বাংলাদেশের বারডেম হাসপাতালে প্রথমবারের মতো ব্ল্যাক ফাঙ্গাস (black fungus) সংক্রমিত রোগী সনাক্ত করা হয় ২১ মে, ২০২১। এ ছত্রাকে সংক্রমিত প্রথম রোগী সনাক্ত হবার পর বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছত্রাক সংক্রান্ত উপসর্গ নিয়ে একজন মারে গেছে এই একই হাসপাতাল অর্থাৎ বারডেমে। ২২ মে, ২০২১ তারিখ বাংলাদশে প্রথম কোনো রোগী ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশের সরকার ও চিকিৎসকগণ যখন নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন, ঠিক তখনই এখানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হবার খবর অধিকাংশ মানুষের মাঝে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এটি অনেকটাই প্রমাণিত যে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মাঝে খুব সহজেই সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর
- ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কী?
- কীভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকোর ছত্রাকে সংক্রমিত হয়?
- ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস কি সংক্রামক বা ছোঁয়াচে?
- কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মাঝে কেন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ হচ্ছে?
- ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার আক্রান্তরা খুব সহযেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হতে পারেন
- ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়ে চিকিৎসকরা কী বলছেন?

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কী?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হলো এক ধরণের ছত্রাকজনিত রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ এই রোগকে চিহ্নিত করা হচ্ছে মিউকরমাইকোসিস (mucormycosis) নামে। এই রোগে আক্রান্ত হয় তখন যখন মানুষের শরীর অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্বল থেকে। এই সংক্রমণ হয় সাধারণত মিউকর (mucor) নামে একটি ছত্রাকের সংস্পর্শে।
কীভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকোর ছত্রাকে সংক্রমিত হয়?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকোর ছত্রাকের সংক্রমণ কখন বা কীভাবে হয় সে নিয়ে বলা খুবই মুশকিল। তবে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, নোংরা জায়গা ও পচন ধরা ফলমূল কিংবা গাছ থেকে মিউকর ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটতে পারে। শরীর সুর্বল হয়ে পড়লে বা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা থাকে। যে কেউ বা যে-কোনো বয়সের ব্যক্তি এই ছত্রাকে সংক্রমিত হতে পারে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস কি সংক্রামক বা ছোঁয়াচে?
না। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস সংক্রামক কিংবা ছোঁয়াচে রোগ নয়। এর মানে হলো এই ছত্রাক এক জনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায় না। পশুপাখি বা অন্যান্য জীববজন্তু থেকে মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগে আক্রান্তের সুযোগ নেই। কিন্তু ছত্রাকটি যেহেতু মাটি, বায়ু, উদ্ভিদে থাকে সেহেতু আমাদের জন্য এ থেকে রক্ষা পাওয়াও কঠিন। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হবার পরিসংখ্যানও আমাদের বিশেষ ভালো কোনো বার্তা দিচ্ছে না। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগে মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ প্রায়।
কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মাঝে কেন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ হচ্ছে?
মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে তারাই আক্রমণের শিকার হচ্ছেন যারা শারীরিকভাবে বা স্বাস্থ্যগতভাবে দুর্বল। মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে ব্ল্যাক ফাংগাস খুব সহজে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। করোনাভাইরাসের (coronavirus) কারণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ (Covid-19) রোগীদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভয়ানকভাবে কমে যাওয়ার কারণে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সহজে আক্রমণ করতে পারছে। কোভিড-১৯ রোগীরা অনেক দিন পর্যন্ত আইসিইউতে থাকলে কিংবা তাদের উপরে স্টেরয়েডের প্রয়োগ বেশি হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া স্বাভাবিক, যার ফলে শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ঢুকে পড়ছে।
ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার আক্রান্তরা খুব সহযেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হতে পারেন
চিকিতকসকেরা বলছেন, যারা ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের মতো রোগে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে আছেন তাদেরকে যতটা সম্ভব সাবধানে থাকতে হবে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস এদের মধ্যে খুব সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। যে সকল মানুষ ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারে আকান্ত হন, স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। এই কারণেই ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীর মিউকরমাইকোসিস ইনফেকশন ফ্রেইন্ডলি।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়ে চিকিৎসকরা কী বলছেন?
চিকিৎসকরা মিউকরমাইকোসিস নিয়ে যা বলছেন তা হলো- ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছত্রাক মাটি ও বাতাসে বিদ্যমান থাকেই। সুস্থ মানুষের শ্লেষ্মাতেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস স্বাভাবিক সময়ে থাকতে পারে। বিশেষ এই ছত্রাক সাধারণত সাইনাস, মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, যেহেতু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুস দুর্বল থাকে, সেহেতু তাদেরকে ক্ষেত্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। এই রোগে খাদ্যনালী ও ত্বকও আক্রান্ত হতে পারে। তবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে শরীরের কোনো অংশই নিরাপদ নয়।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস কী ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়?
মিউকরমাইকোসিস রোগে যারা সংক্রমিত হন তাদের মধ্যে যেসব সাধারণ উপসর্গ লক্ষ্য করা যায় তা হলো:
- মুখে ও গালে ব্যাথা হতে পারে
- নাকের মধ্যখানে লালচে রঙয়ের হয়ে যেতে পারে
- নাক হতে রক্ত পড়তে পারে
- নাক বন্ধ হয়ে যেতে পারে যার কারণে শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি পারে
- নাকের উপরে বা নাকের আশেপাশে কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা যেতে পারে
- চোখে ব্যথা করতে পারে
- আক্রান্তদের চোখ ফুলে যেতে পারে
- ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হলে চোখের পাতা ঝুলে পড়তে পারে
- চোখে ঝাপসা দেখা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ভয়ানক একটি লক্ষণ, এ কারণে পরবর্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরুপে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে
- শরীরের সকল অঙ্গ অবশও হয়ে যেতে পারে
কীভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়?
যে সকল জায়গায় মিউকর ছত্রাকের উপস্থিত থাকে, সাধারণত সে সব জায়গা এড়িয়ে যাওয়া যায় না বললেই চলে। খুবই কঠিন ছত্রাককে এড়িয়ে চলার মতো একটি প্রচেষ্টা। তবে যে সকল মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে মিউকরমাইকোসিস রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমিয়ে আনতে পারে।
অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রোগ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে যে সব উপায়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা যায় তা হলো:
- আমাদের চারপাশে যে সব জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণে ধুলোবালি ও ময়লা রয়েছে সে সব জায়গা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিৎ। তবে এই সব জায়গায় যদি যাতায়াত না করে বা এড়িয়ে চলা সম্ভব না হয়, তাহলে এন-৯৫ (N-95) মাস্ক বা এর সমমানের কোনো প্রটেকশন ব্যবহার করা।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যে সকল বাড়িঘর, ইমারত বা অন্য যে-কোনো স্থাপনা পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে দুর্যোগ পরবর্তি সময়ে সেগুলোর সরাসরি সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিৎ। ছত্রাক দূরীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণের পরই ওই সকল স্থাপনা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।
- সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে, কোন ভাবেই শরীরের ত্বকে বা চামড়ায় যেন কোনো রকমের ইনফেকশন না হয়। অসাবধানতাবসত যদি শরীরের কোনো অংশ কেটে যায় কিংবা কোনো অংশের চামড়া উঠে যায়, তাহলে খেয়াল রাখতে হবে যেন ওই অংশ ধুলো-ময়লার সংস্পর্শে না আসে।
- করোনাভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা প্রয়োজন। চিকিৎসকের ব্যবস্থা অনুযায়ী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি।
- সতর্কতার সাথে রোগীর স্টেরয়েড ব্যবহার করতে হবে কারণ স্টেরয়েডের ব্যবহার ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে, যা ক্ষতিকর। ফলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে বা মিউকরমাইকোসিস রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
- যে সকল রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাদেরকে অক্সিজেন দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট সকল বস্তু ও এরিয়ায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার বিকল্প কিছু নেই।
- সাধারণ মানুষ বা কোনো রোগী যখন মাস্ক ব্যবহার করবেন, খেয়াল রাখতে হবে যেন ওই মাস্ক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ছিল। এছাড়া যেখানে সেখানে মাস্ক সংরক্ষণ করাও উচিৎ নয়। অপরিচ্ছন্ন হাতে মাস্ক না পরা এবং বারেবারে মুভ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
উপর্যুক্ত বিষয়গুলো শুধুই সতর্ক থাকার জন্য। কিন্তু এ সকল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেই মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের আক্রমণ বা সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হিবে তা এখনো শতভাগ প্রমাণিত নয়। সুতরাং, ভয়ের একটি কারণ থেকেই যায়।
আমাদের সকলেরই উচিৎ চোখ-কান খোলা রেখে চলা অর্থাৎ সর্বদা সতর্ক থাকা। আমরা সতর্কতা অবলম্বন করে চলাফেরা করলে যে-কোনো রোগ-বালাই থেকেই মুক্ত থাকতে পারব। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস করোনাভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে না হলেও এ থেকে বাঁচা খুবই কঠিন।
তথ্যসুত্র: বারডেম, বিবিসি, আনন্দবাজার