউনূস করপোরেট ইনোভেশন (Yunus Corporate Innovation)

‘ইউনূস করপোরেট ইনোভেশন’ সাধারণত বড়ো বড়ো কোম্পানি বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ইউনূস সেন্টার উদ্ভাবিত বিভিন্ন পদ্ধতি ও দক্ষতাসমূহ প্রয়োগ করার নির্দেশনা প্রদান করে, যার মাধ্যমে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। ইউনূস সোশ্যাল বিজিনেস’এর চ্যারিট্যাবল এন্টিটি থেকে এটি আলাদা। তবে এখান থেকে যা আয় হয় তা পুনরায় সোশ্যাল বিজনেসে বিনিয়োগ করা হয়।

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস: গরিবের ব্যাংকার, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা এবং সামাজিক ব্যবসায়ের উদ্ভাবক
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস: গরিবের ব্যাংকার, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা এবং সামাজিক ব্যবসায়ের উদ্ভাবক | Photo: Inc.

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বই

  • ব্যাংকার টু দ্য পোর: মাইক্রো লেন্ডিং অ্যন্ড দ্য ব্যাটল অ্যাগেইন্সট ওয়ার্ল্ড প্রোভার্টি (১৯৯১); সহলেখক: অ্যালান জলিস
  • ক্রিয়েটিং আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট পোভার্টি: সোশ্যাল বিজনেস অ্যান্ড ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম (১৯৯৯); সহলেখক: কার্ল ওয়েবার
  • বিল্ডিং সোশ্যাল বিজনেস: দ্য নিউ কাইন্ড অব ক্যাপিটালিজম দ্যাট সার্ভস হিউম্যানিটিস মোস্ট প্রেসিং নিডস (১৯৯৭)
  • আ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস: দ্য নিউ একোনোমিক অব জিরো পোভার্টি, জিরো আনএমপ্লয়েমেন্ট, অ্যান্ড জিরো নেট কার্বন এমিশন (২০১৭)
  • পথের বাধা সরিয়ে নিন, মানুষকে এগুতে দিন (১৯৯৪)
  • এসেনশিয়াল ম্যাসেজ অব ইসলাম (২০১০); সহলেখক: আশফাক সাইদ

পুরষ্কার ও সম্মাননা

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রচুর পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। এসবের মধ্যে যে গুলো উল্লেখ না করলেই নয়, সেগুলো হলো- স্বাধীনতা পুরষ্কার (১৯৮৭), নোবেল শান্তি পুরষ্কার (২০০৬), সিওল শান্তি পুরষ্কার (২০০৬), বিশ্ব খাদ্য পুরষ্কার (১৯৯৪), সিডনি শান্তি পুরষ্কার (১৯৯৮), যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯) ও কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল (২০১০), প্রিন্স অব অস্ট্রিয়াস অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৮), র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরষ্কার (১৯৮৪), রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার (১৯৭৮) ইত্যাদি। বিশ্বের ইতিহাসে সেরা সাত পুরষ্কারপ্রাপ্তদের তিনি একজন। ফোর্বসের ‘টেন মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল বিজনেস গুরুস’ তালিকায় মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন।

প্রফেসর  ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে এখানে যা কিছু তুলে ধরা হয়েছে তা তাঁর সম্পর্কে অসম্পূর্ণ তবে সত্য। প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে আরও জানতে আপনাকে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হবে।