০৫:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শিক্ষার ইতিহাস: প্রাচীন ভারত থেকে বাংলাদেশে শিক্ষার ঐতিহাসিক বিকাশ

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০১:০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ মে ২০২১
  • / ২১৮১০ বার পড়া হয়েছে

শিক্ষার ঐতিহাসিক বিকাশ: প্রাচীন ভারত থেকে বাংলাদেশ।

মানবসভ্যতা পূর্বে যেমন ছিল বর্তমানে তেমন নেই। মানবসভ্যতার ধর্ম অন্যতম একটি ধর্ম হলো ক্রমবিকাশ লাভ। আর এই ক্রমবিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষা। সভ্যতার শুরুতে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার রূপ যেমন ছিল তা পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান আধুনিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানবসভ্যতার বিবর্তনের মূলে যেমন শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে, তেমনই শিক্ষার বিবর্তনেও মানব ও মানবের চাহিদার ভূমিকা রয়েছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষা গ্রহণ করে এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়। আর উত্তম শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থাই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলে। যুগে যুগে শিক্ষাবিদগণ পরিবর্তন হওয়া সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত প্রয়োজন, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত গতিধারা, জাতীয় উন্নয়ন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করেছেন। এই নিবন্ধ থেকে পাঠক প্রাচীন ভারত থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারবেন। চলুন, ছুটে চলা যাক বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে।

শিক্ষার ঐতিহাসিক বিকাশ: প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাস

শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে প্রাচীন গ্রিক

ইতিহাসে পৃথিবীতে বহু সভ্যতার খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষ বিচারে এগিয়ে থাকবে গ্রিক সভ্যতা। মানব সভ্যতার বিবর্তন ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন একই সাথে হয়ে থাকে। গবেষকরা বলে থাকেন, সভ্যতার বিবর্তন এবং শিক্ষার উন্নয়ন বিষয়ক মূলনীতিগুলো প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্র স্পার্টা বা অ্যাথেন্সে প্রথম লক্ষ্য করা যায়। গ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে শিক্ষার ঐতিহ্য নির্ণয়ের ভিত্তি বলে মানা হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান প্রেক্ষাপট

অন্য সকল দেশ ও অঞ্চলের মতোই বাংলাদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তার পেছনে একটি দীর্ঘ্য অতীত রয়েছে। যে অতীতের ক্রমবিবর্তনের ফল আজকের শিক্ষাব্যবস্থা। সময়য়ের ব্যবধানে ও যুগের চাহিদা বিবেচনায় শিক্ষায় অনেক নতুন ধারণা, নতুন বিষয়বস্তু যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে, তেমনই অনেক কিছু বাদও পড়েছে। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও যুগে যুগে নতুন করে নির্ধারণ করতে হয়। শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারকেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। নীতিগত ও রাজনৈতিক, উভয় দিক থেকে সরকার নানান সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত হতে পারে।

প্রাচীন ভারতে বৈদিক শিক্ষা

প্রাচীন ভারতের সর্বপ্রথম শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল বৈদিক শিক্ষা। প্রাচীন ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সে সময় পার্থিব জীবনের তুলনায় আধ্যাত্বিকতায় অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো। যার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটেছে তৎকালীন শিক্ষাদর্শনেও।

আমরা জানি, বেদ (সংস্কৃত: वेद ; ইংরেজি: Veda) হলো প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ এমনই একটি বৃহদাকার গ্রন্থ সংকলন যাতে রয়েছে বিভিন্নরকম তত্ত্বজ্ঞান। বৈদিক কথাটি এসেছে এই বেদ থেকে। আর বেদ ছিল বৈদিক শিক্ষার মূল উৎস।

কেমন ছিল বৈদিক শিক্ষায় পাঠদান?

বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদান ছিল গুরুকেন্দ্রিক এবং গুরু শিষ্যদের যে পদ্ধতিতে পাঠদান করতেন তার নাম শ্রুতি পদ্ধতি। শুনে শুনে শিক্ষালাভ করতে হতো শিক্ষার্থীদের। শ্রুতি সম্পন্ন হতো তিনটি ধাপে, যথা- ১. শ্রবণ, ২. চিন্তন এবং ৩. প্রণিধান।

বৈদিক শিক্ষায় শিক্ষকগণ বেদে বর্ণিত বিষয়গুলো পাঠ করতেন। তখন কখনো তা কোনো গল্পের সাহায্য নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার চেষ্টা করতেন। বেদের বাণী কিংবা বেদকে ভিত্তি করে বলা গুরুর গল্প মনোযোগ সহকারে শুনে তা নিয়ে চিন্তা করত শিক্ষার্থীরা এবং বোঝার চেষ্টা করত। শেষে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেত, যা শিক্ষার্থীদের শিখনকে আরও মজবুত করত।

শিক্ষালয়ে বা গুরুগৃহে যখন শিক্ষক বা গুরু উপস্থিত থাকতেন না তখন সবচেয়ে যে শিক্ষার্থী অগ্রবর্তী বলে বিবেচিত হতো তার ওপর দায়িত্ব থাকত বাকিদেরকে শিক্ষাদানের। একে সরদার পড়ো পদ্ধতি বলা হয়।

পরিপূর্ণভাবে বেদ শিখনের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে বা শিষ্যকে টানা বারো বছর গুরুগৃহে অবস্থান করতে হতো। এ শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞান করা হতো ফলে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন ও মূল্যবোধের বিকাশে এ শিক্ষা অত্যন্ত কার্যকর ছিল।

একনজরে বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  • বৈদিক শিক্ষার ধারক ও বাহক ছিলেন প্রাচীন ভারতের আদি শিক্ষাগুরু জ্ঞানতাপস ঋষিগণ।
  • বৈদিক শিক্ষা শুরু হতো ব্রাহ্মণ বালকের পৈতা পরার মাধ্যমে। একে বলা হয় উপনয়ন।
  • বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচুর সংযম সাধনা করতে হতো।
  • বৈদিক শিক্ষা নেওয়ার জন্য একেকজন শিক্ষার্থীকে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হতো।
  • বৈদিক শিক্ষাপদ্ধতি ছিল গুরু বা শিক্ষককেন্দ্রিক।
  • বোদিক শিক্ষাদান হতো গুরুর বেদপাঠের মাধ্যমে যা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সহকারে শুনে বুঝতে হতো।
  • বৈদিক শিক্ষায় প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির ব্যবহার হতো।
  • বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্দার পড়ো পদ্ধতি চালু ছিল।

প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা

বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার পরবর্তি সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাস বা বৌদ্ধ মতামতের আলোকে গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা। বৌদ্ধ শিক্ষাদানের কেন্দ্রকে বলা হতো বৌদ্ধবিহার। বৌদ্ধবিহারের অপর নাম সঙ্ঘারাম। বৌদ্ধরাই এ দেশে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিহারকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়।

বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষার্জনের পুরো সময়টিতেই বিহারে মধ্যে অবস্থান করতে হতো। গুরু-শিষ্য একই সাথে অবস্থানের ফলে তাদের মধ্যে সব সময়ই মধুর সম্পর্ক বিরাজ করত।

বৌদ্ধ শিক্ষা সাধারণত বৌদ্ধধর্মের ধর্মগ্রন্থ ‘ত্রিপিটক’ কেন্দ্রিক হলেও, জীবনমুখী শিক্ষা প্রদান করাও হতো। কালক্রমে বৌদ্ধ ধর্মে হীনযান ও মহাযান নামে যে দুটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে তাদের মধ্যে মহাযান জীবনমুখী শিক্ষায় এগিয়ে ছিল। মহাযান সম্প্রদায়ের লোকেরাই ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবনমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারে।

বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে শ্রেণি শিক্ষণের উদ্ভব ঘটে। কারণ তখন ব্যক্তিকেদ্রিক শিক্ষার জায়গা নিয়ে নেয় দলকেন্দ্রিক শিক্ষা।­ প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ শিক্ষায় যার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না, তিনি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জন্ম বঙ্গে, বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর উপজেলায়। অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক। পাল সাম্রাজ্যের সময় খুবই প্রভাবশালী একজন পণ্ডিত ছিলেন তিনি। বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি চীনদেশে গমন করেছিলেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে।

বৌদ্ধরা যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বা বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেসবের মধ্যে অন্যতম হলো নালন্দা মহাবিহার (Nalanda Mahavihara) বা ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’। নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠিত হয় ৫ম শতকে। এর পরে প্রতিষ্ঠিত হয় বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় বা বিক্রমশীলা মহাবিহার (Vikramashila Mahavihara), ৮ম থেকে ৯ম শতকের মধ্যে। বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর।

পাল শাসনামলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এগুলো হলো- নওগাঁ জেলার সোমপুর মহাবিহার (Somapura Mahavihara), এর আরেক নাম পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার; এবং জগদ্দল মহাবিহার (Jagaddala Mahavihara), এছাড়া কুমিল্লা জেলায় রয়েছে শালবন বিহার (Shalban Vihara) ।

অন্যান্য যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেগুলো হলো- ওদন্তপুরী মহাবিহার, তক্ষশীলা মহাবিহার এবং অনুরাধাপুর মহাবিহার।

এইসব বিশবিদ্যালয় বা শিক্ষাকেন্দ্র থেকেই চতুর্বেদ, হীনযানশাস্ত্র, মহাযানশাস্ত্র, অষ্টাদশ শাখার তত্ত্ব, যাদুবিদ্যা, যোগশাস্ত্র, গণিত, ধাতুবিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, রসায়নশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, ব্যবহারিকশাস্ত্র, শিল্পবিদ্যা, তান্ত্রিক বৌদ্ধশা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাদান করা হতো।

প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

  • বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাসের আলোকে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থা।
  • প্রাচীন ভারতে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায়, পাল আমলে।
  • ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার জায়গায় দলকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রচলন।
  • শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষা চালু।
  • ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবনমুখী শিক্ষার প্রচলন।
  • শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার।

মুসলিম আমলে শিক্ষা

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের সাথে সাথে বেশ ভাষা, শিল্প ও সাহিত্যের ধারা অনেকাংশেই বদলে যায়। মুসলমানদের প্রভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মুসলমানরা ধর্মীয় প্রয়োজনে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর মসজিদ নির্মান করে। এসকল মসজিদ শুধু ধর্মীয় কাজেই ব্যবহার হয়নি, এখান থেকে শিক্ষাদান করাও হতো। খুব কম সময়ের মধ্যে মসজিদভিত্তিক অনেক মক্তব ও মাদরাসা গড়ে ওঠে, যেখান থেকে খুব সহজেই শিক্ষা কর্মসুচি পরিচালিত হতো।

বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায় শুধু ব্রাহ্মণরাই শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পেত। কিন্তু মুসলিম আমলে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে গেছে সবার দুয়ারে। ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষাও মিলিয়ে দেওয়া হয় এক সময়। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের নেতৃত্বে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার মিশ্রণ ঘটানো হয়। মাদরাসাগুলোতে সাহিত্য ও দর্শণের পাশাপাশি কুরআন, হাদিস, ফিকাহ ও উসুল শেখানো হতো।

সুলতান ইলতুৎমিস তাঁর শাসনামলে বহুসংখ্যক মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর রাজধানী ফিরোজাবাদে একটি সুবিশাল মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন। মুসলমানদের আগমনে ভাষায় অনেকটা পরিবর্তন আসলে সুলতানি আমলে সাধারণ মানুষ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ পেত।

বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্যে অবদানের জন্য আলাউদ্দিন হুসেন শাহ অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। এ সকল ক্ষেত্রে তাঁর উৎসাহ এবং পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তিনি ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন। তিনি যেমনই মসজিদ ও মাদরাসায় শিক্ষার প্রসারে যথাসাধ্য কাজ করেছেন, তেমনই প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। পরবর্তিতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পুত্র নাসিরউদ্দিন নসরৎ শাহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

বাংলার স্বাধীন সুলতানরা মুসলমান ও হিন্দু শিক্ষাধারার মধ্যে এক চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়ে একটি বিশেষ শিক্ষাধারা প্রবর্তনে সক্ষম হন। এই সমন্বিত শিক্ষাধারা জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুঘল আমলে দেখা যায়- সম্রাটদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মক্তব, মাদরাসা ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাকেন্দ্র চালু হয়। সেসব শিক্ষাকেন্দ্রে প্রখ্যাত আলমগণের মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। মুঘল আমলে অনেক হিন্দু ফারসি ভাষা শেখায় আগ্রহী হয়, এ কারণে হিন্দুরাও তখন মাদরাসায় যেত। মুঘল আমল হলো শিক্ষার এমন একটি সময়কাল, যখন পরিমাণগত ও গুণগত (quantitative and qualitative) উভয় দিকে উন্নতিলাভ করে।

মুসলিম আমলে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  • মসজিদ ও মকতবভিত্তিক শিক্ষা।
  • মুসলমান আমলে প্রচুর মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়।
  • শিক্ষার আলো সাধারণ মানুষের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
  • ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়।
  • মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে সমন্বিত শিক্ষাধারার প্রবর্তন।
  • প্রখ্যাত ধর্মীয় আলমেগণ ও যোগ্য পণ্ডিতের মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা।
  • শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত উভয়দিকে উন্নতিলাভ।

ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে মিশনারিদের অবদান

বাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপিয়দের মধ্যে পর্তুগিজরা প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে পা রাখে। পর্তুগিজরা তখন শুধু নিজেদের বাণিজ্যের মধ্যেই নিজদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেনি। তাঁদের সাথে আসা মিশনারিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ধর্ম প্রচারের কাজে। ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তাঁরা এ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলে।

পর্তুগিজদের শিক্ষা প্রধানত চার ধরনের ছিল- যথা

  1. পর্তুগিজ ও ল্যাটিন ভাষার প্রাথমিক বিদ্যালয়
  2. ভারতীয় অনাথ শিশুদের আশ্রস্থলসংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়
  3. জেসুইট কলেজ (উচ্চশিক্ষার জন্য)
  4. ধর্মশিক্ষা ও পাদ্রি তৈরির সেমিনার

১৫৫৬ সালে বণিক পর্তুগিজরাই ভারতীয় উপমহাদেশের গোয়াতে সর্বপ্রথম ছাপাখানা স্থাপন করে। ছাপাখানা স্থাপনের ফলে তখন থেকে মুদ্রিত পাঠসামগ্রীর প্রচল ঘটে যা উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার সম্প্রসারণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। পর্তুগিজদের বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার সূচনাকারী।

ব্রিটিশ মিশনারিরাও ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা কোলকাতা, মদ্রাজ (তামিলনাড়ু) ও বোম্বেতে (মুম্বাই) বেশ কিছু অবৈতনিক/দাতব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

মিশনারিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম প্রচার করা আর একারণেই তারা শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল। বিভিন্ন ইউরোপিয় কোম্পানি এবং মিশনারিদের সমবেত প্রচেষ্টায় অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ধর্মীয় বিদ্যালয়, ভার্নাকুলার স্কুল (Vernacular Schools), শিক্ষকশিক্ষা (teacher education) বিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা হতো।

মাতৃভষা ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য অনেক ইংরেজি ভাষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। তবে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান করার জন্য প্রথম এগিয়ে আসেন উইলিয়াম কেরি। যে সকল মিশনারি ভারতীয় উপমহাদেশে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য কাজ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উইলিয়াম কেরি। ১০ জুলাই, ১৮০০ তারিখ লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান উইলিয়াম কেরি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ এবং সুবৃহৎ ইঙ্গবঙ্গ অভিধান প্রকাশ করেন।

ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা

ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পরপরই এদেশে শিক্ষার উন্নয়নে কাজ শুরু করে। শাসন ক্ষমতা মূলত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। এই কোম্পানি যেমন মুসলমানদের শিক্ষার উন্নয়নএর জন্য মাদরাসা স্থাপন করেন, তেমন হিন্দুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে কলেজ। এ পদক্ষেপ লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতেই শুরু হয়।

ভারতীয় শিক্ষা উন্নয়নের জন্য লর্ড মিন্টো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৮১১ সালে তিনি ভারতের শিক্ষার বেহাল অবস্থা তুলে ধরেন কোম্পানির কাছে। একই সাথে তিনি কোলকাতা, মাদ্রাজ (তামিলনাড়ু) ও বেনারস সংস্কৃত কলেজের সংস্কার এবং জৌনপুর ও ভাগলপুরে মাদ্রাসা স্থাপনের প্রস্তাব দেন।

তবে ইতিহাসে বলছে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের শিক্ষা সংস্কারের জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। ১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সনদ আইনের শিক্ষাধারাকে ভারতে শিক্ষা বিস্তারে প্রথম পদক্ষেপ বলা হয়। এই সনদের অধীনে মিশনারিগণ এদেশে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান।

এতকাল ভারতীয়রা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ পেলেও ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষা পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলশ্রুতিতে মাতৃভাষায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা এক রকম মূল্যহীন হয়ে যায়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কিছু মানুষ ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পদে চাকরি পেয়েছে ঠিকই, আদতে তেমন কোনো লাভ হয়নি ভারতের। বরং শ্রেণি বৈষম্য শুরু হয় এবং জাতীয় সংহতির পথে বিশাল বাধার সৃষ্টি হয়।

উডের ডেসপাচ (Wood’s dispatch)

ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে উডের ডেসপাচ (Wood’s dispatch) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৮৫৪ সালে চার্লস উড (Charles Wood) নিজের তত্ত্বাবধানে ১০০ অনুচ্ছেদবিশিষ্ট একটি ঐতিহাসক শিক্ষা দলিল প্রণয়ন করেন; চার্লস উডের নামানুসারে এটি Wood’s dispatch বা উডের ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত হয়।

উডের ডেসপ্যাচ (Wood’s dispatch) উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি রচনা করে। উডের ডেসপ্যাচ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার একটি কাঠামোগত ধারার রূপরেখা পাওয়া যায়, যাকে এক ধরনের ‘ল্যাডার সিস্টেম’ বলা যায়।

প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন

১৮৮২ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় উডের ডেসপাচ পরবর্তি শিক্ষার গতিধারা ও প্রকৃতি বোঝার জন্য। প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বা সভাপতি ছিলেন উইলিয়াম উইলসন হান্টার। উইলিয়াম হান্টারের নাম অনুসারে ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশনের নামকরণ করা হয় হান্টার কমিশন (Hunter Commission) । এক বছর না যেতেই ১৮৮৩ সালে ২২২ টি প্রস্তাবনা সম্বলিত ৬০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন এই কমিশন সরকারের নিকট পেশ করে।

হান্টার কমিশন প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রদানকে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে এই শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করে। পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল করে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার সুপারিশ করে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাকে ক্রমান্বয়ে বহুমুখী ধারায় নিয়ে উত্তীর্ণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যসূচি প্রবর্তনের সুপারিশ করে।

লর্ড কার্জনের শিক্ষা সম্মেলন ও শিক্ষা কর্মসুচি

১৯০১ সালে শিক্ষাক্ষেত্র সংস্কারের জন্য লর্ড কার্জন শিমলা (বর্তমান হিমাচল প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত) একটি শিক্ষা সম্মেলন করেন। কিন্তু এই শিক্ষা সম্মেলনে কোনো ভারতীয় শিক্ষাবিদকে আমন্ত্রন জানানো হয়নি। শিমলা সম্মেলনে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যম ১৬০ টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই ১৬০ টি প্রস্তাবের ভিত্তিতে লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংস্কার কর্মসুচি গৃহীত হয়।

লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি

১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন তাঁর শিক্ষানীতি সরকারি প্রস্তাবে পেশ করেন। এই শিক্ষানীতিতে সনাতনী প্রাথমিক শিক্ষার পরিবর্তে সেখানে কৃষিশিক্ষা ও শারীরিক শিক্ষার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। এ শিক্ষানীতিতে উঠে আসে, বিগত ২০ বছরে শিক্ষার যথেষ্ট উন্নতি হলেও তার বিস্তার আশানুরূপ হয়নি।

ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪

১৯০৪ সালে প্রণীত ভারতীয় বিশ্ববিদালয় আইন কার্যকর করা হয় ১৯০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪ এর রচিত হয় শিমলায় অনুষ্ঠিত ১৯০১ সালের শিক্ষা সম্মেলনের আলোচনা ও ১৯০২ সালের বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশ অনুসারে। লর্ড কার্জন কর্তৃক ‘ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সটি অ্যাক্ট, ১৯০৪’ জারি করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষাব্যবস্থা চালু এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

স্যাডলার রিপোর্ট

১৯১৯ সালে স্যাডলার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। স্যাডলার রিপোর্টের দাপ্তরিক নাম ছিল রিপোর্ট অব দ্য সিলেক্ট কমিটি অন ফ্যাক্টরি চিলড্রেন’স লেবার (Report of the Select Committee on Factory Children’s Labour) । এই রিপোর্টটি লিখেন মাইকেল স্যাডলার। স্যাডলার রিপোর্টে প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক ও কলেজ পযায়ের শিক্ষা পরিচালনার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে সেকেন্ডারি ও ইন্টারমিডিয়েট বোর্ড (Secondary and Intermediate Board) গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিকে ডিগ্রি কলেজ থেকে পৃথক করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে ম্যাট্রিকুলেশনের বদলে ইন্টারমিডিয়েট (বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াকে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো স্যাডলার কমিশনের বাস্তবে রূপ নেয়া অন্যতম প্রধান একটি সুপারিশ।  

সার্জেন্ট স্কিম

ভারত সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা স্যার জন সার্জেন্টকে চেয়ারম্যান করে গঠিত সার্জেন্ট কমিটি গঠিত হয় ১৯৪৩ সালে। ১৯৪৪ সালে এই কমিটি ভারতের শিক্ষার পুনরায় গঠন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। এই প্রতিবেদনের ন্দাপ্তরিক নাম ‘রিপোর্ট অব দ্য সার্জেন্ট কমিশন অন-পোস্ট ওয়ার এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’।

সার্জেন্ট স্কিমে ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এবং ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী সকল শিশুর জন্য সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়। ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী নির্বাচিত কিছু ছেলে-মেয়ের জন্য ৬ বছর মেয়াদি উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা এবং এ শিক্ষায় উত্তীর্ণ কিছু শিক্ষার্থীদের জন্য ৩ বছর মেয়াদি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সুপারিশও এ রিপোর্টে ছিল। কারিগরি শিক্ষায় জোর দেবার পাশাপাশি দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থার সুপারিশও এ কমিটি করেছিল।

স্যাডলার স্কিমে আরও বলা হয়, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১০% থেকে ১৫% শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ থাকা উচিত।

পাকিস্তান আমলে শিক্ষা

পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন শেষে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি ভিন্ন দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তান গঠিত হয় মুসলিম অধ্যুষিত ভারতীয় উপমহাদেশের দুইটি অংশ নিয়ে যা পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিমপাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। ঔপনিবেশিক শিক্ষা থেকে বেরিয়ে একদমই নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খানকে প্রধান করে ‘পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি’ গঠিত হয়। কমিটি প্রণীত সুপারিশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বলা হয়। সার্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা পরবর্তী ১৫ বছর বা সম্ভব হলে তার পূর্বেই প্রবর্তনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ধরা হয় ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট। পাশাপাশি পেশাগত প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রচলিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনের মধ্যকার ভারসাম্যহীনতা দূর করার গুরুত্ব সুপারিশে তুলে ধরা হয়। এমন কি মাধ্যমিক স্তরে মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার সুপারিশ করা হয়।

এছাড়াও কমিটি সুপারিশ করে যে, ইসলামিক শিক্ষার জন্য একটি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। কমিটির সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাচেলর অব আর্টস ইন এডুকেশন এবং পরবর্তী বছরে মাস্টার অব আর্টস ইন এডুকেশন প্রোগ্রাম প্রবর্তনের কথা বলা হয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের শিক্ষার উন্নয়নে কমিটি গঠন করলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কোন বাস্তব উন্নয়ন গ্রহণ করেনি।

আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৭

১৯৫৭ সালে গঠিত আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তাঁদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল। আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে সমগ্র পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। এ কমিশন পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা এবং ছয় বছরের মাধ্যমিক শিক্ষা চালুর প্রস্তাব দেয়। সেখানে তিন বছর মেয়াদের জুনিয়র হাইস্কুল (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি) এবং তিন বছর মেয়াদের সিনিয়র হাইস্কুল (নবম থেকে একাদশ শ্রেণি) কিংবা পূর্ণ ছয় বছর মেয়াদের হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছিল, যা বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামোর সাথে অনেকাংশেই মিলে যায়; যদিও এখন মাধ্যমিক শিক্ষা সাত বছর মেয়াদি।

জাতীয় শিক্ষা বিষয়ক কমিশন বা শরীফ কমিশন, ১৯৫৮

পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষাসচিব এস. এম. শরীফকে সভাপতি এবং আরও দশ জন শিক্ষাবিদকে সদস্য করে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় শিক্ষা বিষয়ক কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সভাপতি বা চেয়ারম্যানের নাম অনুসারে শরীফ কমিশন নামেও পরিচিত। শরীফ কমিশন পাকিস্তানি মতবাদ ও জাতীয়তাবাদ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নকে সামনে রেখে বেশ চমৎকার কিছু সুপারিশ রেখেছিল। কিন্তু সেখানে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির সঠিক প্রতিফলন ছিলনা। তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতা ও অবহেলায় সুপারিশসমূহের বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে।

বর্তমান বাংলাদেশ আমলে শিক্ষা (১৯৭১-বর্তমান)

কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন, ১৯৭২

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই (১১ শ্রাবণ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ) বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। দাপ্তরিকভাবে কমিশনটির নাম ছিল ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন’। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশন উদ্বোধন করেন। কুদরত-এ-খুদা কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে ৩০ মে, ১৯৭৪ তারিখ। উল্লেখ্য, এই কমিশনের অন্তর্বর্তিকালীন রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছিল ৮ জুন, ১৯৭৩ তারিখ।

কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টেই প্রাথমিক শিক্ষাকে আট বছর মেয়াদি করার সুপারিশ করা হয়। এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করার সুপারিশও করা হয়।

১৯৭২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৩ সালে একসাথে ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। সদ্যস্বাধীন একটি দেশে এ রকমের একটি পদক্ষেপ অনেক কঠিন হলেও সার্বজনীন গুরুত্ব অনুধাবন করে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এ সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে সব সময়ই একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন নবম ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার কথা বলে এবং একে সাধারণ ও বৃত্তিমূলক, এই দুই ধরনের শিক্ষার কথা বলে। মাদরাসা শিক্ষা, টোল শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়েও এ রিপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি

কুদরত-এ-খুদা রিপোর্টের সুপারিশগুলো বাস্তাবায়নের জন্য ১৯৭৫ সালে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটি প্রণীত রিপোর্টের আলোকে বিভিন্ন স্তরের জন্য শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয় এবং পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়।

শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি, ১৯৭৮

কুদরত-এ-খুদা কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করার পর তৎকালীন সরকার এই রিপোর্ট ও তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থাকে রিভিউ করার প্রয়োজন অনুভব করে। সরকার তাই একটি শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ। এই কমিটি সে সময়ের উপযোগী করে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। এ শিক্ষানীতি কুদরত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্ট নির্ভরই হয়েছিল।

মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৩

১৯৭৪ এর শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এবং ১৯৭৮ সালের নতুন শিক্ষানীতির সুপারিশের কিছু অংশ বাস্তবায়ন হতে না হতেই সরকার আবারও শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন অনুভব করল। এই কমিটির প্রধান ছিলেন মজিদ খান। অল্প সময়ের মধ্যে এ কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলো কিন্তু এর কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি।

বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ১৯৮৮

মফিজউদ্দীন আহমদকে সভাপতি করে বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় মজিদ খান কমিশনের ৫ বছরের মাথায়। মজিদ খান কমিশনের কোনো সুপারিশই বাস্তবায়ন না করে এ কমিটি গঠন করা হয়। সুতরাং মফিজউদ্দীন আহমেদের কমিশন যে পর্যালোচনা করে তা মূলত দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট এবং তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশ। এ কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে ১৯৮৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। এটি মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ১৯৮৮ নামে পচিত।

সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিটি, ১৯৯৭

১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম. শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ৫৬ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এ কমিশনকে একটি বাস্তবধর্মী, গণমুখী ও গতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তারা সেটা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। শামসুল হক কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয়াতাবাদি চেতনার কথা উঠে আসে। কমিশনের রিপোর্টে তিন স্তর বিশিষ্ট শিক্ষার সুপারিশ করা হয়ছে, যথা- প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চশিক্ষা। এই কমিশনেও আট বছর মেয়াদের প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়েছিল।

শিক্ষানীতি, ২০০১ (বাতিল)

এই শিক্ষানীতিটি প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ সরকার কিন্তু পরের নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল (বিএনপি) ক্ষমতায় এলে এটি বাতিল করে নতুন শিক্ষা কমিশন গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এম. এ. বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০২

২০০১ সালের শিক্ষানীতি সরকার বাতিল করার পরে আরেকটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। শিক্ষাখাতে গঠন পদ্ধতিসহ নানা ত্রুটি চিহ্নিত করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ২০০২ সালে এ কমিটি গঠন করা হয়। ড. এম. এ. বারী ছিলেন এ বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান। তবে এ কমিটির সুপারিশও আলোর মুখ দেখেনি।

মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশন, ২০০৩

শিক্ষার গুণগতমান অব্যাহতভাবে বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে আবারো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনটি গঠন করা হয় ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে। এই কমিশন ২০০৪ সালের মার্চে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিতে সক্ষম হয়। এই কমিশন শিক্ষার সকল সাব-সেক্টরকে তিনটি ভাগে ভাগ করে মোট ৮৮০ টি সুপারিশ করেছিল। এই কমিশনের রিপোর্টের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সকল জনগণকে মানবসম্পদে রুপান্তর করা। এই রিপোর্টে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১ : ৩০ এবং ১ : ৪০ । একমুখী মাধ্যমিক শিক্ষার সুপারিশ ছিল এ রিপোর্টের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ (কবীর চৌধুরী)

২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যের একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭, ১৮ এবং ৪৮ নম্বর অনুচ্ছেদসমূহ এবং জাতিসংঘ শিশু অধিকার সম্মেলনে যে সকল বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ প্রণয়ন করে।

জাতীয় শিক্ষানীতি – ২০১০ এ শিক্কার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ৩০ টি। প্রথম যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা বলা হয় তা হলো- শিক্ষার সর্বস্তরে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের সচেতন করা। এর পরে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ থেকে সামাজিক, মানবিক, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। এ শিক্ষানীতিতে মুখস্তবিদ্যার পরিবর্তে সৃজনশীলতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যাতে করে শিক্ষার্থী একজন মানসম্পন্ন প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয় শিক্ষানীতি – ২০১০-এ। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা অর্জনকৌশল সম্পর্কে বলা হয়েছে এখানে। চিকিৎসা, সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার ক্ষেত্রকে গুরত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে যেহেতু একটি দেশ অথবা জাতিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রথম শর্তই হলো সুস্থতা।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের পদমর্যাদা, শিক্ষা প্রশাসন এবং শিক্ষা স্তর সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নকশা রয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। এই শিক্ষানীতিতে জাতির আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে বলে বিভিন্ন মহল মনে করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই শিক্ষানীতির বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। যা কিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি সে সবের মধ্যে অন্যতম হলো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ৩০ এ উন্নীত করা।

জাতীয় শিক্ষানীতি – ২০১০ এর প্রধান ১৫ টি বৈশিষ্ট্য

১. সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন

২. বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্য

৩. শিক্ষার্থীদের বিকশিত চিন্তাশক্তির আলোকে অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী এবং সৃজনশীল করে বিজ্ঞানভিত্তিক মানসম্পন্ন প্রান্তিক যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে সহায়ক

৪. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় গুরুত্বারোপ

৫. ডিজিটাল প্রযুক্তিতে গুরুত্বারোপ

৬. আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষাদান

৭. শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ৩০

৮. ধর্ম ও নৈতিকতার ওপর সঠিক শিক্ষা প্রদান

৯. গুণগত প্রকৌশল শিক্ষায় জোর প্রদান

১০. মানসম্পন্ন চিকিৎসা, সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মি তৈরি

১১. শিক্ষকের মর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা

১২. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও কৌশল সম্পর্কে আলোকপাত

১৩. শিক্ষাপ্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থাপনার নকশা

১৪. জীবনঘনিষ্ঠ ও অত্যাবশ্যকীয় শিখনক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসুচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের নির্দেশনা

১৫. বাংলাদেশে প্রচলিত সকল ভাষা ও সংস্কৃতি সহায়ক শিক্ষানীত

[দ্রষ্টব্য: জাতীয় শিক্ষানীতি – ২০১০ এর প্রেক্ষাপট, ভিত্তি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসহ শিক্ষানীতির সব কিছু বিবেচনায় অসংখ্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা সম্ভব। এখানে এই নিবন্ধের প্রয়োজনে মাত্র ১৫ টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে।]

বাংলাদেশে শিক্ষা স্তর

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ৩ টি স্তর রয়েছে।

  1. প্রাথমিক
  2. মাধ্যমিক
  3. উচ্চশিক্ষা
প্রাথমিক শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষার সমকাল পাঁচ বছর। যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির প্রতি শ্রেণিতে একজন শিশুকে এক বছর করে পড়াশোনা করতে হয়। শিশুর বয়স যখন ৬+ বছর তখন সে প্রাথমিক স্তরের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির উপযুক্ত হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি – ২০১০ অনুসারে বর্তমানে প্রাথমিকে ভর্তির পূর্বে এক বছর প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি হতে হয়। প্রাক-প্রাথমিকের একজন শিশুর বয়স ৫+ বছর, পরবর্তীতে যা ৪+ বছর করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাংলাদেশে মৌলিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃত। এই স্তরটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপরের অধীন।

মাধ্যমিক

প্রাথমিক শিক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করার পরে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হতে পারে। এই স্তরটি আবার তিনটি ভাগে বিভক্ত। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্নমাধ্যমিক (Junior Secondary), নবম থেকে দশম পর্যন্ত মাধ্যমিক (Secondary) এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি (Higher Secondary) । শিক্ষানীতিতে যদিও ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষারর আওতাভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। মাধ্যমিক স্তর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন, তবে যাবতীয় বিষয় দেখাশোনার জন্য ৮ টি শিক্ষাবোর্ড (Bangladesh Education Board) নিয়োজিত।

উচ্চশিক্ষা

সফলভাবে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যোগ্যতা অর্জনে করে, স্যাডলার রিপোর্টের মতোই। এই পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ ও ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে পারে। তবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিতে এক ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সাধারণ, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, চিকিৎসাসহ ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সকল ধরনের সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে মোট ৪৯ টি। বেসরকারি (প্রাইভেট) বিশ্ববিদ্যালয় ১০৭ টি টি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩ টি। এছাড়া সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ৩৪ টি এবং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ৫৮ টি।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা পরিচালনার উদ্দেশ্যে নিয়োজত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (Bangladesh University Grants Commission), এটি সংক্ষেপে ইউজিসি বা UGC নামে পরিচিত।

শেয়ার করুন

2 thoughts on “শিক্ষার ইতিহাস: প্রাচীন ভারত থেকে বাংলাদেশে শিক্ষার ঐতিহাসিক বিকাশ

  1. অনেক কিছু শিখলাম।
    আপনাকে ধন্যবাদ।

  2. এখানে অনেক সাধারণ জ্ঞান আছে। খুবই হেল্পফুল।

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

শিক্ষার ইতিহাস: প্রাচীন ভারত থেকে বাংলাদেশে শিক্ষার ঐতিহাসিক বিকাশ

প্রকাশ: ০১:০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ মে ২০২১

মানবসভ্যতা পূর্বে যেমন ছিল বর্তমানে তেমন নেই। মানবসভ্যতার ধর্ম অন্যতম একটি ধর্ম হলো ক্রমবিকাশ লাভ। আর এই ক্রমবিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষা। সভ্যতার শুরুতে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার রূপ যেমন ছিল তা পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান আধুনিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানবসভ্যতার বিবর্তনের মূলে যেমন শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে, তেমনই শিক্ষার বিবর্তনেও মানব ও মানবের চাহিদার ভূমিকা রয়েছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষা গ্রহণ করে এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়। আর উত্তম শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থাই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলে। যুগে যুগে শিক্ষাবিদগণ পরিবর্তন হওয়া সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত প্রয়োজন, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত গতিধারা, জাতীয় উন্নয়ন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করেছেন। এই নিবন্ধ থেকে পাঠক প্রাচীন ভারত থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারবেন। চলুন, ছুটে চলা যাক বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে।

শিক্ষার ঐতিহাসিক বিকাশ: প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাস

শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে প্রাচীন গ্রিক

ইতিহাসে পৃথিবীতে বহু সভ্যতার খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষ বিচারে এগিয়ে থাকবে গ্রিক সভ্যতা। মানব সভ্যতার বিবর্তন ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন একই সাথে হয়ে থাকে। গবেষকরা বলে থাকেন, সভ্যতার বিবর্তন এবং শিক্ষার উন্নয়ন বিষয়ক মূলনীতিগুলো প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্র স্পার্টা বা অ্যাথেন্সে প্রথম লক্ষ্য করা যায়। গ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে শিক্ষার ঐতিহ্য নির্ণয়ের ভিত্তি বলে মানা হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান প্রেক্ষাপট

অন্য সকল দেশ ও অঞ্চলের মতোই বাংলাদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তার পেছনে একটি দীর্ঘ্য অতীত রয়েছে। যে অতীতের ক্রমবিবর্তনের ফল আজকের শিক্ষাব্যবস্থা। সময়য়ের ব্যবধানে ও যুগের চাহিদা বিবেচনায় শিক্ষায় অনেক নতুন ধারণা, নতুন বিষয়বস্তু যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে, তেমনই অনেক কিছু বাদও পড়েছে। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও যুগে যুগে নতুন করে নির্ধারণ করতে হয়। শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারকেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। নীতিগত ও রাজনৈতিক, উভয় দিক থেকে সরকার নানান সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত হতে পারে।

প্রাচীন ভারতে বৈদিক শিক্ষা

প্রাচীন ভারতের সর্বপ্রথম শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল বৈদিক শিক্ষা। প্রাচীন ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সে সময় পার্থিব জীবনের তুলনায় আধ্যাত্বিকতায় অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো। যার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটেছে তৎকালীন শিক্ষাদর্শনেও।

আমরা জানি, বেদ (সংস্কৃত: वेद ; ইংরেজি: Veda) হলো প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ এমনই একটি বৃহদাকার গ্রন্থ সংকলন যাতে রয়েছে বিভিন্নরকম তত্ত্বজ্ঞান। বৈদিক কথাটি এসেছে এই বেদ থেকে। আর বেদ ছিল বৈদিক শিক্ষার মূল উৎস।

কেমন ছিল বৈদিক শিক্ষায় পাঠদান?

বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদান ছিল গুরুকেন্দ্রিক এবং গুরু শিষ্যদের যে পদ্ধতিতে পাঠদান করতেন তার নাম শ্রুতি পদ্ধতি। শুনে শুনে শিক্ষালাভ করতে হতো শিক্ষার্থীদের। শ্রুতি সম্পন্ন হতো তিনটি ধাপে, যথা- ১. শ্রবণ, ২. চিন্তন এবং ৩. প্রণিধান।

বৈদিক শিক্ষায় শিক্ষকগণ বেদে বর্ণিত বিষয়গুলো পাঠ করতেন। তখন কখনো তা কোনো গল্পের সাহায্য নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার চেষ্টা করতেন। বেদের বাণী কিংবা বেদকে ভিত্তি করে বলা গুরুর গল্প মনোযোগ সহকারে শুনে তা নিয়ে চিন্তা করত শিক্ষার্থীরা এবং বোঝার চেষ্টা করত। শেষে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেত, যা শিক্ষার্থীদের শিখনকে আরও মজবুত করত।

শিক্ষালয়ে বা গুরুগৃহে যখন শিক্ষক বা গুরু উপস্থিত থাকতেন না তখন সবচেয়ে যে শিক্ষার্থী অগ্রবর্তী বলে বিবেচিত হতো তার ওপর দায়িত্ব থাকত বাকিদেরকে শিক্ষাদানের। একে সরদার পড়ো পদ্ধতি বলা হয়।

পরিপূর্ণভাবে বেদ শিখনের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে বা শিষ্যকে টানা বারো বছর গুরুগৃহে অবস্থান করতে হতো। এ শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞান করা হতো ফলে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন ও মূল্যবোধের বিকাশে এ শিক্ষা অত্যন্ত কার্যকর ছিল।

একনজরে বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  • বৈদিক শিক্ষার ধারক ও বাহক ছিলেন প্রাচীন ভারতের আদি শিক্ষাগুরু জ্ঞানতাপস ঋষিগণ।
  • বৈদিক শিক্ষা শুরু হতো ব্রাহ্মণ বালকের পৈতা পরার মাধ্যমে। একে বলা হয় উপনয়ন।
  • বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচুর সংযম সাধনা করতে হতো।
  • বৈদিক শিক্ষা নেওয়ার জন্য একেকজন শিক্ষার্থীকে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হতো।
  • বৈদিক শিক্ষাপদ্ধতি ছিল গুরু বা শিক্ষককেন্দ্রিক।
  • বোদিক শিক্ষাদান হতো গুরুর বেদপাঠের মাধ্যমে যা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সহকারে শুনে বুঝতে হতো।
  • বৈদিক শিক্ষায় প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির ব্যবহার হতো।
  • বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্দার পড়ো পদ্ধতি চালু ছিল।

প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা

বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার পরবর্তি সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাস বা বৌদ্ধ মতামতের আলোকে গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা। বৌদ্ধ শিক্ষাদানের কেন্দ্রকে বলা হতো বৌদ্ধবিহার। বৌদ্ধবিহারের অপর নাম সঙ্ঘারাম। বৌদ্ধরাই এ দেশে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিহারকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়।

বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষার্জনের পুরো সময়টিতেই বিহারে মধ্যে অবস্থান করতে হতো। গুরু-শিষ্য একই সাথে অবস্থানের ফলে তাদের মধ্যে সব সময়ই মধুর সম্পর্ক বিরাজ করত।

বৌদ্ধ শিক্ষা সাধারণত বৌদ্ধধর্মের ধর্মগ্রন্থ ‘ত্রিপিটক’ কেন্দ্রিক হলেও, জীবনমুখী শিক্ষা প্রদান করাও হতো। কালক্রমে বৌদ্ধ ধর্মে হীনযান ও মহাযান নামে যে দুটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে তাদের মধ্যে মহাযান জীবনমুখী শিক্ষায় এগিয়ে ছিল। মহাযান সম্প্রদায়ের লোকেরাই ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবনমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারে।

বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে শ্রেণি শিক্ষণের উদ্ভব ঘটে। কারণ তখন ব্যক্তিকেদ্রিক শিক্ষার জায়গা নিয়ে নেয় দলকেন্দ্রিক শিক্ষা।­ প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ শিক্ষায় যার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না, তিনি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জন্ম বঙ্গে, বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর উপজেলায়। অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক। পাল সাম্রাজ্যের সময় খুবই প্রভাবশালী একজন পণ্ডিত ছিলেন তিনি। বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি চীনদেশে গমন করেছিলেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে।

বৌদ্ধরা যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বা বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেসবের মধ্যে অন্যতম হলো নালন্দা মহাবিহার (Nalanda Mahavihara) বা ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’। নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠিত হয় ৫ম শতকে। এর পরে প্রতিষ্ঠিত হয় বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় বা বিক্রমশীলা মহাবিহার (Vikramashila Mahavihara), ৮ম থেকে ৯ম শতকের মধ্যে। বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর।

পাল শাসনামলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এগুলো হলো- নওগাঁ জেলার সোমপুর মহাবিহার (Somapura Mahavihara), এর আরেক নাম পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার; এবং জগদ্দল মহাবিহার (Jagaddala Mahavihara), এছাড়া কুমিল্লা জেলায় রয়েছে শালবন বিহার (Shalban Vihara) ।

অন্যান্য যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেগুলো হলো- ওদন্তপুরী মহাবিহার, তক্ষশীলা মহাবিহার এবং অনুরাধাপুর মহাবিহার।

এইসব বিশবিদ্যালয় বা শিক্ষাকেন্দ্র থেকেই চতুর্বেদ, হীনযানশাস্ত্র, মহাযানশাস্ত্র, অষ্টাদশ শাখার তত্ত্ব, যাদুবিদ্যা, যোগশাস্ত্র, গণিত, ধাতুবিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, রসায়নশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, ব্যবহারিকশাস্ত্র, শিল্পবিদ্যা, তান্ত্রিক বৌদ্ধশা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাদান করা হতো।

প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

  • বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাসের আলোকে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থা।
  • প্রাচীন ভারতে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায়, পাল আমলে।
  • ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার জায়গায় দলকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রচলন।
  • শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষা চালু।
  • ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবনমুখী শিক্ষার প্রচলন।
  • শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার।

মুসলিম আমলে শিক্ষা

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের সাথে সাথে বেশ ভাষা, শিল্প ও সাহিত্যের ধারা অনেকাংশেই বদলে যায়। মুসলমানদের প্রভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মুসলমানরা ধর্মীয় প্রয়োজনে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর মসজিদ নির্মান করে। এসকল মসজিদ শুধু ধর্মীয় কাজেই ব্যবহার হয়নি, এখান থেকে শিক্ষাদান করাও হতো। খুব কম সময়ের মধ্যে মসজিদভিত্তিক অনেক মক্তব ও মাদরাসা গড়ে ওঠে, যেখান থেকে খুব সহজেই শিক্ষা কর্মসুচি পরিচালিত হতো।

বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায় শুধু ব্রাহ্মণরাই শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পেত। কিন্তু মুসলিম আমলে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে গেছে সবার দুয়ারে। ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষাও মিলিয়ে দেওয়া হয় এক সময়। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের নেতৃত্বে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার মিশ্রণ ঘটানো হয়। মাদরাসাগুলোতে সাহিত্য ও দর্শণের পাশাপাশি কুরআন, হাদিস, ফিকাহ ও উসুল শেখানো হতো।

সুলতান ইলতুৎমিস তাঁর শাসনামলে বহুসংখ্যক মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর রাজধানী ফিরোজাবাদে একটি সুবিশাল মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন। মুসলমানদের আগমনে ভাষায় অনেকটা পরিবর্তন আসলে সুলতানি আমলে সাধারণ মানুষ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ পেত।

বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্যে অবদানের জন্য আলাউদ্দিন হুসেন শাহ অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। এ সকল ক্ষেত্রে তাঁর উৎসাহ এবং পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তিনি ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন। তিনি যেমনই মসজিদ ও মাদরাসায় শিক্ষার প্রসারে যথাসাধ্য কাজ করেছেন, তেমনই প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। পরবর্তিতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পুত্র নাসিরউদ্দিন নসরৎ শাহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

বাংলার স্বাধীন সুলতানরা মুসলমান ও হিন্দু শিক্ষাধারার মধ্যে এক চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়ে একটি বিশেষ শিক্ষাধারা প্রবর্তনে সক্ষম হন। এই সমন্বিত শিক্ষাধারা জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুঘল আমলে দেখা যায়- সম্রাটদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মক্তব, মাদরাসা ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাকেন্দ্র চালু হয়। সেসব শিক্ষাকেন্দ্রে প্রখ্যাত আলমগণের মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। মুঘল আমলে অনেক হিন্দু ফারসি ভাষা শেখায় আগ্রহী হয়, এ কারণে হিন্দুরাও তখন মাদরাসায় যেত। মুঘল আমল হলো শিক্ষার এমন একটি সময়কাল, যখন পরিমাণগত ও গুণগত (quantitative and qualitative) উভয় দিকে উন্নতিলাভ করে।

মুসলিম আমলে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  • মসজিদ ও মকতবভিত্তিক শিক্ষা।
  • মুসলমান আমলে প্রচুর মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়।
  • শিক্ষার আলো সাধারণ মানুষের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
  • ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়।
  • মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে সমন্বিত শিক্ষাধারার প্রবর্তন।
  • প্রখ্যাত ধর্মীয় আলমেগণ ও যোগ্য পণ্ডিতের মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা।
  • শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত উভয়দিকে উন্নতিলাভ।

ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে মিশনারিদের অবদান

বাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপিয়দের মধ্যে পর্তুগিজরা প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে পা রাখে। পর্তুগিজরা তখন শুধু নিজেদের বাণিজ্যের মধ্যেই নিজদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেনি। তাঁদের সাথে আসা মিশনারিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ধর্ম প্রচারের কাজে। ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তাঁরা এ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলে।

পর্তুগিজদের শিক্ষা প্রধানত চার ধরনের ছিল- যথা

  1. পর্তুগিজ ও ল্যাটিন ভাষার প্রাথমিক বিদ্যালয়
  2. ভারতীয় অনাথ শিশুদের আশ্রস্থলসংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়
  3. জেসুইট কলেজ (উচ্চশিক্ষার জন্য)
  4. ধর্মশিক্ষা ও পাদ্রি তৈরির সেমিনার

১৫৫৬ সালে বণিক পর্তুগিজরাই ভারতীয় উপমহাদেশের গোয়াতে সর্বপ্রথম ছাপাখানা স্থাপন করে। ছাপাখানা স্থাপনের ফলে তখন থেকে মুদ্রিত পাঠসামগ্রীর প্রচল ঘটে যা উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার সম্প্রসারণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। পর্তুগিজদের বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার সূচনাকারী।

ব্রিটিশ মিশনারিরাও ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা কোলকাতা, মদ্রাজ (তামিলনাড়ু) ও বোম্বেতে (মুম্বাই) বেশ কিছু অবৈতনিক/দাতব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

মিশনারিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম প্রচার করা আর একারণেই তারা শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল। বিভিন্ন ইউরোপিয় কোম্পানি এবং মিশনারিদের সমবেত প্রচেষ্টায় অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ধর্মীয় বিদ্যালয়, ভার্নাকুলার স্কুল (Vernacular Schools), শিক্ষকশিক্ষা (teacher education) বিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা হতো।

মাতৃভষা ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য অনেক ইংরেজি ভাষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। তবে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান করার জন্য প্রথম এগিয়ে আসেন উইলিয়াম কেরি। যে সকল মিশনারি ভারতীয় উপমহাদেশে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য কাজ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উইলিয়াম কেরি। ১০ জুলাই, ১৮০০ তারিখ লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান উইলিয়াম কেরি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ এবং সুবৃহৎ ইঙ্গবঙ্গ অভিধান প্রকাশ করেন।

ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা

ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পরপরই এদেশে শিক্ষার উন্নয়নে কাজ শুরু করে। শাসন ক্ষমতা মূলত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। এই কোম্পানি যেমন মুসলমানদের শিক্ষার উন্নয়নএর জন্য মাদরাসা স্থাপন করেন, তেমন হিন্দুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে কলেজ। এ পদক্ষেপ লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতেই শুরু হয়।

ভারতীয় শিক্ষা উন্নয়নের জন্য লর্ড মিন্টো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৮১১ সালে তিনি ভারতের শিক্ষার বেহাল অবস্থা তুলে ধরেন কোম্পানির কাছে। একই সাথে তিনি কোলকাতা, মাদ্রাজ (তামিলনাড়ু) ও বেনারস সংস্কৃত কলেজের সংস্কার এবং জৌনপুর ও ভাগলপুরে মাদ্রাসা স্থাপনের প্রস্তাব দেন।

তবে ইতিহাসে বলছে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের শিক্ষা সংস্কারের জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। ১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সনদ আইনের শিক্ষাধারাকে ভারতে শিক্ষা বিস্তারে প্রথম পদক্ষেপ বলা হয়। এই সনদের অধীনে মিশনারিগণ এদেশে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান।

এতকাল ভারতীয়রা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ পেলেও ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষা পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলশ্রুতিতে মাতৃভাষায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা এক রকম মূল্যহীন হয়ে যায়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কিছু মানুষ ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পদে চাকরি পেয়েছে ঠিকই, আদতে তেমন কোনো লাভ হয়নি ভারতের। বরং শ্রেণি বৈষম্য শুরু হয় এবং জাতীয় সংহতির পথে বিশাল বাধার সৃষ্টি হয়।

উডের ডেসপাচ (Wood’s dispatch)

ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে উডের ডেসপাচ (Wood’s dispatch) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৮৫৪ সালে চার্লস উড (Charles Wood) নিজের তত্ত্বাবধানে ১০০ অনুচ্ছেদবিশিষ্ট একটি ঐতিহাসক শিক্ষা দলিল প্রণয়ন করেন; চার্লস উডের নামানুসারে এটি Wood’s dispatch বা উডের ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত হয়।

উডের ডেসপ্যাচ (Wood’s dispatch) উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি রচনা করে। উডের ডেসপ্যাচ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার একটি কাঠামোগত ধারার রূপরেখা পাওয়া যায়, যাকে এক ধরনের ‘ল্যাডার সিস্টেম’ বলা যায়।

প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন

১৮৮২ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় উডের ডেসপাচ পরবর্তি শিক্ষার গতিধারা ও প্রকৃতি বোঝার জন্য। প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বা সভাপতি ছিলেন উইলিয়াম উইলসন হান্টার। উইলিয়াম হান্টারের নাম অনুসারে ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশনের নামকরণ করা হয় হান্টার কমিশন (Hunter Commission) । এক বছর না যেতেই ১৮৮৩ সালে ২২২ টি প্রস্তাবনা সম্বলিত ৬০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন এই কমিশন সরকারের নিকট পেশ করে।

হান্টার কমিশন প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রদানকে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে এই শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করে। পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল করে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার সুপারিশ করে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাকে ক্রমান্বয়ে বহুমুখী ধারায় নিয়ে উত্তীর্ণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যসূচি প্রবর্তনের সুপারিশ করে।

লর্ড কার্জনের শিক্ষা সম্মেলন ও শিক্ষা কর্মসুচি

১৯০১ সালে শিক্ষাক্ষেত্র সংস্কারের জন্য লর্ড কার্জন শিমলা (বর্তমান হিমাচল প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত) একটি শিক্ষা সম্মেলন করেন। কিন্তু এই শিক্ষা সম্মেলনে কোনো ভারতীয় শিক্ষাবিদকে আমন্ত্রন জানানো হয়নি। শিমলা সম্মেলনে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যম ১৬০ টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই ১৬০ টি প্রস্তাবের ভিত্তিতে লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংস্কার কর্মসুচি গৃহীত হয়।

লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি

১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন তাঁর শিক্ষানীতি সরকারি প্রস্তাবে পেশ করেন। এই শিক্ষানীতিতে সনাতনী প্রাথমিক শিক্ষার পরিবর্তে সেখানে কৃষিশিক্ষা ও শারীরিক শিক্ষার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। এ শিক্ষানীতিতে উঠে আসে, বিগত ২০ বছরে শিক্ষার যথেষ্ট উন্নতি হলেও তার বিস্তার আশানুরূপ হয়নি।

ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪

১৯০৪ সালে প্রণীত ভারতীয় বিশ্ববিদালয় আইন কার্যকর করা হয় ১৯০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪ এর রচিত হয় শিমলায় অনুষ্ঠিত ১৯০১ সালের শিক্ষা সম্মেলনের আলোচনা ও ১৯০২ সালের বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশ অনুসারে। লর্ড কার্জন কর্তৃক ‘ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সটি অ্যাক্ট, ১৯০৪’ জারি করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষাব্যবস্থা চালু এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

স্যাডলার রিপোর্ট

১৯১৯ সালে স্যাডলার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। স্যাডলার রিপোর্টের দাপ্তরিক নাম ছিল রিপোর্ট অব দ্য সিলেক্ট কমিটি অন ফ্যাক্টরি চিলড্রেন’স লেবার (Report of the Select Committee on Factory Children’s Labour) । এই রিপোর্টটি লিখেন মাইকেল স্যাডলার। স্যাডলার রিপোর্টে প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক ও কলেজ পযায়ের শিক্ষা পরিচালনার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে সেকেন্ডারি ও ইন্টারমিডিয়েট বোর্ড (Secondary and Intermediate Board) গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিকে ডিগ্রি কলেজ থেকে পৃথক করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে ম্যাট্রিকুলেশনের বদলে ইন্টারমিডিয়েট (বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াকে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো স্যাডলার কমিশনের বাস্তবে রূপ নেয়া অন্যতম প্রধান একটি সুপারিশ।  

সার্জেন্ট স্কিম

ভারত সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা স্যার জন সার্জেন্টকে চেয়ারম্যান করে গঠিত সার্জেন্ট কমিটি গঠিত হয় ১৯৪৩ সালে। ১৯৪৪ সালে এই কমিটি ভারতের শিক্ষার পুনরায় গঠন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। এই প্রতিবেদনের ন্দাপ্তরিক নাম ‘রিপোর্ট অব দ্য সার্জেন্ট কমিশন অন-পোস্ট ওয়ার এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’।

সার্জেন্ট স্কিমে ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এবং ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী সকল শিশুর জন্য সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়। ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী নির্বাচিত কিছু ছেলে-মেয়ের জন্য ৬ বছর মেয়াদি উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা এবং এ শিক্ষায় উত্তীর্ণ কিছু শিক্ষার্থীদের জন্য ৩ বছর মেয়াদি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সুপারিশও এ রিপোর্টে ছিল। কারিগরি শিক্ষায় জোর দেবার পাশাপাশি দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থার সুপারিশও এ কমিটি করেছিল।

স্যাডলার স্কিমে আরও বলা হয়, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১০% থেকে ১৫% শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ থাকা উচিত।

পাকিস্তান আমলে শিক্ষা

পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন শেষে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি ভিন্ন দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তান গঠিত হয় মুসলিম অধ্যুষিত ভারতীয় উপমহাদেশের দুইটি অংশ নিয়ে যা পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিমপাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। ঔপনিবেশিক শিক্ষা থেকে বেরিয়ে একদমই নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খানকে প্রধান করে ‘পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি’ গঠিত হয়। কমিটি প্রণীত সুপারিশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বলা হয়। সার্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা পরবর্তী ১৫ বছর বা সম্ভব হলে তার পূর্বেই প্রবর্তনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ধরা হয় ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট। পাশাপাশি পেশাগত প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রচলিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনের মধ্যকার ভারসাম্যহীনতা দূর করার গুরুত্ব সুপারিশে তুলে ধরা হয়। এমন কি মাধ্যমিক স্তরে মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার সুপারিশ করা হয়।

এছাড়াও কমিটি সুপারিশ করে যে, ইসলামিক শিক্ষার জন্য একটি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। কমিটির সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাচেলর অব আর্টস ইন এডুকেশন এবং পরবর্তী বছরে মাস্টার অব আর্টস ইন এডুকেশন প্রোগ্রাম প্রবর্তনের কথা বলা হয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের শিক্ষার উন্নয়নে কমিটি গঠন করলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কোন বাস্তব উন্নয়ন গ্রহণ করেনি।

আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৭

১৯৫৭ সালে গঠিত আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তাঁদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল। আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে সমগ্র পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। এ কমিশন পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা এবং ছয় বছরের মাধ্যমিক শিক্ষা চালুর প্রস্তাব দেয়। সেখানে তিন বছর মেয়াদের জুনিয়র হাইস্কুল (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি) এবং তিন বছর মেয়াদের সিনিয়র হাইস্কুল (নবম থেকে একাদশ শ্রেণি) কিংবা পূর্ণ ছয় বছর মেয়াদের হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছিল, যা বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামোর সাথে অনেকাংশেই মিলে যায়; যদিও এখন মাধ্যমিক শিক্ষা সাত বছর মেয়াদি।

জাতীয় শিক্ষা বিষয়ক কমিশন বা শরীফ কমিশন, ১৯৫৮

পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষাসচিব এস. এম. শরীফকে সভাপতি এবং আরও দশ জন শিক্ষাবিদকে সদস্য করে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় শিক্ষা বিষয়ক কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সভাপতি বা চেয়ারম্যানের নাম অনুসারে শরীফ কমিশন নামেও পরিচিত। শরীফ কমিশন পাকিস্তানি মতবাদ ও জাতীয়তাবাদ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নকে সামনে রেখে বেশ চমৎকার কিছু সুপারিশ রেখেছিল। কিন্তু সেখানে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির সঠিক প্রতিফলন ছিলনা। তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতা ও অবহেলায় সুপারিশসমূহের বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে।

বর্তমান বাংলাদেশ আমলে শিক্ষা (১৯৭১-বর্তমান)

কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন, ১৯৭২

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই (১১ শ্রাবণ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ) বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। দাপ্তরিকভাবে কমিশনটির নাম ছিল ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন’। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশন উদ্বোধন করেন। কুদরত-এ-খুদা কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে ৩০ মে, ১৯৭৪ তারিখ। উল্লেখ্য, এই কমিশনের অন্তর্বর্তিকালীন রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছিল ৮ জুন, ১৯৭৩ তারিখ।

কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টেই প্রাথমিক শিক্ষাকে আট বছর মেয়াদি করার সুপারিশ করা হয়। এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করার সুপারিশও করা হয়।

১৯৭২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৩ সালে একসাথে ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। সদ্যস্বাধীন একটি দেশে এ রকমের একটি পদক্ষেপ অনেক কঠিন হলেও সার্বজনীন গুরুত্ব অনুধাবন করে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এ সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে সব সময়ই একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন নবম ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার কথা বলে এবং একে সাধারণ ও বৃত্তিমূলক, এই দুই ধরনের শিক্ষার কথা বলে। মাদরাসা শিক্ষা, টোল শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়েও এ রিপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি

কুদরত-এ-খুদা রিপোর্টের সুপারিশগুলো বাস্তাবায়নের জন্য ১৯৭৫ সালে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটি প্রণীত রিপোর্টের আলোকে বিভিন্ন স্তরের জন্য শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয় এবং পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়।

শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি, ১৯৭৮

কুদরত-এ-খুদা কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করার পর তৎকালীন সরকার এই রিপোর্ট ও তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থাকে রিভিউ করার প্রয়োজন অনুভব করে। সরকার তাই একটি শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ। এই কমিটি সে সময়ের উপযোগী করে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। এ শিক্ষানীতি কুদরত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্ট নির্ভরই হয়েছিল।

মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৩

১৯৭৪ এর শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এবং ১৯৭৮ সালের নতুন শিক্ষানীতির সুপারিশের কিছু অংশ বাস্তবায়ন হতে না হতেই সরকার আবারও শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন অনুভব করল। এই কমিটির প্রধান ছিলেন মজিদ খান। অল্প সময়ের মধ্যে এ কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলো কিন্তু এর কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি।

বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ১৯৮৮

মফিজউদ্দীন আহমদকে সভাপতি করে বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় মজিদ খান কমিশনের ৫ বছরের মাথায়। মজিদ খান কমিশনের কোনো সুপারিশই বাস্তবায়ন না করে এ কমিটি গঠন করা হয়। সুতরাং মফিজউদ্দীন আহমেদের কমিশন যে পর্যালোচনা করে তা মূলত দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট এবং তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশ। এ কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে ১৯৮৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। এটি মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ১৯৮৮ নামে পচিত।

সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিটি, ১৯৯৭

১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম. শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ৫৬ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এ কমিশনকে একটি বাস্তবধর্মী, গণমুখী ও গতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তারা সেটা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। শামসুল হক কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয়াতাবাদি চেতনার কথা উঠে আসে। কমিশনের রিপোর্টে তিন স্তর বিশিষ্ট শিক্ষার সুপারিশ করা হয়ছে, যথা- প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চশিক্ষা। এই কমিশনেও আট বছর মেয়াদের প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়েছিল।

শিক্ষানীতি, ২০০১ (বাতিল)

এই শিক্ষানীতিটি প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ সরকার কিন্তু পরের নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল (বিএনপি) ক্ষমতায় এলে এটি বাতিল করে নতুন শিক্ষা কমিশন গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এম. এ. বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০২

২০০১ সালের শিক্ষানীতি সরকার বাতিল করার পরে আরেকটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। শিক্ষাখাতে গঠন পদ্ধতিসহ নানা ত্রুটি চিহ্নিত করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ২০০২ সালে এ কমিটি গঠন করা হয়। ড. এম. এ. বারী ছিলেন এ বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান। তবে এ কমিটির সুপারিশও আলোর মুখ দেখেনি।

মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশন, ২০০৩

শিক্ষার গুণগতমান অব্যাহতভাবে বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে আবারো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনটি গঠন করা হয় ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে। এই কমিশন ২০০৪ সালের মার্চে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিতে সক্ষম হয়। এই কমিশন শিক্ষার সকল সাব-সেক্টরকে তিনটি ভাগে ভাগ করে মোট ৮৮০ টি সুপারিশ করেছিল। এই কমিশনের রিপোর্টের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সকল জনগণকে মানবসম্পদে রুপান্তর করা। এই রিপোর্টে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১ : ৩০ এবং ১ : ৪০ । একমুখী মাধ্যমিক শিক্ষার সুপারিশ ছিল এ রিপোর্টের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ (কবীর চৌধুরী)

২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যের একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭, ১৮ এবং ৪৮ নম্বর অনুচ্ছেদসমূহ এবং জাতিসংঘ শিশু অধিকার সম্মেলনে যে সকল বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ প্রণয়ন করে।

জাতীয় শিক্ষানীতি – ২০১০ এ শিক্কার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ৩০ টি। প্রথম যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা বলা হয় তা হলো- শিক্ষার সর্বস্তরে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের সচেতন করা। এর পরে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ থেকে সামাজিক, মানবিক, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। এ শিক্ষানীতিতে মুখস্তবিদ্যার পরিবর্তে সৃজনশীলতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যাতে করে শিক্ষার্থী একজন মানসম্পন্ন প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয় শিক্ষানীতি – ২০১০-এ। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা অর্জনকৌশল সম্পর্কে বলা হয়েছে এখানে। চিকিৎসা, সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার ক্ষেত্রকে গুরত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে যেহেতু একটি দেশ অথবা জাতিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রথম শর্তই হলো সুস্থতা।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের পদমর্যাদা, শিক্ষা প্রশাসন এবং শিক্ষা স্তর সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নকশা রয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। এই শিক্ষানীতিতে জাতির আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে বলে বিভিন্ন মহল মনে করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই শিক্ষানীতির বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। যা কিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি সে সবের মধ্যে অন্যতম হলো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ৩০ এ উন্নীত করা।

জাতীয় শিক্ষানীতি – ২০১০ এর প্রধান ১৫ টি বৈশিষ্ট্য

১. সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন

২. বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্য

৩. শিক্ষার্থীদের বিকশিত চিন্তাশক্তির আলোকে অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী এবং সৃজনশীল করে বিজ্ঞানভিত্তিক মানসম্পন্ন প্রান্তিক যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে সহায়ক

৪. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় গুরুত্বারোপ

৫. ডিজিটাল প্রযুক্তিতে গুরুত্বারোপ

৬. আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষাদান

৭. শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ৩০

৮. ধর্ম ও নৈতিকতার ওপর সঠিক শিক্ষা প্রদান

৯. গুণগত প্রকৌশল শিক্ষায় জোর প্রদান

১০. মানসম্পন্ন চিকিৎসা, সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মি তৈরি

১১. শিক্ষকের মর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা

১২. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও কৌশল সম্পর্কে আলোকপাত

১৩. শিক্ষাপ্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থাপনার নকশা

১৪. জীবনঘনিষ্ঠ ও অত্যাবশ্যকীয় শিখনক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসুচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের নির্দেশনা

১৫. বাংলাদেশে প্রচলিত সকল ভাষা ও সংস্কৃতি সহায়ক শিক্ষানীত

[দ্রষ্টব্য: জাতীয় শিক্ষানীতি – ২০১০ এর প্রেক্ষাপট, ভিত্তি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসহ শিক্ষানীতির সব কিছু বিবেচনায় অসংখ্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা সম্ভব। এখানে এই নিবন্ধের প্রয়োজনে মাত্র ১৫ টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে।]

বাংলাদেশে শিক্ষা স্তর

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ৩ টি স্তর রয়েছে।

  1. প্রাথমিক
  2. মাধ্যমিক
  3. উচ্চশিক্ষা
প্রাথমিক শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষার সমকাল পাঁচ বছর। যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির প্রতি শ্রেণিতে একজন শিশুকে এক বছর করে পড়াশোনা করতে হয়। শিশুর বয়স যখন ৬+ বছর তখন সে প্রাথমিক স্তরের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির উপযুক্ত হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি – ২০১০ অনুসারে বর্তমানে প্রাথমিকে ভর্তির পূর্বে এক বছর প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি হতে হয়। প্রাক-প্রাথমিকের একজন শিশুর বয়স ৫+ বছর, পরবর্তীতে যা ৪+ বছর করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাংলাদেশে মৌলিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃত। এই স্তরটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপরের অধীন।

মাধ্যমিক

প্রাথমিক শিক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করার পরে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হতে পারে। এই স্তরটি আবার তিনটি ভাগে বিভক্ত। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্নমাধ্যমিক (Junior Secondary), নবম থেকে দশম পর্যন্ত মাধ্যমিক (Secondary) এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি (Higher Secondary) । শিক্ষানীতিতে যদিও ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষারর আওতাভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। মাধ্যমিক স্তর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন, তবে যাবতীয় বিষয় দেখাশোনার জন্য ৮ টি শিক্ষাবোর্ড (Bangladesh Education Board) নিয়োজিত।

উচ্চশিক্ষা

সফলভাবে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যোগ্যতা অর্জনে করে, স্যাডলার রিপোর্টের মতোই। এই পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ ও ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে পারে। তবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিতে এক ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সাধারণ, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, চিকিৎসাসহ ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সকল ধরনের সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে মোট ৪৯ টি। বেসরকারি (প্রাইভেট) বিশ্ববিদ্যালয় ১০৭ টি টি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩ টি। এছাড়া সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ৩৪ টি এবং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ৫৮ টি।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা পরিচালনার উদ্দেশ্যে নিয়োজত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (Bangladesh University Grants Commission), এটি সংক্ষেপে ইউজিসি বা UGC নামে পরিচিত।